নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভোগবাদের অন্ধকার গর্ত: স্ট্যাটাসের খেলায় নীতিবোধের পতন

১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৪৫



একসময় যা খুব প্রচলিত ও খ্যাত ছিলো তা সময়ের হাত ধরে বিবর্তিত হয় নতুবা বাতিল হয়ে যায়। আশির-নব্বই দশকে যা কিছুই অত্যন্ত মূল্যবান বা ‘স্ট্যাটাস ড্রিভেন (Status Driven)’ ছিলো তা এসময়ে এসে আর খুব বেশি পাত্তা পায় না। আবার অনেকক্ষেত্রে অনেককিছু বাতিলও হয়ে গেছে। ফেলে আসা সমস্ত গল্পই আমাদের কাছে কোন না কোন ভাবে ফিরে আসে।

ঐ সংস্কৃতির মানুষ আমাদের কাছে উপস্থিত থাকায় আমরা কিছুটা সেসব বিষয়ে অনুধাবন করতে পারি। হুবহু না হলেও প্রায় ৯০℅ শতাংশ বিষয় আমরা সঠিক বিবেচনায় ভেবে চিন্তা করতে পারি। কারণ মানুষের কাছে যা কিছুই অতীত হয় তার মূল্য উক্ত ব্যক্তির কাছে তার বয়সের সাথে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। তাই আবেগময় অতিরিক্ত ১০% শতাংশ বাদ দেওয়া যেতে পারে।

দাদুর সময়ে হাতে একটি ‘ক্যাসিও (Casio)’ ঘড়ি থাকা তার জন্য সমাজের কাছে ব্যক্তিত্বের উঁচুমানের বহিঃপ্রকাশ ছিলো। শুধু তাই নয়, ঐ সময়ে আপনি যদি মেট্রিক পাশ করতে না পারেন তাহলে আপনি হাতঘড়ি পড়ার যোগ্য নন বিবেচনায় নেওয়া হত। ঘড়ির ক্ষেত্রে ‘ক্যাসিও (Casio)’ এবং সাইকেলের ক্ষেত্রে ‘চায়না ফনিক্স (China Phoenix)’ সাইকেল ছিলো সবচেয়ে বেশি স্ট্যাটাস ড্রিভেন বস্তু।

এমনকি বাঙালী সমাজে যদি কেউ শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুকে কেউ এসব তখন পেত তাহলে তারা দারুণ আনন্দিত হত। সমাজের মানুষ পর্যন্ত মনে মনে ভাবতো, “ছেলেটার মনে হয় খুব ধনী ঘরে বিয়ে হয়েছে। সবাই কি আর এসব দামী দামী উপহার দিতে পারে?”

এরপর যৌতুক প্রথায় নকিয়া (Nokia) কোম্পানির মুঠোফোন যুক্ত হয়। আবার যাদের টাকা ছিলো তারা ব্যক্তিগতভাবে গ্রাম পর্যায়ে কল-সেন্টার খুলে বসতেন। আমার নিজের দাদু ওরকম একটা ক্রয় করেছিলেন। আবার আমার আরেক দাদু ক্রয় করে গ্রাম পর্যায়ে একটি কল-সেন্টার দেন।

খুব সম্ভবত এই মডেলের নাম ছিলো ‘Nokia 3310’। স্পষ্ট ধারণা পেতে আপনি ‘Laapataa Ladies (2023)’ সিনেমায় ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি দেখতে পারেন। হুবহু মডেলের একটি ফোন আজও অমর হয়ে আমার বাড়িতে বাক্সবন্দি আছে। এছাড়া ইংরেজিতে কথা বলা, রেডিওতে বিবিসি বাংলার খবর শোনা সে সময়ের সর্বোচ্চ স্ট্যাটাস ড্রিভেন বিষয় বা বস্তু হিসেবে মানা হত।

‘নকিয়া (Nokia)’ নাম এমন এক ধরণের নস্টালজিয়া যেন গোটা তিন প্রজন্মের সাক্ষী। আমি খুব ছোট থেকে, যতদূর মনে পড়ে পঞ্চম শ্রেনী থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতাম। আর এই ফোন দিয়ে দাদুর অনেক টাকা বিনাশ করেছি। কারণ তখন ‘হ্যালো?’ বলাটাও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে মানা হত। সেটাও কোন অংশে কম স্ট্যাটাস ড্রিভেন ছিলো না।

