নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধানের গোলায় যদি এসে পড়ে কামানের গোলা

৩১ শে অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০২

ধানের গোলায় যদি এসে পড়ে কামানের গোলা, তাহলে উপায় থাকে আর? এমন ক্ষণে কার কাছে যাবো আমি? কোন দিকে যাবো? কাকে আমি বাদ দেবো কাকে করবো পর? সবাইকে কি বন্ধু করা যায়? হায় এই বিবেচনায় আমি ধানও চাই, কামানও চাই। কিন্তু যদি ধানের গোলায় এসে পড়ে কামানের গোলা? তাহলে কি উপায়? আমার শৈশবে-কৈশোরে-যৌবনে-মৌবনে মানবীরা সব এই এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কার কাছে যাই আমি, কোনদিকে যাই? আর এখন গোলাপ ফুলে সাজানো এক ফুলদানির প্রেমে পড়েছি। কামানের গোলা আছে বুকে। তবে কি আগুনে পুড়বে গোলাপ ফুল সব?
৮ শ্রাবণ ১৪০৩, পশ্চিম চানপুর, পেয়ারাবাগিচা সড়ক, কুমিল্লা।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সবুজ গ্রামের দাবি করছি আমি। কেন আজ সবুজ হচ্ছে খুন? মানুষের এসব কেমন গুণ? দিগম্বর শহর আমার অপ্রিয়। হতে পারে শহর দারোগার বাসস্থান এবং গ্রাম কৃষকের। কিন্তু গ্রামের দিকদিগন্ত ফুসফুসকে ব্যভিচার থেকে বাঁচায়। কিন্তু এখন সবুজ হচ্ছে খুন। বোমারু বিমান রক্ত আর ব্যান্ডেজ ছাড়া কি দিতে পারে? মাস্তুল বৃক্ষ খেয়ে মানুষ শেষে কতোদূর যাবে? মার্চ ১৯৯২, ঢাকা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------পদ্মফুলের খোঁজে আমি ঘুরি বনে বনে
তবু দেখা হয়না আমার পদ্মফুলের সনে
আমি সে ফুল কাছে পেতে ছেড়েছি মোর ঘর
তবু সে আজ দূরেই আছে আমায় করে পর।
নভেম্বর ১৯৯১, ঢাকা।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আশার সূর্য প্রায়ই নিস্তেজ হয়ে যায়। তবু বুকের ঘামের সোনালি ফসল পরাজয়ের পঙ্কিল পর্দা আড়াল করতে চায়। বিধ্বস্ত করতে চায় নদী। পাকিস্তান-হিন্দুস্তান-গোরস্তান আর মার্কিনীরা স্বপ্ন সব কেড়ে নিতে চায়। তারপরও আমি প্রতিদিন আলোকচিত্রের নৌকা নির্মাণ করি। আমি এই নষ্ট গ্রহের মুখোশ ছিঁড়তে চাই। ভূত-পিশাচে বিশ্বাসী নই আমি। মানুষের মাঝেই কেবল পিশাচ দেখতে পাই। ক’জন লোক আছে, যারা প্রীতিভাজন? পাকিস্তান-হিন্দুস্তান-গোরস্তান আর মার্কিনীরা পর্বতশৃঙ্গে বাস করতে চায়। আর আমাকে পর্বতের গুহায় ফেলে খুন করতে চায়। কিন্তু আমার নেই ডর। কারণ গোটা বিশ্বই আমার ঘর। ভয়? তাকে আমি শৈশবেই জয় করেছি। বন্য হওয়ার জন্য আমি নিজেকে খুব ধন্য মনে করি। আশার সূর্য যদিও প্রায়ই নিস্তেজ হয়ে যায়, যদিও বুকের ঘামের সোনালি ফসল পরাজয়ের পঙ্কিল পর্দা আড়াল করতে চায়, তবু আমি বন্দনা করি মাকে। বন্দে মাতরম বলে মারতে পারি যাকে তাকে, যারা আমার দেশটাকে-বিশ্বটাকে খুন করতে চায়। আমি নই কোনো বেনে। প্রতিদিন আলোকচিত্রের নৌকা নির্মাণ করি সব বুঝে শুনে এবং জেনে। শ্রাবণ ১৪০৩, পশ্চিম চানপুর, পেয়ারাবাগিচা সড়ক, কুমিল্লা।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------জুঁই ফুলকে কেন এত ভালোবাসি আমি? কেন এমন অন্ধকার পথে পথে হাঁটা? কেন এমন শালপিয়ালের বন দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়? কেন আমি পিঞ্জর ভেঙ্গে পিপাসা মেটাই? কেন আমি মল্লিকা ফুল এত ভালোবাসি? কেন আমি ষোড়শী রূপবতী নারী দেখলে উন্মাদ হয়ে যাই? একি আমার আবেগ কিংবা প্রেম? নাকি সর্বোচ্চ কোনো অসুখ?
শ্রাবণ ১৪০৩, পশ্চিম চানপুর, পেয়ারাবাগিচা সড়ক, কুমিল্লা।

মন্তব্য ১১৯ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১১৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৪:৫৬

জসীম অসীম বলেছেন: স্বপ্ন আমার ছবি তোলা নিয়ে
=============
জসীম উদ্দিন অসীম:
আলোকচিত্র প্রতিবেদক: দৈনিক শিরোনাম।
===================
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক শিরোনাম:
26 সেপ্টেম্বর: 2001: বুধবার: কুমিল্লা।
====================
আমি ছবি তুলবো-কিংবা আমার ছবি তোলা হবে-এ উভয় বিষয়েই ছেলেবেলা থেকেই আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল। এ আগ্রহ পরে আরও তীব্রতর হয়।
1992 সালের একদিন ঢাকার মতিঝিলে-ভারতীয় দূতাবাস কেন্দ্র পাঠাগারে নীরোদ রায়ের ফটো সাংবাদিকতা' বইটি আমার হাতে পড়ে। সমস্ত বইটি পড়ে আমি নোট করি এবং তার কিছুদিন পর একটি ক্যামেরা সংগ্রহ করি। তারপর থেকে ঢাকা শহরে হেঁটে হেঁটে শুরু করি ছবি তোলা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ-শহীদ মিনার-কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি-শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর-বাংলা একাডেমী থেকে শুরু করে... বিভিন্ন জায়গার রকমারী ছবি।
1992 সাল থেকে 1995 সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে আমার বিচ্ছিন্নভাবে ফটোগ্রাফি চর্চা। 1996 সালের পূর্ব পর্যন্ত আমি কোন সংবাদ-প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে ছবি তুলিনি। 1996 সালে এসে আমি কুমিল্লার সাপ্তাহিক আমোদ-পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ শুরু করি। কিন্তু আমোদ তখনও লেটার প্রেসে ছাপা হতো বলে সেই পত্রিকায় স্বাভাবিক কারণেই সংবাদ-ছবি খুব বেশি ছাপা যেত না।আমোদ ছিলো তখনও মূলত একটি বিভিন্ন প্রতিবেদন ও কলামনির্ভর পত্রিকা। কারণ তখন ঢাকা থেকে ব্লক করে এনে ছবি ছাপানো ব্যয়ব‎‎হু‎ল ও সময়সাপেক্ষও ছিল। তাই তখন আমার প্রেস-ফটোগ্রাফি চর্চা সংবাদপত্রে তেমন বিস্তৃত ছিল না।
1998 সাল। তখন কুমিল্লার লাকসামের একটি সাপ্তাহিক কাগজ লাকসামবার্তা'র সম্পাদনা বিভাগে কাজ করার বিশেষ সুযোগ পাই। এ পত্রিকার সম্পাদক শহিদুল্লাহ ভূইয়া ডিভি লটারির বদৌলতে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করলে আমার কাজের সেই সুযোগ মিলে। কিন্তু লাকসামবার্তা' স্বাভাবিকভাবিকভাবেই লাকসামের ছবিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার নীতিমালা গ্রহণ করেছিল। আর আমারও তখন তেমন সুযোগ হতো না নিয়মিত লাকসামে যাওয়ার। কেননা তখনও আমি কুমিল্লার সাপ্তাহিক আমোদ'-কে কেন্দ্র করেই সংবাদ-ছবি বেশি সংগ্রহ করি।
1999 সাল। আমি তখন কুমিল্লার দৈনিক রূপসী বাংলা'র বার্তা বিভাগে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। তখন আমার অনেক ছবিই দৈনিক রূপসী বাংলা'য় ছাপা হয়। বিশেষ করে 1999 সালে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার এতবারপুরে গোমতি নদীর পাড় ভেঙ্গে জেলার ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হলে আমি যে সব ছবি তুলি, তার অধিকাংশই তখন দৈনিক রূপসী বাংলা'য় ছাপা হয়েছিল। 1999 সালে ঢাকার একটি পত্রিকায় কাজ শুরু করি। সেই পত্রিকা দৈনিক আল আমীন-এও আমি সংবাদ ও ছবি পাঠাতে শুরু করি। এ পর্যন্ত সে পত্রিকায় আমার অনেক ছবিই ছাপা হয়েছে।
2000 সালে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ উল্লাহ সম্পাদিত কুমিল্লার সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ পত্রিকায় আমি সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করি। এ বছর পর্যন্ত আমি সে কাগজের সঙ্গেই জড়িত ছিলাম।
2000 সালেই আমার লেখক ও সাংবাদিক বন্ধু দৈনিক শিরোনাম-এর চীফ রিপোর্টার সাইয়িদ মাহমুদ পারভেজ আমাকে দৈনিক শিরোনাম-এ কাজ করার আন্তরিক প্রস্তাব দিলে আমি এ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক নীতিশদা'র (নীতিশ সাহা) সঙ্গে কথা বলে দৈনিক শিরোনাম-পত্রিকায় যোগ দেই। শিরোনাম নিয়ে আমার এখন অনেক স্বপ্ন। এসব স্বপ্ন আমার রোমাঞ্চকর সংবাদ-ছবি তোলা নিয়েই...ছবির মতোই সেই স্বপ্ন।
বিগত সময়ে অনেক ঝুঁকি নিয়েও সংবাদপত্রের জন্য ছবি তুলেছি আমি। কিন্তু তার অধিকাংশই অজ্ঞাত কারণে অনেক পত্রিকায় ছাপা হয়নি। গণমানুষের পক্ষে কথা বলে যে ছবি, তা ছাপা না হওয়া একজন ফটো সাংবাদিকের কাছে কতটা দুঃখজনক...তা অবর্ণনীয়। আমি আশা করছি-এবার আমার সে রকম ছবিগুলো কুমিল্লার দৈনিক শিরোনাম-পত্রিকায় ছাপা হবে। সেসব ছবি ছাপা হলেই আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। তৃপ্তি পাবে একজন ক্ষুদ্র প্রেস-ফটোগ্রাফারের অতৃপ্ত সেই আত্মা। আর আমার সেসব স্বপ্নকে রূপ দিতে কেবল দৈনিক শিরোনাম সম্পাদকই নন, সেই আন্দোলনে কুমিল্লার সর্বস্তরের মানুষেরও সার্বিক সহযোগিতা চাই।

২| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন: সেই কবিতা আজও আমার সঙ্গ ছাড়েনি।
জসীম উদ্দিন অসীম:
শনিবার, ২ মার্চ ২০১৩, কুমিল্লা।

ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ের দেশে বারবার যেতে ইচ্ছে হয়েছে আমার। যাওয়া হয়নি কখনো। আমার অনেক স্বপ্ন আমৃত্যু স্বপ্নই থেকে যাবে। যেমন আজ পর্যন্ত আমি কিনতে পারিনি বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর সকল খন্ড। ছাত্রজীবন থেকেই এই স্বপ্ন ছিলো আমার। লাইব্রেরীতে পড়তে গেলেই সব খন্ড পড়ে দেখতাম, ছুঁয়ে দেখতাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে থাকা এক ছাত্রীর সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিলো টি এস সি-তে। সে বলেছিলো, মানুষের স্বপ্ন দেখা উচিত নাগালের মধ্যেই। কিন্তু ছোটবেলায় আমি নাগালের বাইরেই স্বপ্ন দেখতাম। তখনও স্বপ্ন দেখতাম কাজাকিস্তান, কিরগিস্তান কিংবা চীনে চলে যাওয়ার। তখনও রেডিওতে খবর শুনলেই শুনতে পেতাম লেবানন, সিরিয়া, ইসরাইলের নাম। তখন আমার রাগও ছিলো প্রচন্ড। প্রায় প্রতিদিনই অজানা পথে হাঁটতামও খুব।
একটু বড় হয়ে যখন পড়লাম দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার জীবনী, তখন বুকের ভিতরও ভারতের সেই মেঘালয়ের পাহাড়ের মেঘ জমা হলো আমার। তারপর সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি। অতঃপর সৃষ্টি হলো আমার কিছু দুঃখবাহী কবিতা। সেই কবিতা আজও আমার সঙ্গ ছাড়েনি। মনে হয়, আমৃত্যুও ছাড়বে না সেই সঙ্গ।কারণ গোটা বঙ্গদেশই তো কবিতার রসরঙ্গ অঙ্গ সঙ্গ ভরা।

৩| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৬

জসীম অসীম বলেছেন: গল্পাংশ:
জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো=
ইকুয়েল টু জিরো
০+০+০=০
জসীম উদ্দিন অসীম
রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬,
পশ্চিমচানপুর, কুমিল্লা।

সে দেখে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিতও নয়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। সে আরও দেখে কেউ সৎ নেই এই দেশে, শুধুমাত্র শিশুগুলো ছাড়া। সবাই দুর্বৃত্ত: কী রাজা আর কী প্রজা।
মঞ্চ অভিনেতা ও বাংলা সাহিত্যের এ ছাত্রটি দেখে দেশে তার পছন্দের মতো কোনো মঞ্চও নেই। তাই সে মনে মনে একটি কল্পনার মঞ্চ গড়ে নেয়। সেই মঞ্চেও কখনো এসে গান গায় রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়, নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের সংকট নিয়ে কথা বলে পাখি, বঙ্গোপসাগর কথা বলে মঞ্চেরই এক সক্রিয় চরিত্র হয়ে। ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী ইতিহাস বলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, মঞ্চে উপস্থিত হয়েই। সেই মঞ্চে সে কখনো কাক, কখনো বক, কখনো বা কুকুরকে তুলে দিয়ে দারুণ অভিনয় করায়। এমন করে করে সে এ দুর্বৃত্তের দেশে সকল নিরীহকে প্রতিবাদী করে তুলে তার স্বপ্নে।
তার এ রকম খেলাধুলা দেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শিলালিপি চট্টাভট্টাচট্টাচার্য এবং ‘হায় হায় বিশ্ববিদ্যালয়ে’র চোট্টা উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করেন। এ বিষয়ে উপদেষ্টাদ্বয় একটি সংবাদ সম্মেলন করতে এসে সৎ সাংবাদিকদের নৃশংস প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান।

৪| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:১৪

জসীম অসীম বলেছেন: আমার চিরতরে বিক্রি করা উপন্যাস
ভালোবাসার কমলাদিঘী’র মূল পান্ডুলিপি থেকে ..
জসীম উদ্দিন অসীম:
হঠাৎ মনে হয় আমি এক ঐতিহাসিক মানুষ। কিন্তু এ কি সত্য? নাকি সবই কাল্পনিক?
কখনো বা মনে হয় লোমহর্ষক উপন্যাসের চরিত্রেরও অনেক বৈশিষ্ট্য বহন করছি আমি। ভীতিপ্রদ কাহিনী, অলৌকিক রস যে ধরনের উপন্যাসে থাকে। জমিদার রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার আমার অনেক গান শুরেছিলেন। আর আমার নামে খনন করেছিলেন এক রহস্যময়ী দিঘীও।
সেই জমিদার ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী মানুষ। জমিদারদের ক্ষেত্রে এমনটা সচরাচর হতো না।
ভারতবর্ষের ত্রিপুরা এলাকায় রত্নাবতী পরগনায় ছিলো তার এ জমিদারী। শিশির সিক্ত সবুজ ঘাস, কোথাও কাশফুল, আঁকাবাঁকা পথ, কূলবধূদের কলসি কাঁখে সেই রহস্যময়ী দিঘীতে পানি নিতে আসা, নানা ফলের গাছগাছালির সবুজ সৌন্দর্যের নিদর্শন রয়েছে সেই দিঘীতে। জমিদার রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার আমারই নামে একদা এ দিঘী খনন করেছিলেন। সেই থেকে অনেকেই তাদের কন্যাদের নাম কঙ্কা রেখে যাচ্ছে ঠিক আমারই নামে। এই কঙ্কা এখন হিন্দু-মুসলিম উভয় পরিবারেই কন্যা সন্তানের নাম। জমিদার রূপেন্দলোচন মজুমদার এ এলাকায় কেন আমার নামে দিঘী খনন করেছিলেন? আমাকে অমরত্ব দিতে? তাহলে তিনি আমাকে আবার খুন করেছিলেন কেন?
ত্রিপুরা অঞ্চলে আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে মানুষের মুখে মুখেই ছিলো আমার নাম। এমনকি আমারই কন্যা জমিদার মালতীলতা মিত্রের সময়েও মানুষের মুখ থেকে, মন থেকে আমার নাম মুছে গেলো না। একদা আমার সঙ্গে অসফল এক প্রেম হয় আরেক জমিদারপুত্রের। পরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চিরকুমারী থাকার। কিন্তু সেটি আর পরে সম্ভব হয়নি। একজন খাজনা আদায়কারী তার এক দিনলিপিতে অবশ্য এসব কথা লিখেও রেখেছে। ওখান থেকেও অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। কোনো এক কারণে সেই খাজনা আদায়কারী কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সিলেটে চলে গিয়েছিলেন। শেষ জীবনে তিনি আর্থিক কষ্টে যখন দিশেহারা হন, তাঁর তখনকার সময়ের দিনলিপিও পাওয়া যায়। ওখানে তিনি মালতীলতার প্রশংসা করে যান। মালতীলতা দানশীল মানুষ ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি অনেক সাহসী ও মেধাবী ছিলেন। অল্প বয়সে তিনি মা হারা হন। অভাবের ছোঁয়া না থাকা সত্তে¡ও বালিকা মালতীলতা ছিলেন খুবই দুঃখী স্বভাবের। একদিন পিতার বকুনি খেয়ে মালতীলতা কঙ্কাদিঘীর পাড়ে বসে কাঁদছিলেন। তখন খাজনা আদায়কারী দেখতে পান মালতীলতাকে । দয়াপরবশ হয়ে তিনি মালতীলতাকে জিজ্ঞেস করেন কী তার দুঃখের কারণ। মালতীলতা বলেন, তার যে মা নেই, এর চেয়ে দুঃখের কারণ নেই আর তাঁর। সেই খাজনা আদায়কারীর কোনো সন্তান ছিল না। তাই তার অনেক স্নেহ-মমতা ছিল মালতীলতার জন্য। লেখাপড়ার পাশাপাশি তীর-ধনুক চালনায়ও পারদর্শী হয়ে ওঠে আমার কন্যা মালতীলতা মিত্র। এছাড়াও মালতী বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে তালিম নিয়ে নিজেকে একজন দক্ষ জমিদারে রূপান্তরিত করে। কঙ্কাপুর ও রত্নাবতী এলাকায় এখনো অনেক বাড়িতে আমার ও তাঁর নামে মানুষ কন্যা সন্তানের নাম রাখেন কঙ্কা অথবা মালতীলতা। তাই আমার মনে হয় আমি তখনও ছিলাম এবং এখনও রয়েছি। এ এক বড় আশ্চর্যের মানব জীবন। আমি কি সত্যিই ছিলাম? নাকি আমি সত্যিই আবার অতীতে উড়ে যাবো?

৫| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:৪৩

জসীম অসীম বলেছেন: (গল্প)
রক্ষা করবেন আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান
জসীম উদ্দিন অসীম:
জুন ১৯৭১। এখনো ভারতে যাওয়ার সুযোগ করতে পারেননি অতুল চন্দ্র রায়। তাঁর তিন যুবতী কন্যাকে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তই আতঙ্কে কাটাচ্ছেন। অসিতবরণ এমন স্ত্রী- কন্যাসহ পালানোর সময়েই পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা খেয়ে মারা পড়েছে। অতুল বাবুদের বাড়িও প্রায় খালি। সারাবাড়ি দিনের বেলাতেও কেমন যেন ভৌতিক হয়ে থাকে। রাত হলে তো কথাই নেই। তাছাড়া এই বাড়িতে পুরনো পুরনো গাছপালার সংখ্যা এতই বেশি যে, দিনের আলোতেও অর্ধেক আলো মাটিতে নামতে বাধা পায়। অতুল চন্দ্রের বড় ভাই চাকুরি করেন বরিশালের কাশীপুরে। তিনিও ভারতে চলে গেছেন। আর দিন দিন পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, অতুল চন্দ্রেরও না গিয়ে যেন আর বাঁচার উপায় নেই। দুই গ্রাম সামনের এক মুসলিম বাড়িতে গত কয়েকদিন আগে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ওরা। মিনার্ভা-র সুবীরের মুখে এই ঘটনার বিবরণ শুনে অতুলের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। কিন্তু অসুস্থ আর বৃদ্ধ মাকে একা ফেলে তারও পালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া এই অতুল ডাক্তারের কাছে এখনো যে প্রতিদিন ১০/ ১৫ জন রোগী আসে, তাদের সঙ্গে তার শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্কই নয়, এক ধরনের আত্মীয়তাও হয়ে গেছে। তাদের এবং তার হোমিওপ্যাথিক চেম্বার ফেলে যুবতী কন্যাদের নিয়ে শরণার্থী হয়ে কোথায় কিভাবে ঘুরে বেড়াবে, সেই পথ তার মাথায় আসে না। সেদিন বাজারে সেলুনে শেভ করতে গেলে অতুল চন্দ্র রায়কে নাপিত যুধিষ্ঠির বলে, বাবু দাড়িটা এখন রেখে দেন। ধুতি পরাও ছাড়েন। বাজার পর্যন্ত যখন আসেন, তখন আমার এ কথাটি রাখেন। বাড়িতে ফেরার পথে তহশিলদার মোখলেছ বললো, ডাক্তার বাবু পাঁচ কলেমা শিখেছেন? না শিখলে শিখে নেবেন। বিপদে কাজে আসবো । কলেমা মুখস্থ করলেই তো আর মুসলমান হয়ে যাবেন না। সুদেব কামার তার শ্বশুরবাড়ি থেকে একা ফিরছিলো। কপাল মন্দ তার। পড়লো আর্মির হাতে। কলেমা জিজ্ঞেস করেছিলেন। পারেনি। অথচ সেদিন বৈদ্যের বাজারে সুদেবের কাকা কলেমা পড়ে আর্মির হাত থেকে বেঁচে গেল। গত কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে হাওড়া জলার অতুল বাবুর পাটক্ষেতটা ডুবে গেছে। বীজ বুনেছিলেন দেরীতে। পৈত্রিক সূত্রে একতলা একটি বাড়িতে বসবাস করলেও আজকাল তার দিনকাল খুব খারাপই যাচ্ছে। সংসার জীবনের প্রথমদিকে ঢাকার ঠাটারীবাজারে চাকুরি করতেন অতুল। পরে চাকুরি ভালো না লাগায় বাড়িতে চলে আসেন। শুরু করেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি। এখন বাড়ির এ চেম্বারে বসে আমেরিকা- রাশিয়া এবং চীনের ভূমিকা নিয়ে রোগীদের সঙ্গে আড্ডায় বসেন। যারা কোনোদিন গোমতি ছাড়া আর কোনো নদীকেই জীবনে দেখেননি, তাদেরকেও নিজের পড়া জ্ঞান থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের গল্প শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। অশোক নন্দী তো বলেই বেড়ান যে, অতুলের এই বকবকানির কারণেই তার জীবনে চাকুরিতে উন্নতি করা সম্ভব হলো না। কিন্তু এক্ষুণি সব্বাই তাকে ভারতে পালাতে বলছে। আরও বলছে, কলেমা শিখে নিতে, দাড়ি রেখে দিতে। এগুলো তাহলে কিসের লক্ষণ? শাস্ত্রে আছে, ‘ য পলায়তি, স্ব জীবতী।’ যে পলায়ন করে, সে বেঁচে যায়। এখন কি তার পলায়নই একমাত্র পন্থা? অতুল চন্দ্র রায়ের স্কুল জীবনের বন্ধু জহির বিন আলম বলেছেন, ঘরে তোমার যুবতী কন্যা থাকাতে ভয়টা আরও বেড়েছে। বিশ্বজিৎ মজুমজার খুব সাহসী লোক। ইদানিং তিনিও বলছেন, অতুলদা’ আগেভাগে ইন্ডিয়ায় না গিয়ে খুব ভুল করে ফেলেছো। ইদানিং তো যাওয়া আরও কঠিন হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে রূপগঞ্জ বাজারে পাকিস্তানী আর্মি কয়েকটি দোকান পুড়েছে। তার মধ্যে সুষমার বাবার ‘স্বদেশী ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’ অন্যতম। সুষমার বাবা কার্তিক রায় পালিয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু সেদিন রাতেই নিজের সেই ছোট্ট ফ্যাক্টরীতে ঢুকে আগুনে পোড়া ময়দা, ডালডা, চিনি, দুধ দেখে এসে সারারাত বিলাপ করেছেন। ভোরে সুষমা তার বাবার হাত ধরে দুটি চিড়ার লাড্ডু আর এক গ্লাস জল খেতে অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু এত বড় অঘটনের পর কার্তিক বাবুর গলা দিয়ে আর খাওয়া নামছে না। কার্তিক বাবুর মা শৈলবালা রায়ও ছেলেকে ঝুঝিয়েছেন, প্রাণ রক্ষাই যেখানে এত কঠিন, সেখানে দোকানপাট- ব্যবসার কথা ভেবে কী হবে! কিন্তু কার্তিক রায় স্ত্রী গীতা রায়ের কথায়ও আর তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। সারারাত কান্নাকাটির পর থেকে এখন মূর্তি হয়ে বসেছেন। কিন্তু এই মূর্তিরূপে থাকলেও হয়তো শেষ রক্ষা হতো। অথচ দুদিন পর থেকে আবারও যথারীতি ‘স্বদেশী ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’ তে যাওয়া শুরু করলেন কার্তিক রায়। দুই গ্রাম দূরের আর্মি ক্যাম্পে সেই খবর যেতে দেরী হলো না। এর একদিন পরেই আর্মি এসে কার্তিক রায়কে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেল। শুরু করলো তার প্রতি অকথ্য অত্যাচার। অপরাধ : কার্তিক রায় হিন্দু। তাই ভারতের দালাল। গাছে ঝুলিয়ে চাবুক দিয়ে তাকে অনেক পেটানো হলো। সেই চাবুক আবার সাইকেলের টায়ার ছিঁড়ে বানানো। পেটানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে চাক চাক রক্ত উগলে বের হয়ে এসেছে। তারপর তার নাভিতে ধান রেখে বুটের গোড়ালি দিয়ে পিষেছে। কার্তিক রায় তার বাবা সুধীর রায়ের কাছে বাংলার জলদস্যুদের তান্ডবের গল্প অনেক শুনেছেন। কিন্তু এই জনপদে এ কেমন দস্যুর উপদ্রব দেখা দিলো, তা তার জীবনে শোনা সকল গল্পকেই হার মানিয়েছে। দুইদিন পর রেজু খাল এবং সাবের খালের সংযোগস্থলে রশি দিয়ে হাত- পা বাঁধা অবস্থান কার্তিক রায়ের লাশ পাওয়া গেল। ‘স্বদেশী ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’ পোড়ার পর আর ঘুমাতে পারেননি কার্তিক বাবু। লাশ হয়ে এখন নিবিড়ে ঘুমাতে লাগলেন। অতুল চন্দ্র রায়দের গ্রামের নাম মহাদেবপুর। এই গ্রাম এখন প্রায়ই ফাঁকা। দেশে যে যুদ্ধ চলছে, তাঁকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধ না বলে ‘হিন্দু- মুসলমান কিংবা ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধ’ বলে ও প্রচার করছে। সেই কাতারে মীর্জা লোকমান হোসেনও রয়েছেন। তিনি এলাকার মেম্বার। ইদানিং তিনি অতুল চন্দ্র রায়ের হোমিওপ্যাথিক চেম্বারেও রোগী হয়ে আসছেন। রমেশ পোদ্দার বলেছেন, মীর্জা লোকমান হোসেনের সঙ্গে পাকিস্তানী আর্মিরও যোগাযোগ রয়েছে। এই কথা শোনার পর এখন অতুল চন্দ্র রায়ের চোখেও ঘুম নেই। রাত হলেই ভগবানকে স্মরণ করেন আর বারবার চোখ মুছেন। ইদানিং আর শেভও করছেন না তিনি। সারা মুখেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ব্লেড- রেজর- শেভিং ক্রীম ঘরে থাকলেও শেভ করতে আর ইচ্ছে হয় না তার। এরই মধ্যে কেটে গেল কিছুদিন। দাড়িটাও অতুলের আরেকটু বড় হলো। একদিন সকালে হাত ব্যথার কথা বলে অতুলের চেম্বারে এলেন মীর্জা লোকমান হোসেন। এসেই অতুলের দাড়ি দেখে হাসা শুরু করলেন। এ হাসি ভয়ংকর। অতুল বললেন, হাসির ঘটলো কী! লোকমান বললেন, অতুলবাবু আপনার দাড়ি দেখে হাসছি। মন্দ লাগছে না। দাড়িটা সাহস করে রেখে দিন। রবীন্দ্রনাথের মতো। আবার হাসতে লাগলেন লোকমান। অতুলবাবু বললেন, এটা সাহস আর ভয়ের বিষয় নয়, শেভ করার সময় পাইনি কিছুদিন। এই হলো ঘটনা। লোকমান বললেন, ঘটনা যা- ই হোক, দাড়িটা রেখে দিন দাদা। আপনাকে খুব মানিয়েছে। মীর্জা লোকমানের সত্যিকার পরিচয় পাওয়া গেল দুইদিন পর মধ্যরাতে। যখন তিনি সূত্রধর বাড়িতে সত্যি সত্যিই হানা দিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যসহ হামলা করে নিরঞ্জন সূত্রধরের যুবতী কন্যা রেখাকেও তুলে নিলেন যাওয়ার সময় কালীমন্দিরের সামনেই নিরঞ্জনকে গুলি করে মারলেন। ভাঙলেন কালীমন্দিরের প্রতিমা। নিরঞ্জনের স্ত্রী গৌরীরানী ও তার কিশোরী কন্যা সংগীতা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না বলে বেঁচে যান। রেখার পরনে ছিল শাড়ি, কানে ছোট্ট সোনার দুল। ফর্সা হাতে লাল চুড়ি। তাকে দেখেই সুখানুভূতিতে ভরে যায় পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রাণ। তারা তাকে টানতে টানতে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যায়। রেখার হাত স্পর্শ করেই সৈন্যরা ভীষণ কামার্ত হয়ে পড়ে। নীল রঙের সুতি শাড়িতে জড়ানো রেখা তখন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। চোখ দিয়ে টলটল করে বের হচ্ছে জল। রেখার চোখের টলটল জল যেন বলছে:
‘মাসী গো মাসী
পাচ্ছে হাসি
সীম গাছেতে হচ্ছে নিম
হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা
কাকের বাসায় বকের ডিম।’
সুঠাম দেহের অধিকারী মীর্জা লোকমানের ছোটভাই নুরুল ইসলাম একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি মীর্জা লোকমানকে বললেন, আপনার এই কাজের পরিণাম একদিন আমাদের সবাইকে বহন করতে হবে। নিরঞ্জনের ছোটভাই শ্যামাচরণ সূত্রধর কোনো না কোনোদিন এর শোধ নেবে। যুদ্ধ তো আর সারাজীবনই চলবে না। পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞও একসময় বন্ধ হবে। প্রফুল্ল আর শেফালীদের পরিবার কিংবা সুবোধ মল্লিকরাতো চিরতরেই ইন্ডিয়া যায়নি। যুদ্ধ থামলেই দেশে ফিরবে। তখন কি হতে পারে, এখন কি ভাবা যায়? মীর্জা লোকমান বলেন, ওরা আর ফিরবে না। হীরেন বাবুরা তো যুদ্ধের আগেই গিয়েছেন। ফিরেননি আর। এখন এই যুদ্ধের আর্মির পেটা খাওয়া হিন্দুরা কখনোই ফেরার সাহস পাবে না। এমন যুদ্ধের দিনে অতুল চন্দ্র রায়ের কন্যা তুলসী, অপর্ণা, করুণার বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রায় নিষেধই। তারপরও বিশেষ প্রয়োজন ওরা এ বাড়ি-ও বাড়ি যায়। ওদের মা মারা গেছেন অসুখে বছর দুয়েক হলো। কোনো ছেলে নেই অতুলের। বড় মেয়ে তুলসীর যখন বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। ছেলের পরিবারও এখন ইন্ডিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। তুলসী মেয়েটা ভীষণই ভীতু প্রকৃতির। পাকিস্তানি আর্মির নাম শুনলেই তার শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। এই তো সাত-আটদিন আগে অতুলের বাড়ির পাশের ঝোঁপে একটি গেছো বাঘের ছানা দেখে প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। সুবীর ও দুলাল এই খবর শুনে ঝোঁপ-জঙ্গল তছনছ করেও কোনোকিছুর দেখা আর পায়নি। সুবীর পাশের বাড়ির রমেশবাবুর ছেলে। তুলসীকে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু তুলসী তার ছায়াটাও দেখতে পারে না। অথচ সুবীর তুলসীদের ঘরের আঙ্গিনায় ছড়ানো তুলসীর শাড়ি দেখেও মুগ্ধ হয়। ছোট ছোট ফুল আর বহুবর্ণের কাজে সমৃদ্ধ তুলসীর একটি শাড়ির ছড়ানো আঁচলের কথা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না সুবীর। এই মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ বাংলাদেশ। কারণ পূর্ব-পাকিস্তান যে বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে ভারত এবং পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুদের হাত রয়েছে মনে করেই পাকিস্তানি আর্মি হিন্দুদের ওপর এভাবে শোধ নিচ্ছে। ভারতকে তো আর ধরা যাচ্ছে না পূর্ব-পাকিস্তানের অসংখ্য হিন্দুকে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং ...। অপর্ণা ভীষণই রসিক মেয়ে। তুলসীকে বলে, বাড়িতে পাকিস্তানি আর্মি চলে এলে আমাদের বড় ট্রাঙ্কে তোকে ঢুকিয়ে পুকুরপাড়ের জঙ্গলটায় ফেলে আসবো। ট্রাঙ্কটার কোনা ভাঙ্গা। তোর শ্বাস নিতে কোনো সমস্যা হবে না। করুণা আছে সারাদিন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে। এখন পড়ছে ‘শ্রীকান্ত’। তাদের মা প্রিয়বালা রায়েরও এমন উপন্যাস পাঠের নেশা ছিলো। আর ছিলো সন্ধ্যার আগে বারান্দার সিঁড়িতে বসে বাড়ির ওপর দিয়ে অসংখ্য বুনোহাঁসের ঘরে ফেরা দেখার নেশা। অনেক রাজহাঁস পোষতেন প্রিয়বালা। তার মৃত্যুর পর এখন আর হাঁস পোষে না তুলসীর। পাকিস্তানি আর্মিদের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার গল্প শুনতে শুনতে অতুল চন্দ্র রায় এখন প্রায় অর্ধমৃত। তার এক আত্মীয় হরিমোহন রায়কে পিঠমোড়া করে বেঁধে সমানে পেটাতে থাকে। উলঙ্গ করে গোপনাঙ্গ বুট দিয়ে পিষে দেয়। মাটিতে পড়ে গেলে একজন সেনা কর্মকর্তা তারু বুকে বুট দিয়ে ইচ্ছেমতো লাথি মারে। মুমূর্ষ অবস্থায় হরিমোহন তার মা পূর্ণিমা রায় আর ভগবানকে যখন বিড়বিড় করে ডাকছিলো, তখনই চালায় গুলি। এই হরিমোহন যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ছিঁড়েছিলো। তাকে পাকিস্তানী আর্মি অফিসার ঘটনাটি সত্য কী না জিজ্ঞেস করেছিলো। হরিমোহন ঘটনাটি সত্য বলে স্বীকার করেছিলো। অস্বীকারের উপায়ও ছিলো না। ঘটনার সাক্ষী একজন আর্মিদের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলো। মঞ্জু। মঞ্জু রাজাকার। তাকে এ ঘটনার তথ্য দেওয়ার অফিসার একটি বন্দুক উপহার দিয়েছে। অতুল চন্দ্র রায় সারারাত আর ঘুমোতেই পারেন না। এই কি কাল এলো এই দেশে! কী হবে ভবিষ্যতে! পাল-সেন-মোগল-পাঠান-বৃটিশের বিরুদ্ধে এত রক্ত খরচ করার পরও এখন পাকিস্তানীদের এত রক্ত দিতে হবে! এমন শ্বাসরোধী- মৃত্যুগন্ধী সময়কে কবে পার হয়ে যাওয়া যাবে কে জানে। সব শুনে সব দেখে স্থবির হয়ে গেছেন অতুল চন্দ্র রায়। আগষ্টের এক গনগনে দুপুর। হঠাৎ রামপুরের দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। বাড়ি থেকে বের হয়ে অতুলবাবুদের বাড়ির সবাই দেখলো রামপুরের কয়েকটি বাড়িতে আগুন জ্বলছে। ঠিক তখনই হরিদাসের ছেলে প্রফুল্ল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রামপুরের দিক থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আমাদের গ্রামে আর্মি আসতে পারে। সবাই গিয়ে পশ্চিমের পাটক্ষেতগুলোতে লুকিয়ে থাকো। প্রফুল্লের বাজারে একটি টং দোকান রয়েছে। ওখানে সে ফল বিক্রি করে। জিতেন্দ্র অতুলবাবুকে বললো, কাকু তুমি দ্রুতই তোমার মেয়েদের নিয়ে এই গ্রাম ছাড়ো। অতুল চন্দ্র রায় তার মেয়েদের নিয়ে পাটক্ষেতে গেলেন না। তবে অনেকেই গেলেন। ভারত ভাগ হওয়ার পরও যে ভারতবর্ষে এমন রক্তপাত চলবে, তা আগে ভাবতে পারেননি তিনি। যুদ্ধের আগে তার ভারতে যাওয়ার অনেক সুযোগই ছিলো। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এখনো যেমন সিদ্ধান্তহীন তিনি। স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব হারালে স্বাধীনতাকে উপভোগই বা করবে কারা? এরই মধ্যে এক খবর রটে গেল। মীর্জা লোকমান সরাসরি পাকিস্তানি সৈন্যসহ আজকাল ঘুরে বেড়ায়। যুদ্ধের বাজারে তার দারুন কামাই। অনেকের জমি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে তবে ছাড়ছেন। তার সঙ্গে জহুর আহমেদও রয়েছেন। জহুর হাজ্জাম। সে এক দুই হিন্দুকে নাকি এ পর্যন্ত মুসলমানি করিয়েছে। যে হিন্দু মুসলমানি করানোর বিষয়ে সম্মত নয়, তার পুরস্কার আগে লিঙ্গ হারানো এবং তারপর গুলি খেয়ে মরা। আর যদি হিন্দু নারী হয়, তাহলে তার ক্ষেত্রে মুসলমানি বা খৎনার ব্যবস্থা নেই সুদানের মতো। তাকে তখন পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে গিয়েই শুদ্ধ মুসলিম হতে হয়। অতুলের মেয়েদের দিকে মীর্জা লোকমানের লোভ লকলক করে বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। তাই এখানে পাকিস্তানি আর্মিদের আনছেন না। যুবতী নারী যে কয়েকজনের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাদের পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে তুলে দিতে হয়। নিজের জন্য কোনো অবশিষ্টই থাকে না। তাই অতুলের মেয়েদের শরীরের লোভে রাতভর লোকমান ঘুমোতে পারেন না। কিন্তু কী উপায়ে এবং কখন যে হামলা দেবেন অতুলের পরিবারে, নির্ধারণ করতে পারেন না। নিরস্ত্র অতুলকে যে কোনো সময়েই হত্যা করতে পারেন। কিন্তু ভালো কোনো বুদ্ধিও দরকার। একদিন রাতে ডা. অতুল চন্দ্র রায়ের বাড়িতে আসেন মীর্জা লোকমান। সঙ্গে তার একজন বন্দুকধারী বাঙালি যুবক। অতুল আঁৎকে ওঠেন। লোকমান বলেন, অতুলবাবু আমি পাকিস্তানের সঙ্গেই আছি। মিলিটারীর সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তাই বলে আপনার ভয়ের কিছু নাই। আমি আপনার কাছের মানুষ। আপনার কোনো ক্ষতি হতে দেবো না আমি। কিন্তু এই হিন্দু পাড়ায় তো আর্মি কালকেই হামলা করবে। অতুলবাবু বললেন, তাহলে উপায়! লোকমান ভাই আপনি আমাদের রক্ষা করুন। অসুস্থ মা আর মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবো আমি! মীর্জা লোকমান বললেন, আমি কি রক্ষা করবো? রক্ষা করবেন আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান। আপনি এখনই তিন মেয়ে আর ঘরের সোনাদানা সব নিয়ে হাওড়া জলার শাহজাহান সর্দারের বাড়িতে উঠবেন। আপনার বৃদ্ধ অসুস্থ মাকে বাড়িতেই রেখে যাবেন। দুদিন পরেই আবার ভিটায় ফিরবেন। বৃদ্ধ মহিলাকে পাকিস্তানি আর্মি মারবে না। আর্মি সবই পুড়ে দিতে পারে। এ পাড়ায় কিচ্ছু রাখবে না বলেছে। আর ঐ অপরাধ করেছে আপনাদের মনিন্দ্রবাবুর ছেলে। সে পাকিস্তানি এক সিপাহীকে জবাই করে ধরা খেয়েছে। পালানো ছাড়া আর কোনো মুক্তি নেই। খারাপ লগ্নে আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাললাহু ওয়ালাইআসসালামও হিযরত করেছিলেন। অতুল ডাক্তার বললেন, পাড়ার সবাইকে না বলে শুধু নিজের প্রাণ নিয়ে পালাবো! আমি এতোটা স্বার্থপর নই। শাস্ত্রে পালানোর কথা আছে। প্রতিবেশীকে ফেলে দিয়ে নয়। মীর্জা লোকমান বললেন, আমি আপনার কতোকালের আপন মানুষ। অসুখেবিসুখে আপনিও আমাদের পাশে থেকেছেন। আপনাকে আমি মরতে দেবো না। জোর করেই ধরে নিয়ে যাবো। এই এলাকায় আপনার মতো দামি মানুষ দ্বিতীয়টি নেই। আপনি মরলে রাতবিরাতে চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবে মানুষ? চলুন। আপনার মেয়েদের নিয়ে এক কাপড়ে এক্ষুনি চলুন। অতুল ডাক্তার বললেন, আমার একটি শর্ত আছে অতুলবাবু। লোকমান বললেন, কী শর্ত! অতুল রায় বললেন, আমি আমার মাকে কোলে করে হলেও নিয়ে যাবো। পাক- আর্মিকে বিশ্বাস করি না আমি।মীর্জা লোকমান হাসলেন। বললেন, হায় আমি আগেই জানতাম। মা পাগল অতুলবাবু ইন্ডিয়া যেতে পারলেন না মাকে ফেলে! আর দেরি নয়। বটগাছের গোড়ায় নৌকা বাঁধা আছে। জানাজানি হলে ঝামেলা বাড়বে। খুব দ্রুতই রওয়ানা হয় অতুলের পরিবার। কোথা থেকে যেন অতুলের শক্তি- সাহস বেড়ে যায়। এতো সাহস আগে দেখালে তিনি এখন ভারতের উত্তর ত্রিপুরার কৈলাশশহরেই বসবাস করতে পারতেন। মা- মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে নৌকায় বসলেন অতুলবাবু। পাটক্ষেতের ফাঁক দিয়ে নৌকা নিয়ে এগিয়ে গেল লোকমানের আরেক সহযোগী মনজুর। হাওড়া জলার সীমানায় পৌঁছেই মিহি জ্যোৎ¯œার আলোতে জলে একটি মেয়ে মানুষের লাশ ভাসতে দেখলেন অতুলবাবু। চিৎকার করে বললেন, হায় ভগবান- এ কি দেখছি আমি লোকমান ভাই! লোকমান ধমক দিয়ে বললেন, চুপ। কোনো শব্দ করবেন না। দেশে এখন যুদ্ধ চলছে না। কোথা থেকে ভেসে এসেছে কে জানে। ঈশ্বরের কাছে শুকরিয়া করেন যে বিপদ থেকে দূরে চলে এসেছেন। অতুল ডাক্তার বললেন, লোকমান ভাই, বেঁচে থাকলাম। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হয়ে। পাড়ায় খবরটা কাউকে বলে আসতে পারলে কমপক্ষে ওরা পালাতে তো পারতো। লোকমান বললেন, খবরটা আমিই ওদের দেবো। আগে তো আপনাকে রক্ষা করি। আমার মায়ের বাতের ব্যথা আপনার ওষুধে ভালো হয়েছে। সে কথা মা এখনো বলেন। অতুল ডাক্তার বলেন, মাসি এখন আছেন কেমন! কতোদিন দেখি না তাকে। মীর্জা লোকমান বলেন, মা এখন কমপ্লিট সুস্থ আছেন। পানি আর পাটক্ষেত বেষ্টিত শাহজাহান সর্দারের দ্বীপবাড়িতে পা রেখেই হোঁচট খেলেন অতুল ডাক্তার। শাহজাহান সর্দাররা কোথায়? বাড়ি যে শূন্য! মীর্জা লোকমান বললেন, তারা চলে গেছে অনেক পশ্চিমে মেঘনা নদীর কাছাকাছি এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সর্দারের দুই যুবক ছেলেই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। পাকিস্তানী। আর্মি তাদেরও ছাড়বে না। তাই ভয়ে বাড়ি ছাড়া। জীবনের শ্রেষ্ঠ ভুলটি করে ফেলেছে অতুল ডাক্তার এখন এটা মনে মনে ধরতে পারলেও আর ফেরার উপায় নেই। তার অসুস্থ মা তার কানে কানে বললেন, তুই সারাটি জীবনভরই শিশু থাকলি রে অতুল। এ তুই কী করলি! অতুল ডাক্তার বললেন, মা গো, আমি শিশু নই গো মা। আমি ওই গোখরো সাপটিকে বিশ্বাস করেছিলাম। এমন সময় অতুল ডাক্তার টর্চ লাইটের আলোতে দেখতে পেলেন শাহজাহান সর্দারের বাড়ির উঠানে লাল নীল বর্ণের মেয়েদের কিছু জুতো। ততক্ষণে মীর্জা লোকমান ধরিয়েছেন কিংস্টক বা কুইনস্টক এক সিগারেট এবং তার চামচারা বিড়ি। অতুল ডাক্তারের চোখ দিয়ে টলটল করে বেরুচ্ছে জল। তার হাতঘড়িতে তখন রাত্র তিনটা তিরিশ। তার তিন মেয়েই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

৬| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:৫৩

জসীম অসীম বলেছেন: কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাংবাদিক নেতাদের বলছি:
‘তৈল মালিশের চেয়ে জুতা পালিশই শ্রেয়’

জসীম উদ্দিন অসীম:

কুমিল্লা প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দদের বলছি: অতীতেও আমি কুমিল্লা প্রেসক্লাব নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়েছি। যা লিখেছি, ন্যায্য লিখেছি। 'মাল' খেয়ে টাল হয়ে লিখিনি। 'অগা-মগা-বগা'দের প্রেসক্লাবের সদস্য না করতে লিখেছি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আরও লিখেছিলাম: 'কোনো রাজনৈতিক ষন্ডার নিয়ন্ত্রনে যেন না যায় কুমিল্লা প্রেসক্লাব।' দয়া করে আমাকে আর এ বিষয়ে লিখতে বাধ্য করবেন না। এক্ষুনি আমি বলতে চাই: কুমিল্লার কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে 'নিরীক্ষণ' পত্রিকার মাধ্যমে যে কোনো অপদার্থকে আপনাদের ক্লাবের সদস্যপদ প্রদান করার ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকান্ড থেকে অবশ্যই বিরত থাকুন। না হয় এর চড়া মাশুল একদিন আপনাদের অবশ্যই দিতে হবে। কুমিল্লার যেসব সাংবাদিক নেতা এই পত্রিকার প্রকাশককে কয়েক বান্ডেল টাকা ধরিয়ে দিয়ে অপ-রাজনীতিতে লিপ্ত রয়েছেন, তাদের এসব থেকে বিরত থাকার কঠিনতর পরামর্শ দিচ্ছি। না হয় এর পরিণতি একদিন আপনাদের ভয়ঙ্করভাবেই বহন করতে হবে। আইনের আশ্রয় নিয়ে এই পত্রিকার প্রকাশককে অবশ্যই 'বাংলাদেশ দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারা'য় শাস্তির আওতায় আনা আমার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু কুমিল্লার কতিপয় রাজনৈতিক 'রাবণ' নেতাদের কাছে জিম্মি এই অযোগ্য, অসৎ এবং বিশ্বাসঘাতক প্রকাশককে আমি এবং আমার স্ত্রী এই পত্রিকারই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের সম্মানে আপাততঃ করুণাই করেছি। তবে তাই বলে সবার জন্যই আমার ক্ষমাসুলভ মনোভাব থাকবে, এটা আশা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সময়-অর্থ-ক্ষমতাকে সব সময়ের জন্য ধরে রাখা যায় না। সুতরাং এসবের ‘পূজা’ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখুন। কুমিল্লা প্রেসক্লাবে আপনারা রাক্ষসরাজ 'রাবণে'র পূজা করুন। সেটা আপনাদের অভিরুচি। কিন্তু ‘হনুমানে’র লেজের আগুনে ‘লঙ্কা পোড়ানো’র ব্যবস্থা ভুলেও করবেন না। লঙ্কার রাবণ তো হনুমানকে সামান্য বানরই ভেবেছিলো। কিন্তু সেই এক বানরের সঙ্গেই আর লঙ্কার অধিপতি রাবণ শেষ পর্যন্ত পারলো কোথায়? বনের রাজা সিংহও শিকারীর কঠিনতর জালে বন্দী হয়। তাই আমার টার্গেটও কক্ষনোই 'নিরীক্ষণ' প্রকাশক নয়। এমনকি ইঁদুর এসে জাল কেটে উদ্ধার করবে, সিংহের সেই ভাগ্য কি আছে? নমরুদের পরাজয় হয় সামান্য মশার কাছে। ভিডিও আজকাল সহজলভ্য। এই মাধ্যমও প্রমাণ করে কে বা সভ্য কে অসভ্য। আমি আর করতে চাই না কাউকে ছোট কিংবা হেয়। কারণ আপনাদেরও নিশ্চয়ই মোক্ষমভাবেই জানা রয়েছে যে, ‘তৈল মালিশের চেয়ে জুতা পালিশই শ্রেয়।’

৭| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:১৪

জসীম অসীম বলেছেন: আপনার শহরের একটি হিন্দু সংখ্যালঘু পরিবারের পাকা বাড়িসহ আরও জমি দখল করে রেখেছেন ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা। আপনি সাংবাদিক। শুধুমাত্র এটুকু খবর জানার পর আপনি তখন কী করবেন?

জসীম উদ্দিন অসীম:

আমরা এখন বাস করছি এমন এক সময়ে, যে সময়ের সঙ্গে অতীতের কোনো সময়েরই তুলনা দেয়া যাবে না। যখন আমরা খেলা শুধু দেখিই না, খেলা নিয়ে পড়ি। পড়তেই হয়। যখন কলেজে ভর্তির আবেদন করতে হয় প্রিপেইড মোবাইল থেকে এস.এম.এস-এর মাধ্যমে। যখন অধিকাংশ ডাক্তারই অর্থের জন্য উন্মাদ হয়ে আছেন এবং কারণে-অকারণে যেনতেন উপায়ে অস্ত্রোপচার করে মানুষকে নতুন নতুন ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন। ঠিক এ অবস্থায় একজন সাংবাদিকের কাজ করার পদ্ধতিও জটিলতর হয়েছে। পাসপোর্ট নিয়ে হজ যাত্রীরা সমস্যায় পড়লে হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন ‘হাব’-এর সঙ্গে কথা বলে কী বক্তব্য নিতে হবে অথবা ধর্ম মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কী বক্তব্য দেয়, তার দিকে কতোটা নজর দিতে হবে, তাও জানতে হবে। আমরা এখন বাস করছি এমনই এক সময়ে, যে সময়ের সঙ্গে অতীতের কোনো সময়েরই তুলনা দেয়া যায় না। এখনকার এই সময় এবং এই সময়ের একজন সাংবাদিকের কাজ করার পদ্ধতি আগেকার কোনো সময়েরই ব্যাকরণের সঙ্গে আর তেমন মিলছে না। আপনার শহরের বা এলাকার একটি হিন্দু পরিবারের পাকা বাড়িসহ অনেক জমিই দখল করে রেখেছেন ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা। আর সম্পত্তি উদ্ধারের মামলা করে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন কিংবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেই সম্পত্তির মালিক। শুধুমাত্র এটুকু খবর জানার পর আপনি পুরো খবরটি সংগ্রহ করতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন! অবশ্য এ ঘটনা জানার জন্য এই ইন্টারনেটের যুগেও আপনাকে অনেককিছুই সরেজমিনে দেখে আসতে হবে। এক্ষেত্রে মামলার বিবাদীর সঙ্গে আপনাকে যোগাযোগ করতেই হবে। আর মামলা যেহেতু হয়েছে, সুতরাং সেখানে তথ্যের জন্য আপনাকে আদালতের শরণাপন্নও হতে হবে। অবশ্য আদালতকে নিয়ে কোনো মতামত দেওয়ার আইনগত অধিকার আপনার নেই। যেমন: বিবাদী পক্ষ যদি একের পর এক সময় নিয়ে মামলার দিন বারবার পিছিয়ে দেয়, সে ক্ষেত্রে আপনি আদালতকে দায়ি করে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনাকে জানতে হবে ঠিক কবে ও কিভাবে সেই পরিবারের পাকা বাড়িসহ ... বিঘা জমি দখল করে নিলো ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতা। এক্ষেত্রে আপনাকে যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা না বললে রিপোর্টটি পূর্ণাঙ্গই হবে না, সেটি হলো ভূমি কার্যালয় কিংবা ল্যান্ড অফিস। সেই পাকা বাড়িসহ ... বিঘা জমি আপনার জেলার কোন থানার অন্তর্গত সম্পত্তি এবং তা কতো নং ... মৌজার কোন কোন দাগে রয়েছে, এ বিষয়ে সেই ভূমি কার্যালয় কিংবা ল্যান্ড অফিসের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে তথ্য জানতেই হবে। বিশেষ করে আপনাকে ভূমি কর্মকর্তা বা এসি ল্যান্ড-এর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। অভিযোগকারীর সম্পত্তিগুলো ঠিক তার নামে রয়েছে কী না, কিংবা যেহেতু সেই লোক বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু, তাই সেই সম্পত্তি বর্তমানে তার পিতার নামে রয়েছে কী না কিংবা কোনো চাচার নামে, অথবা সেই পরিবারের কেউ ভারতে চলে গিয়েছে কী না কিংবা গেলেও ঠিক কবে গিয়েছিল, সম্পত্তিগুলো কখনো এনিমি প্রপার্টি বা শত্রু সম্পত্তি, অ্যাবান্ডন প্রপার্টি বা পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল কী না অথবা এখনো কোনো সম্পত্তি ভি.পি বা ভাস্টেট প্রপার্টি বা অর্পিত তালিকাভুক্ত কী না এসব জানতেই হবে। আর এ বিষয়ে যেসব আইন ও প্রজ্ঞাপন বিভিন্ন সময়ে জারী হয়েছে, তা জানলে আরও ভালো হবে। আর এসব জমি নিয়ে আদালতে চলমান মামলার খোঁজখবর তো আপনার জানতেই হবে। আর যদি দখলকারী এই সম্পত্তি কিনেছেন দাবী করেন, তাহলে তা রেজিস্ট্রি হয়েছে কী না, তাও খতিয়ে দেখতেই হবে। বিবাদীর বক্তব্য ছাড়া এক্ষেত্রে রিপোর্টটি পরিপূর্ণ হবেই না।
আজকের যুগে একজন সাংবাদিককে রিপোর্ট লেখার জন্য অনেক জ্ঞানই রাখতে হয়। খুব বেশি আরামপ্রিয় লোক হয়ে সব ক্ষেত্রে ভালো রিপোর্ট করা সম্ভব নয়। একটি রিপোর্টের জন্য হয়তো আপনাকে দেখা গেল যে প্রত্যন্ত এলাকার একটি বাঁশের সাঁকো পার হয়ে একটি এলাকার অনেক গভীরে যেতে হচ্ছে। আরেকটি রিপোর্টের জন্য হয়তো বিভাগীয় মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ভোগান্তির মধ্য দিয়েও হয়তো কোথাও যেতে হচ্ছে। এমনি আরও কতো কতো ঘটনার সঙ্গেই আপনাকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই ডিজিটাল যুগেও, এই ইন্টারনেটের যুগেও জগৎ সংসারের অনেক কিছুই এখনো এই ইন্টারনেটের আওতামুক্ত রয়েছে। সুতরাং একজন ভালো রিপোর্টার হওয়ার জন্য আপনাকে হতে হবে অনেক কষ্টসহিষ্ণু মানুষ। আর শিক্ষা এবং দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার তো কোনো বিকল্পই নেই। আপনাকে অনেক কিছুই জানতে হবে। কোনটা মানবিকতা এবং কোনটা নয়, তা জানতেই হবে। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর লাদেনের স্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এটি হয়তো আন্তর্জাতিক সংবাদ। আর এ নিয়ে হয়তো ব্রিটেনের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখেছেন মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট রবার্ট ফিস্ক। আর সেই লেখায় হয়তো তিনি বিন লাদেনকে সমর্থন না করলেও মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাদের অনেক সমালোচনাও করলেন। সেই লেখা পড়ে সব সময় আবেগে গদগদ হওয়ারও কারণ নেই। কারণ ওসব কলামিস্ট-বিশেষজ্ঞ বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের প্রায়ই বাজারীনীতির কারণেই মানবিকতার পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা যায়। বাস্তবিক অর্থে নিরপেক্ষ লেখা পাওয়া খুব কঠিন। যেমন এটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, তেমনি জাতীয় বা আঞ্চলিক ও স্থানীয় ক্ষেত্রেও। আজকের যুগে একজন সাংবাদিককে রিপোর্ট লেখার জন্য অনেক জ্ঞানই রাখতে হয়। কারণ ঘটনার সূত্রগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই মিল পাওয়া যায়। আপনার এলাকার একটি ঘটনাও হতে পারে আন্তর্জাতিক সংবাদ: যেমন একটি বিমান দুর্ঘটনা। তেমনি একটি আন্তর্জাতিক ঘটনার সঙ্গেও থাকতে পারে আপনার অত্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকারও কোনো যোগসূত্র। সুতরাং কোনো ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। আর তা হলেই একজন সাংবাদিক বা রিপোর্টারের পেশাগত দক্ষতার প্রমাণ মিলবে।

৮| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ২:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন: গোমতি নদীর এপার ওপার
জসীম উদ্দিন অসীম:

(নোট: প্রায় সাত বছর সময়-শ্রম দিয়ে আমি 2000 সালের আগেই লিখেছিলাম ‘গোমতি নদীর এপার ওপার’ নামের
এই উপন্যাসটি। কিন্তু 2002 সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রথম সংসার ভাঙ্গার লগ্নে আরও অসংখ্য লেখার সঙ্গে এই উপন্যাসের মূল পান্ডুলিপিটিও হারিয়ে যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে এখনো এই উপন্যাসের কয়েক পর্ব আমার সংরক্ষণে রয়েছে। পর্বগুলো কম্পোজ করেছে আমার বর্তমান স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি।)
================================

সুচিত্রার বাবা একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। তিনি আবার উত্তম-সুচিত্রার ছবির ভক্ত। সেইজন্য মেয়ের নামও রাখলেন সুচিত্রা। এই সুচিত্রার মুখমন্ডলও কাব্যিক। শিশু সুচিত্রাও হাসতে পারে নায়িকা সুচিত্রার মতোই সেই ভুবনমোহিনী হাসি। তারও রয়েছে চোখের মায়াবি চাহনি। কিন্তু নেই চিবুকের ওই তিল, যা দিয়ে নায়িকা সুচিত্রা মুগ্ধ করেছিলেন ভারত-বাংলাদেশের মানুষকে। তাই সুচিত্রার রেখা মাসী শিশু সুচিত্রার চিবুকে প্রায় প্রতিদিনই কাজল দিয়ে একটি তিল এঁকে দেয়।
‘মাসী, ও মাসী, আমার পেটে খিদা লাগছে। খেতে দাও।’ রেখা মাসী বললেন, কে রে, সুচি? আয় আয়। দেখি রান্না ঘরে কী আছে। তোর অতুলদা’ কই! মাসী সুচিত্রার কাছে জানতে চান। সুচিত্রা বলে, আমি জানিনা। আমার খিদা লাগছে। কিছু খেতে দাও।
ঠিক এমনই সময়ে শোনা গেল পূর্বদিকের গ্রাম শ্যামলীতে পাকিস্তানি আর্মি হামলা দিয়েছে। খবর আনলো ঈশ্বরপাড়ার টিটু দত্তের ছেলে চিত্ত। ভয়াবহ আগুনে পুড়তেও দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারীদের একটি বাড়িকে। এ দেখে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই সুচিত্রাকে কোলে নিয়ে পশ্চিমগাঁ-র দিকে ছুটলেন রেখা মাসী। সঙ্গে বাড়ির অন্যান্যরাও। পশ্চিমগাঁ হিন্দু অধ্যুষিত। এ নিয়ে পাকিস্তানি আর্মি আসার ভয়ে তিনবার পশ্চিমগাঁয়ে যাচ্ছে সুচিত্রাদের পরিবার।.........।
নিজের মেয়ে মাধবী ভট্টাচার্য ও তার বান্ধবীদের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে’র এ গল্প বলা শুরু করেছিলেন বাবা অমল ভট্টাচার্য। কিন্তু গল্প বলায় বাধা পড়লো অমল ভট্টাচার্যের এক বন্ধুর হন হন করে তার বাড়িতে ছুটে আসা দেখে। বন্ধুটি হলেন শান্তনু চ্যাটার্জি। তার মেয়ে মাধবীর বান্ধবী সুপ্রিয়ার বাবা। মাধবী-সুপ্রিয়া দুজনেই বাড়ির পাশের হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে

শান্তনু চ্যাটার্জি অমল ভট্টাচার্যকে বললেন, বাংলাদেশের হিন্দুরা কেন দেশ ছেড়ে যায় জানো?
অমল ভট্টাচার্য বললেন, মুসলমানও এখানে শান্তিতে নাই দাদা। অনিয়ম হলে হিন্দু-মুসলিম সবারই ভোগান্তি হয়। আসলে কী হয়েছে, সেই ঘটনা বলো।
শান্তনু চ্যাটার্জি বললেন, আমাদের গোপালগঞ্জ গ্রামে এখনো মুসলমানের চেয়ে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। তাই না? অমল ভট্টাচার্য বললেন, গোপালগঞ্জ গ্রামটা তো আর বাংলাদেশ না এবং তুমি আমিও এই দেশের কোনো সম্রাট মন্ত্রী না।
শান্তনু চ্যাটার্জি বললেন, আমি জানতে চাই তোমার বাড়িতে গোমতি নদীর উত্তরপাড়ের নুরুল হুদা ছেলেটা কেন এতো ঘন ঘন আসে!
অমল ভট্টাচার্য বললেন, নুরুল হুদা ছেলেটা খারাপ না। তার বাবা আমার বন্ধু। পড়ে সে আমাদের মাধবীদের সাথেই। আমাদের এই বাড়িটা ওদের স্কুলের কাছে বলেই হয়তো সে এখানে এতো বেশি বেশি আসে। সে তার বাড়িতে মাধবীলতা ফুলের বাগানও করেছে। ফুলের চারা সব আমাদের থেকেই নিয়েছে। এ নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার তো কোনো ঘটনা দেখি না আমি। তোমার কী হয়েছে শান্তনু, সেই ঘটনা বলো।
শান্তনু চ্যাটার্জি মুখ খুললেন। বললেন, আমাদের কালী মন্দিরের ঠাকুর সন্তোষ ভট্টাচার্য বললেন, আমার মেয়ে সুপ্রিয়াকে নাকি ইউনিয়ন মেম্বার সফি-র ছেলে রাফি প্রতিদিনই ডিস্টার্ব করে। কিন্তু মেয়ে তো আমার একবারও আমাকে খুলে বলেনি সে কথা। ঠাকুর কি সত্য কথা বলেছে? জিজ্ঞেস করলাম সুপ্রিয়াকে। বললো, ঘটনা সত্য। এমনকি হিমাংশু রায়ের ছেলে বাদলও দেখি সব ঘটনা জানে। অথচ কেউই আমাকে বললো না।বললো শেষে মন্দিরের ঠাকুর!

