নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

i blog/therefore i exist

অচিন্ত্য

"জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ"

অচিন্ত্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবীর সুমনকে নিয়ে কিছু অগোছালো ভাবনা

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:২৮



কবীর সুমন!!!
দূর থেকে একলব্যের মত যাঁকে দ্রোণাচার্য ভাবি।

কবীর সুমনকে নিয়ে লিখতে বসেছি। কাজটা যে কতটা কঠিন আগে এমন সম্যকভাবে বুঝতে পারিনি। লিখতে বসে পুরোপুরি অগোছালো আর অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। ঠিক কীভাবে লিখলে যে মনের আসল কথাটা ফুটে উঠবে তা ভেবেই পাচ্ছি না। পাওয়ার কথাও না। তাঁকে নিয়ে অনুভবটা এত বহু বিচিত্র যে তার থৈ পাই না। এ আমার দোষ নয়, তাঁরই কীর্তি। তাঁর উপযোগী বিশেষণ হাতড়ে নিষ্ফল হয়েছি। তাঁকে বর্ণনা, এমনকি তাঁকে নিয়ে আমার ভাবনা প্রকাশেও আমি সম্পূর্ণ অপারগ। এর পরও চেষ্টা করতে ছাড়ব না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসকে একবার এক পত্রে লিখেছিলেন, "একই সূর্যের আলো নানা মেঘের উপর পড়িয়াছে কিন্তু মেঘ খণ্ডগুলির অবস্থা ও অবস্থান অনুসারে তাতে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ফলিয়া উঠিয়াছে। ...কবি ভাবের আলোককে কেবল প্রকাশ করেন তাহা নহে, তিনি যে দেশের মানুষ সেই দেশের হৃদয়ের রঙ দিয়া তাহাকে একটু বিশেষ ভাবে সুন্দর করিয়া প্রকাশ করেন।” একথা বললাম এজন্য যে, সুমনের মধ্যে ধ্রুপদী বাংলা, "বহিরাগত" সাঙ্গীতিক উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এমন সাবলীল রঙ্গে মেতেছে যে তাতে বঙ্গভূমির গানের অনুষঙ্গ সত্যিই এক অফুরান সম্ভাবনার দিগন্ত স্পর্শ করেছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

৯২ এ 'তোমাকে চাই' দিয়ে গানের প্রকাশনা শুরু। শুরুতেই স্বরূপে সুমন। এটি খুবই বিরল দৃষ্টান্ত। আমার প্রাণের কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়েও আমার ধারণা, 'ঝরা পালক' এ জীবনানন্দ তাঁর স্বরূপটি আবিষ্কার করতে পারেন নি। এই আবিষ্কারটি ঘটেছে 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' তে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু সুমন যখন গেয়ে উঠলেন "চালচুলো নেই তার/ নেই তার চেনা বা অচেনা/ আদমশুমারি হলে তার মুখ কেউ গুণবেনা/... সরকারে দরকারে নেই তাই নিজের সুড়ঙ্গে/ পাগল/ সাপ লুডু খেলছে বিধাতার সঙ্গে" কিংবা "শোয়া বসা ঘুম এক জায়গায়/ ছেলেমেয়ে দেখে আধো তন্দ্রায়/ বয়স্ক দুই দেহ মিলে যায় আঁধার ঘনালে ঘুটঘুট/ দরজায় আছে নম্বর লেখা/ তাই দেখে দেখে ঠিকানাটা শেখা/ যদিও বাসার আসল ঠিকানা/ দশ ফুট বাই দশ ফুট" তখন এই উচ্চারণ, এই প্রকাশভঙ্গী, এই বাদন, গানের শব্দশরীরের এই অভিনব রূপ জানান দেয়- এক নবযুগ আসন্ন।

শুধু বাণী, সুর বা বাদনের জন্য নয়। শব্দ সুরের এই যৌথ প্রয়াসে কত সুগভীর রহস্যের আভাষ যে মেলে তা ভেবে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। সর্বপ্রথমে যে বিষয়টি চোখে পড়ে, কানে লাগে তা হল গানের কাঠামোর সচেতন নিরীক্ষা। নিরীক্ষা বললেও হয় না। এক নতুন অবয়ব। চর্যাগীতিকা, বৈষ্ণব পদাবলী, গীতগোবিন্দ এর যুগ পার হয়ে বাংলা গান যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত স্পর্শ করল, মূলত সেই পয়েন্টে এসে তার একটি ওয়াইডলি এক্সেপ্টেড কমন ফরম্যাট দাঁড় হল- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ। তার কিছু পরে চলচ্চিত্র প্রভাবিত একটি ধারা 'আধুনিক বাংলা গান' এর অন্যতম প্রধান স্মারক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর পর দুএকটি ভিন্নধর্মী প্রয়াস ছাড়া দীর্ঘ সময় বাংলা গান একটি স্থিতিজড়তায় ভুগছিল। 'দশ ফুট বাই দশ ফুট' এর অভিনব কাঠামো সেই ফরম্যাট কে অস্বীকার করল।