আমার দাদু অনেক কড়া মানুষ কিন্তু সেসময় আমার ভুলগুলো দেখেও না দেখা করতেন। একদিন তো দাদু আমার উপর রাগ প্রকাশ করতে না পেরে উন্মাদের মত ফোনটা আছড়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। পরে অবশ্য অনেক ফোন উপহার দিয়েছেন। যে ফোন দিয়ে এই মুহুর্তে লিখছি এটাও কিন্তু আমার দাদুর দেয়া। খুব সম্ভবত এজন্যই এটা নষ্ট হচ্ছে না।

বাবার সময় যৌতুক প্রথায় যুক্ত হতে দেখি সাদাকালো টেলিভিশন থেকে রঙীন টেলিভিশন এবং হোন্ডা (Honda) কোম্পানির মোটরসাইকেল যুক্ত হয়। কিন্তু টেলিভিশন হলেই চলবে না; ঐ টেলিভিশনের ব্রান্ড অবশ্যই ‘ন্যাশনাল (National)’ হতে হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার বাবা যৌতুক হিসেবে রঙীন টেলিভিশন নিতে পারেন নি। আমার দাদুর এতে শক্ত আপত্তি ছিলো। ‘টেলিভিশন’ সিনেমা দ্যাখেন নি? মুসলিম সমাজে সেসময় টেলিভিশন দেখা নর্মালাইজ ছিলো না; সত্য ঘটনা।

কিন্তু যাদের টাকা আছে তাদের কাছে সাদাকালো টিভি অন্তত থাকতো। আর যে বাড়িতে রঙীন টেলিভিশন থাকতো সে বাড়ি সাধারণত ধনী পরিবার হিসেবেই দেখা যেত। কেউ কেউ রেডিও নিয়ে গান শুনতো। আমি নিজেও মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শোনতাম না। ছোটবেলা থেকে ‘ঢাকা – ক ও খ’ আমার ‘Panasonic’ রেডিওতে ধরানো থাকতো। আমি ঘুমিয়ে গেলে হক ব্যাটারি আমার মা লুকিয়ে রাখতেন। ঘুম থেকে উঠে আমার প্রথম জিজ্ঞাসা থাকতো, “আমার ব্যাটারি কই?” আর ‘হোন্ডা’ কোম্পানির নাম এত বেশি প্রচলিত হয়েছিলো যে এখন পর্যন্ত মোটরসাইকেল কে আমরা ‘হোন্ডা’ বলে থাকি।

চায়ের দোকানে সবাই বসতেন না। কালো কোট পরা সবার জন্য অনুমোদিত ছিলো না। একজন মুরুব্বি বা একজন শিক্ষক বা মহল্লার মেম্বার ও নেতাগণ কে একসাথে চায়ের দোকানে সকাল ৮টা-১০টার দিকে দেখতে পাওয়া যেত। বিকেলেও তাঁরাই বসতেন।

আজ আমি যে চায়ের দোকানে বসে আছি বা থাকি তা সবার জন্য অনুমোদিত হলেও তখন কিন্তু অলিখিত এক ধরণের নূন্যতম যোগ্যতা লাগতো। আর আপনি স্নাতক শেষ না করে গায়ে কালো কোট তুলেছেন! সর্বনাশ, আপনার নামে পুরো গ্রামে ছিঃ ছিঃ চলবে। খুব সম্ভবত এটা তখন একধরনের বেয়াদবির পর্যায়ে বিবেচনায় নেওয়া হত। কেউ কেউ নিজের ভুল স্বীকারও করেছেন।

ছোটবেলায় দুটো শব্দ একটু বেশি শুনতাম, ১. স্টেট্যাস ও ২. প্রেস্টিজ

পান থেকে চুন খসলেই স্টেস্ট্যাস আর প্রেস্টিজের মা-বোন ক্যামনে যে হয়ে যেত তা কোনভাবেই বুঝতাম না। তবে যেটুকু বুঝতাম তা হলো, আমরা একটি ‘স্ট্যাটাস ড্রিভেন সোসাইটি (Status Driven Society)’ তে বাস করছি। প্রথম থেকে শুরু করুন, ক্যাসিও, চাইনা ফনিক্স, নকিয়া, সাদাকালো বা রঙীন টেলিভিশন (নাশন্যাল কোম্পানির), হোন্ডা, হক ব্যাটারি, কালো কোট, চা খাওয়া, ইংরেজিতে কথা বলা – এই সমস্তই শুধুমাত্র ভোগবাদ নয়, শুধুমাত্র ভোগবাদ দিয়ে এসব ব্যাখ্যা করা যায় না। এই সমস্ত কিছু স্পষ্ট নির্দেশ করে যে, আমরা একটি সত্যিকারের ‘স্ট্যাটাস ড্রিভেন সোসাইটি (Status Driven Society)’ তে বাস করছিলাম।