অমল ভট্টাচার্য বললেন, আমার এ বাড়িটার বয়স কতো জানো শান্তনু? তুমি তো জানো এ বাড়ি কতোকালের পুরনো এক জমিদারবাড়ি। জমিদার হিমাংশু ভট্টাচার্যের বাড়ি। পুরোনো এ বাড়িতে আমরা যদিও এখনো বসবাস করি, মনের ভিতরে কিন্তু জমিদারী ভাবটা রয়েই গেছে। কিন্তু এ ভাব ধুয়ে এখন আর কিছু হবে না। কারণ কোনো এক সময় আমাদের এ গোপালগঞ্জ গ্রামটিতে শতভাগ হিন্দুর বাস ছিল। আর এখন! হিন্দুদের সংখ্যা কতো কমে গেছে। চারপাশের সব গ্রামের মানুষজনের বেশিরভাগই মুসলিম। আরে শান্তনু, কী যে বলছিলে, ওই নুরুল হুদা...তুমি নুরুল হুদার কথা বলো! ও তো ভালো ছেলে। তাই এখানে আসে আর আড্ডা মারে। ফুলের চারা নেয় এবং বাগান করে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে। কিন্তু সে ও তো হতে পারতো অনেক নষ্ট ছেলের মতো দুর্র্ধষ কোনো যুবক। করতে পারতো কতো উৎপাত। কিন্তু ওদের মতো শত যুবক এই দেশে সত্যি সত্যিই ভালো। ওদের উদারতা না থাকলে আমরা কি শান্তিতে থাকতে পারতাম?
শান্তনু চ্যাটার্জি বললেন, কিন্তু এই দেশ থেকে এখনও হিন্দুরা ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। আমি মনে করি না ওরা বিনা কারণেই যাচ্ছে। আমাদের গ্রাম থেকেও কি কম হিন্দু গেছে! পরিমল গুহ, সুরেশ দেব, গোবিন্দ দাস, পরিমল দত্ত, রবীন দাস, রেনুবালা সরকার, আমাদের মধুসূদন চ্যাটার্জি, ঘোষপাড়ার যোগমায়ার বাবা মনোরঞ্জন ঘোষের পরিবার, গাঙ্গুলীবাড়ির রতন চক্রবর্তী, পশ্চিমপাড়ার খগেনরা...আর কতো ঘরের নাম বলবো! হ্যাঁ শীল বাড়ির আর মালী বাড়ির কেউ যায়নি এখনো। আর রানুদের পুরা পরিবারকেই তো একাত্তরে পাকিস্তানীরা মেরে ফেললো।
অমল ভট্টাচার্য প্রসঙ্গ ফিরিয়ে বললেন, শুনো শান্তনু, তুমি তো জানো, আমারও কিন্তু 1971 সালে বাঁচার কথা ছিলো না। আমি মুক্তিযুদ্ধেও গেলাম না এবং দেশও ছাড়লাম না। কারণ আমার কাছে ঠিক নিশ্চিত ছিলো না এ বিষয়টা যে, যুদ্ধটা ঠিক কোনদিক থেকে শুরু হয়ে কোন দিকে গিয়ে শেষ হয়। আর আমার আরেকটা ধারনাও ছিলো যে, যুদ্ধটা কমপক্ষে ১০ বছরও চলতে পারে। কারণ আমি ভেবেছিলাম পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করে ইন্ডিয়া এই দেশটাকে নিয়ে নেবে। তার রক্ত খরচের মূল্য সে নেবে না! তাহলে তো যুদ্ধ চলারই কথা ছিলো। কারণ এখানকার মুসলিমরা তো পাকিস্তানের পর আবারও ইন্ডিয়ার অধীনতা নতুন করে মেনে নেবে না। আর তাহলে তো যুদ্ধ চলারই কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তো গেল অন্যদিকে।
শান্তনু চ্যাটার্জি বললেন, তুমি যেটা ভেবেছো, সেটা কখনোই সঠিক ভাবনা ছিলোনা অমল। অমল ভট্টাচার্যও শান্তনু চ্যাটার্জির এ কথার পাল্টা কিছুই আর বললেন না। শুধু বললেন, শুনো শান্তনু আমার কিন্তু ৭১-এ বাঁচার কোনো কথাই ছিলো না। তখন একদিন বিকেলে আমি ছিলাম বাজারে। বাজারে। আর বাজারে এসে পাকিস্তানী আর্মি ঠিক আমাকেই বললো‘কমল স্যারকা ব্যাটা অমলবাবু কাঁহা হ্যায়? আমি বুঝে নিলাম, ওরা আমাকেই খুঁজছে। কিন্তু আমি তো উর্দু জানি না। তবু বললাম, কমল স্যারকা ব্যাটা অমলবাবু তো গোমতি নদী কি ধার
হ্যায়, ইধার ছিলেন? লেকিন চাল গিয়া।’অমলবাবুর খোঁজে আর্মি চলে গেল গোমতি নদীর দিকে। আর আমি এই সুযোগে পালালাম। মনে মনে ওদের গাল দিলাম, তুমহারা সারা দেশমে হামকো মার দিয়া, আর হাম তুমলোগকো ... । পরে শুনেছি ওই পাক আর্মি অফিসারকে আমার নাম বলে দিয়েছিলো আমাদের এলাকারই তারিক্কা রাজাকার। আর কী আশ্চর্য, ওই হারামী পাকিস্তানী আর্মি অফিসারেরও নাম ছিলো তারেকই। তার পদবী ছিলো ক্যাপ্টেন। ভাগ্য ভালো আমাদের পরিবারের সবাই এর আগেই ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলো। সেদিন যে আমি বাড়ি আর বাজার থেকে পালিয়ে গেলাম, পুরা এক মাস আর বাড়িতে ফিরি নাই। তখন আমাকে এই গোমতি নদীর ওপারের নুরুল হুদার বাপ-দাদারাই তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। নুরুল হুদার বাপ মইনুল হুদা আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। এখন সরকারী চাকরি করেন। আর আমি করি মাস্টারী।

৯| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৭

জসীম অসীম বলেছেন: মিডিয়ার নিরপেক্ষতার ওপর আমার কোনো আস্থা নেই
জসীম উদ্দিন অসীম:
মিডিয়ার নিরপেক্ষতার ওপর আমার কোনো আস্থা নেই। সবার কাগজ এবং টেলিভিশনই গোষ্ঠীবদ্ধ। কোন না কোন রাজনৈতিক-পুঁজিতান্ত্রিক নেতাকে বা নেতৃবৃন্দকে দেয়া তেলে তৈলাক্ত। এ থেকে যেন কারোরই মুক্তি নেই। কোথায় আজ নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা? আজ থেকে অনেক বছর আগে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের প্রখ্যাত টিভি সাংবাদিক নঈম নিজাম যখন এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর, তখন আমার এক আত্মীয় ওই চ্যানেলে আমার জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করার কথা বললে আমি তাঁকে বলি, ভাই আমার দ্বারা আর কোনো সাংবাদিকতাই হবে না। কারণ আমার যাবতীয় অযোগ্যতার কথা স্বীকার করেও বলছি, সাংবাদিকতার যে, রূপ আমি দেখে ফেলেছি, তাই হবে না। উপরেও না, নিচেও না। টি.ভি চ্যানেলেও না, পত্রিকায়ও না। কুমিল্লায়ও না, ঢাকায়ও না। আরও কারণ অনেক সাংবাদিকের ‘কেনা গোলাম’ হওয়ার চরিত্রটা আমার কাছে কখনোই ভালো লাগে না। সুতরাং মাস-মিডিয়ায় আর চাকুরির চেষ্টা করবো না। ... । তারও অনেকদিন পর আমার আরেক বন্ধু যখন বিটিভি ছেড়ে আরেকটিভি-তে যোগ দিলো, তখনও সে আমার জন্য চাকুরির চেষ্টা করেছে। তখন আমি কুমিল্লার দৈনিক শিরোনাম পত্রিকার চাকুরি ছেড়ে বেকার। কিন্তু আমি বন্ধুকে বলি, আমি একজন অক্ষম লোক ভাই, মাস-মিডিয়ায় সক্ষম হওয়ার কোনো যোগ্যতা বা সম্ভাবনাই আমার নেই। তাছাড়া আমি অন্ধের মতো সাংবাদিক নেতাদের আত্মসমর্পণকে মেনে নিতে পারি না। তার কিছুদিন পরই 2003 সালের 3 জুলাই হোটেল সোনারগাঁও-য়ে সুইচ অন করে সেই টিভি-র সম্প্রচার উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের তখনকার রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ।
(পুরনো দিনলিপি থেকে)

১০| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ২:৩০

জসীম অসীম বলেছেন: (কবিতা)
সুষমা এক্সপ্রেস ট্রেন

জসীম উদ্দিন অসীম
মার্চ ১৯৯৭,
পশ্চিম চান্দপুর, কুমিল্লা।

সুষমা কি পড়তো কখনো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে?
না।
তবে কি সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী ছিলো!
নাকি সে লাল ভেটভেট কাপড়ে মোড়া
জুতো পরে আসতো একদা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে!

সুষমা কি রুশপন্থী ছিলো?
সে নাকি প্রতিদিনই বীরপুরুষের হৃদয় করতো হরণ।
তার দেখা না পেলেই অতিমাত্রার ঘুমের ওষুধ খেয়ে
অজ্ঞান হতো কতো যুবরাজ
সুষমার উন্নত বক্ষের পুষ্ট টানে
কবি জীবনানন্দ দাশ কলকাতার ট্রামের নিচে
ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশ্চিতভাবেই আত্মহত্যা করেন।

সুষমার লাগানো আগুন
খবর পেলেও নেভাতে পারে না
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।
এসব কথা কেউ না জানুক
শাপলা-কলমি-তিলাঘুঘু
বাজারের তেল-লবণ- পেঁয়াজ-লবঙ্গও জানে।

তাই সেই সুষমার নামে রেলওয়ে আজ চালু করেছে
সুষমা এক্সপ্রেস ট্রেন।
সরকারের রেলওয়ে বিভাগ কি
সুষমাকে ভালোবেসেছিলো?
============
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।

১১| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৩:১৯

জসীম অসীম বলেছেন: আমার বাঁশি খেলনা
জসীম উদ্দিন অসীম:
ডিসেম্বর ২০০৬, মিলন্তিকা,
ঠাকুরপাড়া, কুমিল্লা।

একদিন সন্ধ্যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হীরার খনির সন্ধানে’ গল্পটি পড়ে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। তখনও কোথাও শুনিনি আমি ‘টাইটানিক’ জাহাজ ডুবির গল্প। বয়স তখন পনেরো আমার। ঠিক তখনই আমি টুকিটাকি গল্প লেখা শুরু করি। তবে আমার বুকের ভিতর শওকত ওসমানের ‘বাঁশির আদর’ গল্পটি অতি যত্ম করে রাখা। ওই গল্পের গহর-জহরের বাপ নুরালির জন্য তখন আমার ভীষণ কান্না পেতো। গহর-জহরের মা মারা গেছে। কিন্তু গল্পের শেষে যখন নুরালি মিঞা বলে, ‘গহর বা-জান, অহন অন্য কাম করমু আর বাঁশি খেলনা বানামু না এবং মট মট শব্দে বাঁশি ভাঙতে শুরু করে, তখনও বুঝিনি যে, বড় হয়ে কোনোদিন আমিও ওই বাঁশি খেলনাই বানামু আর প্রতিদিন এভাবে ভাতের কষ্ট পামু। আমার এই বাঁশি খেলনার নাম: অবশ্যই লেখালেখি।

১২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: পুরনো দিনলিপি থেকে:
দু:খজনক
জসীম উদ্দিন অসীম:

আমি যখনই কোনো পত্রিকায় লেখা দিয়েছি, ওই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বলেছেন, আমি নাকি লেখা দিয়ে বিপ্লব করতে চাই। কেউ কেউ আমাকে কখনো কোনো প্রকারের লেখক...সাংবাদিক বলেও স্বীকার করতে চাননি। কোনো কোনো সম্পাদক লেখা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন...এমনও ঘটেছে। কেউ কেউ আবার লেখা না ছেপে লেখা হারিয়ে ফেলেছেন বলেও পরে জবাব দিয়ছেন। কিছুদিন আগে কুমিল্লার আওয়ামী ধারার একটি স্থানীয় পত্রিকাকে একটি লেখা দিয়েছিলাম। লেখার শিরোনাম ছিল: ‘‘মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, আর্মি নামলে কী কী কারণে আত্মগোপন করেন।’’ লেখাটিতে সত্যতা যাচাই করা অনেক তথ্যও ছিল। কিন্তু সেই লেখা ছাপাও হয়নি, এমনকি লেখাও পরে আর ফেরৎ পাইনি। দু:খজনক।

১৩| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: পুরনো দিনলিপি থেকে:
শুরুতে ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার দাম ছিল ২ টাকা
জসীম উদ্দিন অসীম:

‘দৈনিক আমাদের সময়ে’র সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান একবার বলেন, শুরুতে আমাদের সময়’ পত্রিকার দাম ছিল ২ টাকা। পত্রিকা তখন ছিল সাদাকালো। পাঠকের আগ্রহে এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কিছুদিন পরই পত্রিকা চার রঙে ছাপা হতে থাকে। খরচ বৃদ্ধি নিয়ে বেসামাল অবস্থায় পড়ে গেলাম। তার কিছুদিন পরই নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়ে গেল টনপ্রতি 10 হাজার টাকা করে অর্থাৎ কেজিতে বেড়ে যায় 10 টাকা। তখন পত্রিকা চালাতে পারবো কী না, এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম...।’

পেশাগত সাংবাদিকদের এমন ক্রান্তিলগ্নে বাজারী পত্রিকার মালিকরা এই সংকটকে আরও তীব্রতর করে দিলো। তারও পরে তো দেখা গেলো বাংলাদেশের কাগজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর/ কোম্পানীগুলোরও কেউ কেউ পত্রিকা ব্যবসায় চলে এলো। যেমন-বসুন্ধরা গ্রুপের দৈনিক কালের কন্ঠ...বাংলাদেশ প্রতিদিন...ইত্যাদি পত্রিকা। তাহলে পেশাগত সাংবাদিকদের প্রতিযোগিতা কি আরও তীব্র হয়ে গেল না?

১৪| ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১:১৬

জসীম অসীম বলেছেন: পুরনো দিনলিপি থেকে:
অযাচিত সাংবদিকের সংখ্যা বেড়েছে
প্রকৃত সাংবাদিকতাকে ব্যাহত করার জন্যই
জসীম উদ্দিন অসীম:

সব যুগেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ তৈলবাজ সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে তৈলমর্দন করেন। আর সাংবাদিকদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকেন এসব অযাচিত তৈলবাজ সাংবাদিকগণ। তৈলবাজগণ ন্যায়ের পক্ষে মুখ খুলতেই চান না। আজকাল যে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পত্রিকা বা অনলাইন ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, অযাচিত সম্পাদক ও সাংবদিকের সংখ্যা বেড়েছে, তা মূলত প্রকৃত সাংবাদিকতার গতিকে ব্যাহত করার জন্যই। বিপ্লবকে ব্যাহত করে যেমন প্রতিবিপ্লব, তেমনি সাংবাদিকতা বা জার্নালিজমকেও ধ্বংস করে কাউন্টার জার্নালিজম...যা এখন চলছে। এই কাউন্টার জার্নালিস্টদের পত্রিকা বা তাদের যে কোনো গণমাধ্যম তাই হয় প্রচারপত্র...কখনো বা পোস্টার...লিফলেট। তা না হলে বর্তমান পত্রিকার বা অন্যান্য গণমাধ্যমের এমন সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পত্রিকার কিংবা বা অন্যান্য গণমাধ্যমের সাংবাদিকতার মান বাড়ছে না কেন? এ লক্ষণ তো আজকাল ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন ও প্রিন্ট সংবাদ মাধ্যম...সর্বক্ষেত্রেই বিরাজমান। এটা কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ নয়, যেমন শুভ লক্ষণ ছিল না যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের আমলে ৪টি দৈনিকসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেখে বাংলাদেশের ২২২টি সংবাদপত্রেরই প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া।

১৫| ০৩ রা মে, ২০১৮ বিকাল ৩:২৪

জসীম অসীম বলেছেন: আজ অবধি বিভিন্ন রকম দুর্ঘটনায় আমি আমার অনেক লেখাই হারিয়েছি। এমনকি উপন্যাস ''গোমতি নদীর এপার ওপার''ও। কয়েকদিন আগে ১৩৯৭ বঙ্গাব্দে রচিত আমার একটি পত্রোপন্যাস ''পত্রপ্রবাহ'' এর একটি পর্ব পাওয়া গেছে। এই পুরো উপন্যাসটি ১৯৯৮ সালে কুমিল্লার ''সাপ্তাহিক লাকসামবার্তা'' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পুরো উপন্যাসটি এখন আর আমার সংগ্রহে নেই।

পত্রপ্রবাহ:

১ মাঘ ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ, ঢাকা।

হরি,
আমার শুভেচ্ছা নিবি, নাকি লাঠি দিয়ে আমার মাথা ভাঙ্গবি, তা জানিনা। তবে মনে হয় লাঠি দিয়ে মাথা ভাঙ্গার সম্ভাবনাই বেশি। তুই হয়তো এতক্ষণে রেগেমেগে সূর্যের মত লাল হয়ে গিয়েছিস। আর তা হওয়ারই কথা। কারণ, একে একে পাঁচটি চিঠি দিয়েও তুই আমার কাছ থেকে কোনো উত্তরই পাসনি।
হরি, তুই কি মনে করেছিস আমার মৃত্যু হয়েছে? তা না হলে এতগুলো চিঠি লিখেও উত্তর নেই কেন? ... ইত্যাদি? জানি না, এ ব্যাপারে তোর মনে কী আছে। তবে শোন আমার বড় রকমের এক অসুখ হয়েছিল। মৃত্যু মহাশয় আমার বাড়িতে প্রায় এসেই গিয়েছিলেন, হয়তো বা ঘরেও। সহসা আবার মৃত্যু মহাশয়ের কী হলো, কেনই বা তার ইচ্ছেখানির পরিবর্তন হলো, সেটা তো আর আমি জানি না। তবে এটা সত্য যে, সবাই এবার আমার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। এখন শীতকাল। আর শীতকালটা এলেই আমার মনে আনন্দ লাগে এই জন্যে যে, শীত ঋতুতে বাংলাদেশের যে রূপ দেখা যায়, আমার মনে হয় পৃথিবীর কোথাও হয়তো সে রূপ আর দেখা যায় না। মাঠে মাঠে মটর, সরষের ফুল, খেজুর গাছের গলায় গলায় ঝুলন্ত মাটির কলস, সকাল বেলায় রোদ পোহানো, শীতের মেলা, ... আরও কত কী। অবশ্য শীত আমার জন্য ভয়ের থলিও নিয়ে আসে কিছুটা। ভয় এজন্যে যে, শীতের বায়ুর সঙ্গে আমার একটা বড় রকমের রোগও ভেসে আসে। প্রায় প্রতি বছরই। শৈশবে ও কৈশোরেও এ ব্যাপারটি বহাল ছিল। আজও আছে, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকতে পারে কিংবা এ নিয়মের মধ্য দিয়ে আমার একদিন মৃত্যুও হতে পারে।
যখন কিশোর ছিলাম, তখন শীতের লগ্নে যখন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতো, তখনই শুরু হতো আমার পাখি ধরার অভিযান। পাখি ধরাতে আমার কি যে আনন্দ ছিল, সেটা লিখে প্রকাশ করার যোগ্যতা আমার হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে না। একদিন পাখিকে আমি যেমন ভালোবাসতাম, আজ আমার প্রিয়তমা পার্বতীকেও তেমন ভালোবাসি। আমি ছোট ছিলাম, তখন আমি পাখি কিংবা পাখির ছানা ধরলে মা আমাকে বকতেন, মারতেন কিংবা । আমার ধরা পাখির ছানা পুনরায় ছেড়ে দিতেন। আর আমার অসুখ হলেও তিনি বলতেন, পাখিদের অভিশাপের ফসল রূপেই নাকি আমার এ অসুখ। মায়ের কথা শুনে রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে আমি আর কখনো পাখির ছানা ধরবো না বলে শপথও করতাম। কিন্তু যেই আমার রোগ বা অসুখ শেষ হতো, সেই আবার ঐ অভিযান পুরোদমেই চলতো। আমার আজও মনে আছে যে, আমি কোন নতুন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও সেখানে গিয়ে গাছে গাছে পাখির সন্ধানই করতাম। সে কথাও আমার স্মৃতির মঞ্চে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে যে, তখন আমাদের পাড়ার পাখিগুলোও আমাকে প্রায় চিনে ফেলেছিলো। ওরা আমাকে হাঁটতে দেখলেই কিচিরমিচির করে উঠতো। হয়তো মনে করতো, আমি ওদের বাসা আর ছানার খোঁজ করতেই বের হয়েছি।
আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, তখন পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি এক জায়গা থেকে একটি টিয়ে পাখি কিনে এনে লালনপালন করতে থাকি। কিন্তু সেটি অসুখে মরে গেলে আমার বুকে ব্যথার শেল বিঁধে। এর একদিন পর আমাদের বাড়িরই কাশেম ভাইয়ের ছেলে খায়েরের কাছ থেকে আর একটি বড়সড় আকারের টিয়ে পাখি কিনে এনে লালনপালন করতে থাকি। একদিন টিয়ে পাখিটাকে ঘরের মধ্যে একটি খাঁচায় রেখে বিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে যাই। কিন্তু পরীক্ষা শেষে বাসায় ফেরার সময় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ি। তারপর? তারপর আর খবর নেই আমার। অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখলাম শুয়ে আছি কোনো এক সরকারি হাসপাতালের কোলে। একসময় সুস্থ হয়ে বাড়ি আসার ফেরার পর মা বললেন, মুক্ত পাখিকে বন্দী রাখার ফলই নাকি আমার এ দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া। মায়ের এ মন্তব্য আমি মানতে পারিনি। তাই, আমি মাকে বললাম, তবে কি এ গাড়ির সব যাত্রীই আমার মত মুক্ত পাখিকে বন্দী করেছিল? মা বললেন, পাখি বন্দী না করলেও হয়তো অন্য কোন দোষ করেছে কিংবা তোর জন্যই সবার বিপদ হয়েছে। কারণ একের দোষেও তো দশের বিপদ হতে পারে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আর বাবাও মায়ের কথায় বিশ্বাস এনে আমার সেই সোনার টিয়ে পাখিটা ছেড়ে দিলেন। আমার মনে হলো, টিয়ে পাখিটা নয়, আমার হৃদয়টাই যেন ঘর থেকে বের হয়ে আকাপশে মিলিয়ে গেল। নীরবে সব কষ্ট সহ্য করলাম। এমনকি কোনো প্রতিবাদও করলাম না। কারণ তখনও আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠিনি। আর পাখির প্রতি সেই ভালোবাসা আমার আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে অতীতের মতো এখন আমি পাখি বন্দী করি না। এখন আমি বিশ্বাস করি পাখিকে বন্দী না করেও তাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসা যায়।
হরি,
দ্যাখ, কী লিখতে গিয়ে কী লিখে ফেলেছি। মাথাটাও প্রায় খারাপের মতই হয়ে গেল যেন। নানান কথা লিখতে ইচ্ছে করে। এদিকে যা শীত। রাত্রতো বোধ হয় একটা বাজবে। সুতরাং শীতটা কেমন লাগে, তুই মাঘ মাসের মধ্য রাতে বসে বসে চিঠি লিখলেই টের পেতি। কথায় বলে, মাঘের শীত, বাঘের গায়েও লাগে। সেখানে শীতের তীব্রতায় আমি পাথর হবো না কেন? এবার পত্র নৌকোর মোড় ঘুরাই তোরই বাড়ির দিকে।
হরি,
তুই লিখেছিস, তুই নাকি হিন্দু মুসলিমকে সহোদর ভাইয়ে পরিণত করার লক্ষ্যে ‘সহোদর সংঘ’ গড়ে তুলেছিস। আসলে এটা করার জন্য একদা আমিও তোকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। হয়তো তোর তা এখনো মনে আছে। অনেক আগে সংঘটা আমি আমার গ্রামেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু সংখ্যক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও সাম্প্রদায়িক গুন্ডার লাঠির ভয়ে সেটা আর তখন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে আমি কিন্তু আমার সেই আশাটাকে আজও মনে মনে অটল রেখেছি। একদিন আবার আমি আমার গ্রামে এ পরিকল্পনার বাস্তব রূপ দেব। এখন তোর উদ্যোগে এ সংঘ স্থাপিত হয়েছে শুনে এমন খুশি হয়েছি যে, তুই যদি আমাকে পূর্ণিমার চাঁদও দিয়ে দিতি, তবুও আমি তত খুশি হতাম না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তুই কতোটুকু সফল হবি, সেটাও সময়ই বলতে পারে। আমি কিন্তু হিন্দু মুসলমান সকলকেই এক চোখে দেখি। আর প্রত্যেককে যদি সমান চোখে না দেখতাম, তবে তোর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও গড়ে উঠতো না। কারণ এ সমাজের বিচারে নাকি তুই হিন্দু আর আমি মুসলমান। অথচ তোর শরীরে যা যা আছে, আমার শরীরেও তা তা রয়েছে। তোর যেমন রক্ত লাল, আমারওতো তাই। আমি আমার মায়ের গর্ভ থেকে এসেছি। কিন্তু তুই তো তোর বাবার গর্ভ থেকে জন্ম নিসনি। কেন তুই হিন্দু, আর আমি মুসলমান? কোন বৈজ্ঞানিক বিধানের কারণে এমন ভিন্ন উপাধি আমাদের? আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি। কিন্তু হিন্দু আর মুসলমানের চলাফেরায় পার্থক্য থাকতে পারে, এমন কারণ আজোও খুঁজে পাইনি। হয়তো তা ভবিষ্যতেও পাবো না। তবে লোকে আমাদেরকে যাই বলুক না কেন, আমরা উভয়ে যে মানুষ, সেটাতো আর মিথ্যে কথা নয়। এক বৃদ্ধ মুসলমান আমাকে একবার বলেছিলেন যে, তেল আর পানি দু’টোই তরল বটে। কিন্তু তাই বলে তেল পানি যেমন একত্রে মিশতে পারে না, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে মানুষ হলেও তাঁরা একত্রে মিশতে পারে না। তাঁর এ কথার উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘ আপনার এ ধারনা ভুল। কারণ তেল পানি দিয়ে হিন্দু মুসলমানের তুলনা চলে না। কারণ তেল পানি উভয়ে এক হিসেবে তরল হতে পারে, কিন্তু উভয়ের বৈশিষ্ট্য দু’ প্রকারের। তাই ওরা এক বোতলে পৃথক পৃথক থাকে। পক্ষান্তরে হিন্দু ও মুসলমানের জন্মগত বৈশিষ্ট্যও এক এবং দেহ গঠনের সকল উপাদানও এক। সুতরাং তেল পানি একত্রে মিশতে না পারলেও হিন্দু মুসলিম একত্রে মিশতে পারবে’। তারপরও যদি না মিশে, তবে সেটা মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভুল। আসলে কি জানিস, মুসলমান এবং হিন্দু সমাজে এমন এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি আছেন, যারা হিন্দু নাম শুনলে প্রায়ই থুথু ফেলার মতো ঘৃণা করেন। তাঁদের কুপ্রচারণার কারণেই বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে হিন্দু মুসলমানসহ সকল মানুষ আজও এক হতে পারেনা। অথচ মুসলমান সম্প্রদায়ের পথ প্রদর্শক হযরত মুহম্মদ (সঃ)সহ বিভিন্ন ধর্মের পথপ্রদর্শকগণও কিন্তু ভিন্ন জাতিকে এমন ঘৃণা করার নিদের্শ দিয়ে যাননি। সাম্প্রদায়িক লোক যেমন মুসলমানের মধ্যেও আছে, তেমনি সব ধর্মেই রয়েছে। তোদের হিন্দু সমাজেও এমন এক শ্রেণীর ব্যক্তি আছেন, যারা মুসলমানকে খুবই ঘৃণা করেন। কবি হেমচন্দ্র তার বীরবাহু কাব্যে, সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর আনন্দমঠে এবং রঙ্গলাল তাঁর পদ্মিনীতে মুসলমানদেরকে ভারতবর্ষ হতে তাড়িয়ে দেবার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর উত্তেজনা প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। বিভিন্ন ধর্মে আজও তেমন উত্তেজনা ছড়ানো মানুষের কমতি নেই। তোদের মধ্যে তোদের সমাজে এ বিজ্ঞানের যুগে এমন মানুষও আছেন, যাদের ঘরে মুসলমান নামের কেউ গেলেই নাকি জাত গেল বলে হাঁড়ি-পাতিলও বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। এটা কি মানবিক? আবার এখন ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই হানাহানিটা কিসের ধর্ম? মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হয় করুক। কিন্তু মসজিদ ভেঙ্গে কেন? মসজিদের স্থানটি ছাড়া সেখানে কি আর কোনো স্থানই নেই? না মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে দেবতারা বেশি খুশি হবেন? আমি তো রাধাকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য ও স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। তারা তো কোথাও কখনো এমন নির্দেশনা দিয়ে যাননি।

ভালো থাকিস।
তোরই পরম বন্ধু
অমল।

১৬| ০৩ রা মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৮

জসীম অসীম বলেছেন: লেখার বিষয়ে আমার মোটেও সাহস নেই
কারণ আমি আমার অবশিষ্ট হাড্ডিগুলোকে খুবই ভালোবাসি
জসীম উদ্দিন অসীম:
লেখার বিষয়ে আমার মোটেও সাহস নেই। আমি এক কাপুরুষ লেখক। ভীরু অথবা অপেক্ষায় আছি, ভবিষ্যতে সাহসী লেখা ছেপে দেবো, এই মনে করে। আসলে যে লিখতে পারে, এক্ষনিই পারে। ঠান্ডা মাথায় ভবিষ্যতে লেখার এবং সেই লেখা ছাপানোর কী আছে?
সেদিনের একটি ঘটনার কথা বলি: কুমিল্লা শহরের একটি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল স্টুডিওতে দু’জন লোক বসা। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। যুবক-যুবতী। স্টুডিও'র ভিতরে বসা তাঁরা প্রায় এক ঘন্টা। কী করছে? ম্যাকআপ নিচ্ছে। ছবি তুলবে। হয়তো ছবিই তুলবে। লোক দু’জনের সম্পর্ক বন্ধুত্বের। না প্রেমের, না সাংসারিক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ছেলে-মেয়ে বন্ধু। কিন্তু ওই বন্ধু দু’জনের ছবি তোলার জন্য ম্যাক-আপ আর শেষ হয় না। কয়েকদিন পর আবার ওরা আসে ছবি তুলবে বলে ওই একই স্টুডিও'তে। আবার চলে ঘন্টা খানেক সময় ধরে ওদের ম্যাক-আপ। ওরা কি ফ্যাশন শিল্পে নাম কামাতে চায়? আমার কৌতূহল কিছুটা বাড়ে। কৌতূহলের এক পর্যায়ে গিয়ে দেখিছবিটবি আসলে কিছুই না। ওই স্টুডিওওয়ালার কাছ থেকে সময় কিনে ভিতরে সময় কাটায় ওরা। কিন্তু ওদেরকে সময় ভাড়া দিয়ে ওই স্টুডিওটি কি বাকি সৎ স্টুডিও মালিকদের ইমেজের ক্ষতি করছে না? করছে। কিন্তু তারপরও আমি ওই স্টুডিও'টির নাম বলতে পারছি না এবং এটাই আমার সমস্যা। ওই স্টুডিওটি পরিচালনার সঙ্গে আমার একদার কিছু রাজনৈতিক কর্মীও জড়িত। এমন অনেক অনেক ঘটনা আমার দেখা রয়েছে। কিন্তু আমি ভাবি এসব বলতে গেলেই আমার হাড্ডিগুলো ভাঙ্গা হতে পারে। আমি আমার হাড্ডিগুলোকে আবার খুবই ভালোবাসি। শরীর চর্চা করতে করতে এবং বেকার থেকে পরিমাণের চেয়ে অনেক অল্প আহার করে করে আমার এই শরীরে মেদ-মাংস আর কিচ্ছুই রাখিনি। ওই হাড্ডিগুলোই এখন আমার সম্বল। ওই হাড্ডির মায়ায় পড়ে আমি অনেক ক্রিমিনালের নাম এবং তাঁদের কুকর্মের কথা আমি আর প্রকাশ্যে বলতে পারি না এবং সর্বশেষ এই ব্যর্থতায় সিরিয়াস পাঠকের ঘৃণা লাভ করি। জানি না-মৃত্যুর আগে কোনোদিনও আমি আমার এই হাড্ডির মায়া ত্যাগ করতে পারি কী না।
ছবি: কুমিল্লার কবি 'মাহমুদ কচি'র সঙ্গে আমি।

১৭| ০৩ রা মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৮

জসীম অসীম বলেছেন: বন্যার কন্যা এ বাংলাদেশ
জসীম উদ্দিন অসীম:
বন্যার কন্যা এ বাংলাদেশ
তাই
বাংলাদেশে বন্যা এলো বেড়াতে
বন্যা এলো তার মেয়ের বাড়িতে
নাতি-নাতনীর ভাত মারিতে
কে পারবে তাকে আজ এড়াতে ?
এমন ঘোর অভাবে আহা বন্যা এলো হায়
পানিতে সারা দেশ ডুবে গেল আজ কী হবে উপায়!
দুঃখ ক’দিন সহ্য করো বন্ধ করো কান্না
আমাদের এ বাংলা মা যে বন্যারই প্রিয় কন্যা।
প্রথম প্রকাশ:
বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ১৯৯১,
সাপ্তাহিক আমোদ,
কুমিল্লা।

১৮| ০৩ রা মে, ২০১৮ বিকাল ৫:১২

জসীম অসীম বলেছেন: ১৯৯৬ সালে লেখা আমার একটি প্রতিবেদন:
কুমিল্লায় নজরুল-রবীন্দ্র স্মৃতি সংরক্ষণে দারুণ অবহেলা
জসীম উদ্দিন অসীম:
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কুমিল্লার স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো বর্তমানে দারুণ অবহেলার শিকার। শহরের নজরুল স্মৃতিফলকগুলোও এ অবহেলা থেকে রক্ষা পায়নি। নজরুল এভিনিউ'র শর্মা ক্যামিকেলস সংলগ্ন নজরুল স্মৃতিফলকটি এখন ডাষ্টবিনে পরিণত হয়েছে। এ স্মৃতিফলকটির কয়েক হাতের মধ্যেই একসময় একটি ভাঙ্গা ডাস্টবিন ছিলো। বর্তমানে সেখানে একটি নতুন ডাষ্টবিন নিমার্ণ করা হলেও এলাকাবাসী সকাল-সন্ধ্যা নজরুল স্মৃতিফলকের চারদিক ঘিরেই ময়লা আবর্জনা ফেলে। পৌর কর্তৃপক্ষেরও সে ময়লা সরানোর বিষয়ে নিয়মিত তৎপরতা থাকে না।
নজরুলের কুমিল্লা জীবনের অন্যতম সঙ্গী সুলতান মাহমুদ মজুমদারের লেখা 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' এবং মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুসের লেখা ‘কুমিল্লায় নজরুল' নামের দু'টি বই নজরুল পরিষদ থেকে একদা প্রকাশিত হয়েছিলো। এসব বইয়ের হাজার হাজার কপি সংরক্ষণের অভাবে একসময় পোকায় নষ্ট করেছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় হলেও বাংলাদেশে নজরুলের স্মৃতিবাহী যে সকল স্থান রয়েছে, তার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কুমিল্লার নাম সবাগ্রেই। এমনকি কবি দু'টি বিয়েও করেছেন কুমিল্লাতেই।
তাঁর প্রথম বিয়ে হয় কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে। দ্বিতীয় বিয়ে হয় কুমিল্লা শহরের কান্দিরপারের আশালতা সেনগুপ্তার সাথে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কুমিল্লায় বর্তমানে নজরুল স্মৃতি অত্যন্ত অবহেলার শিকার। বিশেষ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম বিয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত কবিতীর্থ দৌলতপুরের আলী আকবর খাঁর বাড়ি, পুকুরঘাট, নজরুল নার্গিসের বাসরঘরসহ অনেক স্থান অবহেলার শিকার।
১৯২১ সালে কবি নজরুল ইসলাম নাট্যকার সাহিত্যিক আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে কলকাতা হতে বেড়াবার উদ্দেশ্যে দৌলতপুরে আসেন। তখন কবিকে কেন্দ্র করে খাঁ বাড়িতে প্রতিরাতে কবিতা-গানের আসর জমে উঠতো। কবি দৌলতপুরে রচনা করেন কবিতাসহ পত্রোপন্যাস ‘বাধন হারা'-র অংশ বিশেষ। শুধু এটাই নয়, কুমিল্লার দৌলতপুর কবির প্রথম বিয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এদিকে ।কেবল কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানই নয়, এখানকার রবীন্দ্রবিজড়িত স্থান বা স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য।
কুমিল্লায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোও খুবই অবহেলিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুমিল্লায় এসেছিলেন দু'বার। একবার ১৯০৫ সালে এবং অন্যবার ১৯২৬ সালে। কুমিল্লায় অবস্থানকালে কবি পুরনো অভয় আশ্রম, রামমালা ছাত্রাবাস, স্থানীয় টাউনহলেও অভ্যর্থনা সভায় ভাষণ দেন। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী পুরনো অভয় আশ্রমের ত্রিবাষির্ক সভায় কবি সভাপতিত্ব করেন। এসব স্থান বর্তমানে দারুণ অবহেলিত
ছবি: কুমিল্লার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই একই সঙ্গে রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী দীপা সিনহা।

১৯| ০৩ রা মে, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৯

জসীম অসীম বলেছেন: ২০০০ সালে কুমিল্লার 'সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ' পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ
উল্লাহর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিল ফারজানা কবির ঈশিতা। ঈশিতা তখন আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। ‘সুকান্ত’ নামে তখন তার একটি সাহিত্যের কাগজ করারও কথা ছিল। সেই কাগজের জন্য সে তখন কুমিল্লার অনেক লেখকের কাছ থেকেও কবিতা-গল্প সংগ্রহ করেছিল। কুমিল্লার আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোতে কবিতা-গল্প-প্রতিবেদনসহ একটু-আধটু লেখালেখিও করছিল। তাঁর সেই 'সুকান্ত' পত্রিকার জন্যই সে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ উল্লাহর এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিল। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মতান্তর-পথান্তরের কারণে ঈশিতার সঙ্গে আমার সংসার ভেঙে যায়। ঈশিতার মায়ের সঙ্গে রাগ করে একদিন যে আমি আমার সংসার ছেড়ে বের হয়ে আসি, আর তাদের সবার শত অনুরোধেও ফিরে যাইনি ঘরে। বরাবরই চরমপন্থায় বিশ্বাসী ছিলাম আমি। কখনোই মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে পারিনি। এমনকি একসময় ছেড়ে দিলাম সব রাজনীতিই। শ্রদ্ধাভাজন রাজনৈতিক গুরুরা আমার চোখে হয়ে উঠেন আপোষবাদী লম্পট। দুঃখে-ক্ষোভে-হতাশায় ক্রমাগতই সব বিশ্বাস ভেঙে গেল আমার। যেমন করে চোখের সামনেই একদা ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
২০০২ সালের ১ অক্টোবর মোহাম্মদ উল্লাহ মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত তখন তিনি আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকতেন। তার মৃত্যুর পরও ঈশিতার নেয়া এ সাক্ষাৎকারটি আমি কোথাও ছাপাতে দেইনি। এ সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ উল্লাহর জীবনের অনেক অজানা তথ্যই উঠে এসেছে। ঈশিতার হাতে লেখা মূল পান্ডুলিপিটি রয়েছে আমার ব্যক্তিগত সংরক্ষণাগারে। আশ্চর্যজনক হলো যে ওই 'সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ' পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ
উল্লাহর বড় কন্যা সাদিয়া পলি'র সঙ্গেই আবার আমার সাংসারিক জীবন গড়ে উঠে।
ঈশিতা: আপনি তো একজন পত্রিকার সম্পাদক। বয়সেও প্রবীণ। এখন থেকে অনেক বছর আগেও বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী আখতার হামিদ খানের সমবায়ীদের পত্রিকা ‘সমযাত্রা’র প্রথম সম্পাদক ছিলেন। ঠিক কখন আপনি পত্রিকা পড়া শুরু করেন এবং সেটা ছিল কোন পত্রিকা?
মোহাম্মদ উল্লাহ: ১৯৫১ সাল। সেকালে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অন্ধকার যুগে একটি বাংলা শব্দ ‘সংবাদ’ নাম ধারণ করে বের হলো 'দৈনিক সংবাদ'। আমার বয়স তখন ২১ বছর। মূলত সেই পত্রিকা দিয়েই আমার সিরিয়াসলি পত্রিকা পড়া শুরু।
ঈশিতা: তখন তো আপনি ছাত্র। আমি শুনেছি তখন আপনি রাজনীতিও করতেন।
মোহাম্মদ উল্লাহ: হ্যাঁ। ছাত্র ছিলাম। রাজনীতিও করতাম। ছাত্র আন্দোলনে আমি একজন ক্ষুদ্র কর্মী ছিলাম। তখনও পর্যন্ত আমাদের কর্মের সীমানা ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের চার দেয়ালের সীমানায় সীমাবদ্ধ। আমরা তখন যাবতীয় অন্ধকার বিরোধী কাজকর্ম শুরু করেছিলাম। আমাদের ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (ডিএসএফ) এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ। তারপর ত্রিপুরা [বৃহত্তর কুমিল্লা] যুবলীগ শাখা গঠিত হল। আমার সেসব কর্মকান্ডের কোনো সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা কাগজে খুব কমই ছাপা হতো।
ঈশিতা: আপনার কথায় বারবার 'সংবাদ' পত্রিকার কথা উঠে আসছে কেন?
মোহাম্মদ উল্লাহ: ১৯৫১ সনের মে মাসে মুসলিমলীগ নেতৃত্বের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদ। যেহেতু আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অন্ধ অনুসরণ করতাম না, সেহেতু প্রথম প্রথম আমরা 'সংবাদ' সম্পর্কে তেমন উৎসাহী ছিলাম না। কিন্তু ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন আমাকে ত্রিপুরা জেলার যুবলীগ শাখার সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়, এ সংবাদটি তখনকার 'সংবাদ' এ ছাপা হয়েছিল। তাছাড়া জেলা যুবলীগের অনেক সংবাদও এ পত্রিকায় ছাপা হতো।
ঈশিতা: কিভাবে আপনি এমন 'সংবাদ' পত্রিকার ভক্ত হয়ে গেলেন?
মোহাম্মদ উল্লাহ: আমরা আসলে সংবাদ পাঠ করতাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের পাঠকক্ষে বসেই। একসময় লক্ষ্য করলাম যে মুসলিম লীগারদের এই দৈনিকটিতে ব্যতিক্রম অনেক বিষয় রয়েছে। মূলত আমাদের নীতি আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ লেখালেখি দেখেই 'সংবাদ' বেশি পড়তাম এবং এভাবেই একসময় 'সংবাদ' পত্রিকাটি আমার প্রিয় হয়ে উঠে।
ঈশিতা: আচ্ছা সংবাদ পত্রিকা ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকার গল্প কি কিছু মনে পড়ে?
মোহাম্মদ উল্লাহ: না। জেলা যুবলীগের সম্পাদক হিসেবে আমি 'দৈনিক সংবাদ' এ আমার সংগঠনের খবর পাঠাতাম। তখন মূলত ভাষা আন্দোলনের লগ্ন। প্রায়ই সংবাদ অফিসে চলে যেতাম। কখনো কখনো অনেক রাত করে যেতাম। কতোবার যে রাতের বেলা অফিসের মেঝেয় কাগজ বিছিয়ে থেকেছি। তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 'দৈনিক সংবাদ' এ কাজ করতেন।
ঈশিতা: রাজনীতি তো করতেন। জেল খেটেছেন কখনো?
মোহাম্মদ উল্লাহ: অবশ্যই। আমরা তো আর স্বার্থের রাজনীতি করিনি। দেশের জন্য রাজনীতি করতাম। তখন দেশের জন্য জেল খাটতে পারলে বীরের মর্যাদা পাওয়া যেত।