শুধু ফরম্যাট নয়। গায়কীর নবতর এক শৈলীর প্রয়োগ দেখা গেল। গায়ক ঠিক কখন তালকে সমীহ করছেন আর কখন করছেন না তা যেন এক শিল্পীত হেঁয়ালিতে পরিণত হল। এই জায়গায় প্রথমত চোখে পড়ে কানে লাগে কান্ট্রি মিউজিকের ঢং। কিন্তু এর সঙ্গে আরো এক রহস্য জড়িয়ে আছে। এটি খুব সহজে ধরা দিতে চায় না যেন।

সুমন নিজেকে বলেছেন "আমি নাগরিক কবিয়াল/ করি গানের ধর্ম পালন/ সকলে ভাবছে লিখছে সুমন/ আসলে লিখছে লালন"। পয়েন্ট!!! কবিয়াল!!! হ্যাঁ কবিয়াল। কিংবা পালাগানের গায়ক কিংবা যাত্রার কথক। এই সব চরিত্রই কিন্তু মূলত তার গল্পটা বলতে চায়। গান বা সুর নিছকই তার বাহন। সুমন যখন গেয়ে ওঠেন "দূরে যাবে বাসটা ইঞ্জিনে গতির বড়াই/ লোকটাও দমবেনা থামবেনা বাঁচার লড়াই" তিনি আসলে গল্পটাই বলতে চান। গানটা তাঁর ছল।

শুধু কি তাই। ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলে দরবারি আনুকূল্যে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিকের যে সাধনা হয়েছে তার রেশ পশ্চিম বাংলার সঙ্গীতকে ভীষণ ভাবে স্পর্শ করলেও পূর্ববঙ্গে তা হয়নি। দক্ষিণের ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে সুরকেই সঙ্গীত মনে করা হয়। খেয়াল করলে দেখা যায়, ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যালের একমাত্র ঠুমরী বাদে খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামার, যৎ, তারানা, আলাপ, বিস্তার, তান ইত্যাদি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাণীর কোন গুরুত্ব নেই। সব ক্ষেত্রে বাণী থাকেও না। এখানে সুরই যে সঙ্গীত এর আরেকটি চাক্ষুষ নিদর্শন হল এই ঘরানায় যন্ত্র সঙ্গীত ডেভেলপ করেছে, যেখানে স্বভাবতই বাণী অনুপস্থিত। কিন্তু একেও কিন্তু সঙ্গীত (যন্ত্র সঙ্গীত) বলা হয়। কিন্তু এই অঞ্চলে হয়েছে বাণীর সাধনা। তাই আমাদের সঙ্গীত গুরু লালন, হাসন যাঁরা আসলে শব্দ সুরের ছলে বাণীটাই বলতে চেয়েছেন। সুমনের অর্ধেক পূর্বসূরি পূর্ববঙ্গের। এবং সুমন নিজেকে বাংলাদেশের সঙ্গেই একাত্ম বলে বোধ করেন। তাঁর এই বোধ তাঁর সৃষ্টিতে এত প্রকটভাবে উপস্থিত, তাও কোন এক রহস্যের আড়ালে তা যেন ধরা পড়তে চায় না।

সুমনকে আন্তর্জাতিক বাঙালী বললে মনে হয় বেমানান হবে না। তাঁর শৈলীতে সেকাল একাল এখান ওখান সব অদ্ভুতভাবে মিলে মিশে আছে। এরপরও এতকিছুর মিশেলের পরও তা এত স্বতন্ত্র! সুমন তাঁর সুগভীর জীবনবোধকে যেভাবে গানে অনুবাদ করতে পেরেছেন তা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করে।

আরেকটি দিক নিয়ে আলাপ করা যাক। মিউজিক্যাল এরেঞ্জমেন্ট বা যন্ত্রানুষঙ্গ, যাকে চলতি কথায় কম্পোজিশন বলা হয়ে থাকে। সুমনের গানে যন্ত্রানুষঙ্গের ওপর কোন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

আমি নিজেও এক সময় যন্ত্রানুষঙ্গের বিশেষ চেলা ছিলাম এবং সে কারণে সুমনের গানের এই দিকটিতে 'দৈন্য' আছে বলে মনে হত। তবে একটা সময়ে এসে আমি এই মর্মে কনভিন্সড হলাম যে, যে গান বাণী নির্ভর তার মিউজিক্যাল অর্নামেন্ট যত মিনিমাম রাখা যায় তা তত হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে।

আমার এক সময় মনে হত সুমন সম্ভবত মিউজিক্যাল এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েশনে অত দক্ষ নন। কিন্তু তার কিছু কাজ শুনে এই ধারণা পাল্টেছে। সুমনের সিগনেচার স্টাইলে যে মিনিমাল এপ্রোচ অর্থাৎ একটিমাত্র গিটার, তা আমাকে একটিমাত্র দোতরা হাতে গান করা একটি প্রাচীন দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে হয় বুঝিবা সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষ গিটার হাতে নতুন হয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি জাতিস্মর। তাই আগের জন্মের মোহ ত্যাগ করতে পারেন নি।