আচ্ছা, আমরা কি শুধুমাত্র তখন একটি ‘স্ট্যাটাস ড্রিভেন সোসাইটি (Status Driven Society)’ তে বাস করছিলাম? নাকি আজও আমরা আরো শক্তিশালী একটি ‘স্ট্যাটাস ড্রিভেন সোসাইটি (Status Driven Society)’ তে বাস করছি? বর্তমান ভোগবাদে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু স্টেট্যাস ও প্রেস্টিজেও আমরা আজ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছি।

হিন্দি একটি গানের প্রথম লাইন মনে পড়ে গেল, “Jo Dikhta Hai, Wohi Bikta Hai...।” ভাবুন, এখন কেউ নকিয়া ফোন নিয়ে খুব ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চায়না ফনিক্স সাইকেলে প্যাডেলে প্যাডেলে সুখ পাচ্ছে, রাতে বাড়িতে ফিরে রঙীন টিভিতে সিনবাদ বা আলিফ-লায়লা দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, মুঠোফোনে কাকে একবার ‘হ্যালো!’ বলবে সেজন্য ছটফট করছে… না এরকম তো হচ্ছে না।

সত্যি বলতে, এই সমস্তই হচ্ছে। এবং বাড়াবাড়ি পর্যায়ে হচ্ছে। যা ছিলো না, তাও হচ্ছে। নকিয়া (Nokia) মুঠোফোন এখন অ্যাপল (Apple) বা আইফোন হয়ে গেছে, রেডিও এখন ‘স্পটিফাই (Spotify)’ হয়ে গেছে, চায়না ফনিক্স (China Phoenix) সাইকেল এখন ‘Yamaha YZF-R15’ হয়ে গেছে। ন্যাশনাল টিভির বদলে ৫০ ইঞ্চির LED অ্যাড্রয়েড হয়ে গেছে যেখানে নেটফ্লিক্স ও আমাজন প্রাইজ স্ট্রিমিং চলছে। চা অবশ্য এখনো চা-ই রয়েছে, কিন্তু দাম অনেক বেড়ে গেছে। মানে শহরের বড় বড় দোকানে চায়ের কোয়ালিটির দিকে ধ্যান না দিয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে বেশি ভাবছে। বেশিরভাগ দোকানে তো চা-ই পাওয়া যায় না কিন্তু ব্ল্যাক কফি বা ‘এসপ্রেসো (Espresso)’ এর মত হাজার ধরণের কফি এসে গেছে।

আজ সারাদিন যদি আমি এই তালিকা লিখে যাই তাহলেও এই তালিকা হয়তো আমি শেষ করতে পারবো না। কিন্তু যা একান্তভাবেই অন্যের জন্য করছি, পরছি, কিনছি বা খাচ্ছি তা তো আমি নই। আর ক’টা যুগ গেলে আমরা আমাদের মত করে চলতে পারবো? বাঁচতে পারবো?

সর্বোপরি এই ভয়ানক ‘স্ট্যাটাস ড্রিভেন সোসাইটি (Status Driven Society)’ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো? এটাকে যদি স্থিতাবস্থা হিসেবে নেওয়া হয় তাহলে সারাক্ষণ চারপাশে ‘আমেরিকান ড্রিমস’ এর মত ‘বাংলাদেশী ড্রিমস’ নামক নতুন কিছুর উদ্ভাবন ঘটবে। যেখানে প্রত্যাশা মিট করতে না পারা আত্মহত্যার সমান মনে করা হয়।

সেদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম আমার বেশ কিছু সাইটে প্যারাসাইট (পরজীবী) আছে। তাই পুরো সাইট আমাকে পুনরায় ফিক্স করতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জীবনের সাথে, আমাদের সংস্কৃতির সাথে যে প্যারাসাইট (পরজীবী) আজও অবস্থান করছে এবং আস্তেধীরে আমাদেরকে শেষ করে দিচ্ছে তা নিয়ে কি আমরা কোনদিন অনতত একবার ভাববো না? চিন্তা করবো না?

বাদ না-হয় ভেবেচিন্তেই দিলেন।

ছবি: Bing Enterprise (Copilot Ai)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.