২০| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ রাত ৮:৩১

জসীম অসীম বলেছেন:
মা মালতী
মা তাবাস্সুম
জসীম উদ্দিন অসীম

খড়ের গাদার পাশেই এমন সুন্দরী মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলো বাইশ বছরের যুবক বারেক। যাকে অনেকেই বলে ‘বারিক্কা’। হিন্দু মেয়েরা এতো সুন্দরী হয় কিভাবে? বারেক মনে মনে ভাবে। অবশ্য মেয়েটির যে বাড়ি, তার সবটাই বাঁশঝাড়ে ও অন্যান্য বৃক্ষে ঢাকা। রোদ ওই বাড়িতে দুপুরেও তেমন যেতে পারে না।
মেয়েটির নাম মালতী। মালতীকে বারেক দ্বিতীয়বার দেখেছিলো ওদেরই পদ্মপুকুরে জল নেওয়ার সময়। একা একা পুকুরঘাটে এসে জল নিয়ে যায় মালতী। দূরের ঝোপে লুকানো বারেককে একটুও দেখতে পায় না। পাশের গ্রামের এক পেশাদার দুষ্কৃতকারী রাজনীতি করা লোক ফরাজীর দলে আছে এই বারেক। তার চোখে মালতীর মতো যুবতী নারী পড়ে যাওয়া আর তার জানের-মানের-প্রাণের নিরাপত্তা না থাকা...ওই একই কথা।
মালতীদের গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যা হলে গহিন হয়ে যায় পুরো বাড়ি। বাবা এতোদিন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলা’র শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অসুস্থ। ১০ বছর আগে তার হার্টে রিং বসানো হয়েছে। বর্তমানেও হার্টের বøকেজ ধরা পড়েছে। আরো দুইটি রিং বসাতে হবে।
মালতীদের সারাবাড়ি চালতা গাছেও ভরপুর। ভারতের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ এলাকায় ১৯৯২ সালে রামমন্দির তৈরি করা নিয়ে সৃষ্ট দাঙ্গার জের হিসেবে তাদের বাড়ির চালতাগাছেও দুর্বৃত্তদের দায়ের কোপ পড়েছিলো। ওই ঘটনার পর থেকে মালতীর বাবা আর কোনো জাতীয় নির্বাচনেই ভোট দিতে যাননি। মালতীর দিদি কল্পনা রায় সেই ঘটনার পর থেকেই ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা। আর এক কাকা আছেন। চাকুরি করেন ঢাকায়। টিকাটুলির কে এম দাস লেনে। তিনি কখনো কখনো কল্পনাকে ভারতে গিয়ে দেখে আসেন এবং দেশে এসে চোখের জলে কল্পনার ওখানকার গল্প বলেন। মালতীও তার সেই দিদির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয় তার বান্ধবী তাবাস্সুমের কাছে।
মালতীদের পদ্মপুকুরে অনেক কচ্ছপ। বাচ্চা কচ্ছপগুলো মা কচ্ছপের পিঠে বসে থাকে। এসব দেখতে দেখতে বারেক ভাবে, হিন্দুরা কেন কচ্ছপের মাংস খায়? থুথু ফেলে বারেক। ‘ওয়াক’ করে ওঠে। এতো সুন্দরী মালতী। সেও কি কচ্ছপের মাংস খায়?
হঠাৎই মালতীদের প্রতিবেশী পরান বাবুর চোখে পড়ে বারেককে। জোর গলায় বলে, তুই ওখানে কী করস বারিক্কা? বারেকের সারা শরীরে বিরাট এক কম্পন হয়। বলে, পরান কাকু, আমার পোষা ডুহিটা (ঘুঘুটা) খাঁচা থেকে বাহির হইয়া তোমরার বাঁশবনে ঢুকছে। ততোক্ষণে পরানের বড় দাদা নীরদবাবুও বারেককে দেখতে পায়। বারেককে বলে, তুমি আবার ডুহি পালছিলা কবে? আর তোমার ডুহি সাত বাড়ি পার হইয়া কল্পনারার বাড়ির বাঁশবনে আইছে, কেমনে বুঝলা? বারেক বলে, আলমগীর কইছে। সে নাকি লাকরি খোঁজতে আইয়া দেখছে। নীরদবাবু গম্ভীরকন্ঠে বারেককে বলে, বাড়িত যাওÑ বাড়িত যাও। বনে-বাদাড়ে ঘুইরো না। রূপকথার পইখা (পাখি) ভূতের কথা হুনছো যে, ওই বাদামী বুন্যা ফল গাছটায় একটা থাহে। রাইতে যেমনে ডাহে, হুনলে আর হিন্দুবাড়ির ধারেকাছে আসতা না।
এই কথার পর বারেক বড়দিঘির পাড় ধরে চলে যায়। পরান আর নীরদবাবুকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসেন বৃদ্ধ রমাকান্ত চক্রবর্তী। জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে? পরান উত্তর দেয়, মালতীর দিকে চোখ পড়ছে ল্যাবরেটরী বাড়ির মনসুরের ভাতিজা বারিক্কার। মনসুরের বড় ভাইটাইতো মুুক্তিযুদ্ধের সময় শম্ভুর বইনেরে পাকিস্তানী আর্মির হাতে তুইল্যা দিছিলো। নীরদ বলে, শুধু কি বইনেরে? জয়ন্তরে মারছে। সোমেশ পালাইয়া বাঁচছে। মুকুলদের ঘরে আগুন দিছে। ভাবছিলো, দেশটা পাকিস্তানই থাকবো। রমাকান্ত বলেন, বাংলাদেশ হইছে বইলা এতো খুশির কিছু নাই। রাজাকাররা আর তাদের সন্তানেরা তো এই দেশেই আছে। ভালোই আছে। তবে হ্যাঁ,মনসুরের এক মামা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। সেই রফিক মামা যুদ্ধের সময় আমাকে এক বড় বিপদ থেকেই উদ্ধার করেছিলেন। এমন সময় আলাপে এসে শরীক হোন চুনীলাল। চুনী রমাকান্তের ছোট ভাই। সব শুনে চুনীলাল বলেন, মালতীর বাবা লক্ষণবাবুর শরীরটাও খুব ভালো নাই। তার মা কৃষ্ণা বৌদিও অল্প বয়সে মরলো। এর মধ্যে বারিক্কার চোখ পড়েছে মালতীর দিকে। খবরটা আবার লক্ষণরেও জানানো যাবে না। তার হার্টের অসুখ। শুনছি, বারিক্কার লগে সবসময় একটা ছুরিও থাহে। এ তো মস্ত ঝামেলার কথা। তাই মালতীর জ্যাঠাতো ভাই অসিতকে সব জানানো দরকার। মালতী আর বারেকের এই আলোচনা একসময় শেষ হয় এবং সবাই যে যার বাড়িতে চলে যায়।
কিন্তু...
তারা যে দেখেছিলেন বড় দিঘির পাড় ধরে বারেক চলে গেছে, আসলে যায়নি সে। অন্যপথে ঘুরে এসে ওই একই ঝোপে লুকিয়ে সে সবার কথাই শুনেছে। সবাইকে চিনেও নিয়েছে। তাতে তার মাথায় রক্ত চড়ে বসে। এই ধরনের ঘটনা ঘটলে হলে সে রীতিমত উন্মাদ হয়ে যায়। লোকে এসব জানে। তাই অনেকে তার সুন্দর নামটাকে বিকৃত করে ডাকে ‘বারিক্কা’। অথচ তার দুই বাড়ি পরে আরেক বারেককে লোকে ঠিকই বারেক বলেই ডাকে। তাকে বলে ‘বারিক্কা’।
বারিক্কার স্কুলে এক হিন্দু সহপাঠি ছিলো। নিত্য। নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দকে প্রায়ই মনে পড়ে বারিক্কার। এখন আর নিত্যের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই নেই। হঠাৎ বারেক বাঁশবনে কয়েকটি পেঁচা দেখতে পায়। সে নিষ্ঠুর হলেও পেঁচাকে ভয় করে। কারণ সে মনে করে ভূতেরাই দিনে পেঁচার রূপ ধরে। অথচ এটিকে হিন্দুরা তাদের সম্পদের দেবী লক্ষীর বাহন মনে করে। হিন্দুদের সে মোটেও দেখতে পারে না। কিন্তু শরৎকালে দুর্গাপূজার সময় হিন্দুপাড়াগুলোতে অবিকল দুর্গাদেবীর মতো সুন্দরী যুবতীদের যে ঢল নামে, তাদের দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। পার্থক্য শুধু এই দুর্গাদেবীর হাত দশটি। আর হিন্দু মেয়েদের দুটি করে মানুষের মতোই হাত। দুর্গাদেবীর কেন দশটি হাত, তার রহস্য কখনোই উন্মোচন করতে পারেনি বারিক্কা। যদিও তার সহপাঠি ছিলো নিত্যানন্দ, তার কাছেও সব প্রশ্নের উত্তর ছিলো না। নিত্যানন্দও বারিক্কার মতো খারাপ ছাত্রই ছিলো। দুর্গার হাতে কেন এতো অস্ত্র, সিংহের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক কিংবা বিদ্যাদেবী সরস্বতী কেন রাজহংসের পিঠে দাঁড়িয়ে থাকেন, এসব বারেক জানে না। জানতে চায় না এবং সবশেষে বিশ্বাসও করে না। বরং সে এসব নিয়ে মজাও করে। সহপাঠি নিত্যকে সে বলতো, ইন্ডিয়া যদি সব গরু আমাদের ফ্রি দিতো, তাহলে আমরাও সব কচ্ছপ ওদের ফ্রি দিয়ে দিতাম। নিত্য এসব কথা শুনে মুচকি হাসতো। নবম শ্রেণির বাংলার শিক্ষক অবনীবাবু কখনো কখনো ক্লাস শেষে মহাভারতের কথা বলতেন। অবনীবাবুর বাড়ি ছিলো অজন্তাপুর। কিন্তু এই পান্ডব আর কৌরবদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনী শুনতে কখনোই ভালো লাগেনি বারিক্কার। ভালো তার অনেক কিছুই লাগেনা। ভালো লাগে না লোকাল ট্রেন। ভালো লাগে না পুলিশ। হাতকড়া। তবে পিস্তলকে সে খুবই ভালোবাসে। যদিও এ বস্তুটি তার নেই। একটি পিস্তলের মালিক হতে তার খুবই ইচ্ছে করে। এবার সেটা যে কোনোভাবেই হোক না কেন। আর ভালো লাগে মধুসূদন বাবুর পরমাসুন্দরী কন্যা রোহিণীকে এবং অবশেষে তার আজই ভালো লেগে গেলো লক্ষণবাবুর মেয়ে মালতীকে।
এই রোহিণী কিংবা মালতীদের সে কিভাবে শিকার করবে? অবশ্য তার গুরু ফরাজীর কাছে এটা কোনো বিষয়ই নয়। তবু ফরাজীকে আপাতত এ খবর বলতে চায় না বারিক্কা। কারণ ? ফরাজী বলে, মহিলাদের হাতের বেলোয়াড়ি চুড়ি যা, পুরুষদের হাতে পুলিশের হ্যান্ডকাফ বা হাতকড়াও তা। ফরাজীর দুর্ধর্ষ ক্যাডাররাও মদ্যপ অবস্থায় অনেক জায়গা থেকে চাঁদা তুলে আনতে পারে। কিন্তু একা বারিক্কার এতো সাহস নেই। ফরাজীর কথা হলো ‘মানুষের একমাত্র সাহসটাই হলো পুঁজি’। আর বারিক্কাও জানে বাংলাদেশের অনেক হিন্দুর ওই একটি জিনিসই নেই, আর তা হলো সেই সা...হ...স। এরা কোনো বড় ক্ষতি হয়ে গেলে ইন্ডিয়া পালায়, ছোট ক্ষতি হলে প্রতিবাদ বা মানববন্ধন অথবা মামলা-মোকদ্দমা এ জাতীয় কিছু করে। এর বেশি আর কিছু নয়।
বারিক্কা কিছুদিন বেবীট্যাক্সি চালাতো। এখন ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে ফরাজীর কাজ করে কিছু টাকা পায়। ফরাজী আজ বারিক্কাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো শিবাশিস বাবুর বাড়িটার একটু খবর নিতে। বাড়ির নিচেই যে জমিটা, তার সঙ্গে ফরাজীর এক লোকের জমি। শিবাশিস আর প্রিতমরা দীর্ঘদিন এ জমি নিয়ে বিরোধ করছে, যদিও মামলায় এখনও যায়নি তারা। এখন এই জমি জালিয়াতি করার চিন্তা করছে ফরাজী। এর আগেও সে আরেকবার হিন্দুর জমি জালিয়াতি করে বিক্রি করে দিয়েছে। তাই এখন শিবাশিসের জমি নেওয়ার সাহস দেখাচ্ছে। ফরাজীর গিলে খাওয়া ওই জমি ছিলো সিদ্ধার্থের। জমি কি হিন্দুর না মুসলমানের ওটা আসলে ফরাজীর কাছে কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো ফাঁক পেলে সে তার আপন ভাইয়ের জমিটাও গিলে খাবে। এমনই অমানুষ আর অর্থপিশাচ সে। সিদ্ধার্থের জমিটি হজম করে শহরে পাঁচ শতক জায়গা কিনে বাড়ি করেছে ফরাজী। সিদ্ধার্থও নিজ জমি উদ্ধারের খুব চেষ্টা করেনি। কারণ তার বউ আর দুই মেয়ে আগুনে পুড়ে আগেই মারা গিয়েছিলো। কান্তমণি ডিগ্রি কলেজের একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলো তার দুই মেয়ে। রাত তিনটার দিকে গোয়ালঘরের মশা তাড়ানোর ধোঁয়ার কুন্ডলী থেকেই নাকি সেই আগুনের সূত্রপাত। আবার সেই ঘটনার রাতে কী এক কাজে সিদ্ধার্থ ছিলো শহরে। অগ্নিদগ্ধ মা-মেয়েদের মনমোহন ও ফুলমতিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত নিয়েছিলো। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। পরদিন সিদ্ধার্থ শহর থেকে ফিরে এসে তার জীবনের শেষ কান্না কেঁদেছিলো। থানার এস আই এসে বাড়ি ঘুরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের কোনো গন্ধই পাননি। দুর্ঘটনার নোট নিয়ে ফেরত গিয়েছিলেন। জমি নিয়ে ফরাজীর সঙ্গে জোর চাপাচাপি করেছিলো যতীন্দ্রনাথ। বারণ করেছে সিদ্ধার্থ নিজেই। বলে, ফরাজীর বড় ভাই ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে চাকরি করে। তাদের সঙ্গে লড়ে টেকা যাবে না। ১৯৮৫ সালে একবার এই জমি নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছিলো। তখন সেটেলমেন্ট অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার জুতা ক্ষয় হয়েছিলো। এখন আর শরীরে কিংবা মনেও জোর নেই। এই কথার ঘোর বিরোধিতা করেছিলো যতীন্দ্রের ছেলে তাপসও। কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজেই হাল ছেড়ে দেয়।
অন্যদিকে বারিক্কা আজ ঘরে ফিরেনি। রান্নাঘরে সন্ধ্যায় ধনিয়া বাটাবাটি করছিলো মালতী। বিকেলে তার বাবাকে সুজি আর রুটি খেতে দিয়েছে। এখন রাতের রান্নার প্রস্তুতি। রান্নাঘরের কুপির আলোতে মালতীর দুই গালের গোলাপী ছাপ কেমন যেন মোহনীয় দেখাচ্ছে। আর দূরের ঝোপ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তা দেখে বারিক্কার বুক ধকফক করছে। অথচ সে খবর মালতীর কল্পনাতেও নেই। ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক ‘একতা’ পত্রিকা আসে মালতীর বাবার নামে। সন্ধ্যায় মালতীর বাবা তা তন্নতন্ন করে পড়বে। এখনও ঘরে বসে তিনি সেই পত্রিকাই পড়ছেন। যৌবনকালেও হ্যান্ড কম্পোজে টাইপে মুদ্রিত বিভিন্ন বই-পত্রিকা পড়তেন। অভ্যাস আজও যায়নি। ধনিয়া বাটাবাটি রেখে হাত ধুয়ে মালতী তার বাবাকে একটি ক্যাপসুল খেতে দিয়ে এসে আবারও রান্নাঘরে ঢুকে। তারপর বারিক্কা মালতীদের জবাফুলের বাগানের পেছনের ঝোঁপে এগিয়ে আসে। বাড়িটি ভীষণই নির্জনতায় ভরপুর। লুকিয়ে দেখে মালতী কেবল যে দেখতেই সুন্দরী, মুখমন্ডলই তার দেবীর মতো, তা নয়, তার শরীরের গঠনও অকল্পনীয় নজরকাড়া। মাথা ঘুরে যায় বারিক্কার। এই মেয়েকে তার চাই-ই চাই।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মালতীর পিসীর বাড়ি। পিসী আসবে দুই-তিন দিন পরে। চিঠি লিখে জানিয়েছেন। তাই মালতীর মনে এখন অনেক আনন্দ।
এদিকে বারিক্কার ধারণা ফরাজী এই মালতীর জন্য বারিক্কার হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়ার কোনো খবরই পায়নি। কিন্তু ফরাজী জানে ওই হিন্দু পাড়া দিয়ে গেলেই যে কোনো মুসলিম পুরুষেরই নারী-সংশ্রব কামনা জেগে উঠতে পারে। তাই বারিক্কাকে অনুসরণ করতে দেলোয়ারকেও পাঠিয়েছিলো। কারণ বারিক্কার নারীলিপ্সার কথা ফরাজী আগে থেকেই জানে। দেলোয়ার ফরাজীর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। ফিরে এসে দেলোয়ার ফরাজীকে বলেছে, ‘বারিক্কা কংগ্রেসবাড়ির লক্ষণ্যার মাইয়ার প্রেমে পড়ছে ভাই।’ এই কথা শুনে ফরাজীর কী উচ্চকন্ঠে হাসি।
ভারত ভাগ হওয়ার অনেক আগে লক্ষণবাবুর পিতা মোহিনীমোহন বাবু ভারতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ওই থেকে সেই বাড়ির নাম হয়ে যায় ‘কংগ্রেস বাড়ি’। কিন্তু দেশভাগের আগেই বীরভূমের একটি অনুষ্ঠান থেকে কলকাতায় ফেরার সময় মোহিনীবাবু মারা যান। মোহিনীবাবুর অনেক আত্মীয়স্বজন দেশভাগের পর উলুবেড়িয়া, শ্রীরামপুর, তমলুক, বাঁকুড়া যে যেখানে পেরেছে, চলে গেছে। লক্ষণবাবুরা যাননি। লক্ষণবাবু ছাত্রজীবনে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন আর রাজনীতিই করেন না।
এদিকে বারিক্কা রাতের অন্ধকারেই বাইরে দাঁড়িয়ে মালতীর হলুদ এবং মরিচ বাটা দেখে। দেখে শরীরের দোল, উন্নত বক্ষ এবং...। তারপর বারিক্কার মাথায় মারাত্মক নষ্ট প্রতিক্রিয়া হয়। লক্ষণবাবু এরই মধ্যে মালতীকে নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ উপন্যাসটি পড়তে দিয়েছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পাভেল করচাগিন মালতীকে মুগ্ধ করেছে ভীষণ। লক্ষণবাবুর মুখে অনেক বিদগ্ধ কমিউনিস্টেরও গল্প শুনেছে মালতী। এসব শুনেছে বলেই দু’হাতে মুদ্রা উপার্জন করা মানুষদের দেখে সে আবেগাপ্লুত হয় না। যেমন আবেগাপ্লুত ঠিকই হয় চট্টগ্রামের ‘বনফুল মিষ্টি’ দেখলে। মালতী যে কলেজে পড়ে, ওখানে তার প্রিয় এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রয়েছে। নাম তার শর্বরী। সে ভালো গান গাইতে পারে। হারমোনিয়ামও চমৎকার বাজায় শর্বরী। ওদের বাড়ি ভরা কবুতর। নৃত্যকলায়ও তার দক্ষতা রয়েছে। রথযাত্রা উৎসবে ও মেলায় শর্বরী থাকে বেশ ধুমধামের মধ্যে। আর দুর্গাপূজায় তো কোনো কথাই নেই। বর্ণিল সাজে এমনইভাবে সে সাজে যে, সে শুধু মালতীই ভালো জানে। তবে শর্বরী মালতীর মতো এতোটা সরল চরিত্রের নয়। লক্ষণবাবু জীবনে অনেকবারই ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছেন। শেষে আবার হিসাব মেলাতেও পারেননি। বিভিন্ন লাঞ্ছনা-বঞ্চনা থেকে পরিত্রাণের পথ কি ‘ইন্ডিয়া’ চলে যাওয়া? লক্ষণবাবুর এক পিসাতো বোন প্রায়ই তাকে সব বিক্রি করে ভারতের যাদবপুরে চলে যেতে বলেন। সেই বোনের নাম ফুলমতি। একসময় বাংলাদেশেই ছিলেন। এখন যাদবপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। ফুলমতি বলেন, বাংলাদেশে বাস করার ক্ষেত্রে হিন্দুদের ঝুঁকি মোটেও কম নয়। এখনো বাংলাদেশকে ইরান কিংবা আফগানিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখে কিছু ইসলামি জঙ্গি সংগঠন। ওরা বাংলাদেশকে ইরান কিংবা আফগানিস্তান বানাতে পারুক বা না পারুক, ওদের প্রথম বলি হয়ে যাবে বাংলাদেশের হিন্দুরা। যেমন হয়েছিলো ১৯৭১ সালে। সুতরাং এখানে পড়ে মরার কোনোই কারণ নেই। ফুলমতী শিক্ষিত নারী। ১৯৭৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ইতিহাসও জানেন। তিনি লক্ষণকে এসবের ভয়ও দেখান। বলেন, সিরিঞ্জে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে ওই জঙ্গিরা তোমাকে একদিন হত্যা করে ফেলবে। কারণ তুমি একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে কমিউনিস্ট। তখন কাউকেই তোমার পরিবার আর এসব বিষয়ে দায়ি করতে পারবে না। ওই জঙ্গিরাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রূপচাঁদের বোন ইপ্সিতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিলো। বাংলাদেশে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের সন্তানদের তো কোনো সাজাই হবে না। ওরা ভয়ানক হিং¯্র সাপের বাচ্চা। ওদের ছোবলে পড়লে বুঝবে ওরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে কোনোভাবেই কম নয়। ওরা সেই পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীরই বাচ্চা। বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার আগুনে সুযোগ পেলেই ওরা ঘি ঢেলে দেয়। আবার ওদেরকে ইঙ্গিত দেওয়ার মতো এখন পৃথিবীতে অনেক দেশই রয়েছে। কিন্তু লক্ষণবাবু ওসব কথা কানেও নেন না কিংবা সিদ্ধান্তও নিতে পারেন না। এ জন্য তার প্রতি ফুলমতি ভীষণই নাখোশ। ফুলমতি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু উপজাতি গোষ্ঠি তামিলরা পৃথক স্বদেশভূমির দাবিতে ১৯৭২ সাল থেকে লড়াই চালিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের সেই প্রেক্ষাপটও নেই। তাদের সামনে একটিই পথ: ভারতে পালিয়ে আসা। বিকজ বাংলাদেশ অলওয়েজ উইনস টু নেশন থিওরি। কিন্তু লক্ষণবাবু বলেন, বাংলাদেশে এতো খারাপ অবস্থা হবে না কোনোকালেই। তার মনে হয় তিনি ছাত্রদের এতোদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের যে কবিতা’র সারমর্ম বুঝিয়েছেন, তা অসত্য নয়: ‘হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন শকহুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’
লক্ষণ মনে করেন মানুষের নিরাপত্তার সমস্যা কিংবা সাম্প্রদায়িকতা সব দেশেই রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী কিংবা রাজীব গান্ধীরাই তো ভারতে স্বাভাবিক মৃত্যু পাননি। সুতরাং ওখানে গেলেই যে সব সমাধান হয়ে যাবে, তাও ঠিক নয়। তবে লক্ষণবাবুর আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, তাদের হিন্দুপাড়ার কাছাকাছি ঘেঁষে এখন যে একটি দাখিল মাদ্রাসা হয়েছে, তাও খুব সুখের আলামত নয়। কিছুদিন আগে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে মাদ্রাসার কিছু পোলাপানকে কথা বলতে তিনি নিজ কানেই শুনেছেন। ওরা নাকি আবার তলে তলে যুদ্ধাপরাধী খেলোয়ার হোসেনের অনুসারী।
লক্ষণবাবুর দুর্ভাগ্য, অকালে তার বাবা মোহিনীমোহনের মৃত্যু। জীবনে তিনি অনেক এগিয়ে যেতে পারতেন তার বাবা বেঁচে থাকলে। সে আর হলো না। তার বাবার ছিলো এক রেডিও সেট। সেটা ১৯৪৩ সালের দিকের ঘটনা। তখন এলাকার সকল মানুষ রেডিওতে আতঙ্কের সঙ্গে সোভিয়েত-জার্মান ফ্রন্টে লড়াইয়ের খবর শোনার জন্য লাইন ধরে থাকতো। ওই সময়েই মোহিনীবাবুর বাড়ির নাম হয়ে যায় ‘কংগ্রেস বাড়ি’। মোহিনীবাবু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক লোক, যদিও তার অনেক হিন্দু প্রতিবেশি মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন।
মালতীর এক মুসলিম বান্ধবী রয়েছে। তাবাস্সুম। ঠিক যেন মালতীর মতোই দেখতে। লক্ষণবাবু প্রায়ই ভাবেন, ভারতে চলে গেলে এই তাবাস্সুমের জন্য কি মন কাঁদবে না মালতীর কিংবা মালতীর জন্য তাবাস্সুমের? এই তাবাস্সুমের পিতা নুরুল ইসলাম একটি হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। প্রতি ঈদুল ফিতরেই তিনি মালতীর জন্য তাবাস্সুমকে নিয়ে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী কিনেন। নিজের বাড়ির কোনো ফলই খান না মালতীদের বাদ দিয়ে। ভারতে চলে গেলে তাবাস্সুমকে ভুলতে পারবে মালতী? লক্ষণবাবুর সহপাঠিনী শরৎচন্দ্রিকা প্রায়ই তাকে বলতেন, আমরা বাংলাদেশের হিন্দুরা খুব বেশি অবহেলার শিকার। এটা তারও কখনো কখনো মনে হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে যে, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরাও ওই দেশে সুখে নেই। অথচ লক্ষণবাবুর মুসলিম বন্ধু ওয়ালি খানের কোনো তুলনাই হয়না। সারাটা জীবন পরম বন্ধু হয়ে পাশে পাশে থেকেছেন। কিন্তু এমন দু’চার-পাঁচজন ওয়ালি খানদের নিয়ে তো একটি রাষ্ট্র চলে না। এলাকার হিন্দুদের জমি জালিয়াত চক্রের মূল হোতা ফরাজীর সঙ্গেও ওয়ালি খান এক-দুইবার লড়েছেন। ওয়ালি খানের স্ত্রী রেহানা ইয়াসমিন মালতীকে মায়ের মতোই ¯েœহ করেন। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। কংগ্রেসবাড়ির তিনশ গজের মধ্যে দুর্ধর্ষ ক্যাডার নাজমুইল্লার বাড়ি। তার বাড়িতে মধ্যরাতে বসে জুয়ার আসর। এই মদখোর নাজমুইল্লা তার বউকেও ভীষণ মারে। একবার নাজমুইল্যা তার এক প্রতিবেশী বিধবার শ্লীলতাহানি করে ধরা পড়ে গিয়েছিলো। জুতা-ঝাঁটার পিটাতেও তখন শেষ রক্ষা হয়নি তার। হাতে পুলিশের হ্যান্ডকাফ লেগেছিলো। কিন্তু এখন দিব্যি স্বাধীন। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। জেল খেটে খেটে এলাকার পুলিশের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তার। এসব খবর লক্ষণবাবুর কানে ঠিকই আসে। কিন্তু তিনি কী করবেন? বিধবা এবং দুস্থ নারীদের দিকে চোখ তাক করে রাখে যেই নাজমুইল্যা, সে যে হিন্দুবাড়িকে টার্গেটে রাখেনি এতো কাছে থেকেও, এটা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? নাজমুইল্লার জুয়ার আসর নিয়ে এলাকার কয়েকবারই সালিসি বৈঠকে মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে যেন নাজমুইল্লা আবার তা চালু করে দেয়। ইদানিং আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। দাশবাড়ির পান্নালালের যুবক ছেলে বিক্রম গিয়ে নাজমুইল্লার সঙ্গে ভিড়েছে। বিক্রম যে নাজমুইল্লার সঙ্গে গেলো, ওটার চেয়ে বড় বিষয় হলো বিক্রমের গন্ধ নিয়ে হিন্দুপাড়ায় হানা দেবে নাজমুইল্লা। মনোরঞ্জন পান্নার বড় ভাই। তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন লক্ষণবাবু। কিন্তু বিক্রমকে ফেরানো যায়নি। এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হন তিনি। তার ছাত্র সৌগত শেষবার তাকে দেখতে এসে কোনোভাবেই টেনশন করতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু এতো কিছুর পরও কি বিনা টেনশনে থাকা যায়? বিনা টেনশনে থাকার কারণও ছিলো না। তবে আজ তার বাড়িতে বাঘের ছাপ লেগেছে। বারিক্কার উষ্ণ নিঃশ্বাস লেগেছে তার বাড়ির জবা ফুলে। মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠে টয়লেটে যাওয়ার সময় মালতীর বুকে ছুরি ধরে খুব শক্ত করে চেপে তার মুখ বেঁধে ফেলে বারিক্কা। মালতীর আর শব্দ করারই সুযোগ থাকেনি কোনো। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই জবাফুলের গাছের সামনেই মালতীফুলের বাগান ধুমরেমুচরে মালতীকে ধর্ষণ করে বারিক্কা। হঠাৎ মালতীর গোঙানী খেয়াল করে চিৎকার করে ঘর থেকে বের হয় মালতীর বাবা লক্ষণবাবু। এমনভাবে চল্লিশ বছর আগেও সেই পাকিস্তান আমলে হিন্দুপাড়ায় মধ্যরাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো ভারতী রানী দাস। লক্ষণ রীতিমতো চিৎকার শুরু করেন। তার চিৎকারে ডাকাতের উপদ্রব হয়েছে মনে করে পাশের বাড়ির চিত্রা ঘোষ, প্রদ্যুৎ, কার্তিক, সমর ও গৌরিহরিরা লাঠি, দা-রামদা ও ছোরা হাতে লক্ষণের বাড়িতে আসে। তখন ঝোঁপের ভিতর দৌড়ে লুকিয়ে যায় বারিক্কা। কাশীনাথ, প্রসেনজিৎ, তরুন ও লালুও অন্যবাড়ি থেকে ততক্ষণে ছুটে আসে। ননীবাবুর ছেলে ইন্দ্র বারিক্কার ছুরির পোচ খেয়েও তাকে জাপটে ধরে ফেলে। চিত্রার বোন মায়া রাগে উত্তেজিত অবস্থায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সব্বার সামনেই বারিক্কার মাথায় দা দিয়ে দেয় এক শক্ত কোপ। জিহŸা বের করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বারিক্কা। রক্তে ভেসে যায় বারিক্কার শরীর। ইন্দ্র ততোক্ষণে বারিক্কাকে ছেড়ে দশহাত পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা বৌদি থরথর করে কম্পনরত মালতীকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কারো মুখে কোনো কথাই নেই। ততোক্ষণে চুনীলাল বাবুও আসেন। সব শুনে বলেন, শুনো, এতোক্ষণে মুসলিমবাড়ির কেউ না কেউ থানার দিকেও চলে গেছে। চুপ। মালতীর কথা কেউ বলবা না। বলবা যে, চুরিতে ধরা খাইয়া সব্বার লাঠির আঘাতে ও দায়ের কোপে মারা গেছে বারিক্কা। লক্ষণের হার্টের অসুখ। মালতীরে থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারির মুখামুখি কইরো না।
তবু ভোর না হতেই লক্ষণের বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। বারিক্কার লাশ জেলা সদরে পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য। লক্ষণবাবু, ইন্দ্র, সমর ও কার্তিককে হাতকড়া পরিয়ে একটি বেবীট্যাক্সিতে তুলে পেছন পেছন আরেকটি বেবীটেক্সী নিয়ে থানার দিকে চলে যায় পুলিশ। ওরা এখন ‘বারেক খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামী। পুলিশ ওদের বিরুদ্ধে আদালতে রিমান্ড মঞ্জুর করবে। এরই মধ্যে এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশ সুপারও কয়েকবার খবর নিয়েছেন। অন্যদিকে হিন্দুপাড়ার কাছে নতুন করে গড়ে ওঠা দাখিল মাদ্রাসার ছাত্ররাও বিভিন্ন তান্ডব শুরু করেছে। হিন্দুবাড়িতে মুসলিম খুন হওয়ার জের ধরে ওই শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। ঢিল ছোঁড়ে তাদের বাড়ির মন্দির লক্ষ্য করেও। মুকুলকেও ধাওয়া করেছে সন্ধ্যায়। খবর পেয়ে পুলিশও গেছে হিন্দুপাড়ায়। আর বারিক্কা যে চোর ছিলো, কোনো মুসলমানের মুখ থেকেই এ কথার পক্ষে কোনো সায় পায়নি পুলিশ। তার নামে আগেও কোনো চুরি ডাকাতির মামলা হয়নি। তাহলে? এদিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মালতীকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে এমন অসুস্থ অবস্থায়ও লক্ষণবাবুসহ বাকি আসামীদের জামিন হয়নি। বরং কোর্ট তাদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরই মধ্যে এ মামলার তদন্তভার জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে দেন পুলিশ সুপার রহমান জাহিদ। দুঃখের বিষয় জেলহাজতে থাকা অবস্থাতেই লক্ষণবাবু হার্টফেল করে মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে লক্ষণবাবু বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। ওই বলাটুকু থেকে শুধু নাকি বুঝা গিয়েছিলো এইটুকুই যে, ‘মা মালতী, মা তাবাস্সুম ... মা মালতী ... মা ...।’ লক্ষণবাবুর সারা জীবনের সেরা ছাত্র আমিনুল ইসলাম খবর পেয়ে মালতীদের বাড়িতে গেলেন। সব শুনে বললেন, লক্ষণ স্যার তো মরেননি। তাকে আসলে হত্যা করাই হয়েছে। তাবাসসুম আর তার পিতা ইংরেজির শিক্ষক নুরুল ইসলাম এবং নুরুল ইসলাম স্যারের আরেক বন্ধু অহিদুর রহমান স্যারও ছুটে আসেন মালতীদের বাড়িতে।
পরদিন মালতীদের বাড়ি ঘেঁষে যে নতুন দাখিল মাদ্রাসাটি হয়েছে, তার শিক্ষক মাওলানা আনোয়ার হোসাইন তার ছাত্রদের নির্ধারিত পাঠ বাদ রেখেই ব্যাখ্যা করে বুঝান ''ঠিক কী কারণে ইংরেজের দালাল ইংরেজি শিক্ষক নুরুল ইসলাম কোনোভাবেই একজন মুসলমান নন।''


রচনা: ডিসেম্বর: ১৯৯৮
কুমিল্লা।
প্রথম প্রকাশ:
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ, কুমিল্লা।












২১| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ রাত ৮:৩৩

জসীম অসীম বলেছেন: I HAVE NO OFFICE NOW
JASHIM UDDIN ASHIM

GOOD MORNING SIR.
: GOOD MORNING.
: I AM ASHIM-REPORTER OF WEEKLY AMOD
: HOW ARE YOU ?
: FINE.
HE LOOKS AFTER THE H.S.C EXAMINATION FILES IN EDUCATION BOARD OF COMILLA. HE GIVES THE INFORMATION H.S.C EXAMINATION. THERE WERE 11000 H.S.C CONDIDATE IN THIS YEAR MAY-1997.
BUT HE TOLD ME IN HIS OFFICIAL ROOM-THAT I HAVE NO OFFICE NOW. I KNOW THATHE WILL EAT LUNCH AT ONE O'CLOCK. BUT I GO TO MY INFORMATION AT ELEVEN O'CLOCK WITH HIM. THEN I TOLD HIM I WILL CATCH YOU IN MY PEN.
SO AT LAST HE TOLD ME I AM GIVING SOME INFORMATION WITH YOU. THEN YOU MAKE A REPORT WITH THAT INFORMATION.



২২| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ রাত ৮:৩৭

জসীম অসীম বলেছেন: কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকা এমন সব নারীদের
‘সাংবাদিক পরিচয়পত্র’ দিয়ে ফেলেছে, যারা শুধুমাত্রই নারী
জসীম উদ্দিন অসীম:
কুমিল্লার চান্দিনার আমার সাংবাদিক বন্ধু তাহমিদুর রহমান দিদারের বাসায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। ২০০৬ সালের প্রথম দিকে। তিনি আমাকে সংগীত শিল্পী সমীর সৈকতের কাছে নিয়ে গেলেন। সমীর বললেন, অসীম দাদা চলুন চান্দিনা মহিলা কলেজের কয়েকজন ছাত্রীর বাসায়। একজন ভালো গানও গায়। সে থাকলে আপনাকে গান শোনানো যাবে। আমার আবার ‘রবীন্দ্র সংগীত’ প্রীতি বিভিন্ন কারণেই ভীষণ। ১৯৯৬ সাল থেকেই আমি স্বরলিপি নিয়ে একটু আধটু ‘রবীন্দ্র সংগীত’ গাই। আমি বললাম, কেউ কি আমাকে রবীন্দ্র সংগীত শোনাতে পারবে! সমীর দা’ বললেন, আগে তো চলুন। গেলাম। পরিচয় হলো পাখি-র সঙ্গে। পাখি সরকার। সুন্দরী যুবতী। বাচনভঙ্গি চমৎকার। কবিতাও লিখেন। কিছুদিন পরেই খবর পেলাম পাখি-র বাবা ডা. নারায়ণ সরকার মারা গেছেন। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে আমি আর সাংবাদিক দিদার ভাইও গেলাম। বরুড়া উপজেলার ৬ নং উত্তর ঝলম ইউনিয়নের কাদুটিবাজার পার হয়ে ইলাশপুরে। পাখি আমাকে বললো, আজ আমাদের বাড়িতে আপনারা থেকে যাবেন। আমি আপনাদের যেতে দেবো না। আমি বললাম, আমি তো শীতের কাপড় আনিনি। পাখি বললো, আমার শীত-তাড়ানো ভালো চাদর রয়েছে। থেকে যান। রাতে কীর্তন হবে। যাবেন না। অবশেষে থেকেই গেলাম পাখিদের বাড়িতে। আমি তখন ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকার চাকুরি ছেড়ে বেকার। দিদার ভাইয়ের টাকাতেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আর এই দিদার ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ‘দৈনিক শিরোনাম’ পত্রিকায় চাকুরি করার সময়। তিনি তখন ‘দৈনিক শিরোনাম’ পত্রিকার চান্দিনা প্রতিনিধি ছিলেন। পরে আমি যখন ‘দৈনিক কুমিল্লাবার্তা’ পত্রিকায় যোগদান করি, তখন দিদার ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তার বাড়িতে বেড়াতে গেলে তার মা এতোই আপ্যায়ন করতেন, বর্ণনার অতীত। পাখিদের বাড়িতে গিয়ে পরিচয় হলো পাখি-র বান্ধবী হালিমা আক্তার নিপা-র সাথে। আর পরিচয় হলো পাখি-র আরেক বান্ধবী রতœা গোস্বামীর সাথে। রতœা-র বাবা যতীন্দ্র গোস্বামী আমাকে সাংবাদিক জেনে অনেক মূল্যায়ন করেন। কারণ তিনি ছিলেন রামমোহন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। পাখিদের সব বান্ধবী আমার মোবাইল নম্বর নিলো। পরদিন আমি আর আর দিদার ভাই পাখিদের গ্রাম ইলাশপুরের প্রকৃতি দেখতে বের হলাম। দেখার মতোই গাছপালা ছিলো সেই গ্রামে। পাখি-র ছোট ভাই সুমন সরকার আমাদের ‘জোনাকি দিঘী’র কাছে নিয়ে গেল। তারপর যজ্ঞেশ্বরী বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হয়ে আরও অন্যান্য স্থানে। তারপর ফিরে এলাম পাখিদের বাড়ি থেকে। কথা হতে থাকলো মোবাইলে পাখি-র সঙ্গে। নিয়মিত। কিন্তু পাখিকে একটি কথা না বলে আমি ভীষণই অন্যায়ই করেছিলাম। আর সেটি হলো: একটি মেয়ে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সাদিয়া পলি। যার সঙ্গেই একান্তই সংসার এখন আমার। আমি যখন কুমিল্লার কান্দিরপার ‘তুষ্টি হোটেলে’র গলি-র নরেন্দ্রনাথ সাহার ‘মাতৃভবন’ বাসার তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকতাম, তখনও এমন অনেক মেয়েকেই সময় মতো বলা হয়নি যে আমি একটি সংসার ফেলে একদিন চলে এসেছিলাম। ওই বাসায় আমার কাছে নিয়মিত আসতেন ¯িœগ্ধা রায়, নাহিদা আক্তার নিঝুম, ফাহমিদা আক্তার নিপু, স্বপ্না দেবনাথ, তৌহিদা সুলতানা শেলী, লরেন এলুইস, জুঁই পাল, মিতু পাল, সুরভী দে, মুক্তা পাল শানু। কখনো জ্যো¯œা মাসিমার সঙ্গে বীণা বৌদি। মুক্তা পাল শানুর বাসা ছিলো কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়া জোড়পুকুরপারে। তার কাকা স্বপন পালের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পড়েছিলো আমারই উপর। ৯ জুলাই ২০০৪ তারিখে। আর মুক্তা পাল শানুর বিয়ে হয় ৩০ জুলাই ২০০৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪১২ তারিখ শনিবারে। কুমিল্লা শহরের লাকসাম রোডের রজনীগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারে। পরে আমার স্ত্রী সাদিয়া পলিকে নিয়ে অনেকবারই মুক্তা পাল শানুর বাসায় গিয়েছিলাম। ওদের একসময় আমি কুমিল্লার সাংবাদিকতায়ও নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কারণ ওদের কেউই উচ্চ মাধ্যমিক পাশের নিচে ছিলেন না। তাই ওদের সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের সঙ্গেও আমি জড়িত করি। এমন আরও দুইজন মেয়ের নাম ছিলো কাজী উম্মে সালমা সাঞ্জু এবং শাহীনূর। ওদেরও আমি সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণে জড়িত করেছিলাম। কাজী উম্মে সালমা সাঞ্জু এবং শাহীনূর ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকার শুরুর দিকে চাকুরি করতেন। কিন্তু এই কি হলো এখন কুমিল্লায়! ‘না’ পাশ, টু পাশ, ফাইভ পাশ, এইট পাশ সাংবাদিকে ভরে গেল শহর। এই ‘কহর’ কেন পড়লো! ষন্ডায়-গুন্ডায়-পান্ডায় আর ‘আন্ডার মেট্রিক’ (এস.এস.সি পাশও না) অগা-মগা-বগা সাংবাদিকে ভরে গেল এই শহর! এ বিষয়ে একবার আমি কথাও বলেছিলাম গাইবান্ধার কামরুন নাহারের সঙ্গে। কামরুন নাহার ছিলো ‘সালমা সোবহান ফেলো’। কাজ করতেন ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায়। ‘সালমা সোবহান ফেলো’ প্রথম ব্যাচের নয়জনকে ‘প্রথম আলো’ নিয়োগ দিয়েছিলো। আমি যখন কুমিল্লার ‘সাপ্তাহিক আমোদ’ পত্রিকায় চাকুরি করতাম ২০০০সালের আগে, তখন সেই পত্রিকার কম্পোজিটর আবদুল হালিমের সঙ্গে তার সহকারি হিসেবে চাকুরি করতেন মোঃ সাদেকুর রহমান। তার বাড়ি ছিলো কুমিল্লার লালবাগের জগপুর বড় বাড়ি। সেই সাদেক একদিন আমাকে বলেছিলেন, তার এক খালাতো ভাইয়ের খুব সাংবাদিক হওয়ার শখ। আমি বললাম, কী পাশ আপনার সেই ভাই! সাদেক বললেন, “এস.এস.সি ফেলডিভিশন।” আমি বললাম, তার আর সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টারও দরকার নেই। এ কথায় সাদেক কষ্ট পেলেন। কিন্তু এখন যদি আমার সেই সাদেকের সঙ্গে দেখা হতো, তবে বলতাম, আপনার সেই ভাইকে দ্রæত নিয়ে আসুন আমাদের কুমিল্লা শহরে। এই শহরে এখন সাংবাদিক হওয়ার সময় বয়ে যায়। ‘এস.এস.সি ফেলডিভিশন’ ষন্ডায়-গুন্ডায়-পান্ডায় কিংবা ‘আন্ডার মেট্রিক’ (এস.এস.সি পাশও না) অগা-মগা-বগারা যদি সাংবাদিক হতে পারে, মাল কামাতে পারে, তাহলে আপনার ভাই কী দোষ করেছে! কিন্তু ওই যুগ তো মোবাইলের ছিলো না। তাই সাদেককে আর খবরটি দিতে পারছি না আমি। আর আমি যেসব উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের পত্রিকায় কাজ করানোর চিন্তা করতাম, এখন আর তার প্রয়োজন নেই। কারণ কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকা এমন সব নারীদের ‘সাংবাদিক পরিচয়পত্র’ দিয়ে ফেলেছে, যারা শুধুমাত্রই নারী। পত্রিকায় সাংবাদিকতার আর কোনো যোগ্যতা তাদের রয়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। এই বিষয়ে বেশি বলতে গেলেই আবার নিজের পেশার বিরুদ্ধেই বলা হয়ে যাবে। আর অনেকের দৃষ্টিতে সেটা আবার আত্মঘাতী কর্ম।

ব্যক্তিগত দিনলিপি (সংশোধিত):
জুন ২০০৮, কুমিল্লা সেনানিবাস,
কুমিল্লা।
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি

২৩| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ রাত ৮:৪২

জসীম অসীম বলেছেন: সিডিউল কাস্টের মেয়ে

জসীম উদ্দিন অসীম

বাড়ির উঠানের পাশে বৈঠকখানার সামনেই যেখানে বকুলের সবুজ গাছ, তার নিচেই বান্ধবীদের নিয়ে আনন্দে আড্ডায় বিভোর ছিলো বকুল। ষোড়শী বকুল। সুলতানা বকুল। বকুল ফুলের গাছের নামেই মেয়ে। মেয়ের নামেই গাছ। বকুল ফুলের গাছ। রোস্তম শেখের একমাত্র সন্তান এই বকুল। রোস্তম শেখ বাড়িতে ফিরতেই আড্ডায় ছেদ পড়ে যায় মেয়ের। এগিয়ে এসে বাবার ব্যাগটা হাতে নেয়। বাবাকে বলে, বাবা আমার নতুন জ্যামিতি বক্স এনেছো?
রোস্তম শেখ বলে, আজও ভুলে গেলাম মা। আগামীকাল আর ভুল হবে না।
বকুল বলে, বাবা তুমি আগামীকালও ভুলে যাবে। রোস্তম বলে, না মা। আর ভুল হবেই না। বকুল বলে, তোমার নাম রোস্তম শেখ নয়, তোমার নাম বাবা ভোলানাথ।
মেয়ের কথা শুনে হাসে রোস্তম শেখ। বাবাকে ঘর আর দাদীর কাছে পৌঁছে দিয়েই বকুল চলে যায় বান্ধবীদের কাছে, সেই উঠানের বকুলতলায়।
ঘড়ি ংঃধৎঃরহম ভৎড়স ঃযব নধপশ:
‘হিন্দু মেয়েকে মুসলমান করিয়ে বিয়ে করতে পারলে হজ্জ্বের সওয়াব পাওয়া যায়।’ এমন একটি কথা অনেকবারই শুনেছে রোস্তম । কিন্তু সে আসলে হিন্দু মেয়ে নিরুপমাকে ওই কারণে বিয়ে করেনি। বিয়ে করেছে মেয়েটির প্রেমে পড়েই। তবে বিয়ের পর সামাজিক নানা চাপে যেন ধীরে ধীরে তার প্রেম হয়ে যায় হাওয়া।
যৌবনে নিরুপমা দেবকে রোস্তম শেখ নীলরক্তের অধিকারিনীই ভেবেছিলো। কিন্তু এখন দেখছে নাম তার যেমনই হোক, সে যেন কোনো সিডিউল কাস্টের মেয়ে। লোয়ার ক্লাস। মানে ছোটজাত। অনেক গুণাগুনের কথা বলে তাকে গরুর মাংস খাওয়া শেখানো হয়েছিলো। ইদানীং সে গরুর মাংস মুখে নিলেই বমি করে দেয়। তাহলে সে যে তার হিন্দুত্ব ত্যাগ করলো, সেটা কি অভিনয়? এক টুকরা গরুর মাংস খেলে তিনদিন তোর শরীর খারাপ করে। বাটপারি? রোস্তমের সঙ্গে? তাহলে তোর নিরুপমা নাম বাদ দিয়ে এই ‘সুলতানা’ নাম নিয়ে কী লাভ হলো? দু’দিন পরেই তো এসব নিয়ে ধরবে এই সমাজ।
ইদানীং মেয়েটা আবার সবার সঙ্গে কড়া ভাষায় কথা বলে। অথচ তার বাবা নাকি শিক্ষিত ভদ্রলোক। প্রমাণটা কোথায়? সেদিন রোস্তমের মায়ের সঙ্গেও করে বসলো এক বেয়াদবী। সংসারে তার এতোগুলো দিন চলে গেলেও কোরআন শরীফের দুই-তিনটা সুরাও মুখস্থ করতে পারেনি। এ নিয়ে রোস্তমের মা ধমক দিলে নিরুপমা ওরফে সুলতানা বলে, বিয়ের আগে তো মা আপনার ছেলে বলেছিলো, তোমার ধর্ম তোমার এবং আমার ধর্ম আমার। শুধু বিয়ের জন্য একবার তোমাকে মুসলমানের একটি নাম নিতে হবে। পরে সেটা পরিধেয় বস্ত্রের মতো করেই খুলে ফেললে হবে। আমি তোমাকে ‘নিরু...’ বলেই ডাকবো।
এ কথা শুনে রোস্তমের মা বলে, সেটা বিয়ের আগে বলেছিল। এখন এসবং বলে লাভ নেই। শ্বাশুড়ির এই কথাকে নিরুমপার প্রতারণাই মনে হয়। মাঝে মাঝে শ্বাশুড়ি আর স্বামী তাকে এমনই আক্রমণ করে কথা বলে যে, নিরুপমা ঠিক বুঝতেই পারে না তারা কথা বলছে নাকি তার পিঠে ছুরি মারছে। এমন প্রতারণার কথা মনে হলে নিরুপমা তার চোখের জল আর ধরে রাখতেই পারে না। প্রেমের নামে প্রতারণা? ধর্মান্তরিত করা? আর নিরুপমারও সমস্যা অনেক। কাগজেকলমে সে মুসলমান হলেও আসলে সে হিন্দুই রয়ে গিয়েছে। তা না হলে এইবারের দুর্গাপূজার সময়েও সে রোস্তমকে বলেছে, চলো না কোথাও গিয়ে মা দুর্গার প্রতিমা দেখে আসি। মা উমাকে না দেখে মনে কষ্ট পাই। সংসারতো চিরতরেই ছাড়লাম, মা দুর্গাকেও কি আর কোনোদিন দেখতে পারবো না? রোস্তম বলে, চুপ করো তুমি। মা-বাবা শুনলে আগুন লাগবে বাড়িতে। এটা গ্রাম। বুঝলে, মুসলমানদের গ্রাম। পাশের গ্রামে কিংবা বাজারে না গেলে দুর্গা প্রতিমা দেখা সম্ভব নয়। তাছাড়া লুকিয়েও যাওয়া যাবে না। গেলে আর তা প্রচার হয়ে গেলে আব্বা বিপদে পড়বেন। তিনি এখানকার মসজিদ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
নিরুপমা আর কথা বলে না। কারণ সেও গ্রামের মেয়ে, যদিও শহরের কলেজে পড়তে গিয়েই রোস্তমের সঙ্গে পরিচয় এবং প্রেম...তারপর তাদের বিয়ে। বিয়ের আগে রোস্তম নিরুপমার কোলে মাথা রেখে খুবই কেঁদেকেটে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া...। কিন্তু আজ দিন বদল হয়েছে।
সেদিন নিরুপমা তার শ্বাশুড়িকে বলেছে, মা আপনাদের সারাবাড়িতে একটি অর্জুন গাছও নেই। অর্জুনের কতো গুণ। একটি চারা লাগালে হয় না? কদমগাছ তো আছে, একটি বটের চারাও যদি লাগাতেন, কী সুন্দর গাছ!
এ কথা শুনে শ্বাশুড়ি বলেছেন, এসব গাছ তো তোমাদের হিন্দু বাড়িতেই বেশি থাকে। তবে এটা ঠিক অর্জুনের অনেক গুণ। কিন্তু বাড়িতে কেউ বটগাছ লাগায়? বোকা মেয়ে। সারাবাড়ি ঢেকে ফেলবে না? ধান শুকাবো কোথায়? বটগাছ তো বেশি থাকে তোমাদের হিন্দু মন্দিরে বা আশ্রমেই।
নিরুপমা বলে, মা আমাকে হিন্দু বললেন যে, আমি না এখন মুসলমান হয়ে গেছি। শ্বাশুড়ি আর কথা বাড়ান না। কিন্তু বুঝেন, মেয়েটা আজকাল প্রায়ই খুব উগ্র হয়ে কথা বলে যায়। সেটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। নিচুতলার মানুষেরই লক্ষণ। সেদিন সে আবার কী না ঘরের কোনের চড়–ইপাখির বাচ্চা নামিয়ে এনেছে। বাচ্চাগুলো এতোই ছোট ছিল যে, গায়ে ওদের লোমও হয়নি, চোখও ফোটেনি। এ মুখ সে মুখ হয়ে যখন এ কথা রোস্তমের কানে যায়, রোস্তম খুব ক্ষেপে যায়। ‘মা-বাবা কোনো শিক্ষাই দেয় নাই?’ রোস্তমের এই কথায় নিরুপমার চোখ ভিজে যায় জলে। কারণ তার ধর্মত্যাগের-পরিবার ত্যাগের কারণে তার মা-বাবা শোকাহত হৃদয়ে তার ছোটবোনটিকে নিয়ে চিরতরেই পাশের রাষ্ট্র ‘ইন্ডিয়া’য় চলে গিয়েছে। বাড়িটা বিক্রি করে গিয়েছে তার কাকার কাছেই। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো নিরুপমার কাছে খবর পাঠিয়েছিল সে যাবে কী না। নিরুপমা পরিষ্কারভাবেই ‘না’ বলে দিয়েছিল। অথচ আজ শ্বশুরবাড়িতে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময়ে ‘নয় থেকে দশ’ হলেই তার ‘ধর্ম’ কিংবা ‘জাত-বংশ’ নিয়েও তাকে কথা বলে অনেকে। বিশেষ করে তার মা-বাবাকে অপমান করা হলে সেটা তার সহ্যই হয় না।
অনেক অপমানের পরও নিরুপমার উগ্র স্বভাব কিন্তু পাল্টায় না। এ নিয়ে রোস্তমের আত্মীয় স্বজনদের অনেকে মনে করেন রোস্তম এ মেয়েটিকে বিয়ে করে এক ধরনের ধোঁকাই খেয়েছে। মুখে মুখে তর্ক করে এ মেয়ে। এমনকি শ্বশুরের সঙ্গেও কথার জবাব দিয়ে বসে। লোকে বলে ‘কথাকে নিরুপমাকে মাটিতেই নামতে দেয় না’। এমনকি যে বিষয়ে তার কথা বলারও প্রয়োজন নেই, সেই বিষয়েও অনেক সময় যেচে এসে কথা বলতে থাকে। তার এই স্বভাবটি রোস্তমদের পরিবারে অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়। আর এ নিয়ে প্রতিটি জনের আলোচনা-সমালোচনা চলতেই থাকে। তাই অনেকেই বলতে থাকে যে, এ মেয়ে বড় ঘরের কোনো মেয়ে হতেই পারে না। নিশ্চিত ‘সিডিউল কাস্ট’। তার আচরণই বলে। গেলো সে গোসল করতে পুকুরে, ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে ফিরলো ডাহুকের ফিকে সবুজ ডিম। অথচ মেয়ে তোর নিজের পেটেই চারমাসের বাচ্চা। আবার বলে কী না, ‘শালিক পাখির ডিম নীল, দেখতে খুবই সুন্দর। আমি দেখেছি। কিন্তু চিলের ডিম দেখার বড়ই শখ। আমি শুনেছি চিলের ডিম নাকি গাঢ় গোলাপি বা লাল।’ মেয়ে বলে কী। এটা কি মেয়ে, নাকি গেছো ব্যাঙ? নিশ্চিতই ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’। ভদ্র ঘরের মেয়ে এমন হতেই পারে না। আর ইদানিং তাকে শুনিয়ে শুনিয়েও অনেক লোক উচ্চকণ্ঠে বলে, ‘শি...ডি...’।
কিন্তু কী এই ‘শি...ডি...’তা নিরুপমা ভালো করেই জানে। সে জানতো হিন্দুদের মুসলিম পরিবারে ‘ডেডাইয়া বা ডেডু’ বলে গাল দেয় বা মস্করা করে। কিন্তু এই ‘শি...ডি...’ বলে কাউকে আক্রমণ করা যায়, এ তার জানা ছিলো না। যাদের সঙ্গে একেবারেই মিশে গেলো সে, তারাই তাকে এই ‘শি...ডি...’ বলে গাল দিয়ে মজা করছে!
এই এই ‘শি...ডি...’ কথাটিই তাকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে। ‘মনে হয় এ মেয়ে সিডিউল কাস্টের মেয়ে।’ হায়! এ কথা এখন তার কানে প্রতি মুহূর্তেই প্রতিধ্বনিত হয়। অনেক উৎসবে, পূজার অনুষ্ঠানে, বনভোজনে, জন্মদিনে, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রসংগীত গাইতো নিরুপমা। এখন আর চর্চাও করে না। সুযোগও নেই। আক্ষেপও নেই। কিন্তু এখন আক্ষেপ বাড়ে ঐ কথাটি শুনে, ‘নাকি মেয়েটা কোনো সিডিউল কাস্টের মেয়ে।’ অথবা এই ‘শি...ডি...’। অথচ নিরুপমা আগে শুনেছে ইসলাম ধর্ম জাতিবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের হিসেব করে। কিন্তু রোস্তমের ফুপুও সেদিন নিরুপমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই রোস্তমের মাকে বলেছে, দেখেন গিয়ে ভাবী, আপনার ছেলে সুন্দরী দেখে আবার কোনো ধোপা-নাপিতের মেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে কী না। মুখে শুধু খই ফুটে। চলার যা ঢঙ, লক্ষণ তো...।’
এই কথাটি শুনে নিরুপমার হাত থেকে চিরুনি খসে পড়েছিল। বুকের ভিতরটা হয়েছিলো ধু-ধু বালুচর। সেই থেকেই এই শ্বশুরবাড়িতে নিরুপমার মনের অসুখ বাড়ে। তার শরীরের রক্তে সৃষ্টি পেটের সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? আত্মদহনে জ্বলে পুড়ে যায় সে। সুখ থাকলে পিঁড়িতেও সুখ, সুখ না থাকলে অলঙ্কৃত সিংহাসনে বসেও থাকে না। শুধু এই বাড়িতে একটি লোকই তাকে ভীষণ ¯েœহ করেন। তিনি রোস্তমের বাবা। নিরুপমাকে একদিন বলেনও তার কারণ। বলেন, ‘‘ইন্ডিয়া ভাগের আগে আমাদের পরিবার এক হিন্দু পরিবার দ্বারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কী ভয়ানক ছিলো সেই পরিবারের লোকজন। নিষ্ঠুরতা কাকে বলে। তারপর পাকিস্তান আমলে আমাদের পরিবারও কম করেনি। কেউ কেউ তো সেই অত্যাচারী পরিবারের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে রাতের বেলা মলমূত্রও ত্যাগ করেছে। অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ওই পরিবার ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। অথচ আমারই সন্তান কী না এক হিন্দু মেয়েকেই বিয়ে করলো! কে ভাবতে পেরেছে তা আগে? কিন্তু তোমাকে দেখে আমার হিন্দু মনে হয়নি মা। মনে হয়েছে কোনো এক মানবসন্তান তুমি। তুমি কেনো আমাদের পরিবারের অনেকের সঙ্গে লড়তে যাও বা তাদের সংশোধন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করো? তারা কি তোমার মুখের রঙটা দেখে? তারা কি তোমার দুঃখের খোঁজ নেয়। তারা মনে করে তুমি একজন হিন্দু যুবতী, যে কী না ভালোবাসার টানে এখন ‘নামকাওয়াস্তে মুসলমান’ মাত্র হয়েছে। তোমার যে ‘আরবী’ শিখতে আসলেই মন চায় না, এটা তো যে কোনো মুসলিম ছেলেমেয়েরও হতে পারে। কিন্তু তুমি যেহেতু হিন্দুর ঘর ছেড়ে এসেছো, এক্ষেত্রে তোমার অনীহাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়।’’ শ্বশুর তাকে এটুকু বুঝেছেন জেনে নিরুপমার অশান্ত মন প্রশান্ত হয়। বলে, বাবা আমি ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারি। ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছি। এটার জন্য আমি অনেকবারই পুরষ্কৃত হয়েছি। কিন্তু আপনাদের পরিবারে কেউ তা জানলোও না। এমনকি আমি বলাতেও সেদিন সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো। মাকে বললো কি, ‘‘তোমার গায়েন পুত্রবধূকে রেডিওতে পাঠিয়ে দাও’। আর এ কথা শুনে মা পর্যন্ত হাসতে লাগলেন! রোস্তমের বাবা বলেন, তুমি এমন এক ঘরে এসেছো মা, আমরা তো গান-বাজনা একেবারেই করি না। গান-বাজনা আমাদের ধর্মেরও অনেকে করে থাকেন। কিন্তু আমাদের পরিবারে তা প্রায় নিষিদ্ধই। তাই তোমার ওই প্রতিভার এখানে কোনো মূল্যই পাবে না। কিন্তু আমার কথা হলো, তুমি তো মনে করেছো যে, শুধু ধর্ম বদল হচ্ছে। ধর্ম বদল তো ধর্ম বদল নয় মা, এতো কালচারেরও পরিবর্তন। এতো ছোট্ট বয়সে তোমার মাথায় এ কথা কিভাবে ঢুকবে? কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, আমার ছেলে তোমার শুধু রূপ দেখেই মুগ্ধ হয়েছে। না সে তোমার ধর্ম নেবে, না তোমার কালচার। আমরা কেউই তা নিতে পারবো না। কারণ আমাদেরও তো নিজস্ব সমাজ বা কালচার রয়েছে। আমরা তো আর বিসর্জন দেওয়ার অবস্থায় নেই। এসব তো মা এখন বাধ্য হয়েই বিসর্জন দেবে তুমি। নিরুপমা বলে, ‘বাবা আমি তো সব বিসর্জন দিয়েই এসেছি।’ রোস্তমের বাবা বলেন, ‘বিসর্জন এতো সহজ নয় মা। তুমি যে তোমার বাবা-মাকে ফেলে এসেছো, সেটা কি বিসর্জন? তোমাদের দুর্গা দেবীর মূর্তি বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফেরার সময় কিন্তু দুর্গাকে আবার তোমরা বুকে নিয়েই ঘরে ফিরে আসো। সুতরাং বিসর্জন এতো সহজ নয়। অন্তত এটা আমি জানি। তাই যদি পারো, তাহলে আমার ছেলেটাকে একটু বদলাও।’ কিন্তু এই মানবিক চেতনার একমাত্র শ্বশুরকে বা তার মতো গোটা কয়েকজনকে নিয়েই কি এ সমাজে টিকে থাকা যায়? তাই নির্মাণের আগেই নিরুপমার সংসারে আগুন বাড়তে থাকে। বাবা-মায়ের সংসারেও আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। রোস্তম ইদানীং অনুভব করে, শ্বশুরবাড়িতে না যেতে পারারও একটি যন্ত্রণা আছে। ঈদে-উৎসবে বন্ধুরা যখন শ্বশুরবাড়িতে যায়, তখন তার মায়ের কাছে ‘কী বিয়া করলিরে পুত, কোনোদিনও শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারবি না’ এরকম নানা প্রশ্ন রোস্তমকে শুনতে হয়। রোস্তমের তখন কোনো উত্তরই থাকে না। শ্বশুর মনে কষ্ট পাবেন মনে করে নিরুপমা কেবল নিরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলে। কোনো প্রতিবাদ করে না। মরে গেলেও প্রতিবাদ করবে না বলেও ভাবে। কখনো ভাবে যে, এ ক্ষতি তো আর পূরণ হওয়ারও নয়।
শ্বশুরের কথাগুলো প্রায়ই কানে বাজে নিরুপমার। ধর্ম যে ছেড়েছে নিরুপমা, কতোটা ছেড়েছে, পেরেছি কি? যখন শরৎকাল আসে, সে এখনও কেমন যেন আকুল হয়ে উঠে। কেন? সে কি শিশিরের প্রতি ভালো লাগা, নাকি তার উমার প্রতি আবেগ? কাশফুল দেখলেই তার বকুলের কথা মনে পড়ে। বকুল দেব তার ছোট বোন। এখন চিরতরেই ভারতে চলে গেছে। এই ছোট্ট বোনটিকে না দেখে একদিনও তার কাটতো না কোনোদিনও। হায়! এ জীবনে বকুলের সঙ্গে আর কোনোদিনও দেখা হবে না নিরুপমার। সেটা যেন একেবারে পরপারে যাওয়ার মতোই ঘটনা। কোনো এক বান্ধবীর কাছে শুনেছে নিরুপমা ওরফে বর্তমান ‘সুলতানা’ যে, ভারতে যাওয়ার সময় তাদের পারিবারিক শ্মশানের কাছে গিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন একটি প্রখ্যাত স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার পিতা অনিল দেব। কেন তারা ইন্ডিয়ায় চলে গেলেন? এ কথা যদি ধারনাও করতে পারতো নিরুপমা, তাহলে সে কখনোই মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতো না, ভালোবেসে ফেললেও। সে এতোটা করুণ পরিণতি হবে জানলে নিজের প্রেম-ভালোবাসাকেই বিসর্জন দিতো। সে তো মনে করেছিলো এক সময় সবকিছু স্বাভাবিকই হয়ে যাবে। কিন্তু শেষে হলো কী! এমন জানলে কষ্টটা তার নিজের বুকেই না হয় চেপে রেখে দিতো। তার ধারনা ছিল যেহেতু সে তার পিতার বড় আদরের মেয়ে, কিছুদিন পরই বাবা তাকে বুকে টেনে নেবে। বাবা যে এই ঘটনার পর এতোটাই নিষ্ঠুর হয়ে যাবেন, সারাজীবনের নিষ্ঠুরতা একই সঙ্গে দেখাবেন, চিরতরেই পর করে দেবেন, এটা তার ভাবনায় কোনোদিনও আসেনি আগে। অসাম্প্রদায়িকতার বাণী শেখানো বাবার কাছে তার ধর্মটুকু সন্তানের মায়ার চেয়েও প্রিয় হয়ে গেলো?
নিরুপমার স্বামী রোস্তম পাশের গ্রামের গঞ্জেই দোকান দিয়েছে। তৈরি পোশাকের দোকান। বি.এ পাস করে সে চাকুরি করবে, তার বাবা-মা আগে এটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন চাকুরি তার ভালো লাগে না। তাই এখন ব্যবসা নিয়েই এতো ব্যস্ত। এখন তার বাজারের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের দোকান করার চিন্তা। কিন্তু পুঁজির সঙ্কট। হিন্দু মেয়ে বিয়ে না করলে না চাইলেও শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুটা সাহায্য পাওয়া যেতো। এখন সে পথও বন্ধ। মেয়েটা তো জানতো, এমনটা হতেই পারে। অনেক হিন্দু মেয়ে পালানোর সময় তাই সেই ভবিষ্যতের চিন্তা করে বাবার বাড়ির সোনাগয়না নিয়েই পালায়। অথচ নিরুপমা তার ছোটবোন বকুল দেব এর কথা চিন্তা করে এমনটি করেনি। তাছাড়া রোস্তমও তখন বলেছে, আমার ধনসম্পদ কিছুরই দরকার নেই। আমার দরকার তোমাকে। তখন রোস্তম ছিল ছাত্র। আর এখন ব্যবসায়ী। তাই চিন্তাতেও ব্যবসা ঢুকে গেছে। যদিও সে এ বিষয়ে নিরুপমাকে কোনো মানসিক যাতনা দেয় না। কিন্তু যখন শুনলো, নিরুপমার বাবা-মা জমিজিরেত ও ভিটেবাড়ি সব বিক্রি করে তার মামার কাছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহে চলে গেছে, তখন ভাবলো, জমিজিরেত-বসতবাড়িতে কি নিরুপমার অংশও ছিলো না? ধর্ম ত্যাগ করলো বলেই তাকে তার পাওনা থেকেও বঞ্চিত করা হলো? যাক, এ নিয়ে আর ভাবেনা রোস্তম এখন। কিন্তু বুড়োটা এমন প্রতারণা করেছে বলেই কারণে-অকারণে রাত-দিন রোস্তমের অনেক গাল খায়। ঠিক তখনই আর সহ্য করতে পারে না নিরুপমা। ফলে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়াও বাঁধে। সেদিন তো দুজনের এ নিয়ে খুব মারামারিও হয়েছে। এমন করেই চলতে থাকে নিরুপমার ওরফে সুলতানার সংসার। এটাও সহ্য হয় তার। কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়, যখন সে কারো মুখে শুনে, ‘শি...ডি...’। সে নাকি ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’। তাও যদি সে হতো সে রকম কাস্টের কোনো মেয়ে, তাহলেও না হয় কথা ছিলো। কিন্তু সে তো তা নয়। তার তো নিজস্ব বংশগৌরব রয়েছে। আহারে এই দুর্দিনে কে কাকে কেনো বলবে সেই কথা? তাই নিরুপমা আর কারোর সঙ্গেই তেমন মেশে না। আর এতে করে এই ‘শি...ডি...’ কথাটি আরও বেশি প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকে।
নিরুপমাদের বাড়ির কাছে ছিলো এক দিঘি। গগনবেড় দিঘি। আজকাল প্রায়ই তার এ দিঘিটাকে দেখে আসতে খুব মন চায়। দিঘির চারকিনারে খুন্তে বক আর কোঁচবকগুলো সারাদিন বসে থাকতো। সারাটা দিঘিতে উড়ে বেড়াতো, ঘুরে বেড়াতো পানকৌড়ির দল, ডুবুরি হাঁস, বালিহাঁস আর যতীন্দ্রবাবুর পোষা রাজহাঁসগুলো। যতীন্দ্রবাবু নিরুপমার বাবার পিসাতো ভাই। তার বাড়িতে এই পোষা রাজহাঁসগুলোর ঠোকর খাওয়ার ভয়ে অন্য বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা সহজে ঢুকতে চাইতো না। হ্যাঁ, যতীন্দ্র বাবুর বৈঠকখানার পাশেই ছিলো দুইটি বিশাল অশোক গাছ। গাছের চেয়ে সেসব গাছের ছায়াই প্রিয় ছিলো নিরুপমার। এখনও রাতে ঘুম না এলে কিংবা ঘুম ভেঙ্গে গেলে নিরুপমা তার বিছানার শুয়েই যতীন্দ্রবাবুর মানে যতীন্দ্র জ্যাঠুর অশোকফুলের মিষ্টি গন্ধ পায়। তখন তার চোখ ভিজে যায় জলে। গগনবেড় দিঘির দক্ষিণপাড়ের দ্বিজেনবাবুর বাড়িটা ছিলো জারুল ফুলে ছাওয়া। আহারে জারুলের থোকা থোকা নীল ফুলগুলো এই হাতে সে আর ছিঁড়তে পারবে না। আর ঐ গগনবেড় দিঘির শানবাধাঁনো ঘাটের কোনায় দ্বিজেনবাবুর রক্তকাঞ্চন গাছটা। পাখি দেখতে চাইলে, বিশেষ করে ছোট ছোট অনেক পাখি দেখতে চাইলে দ্বিজেনকাকুর রক্তকাঞ্চন গাছের কাছে যাওয়া চাই। মনপ্রাণ ভরে যাবে। রাজঘুঘু, চন্দনা, কখনো বা কোকিল এবং টিয়া এসে হাজির হতো এ রক্তকাঞ্চন গাছে। দ্বিজেনের ঠাকুরমা এবং ঠানদিরা রক্তকাঞ্চন ফুল কুড়িয়ে নিতো পূজাঅর্চনার কাজে। ছাত্রজীবন থেকেই স্বামী রোস্তমকে অনেকটা জেনেছে নিরুপমা। কিন্তু সেটা কতোটা? কারণ এখন রোস্তম যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণই মনমরা। কেন? নিরুপমার ব্যর্থতা কোথায়? এমন বিষন্নতা তার কখনো দেখেনি নিরুপমা। চাঁদে গেলেই আগ্নেয়গিরির বিষন্নতা চোখে পড়ে। অনেক অনেক দূর থেকে শকুনকেও বাবুই পাখির মতো ছোট বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কাছাকাছি এলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। নিরুপমার কিছু সমস্যা তো রয়েছেই। বিশেষ করে সে যে একটি বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে, তা সে প্রায়ই ভুলে বসে থাকে। তারপর আবার ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিমবাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। স্বামীর ঘরে মাংস-পোলাও-কোর্মা- দধি তার বিশেষ চাহিদার বিষয় নয়, তার চাহিদার গুরুত্ব পায় একটি পাখি যখন পুকুরের কোণায় বাসা বানায় বিভিন্ন লতাপাতা এনে, সেটি। অথবা কোনো পাখি যখন পুকুরের পানিতে হেলে পড়া বাঁশে বসে খপ করে ব্যাঙ কিংবা মাছ ধরে ফেলে, সে বিষয়টি। কিছু পাখি শামুক খায় কিংবা কাঁকড়া, তা তার কাছে দেখার বিষয়। বয়সতো একেবারে কম নয়। বাইশ- তেইশ তো হবেই। তারপরও এমন মেয়েলীপনা বড়ই বিরক্তিকর। এমন মেয়েকে সংসারী করা খুব সহজ কাজ নয়। নিরুপমা একদিন স্বামী রোস্তমকে বলে, তোমাদের পুকুরটায় অনেক পাখি রয়েছে। কিন্তু এতে যদি লাল-নীল-শ্বেতপদ্ম থাকতো, কী দারুণ হতো না? আচ্ছা, আমাদের থাকার ঘরের সামনে দিয়ে কয়েকটি বেলিফুলের চারা লাগানো যায় না? সাদা সাদা বেলিফুলের কী সুমিষ্ট ঘ্রাণ! তোমাদের সারাবাড়িতে তো একটাও রক্তজবার গাছ নেই। জবা ফুটলে বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ে। রোস্তম বলে, যেখানে তুমি বেলী ফুলের চারা লাগানোর কথা ভাবছো, ওখানে মা কামরাঙা মরিচের চারা লাগাবে। আগে এখানে একটি লেবু গাছ ছিলো, মরে গেছে। আর রক্তজবা, স্বর্ণচাঁপা ইত্যাদি ফুলের গন্ধ পেলে বাড়িতে রাতে পরী নামবে। সুতরাং এ পরিকল্পনায় মন দিয়ো না। কল্পনা থাক, পরি বাদ দিয়ে পরীদের আসা ঠেকাও। রোস্তমের মুখে পরীর গল্প শুনে নিরুপমা সারাবাড়ি কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসে। রোস্তমের বাবা মেয়ের চড়া গলা শুনে রাগ করেন। ডেকে বলেন, মা, রাগ করো না। আমাদের ধর্মে, আমাদের সমাজে মেয়েদের এমন উচ্চস্বরে হাসতে নেই। ধীরে ধীরে এই বিষয়টিও তোমাকে শিখতে হবে, জানতে হবে। আমি এটা বলেছি বলে মনে কষ্ট নিয়ো না। আরেকজন তোমাকে বাজেভাবেই শেখাবে। কথাটা শুনে নিরুপমার কষ্টের মধ্যে আরও কষ্ট জমা হয়। মাথায় ঘোমটা আরও টেনে দিয়ে সহ্য শক্তির পরীক্ষায় মগ্ন থাকে। রোস্তম ধীরে ধীরে বউয়ের কানের কাছে গিয়ে বলে, চলাফেরাটা ঠিক করো তুমি। তোমার কারণে আমার বাবা-মা প্রতিবেশীদের অনেক কথাই শুনে। তোমার বাড়ি এখান থেকে অনেক অনেক দূরে। তোমার পরিবার কী উচ্চবংশীয় না নি¤œবংশীয়, সেটা কি তারা বুঝে? তাছাড়া তুমি হিন্দুর ঘরের মেয়ে। একটু উগ্রতা দেখালেই তারা মনে করবে তুমি হয়তো কোনো নিচুজাতের মেয়ে। সুতরাং একটু সংসারী হতে চেষ্টা করো লক্ষীটি। দেখছো না, সিডিউল কাস্টের মেয়ে বা ‘শি...ডি...’ বলে কেমন তোমার অপপ্রচার শুরু হয়েছে। তুমি সবার সঙ্গে মিশে যাও, দেখবে সবার মুখেই তালা পড়েছে। কোন কুত্তার বাচ্চা যে কথাটা প্রথম চালু করেছে...। রোস্তমের মুখে ‘শি...ডি...’ কথাটা শুনে নিরুপমার মাথায় রক্ত উঠে। কী, আমি ‘শি...ডি...’? সিডিউল কাস্টের মেয়ে? কে বলে? আমি তার গলা ছিঁড়ে ফেলবো। জিহŸা কেটে ফেলবো। যেখানে আমি ধর্মই ছেড়ে দিলাম, সেখানে কেন আবার আমার কাস্ট নিয়ে এতো কথা? রোস্তম বলে, আরে চুপ করো সুলতানা নিরুপমা, প্লিজ। এ কথা তো আমি কিংবা আমার বাবা মা তোমাকে বলেনি। লোকে বলছে। ওতে তুমি কান দেবে কেন? নিরুপমা বলে, প্রতিবাদ করতে পারো না তুমি? রোস্তম বলে, প্রতিবাদ? ওসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কেলেঙ্কারী আরও বাড়বে। যতোই তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো না কেন, পথ দিয়ে চলার সময় লোকে আমাকেও ডেকে বলে, কী রোস্তম, তুমি নাকি হিন্দু মেয়ে বিয়ে করছো? নিরুপমা বলে, তখন তুমি তাদের কী জবাব দাও? রোস্তম বলে, আমি তখন বলি, হিন্দু মেয়েকে তো বিয়ে করিনি। তাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছি। হিন্দু বিয়ে করলাম কোথায়? রোস্তমের মুখে এমন দুর্বল উত্তর প্রদানের কথা ভাবতেও পারে না নিরুপমা। নিজেকে তখন তার আর রোস্তমের প্রেমিকা মনে হয় না। মনে হয় সে বুঝি তাদের বাড়ির পোষা ব্যথিত কুকুর। স্বামীর বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে কতো কিছুই না ভাবে সে। ভাবে নাগকেশর, জুঁই, চামেলির চারা লাগিয়ে বাড়িটাকে বাগান করে দেবে। কিন্তু সবাই বলে, ওসব তোমার কাজ নয়। তোমার কাজ সংসারের কাজ করা এবং পেটের বাচ্চার খেয়ালখবর রাখা। রোস্তম বাজারে যাওয়ার সময় কাগজের এক পোটলা কিসমিস নিরুপমার হাতে দিয়ে যায়। বলে, ধুয়ে খেয়ে নিয়ো। পেটের বাবু কিসমিস পছন্দ করবে। কিন্তু রোস্তম যেতে না যেতেই নিরুপমা পোটলার সব কিসমিস রাগে- দুঃখে পোষা কুকুরটাকে দিয়ে দেয়। ইচ্ছে হয় তার নিজের ধুতুরার বিষ মুখে দিয়ে দেয়। কিন্তু পেটের সন্তান তাকে এতোটা নিষ্ঠুর হতে দেয় না। কষ্টে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে। রোস্তমের মা দেখে ফেলেন। বলেন, কী হয়েছে বৌমা। কাঁদছো কেন? কাঁদছি না মা। গোলমরিচ মুখে দিয়েছিলাম। নিরুপমার উত্তর। কেন গোলমরিচ খেতে গেলে? পেটের বাচ্চা ক্ষতি হবে যে। এ কথা বলেই শ্বাশুড়ি নিরুপমাকে একটি আপেল এনে দেয় খেতে। এখন এই বাড়িতে সবার কাছে নিরুপমা বা সুলতানার চেয়ে তার পেটের বাচ্চার আদরই বেড়ে গেছে। এদিকে তবু শ্বাশুড়ির একটু আদর পেয়েই নিরুপমা বলে, মা আমাদের একটি টিয়ে পাখি পোষলে হয় না? শহরে খাঁচাসহ কিনতে পাওয়া যায়। নিরুপমার শ্বাশুড়ি বলে, সুলতানা মা, তোমার বয়স খুব কম। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলো না, যার কোনো প্রয়োজন নেই। দুইটা-তিনটা মুরগী দেখে রাখতে পারো না, তুমি পোষবে টিয়া? টিয়া পাখির ডিম খাওয়া যাবে? না তার মাংস খাওয়া যাবে? ডেকে বিপদ এনো না। নিরুপমা বলে, মা, টিয়ে পাখি পোষার অভিজ্ঞতা আমার আছে। আপনার ছেলেকে একটি পাখি এনে দিতে বলেন না মা। শ্বাশুড়ি আর কথা বলেন না। নিরুপমার কাছ থেকে অন্য কাজে চলে যান। রোস্তমের পিতা চলে যান বাড়ির কাছের জমিটার একটুখানি ভাঙ্গা আঁল কাজের লোক দিয়ে বাঁধাতে। রোস্তমের মা পাখির হাত থেকে পাকা ধান রক্ষা করতে কয়েকটি কাকতাড়–য়া বানানোর কাজে মন দেন। আর নিরুপমা? বসে বসে কুমড়োপোকার বাসা বানানো দেখে এবং কিছুক্ষণ পর একটি গঙ্গাফড়িং ধরতে তার পিছু পিছু ধানের জমিন পর্যন্ত চলে যায়। কর্দমাক্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসে ওদিকে শ্বশুরের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পর। নিরুপমার গর্ভে যে সন্তান আসে, তা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। ঠিক এ সময়ে তার মা শর্বরী দেবকে খুব মনে পড়ে তার। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে শর্বরী দেব কতো কষ্ট করেছেন, এখন সে তা ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারে। কিন্তু এখন আর তার মাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ নেই। মায়ের খোঁজ জানতে পারেন অনিমেষ মামা। মামা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কোনো এক ফাঁড়িতে বি এস এফে-র চাকুরি করেন। রোস্তম প্রায়ই মজা করে বলে, তোমার মামা তো বর্বরের চাকুরি করেন, চান্স পেলেই বাংলাদেশীদের গুলি করে দেন। নিরুপমা কিছুই বলে না। ভাবে, এসব নিয়ে অহেতুক তর্ক করে কী লাভ? নিরুপমাকে কয়েকবারই ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার মনের ভয় আর কাটে না। অন্যদিকে পেটের সন্তানের জন্য ঝাঁড়ফুক ও তেলপানি পড়াও অবিরাম চলে। তবু তার মনে ভয়। শ্বাশুড়িকে বলে, মা, কোনো মূর্খ ধাইয়ের হাতে যেন আমার সন্তানের প্রসব করানো না হয়। আমি মেয়ে মানুষ। আমার কথা কেউ গুরুত্ব নাও দিতে পারেন। আপনি মা, আপনার কথা সবাই শুনবে। আপনি আমাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। মূর্খ ধাইয়ের হাতে একদা রোস্তমেরও জন্ম হয়। তখন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছিলেন রোস্তমের মা। রোস্তমেরও বাঁচার আশাই ছিলো না। ধীরে ধীরে সুস্থ হয় ওরা। রোস্তমকে দেখে অভিভূত হয় রোস্তমের দাদা। রোস্তমের বাবা কাশেমের সংসারে স্থায়ী হওয়ার লাইসেন্স পান রোস্তমের মা। সে অনেকদিন আগের কথা। তাই তিনি সুলতানার কথায় রাগ না করে বলেন, মা আমি থাকতে তোমার এতো ভয় কিসের? তোমার মা কাছে নেই, তুমি তো আমারই ছেলের বউ। শ্বাশড়ির ¯েœহ পেয়ে কেঁদে দেয় নিরুপমা। বলে, মা, ডাক্তার বলেছে আমার মেয়ে হবে। যদি মেয়েই হয়, তাহলে তার নাম রাখবেন ‘বকুল’। আমার ছোটবোন বকুলকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। আর যদি আমি সন্তান জন্মের সময় মরেই যাই, তাহলে আপনার বাড়িতে একটি বকুলগাছ লাগাবেন। আমার মেয়ে মায়ের খোঁজ করলে বলবেন, এই বৃক্ষই তোর মা। বকুল গাছের তলের ছায়ায় বসে প্রাণ জুড়াবে তার। ছেলে হলে নাম রাখবেন পলাশ কিংবা কাঞ্চন। আমার দ্বিজেন কাকুর রক্তকাঞ্চন গাছটা আমার খুবই প্রিয় ছিলো। মনে হয় এ জীবনে সে গাছ আমি আর দেখবো না মা। আরেকটি কথা, আমার মেয়েকে যেন কেউ কোনোদিন ‘শি...ডি...’ বা ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’ না বলে। আমি কোনো ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’ নই। আমার কোনো ‘কাস্ট’ নেই মা। আমি একজন মানুষ এবং আপনার মতোই একজন নারী। এ পর্যন্ত বলেই কাঁদতে থাকে নিরুপমা। আর কথা বলতে পারে না। নিরুপমার শ্বাশুড়ি বলে, তুমি মানুষের কথায় কান দিয়ো না সুলতানা। মানুষের মুখে তো আর তালা দিতে পারি না। নিরুপমা বলে, সেদিন ফুপু বলেছেন, মেয়েটা তো সুন্দরীই। কিন্তু শুকনা এবং রসকষহীন। মা, আমার কারণে আমার পুরো পরিবার আজ দেশছাড়া। রসকষ আমি কোথায় পাবো বলেন। নিরুপমার শ্বাশুড়ি বলেন, উনি একটু বেশি কথাই বলেন, ওতে তুমি কান দিয়ো না। বয়সে আমার অনেক বড়। কিছু কি বলা যায়? নিরুপমা বলে, আপনাদের কাছে আমার শরীরটা পড়ে আছে মা। কিন্তু প্রাণটা সারাক্ষণ মায়ের কাছেই। আমার বাবা-মা নিরামিষভোজী। দেখেন না আমারও মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা বিঁধে।
সেদিনই রোস্তম রাতের বেলা বাজার থেকে ফিরে নিরুপমার হাতে বাজারে আসা কতগুলো নতুন দশ টাকার নোট দেয়। নোটে বাংলাদেশের কোনো একটি মসজিদের ছবি। নিরুপমা রোস্তমকে প্রশ্ন করে, অনেক নোটেই অনেক মসজিদের ছবি দেখেছি। কিন্তু কোনো নোটে মন্দিরের ছবি নেই কেন? রোস্তম এ কথার উত্তর দেয় না। বরং এ রকম প্রশ্ন শুনে কিছুটা রাগও করে। তাই চুপ থাকে। নিরুপমাও বুঝতে পারে। হঠাৎ সে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে, আমরা কিছু পায়রা পোষতে পারি না রোস্তম? পায়রা তো খাওয়া যায়। সারাদিন দোকানের খাটাখাটানির পর এসব কথা সহ্য হয় না রোস্তমের। তবু সহ্য করে চুপ থাকে। মনে মনে ভাবে, হায়! এই মেয়েটারে আল্লাহ আর বুদ্ধিসুদ্ধি কোনোদিনও দেবে না। রোস্তম বলে, নামাজ পড়েছো? নিরুপমার সরল উত্তর, না। শরীরটা ভালো লাগছে না। রোস্তম বলে, নামাজ হলো আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। এতে মনেরও প্রশান্তি বাড়ে। নিরুপমার মন তখন আকাশ ছোঁয়। বলে, একটি তারার নাম নাকি রেবতী। সেটা কোনটা তুমি কি তা জানো? রোস্তমের শরীর খুবই ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে এসে নিরুপমার হাত থেকে গামছা নিয়ে মুখ মুছে। নিরুপমার অসংলগ্ন কথা বলার মাত্রা আরও বাড়ে। বলে, আমি আজ চাঁদ ওঠা দেখবো, মধ্যরাতে। তুমি দেখবে? রোস্তম নিরুত্তর। নিরুপমা বলে, রোস্তম, তোমাদের বাড়ির পশ্চিমের ইটাখোলার ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। ভাটাটা এখান থেকে সরানো যায় না? চিমনি থেকে যেভাবে ধোঁয়া উঠে, মনে হয় শ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া ভিতরে ঢুকে আমার ফুসফুসটা কালো হয়ে গেছে। রোস্তমের রাগ বাড়ে। ইচ্ছে হয় সুলতানা নিরুপমাকে একটি কষে থাপ্পড় দেয়। কিন্তু কথা দিয়েও থাপ্পড় দেওয়া যায়। তাই রোস্তম বলে, তুমি কি কখনো কচ্ছপের মাংস খেয়েছো? নিরুপমার সহজ সরল উত্তর, না। নিরুপমা বলে, জানো ছোটবেলায় আমি অনেক কালা বাউস মাছ ধরতে পেরেছিলাম। রোস্তম বলে, ইলিশ মাছ ধরোনি কখনো? নিরুপমা বলে, না, আমি একবার একটি ঢোঁড়াসাপকে পিটিয়ে মেরেছিলাম। সাপটি কিন্তু অনেক বড়ই ছিলো। এ কথা শুনে রোস্তম হেসে দেয়। বলে, কাঁকড়া মারোনি? নিরুপমা বলে, না। তবে একবার কাঁকড়ার কামড় খেয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে একটি শাখানদীর বাঁক আছে। কৃষ্ণমতী নদী। ওখানে বিলঝিলও আছে। আর আছে নানারঙের পাখি। ওখানে যাওয়ার সময় পথে পথে পাখির রঙিন পালক পাওয়া যায়। ওখানে অনেক বুনোপায়রাও আছে। মুনিয়া পাখিরা শরৎকালে বাসা বানাতে কাশফুল ছিঁড়ে নেয়। বালিহাঁস, পানকৌড়ি চোরকাঁটা-উলুখাগড়ার বনে ঘুরে। কিছু পাখি কচি ঘাসও খায়। রোস্তম বলে, ওখানে কচ্ছপ আছে? নিরুপমা বলে, কাঠশোলা, ফুলশোলা, হোগলা, কচুরিপানার ভিতর, বনতুলসীর ঝোপঝাড়ে, কাশবনে-ঘাসবনে বনবিহারী পাখি থাকে। ডাকেও বিভিন্ন শব্দে। এলাকার লোকজন মাঝে মাঝে খরগোসের বাচ্চা ধরে আনে, কেউবা কচ্ছপও। পাখির বাসা সবচেয়ে বেশি শেওড়াগাছগুলোতেই। ওখানে আবার সাপের ভয়ও আছে। রোস্তম বলে, শুধু কি পাখির গল্পই করবে? ভাত খাওয়াবে না? রোস্তমকে ভাত খাওয়ানোর আয়োজন করে নিরুপমা। কিন্তু মুখ চলতেই থাকে। তোমাদের পুকুরের জলও পরিষ্কার। কিন্তু আমাদের গগনবেড় দিঘির জলের মতো টলটলে নয়। আমি শুনেছি সেই দিঘিতে এক জলপরীও থাকে। রাতে সে গগনবেড় দিঘি থেকে কৃষ্ণমতী নদীতে গিয়ে পড়ে। এভাবে সে কথা বলতেই থাকে এবং এক সময় কথা বলা শেষ না হতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রোস্তম দৌড়ে এসে ধরে। দেখে তার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। শরীরেও তখন উচ্চ রক্তচাপ। রোস্তম তার মাকে ডাকে। মা ও ছেলে মিলে নিরুপমাকে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়। অজ্ঞান অবস্থাতেই সে তখন খিঁচুনি দিতে থাকে। কাঁপনিও দেখা দেয়। অবসন্ন নিরুপমাকে দেখে ভয়ে রোস্তমের হৃৎকম্প বাড়ে। দৌড়ে চলে যায় ডাক্তার বাড়ির দিকে।
ঘড়ি ংঃধৎঃরহম ভৎড়স ঃযব ভঁঃঁৎব:
রোস্তমের মৃত্যুর পর নিরুপমার মেয়ে ‘বকুল’ একজন হিন্দু যুবককে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সংসার জীবনে তাকেও ‘শি...ডি...’ গাল শুনতে হয়েছি

২৪| ০৪ ঠা মে, ২০১৮ রাত ৮:৫৮

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প:
মাধুরী আর কলেজেই যাবে না
জসীম উদ্দিন অসীম

বাজারের বস্ত্রের দোকানগুলোতে এতো শত, এতো হাজার রঙিন ওড়না থাকতে আজ সকলের আলাপের বিষয় হলো ‘মাধুরীর গোলাপী ওড়না’। কারণ অনিন্দ্যসুন্দরী মাধুরীর ওড়না ধরে আজ টান দিয়েছে হাকিম মুন্সীর ছেলে দেলোয়ার। মাধুরী বারীনের বড় বোন। বারীন হতাশাবাদী এক কিশোর। আর তাদের বাবা তো ছিলেন একেবারেই ‘পারমানেন্ট’ এক হতাশাবাদী মানুষ। কয়েক মাস আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আর দেলোয়ারের দাদা, মানে হাকিম মুন্সীর বাবা ছিলেন এলাকার খুবই নামীদামী মানুষ। আরও ছিলেন নেজামে ইসলামীর নেতা। তাই রাজনীতি আর হাকিমমুন্সীও ছাড়েননি। এই ঘটনার পর হাকিম মুন্সীদের সঙ্গে কে লড়বে?

দেলোয়ার তার এক বন্ধুকে নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ওঠানোর পর বাড়ির দিকে ফিরছিলো। পথেই হঠাৎ মাধুরীকে একা পায়। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলো মাধুরীও। হঠাৎই তাঁর সারা শরীরে ভ‚মিকম্প আঘাত হানে। পেছন থেকেই ওড়না ধরে হেঁচকা টান দেয় দেলোয়ার। তখন অবশ্য মোটর সাইকেলের গতি ছিলো সবচেয়ে নিচের দিকে। আর সেটা চালাচ্ছিলো তখন হোসেন।

অনিন্দ্যসুন্দরী মাধুরী প্রতিদিনই একা কলেজ থেকে ফিরে না। বান্ধবী হামিদার সঙ্গেই ফিরে। আজ হামিদা অসুস্থ ছিলো। এই ঘটনা কেউ দেখেনি, প্রথমে এমনটাই মনে করা হয়েছিলো। কিন্তু পরে জানা গেলো দূরের জমি থেকে ঘোষপাড়ার চন্দন, সরকার বাড়ির জগদীশরা সবই দেখেছে। জগদীশ জোরে ডাক দেয় বাপ মরা মেয়ে মাধুরীকে। মুহূর্তেই বেজির মতো কেটে পড়ে দেলোয়ার আর হোসেন।

দেলোয়ারের বড় ভাই বিদেশে থাকেন। মাসে মাসেই টাকা পাঠান। তাই যেন সে আরও বেপরোয়া। তাই আজ যেন এই ঘটনাকে উপভোগই করে দেলোয়ার আর হোসেন। তার চেয়ে বয়সেও ছোট তারই মামাতো ভাই হোসেন।

১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর এই এলাকার কাইমুল, মনিরুল ও সাবিরুলরা বিনোদবাবু ও পুলিনবাবুর পরনের ধুতি টেনে খুলে ভীষণ তামাশা করেছিলো। বিনোদ-পুলিনরা তখন এলাকা ছেড়ে পালাতে যাচ্ছিলেন। তখন এই এলাকাটা হয়ে গিয়েছিলো নেপালদের কাছে অচেনা এক এলাকা। বিনোদবাবু ও পুলিনবাবু এই নেপালেরই বাবা-কাকা। সেই কবে ধুতি ধরে টান দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো, তা অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলো মানুষ। কিন্তু আজ মাধুরীর ওড়না ধরে টান দেওয়ায় একই সঙ্গে পুরনো সেই ধুতি টেনে খোলার প্রসঙ্গও চলে এলো স্বপন-সুবীর-রত্মা-সুব্রত ও নন্দিতাদের মনে।

ভারত-বাংলাদেশের কোথাও এখন হিন্দু-মুসলিম সংঘাত নেই। ঠিক এমন সময়ে হিন্দু অধ্যুষিত পুরো গোপালনগর গ্রাম তপ্ত হয়ে গেলো মাধুরীর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মাধুরীর মা বিনোদিনী মেয়েকে বলেছে ঘটনা যেন ভুলে যায়। কিন্তু মাধুরীদের প্রতিবেশী যুবক বলাই শুরু করে আরেক অঘটন। পাড়ার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হানা দেয় জগন্নাথ ও রাজবিহারী দাশদের বাঁশঝাড়ে। অসংখ্য বাঁশের কঞ্চি কেটে লাঠি বানাতে থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ মাথায় লাল কাপড় বেঁধে সবার ঘরে ঘরে একটি করে লাঠি দিয়ে আসে। বলে, লড়াই হবে-প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্রোধে লাল হয়ে বলাই আরও বলে, সহজ সরল হিন্দুদের আমি দুই চোখেই দেখতে পারি না। লোকে আমার বাবাকে গোঁড়া হিন্দু বলে। আমিও গোঁড়া হিন্দুকেই পছন্দ করি।

ওদিকে সাবিরুলদের পাড়াতেও এই খবর রটে যায়। রাতে সাবিরুলদের ঈদগাহ-সংলগ্ন মসজিদে নামাজ শেষে মাধুরীর প্রসঙ্গ ওঠে। সবাই বিষয়টা শুনে কিন্তু এ কাজটা অন্যায় হয়েছে, মেনেও সবাই ঘটনাটি চেপে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।

বলাই ওদিকে কয়েকজনকে নিয়ে সন্ধ্যায় যায় কালীমাতা মন্দিরে। মন্দিরের পাশে গঙ্গাদিঘির ঘাটে বসে দেলোয়ারকে কী করা যায়, এ প্রসঙ্গ তুলে। হীরেন বলে, ইচ্ছা হয় শালারে শ্মশানে আইনা পুইড়া মারি। সেইবার শীতলা মেলার সময়ও সে আমার সঙ্গে গায়ে লাগতে আইছিলো। অনাথকাকু সঙ্গে ছিলেন। আমাকে আর লাগতে দিলেন না। ‘হলধনকা’ থাকলে কিন্তু এই দেলুয়ারে তখনই...। তার বোন সুরাইয়াও খুব উগ্র। হামিদারে কয়, মাধুরীর লগে যাস কেন? হিন্দু আবার বান্ধবী হয় ক্যামনে। হিন্দুরার শইলে কেমন গন্ধ।

তপন বলে, আমি শুনছি দেলু মদ গিলে। অনুপম বলে, খোঁজ নিয়া দেখ, শুধু গিলেই না, অন্যকেও গিলতে দেয়। ব্যবসা করে।
বলাই বলে, এমন আলাপে দেলুর কি একটা লোমও ছিঁড়ে? আলাপের-আড্ডার দরকার নাই, কাম দরকার। তার বাপ আইনের মারপ্যাঁচ জানে। না বুঝে কিছু করা যাবে না।
হীরেন বলাইয়ের কাছে জানতে চায়, এখন তাহলে কী করা দরকার। বলাই বলে, মাধুরীকে অনেকদিন ধরেই ডিস্টার্ব করছিলো দেউল্যা। কাকীমার কাছে শুনছি। দেখলেই নাকি বলতো, মাধুরীর যুগ শেষ। তোমারে আমি সুস্মিতা সেন বলবো। তুমি কি মুসলমান হইবা মিস সুস্মিতা সেন। তাহলে তোমার আমার বেহেস্তটা পাক্কা হইয়া যায়।
হীরেন বলে, তারপর?
বলাই বলে, মাধুরীও ক্ষেপে যায়। দেলুরে জুতা দেখায়। দেলু হাসতে হাসতে বলে, আইজ থাইক্কা তোমার নাম দিলাম শ্রীমতি গোলমরিচ। ও মিস গোলমরিচ, গরুর মাংস রান্না করতে কিন্তু গোলমরিচ লাগে। ঝাল ঝাল গরুর মাংস আমার ভীষণই পছন্দ।

তপন বলে, আমিও সেই কথা জানি। ওই ঘটনার পর মাধুরী কিছুদিনের জন্য কালিদাসপুর তার পিসির বাড়িতে চলে গিয়েছিলো।
ততোক্ষণে চাঁদ উঠেছে আকাশে। গঙ্গাদিঘির টলটলে জলের ভিতর চাঁদটাকে দারুণ সুন্দর লাগছিলো। মাধুরীর মতো সুন্দর? বলাই মনে মনে ভাবে। মেয়েটার প্রতি তারও এক ধরনের প্রেম সৃষ্টি হয়ে আছে। গঙ্গাদিঘির উত্তরপাড়ে লকলকে ঘাস এবং পশ্চিমপাড়ে হিজলছায়া দেখে তার এখন কবিতা লিখতেই ইচ্ছে করছে। হঠাৎ সে দিঘির জলে কল্পচোখে রাশি রাশি রক্তপদ্ম দেখে। সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপ দিয়ে জলে লাফিয়ে পড়ে। এর কোনো অর্থই কেউ খুঁজে বের করতে পারে না। জল থেকে ঘাটে উঠে বলাই এক কৌশল আঁটে। সবাইকে বলে, ভ‚ত আমারে জলে ফেলে দিলো, তোরা কিছুই করলি না? এ কথা বলতে দেরী, আর সবাই হুড়মুড় করে বাড়ির দিকে দৌড় দিতে দেরি নেই।

ওড়না টানার খবর শুনে মাধুরীর বান্ধবী শ্রীরাধাও পরদিন বাড়িতে আসে। আর সেদিন থেকেই মূলত মাধুরী আর কলেজে যায় না। পাশের বাড়ির শিবরাম কবিরাজ বলেছেন, মাধুরী তুই কলেজে রেগুলার যা। দেলুর ঘটনার জন্য দু’দিন আগে আর পরে ঠান্ডা মাথায় একটা বিচারের ব্যবস্থা করবোই আমরা। মাধুরী এ কথায় কান দেয়নি। নিজেদের করমচা গাছের তলে বসে চুপচাপ চোখের জল ফেলেছে। শিবরামের ছোট ভাই শুভায়ু বললেন, যা করার ঠান্ডা মাথায়ই করতে হবে। গরম মাথায় কিছু করলে ওরা বাজারে আমাদের দোকানেও আগুন দিতে পারে। নব্বই আর বিরানব্বইয়ের কথা মনে নাই? এলাকার বাজারে একটিমাত্র মিষ্টির দোকান রয়েছে সিদ্ধার্থের। সিদ্ধার্থজীও চুপচাপ। দোকানের কর্মচারী শিবার মুখে ঘটনা শুনে বলেন, বাড়াবাড়ি করে আর কী ই বা হবে! দেলুদের নাকখত না দিয়ে বাজারে কেউ ব্যবসা করতে পারে? ইদানিং তার শইলে অনেক তেল জমা হইছে। আমাদের তাপে ওই তেলচর্বি গলবে না। সে তো কিছুদিন আমার ভাতিজি পায়েলেরও পিছু নিছিল। বড় কষ্টে তার ছায়া তাড়ানো গেছে। পায়েলকেও তখন কিছুদিনের জন্য শ্যামগঞ্জে পাঠাই দিছিলাম। এখন মাধুরীর জন্য কী করা, ভাবা দরকার।

মাধুরীদের গ্রামের আরেক উগ্র হিন্দু যুবক অভিজিৎ। সে বললো, আমরা কি খ্রিষ্টান নাকি যে কলা মুখে দিয়ে বসে থাকবো? বাংলাদেশে কি আর কোনো হিন্দু নাই? ওরা মুসলমান হইছে বইলা কি পুরাটা দেশ কিন্যা নিছে নাকি? বাংলাদেশের হিন্দু শালাদের এই বড় দোষ, ছোট কিছু হলে চুপচাপ হজম করা এবং বড় কিছু হইলে ইন্ডিয়ায় পালাইয়া যাওয়া। আরে মেয়েটার যেমন নির্যাতন দেউল্যা করছে, তার হাত না ভাঙ্গি, কমপক্ষে তার বাপের কাছে বিচার দেই! এতো বড় ঘটনার বিচার না চাওয়া, বিচার না করাও তো পাপ। প্রতিবাদ না করাই তো অধর্ম!

কিন্তু অভিজিতের কথায় সায় দিয়ে কেউ এগিয়ে আসে না। অভিজিতদের আত্মীয়স্বজনও প্রায় সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। অনেক আগেই। এক মামা ছিলেন কলকাতার ক্ষুদিরাম বোস রোডে থাকতেন। এখন তার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। কারণ ওরা খুব শিক্ষিত ও ধনী। আর ওদের ওই একই বক্তব্য, মাটির মায়া ছেড়ে তোরা চলে আয়। কারণ ওই দেশটা আসলে আমাদের না। জীবন দিয়ে দিলেও ওই দেশে তোরা সম্মান পাবি না। ওই মামার বাবাও ছিলেন খুব শিক্ষিত। ১৯৪৯ সালে মেট্রিকুলেশন করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধের লগ্নে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। পরে সেই মামার বাবা চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন প্রথমে জাপানে এবং পরে জার্মানীর একটি কোম্পানীতে। ওই জার্মানীতেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। অভিজিতরা সেই দৌড়ে শামিল হতে পারেনি।

তবে অভিজিতেরও ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরের ঘটনাগুলো মনে আছে। ওদের গ্রামে তখন পুলিশ চলে এসেছিলো। কিন্তু আসার আগে পর্যন্ত যা ঘটেছিলো, ভুলেনি সে। খেলাধুলা শেষে ক্লান্ত শরীরে একটি আইসক্রীম কিনে খাচ্ছিলো সে। সঙ্গে তার বন্ধু বীরভদ্র। দুজনে মিলে ওই একটি আইসক্রীমই ভাগাভাগি করে খাচ্ছিলো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দেখে এসেছিলো তার মা চালকুমড়ো ভেজে সর্ষে ভাজা দিয়ে মাখছিলো। কতোক্ষণে ঘরে গিয়ে খাবে, সেই দিকেই মন পড়েছিলো। হঠাৎ দেখলো, চিত্ত ও অমিয়দের বাড়ির দিকে মাদ্রাসার কিছু ছাত্র লাঠিসোঁটা নিয়ে খুব দ্রæত গতিতে দৌড়ে যাচ্ছে। ওদের দলে লোক হবে ৩৫ থেকে ৪০ জন। ওরাও সেদিকে দৌড় দিলো। সামনে পড়লেন আশরাফ চাচা। তিনি আবার রাজনীতি করেন। তার দলের নাম জাসদ। এই দলকে এলাকায় কেউ ‘বাল’ দিয়েও জমা দেয় না। তিনি চিৎকার করে ধমক দিলেন, বীরভদ্র কই যাস। তাড়াতাড়ি পালা। ওরা তোদের হিন্দুদের খুন করবে। বাজারে একসময় সেলাইসুতার দোকান ছিলো আশরাফ চাচার। এখন নেই। অভিজিৎ বললো, চাচা ওরা হিন্দু মারবে কেন? আশরাফ চাচা বললেন, কারণ ওরা মুসলমান নয়, ওরা শিবির। ওরা জীবন্ত মুসলমানেরও রগ কেটে দেয়। আর তোরা তো হিন্দু। এখন আবার ইন্ডিয়ার হিন্দু শিবিরের গুন্ডারা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গছে। তাই বাংলাদেশের শিবির এমন ক্ষেপছে।

শিবিরের পোলাপানের কোপে প্রথমে কতল হলো অমিয়দের বাড়ির রক্তজবা আর বেলিফুলের গাছগুলো। চিত্তের কাকীর বøাউজের বাইরে বেরিয়ে থাকা পিঠে শক্ত করে কয়েকটি কিল মারলো শিবিরকর্মী মতিন। হাত থেকে শাক ফেলে বড় পুকুরের ঝোঁপের দিকে দৌড় দিলো রমা। টুপি পরা লাঠি হাতে এতো লোক আসতে দেখে আগেই গাছে উঠে বসেছিলো নীতিশ। কৃষ্ণার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। কৃষ্ণা লুকিয়েছে পানের বরজে। কৃষ্ণার চোখের জল পানপাতা বেয়ে টপটপ করে মাটিতে নামে। কৃষ্ণাকে পেলে ওরা ধর্ষণও করতে পারে। কারণ ওদের শেখানো হয়েছে, এই কাজে ওদের সওয়াব জুটবে। না করলে পাপ হবে। ওদের লিডারও সঙ্গে আছেন। এলাকার কিছু নিরীহ মুসলমানদেরও ওরা নিজেদের জায়েজ করতে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আর ওই লিডারের কথাতেই ওরা নিমাই গাঙ্গুলিরও মাথা ফাটিয়ে দেয়। গাঙ্গুলি বাবু একটি কোলস্টোরে চাকুরি করেন। বাড়ি যাচ্ছিলেন চিত্তদের পুকুরপাড় ধরে। এই গাঙ্গুলিবাবু অনেকদিন ভারতের কোচবিহার ও জয়নগরে ছিলেন। কিন্তু ওখানে তার থাকতে ভালো লাগে না। তাই ফিরে আসা।

দেলুর মাধুরীর পেছনে লাগা একদিনের ঘটনা নয়। কয়েক বছরের পুরনো। তখন মাধুরীর বাবাও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বিষয়টিকে এতো বেশি পাত্তা দেওয়া হয়নি আগে। তাছাড়া মাধুরীর বাবাও জানতেন, দেলুদের সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদদের কেমন যেন আত্মীয়তা রয়েছে। সুতরাং তাদের সঙ্গে সাধারণ বিষয়াদি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই উত্তম।

বছর তিনেক আগে মাধুরী যখন গ্রামের হাইস্কুলে পড়ে, তখন একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে এই দেলোয়ার হোসেন দেলু সামনে দাঁড়িয়েছিলো তাঁর সাইকেল নিয়ে ইটখোলার কাছে। ইটখোলার আকাশ ছোঁয়া চিমনি দিয়ে তখন ধোঁয়া উঠছিলো ভীষণভাবে। দেলু তখন মাধুরীকে বললো, মাধুরী ঐ চিমনীর ধোঁয়া বের হয় আমার বুকের আগুন থেকে। তোকে না পেয়ে আমার বুকে আগুন লেগে গেছে।

মাধুরী তখন বলেছিলো, ওই ইটখোলা তো আপনার চাচার। বন্ধ করে দেন। আমরাও এই বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে বাঁচি। আপনার চাচার ট্রাক্টরগুলো তো আমাদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তাগুলোও ভেঙ্গে দিয়েছে। এমন সুন্দর গ্রামটাকে ধুলাবালি দিয়েও শেষ করে দিচ্ছে।

দেলু তখন বলে, আমার চাচারে নিয়া কোনো কথা কইস না মাধুরী। চাচা জানলে তোর বাপেরে শুদ্ধ...। দেলুু আর কথা বাড়ায় না। মাধুরী বলে, ওসব জানি। আপনার চাচার কিছু গুন্ডা আছে। আর তার সঙ্গে পুলিশের খুব ভালো সম্পর্ক। এবং ওই তালগাছ পর্যন্ত জমিগুলোও তার। কিন্তু তাই বইলা গ্রামের মানুষ তারে এতোটা ইজ্জত করে না, দেলুভাই আপনি যতোটা ভাবছেন।

দেলু বলে, মাধুরী মুখ সামলাইয়া কথা কওয়া শিখিস। আমি তোরে ভালোবাসি বইলা চাচার বিরুদ্ধে বলা এইসব কথা হজম করলাম। অন্য কেউ হইলে...। জানস মাধুরী, চাচা আগামীতে চেয়ারম্যান ইলেকশন করবো? মাধুরী দেলুর এই কথায় আর কান না দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। দেলু তখন খোলা মাঠের রাস্তায় মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, মাধুরী তুই ইন্ডিয়ার বিএসএফের মতো নিষ্ঠুর হইস না। আমার বুকের রক্ত ঝরাইস না।

মাধুরীও চিৎকার করে জবাব দেয়, বিএসএফ আমার বাপ লাগে না। ওদের সঙ্গে আমার তুলনা দিবেন না। আর আপনি যে আজিজ কাকার মেয়ে রহিমার সঙ্গে প্রেম করেন, ওই কথাটাও আমি জানি।

আজ পাঁচদিন মাধুরী কলেজে যায় না। মাধুরী বলেছে, আর যাবেই না। লেখাপড়াও ছেড়ে দেবে। মাধুরীর ছোটভাই বারীন সব শুনে। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মাধুরী কলেজে গেলে না গেলে বারীনের কোনো লাভ-ক্ষতি আছে কী না, সেটা সে অতো তলিয়ে দেখতে শিখেনি। তার আছে হাঁপানিসহ শ্বাসকষ্টের কিছু অসুখও। তাই সে বেশিকিছু ভাবতেও পারে না। তার ভালো লাগে রাজেশ্বরী দিঘির ঘাটে বসে পানকৌড়ির মৎস্য শিকার দেখতে, বাজারের বটবৃক্ষের বোর্ডে লাগানো সিনেমার পোস্টার দেখতে এবং ইন্ডিয়ান হিন্দী সিনেমার নায়িকা মাধুরীর ‘এক দো তিন’ গানের সঙ্গে যে নাচটা তার বোন মাধুরীও প্রায় সবটা শিখে নিয়েছে, সে নাচটা দেখতে, আর ক্ষুদ্র টুনটুনিগুলো কিভাবে পাতা সেলাই করে নিজেদের বাসা গড়ে, তা দেখতে। বাড়ির কেউই তার উপর কোনো বিষয়ে বিশেষ ভরসা রাখে না।

এমন সময় হঠাৎই মাধুরীদের গোপালনগর গ্রামে রটে গেলো অভিজিৎকে বাজারের কাছে বেঁধে রেখেছে দেলোয়ার হোসেন দেলু। যে যার মতো ছুটে গেলো। গিয়ে দেখলো অভিজিতের ছোঁড়া ইটে দেলুর মাথা কেটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। এলাকার মনু ডাক্তার সেলাই দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন। কাছেই অভিজিতকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। সবাই দেখছে তাঁকে ভীষণ কৌত‚হল নিয়ে। অভিজিতের শম্ভুকাকা বললেন, অভি তুই দেলুভাইয়ের মাথায় কেন ইট মারলি?
অভিজিতের প্রশান্ত জবাব, এমনি।
আর তখনই শম্ভুলাল দেলোয়ারের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে বলেন, দেলু ভাই, এবারের মতো তাকে ক্ষমা করে দেন। সকল ক্ষতিপূরণ দেবে অভিজিৎ। আমরা করবো তার বিচার। ক্ষতিপূরণও দেবো। এবারের মতো ক্ষমা করে দেন।

দেলুও শান্ত ও ধীর করে জবাব দেয়, ক্ষতিপূরণ? আমার শরীর থেকে যতোটা রক্ত ঝরছে, তোমার ভাতিজার শরীর থেকেও ততোটা রক্ত ঝরাবো। শম্ভুলাল দেলোয়ারের পা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমাদের ক্ষমা দেন দেলু ভাই। ক্ষমা করে দেন।

দেলু হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, তাহের, তেতাল্লিশপাড়ার মুসা হাজ্জামকে খবর দে। আজ ডেডাইয়ার বাচ্চার মুসলমানি করামু। তার নাম রাখমু মনির পাগলার নামে-মনিরুল ইসলাম।

দেলুর মুখে এই কথা শুনে চর্তুদিকে হাসাহাসির ঢেউ বয়ে যায়। অনেকে মুখে মুখে ভীড় থেকে সায় দেয়, হ্যাঁ হ্যাঁ মালোয়ানের বাচ্চারে মুসলমানি করানো দরকার। খৎনা হোক হারামজাদার। ভীড় থেকে একজন চিকন সুরে বলে, অভিজিত্যারে মুসলমানি করাইতে পারলে মুসা হাজ্জাম বেহেস্তে যাইবো। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে হাসির যেন নদী বয়ে যায়। এমনকি সদ্য মাথাকাটা রোগী স্বয়ং দেলুও হাসতে থাকে।

খবর পেয়ে বাজার থেকে দ্রæত ছুটে আসেন মিষ্টি দোকানদার সিদ্ধার্থবাবু। সবাইকে ঠেলে গিয়ে দেলুর হাতে ধরেন বলেন, দেলোয়ার, বাবা আমার কথা রাখো। এর বিচারের দায়িত্ব আমার হাতে দাও। আমি এর ন্যায্য বিচার করবো।

দেলোয়ার বলে, না না সিদ্ধার্থ কাকা। তার দায়িত্ব আপনি নিয়া বিপদে পড়ার দরকার নাই। ওই হারামী বিনা কারণে, বিনা দ্ব›েদ্ব আমারে আজকে খুন করতে চাইছে। ভাগ্য ভালো, আসাদ দেইখা তারে ধইরা ফালাইছে। আমি তো চলন্ত হোন্ডায়। দেখতেও পাইনি। বাঁশবনে পালাইয়া গেলে কার বালে দেখতো। আমি মইরা পইড়া থাকলে লোকে ভাবতো, হোন্ডা একসিডেন্টে মরছে।

সিদ্ধার্থবাবু কতোক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর বলেন, দেলোয়ার, বাবা তুমি আমার কথা রাখো। দেখো, আমি তার কী সাজার ব্যবস্থা করি। কী সমাধান দেই। তোমার আব্বা আমার স্কুলের বন্ধু ছিলেন। পরে তিনি হয়ে গেলেন তোমার দাদার মতোই এ এলাকার নেতা। আর আমি হয়ে গেলাম মিষ্টি দোকানদার। কিন্তু একসঙ্গেই তো খেলছি, বড় হইছি। তোমার দাদীর হাতের কতো খাওয়া খাইছি। আমার কথা রাখো, বিশ্বাস করে দেখো। কী সমাধান দেই। হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে অভিজিতের পিঠে এক লাথি মারে দেলু। সিদ্ধার্থ বলেন, দেলু বাবা একটা না পাঁচটা লাথি দাও, দশটা লাথি দাও কুত্তার বাচ্চারে। সবার সামনেই দাও। তখন শম্ভুলালের চোখের জল মুখমন্ডল বেয়ে টপটপ করে মাটিতে নামে। প্রবীণ সিদ্ধার্থের মুখমন্ডলে কৃতজ্ঞতার ছাপ এবং অভিজিতের চোখে আত্মপ্রকাশের ক্রোধ।
এই কৃতজ্ঞতা আর ক্রোধের অভিশাপে মাধুরীর কলেজে পড়ার ইচ্ছাও পুড়ে যায়। সেই থেকে আর মাধুরী কলেজে যায়নি কোনোদিনও। এমনকি লেখাপড়াও ছেড়ে দেয়। আরও আশ্চর্যের বিষয়: বাবা হারা মেয়ে অনিন্দ্যসুন্দরী মাধুরীর কলেজে যাওয়ার দায় আর এলাকার বিশ-ত্রিশ ঘর সনাতন ধর্মাবলম্বী নিতেও ইচ্ছা প্রকাশ করে না। সব শেষে মাধুরীর বাবার যুগ যুগের বন্ধু ও তার স্কুলের বাংলার শিক্ষক সিরাজুল ইসলামও তাকে বাড়িতে এসে কলেজে যাওয়ার বিষয়ে জোর আশ্বাস দেন। কিন্তু এতো ঘটনার পরও মাধুরী আর ভরসাই পায় না। অতি বিমর্ষ কণ্ঠে মাধুরীর মা সিরাজ স্যারকে বলেন, সিরাজ ভাই, আমাদের আপনি ক্ষমা করবেন। অনেক আগেই আমাদের একটি বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো। ভগবান রক্ষা করেছেন। আমরা অনেকে অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, মাধুরী আর কলেজেই যাবে না।
রচনা:
ডিসেম্বর ২০০৬,
মিলন্তিকা,
ঠাকুরপাড়া,
কুমিল্লা।

২৫| ০৮ ই মে, ২০১৮ রাত ১:০৬

জসীম অসীম বলেছেন: জুতো পালিশ করে সেবার তহবিল
গঠন করতো কুমিল্লা ছাত্র ইউনিয়ন
জসীম উদ্দিন অসীম:
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা সংসদ কোনো এক সময় কুমিল্লায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। কুমিল্লার ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে সংযোজন করেছিলো নতুন এক মাত্রা। সমাজসেবায়, ছাত্রদের অধিকার আদায়ে, ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা সংসদ ব্যাপক সাড়া জাগায়। এ সময়ে কুমিল্লা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ শহরের রাস্তায় রাস্তায় জুতো পালিশ করে, আইসক্রীম বিক্রি করে এবং এমনি আরও বিভিন্ন শ্রমের কাজ করে করে সমাজসেবার তহবিল গঠন করে সেই তহবিলে সমাজ সেবার বিভিন্ন ধরনের কাজ করে যেতো। আজকে কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক ছাত্র সংগঠনের এমন কর্মসূচীর কথা কল্পনাও করা যায় না। কুমিল্লার এসব গণমুখী কর্মসূচী ষাটের দশকে সারাদেশব্যাপীই ব্যাপক সাড়া ফেলে।
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম। এ বছরই ডিসেম্বর মাসে ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রগতিশীল ছাত্র কর্মীদের সংগঠন ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। ঐ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এ.বি.এম শাহজাহান। তার উদ্যোগেই কুমিল্লায় সর্বপ্রথম ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়।
১৯৫৩ সালে মনসুর-উর রহমানকে আহবায়ক করে আনুষ্ঠানিকভাবে আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কুমিল্লায় ছাত্র ইউনিয়নের শুরুতেই ১৯৫৩ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সর্বপ্রথম ছাত্রদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন জেলা ছাত্র ইউনিয়ন আহবায়ক মনসুর উর রহমান। ১৯৫৩ সালে প্রশংসনীয় তৎপরতার কারণে ছাত্র ইউনিয়ন শুধু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজেই নয়, শহরের অন্যসব কলেজগুলোতেও যথাযথ বিজয়ী স্থান অধিকার করে নেয়।
১৯৫৩ সালের ২২, ২৩ ও ২৪ আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লা বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তনে। এ সম্মেলনের প্রধান আয়োজক ছিলেন কুমিল্লা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। এর মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম, এডভোকেট মোঃ ফয়েজ উল্লাহ, জালাল উদ্দিন শানু, সালাউদ্দিন, মোহাম্মদ উল্লাহ প্রমুখ।
১৯৫৪-৫৫ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন আব্দুস সোবহান ও জি.এস নির্বাচিত হন আলী আহমদ মজুমদার। ১৯৫৫-৫৬ সালে জি.এস দানেস আলী মোল্লা ও ১৯৫৬-৫৭ সালে ভিপি এ.কে.এম হুমায়ূন আজাদ ও জি.এস নূর উদ্দিন আহমেদ ছাত্র ইউনিয়নে নেতা ছিলেন। ১৯৫৬ সালে জেলা ছাত্র ইউনিয়ন সারা জেলায় সংগঠন গড়ার শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের মাধ্যমে ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ সেবাসপ্তাহ পালন উপলক্ষে রাস্তায় রাস্তায় জুতো পালিশ করতো। এমনকি আইসক্রীম বিক্রিসহ শ্রমসাধ্য আরও অনেক কাজের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করে ছাত্র ইউনিয়নের সমাজসেবা তহবিলে জমা দিত। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, শিক্ষা আন্দোলনে, ছয়দফা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের মতো কুমিল্লা জেলা ছাত্র ইউনিয়নও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসক উৎখাতের লক্ষ্যে কুমিল্লার কর্মীরাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা মিছিল-মিটিং-দেয়াল লিখন পোষ্টারিংসহ বিভিন্নভাবে আন্দোলন করে গেলেও কুমিল্লা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচি আর আগের মতো নেই। তারপরও এ ছাত্র সংগঠনটির সমাজকল্যাণমূলক কিছু কর্মসূচী এখনো অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ: প্রতিবছরই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা সংসদ কর্তৃক ব্রাইটস্টার বৃত্তি প্রদানই তার একটি উদাহরণ হতে পারে। তবে ষাটের দশকের গণমুখী কর্মসূচীর মতো কর্মসূচী সংগঠনটির এখন আর নেই। তবে আমি নিজেও এ সংগঠনের একজন অতি সাধারণ কর্মী ছিলাম বলে আজও খুব গর্ববোধ করি। কারণ অন্য অনেক বুর্জোয়া ছাত্র সংগঠনের মতো আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। আমরা কখনোই কোনো পেশীশক্তির পূজা করিনি । অবৈধ অর্থের লোভে আমরা নৈতিকতাকে এখনো যে একবিন্দু বিসর্জন দিতে পারিনি, সেই নৈতিকতার শিক্ষা ঘরে যেমন বাবা-মা দিয়েছেন, বাইরেও তার চর্চা অব্যাহত রাখতে পেরেছি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা সংসদসহ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের বিভিন্ন সময়ের ইস্পাতকঠিন নেতৃবৃন্দের সঙ্গ-শিক্ষা লাভের কারণেই। তাদের কাছে আজীবনের ঋণ আমার এবং আমদের প্রত্যেকের। এ ঋণ কোনোদিনও শোধ হওয়ার নয়। কারণ আমরা দেশের রক্ত পান করার বর্বরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বরং নিজের শরীর থেকে একবিন্দু রক্ত দেশের জন্য বিসর্জন দেওয়ার দীক্ষাই পোক্তভাবে নিয়েছিলাম। তাই আজ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা সংসদসহ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের বিভিন্ন সময়ের ইস্পাতকঠিন নেতৃবৃন্দের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আমার।

২৬| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:১১

জসীম অসীম বলেছেন: জসীম উদ্দিন অসীম এর আলোকচিত্র প্রদর্শনী
ফখরুল হুদা হেলাল
কবি ও সংগঠক

জসীম উদ্দিন অসীম একজন কবি ও সাংবাদিক হিসেবেই আমার কাছে পরিচিত ছিলেন। হঠাৎ ২০০২ সালে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন কুমিল্লা প্রেসক্লাবে স্থানীয় বেশকিছু ফটোসাংবাদিকের আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে। তিনদিনব্যাপী এ প্রদর্শনীতে অসীমের ছবিও স্থান পায়। আর আমি বিশেষত তখনই জানতে পারলাম যে, জসীম উদ্দিন অসীম একজন ফোটোগ্রাফারও । ওই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তাঁর সব ছবিই আমার ভালো লেগেছিলো।
‘গোমতি নদীর এপার ওপার' নামে অসীমের প্রথম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয় ২০০৪ সালের মার্চ মাসে জেলা শিল্পকলা একাডেমী কুমিল্লার উদ্যোগে। আমি সেই প্রদর্শনীর খবর আগে থেকে জানতে পারিনি বলে দেখতেও যেতে পারিনি। তবে তাঁর দ্বিতীয় একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী আমি দেখেছি। আর তাঁর তৃতীয় একক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আমি নিজেই একজন অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। সেই প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিলো ‘বন্যাঃ নদীমাতৃক রাক্ষস’। কুমিল্লা টাউনহলে চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিষয়ক স্থানীয় একটি সংগঠন ‘দি সিনেমা' কর্তৃক আয়োজিত এ প্রদর্শনী গত 2004 সালের সেপ্টেম্বর মাসে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) এর তখনকার পরিচালক (প্রকল্প) এম খায়রুল কবীর। সেদিন অতিথিদের আসনে বসে খায়রুল কবীর সাহেবের সঙ্গে আমার অনেক বিষয়েই কথা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান বিষয়েও।
কথা বলছিলাম অসীমের ফটোগ্রাফি নিয়ে। কুমিল্লার কয়েকজন ফটোগ্রাফারের তোলা আমার পোট্রেট ছবি আমারই ড্রয়িংরুমে টানানো রয়েছে। সেখানে জসীম উদ্দিন অসীমের তোলা আমার একটি ছবিও রয়েছে। তার তুলে দেয়া এ ছবিটি খুবই চমৎকার।
অসীমের আলোকচিত্র অবশ্যই তাঁর হাতের ও হৃদয়ের পরিপক্কতারই প্রমাণ দিচ্ছে। তাঁর গত প্রদর্শনীতে বন্যাসহ বাংলার সৌন্দর্য, গোমতি নদীর কথা এবং কুমিল্লার গ্রাম ও শহর বিভিন্ন আঙ্গিকে উঠে এসেছিলো। কবিতা ও সাংবাদিকতা চর্চার পাশাপাশি আলোকচিত্র চর্চাও অসীমকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেই বিশ্বাসও আমার তাঁর প্রতি দৃঢ়ভাবেই রয়েছে।

২৭| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:২০

জসীম অসীম বলেছেন: আবারও পেট্রলবোমার গন্ধ পাচ্ছি আমি
জসীম উদ্দিন অসীম
দিনলিপি থেকে:

আবারও পেট্রলবোমার গন্ধ পাচ্ছি আমি। আবারও কান্না শুনতে পাচ্ছি ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের।এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়।
মানুষের আর্তচিৎকারের বিভীষিকা বড় অসহ্য লাগে আমার। সাধারণ মানুষ এই রাষ্ট্রে আর কতোবার পুড়বে! বারবার গুরুতর দগ্ধ হয় আমার উচ্চাঙ্গহৃদয়।
আবারও শরণার্থীর কান্না শুনতে পাচ্ছি আমি। এতো শরণার্থী কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ছিলো?
সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, মিয়ানমার থেকে দগ্ধ লাখ লাখ মানুষের গন্ধ পাচ্ছি আমি। যারা ধান গমের বদলে প্রতিদিনই উৎপাদন করছে গাড়িবোমা অথবা ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা এসব ব্যবহার করছে সাধারণ মানুষের বুকে, তাদের এমন কর্মকান্ডে বিপ্লবী চে গুয়েভারা নেই সুখে।
আমরা যে একদা মহান বিপ্লবী হতে চেয়েছিলাম, আজ কোথায় আমাদের সেই দীপ্ত অঙ্গীকার? আজ গোটা রাষ্ট্র, পুরো বিশ্ব জুড়ে শুধু হাহাকার।
আজ আবারও কেন পেট্রলবোমার গন্ধ পাচ্ছি আমি, আবারও কেন কাঁদতে হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটকে! আবারও কেন আর্তচিৎকারের বিভীষিকা ভেসে আসে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি থেকে?