এসব বাস্তব এবং কাল্পনিক ছবি জুড়ে যে দৃশটির জন্ম হয় তাতে দেখি মিউজিক্যাল এনভায়রনমেন্ট এর বিষয়ে মিনিমাল এপ্রোচ সুমনের সচেতন প্রয়াস।

আরো আছে। বিষয় বৈচিত্র্য। সুমনের গানের বিষয়ের কোন ইয়ত্তা নেই। লোড শেডিং, বাসে ওঠা, অফিস যাওয়ার তাড়া, যুদ্ধ, হেলিকপ্টার, পাগল কী নেই। প্রচুর কবি সাহিত্যিক, প্রচুর সাধারণ অসাধারণ মানুষকে নিয়ে তিনি গান করেছেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যরকম মনে হয় কবি অরুণ মিত্রকে নিয়ে করা গানখানি। এই গানখানি একটি মুহূর্তের শব্দছবি। মুহূর্তটি হল- কবি অরুণ মিত্র নতুন একখানি কবিতা পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। এই একটি মুহূর্তকে শব্দে ধরার খায়েশ! কি অবিশ্বাস্য এম্বিশাস! এই উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তটি এক আশ্চর্য শব্দপটে চিত্রিত হয়ে কবিতায় ধারণ করা যায় এমন প্রায় সমস্তকিছু স্পর্শ করল। কি যে অদ্ভুত এই শৈলী। এই লিরিকখানি দিয়ে আপাতত বিদায় বলা যাক

পৃথিবী দেখছে আমাদের মুখে
বেলা অবেলার প্রতিচ্ছবি
নতুন একটা কবিতা পড়তে
উঠে দাঁড়ালেন প্রবীণ কবি।

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
পুরানো মাটিতে গাছের চারা
সে উত্থান দেখে নেয় শুধু
মহাজীবনের সঙ্গী যারা।

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
বন্দিনী এক বাঘিনী চিতা
চিড়িয়াখানায় অসহায়তবু
উঠে দাঁড়ানোয় অপরাজিতা।

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
সাধারণ লোক হঠাৎ রুখে
অনেককালের চাপা বিদ্রোহ
ফাটলো এবার ক্লান্ত বুকে।

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
প্রেমিক প্রেমিকা বুকের জোরে
দুঃখগুলোকে রেখে দেয় তারা
আদরে আদরে আড়াল করে

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
সন্তান হারা মায়ের বাঁচা
একদিন ভোরে খুলে দেন তিনি
জোড়া মুনিয়ার ছোট্টো খাঁচা।

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
চেনা কবিতায় অচেনা শব্দ
আবেগের কোনো অভিধান নেই
তাই বেরসিক পাঠক জব্দ।

উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
জমকালো মেঘে বকের ডানা
সহজ সরল কারণে আকাশ
মুলতবি রাখে বিজলি হানা।

অতর্কিতেই আকাশ আনলো
বিদ্যুৎময় আলোকচিত্র
নতুন একটা কবিতা পড়তে
উঠে দাঁড়ালেন অরুণ মিত্র।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: তার গান আমার ভালো লাগে।

১৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:২১

অচিন্ত্য বলেছেন: :)

২| ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:২২

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: বাঁশরিয়া বাজাও বাঁশি ...

১৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:২১

অচিন্ত্য বলেছেন: তাদেরই গাইয়ে আমি সাজানো জলসায়

৩| ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৩৪

তারেক_মাহমুদ বলেছেন:
কবির সুমন(সুমন চট্টোপাধ্যায়) এর গান ছেলে বেলায় ভাল লাগার নাম, প্রথমত আমি তোমাকে চাই দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই এই গান সব সময় আমাদের মুখে মুখে থাকতো। একদিন সুমনের জাতিস্মর ক্যাসেটটি কিনে ফেলালাম,দারুণ সব গান ছিল এই ক্যাসেট এ, যেমন : এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া, এসো করস্নান নবধরা জলে বলবে কি আর, বুকের ভিতর বৃষ্টি পড়ে সহ দারুন দারুণ গান।

সুমনের গলাটাকে আমার কাছে মিউজিক মনে হয় ।ও যদি খালি গলায় ও গান গায় আমার কাছে মনে হয় মিউজিক বাঝছে।

ধন্যবাদ সুমনকে নিয়ে লেখার জন্য

১৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:২২

অচিন্ত্য বলেছেন: ্ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য এবং এতদিন পর মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য দুঃখিত

৪| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ২:১১

সুমন কর বলেছেন: অ-সা-ধা-র-ণ লিখেছেন।

সুমনের অধিকাংশ গানের পিছনে একটি কাহিনী থাকে। তিনি প্রমাণ করেছেন, কথা দিয়েও গান হয়, সুর হয়। উনাকে নিয়ে মন্তব্য করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে শুনছি.......আজো

১৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:২২

অচিন্ত্য বলেছেন: :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.