২৮| ১০ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:১৪

জসীম অসীম বলেছেন:

২৯| ১০ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:২৩

জসীম অসীম বলেছেন: Sky
Jashim uddin Ashim.
November 1992
Dhaka.

I live in the sky.
I sing the songs of the sky.
I want whole the sky.
I have no one else
except the sky.
And you're in my sky.
If you give me away,
i want to die.

Painting: Jashim uddin Ashim

৩০| ১০ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:৩০

জসীম অসীম বলেছেন: If you say
you will love me

Jashim uddin Ashim

September 1994
Dhaka.

I'm not someone else.
I'm mine.
I'm not any other.
That's the truth.

at least
I'm not like anyone.
I like me.
Why would I be like another?
I will walk on my way.
Always...always...forever.

But if you say,
you will love me...
Then I'll walk on your way.

Photo: Jashim Uddin Ashim.

৩১| ১৭ ই মে, ২০১৮ রাত ৮:২৬

জসীম অসীম বলেছেন: (কবিতা)
সুষমা এক্সপ্রেস
জসীম উদ্দিন অসীম
মার্চ ১৯৯৭,
পশ্চিম চান্দপুর, কুমিল্লা।
===========
সুষমা কি পড়তো কখনো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে?
না।
তবে কি সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী ছিলো!
নাকি সে লাল ভেটভেট কাপড়ে মোড়া
জুতো পরে আসতো একদা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
সুষমা কি রুশপন্থী ছিলো?
সে নাকি প্রতিদিনই বীরপুরুষের হৃদয় করতো হরণ।
তার দেখা না পেলেই অতিমাত্রার ঘুমের ওষুধ খেয়ে
অজ্ঞান হতো কতো যুবরাজ
সুষমার উন্নত বক্ষের পুষ্ট টানে
কবি জীবনানন্দ দাশ কলকাতার ট্রামের নিচে
ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশ্চিতভাবেই আত্মহত্যা করেন।
সুষমার লাগানো আগুন
খবর পেলেও নেভাতে পারে না
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।
এসব কথা কেউ না জানুক
শাপলা-কলমি-তিলাঘুঘু
বাজারের তেল-লবণ- পেঁয়াজ-লবঙ্গও জানে।
তাই সেই সুষমার নামে রেলওয়ে আজ চালু করেছে
সুষমা এক্সপ্রেস ট্রেন।
সরকারের রেলওয়ে বিভাগ কি
সুষমাকে ভালোবেসেছিলো?
============
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।

৩২| ১৭ ই মে, ২০১৮ রাত ৮:২৮

জসীম অসীম বলেছেন: 2002 সালের এক রাতের আড্ডায় কুমিল্লা পৌরসভার কাউন্সিলর আহম্মদ সোয়েব সোহেল শহরের রাজগঞ্জে আমাকে চা-পরোটা খাওয়ান। তারপর দীর্ঘদিন...হয়তো অনেক অনেক বছর ধরেই তার সঙ্গে আর আমার কোনো যোগাযোগই নেই। এর মাঝখানের বছরগুলোতে আমি কুমিল্লার অনেক পত্রিকায়ই চাকুরি করেছি। তারপর 2014 সালে আমি কুমিল্লার ‘দৈনিক ডাক প্রতিদিন’ পত্রিকায় ‘বার্তা সম্পাদক’ হিসেবে যোগদান করি।
অবশ্য এরই মধ্যে কুমিল্লা পৌরসভাও হয়েছে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন। দৈনিক ডাক প্রতিদিন পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় একদিন বিকেলে একটি সংবাদ এলো ওই পত্রিকার বার্তা বিভাগে। মালয়েশিয়ার পেনাং এর অনারেবল স্টেট মিনিষ্টার অব পেনাং চোকন ইউ’র আমন্ত্রণে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আহম্মদ সোয়েব সোহেল পেনাং সিটি পরিদর্শন করেছেন।
সেটা আগষ্ট ২০১৪ এর দিকের ঘটনা। তখন সংবাদটি পড়ে আরও জানলাম, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর নেতৃত্বে কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের একটি প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়ার পেনাং পরিদর্শনে যাবেন।
যিনি সংবাদটি নিয়ে এলেন, তিনিও ছিলেন কুমিল্লার একজন সাংবাদিকই। আমি তাঁকে তখন বললাম, কুমিল্লার পত্রিকাগুলোতে এখন ছবিনির্ভর সংবাদই বেশি হয়। অবশ্য অনেকক্ষেত্রে ডেপথ নিউজ পত্রিকার মালিক পক্ষই ছাপাতে উদ্যোগী হয় না। আমি এক্ষেত্রে কুমিল্লার পত্রিকার কথাই বলছি। ওই সাংবাদিক তখন ছবিনির্ভর সংবাদই বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। আমি তাঁকে বললাম, সিটি কর্পোরেশনের আয়ের খাত-ব্যয়ের খাত নিয়ে তেমন কোনো রির্পোট নেই। বাজেটে আয়-ব্যয়ের পরিমাণ সমান না হলেও কখনো এ নিয়ে তেমন প্রশ্নও নেই। মশক নিধনের কাজে বরাদ্দ টাকার কতো অংশ কার পেটে যায়, এ নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী গণিত নেই। বাজার সেলামি, ট্রেড লাইসেন্স ফি, বাস-টার্মিনাল থেকে পাওয়া অর্থ বিষয়ক রির্পোট কুমিল্লার স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই দেখি না। ওই সাংবাদিক তখন তাঁর মতো এর একটি ব্যাখ্যাও দিলেন। আমি ঠিকই বুঝলাম। হয়তো আরও বুঝলাম, আমি তো আর তেমন সাংবাদিকতাই করি না। কিন্তু যারা করছেন, তারাও ঠিক কতোটা করছেন কিংবা কেন বা পুরোটা করছেন না! কারণটা কী! জানতে আমার খুবই ইচ্ছে করছে।
ডিসেম্বর ২০১৪, কলাবাগ হাউজিং, ধর্মপুর, কুমিল্লা।
অলংকরণ: জসীম উদ্দিন অসীম।

৩৩| ১৭ ই মে, ২০১৮ রাত ৮:৩০

জসীম অসীম বলেছেন: পৃথিবীতে মহাকাশ বা মহাসাগর যেমন আছে, তেমনি আছে মহারাষ্ট্রও। এক্ষেত্রে আমি কয়েকটি দেশ নিয়ে যে মহাদেশ হয়, তার কথা বলছি না। আমি বলছি মহারাষ্ট্রের কথা। (অবশ্য ভারতের একটি রাজ্যের নামও মহারাষ্ট্র।)
হয়তো একটি লোক বুলডোজার নিয়ে বস্তি উচ্ছেদ করতে এলো। বস্তিবাসী তখন তাঁকেই শত্রু মনে করলো। কিন্তু শুধুমাত্র বুলডোজার চালককে দেখলেই তো হবে না। তার পেছনে ধাপে ধাপে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেসবও খতিয়ে দেখতে হবে। হয়তো প্রকাশ্যে সব শেষে আছে আমাদের মতো গরীব রাষ্ট্র নামক কোনো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাষ্ট্রের পেছনেও থাকে আরেক মহারাষ্ট্র, যার নাম হয়তো বিশ্বব্যাংক, কখনো বা আই.এম.এফ...ইত্যাদি। আর সেই মহারাষ্ট্রের ফাঁদ হলো ওই মুক্তবাজার। ওখানেই 2আমরা মাকড়সার জালে বন্দী পোকার মতো আটকা পড়ি। মুক্তবাজারী...বিশ্ববাজারী এই বিশ্বব্যাংক আমার সঙ্গে আপনার, শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিরোধ থাকলে তার নিজস্ব ব্যবসা খুব ভালোভাবেই করতে পারে। তাই বলতেই হয়, খুব বেশি দুঃসময় এখন পৃথিবীর। এই দুঃসময় শুধু আমার-আপনারই নয়, শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বলতে গেলে সারা বিশ্বেরই। এমনই এক নষ্ট সময় এখন। নষ্ট না হয়ে তাই বাঁচা কঠিন। অনেকেই সৎভাবে মরার মতো বেঁচে আছেন। অনেকে অর্ধেক নষ্ট হচ্ছেন। কেউ কেউ নষ্ট হয়েও শেষ বাঁচাটাও বাঁচতে পারছেন না। এমনই বড় বেশি জটিল সময় এখন। সময় এখন এই পৃথিবী নামক গ্রহে এক বিশাল ফ্যাক্টর। এই সময়ই এক্ষুনি আপনাকে বলবে গাধা খুব উপকারী, গাধাকে টেনে সঙ্গে রাখো এবং এই সময়ই আবার সহসাই বলে বসবে যে, গাধাকে ঠেলো। গাধাকে না তাড়ালে, না মারলে তুমিও বাঁচবে না। আর আজকের সময়ে এই সময়কেই অধিকমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করছে স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হলো প্রকৃত মহারাষ্ট্র, যে কী না সারা বিশ্বেই তার সামরিক ঘাঁটি ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই পুরো বিশ্বকেই সে তার নিজের রাষ্ট্র মনে করতে চায়। সে আশা করে পুরো বিশ্বই তার তাবেদারি মেনে চলবে। সে এখন সারা পৃথিবীতেই রীতিমত প্রভু হয়ে বসে আছে। আর এক্ষেত্রে সারা বিশ্বে সাম্রাজ্য বা বাজার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তার শেষ ভরসা সামরিক শক্তিই। অথচ এমন একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করেও সেই আবার সারাদিনই গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়। এর চেয়ে বড় ম্যাজিক এই সময়ে পৃথিবীতে আর কী ই বা আছে!

৩৪| ১৭ ই মে, ২০১৮ রাত ৮:৪০

জসীম অসীম বলেছেন:

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআর সদরদপ্তরে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ নিয়ে এখনো ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে অনেকের মনে বিভিন্ন রকমের সন্দেহ রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর-এর সৈন্যদের নানা ক্ষোভের কারণে বিদ্রোহ হয়েছে বলেই প্রথম জানা গিয়েছিল। কিন্তু এটি একটি ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে পরিণত হয় কেন? বিডিআর সৈন্যদের ক্ষোভ কেন হত্যায় রূপ নিল? এটি কি একটি বিদ্রোহ ছিল? নাকি কোনো ষড়যন্ত্র? চার হাজারেরও বেশি বিডিআর সৈন্যের কারাদণ্ড এবং দেড়শ-র বেশি মৃত্যুদণ্ডও সন্দেহকে দমন করতে পারেনি। ঢাকার তৎকালীন বিডিআর সদরদপ্তরে 2009 সালের 25 এবং 26শে ফেব্রুয়ারিতে ওই বিদ্রোহের ঘটনায় 57 জন সেনা কর্মকর্তাসহ 74 জন নিহত হন। আমার বাসা ছিল তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই। 7 ফেব্রুয়ারি আমার ছেলের জন্ম হলো। শহরের এক হাসপাতালে। 14 ফেব্রুয়ারি 2009 তারিখে আমি আমার ছেলে ও বউকে নিয়ে চলে গেলাম কুমিল্লা বার্ডে (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী) আমার ভাইয়ের বাসায়। ভাই বার্ডে চাকুরি করেন। কিন্তু ভাইয়ের বাসায় রয়ে গেলাম 28 ফেব্রুয়ারি তারিখ পর্যন্ত। কুমিল্লা বার্ডের পশ্চিম পাশেই কোটবাড়ি বিডিঅার সেক্টর কমান্ডারের কার্যালয়। উত্তরপাশে কুমিল্লা সেনানিবাস। আমি তখনও সেনানিবাসের বাসায় যাইনি। 25 তারিখ রাতে একটি গুজব উঠল যে, রাতে বিডিআর আর আর্মির মধ্যে কুমিল্লায়ও ফায়ারিং হতে পারে। মাঝখানেই বার্ড। বড় ভাই বললেন, এ অবস্থায় তোর বাচ্চা নিয়ে সেনানিবাসের বাসার মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না। বরং প্রয়োজনে অবস্থা খারাপ হলে আমাদেরই বরং কুমিল্লা শহরে চলে যাওয়া দরকার। এ অবস্থায়ও আমি আমার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি সব জায়গায়ই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আমার ওই বাসার প্রতিবেশিদের একজন ছিলেন পুলিশ এবং আর বাকিরা সেনাবাহিনীর সদস্য। শুধুমাত্র আমিই কেবল একঘর সাংবাদিক পরিবার ছিলাম। কিভাবে আমি তখন ওখানে ছিলাম এবং কেন সেটা অন্য প্রসঙ্গ। গিয়ে দেখলাম আর্মি ভাবীরা সবাই টিভি-তে খবর দেখছেন।...একজন ভাবী (রাজুর মা) বললেন, আপনি তো সাংবাদিক। জানেন কিছু? অন্যদেশের কোনো টেলিভিশনের সংবাদে আলাদা কোনো খবর পেয়েছেন? বিডিআর কেন সেনাবাহিনী থেকে আসা অফিসারদেরকে মেরেই ফেলছে? আমি বললাম, আমি শুনেছি, বিডিআর ডালভাত কর্মসূচীতে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। রাজুর মা বললেন, দুর্নীতির জন্য এভাবে গণহারে আর্মি অফিসার হত্যা করবে! আমি বললাম, এ বিষয়ে তো ভাবী আমি কিছুই বলতে পারবো না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মাত্র 40 দিনের মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটলো। তাদের সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলেও অনেকে মনে করলেন। বিদ্রোহ দমনে সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করায় বিরোধী দল বিএনপি শুরুতেই নানা প্রশ্ন তুলেছিল। অনেকেই এই ঘটনার জন্য ভারতকে জড়িত মনে করেন।
কোন মামলায় এত সংখ্যক আসামীর সাজা বাংলাদেশে আগে তো কখনো হয়নি আর । কিন্তু তারপরও এ নিয়ে এখনো অনেকে সংশয়মূলক মতামত প্রকাশ করছেন। এ বিষয়ে অবশ্যই অতিরিক্ত কিছু বলতে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ বিষয়টি নিয়ে এখনো বিচারাধীন কতিপয় প্রসঙ্গ রয়েছে।...।

৩৫| ১৭ ই মে, ২০১৮ রাত ৮:৪৩

জসীম অসীম বলেছেন: রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকাটির বর্তমান ‘দখল অপচেষ্টা নিরসনে’
কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদ-এর সহযোগিতা কামনা করছি।




বরাবর,
সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক
কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদ, কুমিল্লা।

বিষয়: রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী প্রভাব খাটিয়ে কুমিল্লা থেকে বিগত ২৬ বছর ধরে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকাটির বর্তমান ‘দখল অপচেষ্টা নিরসনে’ আপনাদের সহযোগিতা কামনা প্রসঙ্গে।

জনাব, আমি সাদিয়া অসীম পলি, কুমিল্লা থেকে বিগত ২৬ বছর ধরে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ এবং এই পত্রিকার বর্তমান প্রকাশক কাজী ফাতেমা বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে। আমার স্বামী সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীম বিগত ২০ বছর ধরে কুমিল্লায় পেশাগতভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে বিভিন্নভাবেই জড়িত রয়েছেন। কুমিল্লার বিভিন্ন স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকায়ও তিনি দায়িত্বশীল অনেক পদে চাকুরি করেছেন। বিগত ২০০৮ সাল থেকে জসীম উদ্দিন অসীম আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত এবং আমার মাতা কাজী ফাতেমা বেগম প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকার ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ২০১২ সাল থেকে তিনি এই পত্রিকার প্রকাশক ও আমার মাতা কাজী ফাতেমা বেগম কর্তৃক ‘একমাত্র উত্তরসূরী’ (নোটারী পাবলিক) হিসেবে মনোনীত হয়ে এ পত্রিকার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মোকাম, বিজ্ঞ নোটারী পাবলিকের কার্যালয়, কুমিল্লা কর্তৃক ২০১২ সালে প্রদত্ত এক ‘হলফনামা’য় এই পত্রিকার প্রকাশক ও আমার মাতা কাজী ফাতেমা বেগম তাকে “এই পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনার বিষয়ে একমাত্র উত্তরসূরী হিসেবে সার্বিক ক্ষমতা” অর্পণ করেন। আমার মাতা সেই ‘হলফনামা’য় আরও উল্লেখ করেন যে, “সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীমকেই আমি আমার এই ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকার একমাত্র যোগ্য ও বিশ্বস্থ এবং সৎ উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করলাম। এতে আমার কোনো উত্তরসূরীর কোনো ওজর-আপত্তি নেই এবং কখনোই থাকবে না। যদি সে রকম কোনো ওজর আপত্তি কখনো আমি করি কিংবা উত্তরসূরীদের কাউকে দিয়ে করাই, তা হলে তা বাংলাদেশের সর্বাদালতে তা অগ্রাহ্য হবে।” এর আগেও ২০১২ সালে এই পত্রিকার প্রকাশক ও আমার মাতা কাজী ফাতেমা বেগম এক ‘পারিবারিক অঙ্গীকারনামা’য় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মুদ্রিত বিভিন্ন দরের স্ট্যাম্প পেপারে ‘পারিবারিক ৪ জন স্বাক্ষী’র লিখিত উপস্থিতিতে মোট ‘৪ বার স্বাক্ষরপূর্বক অঙ্গীকার করেন যে, “আমি কাজী ফাতেমা বেগম, স্বামী-মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহ, সাং-গোবিন্দপুর, আদর্শ সদর, কুমিল্লা, জাতীয়তা: বাংলাদেশী। আমি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকও বটে। এই আমি আমার মরহুম স্বামী ভাষাসৈনিক, গ্রন্থকার মোহাম্মদ উল্লাহর (প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’, কুমিল্লা) নামে শপথপূর্বক অঙ্গীকার করছি যে, আমার প্রকাশিত “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকার পুনঃ ঘোষণাপ্রাপ্তির (রি-ডিক্লারেশনের) জন্য আমার বড় মেয়ের জামাতা একমাত্র সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীমকেই সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। এ পত্রিকাটি তার নিজ নামে পুনঃ ঘোষণাপ্রাপ্তির (রি-ডিক্লারেশনের) জন্য আইনানুগভাবে অনুমতি লাভ করার পূর্বেই যদি কোনো কারণে আমার মৃত্যু হয়, তা হলে এ পত্রিকার একমাত্র উত্তরাধিকারী হবেন আমার বড় কন্যা সাদিয়া অসীম পলি-র জামাতা সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীম (পিতা-মৃত: কফিল উদ্দিন, মাতা: মৃত-সুফিয়া খাতুন, গ্রাম: খয়রাবাদ, পো: গংগামন্ডল, দেবিদ্বার, কুমিল্লা)। কোনো ক্রমেই আমার ছোট কন্যা ফৌজিয়া খানম মলি-র জামাতা রকিবুল ইসলাম রনি (পিতাঃ মোঃ আবুল কাশেম, মাতাঃ নাছিমা বেগম, সাং-দক্ষিণ ঠাকুরপাড়া, কোতয়ালী, কুমিল্লা) এই পত্রিকার সাথে জড়িত থাকতে পারবেন না। এমনকি রকিবুল ইসলাম রনি এই পত্রিকার কোনো অংশও কখনো দাবী করতে পারবেন না। এটি আমাদের একটি একান্তই পারিবারিক সিদ্ধান্ত। কেন না, আমার দুই কন্যার কেউই সাংবাদিকতা করেন না। ছোট কন্যার জামাতা রকিবুল ইসলাম রনিও নন। তাই আমার মৃত্যুর পর এই পত্রিকার “পুনঃঘোষণাপ্রাপ্তি”, পারিবারিক সিদ্ধান্ত মোতাবেক শুধুমাত্র বড় কন্যা ‘সাদিয়া অসীম পলি’র জামাতা সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীমের নামেই হবে। আর অন্য কারো নামে নয়। তবে প্রকাশ থাকে যে, যেহেতু আমার ছোট কন্যা ফৌজিয়া খানম মলি-র জামাতা রকিবুল ইসলাম রনি এই পত্রিকার কোনো অংশও কখনো দাবী করতে পারবে না, সেহেতু আমার বড় কন্যার ‘আপন দেবর’ ও “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকার বর্তমান ‘নির্বাহী সম্পাদক জামাল উদ্দিন দামালও এ পত্রিকার কোনো অংশ কখনো দাবী করতে পারবে না। আমার মৃত স্বামী মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহর নামে শপথ করা এই অঙ্গীকার যদি আমি ভুলে যাই, কিংবা যদি আমি এই সিদ্ধান্তের বিন্দুমাত্র অমর্যাদা করি, তা হলে রোজ হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে বেহেশত দাবী করতে পারবো না।” কিন্তু বর্তমানে এই পত্রিকার প্রকাশক ও আমার মাতা কাজী ফাতেমা বেগমকে কুমিল্লার একদল কুচক্রী লোক অনেক রাজনৈতিক প্রভাব ও সন্ত্রাসী প্ররোচনার মাধ্যমে প্রভাবিত করে আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত এ পত্রিকা নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে এ বিষয়টি জেলা প্রশাসক কুমিল্লা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কুমিল্লা, কুমিল্লা প্রেসক্লাব সভাপতি এবং কুমিল্লা-৬-সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজী আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহারকেও অবহিত করা হয়েছে।
বিগত সময়ে কুমিল্লা থেকে ২৬ বছর ধরে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকার প্রকাশক ও আমার মাতা কাজী ফাতেমা বেগম, (তৎ স্বামী-মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহ, সাং-গোবিন্দপুর, আদর্শ সদর, কুমিল্লা, জাতীয়তা: বাংলাদেশী।) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মুদ্রিত বিভিন্ন দরের স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষরপূর্বক তার অন্য ‘অঙ্গীকারনামা’য় আরও উল্লেখ করেন যে, “আমি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকও বটে। যদি আমি আমার প্রকাশিত “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকাটি পারিবারিক উত্তরসূরী ব্যতিত অন্য কোথাও ‘বিক্রয়/ হস্তান্তর’ করি (যার আনুমানিক অর্থমূল্য ৫ লক্ষ টাকা), তা হলে আমার দুই কন্যার আইনস্বীকৃত সম্মতিপত্র আদায়পূর্বক তা করতে বাধ্য থাকবো। অন্যদিকে বিগত সময়ে আমি যে জনাব শফিকুল আলম সেলিম, পিতা-আফতাব উদ্দিন, কালার এড, হাজী তারু মিয়া পৌর মার্কেট (দ্বিতীয় তলা) কান্দিরপাড়, কুমিল্লা’র নিকট ৫০,০০০/-(পঞ্চাশ হাজার) টাকায় এবং মোঃ রুহুল আমীন সাদাত, পিতা-মরহুম সাদাত আলী, গ্রাম-আশাবাড়ি, ডাকঘর-শশীদল, বি-পাড়া, কুমিল্লা’র নিকট ৪৫,০০০/- (পয়তাল্লিশ হাজার) টাকায় আমার প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকাটি ‘বন্ধক’ রেখেছিলাম, সেই সমুদয় অর্থ আমার বড় মেয়ে সাদিয়া অসীম পলি-র জামাতা সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীমকে পরিশোধপূর্বক এবং আমার বড় কন্যা সাদিয়া অসীম পলি-র এ পত্রিকায় প্রাপ্য অংশও বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো। যেহেতু আমার বড় মেয়ে সাদিয়া অসীম পলি-র জামাতা সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীমই আমার ঋণে জর্জরিত “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকা উদ্ধার করে নিজস্ব দখলে ও নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, সেহেতু আমি কাজী ফাতেমা বেগম, স্বামী-মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহ, সাং-গোবিন্দপুর, আদর্শ সদর, কুমিল্লা, জাতীয়তা: বাংলাদেশী এবং কুমিল্লা থেকে ২৬ বছর ধরে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ’ পত্রিকার প্রকাশক, এইসব শর্তাবলী মেনে চলবো ও অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবো। অন্যথায় আমি আইন-আদালতের আওতায় এসে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আদালতের দন্ড মেনে নিতে বাধ্য থাকবো।”
সুতরাং “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকার বর্তমান এই সংকটে আমি সাদিয়া অসীম পলি কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সকল নেতৃবৃন্দের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি। কুমিল্লা প্রেসক্লাব সভাপতি মাসুক আলতাফ চৌধুরীকে এ বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ আমি নিজে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কুমিল্লা প্রেসক্লাব সভাপতি মাসুক আলতাফ চৌধুরীকে অসংখ্যবার ফোন করেছি। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে একবারের জন্যও আমার সঙ্গে কথা বলেননি। এতে আমি ধরে নিয়েছি যে, বিভিন্ন কারণেই তার এ বিষয়ে কিছু করনীয় নেই। অথবা থাকতে পারে অন্য কোনো সীমাবদ্ধতাও। তাই এখন আমি আপনাদেরকে (কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদের নেতৃবৃন্দ) বিষয়টি অবহিত করলাম। আপনাদের মাধ্যমেও যদি বিষয়টির শেষ পর্যন্ত কোনো সুরাহা না-ই হয়, তা হলে আমি আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত এ পত্রিকা উদ্ধারে অবশ্যই আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হবো। কোনো পত্রিকা কখনোই কোনো নদীর হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চর নয় যে, রাজনৈতিক প্রভাব ও পেশীশক্তি খাটিয়েই এর দখল নেয়া যাবে। বিচারিক পন্থা ব্যতিত এর কোনো সুরাহা যে নেই, এটা আমি জানি। তবু “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” এর বর্তমান সংকট বিষয়ে সামাজিক সমঝোতার জন্য আপনারা কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদের নেতৃবৃন্দকে আমি অবহিত করলাম। আদালতে যাওয়ার আগে আপনাদেরকে এর সুষ্ঠু সুরাহাকল্পে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। যেহেতু আপনাদের সংগঠনটি একটি রাজনৈতিক প্রভাব ও সন্ত্রাসী প্ররোচনামুক্ত, সেহেতু এ বিষয়ে আপনাদের করনীয় অনেক সুদূরপ্রসারী বলেই আমি মনে করছি। একদা আমার পিতাও আপনাদের অনেক সম্পাদকের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। তার এই অমূল্য স্মৃতি রক্ষার্থে ও স্বার্থপর কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকর্তৃক আমাদের এই পত্রিকাটির মৃত্যু ঠেকাতে তাই আপনাদের কিছু মহান দায়িত্ব রয়েছে বলেও আমি মনে করছি।

সাদিয়া অসীম পলি।
স্বামী: জসীম উদ্দিন অসীম।
পিতা: মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহ (প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক: সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ), কুমিল্লা।

৩৬| ০৭ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৩

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প:
বক দন্ড
জসীম উদ্দিন অসীম
রচনা: অক্টোবর 2004, কুমিল্লা।

রনির বাম চোখটি একটি দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র ডান চোখটিই তাঁর এখন সকল কাজের ভরসা। একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার বলে দিয়েছেন, রনির বাম চোখটি আর ঠিক হবে না। সংসারে একমাত্র বিধবা মা। দেনার বোঝা নিয়েই তাঁর পিতা মোজাফ্ফর হোসেন দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যান।
রনির মা যতোবার তাঁকে একটি চাকুরি বা কাজের কথা বলেছে, ঠিক প্রায় ততোবারই সে আত্মহত্যার বিভিন্ন রকম চেষ্টা চালিয়েছে। এভাবে সে লেখাপড়াও ছেড়ে দেয়। কিছু একটা জোর করলেই ফাঁস অথবা বিষের ভয় দেখায়। কী এর কারণ: খুঁজে পান না রনির মা। রনির পিতার তো এমন প্রবণতা ছিলো না কোনোদিনও!
রঞ্জনা নামের একটি মেয়েকে পছন্দ করতো রনি। কিন্তু তাঁর বাম চোখটি নষ্ট হওয়ায় অন্য কোথাও বিয়ে হওয়াতে আপত্তি করেনি মেয়েটি। সেই থেকে বাড়ির কাছের মরা গোমতি নদীর মৃত্যুকূপসম এক ঝোপের কাছেই দিনের অনেকটা সময় কাটায়।
কয়েকদিন পর ঈদ-উল-ফিতর। বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। প্রচন্ড গরমে অস্থির মানুষ। এরই মধ্যে জীবন থেকে রঞ্জনাকে হারানোর কথা রনি রীতিমতো পাগল বানিয়েই ছাড়ে।
রনির এক সময়ের বন্ধু মাহমুদ প্রায়ই আখাউড়ায় যায়। কুলাউড়ার গল্প বলে। বর্ণনা দেয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার মোহনপুর বাজারের। কিন্তু রনিকে কিছুই যেন আকর্ষণ করে না। সারাদিন সে মরা গোমতির উত্তর এলাকায় ঘুরে। এমনকি যেদিন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ছিলো, সেদিনও রনির মা তাকে ওখান থেকেই বাড়িতে ডেকে আনে।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আত্রাই কিংবা ব্রহ্মপুত্র... কতো নদীর নাম শুনেছে রনি। অথচ সে সারাদিন কাটায় মরা গোমতির আশপাশের জলা এলাকায়। বিল- জলাশয় বা কোনো হাওড় এলাকা না হয়েও মরা গোমতির বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি জুড়ে এক ধরনের মায়াবী পরিবেশ বিরাজ করে।
রনিদের গ্রামের নাম মোহনপুর। বন্ধু মাহমুদের মুখে পশ্চিম ত্রিপুরার মোহনপুর বাজারের গল্প শুনেও এই মোহনপুরের সঙ্গেও ওই মোহনপুরের কোনো তুলনা করতে পারে না।

এবারের শীতের শুরুতে মোহনপুরের মরা গোমতির জলা এলাকায় হঠাৎই নামতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরীযায়ী পাখির দল। জলাবদ্ধ এ এলাকায় এতো পাখি এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। মানুষের ব্যস্ততার কোলাহলকে ছাপিয়ে অতিথি পাখির কিচিরমিচিরই বাতাসে আর আকাশে উড়ে বেড়ায়। মরা গোমতিই মানুষের মাঝে এতোটা মুগ্ধতা ছড়ায়, পাশেই বহমান স্রোতবাহী গোমতিও সেখানে যেন ম্লান। বিকেলে আশ্বিনের কুয়াশায় উড়ে স্বর্গীয় সব পাখি।
এইসব পাখিদের সংস্পর্শে যখনই রনির দিনগুলো সুখেই কাটছিলো, তখনই তার চাচাতো বোন রুশনারা তাকে একটি দুঃসংবাদ দিলো। ২০ বছরের যুবতী রঞ্জনা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার জের ধরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তারপর হাসপাতালে নেয়া হলেও ৭ দিন পর মারা যায় রঞ্জনা খাতুন। রুশনারা যেদিন রনিকে এই দুঃসংবাদটি দেয়, সেদিন রাতেই রনি দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে যাবে ভেবেছিলো। আর যাওয়া হয়নি। চোখের জলে বিজয়া দশমীতে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মরা গোমতির জলেই বিদায় জানিয়েছেন ভক্তরা। রনির এবার পূজা দেখা আর হলো না। তাঁর দেবী রঞ্জনা খাতুন জলে নয়, অগ্নি আরোহণে বিদায় নিয়ে গেছে। তাই রনির সারাটা বুক তপ্ত হয়ে যায়। তপ্ত বুক শীতল করতে জলই অতি জরুরী। তাই যেন তাঁর মরা গোমতির জলদেবীর এমন কাছাকাছি সময় যাপন।
প্রতিমা বিসর্জন হলো। থেমে গেলো ঢাক-ঢোল আর কাঁসর-ঘন্টা বাজানো। মন খুবই খারাপ হলো রনির। তার বন্ধু মাহমুদও আখাউড়া হয়ে ইন্ডিয়ায় গেছে কয়েকদিন। পূজার রেশ সম্পূর্ণ শেষ হলেই নিজ গ্রাম মোহনপুরে ফিরবে আবার।
রনির মা সারাটা দিন রনির জন্য কাঁদেন। বলেন, মরা গোমতির আশপাশটা ভালো জায়গা নয়। এখানে অনেক ভূত-প্রেতের ছায়া। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদররা হিন্দু-মুসলিম যতো লোককে মেরেছে, তাদের অধিকাংশকেই এখানে মেরে ফেলেছে। এক রাতে তখন পূর্ণিমা ছিলো, তোর বাপ মোজাফ্ফর হোসেন বাজার থেকে ফেরার সময় ওখানে এক লাশখেকো জন্তুর গোঙানি শুনে দৌড়ে প্রাণে বেঁচেছে। আমি বিশ্বাস করি ওইসব ভূতেরা মরা গোমতির আশপাশটায় এখনও বিচরণ করে।
মায়ের কাছে এসব গল্প শুনেও ভয় আসে না রনির মনে। বরং এ মরা গোমতিকে জানবার কৌতুহল আরও তীব্রতর হয়। ঠিক এই সময়টায় মরা গোমতির আশপাশটায় শত শত পাখি নামে পাখির হাজারো কিচিরমিচিরে আকাশে বাতাসে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি বাজতে থাকে অথবা চৌরাসিয়ার বাঁশি এখান থেকেই সুর আহরণ করে। পুরো আকাশ, আকাশের সাদা মেঘ স্থির হয়ে মোহনপুরের মরা গোমতির জলাশয় এলাকায় স্বর্গীয় নানা বর্ণিল পাখির গান শুনতে থাকে। পরীযায়ী পাখির ডানায় ডানায় বাজতে থাকে তবলার তিনতালের বোল অথবা পাখির তাদের পাখা দিয়ে পাখোয়াজ বাজাতে থাকে। এসব দেখে রনি এতোদিনে সম্পূর্ণরূপেই পাগল হয়ে যায়। পাখির পাগল।
তারপর তাঁর সেই পাগলামী পাখি শিকারে রূপান্তরিত হয়। মোজাফ্ফর হোসেনের একমাত্র ছেলে রবিউল হোসেন রনি ভাবে বক বা অন্যান্য অনেক পাখি ধরতে পারলেই তো খাওয়া অথবা পাশের ফুলতলা বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন সম্ভব। কিছুদিন আগেও ফুলতলা বাজারে এক মধ্যবয়সী লোককে কয়েক জোড়া বক পাখি বিক্রি করতে দেখেছে সে। কিন্তু তখনও মাথায় আসেনি লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে যে এই পাখিগুলোকে কোথা থেকে কোন পন্থায় ধরেছে। মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনেই বসেছিলো লোকটি। এই লোক কি এখনও পাখি বিক্রি করতে ফুলতলা বাজারে আসে? খোঁজ নিতে হবে।
এদিকে ফুলতলা বাজারের ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে যাওয়ায় বাজারের সকল গ্রাহক বা দোকানদার বিদ্যুতহীন অবস্থায় পড়েছে নানা বিপাকে। গত দেড় সপ্তাহ ধরে ট্রান্সফরমারটি বিকল। আগের বছরও বজ্রপাতে এই বাজারের ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছিলো। এই সময়ে রনি ফুলতলা বাজারের দোকানে দোকানে কোনো একদিন মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে বসে পাখি বিক্রি করা সেই লোকের খোঁজ করলো। সবাই তাকে যা তা উত্তর দিলো। অবশেষে রনি গোমতি নদীর খেয়াঘাটে গিয়ে বসলো। তার মনে হলো পাখি বিক্রেতা সেই লোকটি যেন রজনীগঞ্জ এলাকা থেকে খেয়া পার হয়ে এসেছে। ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করেও কোনো নৌকাতেই সেই লোকের খোঁজ পেলো না রনি। তবে এই অপেক্ষা একেবারে বৃথাও যায়নি তাঁর। হঠাৎ দেখলো খেয়ানৌকা থেকে স্বামীর হাত ধরে উঠে আসছে সুষমা। তার স্কুল জীবনের সেরা বান্ধবী। ক্লাসের সেরা সুন্দরীও বটে। কিন্তু নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই সুষমার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর কতো বছর আর সুষমার সঙ্গে রনির দেখা নেই। সুষমা চিৎকার করে রনির বাম চোখটি কিভাবে নষ্ট হলো, তা জানতে চায়। রনি উত্তর এড়িয়ে বললো, এক চোখ গেছে, কী হয়েছে আরেক চোখ তো আছে। একেবারে অন্ধ তো আর হয়ে যাইনি। দুই চোখও তো নষ্ট হতে পারতো। রঞ্জনা যে আগুনে আত্মহুতি দিলো। এই খবরেও আকাশ থেকে পড়লো যেন সুষমা। রঞ্জনার বিয়ের খবর জেনেছিলাম। মরে গেছে? সুষমার চোখে জল এলো। সুষমার প্রিয় বান্ধবী ছিলো রঞ্জনা। এদিকে খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে এতো ইতিবৃত্ত নিয়ে আলাপে বড়ই বিরক্ত হলো সুষমার স্বামী জয়দেব চক্রবর্তী। অবশেষে সুষমাকে যেতেই হয়। জয়দেব শহরে যাচ্ছে কিছু কেনাকাটা করতে ও একটি মোটর সাইকেল দেখতে। কিছুদিনের মধ্যেই একটি মোটর সাইকেল কেনার পরিকল্পনা আছে জয়দেবের। কেনাকাটা শেষে সুষমাদের বাড়িতে ফিরে আসবে।
কাঁচা ধানের আঘাত লেগে রনির বাম চোখ ক্ষতবিক্ষত হলে ফুলতলা বাজারের হারুন ডাক্তারকে দেখানো হয়। আসলে হারুন ডাক্তার ডাক্তার নন। বাজারে তার এলোপ্যাথিক ওষুধের দোকান রয়েছে। তবু এলাকার লোক তাকে ডাক্তারই সম্বোধন করে।
রনির চোখ মারাত্মক ফুলে গেলে হারুন ডাক্তার যেসব ওষুধ দেয়, তা সেবন করেও চোখের যন্ত্রণা থামানো যায় না। অনেকে বললো বাজারের কদমতলায় মনমোহনের হোমিও চিকিৎসা নিতে। হারুন ডাক্তার বললেন, একই সমস্যা নিয়ে দুই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ ঝুঁকির্পূণ। এরই মধ্যে রনির চোখে রক্ত ও পুঁজ জমতে থাকে। ছেলের চোখের এমন ইনফেকশন দেখে রনির মা কার পরামর্শে এক হারবাল তেল প্রয়োগ করে। এতে জীবাণু আক্রান্ত চোখ তো ভালো হয়নি, বরং চিরতরেই এই চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। সবশেষে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার বাবুও বলে দিয়েছেন, রনির বাম চোখটি আর কোনোদিনও ঠিক হবে না।
মরা গোমতির জলাশয় এলাকায় অসংখ্য কানিবকও নামে। ওরা সারাদিন ঠোঁট চালিয়ে ছোট মাছ ধরে। কোনো পাখি গোসল করে স্বচ্ছ নীল জলে। কিছু পাখি সাঁতরায় মরা গোমতির জলে। ঝোপঝাড়ের মাথায় বসা সাদা বকের সারি। কাঁকড়াও খায় কিছু পাখি। মরা গোমতির উত্তর দিকটায় উঁচু কোনো গাছ নেই। শুধুই ধানি জমি। বিস্তীর্ণ ধানি জমির ওপর দিয়ে সাদা বকের ওড়াওড়ি মনোমুগ্ধকর। বিস্ময়কর কিছু পাখিও এসেছে এবার, যা কখনোই দেখেনি রনি এই এলাকায়। ওসবের নামও জানে না সে। তবে এক সঙ্গে এতো বকের দেখা পাওয়া যেন অসম্ভব কোনো ঘটনা। মরা গোমতির উত্তরদিকের বিস্তীর্ণ ধানি জমির দিকেই ওদের ওড়াওড়ি। কিন্তু ওখানে উঁচু কোনো গাছই নেই, যেখানে উড়ন্ত বকেরা একটু আয়েশে বসতে পারে।
এরই মধ্যে ফুলতলা বাজারে সেই মধ্য বয়সী লোককে আবারও খুঁজে পায় রনি। মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে আবারও বক নিয়ে আসে। তিন জোড়া সাদা বক। কিছুক্ষণের মধ্যেই বকগুলো বিক্রি হয়ে যায়। বাজারের একটি রেস্টুরেন্ট মালিক নিয়ে যায় দুই জোড়া বক এবং এক জোড়া বক নিয়ে যায় রাতের ব্যথার এক রোগী। বকের মাংস খেলে বাতের ব্যথার উপশম হয়, এমন কথা এলাকায় প্রচলিত রয়েছে।
বক বিক্রেতা লোকটির নাম মনসুর আলী। মনসুর আলীকে মরা গোমতির পাশে এসে বক ধরার আমন্ত্রণ জানায় রনি। হাতে পায়ে ধরে। কিন্তু মনসুর আলী রাজি হয় না নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় যেতে অথবা এমনও হতে পারে যে মনসুর আলীর এলাকাতেই অসংখ্য বক রয়েছে।
রনির পরিবারের খোঁজ নেয় মনসুর আলী। তারপর বলে, আমাকে তোমার মরা গোমতি এলাকায় নিয়ে গিয়ে বক ধরার কৌশল শেখার দরকার নেই। তুমিই বরং একদিন আমার সঙ্গে গিয়ে সব শিখে এসো। তবে কখনো পুলিশের হাতে ধরা খেলেও আমার নামটি বলো না। পুলিশ একবার শিবপুর বাজারে আমাকে পাকড়াও করেছিলো। সেই থেকেই বড় হুশিয়ার আমি।
টানা তিনদিন মনসুর আলীর সঙ্গে সময় কাটায় রনি। পাহাড়ি এলাকায় নদীপথে দীর্ঘভ্রমণ করে। নলবনে যে মনসুর আলী লুকিয়ে যেতে পারে, সেই মনসুর আলীকে ফুলতলা বাজারে অনুভব করা যায় না। মনসুর আলীর পুরো জীবনই কেটেছে বিভিন্ন গাছের ডালপালা ও লতাপাতার ছায়ায়। এমনকি অনেক সুমিষ্ট পাখির গলা বা ডাকও নকল করতে পারে। সুর শুনেই মনসুর আলী পাখির অবস্থান বলতে পারে।
মনসুর আলীর প্রশিক্ষণ লাভের পর রনি মরা গোমতির উত্তর দিকটায় টানা তিনদিন ধরে সাদা বক ধরার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। তবু তাঁর প্রতিদিনের রুটিনই এখন বক ধরতে যাওয়া। একবার ধরা শিখে গেলে তাকে আর কে পায়? এতো বক এখানে, কখনোই শেষ হবে না। মনসুর আলী একদিনে সর্বোচ্চ ১৫টি বকও নাকি ধরেছিলো। অথচ রনি একটি বকও ধরতে পারছে না। তবু তাঁর চেষ্টার বিরাম নেই। বিস্তীর্ণ ধানি জমিতে চিকন বাঁশের খুঁটি দিয়ে কৌশল করে পাতা দিয়ে ঘন সবুজ গাছের মতো করে একটি ঘর বানায় রনি। দূর থেকে একে ঘর মনে হয় না একটুও। গাছই মনে হয়। পাঁচ হাত উচ্চতার এ ঘরের ভিতরে লুকিয়ে রনি বকের মতোই শব্দ করে ডাকে। কিন্তু বকেরা কেন যে সাড়া দেয় না। উড়ে এসে কেউ বসে না তার নকল বৃক্ষে। হতাশ হয়ে যখন রনি তার গড়া নকল বৃক্ষের ভিতর শুয়ে থাকে, ঠিক তখনই ঘটলো আচানক ঘটনা। দুই দুইটি সাদা বক এসে বসলো পাতায় গড়া তার বৃক্ষের মাথায়। দম বন্ধ করে রনি খপ করে ভিতর থেকে একটি বকের পা ধরে ফেলতেই অন্য বকটিও উড়ে যায়। রনি তার হাতের মুঠোর বকটিকে টেনে নিচে নামিয়ে এনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে।
রনির বক ধরার খবর মুহর্তেই ছড়িয়ে পড়ে মোহনপুর গ্রামে। কাদা-পানিতে মাখামাখি হয়ে রনি বক হাতে ফুলতলা বাজারের দিকে ছোটে। বিকেল সবেমাত্র হয়েছে। এখনই ক্রেতার সমাগম থাকবে বাজারে। কিন্তু পথ থেকেই চাম্পাপুরের আমীন আহম্মেদ রনিকে ফিরিয়ে দেন। বকের দাম ১০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বলেন, তুই আরও বক ধরে আমাদের দিয়ে দিস। আগামী দিন তোকে আরও ১০০ টাকা দেবো। আমার মা বাতের ব্যথায় সারারাত ক্যা ক্যা করে। কিছুদিন বকের মাংস খাওয়ায়ে দেখি কোনো কাজ হয় কী না।
১০০ টাকার নোট হাতে নিয়ে রনির আর আনন্দের সীমা থাকে না। গুরু মনসুর আলীর শেখানো বকের ডাকটি ডাকতে ডাকতে মরা গোমতির উত্তরের বিস্তীর্ণ ধানি জমির দিকে চলে যায়। এতো পাখি রয়েছে এখানে, একটু বুদ্ধি খাটাতে পারলে রনির রুটি-রুজিরই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নিজের গড়া পাতার ঘন নকল বৃক্ষের ভিতরে ঢুকে অবিকল বকের শব্দ করে ডাকে রনি। তার মাথার উপর দিয়ে বক উড়ে যাওয়ার শব্দ পায়। কিন্তু বক আর বসে না। নলবন-ঝোপঝাড় থেকে আরও ডাল-লতাপাতা কেটে এনে নকল বৃক্ষের চারপাশ আরও ঘন করে দেয়। ওপরের ফাঁকা অংশে যেখানে এসে বসবে বকেরা, সেইখানেও আরও পাতা ও ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। দূর থেকে এটিকে ঝোপ বা লতাপাতা ছড়ানো গাছই মনে হয়। এরই ভিতর বসে বসে রনি বকের শব্দ করে ডাকে।
দিনে দিনে রনি একজন পাখি শিকারী হয়ে যায়। ঠিক পাখি শিকারী নয়, বক শিকারী। ফুলতলা বাজারে যায়। মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে বসে বক বিক্রি করে। কিন্তু বক বিক্রেতা মনসুর আলীর আর দেখা নেই। পুলিশের কথা বলেছিলো মনসুর আলী। তবে কি কোনো বিপদ হলো তার? রনির বুকে ভয় জমে ওঠে।
পরদিন ঠিক দুপুর বেলা মরা গোমতির উত্তরদিক থেকে দৌড়ে আসে কৃষক সুমন মোল্লা। মোহনপুর গ্রামবাসীকে ডেকে মরা গোমতির দিকে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখে এক বীজতলায় পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করছে রনি। কেউ ভেবেছে সাপে কেটেছে রনিকে। পরে দেখলো খালি হাতে বক শিকারের সময় বক পাখি তাঁর ডান চোখে ঠোকর দিয়ে একমাত্র ডান চোখটিও বাতিল করে দিয়েছে। একজনের পরামর্শে তাৎক্ষণিক ডাবের জল দেওয়া হলো সেই চোখে। উপশম হলো না কিছুই। যন্ত্রণায় আরও ভয়াবহভাবে চিৎকার করতে থাকলো রনি। হারানো চোখটি উদ্ধারের আশায় সর্বশেষ তাকে হাসপাতালে নেয়া হলেও কাজ হলো না কিছুই। অন্ধই হয়ে গেলো রনি। ফুলতলা বাজার- মোহনপুর গ্রামসহ গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে গেলো সে খবর। সবাই রনিকে দেখতে এসে সহমর্মিতা প্রকাশ করলো, শুধুমাত্র বক শিকারী মনসুর আলীকে ছাড়া। আর কোনোদিনও মনসুর আলীর খোঁজ পেলো না রনি। এমনকি এলো না সে আর ফুলতলা বাজারেও। কোনোদিনও আর এলো না। সেই থেকেই ফুলতলা বাজারের মোহাম্মদ ফয়াজ আলীর মুদি দোকানের সামনে বসে হাট-বাজার চলাকালীন সময়ে ভিক্ষা করে রবিউল হোসেন রনি। বক-দন্ডে গত দেড় যুগ সময় তার অন্ধকারেই কেটেছে। হয়তো বাকিটা জীবনও তাঁর কবরের অন্ধকারেই কাটাতে হবে।

৩৭| ০৮ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১:০৫

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প
পাখির অটোবায়োগ্রাফি
জসীম উদ্দিন অসীম
============
রচনা: বৈশাখ, ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ,
মাতুয়াইল, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর, ২০০৯ :
সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ, কুমিল্লা।

আলোকচিত্র: জসীম উদ্দিন অসীম:
2001 খ্রিস্টাব্দ

জল তো জলীয়বাষ্প হয়। কিন্তু পাখিরা কি জলীয়বাষ্প হয়? কিংবা কোনো মানুষ? মানুষ কি মেঘ হতে পারে? হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর নিয়তই বহন করে বিশ্বপ্রকৃতি। কিন্তু আমি তা জানি না। ক্ষুধা মানুষকে খুন করতে পারে, সে আমরা অনেকেই জানি। সুন্দরী নারীকে তো কেউ কেউ খুনিই বলেন। কিন্তু কখনো কি শোনা যায় একগুচ্ছ গোলাপ খুন করেছে কোনো যুবতীকে? অথবা পানকৌড়ি, বুনোহাঁস, ধনেশ, মাছরাঙা পাখি?

পান্থ আর পিয়াসু এক নদীকূল এলাকার দুইজন মানুষ। ঝড়ের রাতে, বৃষ্টিবাদলার দিনে প্রায়ই একইসঙ্গে কেটেছে ওদের শৈশব। অবিচ্ছেদ্য এই দুইজনের আজ বিচ্ছিন্ন বসবাস। কিন্তু এর কারণ কী পাখি? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো গাঙশালিকেরা জানে, নীলকন্ঠ জানে এবং জানে চকোর...মুনিয়া। কিন্তু আমি জানি না।

বৈশাখ মাসের দুপুর। আনন্দপুর গ্রামের দিকে মাটির যে দীর্ঘ পথটা গিয়েছে, সে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পান্থ। এ হাঁটার পথ নদীর মতোই আঁকাবাঁকা । সড়কপথ থেকে পান্থদের আনন্দপুর গ্রামটা খুব দূরে নেই। তাই এটুকু পথ হেঁটেই চলে যায় অনেকে।
আকাশ থেকে রোদ নয়, ঠিক যেন আগুনই ঝরছে। পথের পাশে রয়েছে কোথাও কোথাও ছায়াদার বৃক্ষ। কোনো কোনো বৃক্ষের নিচে গ্রামের কৃষকরা কাজ ফেলে নানা গল্পে ব্যস্ত।
এই আনন্দপুর গ্রামেই পান্থের জন্ম হয়েছিল। এখন সে ঢাকা শহরে থাকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে। শৈশবটা তার গ্রামে কেটেছে বলে গ্রামকে সে আজও ভুলতে পারে না।
তবে আনন্দপুর গ্রামটা এখন আর আগের মতো নেই। সারাটা গ্রাম ছিল একদা বাঁশঝাড়ে আচ্ছন্ন। বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ...। আর এখন? যেন বাঁশ বাগানের মাথার উপর ঘাস...। আহারে এত শত হিজল-পিয়াল আনন্দপুর গ্রামটা থেকে কোথায় গেল আজকাল? এখন কি আর এই গ্রামে পূর্ণিমায় চাঁদ নামে?
পান্থের হাতে ছাতা নেই। মাথায় দমকা রোদ। আরেকটু হেঁটে পথের পাশের ছায়াদার জামগাছটির নিচে দাঁড়ায় পান্থ। এখানে এই ভরদুপুরেও আড্ডা বসেছে। কতো গল্প। পান্থও বসে পড়ে। এমনি সময় জামগাছের পাশেই ধপাস করে একটি যুবক পড়ে যায় গাছের ঠিক মগডাল থেকেই। সবাই হৈচৈ করে উঠে। একজন বলে, হায় হায়রে পিয়াসুটা শেষ। পানি আন, ওসমান ডাক্তারের বাড়ি নিয়ে চল...। পান্থ বলে, কোন পিয়াসু সে? পান্থের কথার জবাব দেয় না কেউ...।

আনন্দপুর গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে বাঁধন নদী। সেই বাঁধন নদীর ওপার থেকে এক বুড়ি আসতেন পাড়ায় পাড়ায় পানসুপারি বিক্রি করতে। বুড়ির সঙ্গে আসতো বুড়ির ছোট্ট নাতি পিয়াসু। এ কি সেই পিয়াসু? পান্থের নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন। সবাই সেই পিয়াসুকে বুড়ির লাঠি বলতো।
পান্থদের বাড়িতে বুড়ি এলেই এই কিছুক্ষণের জন্যই পান্থ-পিয়াসুর খেলা জমে উঠতো। দাদীর সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে নানা গল্প শুনে শৈশবেই পিয়াসু হয়ে উঠেছিল এক মহাগল্পরাজ। পিয়াসু গল্প বলতো আর তা মুগ্ধ হয়ে শুনতো শুধু পান্থ। এভাবে যে কতো দিন তাদের কেটেছে।
এই পিয়াসুর বাবা-মা কেউই তখন বেঁচে ছিল না। পরে তার বুড়ীদাদীও মারা যায়। পিতৃমাতৃহীন পিয়াসুকে পাঠিয়ে দেয়া হয় তার মামার বাড়িতে। কিন্তু মামীদের অত্যাচারে সে সেখানে থাকতে পারেনি। মামীরা তাকে দিয়ে যত কাজ করাতেন, তত খাবার বা স্নেহ দিতেন না। অবুঝ পিয়াসুর মন এতে ভীষণ ভীষণতর খারাপ হয়ে যেত।

পান্থ আর পিয়াসু শৈশবে বাঁধন নদীর তীরে কাশফুল দেখতে যেত। কাশফুল দেখতে গিয়ে খুঁজে পেত পাখি। হরেক রকম পাখি। তাদের মধ্যে পানকৌড়ি-গাঙশালিক-সারস-কালীবক-কোচবকই ছিল বেশি। তখন ছিল এক বাঁশিওয়ালাও। সারাদিন বাঁশি বিক্রি করে দিনশেষে নদীর পার ধরে বাঁশি বাজাতে বাজাতে তার নিজের বাড়িতে চলে যেত। একটু বড় হয়ে পান্থ তার মাকে বলেছিল, নদীটাতো দু-পাশের মানুষকে ভাগ করে রেখেছে। তবে এ নদীর নাম বাঁধন’ নদী হলো কিভাবে? পান্থ-র মা বলেছিলেন, নদীটা আসলে জল দিয়ে ভালাবাসা দিয়ে দু’পাশের মানুষকেই বেঁধেই রেখেছে। বাঁধন নদীর ঐ যে খেয়া নৌকার মাঝি-সে তো দুপাশের মানুষকে সারাদিন এপার-ওপার করে মিলিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে।

পান্থ ছোটবেলায় ভাবতো একদিন সে বাঁশিওয়ালাই হবে। এই ভেবে শৈশবে কিনেছিল কত বাঁশি। সেই বাঁশি সবসময়ই সঙ্গে থাকতো তার। স্কুলে যাওয়ার সময়ও সঙ্গে, আসার সময়ও সঙ্গে। খাওয়ার সময়, ঘুমানোর সময়ও বাঁশি থাকতো সঙ্গী হয়ে। কিন্তু পরে কোথায় গেল বাঁশি আর কোথায় গেল বাঁশির সেই স্বপ্ন...তা সে নিজেও জানে না।
পিয়াসু-র দাদীর মৃত্যুর পর পিয়াসু যখন তার মামার বাড়িতে থাকতে গিয়েছিল, তখন বুঝলো এই পৃথিবী কতো কঠিন। মামীদের আচরণে মামার বাড়িকে তার চামার বাড়ি মনে হতো। মামীরা ভাবতেন এ ছেলের দায়িত্ব নেবে কে? যেখানে কী না তাদের নিজেদের ছেলেদের দিকেই তাকানোর তেমন সময় সুযোগ নেই। তাও যদি ছেলেটা একটু কাজে মনোযোগী হতো। আর মামারা নানা কারণে মামীদের খুব ভয়ই করতেন। নানী থাকলে পিয়াসু-র একটা ব্যবস্থা হতোই। কিন্তু পিয়াসুর ভাগ্যখানা সবদিক দিয়েই সত্যিই খারাপ ছিল।
দাদীর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছোটবেলা থেকেই আনন্দপুর গ্রামটা পিয়াসুর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো এ গ্রামটা ছেড়ে সে কোথাও থাকতে পারেনি। একবার কাজ নিয়েছিল কোম্পানীগঞ্জের এক মিষ্টি দোকানে। কিন্তু মিষ্টি দোকানের কাজ তার ভালো লাগেনি। আবার ফিরে এসেছিল আনন্দপুর গ্রামে। কিন্তু বাঁচবে-খাবে কী করে? আগে কেউ কেউ একটু দয়া করে খেতে দিতো। পরে সবাই অভিযোগ করলো, ছেলেটার তো কাজেই মনোযোগ নেই।
কাজে কেন মনোযোগ নেই পিয়াসুর? অনেকে বললেন, পিয়াসু তোর দাদীর ব্যবসাটা ধর। টাকা কিছু লাগলে আমরা দেব। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানসুপারি বিক্রি করতে ভালো না লাগলে জামতলায় একটি ছোট্টখাট্ট দোকান করে দেব। পিয়াসু তাতেও মন দেয় না। কিন্তু পেট চলবে কী করে তার? কিছুদিন বাঁশিওয়ালার পেছন পেছন ঘুরেছে বাঁশি বিক্রি করবে বলে। বাঁশিওয়ালা বলে, বাঁশি বাজায় পাগলে। পাগল না হলে কেউ বাঁশি বাজায় না, বাঁশি বিক্রি করে না। আমি তো এক পাগল। তাছাড়া বাঁশি বিক্রি করার প্রথম শর্ত বাঁশি বাজাতে শেখা। বাঁশি বাজাতে শিখতে হলে তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।
তারপর বাঁশির নেশায় কিছুদিন পিয়াসু বাঁশিওয়ালার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। এই গ্রাম-সেই গ্রাম-এই গঞ্জে-সেই গঞ্জে করে কতো গ্রামে কতো গঞ্জে যে যায়। কিন্তু আবারও সে ফিরে আসে তার আনন্দপুর গ্রামে। যেন সব আনন্দ তার এই আনন্দপুর গ্রামেই।
পিয়াসু জানতে চেয়েছিল বাঁশিওয়ালা কেন বাঁশিওয়ালা হলো: অন্য কিছু না হয়ে। বাঁশিওয়ালা বলেছিলো, ছোটবেলায় তার বাঁশির খুব নেশা ছিল। কিন্তু তার বাবার হাতে পয়সা ছিল না। তাই সে পৌষের মেলা থেকে বাঁশি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে অনেক মার খেয়েছিল মানুষের। তারপর ভেবেছিলো, বাঁশির জন্য যেহেতু এত অপমান, সেহেতু বাঁশির জন্যই জীবন উৎসর্গ করবে। বাঁশি বাজানো, বাঁশি বানানো এবং বাঁশি বিক্রির সেই হলো পেছনের এক গল্প। কিন্তু পিয়াসুর জীবনে তো এমন কিছু ঘটেনি। তবে কেন সে বাঁশিওয়ালা হবে?
বাঁশিওয়ালার আসল নাম সবুজ মিয়া। কিন্তু ও নাম এখন বাঁশিওয়ালা নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ছোট্ট একটি সংসারও আছে তার। সংসারে আছে ছোট্ট এক কন্যা সন্তান: বাঁশির নামেই নাম রেখেছে তার। বাঁশিওয়ালা গানও রচনা করে। কখনো কখনো। সেই গানের সুর সৃষ্টি করে বাঁশিতে ঢেউ তোলে। বাঁধন নদী প্রাণ দিয়েছে আমার জীবনকে... বাঁশিওয়ালার এ সুর পিয়াসুর খুবই প্রিয়।

বাঁচার জন্য কী করবে পিয়াসু, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাঁশি বাজাতে হলে, বাঁশি বিক্রি করতে হলে বাঁশিওয়ালার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কারো অধীনে কাজ করতে ইচ্ছে হয় না পিয়াসুর। নিজের মতো কাজ করবে। নিজের মতো স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু কী কাজ করবে? করবেটা কী? তা খুঁজে বের করতে পারে না।
পিয়াসু কোনো লেখাপড়াই করেনি। অথচ স্বাধীনতা চায়: সব স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার সন্ধানে সব আজব আজব চিন্তা কাজ করে তার মাথায়। ধানকাটা হয়ে গেলে ধানের জমিতে থাকা ইদুরের গর্ত থেকে ধান বের করে করে একবার অনেক ধান জমা করে পিয়াসু। সেই ধান বিক্রি করে কিছুদিন ভালোই কেটেছে। কিন্তু সে আর কতোদিন! তাছাড়া এ কাজে সাপের ভয়ও আছে। প্রচন্ড গরমে একবার মানুষের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সে সময়ে পিয়াসু কিছুদিন একটি ছোট্ট বাক্সে করে অল্প কিছু আইসক্রীম নিয়ে আনন্দপুর গ্রামে বিক্রি শুরু করে। মোটামুটি লাভ হয়েছিল। কিন্তু যেই অনাবৃষ্টির অবস্থা কেটে গেল, সেই তার বিক্রি গেল খুব কমে। পেটের ক্ষুধায় পিয়াসু তখন হিংস্র হয়ে গেল। মনে হল তার দেশটা যদি মরুভূমি হয়ে যেত, তাহলে সারাদিন আইসক্রীম আইসক্রীম করে চিৎকার করলে অনেক লাভ হতো। অথচ যখন বর্ষা এলো, জলস্ফীতি দেখা দিলো বাঁধন নদীতে। তখন আর আইসক্রীম খায় কে?
পিয়াসু কেন অন্যের কাজ করতে পারে না, তা সে নিজেও জানে না। শুধু জানে অন্যের কাজ করতে তার ভালোই লাগে না। নিজের কাজও কিছু নেই যে করবে। এই কারণে তার অনেক অভাব। কিছুদিন এ-ঘর ও-ঘর পান্তাভাত ভিক্ষে করে খেয়েছে। বেশি অভাবে খুদের জাউ করে খেয়েছে-কলাগাছের লাবড়া খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে।

পিয়াসুর মা মারা যায় তার জন্মের কিছুদিন পরই। অসুখে। আর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায়। যদি তার কাজে মনোযোগ থাকতো, তবে আজ তার এ অবস্থা কি হয়? মাথায় তার যত অদ্ভুত চিন্তা। অদ্ভুত হলেও হতো, অদ্ভুতচিন্তাগুলোও স্থির নয়। আজ যদি ভাবে রুটি বিক্রি করবে, রুটিওয়ালা হবে, আগামীকাল সেই ভাবনা বদলে যায়। ভাবে, রাশি রাশি কাকতাড়ুয়া বানিয়ে বানিয়ে গ্রামের কৃষকদের কাছে বিক্রি করবে। কিন্তু কোন কৃষক কিনবে এ পাগলের কাছ থেকে কাকতাড়ুয়া?
খুব বেশি কষ্টেই পিয়াসুর ছেলেবেলাটা কেটেছে। তারপরও তার দাদী ছিল। এখন সে শুধুই একা মানুষ। দাদীর মৃত্যুর পর যখন বয়স কিছুটা বাড়লো, তখন তার এক দূর সম্পর্কের কাকা তাকে কিছুদিনের জন্য গরুছাগল লালনপালনের কাজ দিয়েছিল। করেছিলও কাজটা কিছুদিন। পরে তার মনে হলো এমন সুন্দর জীবনটা তাঁর শুধু পরের গরু আর ছাগলের পেছনে ব্যয় করার কোন মানেই হয় না। পিয়াসুর কাছে মনে হলো গরুছাগলতো প্রায় সবাই লালনপালন করে। বরং জঙ্গল থেকে শিয়ালের বাচ্চা ধরে পোষতে পারলে কাজে দেবে। কিন্তু শেয়ালের বাচ্চা তো আর একা ধরা সম্ভব নয়। তাই তাঁর এ কাজে আর শরীক হবে কে?
সর্বশেষ পিয়াসুর নজর পড়ে পাখির দিকে। পাখপাখালি আগে তার অনেক প্রিয় ছিল। কিন্তু পরে মনে হলো, এগুলোকে তো ধরে তো বিক্রিও করা যায়। প্রথমে নজর পড়ে যাযাবর পাখিদের দিকে। কিন্তু কোনোভাবেই সেই পাখি ধরতে পারে না সে। বাঁধন নদীর দক্ষিণপাড়ের কাছে বিরাট এক জলাশয় রয়েছে। ওখানে সারাবছরই জল থাকে। শুকনো মৌশুমেও। ওখানে আছে অনেক সারস-কালীবক-কোঁচবক। মাথার উপর বাজপাখি। পানকৌড়ি-বুনোহাঁসও কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায়। মাছরাঙারতো অভাবই নেই। এলাকায় এ জলাশয়ের নাম তিতির জলা। পিয়াসু একদিন অর্ধেক মাছ দেবে বলে আনন্দপুরের রেখাদিদির কাছ থেকে তাদের কুনোজালটা নিয়ে তিতির জলায় যায়। মাছ কিছু পায়ও প্রথম। কিছু চুনোপুঁটি, একটি সরপুটি, একটি পাবদা, একটি টাকি আর কিছু চিংড়ী মাছ। এমন সময় পিয়াসু দেখতে পায় দুটি সারস কী নিয়ে যেন ভীষণ ঝগড়ারত। দৌড়ে গিয়ে ওদের উপর জাল ফেলে পিয়াসু। সঙ্গে সঙ্গেই সারস দুটি জালের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। কিছু মাছ আর সারস পাখি দুটিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে পিয়াসু। রেখাদিকে পুরো মাছ দিয়ে সারস দুটিকে নিয়ে বাজারে যায় সে। ভালো দামে সারসদুটিকে বিক্রিও করে। তারপর সন্ধ্যার পরপরই বাড়িতে ফিরে আসে। পাখি হত্যার এ প্রথম রাতেই গভীর ঘুমে পিয়াসু এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখে পিয়াসুর সবগুলো আঙ্গুল বঁড়শি হয়ে আছে। কেন দেখলো সে এমন স্বপ্ন? ঘুম থেকে উঠে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা সন্ধান করে পিয়াসু। ভোর হতেই স্বপ্নটা ভুলে নিজেকে পাখি শিকারী ভাবতে থাকে আবার। জালের খোঁজে নেমে পড়ে গ্রামে। শুধু কুনোজাল নয়-চুনোজাল-ধর্মজাল-টানাজাল...জগৎবেড়-বেড়াজাল-কুঁড়াজাল... কোন জালে কিভাবে কোন পাখি শিকার করা সম্ভব, এ নিয়ে রীতিমত যেন গবেষণায় নামে সে। তারপর কোন পাখি কী খায়, এ নিয়ে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে। কিভাবে পাখি শিকার করা যায়, এ ফাঁদ নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় পিয়াসুর মনে হয় শিকারী পাখির মতো তার একজোড়া পাখা থাকলে খুবই ভালো হতো। কোন পাখি কোথায় বাসা বাঁধে, কোন পাখি কেমন করে ডাকে...এ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাঁধন নদীর উত্তরপার পার হয়ে আছে গগনবিল। সেই বিল পার হয়ে পাখসাট জঙ্গল। সেখানে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ যায় না। কারণ ওই জঙ্গলে-সবাই বলে শঙ্খচূড় আর দাঁড়াশ সাপের অতি উৎপাত। তবে পাখিও রয়েছে হরেক রকম। লোকে বলে ওই জঙ্গলের মাটিতে গাছের ঝরা পাতা আর পাখির ঝরা পালকের পরিমাণ নাকি প্রায় কাছাকাছি। এত পাখির পালক দেখে অনেকে সন্দেহ করে পাখিখেকো সাপও এ জঙ্গলে রয়েছে।
কিন্তু পিয়াসু সব ভয় অতিক্রম করে পাখসাট জঙ্গলে যায়। কেউ তার সঙ্গী হয় না। যাবার সময় দড়ি-লাঠি সব নিয়ে যায়, যদি সাপ সত্যি সত্যিই তাড়া করে! পাখসাট জঙ্গলে ঢুকে পিয়াসুর অনেকটা ভয়ই লাগে। সাপের দেখা পায়নি, যা সুখকর। পাখিরও কোনো দেখা মিলেনি, যদিও পাখির কিছু পালক ততক্ষণে চোখে পড়েছে তার। মাটিতে ছড়ানো পালক। আর দেখা গেলো পেঁচা রাশি রাশি। কাল পেঁচা -লক্ষী পেঁচা -হুতোম পেঁচা -কতো রকম পেঁচা। একবার একটি ঝোঁপের ভিতর ফোঁসফোসানি শোনাও গেল। এক জায়গায় দেখা গেল কাঁকড়ার শুকনো কিছু খোলস, কয়েকটি শামুকেরও। ফোঁসফোসানি শুনে মনে হয় চন্দ্রবোড়া সাপের। আরেকটু এগিয়ে পিয়াসু একটি গাছের তলে সাপের খোলস দেখে ভয়ে আৎকে ওঠে। হঠাৎ চোখে পড়লো একটি বউ কথা কও পাখি এবং একটি পানকৌড়ি। পানকৌড়ি দেখেই বুঝলো এ গভীর জঙ্গলের কাছেই হয়তো কোথাও কোনো জল আছে। হ্যাঁ ঠিক। একটু গভীরে ঢুকেই দেখলো জঙ্গলের ভিতরে একটি পুকুরও রয়েছে।এ পুকুরের কথা আগে কেউ পিয়াসুকে বলেনি। আর দেখা গেল একটি বিরাট আকারের বল্লার (বোলতা) বাসা। মাটি থেকে সামান্য উঁচু একটি গাছের ডালে।
জঙ্গলের ভিতর তেমন রোদ পড়ে না। ঘনানো অন্ধকার। ভরদুপুরেই। গাছগাছালির বেষ্টনী ভেদ করে ঠাঠাপড়া রোদ্দুরও খুব কষ্টে মাটিতে নামে।
পিয়াসু একটু এগিয়ে গিয়ে বনের ভিতরের পুকুরটা দেখতে পায়। পুকুরের পানি পানিতো নয়...যেন গোলাপজল। পুকুরজলে নীল পদ্ম লালপদ্মের বিস্তার। পদ্মপাতার ছড়াছড়ি। খর বৈশাখেও শুকায় না এ পুকুর। পুকুরপাড় ধরে হাঁটে পিয়াসু। হঠাৎ নাকে বেলিফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। দূরে একটি রক্তজবার গাছ চোখে পড়ে। তারপরই বেতবন। আছে কিছু নলখাগড়া। এখানে ওখানে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় নয়, বাঁশবাগান।
সুন্দরবনের নাম শুনেছে পিয়াসু। দেখেনি। এখন মনে হয়ে এই পাখসাট জঙ্গলই যেন কোনো এক সুন্দরবন। এক জায়গায় অসংখ্য তুলসী গাছ দেখে পিয়াসুর মনে হয় এ জঙ্গল কোন এককালে হয়তো হিন্দুবসতিই ছিল। তবে এগুলোর অধিকাংশই বনতুলসী গাছ। হঠাৎ পিয়াসুর মনে হয় জন্তু জানোয়ার থাকলেও থাকতে পারে। বাঁশবনে কিছু বক দেখলেও ধরার উপায় নেই।
বনে এসেছে পিয়াসু পাখির বাচ্চার খোঁজে। কিন্তু পাখির বাসা খুঁজে পাচ্ছে না। তাছাড়া ভয় লাগে। সাপের ভয়। এছাড়া একা এসেছে বলে মনে হয় সারা জঙ্গলে ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জঙ্গলে পক্ষীরব আছে কিন্তু ওদের দেখতে পাওয়া যায় না। গাছের পাতার সঙ্গে মিশে থাকে। তবে মাটিতে পালক খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন পাখির। শোনা যায় পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দও। সারা জঙ্গলে পাখির এতই কিচিরমিচির যে, ঠিক কোথা থেকে শব্দ আসছে, তা বুঝতে পারাও কঠিন। তবে এরই মধ্যে কিছু হরিয়াল-টিয়ে-চন্দনা উড়তে দেখেছে পিয়াসু। এদের বাসা চোখে পড়েনি। একটি ধনেশপাখিও চোখে পড়েছে খুব উঁচুতে। কিন্তু এদের বাসা কোথায়? পাখি যেহেতু রয়েছে, বাসাও নিশ্চয়ই থাকবে।
বিকেল হওয়ার একটু আগেই টিয়ে পাখির একটি কোটর খুঁজে পায় পিয়াসু। বাসায় পাখির বাচ্চাও আছে বুঝতে পারে। মা পাখি কী এক ফলের শাঁস জাতীয় খাবার নিয়ে সেই কোটরে ঢুকতেই কোটরের মুখ পর্যন্ত বাচ্চারা এগিয়ে এসে বিভিন্ন শব্দ করে উঠে। সেই কোটর বিশাল এক মহুয়া গাছে। মা পাখিটা বাসা ছাড়তেই মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে পিয়াসু সেই মহুয়া গাছে উঠে। গাছে উঠার ভঙ্গিটি পিয়াসুর এমন যেন সে কোন গাছুড়িয়ার রক্ত বহন করছে।
সন্ধ্যার আগেই টিয়ে পাখির বাচ্চাগুলো নিয়ে বাড়িতে ফিরে পিয়াসু। পরদিন সারা আনন্দপুরে হৈচৈ পড়ে পিয়াসুর এ পাখির নেশা নিয়ে। দুপুরের আগেই এক শৌখিন লোকের কাছে টিয়ে পাখির বাচ্চাগুলো ভালো দামে বিক্রি করে সে। তারপর ভরদুপুরে আবার সে সেই পাখসাট জঙ্গলে চলে যায়।

পাখির জন্য শৈশবে পিয়াসুর যে প্রণয় ছিল, তা এখন রুচিহীনতার রূপ পায়। পাখির প্রতি প্রবল ঝোঁক এখনও রয়েছে তার। তবে তা অনাদরের। পাখি দিয়ে কী ব্যবসা হবে, এটাই এখন তার ভাবনার বিষয়। ভালোবাসার জায়গা দখল করেছে ব্যবসা। পাখিরা আগে ভালোবাসতো পিয়াসুকে। এখন ঘৃণা করে। আগের পিয়াসু সভ্য, এই পিয়াসু বর্বর। সে সারাদিন তিতিরজলার নলখাগড়ার বনে ঘুরে বেড়ায় পাখি ধরে বিক্রি করবে বলে। আনন্দপুরের অনেকেই এখন বলে এই পিয়াসু খুবই কুশ্রী মানুষ। তার চেয়ে পেঁচার মনও সুন্দর।

এদিকে পাখসাট জঙ্গল থেকে পাখি আর পাখির বাচ্চা ধরার কাজে পিয়াসুর দক্ষতা দিনদিন বেড়েই চলে। এখন পিয়াসু অনায়াসেই তাঁর অভ্যস্ত হাতে পাখি ধরে ফেলে। বর্শিতে টাকি মাছের জ্যান্ত পোনা গেঁথে বক ধরে ফেলে। সারাদিনের ফন্দিফিকির-কুটকৌশল ঐ পাখি শিকার নিয়েই। পাখি বিক্রি করে সে এখন মুচমুচে বড়া কিনে খায়। সিঙারা খায়, নিমকি খায়। নানা কোম্পানীর লেবেঞ্চুস কিনে আনে। সেদিন খেয়েছে ক্ষীর। আহ-কী মজা! মায়ের দুধ বেশিদিন খেতে পারেনি পিয়াসু। তাই দুধের অভাবটা যেন এখনও বোধ করে। পাখি বিক্রির টাকায় সেদিন অনেক শোনপাপড়িও কিনেছে। অথচ শৈশবে এই শোনপাপড়ি চেয়ে চেয়ে দাদীর কাছে কতো কান্না কাঁদতো। আহারে পাখি বিক্রির আগে পিয়াসু খুদের জাউ খেতে খেতে পাগল হয়ে উঠেছিল। একবার এক সকালে প্রতিবেশীর ঘর থেকে পান্তাভাত আর টকডাল খেতে না পেলে নির্ঘাত মারা যেত। আর এখন পাখি বিক্রির বদৌলতে টাকা দিয়ে পিয়াসু জিলিপিও কিনেও খেতে পারে।
যে জামগাছ থেকে অবশেষে পড়ে গেলো পিয়াসু, পরে মরেও গেলো, সেই জামগাছে সে উঠেছিল পাখির খোঁজেই। তবে পাখির এ সন্ধান ছিল ভিন্নরকমের।
একদিন কোনো এক শিকারীর গুলি খেয়ে পাখসাট জঙ্গলে উড়ে এসে ধপাস করে পড়েছিল এক গাঢ় সবুজ টিয়ে। প্রথমে এ পাখিকে হীরামন বা চন্দনা ভেবেছিল পিয়াসু। পরে দেখলো টিয়ে। তখন রক্তে ভিজে সবুজ এ পাখিটির শরীর লাল হয়েই গিয়েছিল। পিয়াসু এ পাখিকে উদ্ধার করে অনেক সেবাযত্ন করে। বাজার থেকে কিনে আনে চাঁপাকলা-পেয়ারা-পাউরুটি-চিড়েমুড়ি...কতো কী! তাঁর আহত-অসুস্থ টিয়ে পাখিটাকে খাওয়াবে বলে। পাখিটাও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়। যেন বশও মানে। শুধু এই একটি আহত অসুস্থ পাখির প্রতি পিয়াসুর কর্তব্যজ্ঞান দেখে অনেকে আবার সত্যিই অবাক হয়। অনেকে বলে, এই পাখিটি সুস্থ হলে পিয়াসু একেও বিক্রি করে দেবে। তবে এ জন্য তার নিয়মিত পাখি ধরা ও পাখি বিক্রি করার কাজটি কিন্তু মোটেও বন্ধ নেই। এদিকে পরিচর্যায় একসময় সম্পূর্ণ সুস্থও হয় সেই আহত টিয়ে পাখিটি। কিন্তু পিয়াসু সেই পাখিটিকে কোথাও বিক্রি করে না। আদরযত্ন করতে করতে পাখিটার ওপর এক ধরনের মায়াও তৈরি হয় তাঁর। একসময় পাখিটার একটি নামও দেয় পিয়াসু। যুবরাজ। যুবরাজ পিয়াসুর কোনো মতলবই বুঝে না। যুবরাজেরও কোনো মতলব রয়েছে কী না তাও বুঝে না পিয়াসু। পিয়াসু তাঁর দাদীর কাছে যেসব পাখির গল্প শুনতো, তা হলো ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী পাখি। কিন্তু এখন সে অনেক পাখি চিনে। বুনোহাঁস-বালিহাঁস-বেলেহাঁস। গাঙশালিক-রামশালিক-হাড়গিলা-ডাহুক-তিতির-শঙ্খচিল... কতো পাখি।
গুলি খাওয়া পাখিটাকে সুস্থ করার পর সেটাকে সে পোষা পাখির মতোই লালন করতে থাকে। পাখিটাও যেন এক ধরনের পোষ মেনেই যায়। দেখায় কৃতজ্ঞতা। খাঁচা ছাড়াই পিয়াসুর হাতে হাতে থাকে। যেন মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। যুবরাজ পাখিটি পিয়াসুকে দেখলেই বিনীতভঙ্গিতে ডেকে উঠে। কৃতজ্ঞচিত্তে নাড়াতে থাকে লেজ। যেন সে আর কখনো আকাশে যাবে না। শোঁ করে ঢুকবে না পাখসাট জঙ্গলে। পিয়াসু তো এসব দেখে ভীষণই খুশি হয়।
যুবরাজ পাখিটি ধীরে ধীরে পিয়াসুর ভীষণ ভক্তও হয়ে পড়ে। পিয়াসুর কথা বুঝতে চেষ্টা করে। অনেকে ভাবে, পিয়াসু এ পাখিকে শিকারী পাখি হিসেবে গড়ে নেবে। পাখসাট জঙ্গলের আরও পাখি শিকার করবে বলে। পাখিটিকে পিয়াসু নিজহাতে স্নান করিয়ে দেয়। দুষ্টুমি করে পাখিকে বলে, বল যুবরাজ বল, ভাগ্য আমার গণনা করে বল, আমি কখনো রাজা হবো কী না...। আমার মাথায় রাজমুকুট লাগলে তোকেই করবো রাজার প্রধান দূত...ইত্যাদি। কিন্তু পাখিরওতো কিংবদন্তী আছে, স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে। আছে সন্দিহান মন। কৌতূহলে-কূটপ্রশ্নে পাখিও নিজেকে জর্জরিত করে। পাখিও খুঁজে বেড়ায় নিজের আপন অতীত...পাখিরও থাকে বায়োগ্রাফি…অটোবায়োগ্রাফি...। তাই এতকিছুর পরও যুবরাজ পালায়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পিয়াসু দেখে তাঁর সেই যুবরাজ ঘরে নেই। নেই তো একেবারেই নেই...কোথাওই নেই। যুবরাজের খোঁজে পাখসাট জঙ্গল তছনছ করে পিয়াসু। কোথায় পাবে ‍যুবরাজকে? নেই। কোথাওই নেই।একেবারেই নেই।পোষা পাখি হারানো এতটাই দুঃখময়, এ জীবনে কখনোই ভাবেনি পিয়াসু। ব্যথা বেদনায় নি®প্রাণ হয়ে পড়ে। শোকদগ্ধ মন নিয়ে কখনো সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। নিজেকে সে প্রশ্ন করে, পাখিরাও এমন বিশ্বাসঘাতক হয়?

এরই মধ্যে একদিন সকালে পাড়ার একটি বালক পিয়াসুকে দৌড়ে এসে বলে, যুবরাজকে সে দেখেছে সেই সড়কপথের কাছের বুড়ো জামগাছের মগডালে। পাতার ঝোঁপে লুকানো। শুনতে দেরি, যেতে দেরী নেই পিয়াসুর। আঠা-কাঁটা-সুতা-খাঁচা নিয়ে ছুটে জামগাছের দিকে। আর যদি জীবনে একবার ধরতে পারে যুবরাজকে, তবে চিরতরেই বুঝিয়ে দেবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার জেলে বন্দী হতে সত্যিই কেমন লাগে!

৩৮| ০৮ ই জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৮

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প:
পোনরা মেলা
জসীম উদ্দিন অসীম
রচনা: অক্টোবর, ১৯৯৮, কুমিল্লা

সাতদিঘি গ্রামের অনামিকা দত্ত পোনরা মেলার এমনই পাগল, যেমন হেলাল। অনামিকা পড়ে নিরুপমা বালিকা বিদ্যালয়ে। অবিভক্ত বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ বিদ্যালয়টি। এ এলাকায় এমন প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ আর দ্বিতীয়টি নেই। এদিকে পরবর্তী জীবনে যে হেলাল আর্জেন্টিনা, কিউবা বা ল্যাতিন আমেরিকার ভয়ানক পাগল হয়ে উঠবে, সে এখন শুধু পোনরা মেলারই পাগল। যে ছেলেটি এখন শুধু অনামিকা দত্তকেই ভালোবাসে। এই কয়েকবছর পরেই সে হয়ে উঠবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী এক যুবক। মার্কিন মদদপুষ্ট সকল মানুষকেই করবে ভয়ানক ঘৃণা। প্রচন্ড অস্থির এই যুবকও নবম শ্রেণিরই ছাত্র।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এক মেলা পোনরা মেলা। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দেবিদ্বার উপজেলার এ মেলাটি হেলালের খুবই প্রিয়। এ মেলার গুরুত্ব তার মতো আর তাঁর কোনো বন্ধুই অনুধাবন করে না। এ মেলা দেখতে প্রতি বছরই ‘ইন্ডিয়া’ থেকেও অনেক লোক আসেন।অনেক দুর্লভ ও দুস্পাপ্য খেলনার ভান্ডার এ মেলা।প্রচুর ব্যবহারিক সামগ্রীও পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় কাঠের আসবাবপত্র। লোকে ওই মেলাকে বলে ‘কাঠের মেলা’। মেলার নান্দনিক সৌন্দর্য আসলে বাড়িয়েছে মেলার মধ্যের সুপ্রাচীন বটবৃক্ষগুলোও।
হেলাল বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও প্রচন্ড হিন্দুপ্রীতির বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে উত্তরাধিকারসূত্রেই।এখনও তাঁর মাথার ভিতর মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। শুধু সংগ্রহে রয়েছে তাঁর অনামিকা দত্তের জন্য পছন্দ করে কেনা কিছু গল্পের বই।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে ভিয়েতনামের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়েছে, সে গল্প সে তার মায়ের কাছে শুনেছে বটে, কিন্তু সে এ নিয়ে খুব বেশি আর ভাবনা ভাবতে পারে না।সারাদিনই মাঠে মাঠে ঘুরে। কৃষকদের চরম দুরাবস্থা দেখে। স্বৈরশাসক এরশাদের গল্প শুনে সাধারণ মানুষের মুখেও। আর্নেস্টো চে গুয়েভারার গল্প এখনো তাকে এ এলাকার কেউই শোনায়নি…তাঁর এ গহীন গ্রামে।
হেলাল যেন এক রাজকুমার, এমনই ভাবভঙ্গিমা তাঁর। একবার পোনরা মেলায় এসে মাইকে একটি গান শুনে পাগল হয়ে যায় হেলাল। ‘শোন গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’। এমন গান সে আর জীবনেও শুনেনি। অনামিকা দত্ত কি এই গানটি শুনেছে? গানের গায়ক একজন বৃদ্ধ লোক হলেও সুর বড়ই মধুর। রেডিওতে সে এ পোনরা মেলায় আসার আগে এ গানটি কোনোদিনও শুনেনি। তাঁর মা প্রায় নিয়মিতই ‘আকাশবাণী’ কলকাতা কেন্দ্রের গান শুনেন। কিন্তু হেলাল এ গান পোনরা মেলার আগে আর কোথাওই শুনেনি। তাঁর জ্যাঠার কাছে ভারতের শীর্ষ রেকর্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এইচএমভি-র এত গল্প শুনেছে, অথচ এ গানটি কার, এ প্রশ্নটি তাঁর একবারও করা হয় না। মনের ভুলেই।অথচ এ গান তাঁর মনের মধ্যে সদাই বেজে যায়।
হেলাল কবিতা, গল্প, দিনলিপি, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি নিয়মিত লিখে যায়। ক্লাসেও সে বাংলা গদ্যে-পদ্যে ও ব্যাকরণে খুবই ভালো। তাঁর পিতা সরকারী চাকুরে। তাঁর সেই পিতাও হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার গল্প এই ভূখন্ডে এত বেশিই শুনেছে যে, সে আর এই ভূ-খন্ডে হিন্দু ও মুসলমানের আর এক বিন্দু রক্তক্ষরণও দেখতে চায় না। বৃটিশ আর পাকিস্তানের গল্প শুনে শুনে তাঁর পিতাও এখন ক্লান্ত। কোনো নতুন গল্প শুনতে চায় সে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক জীবনকে জীবদ্দশায় অনুসরণ করতে চান হেলালের বাবাও।
গ্রামীণ পরিবেশে বসা ‘পোনরা মেলা’ যেন এলাকাবাসীর বড় বেশি সাধনার ধন। সবুজ শ্যামলে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে এ মেলার আয়োজন হয়। এই মেলার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে এত মানুষ এই পোনরা মেলায় আসে, না দেখলে তা কখনো বিশ্বাস করাই কঠিন।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর অনামিকা দত্তের বাবা অতীন্দ্রনাথ দত্তের বড় দাদা এই ‘পোনরা মেলা’র পথ দিয়েই কোনো এক রাতে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতের হাতে খুন হন। তার পরপরই ঘটলো ট্রিপল মার্ডারের আরেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। অনামিকাদের দিঘীর শানবাঁধানো ঘাটে বসে এই গল্প হেলাল সেই কবেই শুনেছে! অনামিকাদের মন্দির, পুকুর, নিজস্ব বাগান, সত্যিই বিস্ময়ের বস্তু এই হেলালের কাছে। বড় বেশি দুস্প্রাপ্য মেয়ে যেন অনামিকা দত্ত। বড় দুর্লভ নারী। তার পূর্ব পুরুষদের একজন ‘দত্ত মেমোরিয়েল ট্রাষ্ট’ এর নামে ২০ একর ১০ শতক সম্পত্তি দান করে গেছেন। রেকর্ডভুক্ত প্রায় সব সম্পত্তিতেই গড়ে উঠেছে সেই মন্দির ও দিঘি এবং খেলার মাঠ। মন্দিরের একদিকে বাবা লোকনাথের আবক্ষ মূর্তি। দিঘীর স্বচ্ছ জলে লাল পদ্মফুলগুলো যেন ১৯৭১ সালের শ্যামাপ্রসাদ দত্তের রক্তকেই এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে। আশুতোষ, গৌরাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় শ্যামাপ্রসাদ দত্তকেও নিতে চেয়েছিলেন। ভীতু ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু। ভয়ে ‘ইন্ডিয়া’ যেতেও রাজি হননি। পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে সারাদিন বাঁশঝাড়েই লুকিয়ে থাকতেন। তবু শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। বাঙালি হিন্দু শরণার্থী হয়ে ত্রিপুরায় গেলে অস্তিত্ব হয়তো এত খারাপ নাও হতে পারতো। নিজ দেশে যুদ্ধ হলে সব দেশে তো বটেই, নিজের দেশেও মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যায়! বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ দত্তের কাকারা। সেটা ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরই। কিন্তু আজকাল হেলালের মনে একটি প্রশ্ন প্রায়ই বিরাজ করে। অনামিকার পরিবার কেন তাকে হেলালের সঙ্গে মিশতে বারণ করে না? সে কি অনামিকা হেলালের বাবার বন্ধুর মেয়ে বলেই! একেবারে উল্টো কোনো কারণও তো থাকতে পারে! ১৯৮৫ সালের রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার নিয়ে কী যেন আলাপ করছিলেন হেলাল আর অনামিকার বাবা। এদিকে অনামিকা আর হেলাল অনামিকার পড়ার ঘরে বসে আলাপ করছিলো ওদের স্কুলের পাঠ নিয়েই। তবে ওদের উভয়েরই চোখগুলো বা হৃদয় ছিলো মেলার সেই গানেই যেন: ‘শোন গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’। হঠাৎই হেলালের বাবা অনামিকার বাবাকে বললেন, ‘একদিন…হয়তো এটা একশত বছর পর...বাংলাদেশের
হিন্দুরা প্রায় নিশ্চিহ্নই হয়ে যাবে।সব্বাইই চলে যাবে ইন্ডিয়ায়’। কথাটি শোনার পরপরই অনামিকা ও হেলালের আলাপও কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ‘ইংরেজদের আমলে বাংলাদেশ অঞ্চলের হিন্দুরা যেমন আরামে ছিলো, সেদিন আর কোনোদিনও আসবে না।’ এ কথা বললেন অনামিকার বাবা অখিল দত্ত। তিনি আরও বলেন, বৃটিশ আমলে কলকাতায়, বৌবাজারে, মিরাটে, লখনৌতে, ঝাঁসিতে, বেরেলীতে, দমদমে, বারাকপুরে এবং বালিগঞ্জে কতো না সুখে ছিলো বাঙ্গালি হিন্দুরা! কিন্তু আজ! শুনেছি কলকাতাতেও হিন্দুরা সুখে নেই!। আরে সেদিনও আমাদের অনিল বাজারে সামান্য একটু অপরাধে লাথি, কিল, ঘুষি কোনোটাই খাওয়া থেকে বাদ থাকেনি। তারপর তাকে জোর একটি বানোয়াট স্বীকারোক্তি পত্রেও স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। সে যদি আজ মুসলমান হতো, তাহলে তোরা এটা পারতি! বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা হলে খুব সহজেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। মানুষ এতটা নির্যাতক হয় কিভাবে!
এই কুমিল্লায় গোমতী নদীর এপারে প্রমীলা, আর ওই পারে নার্গিস। গোমতি নদীর এপার ওপার দুই পারেই নজরুলের হৃদয় প্রবাহিত। আর আমরা আছি কোথায়! কুমিল্লা শহরে গেলেই আমি মহেশাঙ্গন, বীরচন্দ্রনগর মিলনায়তন, ঝাউতলা, রানীর দীঘিরপার, ধর্মসাগরপারসহ কতো জায়গায় যাই। শহরে কিন্তু এমন বিভেদ নেই।
এদিকে হেলাল আর অনামিকার আলাপ আবারও জমে ওঠে। নিজের জ্যাঠার কাছে শোনা গল্প হেলাল অনামিকাকে বিভিন্ন ভঙ্গি করে শোনায়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম কুমিল্লায় আসেন মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কবির বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে। এই আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিসের সাথে কবির বিয়ে হয়। কিন্তু এ বিয়ে ছিলো চাপাচাপির বিয়ে। নজরুল এ বিয়ে মানেননি। তাই রাতের বেলা গোমতি নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে কবি নজরুল গিয়ে উঠেন কুমিল্লা শহরের আশালতা সেনগুপ্তার বাসায়। আশালতাকে সবাই প্রমীলা নামেই ডাকতো। তার সঙ্গেই নজরুলের প্রেম এবং বিয়ে হয়। বলতে বলতে হেলাল তার জ্যাঠার কাছে শোনা গল্পটিকে ইচ্ছেমতো বানায়। অনামিকা জানতে চায়, নার্গিসের কী হলো! হেলালের সোজা উত্তর, কবি নজরুল তাঁকে ‘তালাক’ দিয়ে দিলো। আরে এই বিয়ে তো সে নিজের ইচ্ছায় করেনি। সুতরাং ‘তালাক’ ছাড়া পথ ছিলো না। তারপর হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টে হেলাল অনামিকাকে বললো, তুমি কি আমার একটি কবিতা শুনবে! আমি কিন্তু গানও লিখি। তোমাদের দিঘীর ঘাটের পশ্চিম কোণে বসে গতকালও একটি গান লিখেছি। অনামিকা বললো, এই গান-কবিতা আমার একদমই ভালো লাগে না। হেলাল আমাকে ভূতের গল্প শোনাও। হেলাল বললো, কবিতা পছন্দ করো না মানে! আমি তো সব কবিতা তোমাকে নিয়েই লিখি। অনামিকা হেসে বললো, তাই নাকি! তবু আজ ভূতের গল্প শোনাও। হেলাল বললো, ময়মনামতি পাহাড়ের রূপবান ভূতের গল্প শুনবে! অনামিকা বললো, না হেলাল, তুমি আমাকে পোনরা মেলার বটগাছের ভূতের গল্প শোনাও। ওখানে নাকি মহারাজ ভূত বৃটিশ আমল থেকেই থাকে! সে নাকি আবার তিতাস এলাকার বিলাঞ্চলেও মাছ খেতে যায়। পোনরা এলাকায় তো আবার মাছের বড়ই অভাব। হেলাল বলে, আমি জানি অন্য এক ভূতের কথা। পোনরা মেলার বটগাছের কাছেই ছিলো এক প্রাচীন মন্দির। সেটা ৮০০ কিংবা ৯০০ বছর আগের কথা। তখন এক বৌদ্ধ রাজা অন্য এক হিন্দু রাণীর প্রেমে পড়েন। হিন্দু রাণীও সে বিষয়টা বুঝতে পেরে একদিন রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে চলে আসেন বৌদ্ধ রাজার কাছে। কিন্তু রানীর স্বামী সেই হিন্দু রাজা ঘটনা টের পেয়ে প্রেমিক প্রেমিকা দুইজনকেই কতল করে। তারও অনেক পরে সেই খুনি হিন্দু রাজাও একটি শিকার নিয়ে দুর্ঘটনায় বাঘের পেটে যায়। তারপর এলাকার লোক সেই অমর প্রেমকে স্মরণীয় করতে এখানে গড়ে সেই প্রাচীন মন্দির, যা এখন আর নেই। আছে শুধু বটগাছ, যেখানে এখন পোনরা মেলা বসে। অনামিকা হেলালকে বলে, এসব কি সত্যি? নাকি তোমার নিজেরই বানানো গল্প! হেলাল বলে, আমার দূর সম্পর্কের এক নানা আছেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তার কাছেই এ গল্প আমি প্রথম শুনেছি। জানি না এসব সত্যি নাকি মিথ্যে। সেই নানা আবার ইন্টারমিডিয়েট পাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এক হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়ে তাঁর লাইফটা-ই বরবাদ হয়ে যায়। অনামিকা প্রশ্ন করে হেলালকে, লাইফটা-ই বরবাদ হয়ে যায় কেন? হেলাল বলে, বরবাদ হবে না, তিনি তো মেয়েটাকে না পেয়ে বিষই খেয়ে ফেললেন। তারপর এমন অসুস্থ হলেন, সারা জীবনেও আর কোনো পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। রাজনীতি করেছেন। কারাগারে গিয়েছেন। কিন্তু আর কোনো পরীক্ষায়ই পাশ করতে পারেননি তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পার্টি করেন। আর সেই হিন্দু মেয়ের কথা মনে পড়লে কিশোর কুমারের রোমান্টিক গান শুনেন। হেলাল আর অনামিকার এই মাখামাখি ভীষণ অপছন্দ করছেন অনামিকার কাকা কুঞ্জলাল দত্ত। তিনি এ নিয়ে বৌদির কাছে দুইবার রিপোর্ট করে এসছেন। বলেছেন, বৌদি ছেলেটা মুসলমান। তোমার মেয়েও বড় হয়েছে। কথাটি খেয়াল রেখো। নালিশ শুনে অনামিকাকে ডাক দেয় তার মা। অনু, আমার কাছে আয়। কাজ আছে।‘আসছি মা’ বলে উত্তর দিয়ে অনু হেলালকে বলে, তোমার সব গল্পে কেন তুমি হিন্দু মেয়েদের নিয়ে আসো! কারণটা কী! হেলাল বলে, সীতা দেবীর এক ভাগিনা ছিলো। সে একদিন আমাকে বললো, ‘পেয়ার’ অর্থ কি তুমি জানো? আমি বললাম, না। সে গান গাইতে শুরু করলো, ‘রূপ তেরা মস্তানা...’। একদিন হঠাৎ আমি সেই গান শুনলাম রেডিওতে। মধ্যরাতে। মা শুনছেন। তারপর আরেকটি গান, ‘অগর তুম না হোতে...’। আর এসব গান শুনে আমি তো গেলাম পাগল হয়ে।একদিন রাতের বেলা পুরনো জমিদার বাড়িতে একা একা চলে গেলাম দুর্গাপূজা দেখতে। গিয়ে ওখানে দেখি ২০০ বছরের পুরনো একটি বটগাছ। বটগাছের মগডালে বসে জমিদার প্রমোদলাল মজুমদারের ভূত আমাকে বলছে, তোকে এই মধ্যরাতে আমি তুলে এনেছি। তোর মরণ সামনেই। বাঁচার মাত্র একটিই উপায়। সে হলো, তোর বয়সী কোনো সুন্দরী হিন্দু মেয়েকে নিয়ে তুই এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যা। সকলেই জানে আমি একজন ভূতভীরু যুবক। গেলাম এক সাধুর কাছে। পরামর্শের জন্য। সাধু আবার স্বর্গীয় রণবীর চৌধুরীর পুত্র। তিনি বললেন, কথা তো ঠিক। আমি তো আরও ভয় পেয়ে গেলাম। জগন্নাথ মন্দিরের ধর্মীয় উৎসবে গেলাম। মুখরিত মন্দির প্রাঙ্গনের পেছনের বটগাছ থেকে জমিদার প্রমোদলাল মজুমদারের ভূত আবারো আমার সামনে উপস্থিত। আমাকে বলছে, এ কী, তুই যে কথা শুনছিস না! অমঙ্গল হয়ে যাবে কিন্তু! তারপর থেকেই তো মহাকল্যাণ কামনায় তোমাদের দিঘীর কোনায় বসি, কীর্তন উৎসবে ও মহাপ্রসাদ বিতরনে অংশ নেই। কিছুদিন আগে জমিদার প্রমোদলাল মজুমদারের ভূত তোমাদের বাড়ির সমাধিস্থল পরিদর্শন করে। তারপর থেকেই সমাধিস্থলের পাশের চিতাটাও আমার হৃৎপিন্ডে ঢুকে গেছে।এবারে দেখা গেল হেলালের চোখে জল। অনামিকার মা খুব জোর গলায় ডাক দেয়, অনু...। অনামিকা হেলালকে বলে, আমি তোমার সঙ্গে ‘পোনরা মেলা’য় দেখা করবো।পৌষ মাসের শেষ দিন। আজকে পৌষের ১০ তারিখ। তারপর অনামিকা চলে যায় তার মায়ের কাছে। হেলালও তার বাবার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। তারপর আরও দিন যায়। অপেক্ষায় থাকে হেলাল অনামিকা এবং সেই পোনরা মেলার কিংবা সেই পৌষ মাসের শেষ দিনের। কিন্তু অন্য এক ঘটনায় এ জীবনে অনামিকার দেখা আর সে কখনোই পায় না। সেই থেকে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্থান ‘পোনরা মেলা’য়ও সে আর কখনো যায় না। পৌষ মাসের শেষ দিনের মধ্যরাতে হেলাল নিশ্চিতভাবে খবর পায়, পূর্বে থেকে অনেককে অনেককিছু না বলেই অনামিকার পরিবার হঠাৎ বাংলাদেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে যায়। হেলালের বাবা তখন চাকুরিতে। খুলনায়। আর হেলাল সারা দিন অনামিকা দত্তের বাড়িটার দিকের ছায়াদার পথে পথে হাঁটে এবং মনে মনে গুন গুন করে গায় ‘পোনরা মেলা’য় শোনা সেই গানটি: ‘শোন গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’। যে হেলাল একদিন তাঁর পরবর্তী জীবনে আর্জেন্টিনা, কিউবা বা ল্যাতিন আমেরিকার ভয়ানক পাগল হয়ে উঠবে এবং এই কয়েকবছর পরেই সে হয়ে উঠবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থানরত বিপ্লবী এক যুবক। আর মার্কিন মদদপুষ্ট সকল মানুষকেই করবে ভয়ানক রকম ঘৃণা।
ছবি: জসীম উদ্দিন অসীম।
প্রথম প্রকাশ: 20 ডিসেম্বর, 2017
সাপ্তাহিক সমতটের কাগজ, কুমিল্লা।

৩৯| ১১ ই জুন, ২০১৮ রাত ১০:৫৪

জসীম অসীম বলেছেন: একটা ‘কুমিল্লার কাগজ’ দ্যান
জসীম উদ্দিন অসীম:
কুমিল্লার পত্রিকার একটি ষ্টলে দাঁড়িয়ে আছি একদিন। এমন সময় অচেনা একজন লোক এসে দোকানদারকে বললেন, আজকের একটা ‘কুমিল্লার কাগজ’ দ্যান তো।’ তারপর ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকা কিনে চলে গেলেন সেই লোক। কিছুক্ষণ পর আরও একজন কিনে নিলেন সেই একই পত্রিকা। কুমিল্লায় আরও দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ লোক কেন ‘কুমিল্লার কাগজ’ খোঁজ করছে! এবার আমি দোকানদার তপন পালকে বললাম, দাদা কী আছে আজকের ‘কুমিল্লার কাগজ’-এ? তপনদা’ আমার বাবার পরম বন্ধু অশ্বিনী পালের নাতিন জামাই। তাদের দোকান কুমিল্লা শহরের লাকসাম রোডের ‘খাদি জ্যোৎস্না স্টোর’। তিনি সেদিনের একটি ‘কুমিল্লার কাগজ’ এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি দেখলাম অন্যান্য স্থানীয় দৈনিকগুলোর তুলনায় ছাপা ভালো, কাগজ ভালো, নিউজের মানও ভালো। কিন্তু তুলনায় অনেক বেশি বিজ্ঞাপনে ঠাসা একটি রঙিন ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘কুমিল্লার কাগজ’। তপনদা’কে বললাম, দাদা এতো বিজ্ঞাপন থাকার পরও কেন মানুষ অধিক পরিমাণে ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকার খোঁজ করে? তপনদা’র সহজ উত্তর। এটা কুমিল্লার ‘মাতৃভান্ডার’ এর রসমালাই।
কিন্তু ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকাটি কেন এতো জনপ্রিয় হলো! কেন মানুষের মুখে মুখে এর নাম? এটা কি শুধুই ঝকঝকে ছাপার কারণে? কেন তারা তুলনামূলক বেশি বিজ্ঞাপন পায় কিংবা বিজ্ঞাপনের রেটও বেশি রাখে? এর নিশ্চয়ই আরও অনেক কারণ রয়েছে, যা পাঠককে আকৃষ্ট করছে। কারণ পাঠক কারো দাস নন। তারা নিজের টাকায় নিজের চাহিদা মতো নিজের পছন্দের পত্রিকাটিই কিনেন। কুমিল্লার মেয়ে মীম কিংবা ইশানা যখন লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নামেন, তখন এবং অন্যান্য লোকাল ইস্যুতেও পাঠক কুমিল্লার সবগুলো দৈনিক হাতিয়ে দেখেন সর্বোচ্চ মানের কাভারেজটি প্রথমেই এসেছে কোন পত্রিকায়। আর সে ক্ষেত্রে ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকাকে বরাবরই এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। একটি পত্রিকা কিছু সময়ের জন্য সর্বোচ্চ বাজার দখল করে রাখে কিংবা রাখতে পারে। কিন্তু একটি পত্রিকা সব সময়ের জন্য বাজার হয়তো সমান্তরালে ধরে নাও রাখতে পারে। কিন্তু কী সেই ‘কুমিল্লার কাগজ’ এর মূলমন্ত্র, যার কারণে জন্মের পর থেকে বিগত এক যুগ ধরে এই পত্রিকাটিই কুমিল্লার পাঠক চাহিদার এক নম্বর তালিকা দখল করে রয়েছে?
2004 সালের ৮ ডিসেম্বর তারিখে কুমিল্লা মুক্তদিবসে ‘কুমিল্লার কাগজ’ আত্মপ্রকাশ করে। এই আত্মপ্রকাশের দিন নির্ধারণের মধ্য দিয়েও পত্রিকাটি কুমিল্লার ইতিহাসে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। শুরুতে ‘কুমিল্লার কাগজ’ এর সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম। পত্রিকাটির ঘোষণাপত্র প্রাপ্তির পর অনেক পরীক্ষানির্ভর সংখ্যা মুদ্রিত হলেও পাঠককে আনুষ্ঠানিকভাবে ৫০ পৃষ্ঠার রঙিন ক্রোড়পত্রসহ উদ্বোধনী সংখ্যাটি দেওয়া হয় ৮ ডিসেম্বর তারিখেই। ওই হিসেবে কুমিল্লা মুক্তদিবসের মতো কুমিল্লার কাগজেরও জন্মদিন সেই ৮ ডিসেম্বর তারিখেই। এ বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়েরই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল। কুমিল্লার সাংবাদিকদের মধ্যে বরাবরই মতবিরোধ ছিলো। কিন্তু এই বিরোধিতা ‘কুমিল্লার কাগজ’ এর জনপ্রিয়তা লাভের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারেনি। জনগণের সমর্থন পেলে রাজনীতি তুষ্ট হয়, আর পাঠকের সাড়া পেলে পত্রিকা পুষ্ট হয়। ‘কুমিল্লার কাগজ’ সেই পাঠকের সাড়া আদায় করে নিয়ে পুষ্ট হতে পেরেছে। পাঠক ‘হীরা’কে ‘কাচ’ বলে না। ‘কাচ’কেও ‘হীরা’ বলে তুলে নেয় না। পাঠক ভীষণই চালাক। তাদের লাভের ক্ষেত্রে তারাই বিন্দুমাত্রও ছাড় দেয় না। আর নিন্দুকেরা হীরাকেও ঈর্ষায় কাচ বলে কিংবা স্বার্থের লোভে কাচকেও হিটলারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের মতো হীরা বলে চালিয়ে দিতে অপচেষ্টা চালায়।
‘কুমিল্লার কাগজ’ এর একটি বড় কমিটমেন্ট ছিল নিয়মিত প্রকাশিত হওয়া। হরতালে-অবরোধে- বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে-অর্থনৈতিক মন্দায় বরাবরই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। গরু-মহিষের শিং রয়েছে, কিন্তু মানুষের নেই। অথচ পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে বেশি গুতোগুতি করে। আর সে মানুষ যদি হয় সাংবাদিকতা পেশার মতো কূটনৈতিক পেশার লোক, তাহলে তো কথাই নেই। এ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়ও তার ব্যতিক্রম নন। অথচ তিনি মূল কাজটি করার ক্ষেত্রে কখনোই ছাড় দেননি। প্রকৃত ব্যবসায়ী তো তিনিই, যিনি মন্দার বাজারেও তার দোকান খোলা রাখেন।
সাংবাদিক আবুল কাশেম হৃদয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো আজ থেকে দুই যুগ আগে। ১৯৯২ সালে। তারপর পেশাদারী সাহস ও দক্ষতার সাথে তার পথ চলা ক্রমাগতই চলতে থাকে। ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকা বাজারে আসার পূর্বেই আবুল কাশেম হৃদয় সাহসী সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। আর ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকা বাজারে আসার পূর্বে সেই পত্রিকার একটি প্রকাশিত পোষ্টারেও তার জানান দেয়া হয়েছিলো। ‘সময়ের সাহসী সাংবাদিকের সম্পাদনায় বের হচ্ছে কুমিল্লার কাগজ।’ কিন্তু সাহসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হয়। না হলে সমূহ সর্বনাশ। ইরাক যুদ্ধের সময় যখন আল জাজিরা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের ঘুমন্ত অবস্থায় গানশিপ চালিয়ে মার্কিন সেনারা হত্যা করে, তখন সহজেই বুঝতে পারা যায় সাংবাদিকের লাগামহীন সাহস কতোটা আত্মঘাতী। সাংবাদিকগণ রাষ্ট্রীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে নন। আর সেই বৈশ্বিক বা রাষ্ট্রীয় রাজনীতি ভীষণই বৈচিত্র্যময়। যে ফরাসিরা একদিন ইরাককে অস্ত্র যুগিয়েছিল, তারাই আবার যৌথবাহিনীতে যোগ দিয়ে ইরাকের দিকে অস্ত্র তাক করেছিলো। আজ যে ফ্রান্সসহ সেই সময়কার যৌথবাহিনীর বিভিন্ন দেশে জঙ্গি হামলা চলছে, তাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের একসময়কার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( রাজস্ব ) মোঃ তাজুল ইসলাম যখন কুমিল্লা সদর উপজেলার ইউএনও ছিলেন, সেই ২০০৩-২০০৪ সালের দিকে, তখন আমি একবার আবুল কাশেম হৃদয়ের সঙ্গে ইউএনও-র কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তাজুল ইসলাম সেদিন হৃদয়কে বলেছিলেন যেন তিনি পেশাগত সাহস দেখাতে গিয়ে আবার আত্মঘাতী না হয়ে পড়েন। এখন আমার কাছেও দুঃসাহসের এই পন্থাকে আর সঠিক মনে হয় না। কারণ অস্তিত্ব না বাঁচলে সাহস দিয়ে কী হবে! ব্যাংকের সঞ্চিত টাকা যেমন মূল্যবান, তার চেয়ে কম মূল্যবান কোনোভাবেই নয় সাংবাদিকের প্রাণ। কিন্তু কুমিল্লার এত এত ব্যাংকের এত এত শাখায় এত এত গানম্যান থাকলেও আমার জানামতে কুমিল্লার কোনো সংবাদপত্র অফিসেই একজনও গানম্যান নেই। এখানকার কোনো একটি পত্রিকাও আজ অবধি তাদের জন্য কিংবা তাদের অফিসের জন্য কোনো গানম্যান নিয়োগের বিজ্ঞাপন ছেপেছে বলেও আমার জানা নেই। আমার এটাও জানা নেই কুমিল্লার কোনো সম্পাদকের লাইসেন্সকৃত কোনো শর্ট গান কিংবা পিস্তল রয়েছে কী না। কিন্তু থাকা উচিত। সাংবাদিক আবুল কাশেম হৃদয় একজন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক। যে রাজাকাররা আমাদের মায়েদের গনিমতের মাল বলে ফতোয়া দিয়েছিল, বোনদের তুলে দিয়েছিল পাক-জল্লাদদের হাতে, মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলো কাফের এবং তারা নিজেরা নিয়েছিলো ‘গাজী’র খেতাব, তারা এবং তাদের উত্তরসূরিরা আর তাদের সংগঠনগুলো এই দেশে ভয়ংকর রূপে এখনো বহাল রয়েছে। ১৯৭১ সালের সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতো তাই কুমিল্লার সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গ্রামের ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস লিখন, মুদ্রণ, প্রকাশ ও প্রচারের কাজটিও কখনোই নির্বিঘœ নয়। প্রকৃত লেখক- সাংবাদিক-গবেষক ও শিল্পীদের জন্য পৃথিবীর সব দেশই সব যুগেই বিপজ্জনক ছিলো। নিষিদ্ধ রাজদ্রোহী সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মর্মান্তিক ইতিহাস আমাদের কম বেশি সবারই পড়া রয়েছে। আজকে যদি সংবাদ ছাপা হয় ‘অমুক’ কলেজের লাল-সবুজ পতাকা আলমারিতে বন্দি, আগামীকালই তমুক ভাইয়ের হুমকি পাওয়া সাংবাদিকের জীবনে ফ্রি। কারণ ক্ষমতাবানদের সঙ্গে লড়াই করা সহজ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা চড়বে বলে ভারতীয়দের ট্রেনে চড়া বারণ ছিলো। কথা না শুনলে কোনো ভারতীয় তাকে ঘোড়সওয়ার বৃটিশ পুলিশ ইচ্ছেমতো ঠেঙ্গাতো। র্যাবের হাতে আজ পর্যন্ত যারা মারা পড়েছে, তারা একজনও গডফাদার নয়। গডফাদারদের সৃষ্টি সন্ত্রাসী মাত্র। দেশের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কিংবা গডফাদারগণ এখনো র্যাবের বন্দুকের নলের আওতায় আসেনি। সুতরাং সেই গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচনে প্রাণ উৎসর্গ করবে স্থানীয় কোনো সংবাদপত্র, মনে হয় এইভাবে ভাবার কোনো এই সময়ে বাস্তব কারণ নেই। সাংবাদিকগণ- সম্পাদকগণ এতোটা স্বাধীন নন। নন বিচারকগণও। বিচার বিভাগ এতটা স্বাধীন হলে বিচারগণ যখন তখন ওয়ারেন্ট দিয়ে অনেক এম. পি মন্ত্রীকে নিয়মিত কোর্টে নিয়ে যেতে পারতেন। সুতরাং ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকার যেখানে সীমাবদ্ধতার শুরু, সেটার দায় সম্পাদকের একার নয়, রাষ্ট্রের। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের জাতীয় পতাকার রূপকার শিবনারায়ণ দাশ কুমিল্লায় দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনায় এসেছিলেন। তার প্রতি সর্ম্পূণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি উপলব্ধি করেছেন কুমিল্লায় এখন একটি পত্রিকাকে নিয়মিত মুদ্রণ ও প্রকাশ কতোটা কষ্ট সাধ্য কিংবা অসাধ্য একটি ঘটনা। আর সোসাল- পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট মেনটেইন করা তো আরও পরের কথা। ব্যবসার দুনিয়ার কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। আবুল কাশেম হৃদয় এবং তার ‘কুমিল্লার কাগজ’ কেও কেউ ছাড় দেয়নি। সম্পাদক নিজেই এ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। আজকে পারলে আজকে আমিই তার স্থান কেড়ে নিতে বদ্ধ পরিকর এত ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ার পরও। বাজারের দুনিয়া এতোই হিংস্র। লিবিয়া পতনের শেষ দিনগুলোতে, এমনকি গাদ্দাফির মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও চীনের একটি কোম্পানী গাদ্দাফির কাছে অস্ত্র বিক্রির আশায় বসেছিল। গাদ্দাফিকে উদ্ধারের কথা কেউ ভাবেননি। অন্যেরা বসেছিলেন তার বড় বড় তেলখনি গুলোর দখল নিতে। সুতরাং আজ যে অজ্ঞাত কিংবা অপরিচিত একজন পাঠক দোকানে এসে প্রতিদিনকার ‘কুমিল্লার কাগজ’ কিনেন এবং বলেন, ‘একটা কুমিল্লার কাগজ দেন’ তার একমাত্র কৃতিত্ব এই পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক আবুল কাশেম হৃদয়েরই।

৪০| ১১ ই জুন, ২০১৮ রাত ১১:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন:
সাদিয়া অসীম পলি:
একজন সাংবাদিকের কন্যা এবং একজন সাংবাদিকের স্ত্রী।
পিতা এবং স্বামী: উভয়েরই প্রতিকূল জীবন দেখেছে সে।




৪১| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ১২:০৮

জসীম অসীম বলেছেন: আমাদের পোষা ফুল।
2016 খ্রিস্টাব্দ থেকে
আমার ভাড়া বাসার বারান্দায়…বাস করে যায়।

৪২| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ১২:৩৯

জসীম অসীম বলেছেন: আমাদের পোষা ফুল।
2016 খ্রিস্টাব্দ থেকে
ভাড়া বাসার বারান্দায়…বাস করে যায়।

৪৩| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ১:০১

জসীম অসীম বলেছেন: এই আমাকে
আজ অবধি
নিয়মিত করা হচ্ছে শোষণ
ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছি আমি
টেরও পাচ্ছি ভীষণ।

৪৪| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ১:১২

জসীম অসীম বলেছেন: অপূর্বের প্রিয় খেলনা: লাকি।
আমাদের বাসায় আসে 2014 সালে।







৪৫| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ১:৩৭

জসীম অসীম বলেছেন: মা ও ছেলে: 2017

৪৬| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ১:৫৫

জসীম অসীম বলেছেন: আমাদের অপূর্ব,
2010 সালে,
আমাদের গ্রামের বাড়িতে।

৪৭| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ২:০৭

জসীম অসীম বলেছেন: হায়!
কেন যে আমার আগের স্ত্রী ফারজানা কবির ঈশিতাও
মাঝে মাঝে গরম ইস্ত্রি হয়ে যেত।
বর্তমান স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলিও
মাঝে মধ্যে উত্তপ্ত ইস্ত্রি হয়ে যায়।



৪৮| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ২:২৯

জসীম অসীম বলেছেন: কবিতা:
আজ রাতে আবার আসবেন তিনি
অক্টোবর: 1992
ঢাকা।

আজ রাতে আবার আসবেন তিনি।
কথা বলবেন আমার সাথে।
এমন কঠোর নারী এমন কোমল হতে পারেন,
ভাবতেও পারি না আমি।
আজ রাতে আবার আসবেন তিনি।
কথা বলবেন আমার সাথে।
তখন ভয়ানক এক ভয়ের মুখোমুখি হবো আমি।
তারপরও তাঁর আসার প্রতীক্ষায় রয়েছি।
তিনি এলে কি মৃতেরা সব প্রাণ ফিরে পাবে?

৪৯| ২১ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:০৮

জসীম অসীম বলেছেন: ইউরেনিয়াম গিলে কি আর
বেঁচে থাকা যায়?

জসীম উদ্দিন অসীম:

আগষ্ট: ২০০৮
সাহেবনগর, কুমিল্লা সেনানিবাস,
কুমিল্লা।
===============
আকাশ কেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে
আমার মাথায় পড়ে?
কী অপরাধ আমার!
বজ্রপাত কেন বারবার
আমার ঘাড়েই পড়ে!
আমি তো নই সালভাদর আলেন্দে
অথবা ওই চিলির কবি
কমিউনিস্ট পাবলো নেরুদা।
তবু কেন আমারই মাথায়
আকাশ ভেঙ্গে পড়ে?
আমার নদীর টুটি চেপে ধরে
তিব্বতে ওই চীন।
কখনো বা ভারত।
তাই
আকাশ আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়ে।
আর তিউনিসিয়ায়, আফগানিস্তানে
এবং বাংলাদেশে বিষবৃক্ষ বাড়ে।
তাই
ধরা পড়ে আমারই হৃদরোগ
কী অপরাধ আমার!
আমি তো নই চিলির কবি
কমিউনিস্ট পাবলো নেরুদা।
তবু কেন আমারই মাথায়
আকাশ ভেঙ্গে পড়ে?
আমি কি তবে চলে যাবো
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে?
বৌদ্ধবিহার ভেঙ্গে কেন
আমার বুকেই পড়ে?
হায়!
ইউরেনিয়াম গিলে কি আর
বেঁচে থাকা যায়?
আকাশ আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়ে
সাক্ষী ছায়াপথ
সে কারণেই আমার জীবন
ভীষণই নির্ঘুম।
ইউরেনিয়াম গিলে কি কেউ
ঘুমিয়ে থাকতে পারে?

==================

কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।

৫০| ২২ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:২৭

জসীম অসীম বলেছেন: I will be sky.
& I will also be the river,
innocent water of the river.
because I love the sea,
blue deep sea,
and the sky touches
waves of the sea
and that's how I want to be
the sky again.
This love like my life.

৫১| ২২ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৯

জসীম অসীম বলেছেন: জসীম উদ্দিন অসীম কুমিল্লার গোমতি অঞ্চলের অনেক ছবিই তুলেছেন
মোঃ নাসিম আহম্মদ
প্রভাষক: বাংলা বিভাগ, আনন্দপুর ডিগ্রি কলেজ, কোতয়ালী, কুমিল্লা।
রচনা: মার্চ-২০০৪
কুমিল্লা সরকারি গণ গ্রন্থাগারে (পাবলিক লাইব্রেরী) প্রথম জসীম উদ্দিন অসীমের সাথে আমার পরিচয় হয়। সময়টা ১৯৯৩ সালের শেষের দিক। তিনি ঢাকায় তখন বাংলায় অর্নাস পড়তেন। আর আমি তখন বাংলা'তেই অনার্স পড়তাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ড. জয়নাল আবেদীন স্যারের উপদেশ মেনে আমি কলেজের ক্লাশ শেষে প্রতিদিনই পাঠাগারে (কুমিল্লা সরকারি গণ গ্রন্থাগারে=পাবলিক লাইব্রেরী) বসে বিভিন্ন রেফারেন্স বইয়ের সহযোগিতায় নোট তৈরি করতাম। তেমনি একদিন শুভলগ্নে বই পড়ার ফাঁকেই জসীম উদ্দিন অসীম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। তিনি তখন ঢাকাতেই থাকতেন। আর তার মা বাবা ভাই বোন থাকতেন কুমিল্লা শহরের গয়ামবাগিচা সড়কের একটি বাসায়। কুমিল্লা আসলেই অসীম ভাই কুমিল্লা সরকারি গণ গ্রন্থাগারের পাঠাগারে আসতেন। সে সময়ে সাহিত্য, নাটক, ছবি, রাজনীতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ে দু’জনের মধ্যে বেশ আলাপ আলোচনা হতো। তার তখন সকল বিষয়েই পাঠের ভীষণ নেশা ছিলো। তাঁদের গয়ামবাগিচা সড়কের বাসায়ও আমি বহুবার গিয়েছি। সে সময় তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন ও কবিতার পুস্তিকাও ছেপেছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ছবি অাঁকা বা ছবি তোলার আগ্রহই ভীষণতর ছিলো। বিশেষ করে ক্যামেরায় তোলা ছবি বা ফটোগ্রাফির নেশা ছিলো তার মারাত্মক। তিনি গোমতি নদী ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলের অনেক সৌন্দর্যময় ছবিই তখন তুলেছেন। সেগুলো তিনি পরে কুমিল্লার 'সাপ্তাহিক আমোদ’সহ আরও পত্রিকায় ছেপেছেন। তিনি যেমন সুন্দরভাবে ছবি তুলতেন, তেমনি সুন্দরভাবে ছবিও আকঁতেন। তার ঘরের দেয়ালে এখনও তার অংকিত ছবি শোভা পায়।
১৯৯৬ সালে জসীম উদ্দিন অসীম ভাই ‘আমোদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। সে সময়ও ছবি তোলার জন্য তিনি দূরদূরান্তে ছুটে যেতেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি কুমিল্লার লাকসাম থেকে প্রকাশিত ‘লাকসাম বার্তা'য় কাজ করতেন। তখন আমি টমছমব্রীজ উপকূল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন লতিফ স্যারের বাসায় থাকতাম। সে সময়েও তিনি প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতেন। তিনি ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক আবদুল ওহাব স্যারের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’তেও কাজ করেছেন। ২০০০ সালে এসে 'সহকারি সম্পাদক' হিসেবে যোগ দেন প্রবীণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহর “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকায়। পরে ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে কুমিল্লার ‘দৈনিক শিরোনাম’ পত্রিকায়ও কর্মরত ছিলেন। সে সময় আমি প্রায়ই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতাম। সেখানে প্রায়ই সাহিত্য, রাজনীতিসহ সকল বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন কবি ফখরুল হুদা হেলাল, পত্রিকার সম্পাদক নীতিশ সাহা, চীফ রিপোর্টার পারভেজ ভাই ও গল্পকার ও গবেষক মামুন সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে।
জসীম উদ্দিন অসীম ভাই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে বক্তা, কবি, গল্পকার, চিত্রকর, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও ফটোগ্রাফার। তাঁর মত সমাজ সচেতন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব আধুনিক তরুণ সমাজে বিরল, ছবি নিয়ে তিনি গত কয়েক বছর ধরেই অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। তাঁর তোলা ও অংকিত ছবিগুলোতেও এসবের প্রমাণ মিলে। আমার বিশ্বাস: তিনি একদিন তার সৃষ্টির জগতে সফল হবেনই।

৫২| ২২ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০২

জসীম অসীম বলেছেন: ১৯৯৩ সালে আমি। আমার এ ছবিটি ঢাকার শাহবাগ এলাকা থেকে তুলে দিয়েছিলো বন্ধু আবিদ হোসেন। আমরা দু'জনেই তখন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। একদিন না লিখলেই তখন আমাদের রাতের ঘুম হারাম হতো। আবিদ লিখতো গ্রাম-বাংলার বাস্তব জীবনের অনুভূতিপ্রবণ যত গল্প এবং নিজের তৈরি গদ্যে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ। আর আমি বিশেষত রবীন্দ্র সাহিত্যের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। রবীন্দ্রনাথ: একজন বাঙালি: তিনি আবার একই সঙ্গে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক: তার পাঠে পাঠেই আমার অধিকাংশ বেলা বয়ে গেলো। তবে আমাকে পাগল করে দিলেন মূলত সংগীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ। বিভিন্ন পাঠাগারে রবীন্দ্র রচনাবলী তখন আমার নিয়মিত পাঠের বিষয়। তার 'মানসী', 'সোনার তরী', ' চিত্রা', 'ক্ষণিকা' ইত্যাদি আমার পাঠ্য থাকলেও তার সংগীত আমাকে দিনভর পথে পথে হাঁটিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রেম আমাকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিলো। কৈশোরেই পড়েছিলাম তার আধ্যাত্মিক চিন্তার কাব্যগ্রন্থ 'নৈবেদ্য', 'খেয়া', গীতাঞ্জলি ইত্যাদি। কিন্তু আমার যৌবনে রবীন্দ্রনাথের সোনার ফসল আমি হাতে পেলাম। 'বলাকা' পড়ে মাথা ঘুরে গেলো। 'পলাতকা'য় আবিষ্কার করলাম নারীর অধিকার ফিরে চাওয়ার দাবীতে সোচ্চার রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু তার কাব্যনাট্য 'বিসর্জন' পড়ে আমি তো অবাক। এটি আবার আমাদের পাঠ্য ছিলো। আরও আশ্চর্যের বিষয়: ১৮৯০ সালে 'বিসর্জন' মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। আর তার 'নৃত্যনাট্য' 'চিত্রাঙ্গদা'র কথা বলে তো শেষই হবে না। কিন্তু তার সকল সৃষ্টি ছাপিয়ে গেল তারই সৃষ্টি সংগীত। ওই সংগীত রাজ্য আজও অনাবিষ্কৃতই।এভাবে 'রবীন্দ্র-আবিষ্কার' আজ অবধিও শেষ হয়নি আমার।

৫৩| ২৪ শে জুন, ২০১৮ রাত ৩:৫৯

জসীম অসীম বলেছেন: যারা মগজ দখলের পাঁয়তারা করে
জসীম উদ্দিন অসীম
মার্চ ২০০৬, কুমিল্লা
=================
আমার যেদিন কুলখানি হবে
সেদিন অনেক গান গাইবেন
মান্না দে অথবা দেবব্রত বিশ্বাস
মুক্তধারী প্রকাশনীর বিজলীপ্রভা
সাহা এবং বিশ্বজিৎ সাহাকে আমি
৭৪ ফরাশগঞ্জের বাড়িতে
সেই খবর জানিয়ে এসেছিলাম
১৯৮৯ সালেই।

আমার কোনো জমি নেই যে
বন্ধক রাখতে পারি
সম্পদ সে তো আকাশ আর
ওই আকাশের তারা
তাই গর্ভবতী পুষ্টিবতী গোমতিবতী
পান্ডুলিপি আমার
ঠিক পশুখাদ্যের সঙ্গেই মিশিয়ে দেই

হায়! যারা এ দেশেও
মগজ দখলের পাঁয়তারা করে
তারাই শেষে ইবনে সিনা অথবা
আরও আরও উন্নত কোনো
হাসপাতালে যায়
আমি তখন পরিভ্রমণ করি
মহাবিশ্বের বাইরের কোনো গ্রহে
মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কিংবা
স্টিফেন হকিং সাক্ষী থাকে তার

আমার যেদিন কুলখানি হবে
সেদিনও আমার আত্মা সমুদ্র মার্চ করবে
আটলান্টিক অথবা প্রশান্ত মহাসাগর মার্চ
ভূ-মধ্য অথবা অন্য রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো সাগরে
ব্রিটেন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের রণতরীর বিরুদ্ধে
কিংবা ইসরায়েলের বর্বর মহড়ার বিরুদ্ধেও।

হায়! যারা এ বিশ্বে মানুষের
মগজ দখলের পাঁয়তারা করে
গর্ভবতী পুষ্টিবতী সকল পান্ডুলিপি
প্রস্ফুটিত আজকে তাঁদের ঘরে।

যেদিন আমি ত্যাগ করবো শেষ নিঃশ্বাস
সেদিন চোখের জল ফেলবেন
কাজী নজরুল, মান্না দে
অথবা কোনো দেবব্রত বিশ্বাস।
===================
অলংকরণ: জসীম উদ্দিন অসীম।
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।











৫৪| ২৪ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৪:৩৩

জসীম অসীম বলেছেন:
আমার মায়ের মৃত্যু অভিযাত্রা
জসীম উদ্দিন অসীম
ডিসেম্বর-১৯৯৮,
পুরাতন চৌধুরীপাড়া, কুমিল্লা।
=======================
এবারের পৌষের কনকনে শীত
আমাকে মোটেও ছুঁতে পারবে না
পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়লে এবার
আমি সেই সংবাদও লিখবো না
কারণ, আমার মায়ের মৃত্যু অভিযাত্রা
এখন থেকে আমি যদি
উত্তাপে আক্রান্ত হই কিংবা
কখনো হই শীতার্ত কোনো মানুষ
কারো কোনো ক্ষতি নেই
যার ক্ষতি ছিলো, সেই মা
আমার শ্রদ্ধা হয়ে, স্মৃতি হয়ে
মিশে গেছেন ঘন কুয়াশায়
এখন থেকে এই বিশাল
পৃথিবীতে অস্তিত্বহীন এই যুবক
এখন থেকে আমার
সকল গাফিলতিই বন্ধ হয়ে যাবে
অথবা আমার সবটা জীবনই
হবে এক গাফিলতি
মায়ের কথা মনে হলেই আমার
নিঃশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে যায়
মায়ের মৃত্যু আমাকে করেছে আজ
নাগরিকত্বহারা।

৫৫| ২৪ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৯

জসীম অসীম বলেছেন: আমি ভাই মারাত্মক ভীতু স্বভাবের মানুষ। কিন্তু না লিখলে আবার অপ্রকাশের বেদনায় মারা যাবো। তাই এখন আর ব্লগেও নয়, খাতায়ই লিখে রাখি। লেখা একবার লিখে ফেললে একসময় না একসময় তা প্রকাশিত হবেই, যদি তার ঐতিহাসিক বা আর্থিক বা সাহিত্য বা যে কোনো প্রকারের প্রকাশমূল্য থাকে। তবে লেখার কারণে আমি এক্ষুনিই লোরকার মতো বুলেটবিদ্ধ হয়ে মরতে চাই না। বাংলাদেশে সোমেন চন্দকে এবং তারও আগে স্পেনে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকাকে কি ফ্যাসিবাদীরা হত্যা করেনি? কতিপয় কমিউনিস্ট বাঁচতে দিলো না বিপ্লবী লিও ট্রটস্কিকে। তাই আমি লেখার জন্য এই মুহূর্তেই আক্রান্ত হতে চাই না। এমনিতেই আমার শরীরে মেদ-মাংস বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। আছে কয়েক অপুষ্ট হাড় বা হাড্ডি। আর ওসব হাড্ডিগুলোকেই আমি আবার ভীষণতর ভালোবাসি। তাই লিখতে চাইলেও মুদ্রণ বা অন্য যে কোনো প্রচার-প্রকাশনা মাধ্যমে এক্ষুনিই প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নই।

৫৬| ২৪ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৩

জসীম অসীম বলেছেন: Why I became a mad?
Jashim uddin Ashim
September 1992, Dhaka.
====================
This world is very cruel. There is nothing to say. Why is women so angry and unfaithful or excited? ? ? ? But this woman is very beautiful, she is very beautiful like flowers in the garden. So, I want to know today loving women really have on this planet? I don’t know at all. Women don’t have love Women loves golds, ornaments and various jewels. Do they love only love? I don’t know at all. I'm a mad poet I cann’t live without women. So i want a woman that woman understands or feels my love. I have nothing to do. I have some poems I love poetry poem of love. I want to love my poems & I want to love this planet. But now... At this time what is this planet? This planet is now extremely ungrateful. Now this planet of injustice or a hell. So i don’t understand why I became a mad? I'm frustrated now. Where are we going today? Live or die? I don’t know. Really i don’t know. So i don’t understand why i became a mad?

৫৭| ২৪ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৩

জসীম অসীম বলেছেন: কবিতা:
কীর্তিনাশার বুকে
জসীম উদ্দিন অসীম:
প্রথম প্রকাশ:
২২ চৈত্র ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ,
দৈনিক সমাচার, ঢাকা।
অলংকরণ: জসীম উদ্দিন অসীম।
আমার এ দেশ তরঙ্গ হয়
কীর্তিনাশার বুকে
শহীদ সেনা প্রাণ খুঁজে পায়
আমার দেশের সুখে
আমার এ দেশ আমারই প্রাণ
মায়ের দুধের পবিত্র ঘ্রাণ
এ প্রাণ আমার দিতে পারি
সোনার দেশের নামে
বাঁধ দেখে কি চলার পথে
কীর্তিনাশা থামে?

৫৮| ২৪ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪০

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প:
বকদিঘির উত্তর পাড়ের অশ্বত্থ বট
জসীম উদ্দিন অসীম:
এটা আমার শৈশবের এক ঘটনা। আমাদের পরিচিত এক বাড়িতে ভূত থাকে বলেই জানতাম। একদিন সন্ধ্যায় গেলাম সেই বাড়িতে। এটা ছিল অশোকের পিসির বাড়ি। সেই বাড়িতে ঢুকতেই একটি গাছের নিচু ডালের বাসায় বসে ডিমে তা দিতে দেখলাম একটি ঘুঘুকে। ঢিল ছুঁড়ে দিলাম। পাখিটির কাছ দিয়ে গেল। অবশেষে পাখিটি উড়ে গেল। প্রভারাণী বসুদের ঘরের কাছেই ছিল একটি অর্জুন বৃক্ষ। সন্ধ্যা হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে নানা প্রকার পাখি বসছিল সে বৃক্ষে। সেই বৃক্ষের ঠিক পেছনেই বকদিঘি। আমাদের নজর ছিল বকদিঘির উত্তরপাড়ের গহিন মাঠের অশ্বত্থ বটের গাছটির দিকে। ওখানে নাকি মধ্যরাতে ভূূতদের আসর বসে। আমি, অশোক, প্রশান্ত একই সঙ্গে সঞ্চিতা, প্রিয়াংকা, পার্থ, পূর্ণা, ও প্রমিলাদের ঘর পার হয়ে যেতে লাগলাম সেই অশ্বত্থ বটের গাছটির দিকে। পথেই সমীর এবং সুমেন্দুর সঙ্গে দেখা। যেতে বারণ করলো ওদিকে। ভয়ও দেখালো। বটতলা তখন অন্ধকারে ডুবছে। তার আগেই বিশাল এক কদমগাছ। তারপর এক ছাতিম বৃক্ষ। সবশেষে অশ্বত্থ বট। বটের কাছে যেতেই পটপট করে অনেক শব্দ হলো। আমরা কোনো ভয়ই পেলাম না। বকদিঘির উত্তরপাড়টা রীতিমত বনের মতোই। হঠাৎ আমাদের নজরে এলো একটি কালো রঙের ছোট হাঁস। ধরতে গেলেই শব্দ না করে উড়াল দিয়ে ছাতিম বৃক্ষে মিশে গেল। ভয়ে তখন কাঁপছিল প্রশান্ত। তখন ছিল শীতকাল। অশোকের পায়ের নিচে চাপা পড়লো একটি ব্যাঙ। সঙ্গে সঙ্গেই ধাপ করে লাফ দিলো অশোক। আমিও গেলাম একটু ভয় পেয়ে। কিছু বাদুর ও চামচিকার দেখা পেয়ে আমারও ভয় ভয় লাগছিলো। ভাবলাম পেঁচার দেখাও পাবো। আরেকটু এগিয়ে যেতেই মরা ছাগল কিংবা গরুর গন্ধ নাকে এলো ভাগাড় থেকে। প্রশান্তকে বললাম, শকুনের ডাক শুনলে আবার ভয় পাস না যেন। অশোক বললো, একটা দেয়াশলাই বক্স আনার দরকার ছিল। ... অবশেষে চলে এলাম সন্ধ্যার মধ্যেই সেই অশ্বত্থতলা থেকে। ভূতের দেখা পেলাম না আর।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পরদিন সকালেই সবাই গিয়ে সেই অশ্বত্থ বটের নিচু ডালে অশোকের পিসাতো বোন উর্মিলাদিকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে দেখলো। এটা কি ঠিক আত্মহত্যা নাকি হত্যা, এ নিয়ে চতুর্দিকে গবেষণাও শুরু হয়ে গেলো। তারপর থেকে আর কখনো দিনের বেলায়ও একা একা সেই বক দিঘির উত্তরপাড়ের অশ্বত্থ বটের কাছে যাইনি আমরা। এখন অবশ্য ওখানটায় ছাতিম কিংবা অশ্বত্থ বটবৃক্ষ আর কোনোটাই নেই। কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু স্মৃতিকে তো আর কেটে ফেলা যায় না।

৫৯| ২৭ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:২১

জসীম অসীম বলেছেন: আমি কেন রূপালিকে
ফেলে চলে যাবো

জসীম উদ্দিন অসীম

বৈশাখ 1400 বঙ্গাব্দ,
ঢাকা।
===================
আমি কেন রূপালিকে ফেলে চলে যাবো?
কারণ আমি বিষটোপে
পাখি শিকারে বিশ্বাসী নই।
আর রূপালির জন্যও আমার এই বুকে
বিষ ছাড়া অন্য কিছু নেই,
যাকে সে আসলে
ভালোবাসা বলেই ধরে নেয়।
অন্যদিকে তাঁর ভালোবাসাকেও আমি
বিষ বলেই জানি।
এই ঢাকা শহরে যে আমার
নেই তেমন শীতবস্ত্র
যে আমি বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্তও
খেতে পাই না একমুঠো ভাত
যে আমি এক অর্থশূন্য মানুষ
এমনকি প্রাণ দিয়েও
পঞ্চাশ গ্রাম স্বর্ণ কেনার
স্বপ্ন দেখতে পারি না
সেই আমাকে নিয়েই রূপালি
টিকাটুলির কে. এম দাস লেনে
বাসা ভাড়া করে থাকার
সোনালি স্বপ্ন দেখে
যে আমি সারা একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরেও
অর্থাভাবে ক্রয় করতে পারি না
আকাঙ্ক্ষিত একটিমাত্র গ্রন্থও
রূপালি স্বপ্ন দেখে সেই আমিই একদিন
কিনে ফেলতে পারবো
পাঁচ-দশটি উড়োজাহাজও এই দেশে।
আর ঠিক এ জন্যই আমি একদিন
রূপালিকে ফেলে
এই ঢাকা শহর থেকে
একেবারেই দূরে চলে যাবো
যে আমাকে ভালোবাসার নামে
প্রতিক্ষণই বিষটোপে
শিকার করতে চায়।
=============
(বি. দ্র: এটি ছিল একটি
দীর্ঘ কবিতা।
2012 সালে এর
মেদ বর্জন করা হয়েছে।)
=================
কম্পোজ:
সাদিয়া অসীম পলি।

৬০| ২৮ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:০৪

জসীম অসীম বলেছেন: ‘‘এই দেশ আমার হলেও
আমাকেই ভাবা হচ্ছে পরিযায়ী পাখি।
অনেকে আমাকে দিয়েও দেখাচ্ছে সার্কাস।
সব হিংস্রতা ঠেলে দিচ্ছে আমারই কপালে।
ফেন্সিখোরের হাতে যখন চলে আসে
শ্যাম্পেনের বোতল,
তখন তো আসলে এমনই হয়’’:
=================
2013 এর ডিসেম্বরের ডায়েরি থেকে।

৬১| ৩০ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৫:৩৮

জসীম অসীম বলেছেন: ৩০ বছর পর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে
কবি পিয়াস মজিদের
কুমিল্লা শহরে বাস শেষ হওয়া বিষয়ে
আমার তাৎক্ষণিক মতামত:
==================
চলে যাওয়াটা অত্যন্ত দুঃখময়…বেদনাবহ। কিন্তু এ তোমার নিষ্ঠুর বাস্তবতা। বরং চলে গেলেই অনুভব করা হয় অধিক। তুমি চলে যাওয়াতে তোমাকেও আমরা আরও অধিকমাত্রায় অনুভব করবো। পিতার অবর্তমানে পিতা আরও অধিকমাত্রায়ই স্মরণীয় হচ্ছেন।এই কুমিল্লাতেও বা এই দেশেও অনেক গুণী লোক পচে মরেছেন বা মরছেনও তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কিছু ছিল না বলে। যাওয়াটা দুঃখবহ, কিন্তু প্রয়োজন। আমার বন্ধুরা আমাকে ঢাকা ছেড়ে আসতে দিতে চায়নি। আমি ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লায় এসে বিভিন্ন কারণে আজ এক ভাঙ্গা কুলায় রূপান্তরিত হয়েছি। আর এ জন্য সব্বাই একই সঙ্গে শুধুমাত্র আমাকেই দোষারোপ করলেও স্থানও এখানে প্রভাব ফেলেছে। ইন্টারনেট আজ সকল দূরত্ব দূর করে দিলেও স্থানের গুরুত্ব কিছু কমেও যায়নি। এখনো কি আমাদের মননের প্রতীক বাংলা একাডেমীর বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে? বাংলা একাডেমী কি আজও সারাদেশে আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলন বা গ্রন্থমেলার আয়োজন করতে পারছে? মূল কথা হলো, বাংলা একাডেমীর বিকেন্দ্রীকরণ কি আদৌ সম্ভব? অথচ এগুলোর তো এদেশে প্রয়োজনও রয়েছে। আমি মনে করি সুযোগ থাকলে তুমি অক্সফোর্ড বা ক্যাম্ব্রিজের মতো জায়গায়…আরও দূরে এবং বড় জায়গায় চলে যাও। নোবেল পুরষ্কারের আগে এদেশে রবীন্দ্র স্বীকৃতি আসেনি তেমন। নীরদ সি চৌধুরীকে দেশের বাইরে কিন্তু বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল। দূরে থেকেও নিজের ঐতিহ্যের জন্য বড় কিছু করা যায়। নিজের স্বজনের স্মৃতি ধারণ-লালন এবং তাকে বিকশিত করা যায়। বিশ্বস্বীকৃত সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত এই বাংলায় ফিরে এসে অযত্নে-অবহেলায় ও বিনা চিকিৎসায় পচে মৃত্যুবরণ করেছেন। হায়! বাঁচার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রাক্তন এই ছাত্র ও গুণী এই শিল্পী সবশেষে একটি মুদি দোকানও করেছিলেন। তারপরও এইচএমভি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার কমল দাশগুপ্তের শেষ রক্ষা হয়নি। এমন নারকীয় বেঁচে থাকার চেয়ে কখনো কখনো যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে দূরে গিয়ে বেঁচে থাকাও অনেক মঙ্গলজনক।… 30 বছরের স্মৃতির কুমিল্লা শহর ছেড়ে চলে যাওয়াটা অত্যন্ত দুঃখময়…বেদনাবহ। কিন্তু এ তোমার নিষ্ঠুর বাস্তবতা। নিরন্তর শুভ কামনা রইলো।
(এই মতামতটি কবি পিয়াস মজিদের
‘‘ বিদায় কুমিল্লা: ভালো থেকো কুমিল্লা শহর ’’
‘পোস্ট’ এ সংকলিত মতামত। )

৬২| ৩০ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৬:৪৯

জসীম অসীম বলেছেন: সংশোধিত:
জসীম উদ্দিন অসীম
কুমিল্লার গোমতি অঞ্চলের
অনেক ছবিই তুলেছেন
মোঃ নাসিম আহম্মদ
রচনা: মার্চ-2004
===========
কুমিল্লা সরকারি গণ গ্রন্থাগারে (কুমিল্লা পাবলিক লাইব্রেরী) প্রথম জসীম উদ্দিন অসীমের সাথে আমার পরিচয় হয়। সময়টা ১৯৯৩ সালের শেষের দিক। তিনি ঢাকায় তখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অর্নাস পড়তেন। আর আমি তখন বাংলা'তেই অনার্স পড়তাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ভিক্টোরিয়া কলেজের ড. জয়নাল আবেদীন স্যারের উপদেশ মেনে আমি কলেজের ক্লাশ শেষে প্রতিদিনই পাঠাগারে (কুমিল্লা সরকারি গণ গ্রন্থাগারে) বসে বিভিন্ন রেফারেন্স বইয়ের সহযোগিতায় নোট তৈরি করতাম। তেমনি একদিন শুভলগ্নে বই পড়ার ফাঁকেই জসীম উদ্দিন অসীম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। তিনি তখন ঢাকাতেই থাকতেন। আর তার মা-বাবা ভাই-বোনরা থাকতেন কুমিল্লা শহরের গয়ামবাগিচা সড়কের পাশের একটি বাসায়। কুমিল্লা আসলেই জসীম উদ্দিন অসীম ভাই কুমিল্লা সরকারি গণ গ্রন্থাগারে আসতেন। সে সময়ে সাহিত্য, নাটক, আলোকচিত্র, চিত্রকলা, রাজনীতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ে দু’জনের মধ্যে বেশ আলাপ আলোচনা হতো। তার তখন সকল বিষয়েই পাঠের ভীষণ নেশা ছিলো। তাঁদের গয়ামবাগিচা সড়কের বাসায়ও আমি বহুবার গিয়েছি। তারপর তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন ও কবিতার পুস্তিকাও ছেপেছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ছবি অাঁকা বা ছবি তোলার আগ্রহই তাঁর ভীষণতর ছিলো। বিশেষ করে ক্যামেরায় তোলা ছবি বা ফটোগ্রাফির নেশা ছিলো তাঁর প্রকট। তিনি কুমিল্লার গোমতি নদী ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলের অনেক সৌন্দর্যময় ছবিই তখন তুলেছেন। সেগুলো তিনি পরে কুমিল্লার 'সাপ্তাহিক আমোদ’ ও দৈনিক রূপসী বাংলা’ পত্রিকাসহ আরও পত্রিকায় ছেপেছেন। তিনি যেমন সুন্দরভাবে ছবি তুলতেন, তেমনি সুন্দরভাবে ছবি আকঁতেনও । তার ঘরের দেয়ালে এখনও তাঁর অঙ্কিত ছবি শোভা পায়।
১৯৯৬ সালে জসীম উদ্দিন অসীম ভাই ‘আমোদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। সে সময়ও ছবি তোলার জন্য তিনি দূরদূরান্তে ছুটে যেতেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি কুমিল্লার লাকসাম থেকে প্রকাশিত ‘লাকসাম বার্তা'য় কাজ করতেন। তখন আমি টমছমব্রীজ উপকূল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন লতিফ স্যারের বাসায় থাকতাম। সে সময়েও তিনি প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতেন। তিনি অধ্যাপক আবদুল ওহাব স্যারের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘দৈনিক রূপসী বাংলা’তেও কাজ করেছেন। ২০০০ সালে এসে 'সহকারি সম্পাদক' হিসেবে যোগ দেন প্রবীণ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহর “সাপ্তাহিক নিরীক্ষণ” পত্রিকায়। পরে ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে কুমিল্লার ‘দৈনিক শিরোনাম’ পত্রিকায়ও কর্মরত ছিলেন। সে সময় আমি প্রায়ই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতাম। সেখানে প্রায়ই সাহিত্য, রাজনীতিসহ সকল বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন কবি ফখরুল হুদা হেলাল, পত্রিকার সম্পাদক নীতিশ সাহা, চীফ রিপোর্টার সাইয়িদ মাহমুদ পারভেজ ভাই ও গল্পকার ও গবেষক মামুন সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে।
জসীম উদ্দিন অসীম ভাই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে বক্তা, কবি, গল্পকার, চিত্রকর, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও ফটোগ্রাফার বা আলোকচিত্রী। তাঁর মত সমাজ সচেতন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব আধুনিক তরুণ সমাজে বিরল। ছবি নিয়ে তিনি গত কয়েক বছর ধরেই অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। তাঁর তোলা ও অঙ্কিত ছবিগুলোতেও এসবের প্রমাণ মিলে। আমার বিশ্বাস: তিনি একদিন তাঁর সৃষ্টির জগতে সফল হবেনই।
================
লেখক: প্রভাষক: বাংলা বিভাগ, আনন্দপুর ডিগ্রি কলেজ, কোতয়ালী, কুমিল্লা।
================
কম্পোজঋণ:
সাদিয়া অসীম পলি।

৬৩| ৩০ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৩

জসীম অসীম বলেছেন: নিজের মগজের পচন দেখছি না
এমনই সভ্য আমি
দিনলিপি: আগষ্ট-2013,
কুমিল্লা।

আমি এক অসভ্য মানুষ হয়েও সভ্য মানুষের মতো নিপুন অভিনয় করে যাই। হায়! কী করুণ সংকটে কাটে সময়। অভিজাত পাড়ায় পাড়ায় নোঙর করছি জীবনের জাহাজ এবং পিতার পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করছি। এমনই এক অসভ্য মানুষ হয়েও নিজেকে আবার সভ্য মানুষ বলেও দাবি করছি। কখনো বা লুকিয়ে রাখছি পিতৃপরিচয়। পিতার পেশাকে করছি ঘৃণা, যে কাজ করে পিতা আমাদের প্রতিদিনের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করেছেন।এমনই সভ্য আমি, ধানমন্ডির আর্ট সেন্টারে শিল্পকর্ম প্রদর্শনী দেখে এসে নিজেকে মুর্তজা বশীরের সমকক্ষ শিল্পী ভাবছি। মাটি ও মানুষের কবি জসীম উদদীনকে প্রিয় কবি বলতে লজ্জা পাচ্ছি। কোনোভাবেই নিজের মগজের পচন দেখছি না। কখনো বা অভিনয় না শিখেই নিজেকে ভাবছি নায়ক এবং সংগীতের পাঠ না নিয়েই নিজেকে ভাবছি গায়ক। এমনই সভ্য আমি, অসভ্যকেও হার মানিয়ে পথ চলছি প্রতিদিন। আমার পুরো যাপিত জীবনেই এমন অসভ্যতার বিবিধ প্রতিচ্ছবি। অথচ নিজেকে আবার দাবী করছি সভ্য মানুষ বলেও।
====================
ছবি: কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব।
দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র।

৬৪| ১২ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১১:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন: Click This Link

৬৫| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:০৮

জসীম অসীম বলেছেন: আমি আঁকি পাখি
জসীম উদ্দিন অসীম
ছবি আকাঁর প্রতিভা আমার কখনোই ছিল না। এসএসসি পরীা দেয়ার আগে একটি খেলনা অনুবীণ যন্ত্র তৈরি করেছিলাম-যা দিয়ে পেঁয়াজ-রসুনের কোষ দেখতাম। এক সময় এ দেখাটা কিছুটা কাজে এলো বিজ্ঞানের চিত্রমালা আঁকার েেত্র।
একদিন বিজ্ঞানের শিক ম"ণাল বাবুর ব্যবহারিক কাশে চিত্র আঁকার ভুলের কারণে আমাকে ছাড়া প্রত্যেকে বেত খেলো। আমি তখন খারাপ ছাত্র হয়ে গেছি। নানা কারণে। কিš' বুঝতে পারলাম না-আমার চিত্রটা নির্ভুল হলো কেন! কাশ শেষে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমার ওপর। বিশেষ করে মেয়েরা। আমি বললাম- আমি জানিনা-আমার চিত্রটা কী কারণে সঠিক-আর তোমাদেরটা কী কারণে ভুল। তবে এটা জানি রাত জেগে আমি মনোযোগ দিয়ে চিত্রটা এঁকেছি। পরে সবাই আমার খাতা দেখে চিত্রটা এঁকে বিরতির পর ম"ণাল স্যারকে ভয়ে ভয়ে আবার দেখালো। ম"ণাল স্যার বললেন-ঠিক আছে। তবে কারো কারো চিত্র তখন তিনি একটু আধটু ঠিক করেও দিলেন। সেদিন কেন যে মনে হলো-ছবি আঁকলে আমি কি খুব ভালো করতে পারবো?
অনেকটা সময় এভাবেই কেটে যায়। তার অনেক দিন পর প্রায় দু'দিন ব্যয় করে লালন ফকিরের একটি ছবি আঁকলাম। পেন্সিল দিয়ে।লালনের ছবিটি ছবি দেখে আঁকা হলেও লালন ফকিরের পাশ দিয়ে নতুনভাবে গোমতীর মতো একটি নদী এঁকে দিয়েছিলাম। ১৯৯০ সালে। ও ছবিটা দেখলে লালনকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতো। ১৯৯৩ সাল পর্যš- ছবিটা আমাদের বাসায় টানানো ছিল। তারই পাশে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি ছবি।
১৯৮৭ সালে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে। তখন একদিন একা একা বাটালি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দার"ণভাবে মু" হয়েছিলাম। তার আগে এতো উঁঁচু থেকে প"থিবীকে আর দেখিনি। সেদিনের সে দেখাটা আমি আকঁতে চেয়েও পারিনি।
১৯৯২ সাল। আমার জীবনের সোনালী সুখের দিন। ঢাকায় আমার প্রেমে পড়েছে রূপালি। আমিও তার প্রেমে পড়ে প"থিবীকে লাল-নীল কতোভাবে দেখছি। তখন আমি ঢাকার বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রায়ই চিত্র প্রদর্শনী দেখছি। লাইব্রেরীতে চিত্রকলার বইপত্র পড়ছি। আর বাসায় বসে ছবির পর ছবি আঁকছি। একদিন রূপালি এসে বললো-তুমি ছবিও আঁকো? আমি বললাম-পারি না। জলরঙ নিয়ে চেষ্টা করছি। রূপালিকে একের পর এক আঁকতে থাকলাম তখন। কিš' একটি মুখও রূপালির মুখ হ"িছল না। তাই রূপালিকে দেখাতে চাইনি আর। তখন রঙতুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না। রঙতুলি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতো। তারপরও হয়ে যেতো কখনো কখনো নিজের কাছে ভালো লাগা একটি ছবি। এসব ছবিতে ব্যাকরণ ও রঙের অন্যরকম ব্যবহার দেখে অনেকেই ‘ছিঃ' বলতে পারেন। তারপরও আমি বলবো-এসব আকাঁ শুধুই ভালোলাগার জন্য। জানি না-রূপালি আর আগের মতো সুন্দরী আছে কী না। অথবা বেঁচে রয়েছে কী না। বেঁচে থাকলে প্রেমের কথা একদিন হয়তো অস^ীকার করতেও পারে। সামাজিক কারণে। তবে রূপালির প্রেমে না পড়লে তখন আমি ছবি আঁকতাম কী না-জানি না। আমার সেসব অভাবের দিনে ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন পিয়াস জলরঙ দিয়ে খুব সহায়তা করতো। যদিও সে অনেক অনুরোধ করে মায়ের কাছ থেকে জলরঙ কেনার টাকার যোগাড় করতো। আমার ‘লাভ ফর গ্যাম্বলিং' সে সময়ের আঁকা একটি ছবি। পরে আবার এ ছবিতে হাত লাগাতে হয়েছে। এ ছবির নারী চরিত্রটি আমার কাছে খুবই বেপরোয়া-ঠিক তখনকার রূপালির চরিত্রের মতো।
আমাদের গ্রামের পূর্বপাশে ছিলো একটি জলাশয়। ওদিকটার প্রায় সব মাটিই এঁটেল মাটি। জলাশয়ের কাছেই বড় আপার বিয়ে হয়। আমি তখন খুব ছোট। প্রায়ই বেড়াতে যেতাম তাদের বাড়িতে। আর জলাশয়ের মাটি এনে গর"-ছাগল-পাখি বানাতাম। তারপর পুড়ে অথবা রোদে শুকিয়ে নিয়ে আসতাম বাড়িতে। আমার মা এগুলোতে রঙ দেয়ার কাজে সহায়তা করতেন। একটু বড় হয়েই কিছু বইয়ে শহীদ মিনারের অনেক ছবি দেখি। বাবা নিয়ে গেলেন কুমিল্লার বিখ্যাত শালবন বিহার যাদুঘরে। খুব ছোটবেলায়। পোড়ামাটির কাজ দেখে আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। কারণ বাবা তখন বলেছিলেন-ওসব কাজ হাজার বছর আগেই নাকি তৈরি করা ছিলো। তাহলে এ যুগে আর আমি কী-ই-বা তৈরি করবো। ত্রিমাত্রিক ভাদ্ধকর্যগুলোকে বাবা আমাকে শিশুতোষ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে আমি যখন ঢাকার পথে পথে ছবি তুলছি-তখনও কোনো ভাসশুর্যের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাসশুর্যের ছবি তুলেছি। ছবি তুলেছি পথিককে দিয়ে আমার-নিজের ভাসশুর্যের সামনে দাঁড়িয়ে। মূর্তি অথবা ভাসশুর্য যুগে যুগেই আমাকে পাগল করেছে। আমাদের আগের বাসায় একটি নারী ও পুর"ষের শারীরিক মিলনের মূর্তি শোভা পেত। বাবা-মা কখনো বাঁধা দেননি। তবে বাবার কোনো কোনো বন্ধু এজন্য আমাকে অনেক অপমান করেছেন।
১৯৯৯ সালে আমি যখন আমার ত"তীয় কবিতার সংকলন-তুমি এখন আকাশবাসী-প্রকাশ করি-তার প্র"ছদ ছিলো একটি থখত্র নারীমূতির ছবি। বাবা ভয় দেখালো মৌলবাদীদের হামলায় পড়তে পারি বলে। হামলায় না পড়লেও তার জন্যে আমি পথে পথে বকা শুনেছিলাম।
আমার ওপর বাবার আ¯'া ছিল-কারণ বাবার পড়াশোনা ছিলো। আমি যখন আকাশবাসীর প্র"ছদ করি-তার কিছুদিন আগে বাবা র্যঁদার ভাসশুর্য বিষয়েও একটি বই পড়েছিলেন। তার পরপরই পড়েছিলেন ফরাসী চিত্রশিল্পীদের কথা। ওসব বই পড়তেন না বড় ভাই। তার হাতে তেমন সময়ও থাকতো না।
আমার বাবা আমাকে নিয়ে দুশ্চিš-ায় ছিলেন। কারণ তিনি যখন ১৯৮৯ সালে প্রথম আমাকে মনোমোহন দত্তের গানের বই ‘মলয়া' পড়তে দেন-তখন আমি ওসব গান নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চিš-া শুর" করলাম। আবার একদিকে আঁকার নেশা-অন্যদিকে লেখার নেশা।
বাবা বুঝলেন-আমার দ্বারা ঔিচুই হবে না। পড়াশোনা আর চাকুরী তো নয়ই। যেমনটি বাবার হয়েছিলো। শেষমেষ তিনি চাকুরী করতে পেরেছিলেন-যেহেতু সংসার পেতে ফেলেছিলেন।
আমি ছবি আঁকার চেষ্টা বোধ হয় সেদিনই ছেড়ে দিলাম-যখন দেখলাম ফ"সোয়া অগু¯- রেনে র‌্যাদা-র মতো শিল্পীও উš§াদের মতো নেশা নিয়ে লত্রৎথৎশৎভ ভুলে অনেক সময় দিনে চৌদ্দ ঘন্টাও অনুশীলন করেছেন। তার ব্রোঞ্জের যুগ, থিঙ্কার, বালজাক-এসব ছবি দেখে মাথা ঘুরে গেলো। মনে হলো শিল্প করার নামে আমি যা করছি-তা এক প্রকার বদমাইশী ছাড়া কিছুই নয়। কারণ শিল্প করতে হলে পাগল হতে হবে। কাজের পাগল।
আঁকার নেশা কয়েকবারই জেগে উঠেছিলো। কাস এইটে পড়ার সময় ভাবলাম আমার দ্বারা সশুাউট হতে পারে। অনেকদিন সময় দিলাম। সশুাউট ওয়াদা মুখ¯' করলাম। লোকের সঙ্গে মজা করে বাম হাত মেলাতাম। আমরা একে অন্যকে দেখলে সশুাউটের ৭টি আইন মুখ¯' আছে কী-না পরীা করতে বলতাম-ইববিঅজীহামিচিকনী। সালাম দিতাম বন্ধুদের তিন আঙ্গুল দ্বারা। পকেটে রাখতাম ছুরি। কিছুদিন পর দেখলাম আমার দ্বারা তাও হবে না। তবে সে সময়ে সশুাউট নিশানাগুলো বুঝানোর জন্য আমি আঁকার চর্চা শুর" করলাম। বেশির ভাগ চিত্রই ছিলো পাঠ্য জ্যামিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সেদিকে যাও-এদিকে যেও না-এদিকে যাও-খেয়াঘাট আছে-ক্যা¤প আছে-তিন কদম যাও-খবর আছে-খাবার পানি আছে-প্যাট্রোল চিহ্ন বুঝাতে আমি অনেক দ"শ্য আঁকার কাজ করেছিলাম। পরে বুঝলাম-আমার দ্বারা আকাঁও সম¢ব হ"েছ না।কারণ আমি খুব অ¯ি'র প্রক"তির।
ঢাকায় নিয়মিত থাকার সময়ে আমি কিছু কিছু চিত্র প্রদর্শনী দেখেছি। ছবি তেমন বুঝিনি। তবে ছবি দেখে আনন্দ পেতাম। আনন্দ পেতেই এক সময় কিছু নিসর্গচিত্র এঁকেছি। হারিয়ে গেছে। তেল রঙে আঁকিনি কখনো। জলরঙে আঁকার চেষ্টা ছিলো। রেখার ভাষা তেমন বুঝি না। বুঝতে চেষ্টাও করিনি সে রকম। ঠত-১৯৭১-এর মতো কিছু ছবিতে গল্প বলতে চেয়েছিলাম। ছবির রীতি বা ফর্ম নিয়ে কোনো পরীানিরীা করিনি। আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলন স¤পর্কেও আমি তেমন অবহিত নই। জেলা শহরে থাকার কারণে সে সুযোগ অনেক কম ছিলো। যদিও এখন ইন্টারনেটের যুগ।
বিভিন্ন শিল্পীর কাজ পত্রিকায় দেখে সবটা বুঝা যায় না। তবু দেখি মাঝে মাঝে-খুব সাধারণ ছবিও খুব বেশি ভালো লেগে যায়। শিল্পী কনকচাঁপা চাকমার কাজ আমার ভালো লাগে। সংবাদ সাময়িকীতে ছাপা হওয়া তার ‘একটি মুহূর্ত; এক্রোলিক অন ক্যানভাস'-‘উপজাতি'-এখনও মাথায় ভাসে।
শিল্পের চর্চা করতে গিয়ে শিল্পবোদ্ধাদের টানাটানিতে প্রথম প্রথম হাঁপিয়ে উঠতাম। মার্কসবাদী নন্দনতত্ত¦ পড়ে ব¯-ুসত্ত¦ার দিকে যতটা এগিয়ে গিয়েছিলাম-পল কী পড়ে বানরের তৈলাক্ত বাঁশে বেয়ে উঠার পরের পর্বের মতো ঠিক অনেকটা নেমে গেলাম। পল কী বুঝাতে চেয়েছেন একজন শিল্পীর অš-সত্ত¦াকে কোনোভাবেই হেয় করে দেখার সুযোগ নেই।
পিকাসোর আঁকা ছবিগুলো লাইব্রেরীতে দেখে প্রথম প্রথম মাথা ঘুরে গেলো। আমি ইংরেজি ভালো জানি না। তাই বিদেশী লেখার ইংরেজি অনুবাদে মনে তেমন সাড়া জাগেনি। কিš' ছবি দেখে বুঝলাম-এ এমন মাধ্যম-যার অনুবাদের কোনো তোয়াক্কা নেই। শুধুমাত্র চোখ থাকলেই হলো । যেমনই চোখ হোক। যে সাধারণ চোখ চিত্রকর্মের ব্যাকরণ বুঝে না-সে চোখও চিত্র থেকে কিছুটা আনন্দ পেতে পারে। যে শিল্পীর রীতি বুঝে না-যে যায়নি কখনোই আর্ট সশুুলে-সেও একটি চিত্র দেখে থমকে দাঁড়াতে পারে-লেখার েেত্র যা সম¢ব নয়। তাছাড়া শিল্পের ব্যাকরণও পরিবর্তনশীল। কোনোটা সাধারণ মানুষকে ভরসা করে এগোয়-কোনোটা আবার তাদের বাদ দিয়ে। সনাতন নিয়ম নয়। আজকের যুগের শিল্পের বিচার হওয়া উচিত যে কতো দ"ষ্টিকোন থেকে-তা বলারই অপো রাখে না।
দূরের ব¯-ু ছোট দেখা যায়-এ তো ফটোগ্রাফিক গ্রামার। সনাতন কথা। আমার ছবিতে প্রায়ই এসব মানা হয়নি। আমি যখন এই তিনতলায় ছবিতে রঙ লাগাই-তখন বিশ গজ দূরের বাসার একটি খুনী সুন্দরী মেয়ে আমার দিকে উঁকি মারে। তার ওপর সে হিন্দু মেয়ে। অবিবাহিতা। উড়নাটা বারবার ই"েছ করে খসায়-আবার তুলে ধরে। আমি তখন কোলের কাছের রঙ লাগানো ভুলে গিয়ে-দূরের মেয়েটিকে বড় করে দেখে মনের মধ্যে রঙ না লাগিয়ে কি পারি?
আমার ছবিতে রঙের ব্যবহার এলোমেলো। রঙের যে অর্থ-অল্প হলেও বুঝি। কিš' রঙ আমার কাছে আপেকি। ভিখারীর চোখ আর রাজার চোখ একই ব¯-ুকে দু'ভাবে দু'রঙে দেখতে পারে। আপনার কাছে পয়সা আছে বলে আপনি এ বেলা দার"ণ খাবার খেলেন-আমি যে উপোসই থাকলাম। সুতরাং রঙ কেনার কাগজ কেনার পয়সা থাকার পরও যে আকাঁর নেশায় ভোগে-তার রঙ তো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মিলবে না।
ইতিহাস-ভবিষ্যৎ-দুবিষয়েই আমার আঁকা ছিলো। একুশ শতকের নবাব সিরাজ-ছবিটা করা ছিলো জলরঙে। ১৯৯৪-এ এঁকেছিলাম। খোয়া গেছে। বিয়ে ভাঙ্গনের সময়। আরও খোয়া গেছে ‘পতিতা' সিরিজের কয়েকটি ছবি। ছবিগুলোতে আমি চিত্রকলার রেখা ও রংয়ের নির্ধারিত কোনো ব্যাকরণ মানিনি।‘স^াধীনতা তুমি...যেমন ই"েছ লেখার আমার কবিতার খাতা (স^াধীনতা তুমি/শামসুর রাহমান)।
রেখা আর রঙ।রেখা আর রঙ বিশŸাসী বন্ধু-আবার সে বিশŸাসঘাতক। আমার রঙ-রেখা অধিকাংশ সময়ে বিশŸাসঘাতকতা করেছে।আমার ছবিতে কখনো কখনো রঙ রেখাকে নিয়মমত ব্যবহার করতে ই"েছ করেনি। অথচ তা ছিলো আমার জন্য খুবই তিকর। কারণ যান্ত্রিক সমালোচনা-প্রয়োগবাদী সমালোচনা-ভাববাদী-রূপবাদী সমালোচক-সকলেই আমাকে শত্র" মনে করতে পারেন। আমি ছবিকে দু'ভাবে বুঝি। ভালো লাগা অথবা মন্দ লাগা। রাজরানীর ছবি এঁকেও ভালো লাগে না। আবার পতিতার ছবিটারও প্রেমে পড়ে গেলাম।এমনটি হতেই পারে।
আমি আঁকি। আঁকার জন্যই-অথবা আমার জন্যই। নন্দলাল বসুদের ছবিতে যেসব ব্যাকরণ দেখা যায়-তা আমি বুঝতেও চাই না। কারণ তা ডুবে ডুবে বুঝতে গেলেও সাধনা দরকার। আমি আসলে আমার আনন্দের প্রয়োজনে ছবি এঁকেছি। আমার মেধা বা প্রতিভা নেই। তাই দর্শককে তাক লাগিয়ে দেয়ার সাধনাও নেই। ১৫০০০ বছর আগের গুহাবাসীরা ফ"ান্স এরাকায় যে বল্গা হরিণের ছবি এঁকে গেছেন-তার ছবি দেখে আমি এ যুগেও হতবাক হয়ে যাই। সাধারণ ছবি। কিš' কতো অসাধারণ। ২০ হাজার বছরের পুরনো পেন দেশীয় গুহাচিত্রের বাইসনের বেলাও একই কথা খাটে।
বল্গা হরিণ অথবা বাইসনটিকে দেখলেই বুঝতে পারা যায়-সেটি কি হাসছে না কাঁদছে। রেখার কী অসাধারণ ব্যবহার। রেখা কাঁদে-রেখা হাসে-রেখা ভয় দেখায়।
যখন আমার আঁকার নেশাটা তীব্র ছিলো-তখন আমার তুলি কেনারও টাকা থাকতো না। আমরা খুব গরীব ছিলাম। ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন পিয়াসের তুলি চুরি করে ঢাকায় নিয়ে যেতাম। তাও যখন হারিয়ে যেতো-তখন গাছের ডালই ভরসা হতো। মনে আছে-ছোটবেলায় একবার একটি ইঁদুর মেরে তার গায়ে রঙ মেখে তাকে দিয়ে আরেকটি ইঁদুরের ছবিও এঁকেছিলাম। মা আমার আঁকার ঝোঁককে পছন্দ করলেও এ কাজটা পছন্দ করলেন না। বাড়ী থেকে বকে বের করে দিলেন। অথচ আঁকাটা দার"ণ হয়েছিলো। কাঠবিড়ালী আঁকার জন্য শ্যাওড়া গাছ থেকে কাঠবিড়ালীর বা"চা চুরি করে আনার সময়ে কয়েকটি কামড় খেয়ে বা"চা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
আমার ছোট ভাই পিয়াস খুব ছোটবেলা থেকেই ভালো আঁকতে পারতো। মূর্ত ছবি। এখন আঁকা ছেড়ে দিয়েছে। সে যখন খুব বেশি আঁকাআঁকি করতো-নৈসর্গিক ছবি-তখন তাকে একদিন আমি কাছে বসিয়ে বললাম-যদিও রঙের অনেক ধারনা যুগের সঙ্গে পাল্টে গেছে-তবু শুদ্ধ রঙ-মিশ্র রঙ কথাটি বহাল আছে। বহাল থাকবে। কারণ হলদে-লাল-নীল এ তিনটি শুদ্ধ রঙের মিশ্রণে বহু রঙ হতে পারে। তাকে আমি বলেছিলাম-সব শিা আর রঙের ব্যবহার জেনে নিতে হবে প্রক"তি থেকে। সে প্রায়ই নদীর কাছে চলে যেতো। তারপর আঁকতে থাকতো দার"ণ দার"ণ ছবি। সে মূর্ত ছবি আঁকলেও তার ছবিতে দেখতে পেতাম আমার মতো উল্টাপাল্টা-যত্রতত্র রঙের ব্যবহার।

৬৬| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:১০

জসীম অসীম বলেছেন: ভূতের গল্প
সন্ধ্যামণি-র উৎপাত
জসীম উদ্দিন অসীম
বাঁশঝাড়ের চূড়ায় বসে চালভাজা খায় বটেশ্বর ভূত। এই ভূতটি হিন্দু, কিন্তু বাস করে মুসলমান ঝাড়– মিয়ার ডেঙ্গায়। কারণ এই ডেঙ্গায় শত শত পাখি থাকে। বিশেষ করে পানকৌড়ি। আর এই পানকৌড়ির ডিম খেতে পছন্দ করে বটেশ্বর ভূত। ঝাড়– মিয়া হজ্জ করেছেন। ভালো মানুষ। কিন্তু তার ডেঙ্গায়ই আবাস গড়েছে হিন্দু বটেশ্বর ভূত। এর আরেকটি কারণ রয়েছে। আর তা হলো ঝাড়– মিয়ার ডেঙ্গার পাশের ডোবাটায় বিপুল কই, টাকি ও অন্যান্য মাছের সমাহার।
এলাকার লোক এই বাঁশঝাড়কে ‘ডেঙ্গা’ বলে। আর ঝাড়– মিয়ার একমাত্র ছেলে মোস্তফা ধনী বলে এই ডোবাটার কই মাছগুলো খায় না। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে এই বটেশ্বর ভূত। সে আবার ভালোবাসে হাড়েশ্যার গ্রামের নরেশ স্যারের বাড়ির আন্ধি দিঘির সন্ধ্যামণিকে। সন্ধ্যামণি অমাবশ্যার মধ্যরাতে ছাতিমগাছে বসে আজান দেওয়ার আগ পর্যন্ত ডুগডুগি বাজায়। এক টাকার মুরালি কিনে মজা করে খায় আর ওই ডুগডুগি বাজায়। পেঁয়াজ আর কেরোসিন ভীষণ অপছন্দ করে সন্ধ্যামণি। ১৯৭১ সালের নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পালবাড়ির লোকদের সঙ্গে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল। কিন্তু গত ১৪ বছর ধরে রোজ রাতে এই ছাতিম গাছে বসে। এখন দুর্যোধনের বউয়ের গর্ভবতী পেটের দিকেই তার দৃষ্টি। শিশুর দিকেই তার অশুভ দৃষ্টি। বনমালীর শিশুপুত্রকে এই সন্ধ্যামণিই মেরেছে। দরিদ্র মানুষেরই বেশি ক্ষতি করে সে। তাকে নিয়ে কেউ মজা করলে সে তাকে ছাতিমগাছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এলাকায় এখন পল্লীবিদ্যুৎ আনতে যারা ব্যস্ত, সন্ধ্যামণি তাদের ছাড়বে না। বিদ্যুতের আলো মেনে নিতে চায় না সে। এ জন্য প্রয়োজনে একুশটা লাশ ফেলে দেবে সন্ধ্যামণি। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড তার ভীষণ প্রিয়। কারণ বৃটিশ আমলে তাকে ফাঁসিতেই মরতে হয়েছিল। তখন এক রাজপ্রাসাদে থাকতো সন্ধ্যামণি।
কিন্তু একদিন রাজবাড়ির এক গোপন সুড়ঙ্গে তারই পিসাতো ভাই তাকে ধর্ষণ করেছিল। কয়েকমাস পর তার পেটে এলো বাচ্চা। একদিন রাতে প্রাসাদ ছেড়ে গৌতমদের পরিত্যক্ত বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পার হয়ে মাণিকবাবুর ছাতিমগাছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সন্ধ্যামণি। সেই থেকেই একমাত্র দূর্গাপুজা ও পোনরার মেলার সময় ছাড়া অমাবশ্যার মধ্যরাতে ডুগডুগি বাজায় এই সন্ধ্যামণি৷আর কারো পেটে বাচ্চা এলে কুদৃষ্টি দেয়। কিন্তু দেখতে তাকে বেশ সুন্দরী দেখায় বলেই তাকে ভীষণ ভালোবাসে ঝাড়–মিয়ার বাঁশঝাড়ের বটেশ্বর ভূত। সে ওই সন্ধ্যামণির ডুগডুগি বাজনাও ভালোবাসে। আর ওই আমাদের যে নরেশ স্যার, তিনি এই সন্ধ্যামণির ভয়েই প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যান। কারণ সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় এই সন্ধ্যামণির বিভিন্ন উৎপাত।
অক্টোবর-১৯৮৮, খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।

৬৭| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:১২

জসীম অসীম বলেছেন: স্বপ্ন আমার শিরোনামকে নিয়ে ছবি তোলা নিয়ে
জসীম উদ্দিন অসীম
আলোকচিত্র প্রতিবেদক : আমি ছবি তুলবো - কিংবা আমার ছবি তোলা হবে - এ উভয় বিষয়ে ছেলেবেলা থেকেই আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল। এ আগ্রহ পরে আরও তীব্রতর হয়। ১৯৯২ সালের একদিন- ঢাকার মতিঝিলে ভারতীয় দূতাবাস কেন্দ্র পাঠাগারে নীরোদ রায়ের ‘ফটো সাংবাদিকতা’ বইটি আমার হাতে পড়ে। একদিনেই সমস্ত বইটি পড়ে নোট করি এবং পরদিনই একটি ক্যামেরা সংগ্রহ করি। তারপর ঢাকা শহরে হেঁটে হেঁটে শুরু করি ছবি তোলা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ, শহীদ মিনার, নজরুলের মাজার, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় রকমারী ছবি। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে আমার বিচ্ছিন্নভাবে ফটোগ্রাফি চর্চা। ১৯৯৬ সালে আমি কুমিল্লার সাপ্তাহিক ‘আমোদ’- এ সাংবাদিকতার কাজ শুরু করি। কিন্তু ‘আমোদ’ তখন লেটার প্রেসে ছাপা হতো বলে ছবি খুব কম ছাপা হতো। ঢাকা থেকে ব্লক করে এনে ছবি ছাপানো ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ছিল বলে তখন আমার প্রেস- ফটোগ্রাফি চর্চা তেমন বিস্তৃত ছিল না। ১৯৯৮ সাল। তখন লাকসামের একটি সাপ্তাহিক কাগজ ‘লাকসামবার্তা’র সম্পাদনা বিভাগে কাজ করার বিশেষ সুযোগ পাই। কিন্তু ‘লাকসামবার্তা’ লাকসামের ছবিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ার নীতিমালা গ্রহণ করেছিল। আর আমারও তেমন সুযোগ হতো না লাকসাম যাওয়ার। কেননা তখনও আমি ‘আমোদ’- কে কেন্দ্র করেই সংবাদ- ছবি বেশি সংগ্রহ করি। ১৯৯৯ সাল। আমি তখন দৈনিক ‘রূপসী বাংলা’র বার্তা বিভাগে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। তখন আমার অনেক ছবি দৈনিক ‘রূপসী বাংলা’য় ছাপা হয়। ১৯৯৯ সালে ঢাকার পত্রিকা দৈনিক ‘আল আমীন’- এ আমি সংবাদ ও ছবি পাঠাতে শুরু করি। এ পর্যন্ত সে পত্রিকায় আমার অনেক ছবি ছাপা হয়েছে। ২০০০ সালে কুমিল্লার সাপ্তাহিক ‘নিরীক্ষণ’ পত্রিকায় আমি সহ- সম্পাদক হিসেবে কাজ করি। এ বছর পর্যন্ত আমি সে কাগজের সঙ্গেই জড়িত ছিলাম। ২০০০ সালেই আমার বন্ধু ‘দৈনিক শিরোনাম’- এর চীফ রিপোর্টার সাইয়িদ মাহমুদ পারভেজ আমাকে দৈনিক ‘শিরোনাম’- এ কাজ করার আন্তরিক প্রস্তাব দিলে আমি এ পত্রিকার সম্পাদক নীতিশ দা’র সঙ্গে কথা বলে দৈনিক ‘শিরোনাম’- এ যোগ দেই। ‘শিরোনাম’ নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। এসব স্বপ্ন আমার ছবি তোলা নিয়ে .... ছবির মতো স্বপ্ন। বিগত সময়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে সংবাদপত্রের জন্য ছবি তুলেছি আমি। কিন্তু তার অধিকাংশই অজ্ঞাত কারণে ছাপা হয়নি। গণমানুষের পক্ষে কথা বলে যে ছবি, তা ছাপা না হওয়া একজন ফটো সাংবাদিকের কাছে কতটা দুঃখজনক .....তা অবর্ণনীয়। আমি আশা করছি এবার আমার তেমন ছবি দৈনিক ‘শিরোনাম’- এ ছাপা হবে। সেসব ছবি ছাপা হলেই আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। আমার সেসব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কেবল দৈনিক ‘শিরোনাম’ সম্পাদক নন, কুমিল্লার সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক সহযোগিতা চাই।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০০১- বুধবার, শিরোনাম, কুমিল্লা।

৬৮| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: নেপাল
জসীম উদ্দিন অসীম
স্বপ্ন। দুরন্ত এক কিশোর। তার অনেক অতলস্পর্শ ইচ্ছে রয়েছে। তার প্রথম ইচ্ছে হলো নেপালের একটি পাহাড়ি মেয়েকে বিয়ে করবে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব- তা সে পরিস্কারভাবে জানে না। এটি তার মনের কল্পনা থেকে পরিকল্পনা হয়ে আছে। বাঙালী মেয়েদের ও ভালো লাগে স্বপ্নের মনে। বিশেষ করে বাঙালী মেয়ের শাড়ির জীবনকে তার কাছে এক অপূর্ব রূপের জীবন মনে হয়। সালোয়ার- কামিজ কিংবা ফ্রককেও ভালো লাগে তার মনে। কিন্তু শাড়ির বিকল্প খুঁজে পায় না। নেপালী মেয়েকে কেন বউ করে পেতে চায় স্বপ্ন? সে কি কেবল বিদেশী মেয়ে বলেই? বিদেশ বলতে তো আরও অনেক দেশ রয়েছে। শুধু নেপালী মেয়েকে কেন কল্পনায় এত ভালো লাগে তার স্কুলের বইয়ে সে পড়ছে নেপাল থেকে বাংলা কবিতার প্রথম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ উদ্ধার করা হয়েছে। সেই থেকেই তার কাছে নেপালী মানুষকে বাঙালীর কাছের মানুষ মনে হয়। স্বপ্নদের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা বুঝে না সে। জ্যোৎ¯œা রাতের আকাশ ভালোবাসে। আকাশ ভেঙ্গে জ্যোৎ¯œা নামতে দেখলে স্বপ্ন পাগল হয়ে যায়। কখনো কখনো ভাবে। আমি যে নেপালী মেয়েটিকে বিয়ে করবো, সেও হয়তো জ্যোৎ¯œা দেখে এমন করে পাগল হয়ে থাকে। নেপাল কিভাবে যাওয়া যায়? কতো দূরে নেপাল? এসব জানতে ভূগোল বইয়ের আশ্রয় নেয় সে। কিন্তু সেখানে তার মন মতো তেমন তথ্য পায় না। ভাবে- যদি তার পাখির মতো পাখা থাকতো, তবে তো উড়ে নেপাল যেতে পারতো। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আর উড়োজাহাজে করে নেপালে যাওয়ার মতো অর্থও তার নেই। নেপালী মেয়েকে তার ভালো লাগে সত্য। তাই বলে মায়ের সবুজ ভিটে ছেড়ে নেপালে সে স্থায়ী বসবাসের স্বপ্ন দেখতে পারে না। এ বিচ্ছেদের ক্ষত সে কখনো বহন করতে পারবে না। তবে সে নেপালের অনেক নিয়ম। যা তার ভালো লাগবে, তাকে মেনে নেবে বলে মনে মনে কল্পনা করে। জন্মের পর ভালো করে পাহাড়ও দেখেনি। স্বপ্ন এখন হৃদয় নেপালের পাহাড়। সেই পাহাড়ে প্রেমের অংকুরোদগম হয়েছে। কল্পনার এক নেপালী মেয়ে স্বপ্নের হৃদয় আলোড়িত করে। সে মেয়েটির ছবি সে মনে আঁকে। তারপর তাকে মনে মনে বলেÑ তুমি নেই। তাই এমন নিঃসঙ্গতা আমার। আমার হৃদয়ের মানসী, কবে তুমি আসবে আমার ঘরে। কেন তুমি আগুন হয়ে আমাকে পুড়ে যাও। স্বপ্ন ভাবে- যদি মৃত্যু এসে তাকে শীতল আলিঙ্গন করলে- যদি নেপালী সেই মেয়েকে নিয়ে ঘর- সংসারও আর না হয়। এত দুঃখ কি সে বহন করতে পারবে? স্বপ্ন আবার এও ভাবে যে, নাকি বাঙালী কোনো মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে। কেননা যদি এমন হয় যে, নেপালী মেয়েকে সে কোনদিনই আর পেল না। তাহলে এভাবে সে আর কতোকাল বেঁচে থাকবে? স্বপ্নের স্বপ্ন আর ভালো নেই। সুখে নেই তার কল্পনারা। স্বপ্ন আর কল্পনা ছাড়া তার আর তেমন কিছু নেই। তাই কল্পনাকে হারাতে চায় না সে। কাছের মানুষ কেমন করে দূরের মানুষ হয়ে যায়। ভাবতে পারে না সে। তার কাছাকাছি যারা আছে, তাদের কেউ তাকে গভীর করে ভালোবাসে না। তাই তার এত দুঃখ। তাই সে বেঁচে থাকে কল্পনা নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বেঁচে থাকে যেন সে কেবল তার দুঃখিনী মায়ের জন্য। স্বপ্নের এখন পালাবার পথ নেই। সময়ও নেই। নেই একটি পালানোর মতো জায়গা। তাছাড়া তার দুঃখিনী মা’কে ফেলে রেখে একবারও পালানোর কথা ভাবে না সে। কিন্তু তার বুকের ভিতর ফুলের কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত। বাইরে কেবল জালের গুটির টুং টাং শব্দ। বসন্ত আসেনি স্বপ্নের জীবনে। এসেছে যেন চিরবর্ষা। তাই সে তার বাড়ির সামনের পথটি দিয়ে যখন স্কুলে যায়, তখন তার নিজের কাছে মনে হয়। যেন সে হাজার মাইল যন্ত্রণার সড়ক পাড়ি দিয়ে যায়। স্কুলে যাওয়ার সে পথটি ধরে একটু গেলে এক চিলতে উঠোন পেরিয়ে ছায়াচ্ছন্ন একটি ঘর। সে ঘরের এক মেয়ে নাম সংগীতা। সেই মেয়েকে স্বপ্নের খুব ভালো লেগেছিল। তাকে আর চোখে পড়ে না। সেই মেয়েকেই ভালো লাগতো স্বপ্নের। কিন্তু যেদিন থেকে মেয়েটিকে সচরাচর চোখে পড়ে না আর, সেদিন থেকে স্বপ্ন এক কাঠখোট্টা কিশোর এখন সে নেপালী মেয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকে। অনেক অনেক দুঃখে থাকে সে। তার এ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার কোনো মানুষ নেই। মাকেও সে তার সব কথা খুলে বলতে পারে না। যে সংগীতাকে দেখে তার মনের অনুভূতির দেয়ালে নতুন রঙ লেগেছিল, সে ফিরে গেছে চোখের সামনে থেকে। এমন হোঁচট স্বপ্ন সহ্য করতে পারে না। সেই সংগীতা যখন গ্রামের এক ডাক্তারের ছেলের সঙ্গে বিভিন্নভাবে দাঁত বের করে হাসে, তখন সে আরও ভীষণ একা হয়ে যায়। তার কেবল মনে হয়Ñ নেপালের পাহাড়ী মেয়েরা অতটা হৃদয়হীনা হতে পারে না। স্বপ্নের বুকে এখন কষ্টের বালুচর। জীবনের হিসেবের খাতা বড় গোলমেলে হয়ে যায়। জীবনের তেমন সংজ্ঞা খুঁজে পায় না। মানুষ কি কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ? বারবার এমন প্রশ্ন জাগে। কেন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না, বুকের কথা খুলে বলার জন্য? কিছুদিনের জন্য স্বপ্ন চট্টগ্রামে তার মামার কাছে বেড়াতে যায়। মামা রেলওয়েতে চাকুরী করেন। অনেক দিনের সাধ ছিল তার এ চট্টগ্রাম দেখা। চট্টগ্রামে যেতে সে অনেক পাহাড় দেখেছে। এত পাহাড় বাংলাদেশে আছে, এ কথা সে আগে ভাবতে পারেনি। খুব ভালো লেগেছে এ পাহাড়। একান্ত মগ্ন পাহাড়। যখন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে রেলে যাচ্ছিল সে, তখন তার মনে হয়েছে। সে যেন নেপালে আছে। এ পাহাড়কেও তার কাছে নেপালের পাহাড়ের মতো মনে হয়েছে। এসব পাহাড় দেখে স্বপ্নের মনে হয়। বাংলাদেশ হয়তো নেপালের চেয়েও সুন্দর। এমন পাহাড়ের তোরণ রয়েছে যে দেশে, সে দেশটিকে ভালো না বেসে পারে না স্বপ্ন। কিন্তু যখন মনের কল্পনায় তার এমন বোধ হয় যে, নেপালের মেয়েদের মন বাঙালী মেয়েদেরও অধিক সুন্দর, তখন আর সে স্থির থাকতে পারে না। কিন্তু এ কথা তার কাছে কেন মনে হয়, তারও স্পষ্ট কারণ জানে না সে। চট্টগ্রামের মাথা উঁচু করা পাহাড় দেখে সে কেবলই অবাক হয়। এত পাহাড়? পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে শহর। শহরে অনেক হাল ফ্যাশনের বাড়ি। স্বপ্নের ইচ্ছে হয় সমস্ত চট্টগ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখে। কিন্তু সেই সুযোগ অল্প। তার মামা খুব বড় চাকুরী করে না। তার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মধ্যরাতে স্বপ্নে পাহাড়ে বসে পূর্ণিমা দেখার ইচ্ছে হয় বেশি। যা করা কখনো সম্ভব নয়। কারণ তার মামাই এমন শখের কথা শুনলে ধমক দেবেন। চট্টগ্রাম থেকে মায়ের কাছে নিজের গ্রামে আবার ফিরে আসে স্বপ্ন। এসে দেখে ডাক্তারের ছেলের সঙ্গে সংগীতার বিয়ে হয়ে গেছে। বুকে আগুন জ্বলে ওঠে স্বপ্নের। জ্বলতেই থাকে। তার কষ্টে যেন কেঁপে ওঠে মাটি। ভিতরে ভিতরে গর্জে ওঠে স্বপ্ন। নূরানী চেহারার ডাক্তার- যে কি- না প্রায় সময়েই মসজিদে বসেই মিথ্যে কথা বলেÑ তার ছেলের সঙ্গে সংগীতার মতো ফুটফুটে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে হয়েই গেল? ঘড়িরকাঁটাকে আর পিছিয়ে আনা যাবে না? স্বপ্নের বাবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। নূরানী চেহারার এ ডাক্তারেরই বন্দুকের খোরাক হয়েছিল তার বাবা। সংগীতার মতো মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে হতে পারলো না? ছেলেটাও তো এক রাজাকার। মুখে কোরআন- কালেমা, কাজের বেলায় মসজিদ নিয়েও ব্যবসা করে বেড়ায়। শেষে কি- না এমন ছেলের সঙ্গেই সংগীতার বিয়ে হলো? বুকের ভিতর তার কেবল বারুদ জ্বলে। এ- কি কেয়ামতের আলামত? ভেবে পায় না সে। নূরানী চেহারার এ ডাক্তার আরও আগে একটি শহীদ মিনার ভেঙ্গে তছনছ করেছিল। কলা গাছে তৈরী শহীদ মিনার। শোক দিবসের অনুষ্ঠান করবে বলে পাড়ার ছেলেরা এ মিনারটি গড়েছিল। ডাক্তার সেটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলেছিল, “এ গ্রামে এমন পুজো চলবে না। ” গ্রামে পুলিশ নেই- কিন্তু ডাক্তারের গুন্ডা বাহিনী রয়েছে। ফলে ভয়ে মুখ খুলে না কেউ। এ ডাক্তার পাকিস্তানকে দূর থেকে ভালোবাসে। দেশ স্বাধীনের আগে যেমন ছিল, এখনও তেমন পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলে। রোজা এলে ইফতারের আয়োজন করে মানুষকে ডেকে নিয়ে রাজনৈতিক আলাপ শুরু করে। বলে, ভারত এমন পরমাণু অস্ত্রে পাকিস্তানের কী করবে? পাকিস্তান কি বসে চিড়া খাবে? এসব দেখে স্বপ্নের বুকের ভিতরের সাহসী কিশোরটা শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। এ রাজাকার নামে ডাক্তার হলেও কেবল ওষুধ বিক্রিই বুঝে। আসল ব্যবসা ট্রাকের। বছরে সে শত শত মন শস্যও ফলায়। চার চারটি ট্রাকের মালিক। তার রক্তাক্ত থাবার কারণে ক্ষত বিক্ষত এ গ্রাম। একজনের দখলে পুরোটা গ্রাম যাবে? রাজাকার ডাক্তার নির্বাচনে অংশ নিলেও পাশ করতে পারে না। অনেক টাকা খরচ করে। তারপরও পারে না। এখানেই যেন ধোঁকা খাওয়া মানুষগুলোর বিজয় ফুটে ওঠে। তারপরও সে বসে থাকে না। সমস্ত গ্রামে বইয়ে দেয় পাকিস্তানী হওয়া। সুযোগ পেলেই মানুষকে বুঝায়, ‘আজকের বাঙ্গাদেশ ( বাংলাদেশ ) পাকিস্তানের সঙ্গে ভীষণ বেঈমানী করেছে। তারা ছিলেন আমাদের বন্ধু। আমাদের গুরু। গুরুবাক্যে শিরোধার্য। কিন্তু আমরা এ পাকিস্তানে যারা ছিলাম, তারা গুরুদের কথা মেনে নিতাম না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এক সময় দেখা দেয় গন্ডগোল।’ স্বপ্নের প্রায়ই ইচ্ছে হয় রাজাকার এ ডাক্তারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। আবার ভাবে, এখনও সময় আসেনি। সময় এলে সে তার বাবার খুনীকে ছাড়বে না। গ্রামটাকে নামাতে নামাতে সে অনেক নিচে নামিয়েছে। আর সহ্য করা যায় না। স্বপ্নের এমন মনোভাব অল্প হলেও বুঝতে পারে নূরানী চেহারার ডাক্তার। ফলে সে ভিতরে ভিতরে স্বপ্নকে খামচে ধরে পুরনো শকুনের মতো। স্বপ্নের মতো এমন পিতৃহীন বালক এত মেধাবী থাকবে কেন? কেন সে এত গরীব হয়েও প্রেমের স্বপ্ন দেখবে? স্বপ্নের স্বপ্ন খুন করে দেবে বলে, ডাক্তার গোপনে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্বপ্ন হাল ছেড়ে দিতে না পারা এক কিশোর। নিজেকে সে ফাঁকি দেয়া বুঝে না। তাই সে রাত জেগে জ্যোৎ¯œা দেখে। চাঁদের মুখে বাবার মুখটা দেখতে চেষ্টা করে। সে আগে জানতো না একাত্তরে তার বাবাকে কে গুলি করে মেরেছিল। চট্টগ্রাম থেকে আসার পর এবার তার মা সেই গোপন কথাটি বলেছে। ছেলে একটু বড় হয়েছে। আর না বললে চলে না। কতোদিন আর গোপন রাখা যায়? স্বপ্নের বাবার একটি ছবিও নেই। কেন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একটি ছবিও থাকবে না? মায়ের কাছে স্বপ্ন তার বাবার মুখের বিবরণ শুনতে চায়। তারপর মনের মধ্যে কল্পনায় বাবার একটি ছবি একেঁ নেয়। সংগীতাকে ছেড়ে তার দিন কাটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। তারপরও অসহায় মাকে ফেলে দূরে কোথাও যায় না। ভাবে না আর পাহাড় নিয়ে। কখনো কখনো জমিতে যারা কাজ করে, তাদের সঙ্গে পড়ে থাকে। গ্রামে ওদের বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু ওর শরীরে কেমন একটা বিদ্যুৎই খেলা করে। সেই বিদ্যুৎ নূরানী চেহারার রাজাকার ডাক্তারকে পুড়িয়ে মারতে চায়। এরই মধ্যে নদীর পাড় ভেঙ্গে বন্যা এসে ফসল ডুবিয়ে দেয়। স্বপ্নদের উঠোনের সবজিগুলোতে পোকা আক্রমণ করে। তবু স্বপ্নের বিশ্বাস ভাঙ্গে না। ভাবে- এত বছরেও গ্রামটা স্বাধীন হলো না? এখনও গ্রামে ভিতরে ভিতরে পাকিস্তানী শাসন চলে? হাজারবার ভেবে দেখতে চেষ্টা করে, কেমন করে সেই ডাক্তারকে শাস্তি দেবে। পাকিস্তানের বিদ্রোহী আত্মাটাকে কেমন করে তাড়াবে এ গ্রাম থেকে? রাতের বেলা ঘুমের অচেতন রাজ্যে স্বপ্ন এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। দেখেÑ নূরানী চেহারার সেই ডাক্তার স্বপ্নকে ডেকে বলছে, ‘তুই নেপাল যাবি? আমি দেব টাকা। আমি তোকে নেপাল পাঠিয়ে দেব। নেপাল- পাকিস্তানে আমার কয়েকজন বন্ধু রয়েছে। তুই বললে এখনই পাঠাতে পারবো। যা এ দেশটা ছেড়ে চলে যা। এ দেশটা বড় অসুন্দর। এদেশে আর থাকিস না।’ সহসা স্বপ্নের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। এ রকম স্বপ্ন সচরাচর দেখে না সে। তাই ঘুম থেকে চিৎকার করে বলে ‘ধুশ শালার নেপাল’। স্বপ্নের মা তখনও ঘুমায়নি। রাতের বেলা সে হাতের কাছে রামদা রেখে ঘুমায়। ছেলের এমন চিৎকার শুনে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে কী হয়েছে বাবা, দুঃস্বপ্ন দেখেছিস? স্বপ্ন তার মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, ‘মা আমি নেপাল যাবো না’। তারপর ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে স্বপ্ন। স্বপ্নের মা ডানহাত দিয়ে বিছানার নীচটা পরীক্ষা করে দেখে রাম দা- টা জায়গায় আছে কি না। দেখে রাম দা আছে।

৬৯| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:২১

জসীম অসীম বলেছেন: শিপ্রা-র খুনের প্রতিশোধ
জসীম উদ্দিন অসীম
কেমন ছিলো আদিম যুগের মানুষ? প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ? তারা কি প্রতিবাদ করতো? তাদের গায়ের অসীম শক্তি দিয়ে পাথর ছুঁড়ে তারা পশু শিকার করতো। কিন্তু এতো ছিলো তাদের বাঁচার সংগ্রাম। তারা কি প্রতিবাদ করতো? এসব কথা চঞ্চল ভাবে। কিন্তু চঞ্চলের প্রতিবেশী আখতার কেড়ে নিয়েছে বিভিন্ন ছলচাতুরিতে চঞ্চলের পাওনা ভূমি। বসতের জ্যোৎ¯œা- নামা জমি। দেহে- শরীরে আখতার যেন এক হাতি। তাই সত্য কথা বললেই চঞ্চল, উত্তেজিত হয়ে সে মারতে আসে চঞ্চলকে শত-সহ¯্র লাথি। চঞ্চল বলে, ধন্য জীবন, শূণ্য তাই। পূর্ণ জীবন খুঁজে পেতে এবার যোদ্ধা হতে চাই। চঞ্চল কর্মকার, শর্বরী কর্মকারকে ভালোবাসতো। কিন্তু শর্বরী এখন কোথায়? চঞ্চল জানে না। তাই সে শুধু সারাদিন শর্বরীকে খুঁজে এবং রাত হলে কেবল কবিতা লিখে। মানুষের এ পৃথিবীটা সৃষ্টি হয়েছে পাঁচশত কোটি বছর আগে। কিন্তু তখন না ছিলো গাছপালা এবং না মানুষ। মানুষের ইতিহাস শুরু হয় তারও পর থেকে। সেই গরিলা কিংবা বানর চেহারার মানুষের যুগে কি চঞ্চল আর শর্বরীরা ছিলো? ছিলো পর্বতের পাদদেশে কিংবা বনে- জঙ্গলে। দুঃখজনক হলো, যখন রোম পুড়ে, তখন নীরো বাঁশি বাজায়। আর যখন চঞ্চল শর্বরীকে ভালোবাসে, তখন আখতার চঞ্চলের জমি দখল করে নেয়। তবু ভয় নেই চঞ্চলের। চঞ্চল অন্ধকারকে জয় করতে জানে। তাই একদিন আখতার শিক্ষা পাবেই। চঞ্চল এক স্বপ্নবাসী। প্রয়োজনে সে হাসি মুখে বরণ করবে ফাঁসি। তবু মেনে নেবে না এমন আখতারের জবর দখল। তাই ঘুমের ভিতরও চঞ্চল প্রায়ই চিৎকার করে এ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বলে ওঠে, তুমি আখতার নিয়েছো কেড়ে আমার পাওনা ভূমি। আমি এক নদীমাতৃক নারীর সন্তান। ফসলের ক্ষেতে একদা আনন্দে থেকেছি মেতে। তুমি নিয়েছো আমার সেই মাটির ঘ্রাণে প্রাণ বাঁচানো জমি। তাই আমার ইস্পাত হাতের ছোবল থেকে কক্ষনোই রেহাই পাবে না তুমি। গাছের ছায়ার মায়া মাখা জমি আমার খেয়েছো তুমি কেড়ে। আমিও হবো সহসা দমকা হাওয়া। আখতার, তোমাকেও আমি এই চঞ্চল, কক্ষনো দেব না ছেড়ে। শর্বরীর নৃত্যকলা পাগল করে দিয়েছে চঞ্চলকে। উদীচী করতো মেয়েটা। সমবেত নৃত্যেও নেতৃত্ব দিতো। নাচ শিখেছিলো নামকরা এক একাডেমি থেকে। ‘বাজার সংস্কৃতি’ বিরোধী এই মেয়েটার সঙ্গে কতদিন চঞ্চলের দেখা নেই। রাশিয়ার ক্রেমলিন বিষয়েও অনেক জানতো মেয়েটা। নিকোনভ নামে এক রাশিয়ান যুবকের সঙ্গে তার একসময় নাকি যোগাযোগও ছিলো। কিন্তু যেদিন, অর্থ্যাৎ শর্বরী যেদিন এইচ এস সি- র উচ্চতর গণিত পরীক্ষা দিচ্ছিল, সেদিন বুর্জোয়া একটি ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখার কর্মীরা কলেজ চত্বরে দলীয় মিছিল বের করার চেষ্টা করে। কলেজের অধ্যক্ষ এ কাজে বাধা দিলে ওই সংগঠনের ক্ষিপ্ত কর্মীরা কলেজের দোতলার উঠে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। গ্লাস ভেঙ্গে চোখে পড়ে শর্বরী কর্মকারের। তারপর হাসপাতাল এবং পুলিশ। তারপর ডট ডট। শর্বরী কর্মকার চট্টগ্রামের মেয়ে। অথচ একদিন চঞ্চল তাকে নিয়েই গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে গিয়েছিলো। ঢাকা- ময়মনসিংহ সড়কের পাশে শাল- গজারীর এ বনে যখন চঞ্চল শর্বরীকে নিয়ে ঘুরেছে, তখনও ভাবেনি সে তারই প্রতিবেশী আখতার তার এমন সর্বনাশে লিপ্ত রয়েছে। কে- ই- বা তার নিজের প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে গাছের ছায়ায় পাতা মাড়িয়ে মর্মর শব্দ তুলে বেড়ানোর সময় তার বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ভাবে? চঞ্চলের বাবা পরিতোষ কর্মকারের মৃত্যুর পরই সব বিপদ দেখা দেয়। চঞ্চল তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হঠাৎ খবর পেল চট্টগ্রামের বাটালি পাহাড়ের কিছু অংশ ধসে কিছু লোকের মৃত্যু হয়েছে। দেখতে গেলো সে। ঘটনাটা শহরের টাইগারপাসের ঘটনা। তখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মরেছে ঘুমন্ত বস্তির লোক। সুতরাং ছাত্র ইউনিয়ন করা একটি ছেলে কী করে বসে থাকে? সে কাজ না করুক ফায়ার সার্ভিসে কিংবা সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে, দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন তাই তার বিবেকের দায় হয়ে দেখা দিয়েছিলো। ওখানে গিয়েই তার দেখা হয়েছিলো যদুনাথের সঙ্গে। যদুনাথ আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী চঞ্চলের এলাকার ছেলে। বললো, সব খবর জানি না আমি- একবার বাড়িতে যাও। এই যদুর নামেই এক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, স্যার যদুনাথ সরকার। তার লেখা: ‘মিলিটারী হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইটি এখনো পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে পারেনি চঞ্চল। যদুর কথামতো চঞ্চল বাড়িতে এসে শুনে তার নামে তারই প্রতিবেশী আখতার হোসেন এক অভিযোগ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বলছে, আখতারের বড় ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহযোগিতার কথা বলে নাকি চঞ্চল কিছু টাকা নিয়েছে। কিন্তু না করেছে তার ছেলেকে ভর্তি কিংবা না ফেরৎ দিয়েছে তার টাকা... ইত্যাদি। অথচ আখতার এ নিয়ে একবার কথা বলেছিলো চঞ্চলের সঙ্গেÑ কোনো টাকার লেনদেন হয়নি। এই সমস্যার সমাধান বিষয়ে যখন নিজের এলাকায় খুব ব্যস্ত চঞ্চল, তখনই আবার খবর পেল শর্বরী কর্মকারের চোখ সারার পর রিকশায় করে আবার একদিন কলেজে যাওয়ার পথে কে বা কারা পাথর ছুঁড়ে তার সেই বা চোখটিকেই আবার চিরতরে বিনষ্ট করে দেয়। সেদিন শর্বরীর চোখ থেকে যত রক্ত ঝরেছে, খবরটা শোনার পর চঞ্চলের দু’চোখ থেকেও তত অশ্রু ঝরেছে। চঞ্চলের জাপানী বন্ধু কায়ও আজুমা তাকে এ বিষয়ে বারবার সান্ত¡না দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবায় চঞ্চলের গ্রামের বাড়ি। ওদের কিছু জমি আছে, যেগুলোতে ধান ফলে খুব ভালো। কিন্তু এই জমিগুলোর সমান্তরালে রয়েছে সেই আখতারের জমি। প্রতি বছর ধান কাটাকে কেন্দ্র করে আখতারের সঙ্গে বিভিন্ন ঝামেলা বাঁধে। কোনো কোনো বছর কিছু ধান চুরিও হয়। কে বা কারা চুরি করে, চঞ্চলের সন্দেহ বাড়ে আখতারের প্রতি। এতে দু’জনের সর্ম্পক আরও খারাপ হয়। এই খারাপ সর্ম্পক থেকে বাড়ির ঘরে শৌচাগারেও রাতের বেলা ঢিল পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো সেদিন, যেদিন এই ঢিল মারাকে বিষয় করে ঝগড়া হলো সেই মধ্যরাতে চঞ্চলদের ঘরে আগুন দেয়। পন্ডিতবাড়ি ও ধোপাবাড়ির লোক এসে আগুন জল ঢেলে খুব দ্রুত নিভিয়ে ফেললেও ততক্ষণে অনেক কিছুই পুড়ে শেষ। গাঙ্গুলি বাড়ির কানাই লাল গাঙ্গুলি এতো বড় দুর্ঘটনার দিনও চঞ্চলের মাকে কড়া ধমক দেয়। তোমার ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করো। না হয় আরও ভোগান্তি কপালে তোমাদের আছে। মুসলমান বাড়ির সঙ্গে লাগতে যায় তোমার ছেলে। লেখাপড়া শিখে কিছু মাথাটাই তার বাতিল হইয়া গেছে। সরকার বাড়ির সহদেব চন্দ্র বলে, তোমার ছেলে বোকা, চঞ্চলের মা। কয়টা দেওয়াল ভাঙ্গবি তুই? ঘরে আছে তোর যুবতী একটা বোন, বাপটা গেল মইরা। তোর কি মনে বিষ রাখা ঠিক? চঞ্চল আপাতত: সব কথাই শুনে। কারো কোনো কথার প্রতিবাদ করে না। বৃদ্ধ দয়ারাম রায় বলে, চঞ্চল, প্রথম দেওয়াল দ্বিতীয় দেওয়াল ভাঙ্গন যায়। কিন্তু এত দেওয়াল। শেষ দেওয়াল পর্যন্ত ভাঙ্গন যায় না। একসময় আমাগো শরীরের রক্তও কম গরম ছিলো না। চঞ্চলের ছোট বোন শিপ্রা কর্মকার বলে, শেষ দেওয়ালটা হইল মরণ কাকা। ওই দেওয়ালের কাছে সবাই হারে। আকাশের পাখি যেমন শেষ পর্যন্ত মাটিতেই নামে। চঞ্চলের মা লীনা কর্মকার কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাদের বাছুরটা মরলো সে তো অনেকদিন। গাভীটা এখনও চোখের জল ফেলে। আমি আমার সর্বনাশ ভুলতে পারবো না। পাড়ার ছেলে রমেন্দ্র বলে, নীলা বৌদি, তোমার ছেলে থাকে তো শহরে- গ্রাম ভুইলা গেছে। ওখানে গিয়া করে এক রাশিয়ান পার্টি- ও পার্টি বাল এই এলাকার লোকে চিনে না। চিনলে কি আর তর লগে লাগে কেউ? পুলক, অলক ও তাপসও এই কথায় গলা মেলায়। পুলক বলে, ওই রাশিয়ান পার্টির খোঁজ তো এই এলাকার কেউ রাখে না, ডাইরেক্ট চঞ্চলদা’ কে কেউ কেউ বলছে ও নাকি ইন্ডিয়ার এজেন্ট। ঘুম থেকে জাইগাই সব ইন্ডিয়ার খরচ খাবি, আবার গালির সময় ইন্ডিয়ারে...। চুপ করা। পুলককে ধমক দেয় সজল কান্তি। বলে, আর একটা কথা বাড়াইস না। আখতারের বাড়ির লোকজন ওই দেখ, কান খাড়া কইরা সব কথা গিলছে। এই কথা বলামাত্রই তুলশীতলার পেছন থেকে একজন লোক দৌড়ে পালিয়ে যায়। অন্ধকারে তার চেহারাও দেখা যায় না। পরদিন সকালে বাজারে যাওয়ার সময় নুরুল ইসলাম মাস্টারের সঙ্গে দেখা হয় চঞ্চল কর্মকারের। নুরু মাস্টার বলেন, চঞ্চল, তোমার বাবার সঙ্গে কতো বন্ধুত্ব ছিলো। নিখিল দা’ এত ভালো মানুষ ছিলেন। তার পরিবারে এত অত্যাচার শুরু হলো, ঘটনাটা কী! চঞ্চল বলে, জানি না কাকা, কপালে ছিলো। ছোটবোনটার কানে যেন কী একটা ব্যথা, বাজারে যাই। মাকেও সেদিন নিউরোলজির এক ডাক্তার দেখালাম শহরে গিয়ে, উপকার কিছু অনুভব করতে পারছি না। নাকি মা বাবার মতো হৃদরোগের কোনো সমস্যায় ভুগছেন, কে জানে। নুরুল ইসলাম মাস্টার বলেন, শোনো চঞ্চল, উত্তরমেরুর খ্যাঁকশিয়াল শীতে থাকে সাদা, আবার গরম এলেই তার রং বদলে যায়। আখতারদের সঙ্গে লড়তে পারবা না। ওরা বদলোক। কোরবানীর সময় সে ইন্ডিয়া থেকে এক অফিসিয়াল টোকেনে পাঁচবার গরু আনে। আগে তো টোকেন ছাড়াই কারবার করতো। যেই লোকটা সরকারের সঙ্গে এমন, তার ব্যবহার তোমার সঙ্গে কেমন হবে? আমি শুনছি অন্য কথা। আজ থেকে আর তুলশীতলায় প্রদীপ জ্বালাতে শিপ্রাকে পাঠায়ো না। তার প্রতি চোখ রেখো। মাস্টারের এমন কথায় খুব অবাক হয় চঞ্চল। কেন কাকা, কিছু শুনছেন? মাস্টার বলেন, শুনছি কিছু। সাবধানে থাকবা। চঞ্চল হতাশার রাজনীতি করে না, তবু সে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ে। চঞ্চলের জীবন এক কেবল হারাতে থাকা জীবন। সেই শৈশবে এক প্রেমিকাকে হারিয়েছিলো। তখন চঞ্চল নবম শ্রেণীর ছাত্র। একই গ্রামের প্রিয়াঙ্কা সেন গুপ্তাকে ভালোবাসতো চঞ্চল। কিন্তু একদিন স্ত্রী মঞ্জুশ্রী সেন গুপ্তা এবং একমাত্র কন্যা প্রিয়াঙ্কা সেন গুপ্তাকে নিয়ে রমাকান্ত সেন গুপ্ত চিরতরেই ভারতে চলে যায়। তখন এই চঞ্চল কর্মকারের আর প্রিয়াঙ্কা সেন গুপ্তার নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া কোনো গতিই ছিল না। সে কথা মনে হলে প্রায়ই তাকে পেয়ে বসে নস্টালজিয়ায়। ডায়েরিতে লিখে তখন, জীবনের প্রথম প্রহরে যার জন্ম হয়েছিল, মধ্যাহ্নের আগেই তাকে শিশিরের মতো আমি হারিয়েছে হায়। এখন চলে যেতে বসেছে ¯িœগ্ধ জ্যোৎ¯œা- নামা জমি। আমি তো কারো ক্ষতি করিনি কোনোদিন। সৃষ্টি- পাগল এক শিল্পী ছিলাম। তখন জল- স্থল- অন্তরীক্ষ ঘুরে রূপ- রস এনে প্রিয়াঙ্কাকে সৃষ্টি করেছিলাম। সেই প্রিয়াঙ্কা ক্ষুধা- তৃষ্ণার সীমা ছেড়েছিল। সৃষ্টিপ্রবণ শিল্পপাগল সংগীতপ্রিয় এই চঞ্চল কর্মকারের জীবন থেকে প্রিয়াঙ্কা সেন গুপ্তার চলে যাওয়ার পর এ তার জীবন থেমে গিয়েছিলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র লেখাপড়াটা করে গেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পরিচয় শর্বরী কর্মকারের সঙ্গে। সেই থেকে আবার তার জীবন দখল করে নেয় উদীচীকন্যা শর্বরীর নৃত্যকলা। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হলেও সব বিষয়েই পড়তো মেয়েটা। কিন্তু একদিকে একটি চোখ গেল মেয়েটার, অন্যদিকে চঞ্চলের বাড়িতে লাগল আগুন। যন্ত্রণার ছুরিকাঘাতে, মন্দার বাতাসে তার জীবনটা এখন বিপন্ন। সুখ যেন তার জীবনে নেই- দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে রয়েছে। বড় কঠিন এই সুখের পথ খুঁজে পাওয়া। স্থান- কাল এবং সমাজের বিভিন্ন পাত্রপাত্রীও যেন তার বিপক্ষে চলে গেছে। তার জীবন- সংগীতের নদী যেন আটকে পড়েছে চরে। সেই সুযোগে একই গ্রামের প্রতিবেশী প্রতাপশালী আখতার জমিও কেড়ে নিতে চায় কেড়ে। মস্তিস্কের অসুখ হলে তাঁর চিকিৎসা চলে হাসপাতালে। কিন্তু চঞ্চলের অনেক রোগই তার হৃদয়ে। তাই চঞ্চল কখনো কখনো তার ভিটার কিংবা জমির কথা ভুলে তার হারানো অথবা আহত প্রেমিকাকে খুঁজে। প্রিয়াঙ্কার কথা মনে হলেই ভাবে, সে কি এখন ভারতে সুখে আছে? মনে রেখেছে তাকে? নাকি সে আজ অন্য কোনো নতুন প্রেমিকের ব্যক্তিগত সড়ক? ত্রিপুরার দুর্গম পাহাড়ী জীবনে, কে জানে কেমন কষ্টে সে বেঁচে মরে আছে! তাকে হারিয়ে সে যেন হয়েছিল পরিচয়হীন এক যুবক। যেন সে তার পতাকা পুড়ে ফেলেছিল। চঞ্চলের বাবা দীর্ঘায়ুদের দলে তার নাম লেখাতে পারেননি। তেমনি মনে হয় চঞ্চলের জীবনের সমস্ত অপূরণের আগুনও তাঁকে পুড়ে করে যাবে বাড়িঘর লোকালয় ছাড়া। তার শরীরে যেন কোনো শরীর নেই- অবশিষ্ট আছে কিছু ভস্মমাত্র। না মরেও, জ্বলন্ত চিতায় না গিয়েও সে ভস্ম হয়ে গেছে আজ এ সমাজের বিভিন্ন যন্ত্রণার চাপে। বিশেষ করে ঐ যে তার বাবার বন্ধু নুরুল ইসলাম স্যার বললেন আরেক বিপদের কথা। আজ থেকে আর তোমাদের তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাতে শিপ্রাকে পাঠাবে না। নির্দেশ দিলেন স্যার... কিন্তু কারণ ব্যাখ্যা করলেন না। হঠাৎই মনে হয় চঞ্চলের, তবে কি কোনো দুষ্টু চক্রই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে শর্বরীর চোখে ঢিল মেরেছে? খুব শিগগিরই তাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে আবার। অথচ এদিকে বাড়িতেও কতো বিপদ লেগে আছে। এ অবস্থায় কী করবে চঞ্চল কর্মকার? ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় এক নেতার কথা মনে পড়ে তার। তিনি বলেছিলেন, টেম্পার না করালে কোনো কাঁচ অল্প আঘাতে ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে যায়। তাই সমাজের বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হলেও আমাদের নিজেদের জীবনগুলোকেও টেম্পার করাতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই চিন্তায় রীতিমত বিপ্লবী পরিবর্তন আসতে থাকে চঞ্চলের। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দাবীদাওয়া পূরণের লক্ষ্যে মিছিল- মিটিংয়ে অংশ নিয়ে তার সাহস খুব বেড়ে যায়। দেশের সাধারণ মানুষের শ্রমে- ঘামে অর্জিত অর্থে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। এখানে তাই কোনো অন্যায় বরদাশত করবে না চঞ্চল। বিতর্ক অনুষ্ঠানে, নাটক কিংবা সংগীত পরিবেশনে, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে, সংগঠনের গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজে... সর্বত্রই সে ছিল মুখরা। সহসা তার পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন ঝড় আসায় থমকে যায় তার গতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার, কোষাধ্যক্ষ, উপ- উপাচার্য... সবার সঙ্গেই ছিল তার সুসর্ম্পক। কিন্তু এলাকার কালো টাকার মালিক আখতারের চোখ পড়েছে এখন তাদের ভিটার দিকেই। এ নিয়ে সে অশান্তিতেই আছে। কালোবাজারে টাকা খাটিয়ে সে এখন এত টাকার মালিক, কল্পনাও করা কঠিন। নুরুল ইসলাম স্যার আবারও বললেন, আরেক ভয়ংকর কথা। এই আখতারই নাকি প্রিয়াঙ্কার বাবা রমাকান্ত সেনগুপ্তের কাছ থেকে তার সব ভূ- সম্পত্তি পিস্তল দেখিয়ে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিল। এই নুরুল ইসলাম স্যার, জীবনে কোথাও কারো সঙ্গে একবিন্দু মিথ্যে কথা বলেছেন, তেমন কোনো নজির নেই। তাই আখতারের বিষয়ে এই শেষ কথাটা শুনে মাথায় রক্ত উঠে যায় চঞ্চল কর্মকারের। সারাজীবন করলি ফেনসিডিলের ব্যবসা, আর এখন? কিছুদিন আগে কী এক অসুখে ভারত থেকে চিকিৎসাও নিয়ে এসেছে আখতার। এখন সুস্থ। কিন্তু মৃত্যু ভয়ের বদলে উল্টো আরও সম্পদের লোভ বেড়েছে তার। যেন সে তার সব সম্পদ কবরে নিয়ে যাবে। ওদিকে অনেকদিন শর্বরীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই চঞ্চলের। শেষ চিঠি যে কবে লিখেছিলো, মনে পড়ে, কিন্তু সেটা কয়েকমাস আগে। নুরুল ইসলাম স্যারকে তার বাড়িতে গিয়ে চঞ্চল আবার জিজ্ঞেস করে, স্যার, আমাদের তুলসীতলায় শিপ্রাকে কেন প্রদীপ জ্বালাতে পাঠাবো না? নুরুল ইসলাম স্যার রেগে যান এই প্রশ্ন শুনে। এত ব্যাখ্যা দিতে পারবো না এখন। কথায় সন্দেহ থাকলে পাঠাও তোমার বোনকে। ফের আর কোনো কথা বলতে পারে না চঞ্চল। সহসা তার শর্বরীর কথাও খুব মনে পড়ে। অনুপ ঘোষালের কন্ঠের গান ‘তুমি ফিরাবে কি শূন্য আমারে’ শর্বরীর কন্ঠে এই গান শুনে সে যে মুগ্ধ হয়েছিলো, এখনো তার রেশ যেন মনে লেগে আছে। কিন্তু ঐ হারামী আখতার কী ধরনের মানুষ? সে তো কোনোদিনও পড়েনি বিশিষ্ট গল্পকার কমলকুমার মজুমদারের কোনো লেখা, দেখেনি ১৯৪৭ এ স্বাধীনতার নামে দুই বাংলায় কতো হারিয়েছে মানুষ। অথচ তারই আপন কাকা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তিনি কতো ভালো মানুষ। অথচ চঞ্চলের সঙ্গে আখতার আচরণটাই এমন করে বসে, যেন চঞ্চল এই এলাকার কোনো বহিরাগত। অথচ চঞ্চলের বাবার সব সময় স্বপ্ন ছিলো চঞ্চল লেখাপড়া শিখে ¯œাতক হবে, অভিসন্দর্ভ রচনা করে এলাকার একজন আলোকিত মানুষ হবে। অথচ আখতারের অত্যাচারে চঞ্চলের এখন ইচ্ছে হয় অন্ধকার রাজ্যে ফিরে যায় এবং তারপর শোধ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চঞ্চল আসলে আখতারের প্রতি সহিংস হতে পারে না। আর আখতারও সেই সুযোগেরই দারুণ ব্যবহার করে। এতকিছুর পরও অমাবশ্যায় চন্দ্রোদয় হয়ে তার জীবনে এসেছিলো যে শর্বরী, তার এখন কতো বিপদ যাচ্ছে। সেই বিপদে সব বন্ধুদের সহানুভূতি থাকলেও চঞ্চলের সঙ্গে শর্বরীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক দুঃখের পরও নিজ হৃদয়ের বন্দী কথাগুলো খুলে বলতে পেরেছিলো সে এই শর্বরীকেই। তার হৃদয় ছিলো সমতলই। কিন্তু যেই শর্বরী দুর্ঘটনার শিকার হলো, সেই থেকে চঞ্চলের পরিবারেও দেখা দিল একের পর এক বিপদ। পাষাণ এই দুর্ঘটনা এসে যেন খাঁচায় বন্দী করে অনেক দূরে নিয়ে গেলো শর্বরীকে। সেদিন থেকেই চঞ্চলের পরিচিত পৃথিবীটা খরায় খরায় ভরে গেলো। কোথাও খুঁজে যেন আর পাওয়া গেলো না একফোঁটা জল। গল্পকার শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পগুলো শর্বরীর খুব প্রিয় ছিলো। শর্বরীর বাবার চট্টগ্রাম শহরে ডিলারশীপের ব্যবসা। ঘুষ না দিয়ে কোনো দ্রব্য উত্তোলন করতে না পারলেও, রেট বাঁধা ঘুষের টাকার লেনদেন ছাড়া তিনি ব্যবসা করতে পারলেও নিজের একমাত্র মেয়েকে করতে দিয়েছেন কমিউনিস্ট সত্যেন সেনের সংগঠন উদীচী। বাবা হিসেবে প্রবুদ্ধ কর্মকার এ জন্য গর্ববোধও করেন। একসময় চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডে চাকুরি করলেও পরে ছেড়ে দেন। কিন্তু সহসা তার মেয়ের জীবনে নেমে আসা এ দুর্ঘটনা অথবা বিপদ অথবা ষড়যন্ত্রে তিনি রীতিমত দিশেহারা। ওএমএস ডিলার প্রবুদ্ধ কর্মকার জীবনে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত হয়েছেন একজন খাদ্য গুদামের ডিলার। অথচ মেয়েকে নিয়ে এভারেস্ট বিজয়ী স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেলো তার জীবনে। উত্তর পাহাড়তলীর পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে ভাড়া থেকেও মেয়েকে নিয়ে সংসারে সুখে ছিলেন। মেয়ের মেধাশক্তিতে তার ভরসা ছিলো। মেয়ের শরীরের বর্ণও কাঁচা সেরা হলুদ যেন। ২৩ বছরের এ মেয়ের চোখে কে পাথর মারলো, এ নিয়ে থানার এস আই আবুল হোসেন বলেন, এলাকাবাসীর কাছে গিয়ে শুনলাম ঢিলটা এসেছিল পাশের একটি রিকশার গ্যারেজের কাছ থেকে। কিন্তু পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কাকে গ্রেফতার করি বলুন। তাই মামলাটা আমি নিলেও এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারিনি। এলাকার লোক জানায়, শর্বরীর চিৎকার শুনে তাকে তারা সাহায্যেও জন্য এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু ঢিল ছোড়া কাউকেই তারা দেখতে পায়নি। একটি লোক পাথর মারবে আর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করে কেউ পুলিশে দিতে পারবে না- এটাকে মানতে পারে না প্রবুদ্ধ কর্মকার। নেত্রকোনার পূর্বধলার কুমুদরঞ্জন বাজারের কাছেই প্রবুদ্ধ কর্মকারের বোনের শ্বশুর বাড়ি। শর্বরীর দুর্ঘটনার খবর পেয়েই সেই বোন কানন কর্মকার চট্টগ্রাম চলে আসে। আসার দিন ঢাকা- ময়মনসিংহ সড়কে ছিলো কী নিয়ে এক অবরোধ। সারা পথেই কানন তাই কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। এসে যখন শর্বরীর ঠিক এমন সর্বনাশ দেখেছে, তখন তার আর বিলাপ থামায় কে। এসব বিষয় নিয়ে প্রবুদ্ধ কর্মকার একদিন চট্টগ্রামের এ এস পি- সার্কেল- এর সঙ্গেও কথা বলে। এ এস পি থানার ওসি -কে আবার ফোন করে বিষয়টির তদারকির নির্দেশ দেন। এস আই সহ পুলিশ আবার সেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। কিন্তু এতে তেমন উপকার পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ দাশ পড়া মেয়ে শর্বরীর চোখ প্রতিদিন দেখেছে ঘাসফুল, ফড়িং ... ইত্যাদি। হঠাৎ চোখে কাঁচ কিংবা পাথর এসে পড়বে, এটা কি ভাবা গেছে? শর্বরীর পড়ার রুমে জওহরলাল নেহেরুর একটি ছবি রয়েছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ ছবিটা শর্বরীর খুব প্রিয়। আর প্রিয় লেনিনের ছবিটাও। কিন্তু দু’নেতা এক মেরুর না হলেও একই রুমে শর্বরী তাদের ছবি রেখেছে। বারান্দার টবের ফুল ফোঁটা বেলি ফুলের গাছ। অথচ এখন শর্বরীর মনে হয় চোখ দুটি তার কতো কতো আপন। সেদিন প্রবুদ্ধ কর্মকারকে এ এস পি- ও বলেছেন, পুলিশ দিয়ে কি মানুষ ঠিক করা যায়- মানুষ যদি নিজেকে নিজে ঠিক না করে? প্রবুদ্ধ কর্মকারের ঠিক তখনই কল্পনা চাকমার কথা মনে পড়ে যায়। ১৯৯৬ সালের এক মধ্যরাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে তার নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়েছিলো। তারপর তাঁকে আর উদ্ধারও করা যায়নি এবং তার অপহরণের রহস্যও উদঘাটিত হয়নি। যদি কেউ তার মেয়েকে টার্গেট করে থাকে। কমপক্ষে সে রকম বিপদ থেকে তো মেয়ে তার রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু মন ভেঙ্গে যায় শর্বরীর। টিভি- তে সে যখন লক্ষ্মৌ ঘরানার কত্থক নৃত্যপটিয়সী মুনমুন আহমেদের সলো পারফরম্যান্স দেখে, তখন তার ভীষণ কান্না পায়। আর কি সে কোনোদিনও মঞ্চে পারফরম্যান্স করতে পারবে? প্রবুদ্ধ কর্মকার মেয়েকে সান্ত¡না দেয়। বলে, আমার বাবার মতো মনটা শক্ত করো। বাবা বৃটিশ আমলে চাঁদপুর হয়ে স্টিমারে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ট্রেনে সরাসরি কলকাতা যেতেন। একবার ডাকাত বাবার পিঠে গুলি করে বসে। বাবা পালিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চলে যান। দীর্ঘদিন পর মোটামুটি সুস্থ হন। তাহলে, গুলি খেয়েও বাবা আরও চল্লিশ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। শর্বরী তার বাবাকে বলে, মানে তুমি আমাকে চোখ দেখাতে ঢাকায় নিয়ে যাবে। প্রবুদ্ধ বলেন, অবশ্যই। শর্বরী বলে, তাহলে বাবা কথাটা এত ঘুরিয়ে বলার দরকার কী? প্রবুদ্ধ কর্মকার বলে, সেটা তো আমার পুরনো অভ্যাসরে মা। দুর্ঘটনার পর আর যোগাযোগ নেই চঞ্চলের। কেন? শর্বরীর চোখের বিষয়টা কি ওদের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে? যেদিন থেকে শর্বরীর জীবন থেকে চঞ্চল প্রায় অনুপস্থিত, সেদিন থেকে তার জীবন থেকে যেন জীবন চলে গেছে। কতো দিকের দুঃখ সইবে সে? সে ও তো একজন মানুষ! একদিকে এই চোখের সমস্যা, অন্যদিকে প্রিয় মানুষটি কাছে নেই। তাই আজকাল খুব বেশিই হতাশ হয়ে পড়ে সে। মনে মনে বলে, মাথাটাকে রাখতে আজ পর্যন্ত কোল পেলাম না তার। বীজ দিয়ে কী করবো আমি, যদি না পাই মাটি। চোখ দিয়েও বা কী হবে, যদি আমার প্রিয় মানুষকে দেখতে না পাই। এতো শত আগুন নিয়ে কি মানুষের জীবন চলে? অজন্তার গুহাচিত্রের শৈলীতে কি মানুষের হৃদয়ের এই অগ্নির ছাপ আছে? আজকাল এমন সব স্বপ্নচিন্তাই শর্বরীর মাথা দখল করে রাখে। ওদিকে চঞ্চল কর্মকারের বাড়িতে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হয় ওই তুলসীতলাতেই। বারণ না শুনে চঞ্চলের বোন শিপ্রা গিয়েছিলো প্রদীপ জ্বালাতে। তারপর আর তার খবর নেই। তিনদিন পরও যখন কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না, তখন চঞ্চল ভাবলো, শিপ্রাও কি তবে কল্পনা চাকমার মতো নিখোঁজ হয়ে গেলো? থানা- পুলিশ, আত্মীয়- স্বজন কোথাও খোঁজ পাওয়া গেলো না আর। এরই মধ্যে শেষ বিকেলে তুলসীতলার আরও পশ্চিমে এলাকার ছেলেপেলেরা সাতচাড়া খেলছিলো। হঠাৎ তাদের বল গিয়ে পড়লো পানা পুকুরের কচুরিপানায়। একজন গিয়ে এমনভাবে পুকুরে লাফিয়ে পড়লো, যেমনভাবে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কাশী যাওয়ার আগে দুর্গার চুরি করা পুঁতির মালাটা ছুঁড়ে ফেলেছিলো ‘পথের পাচাঁলী’র অপু। কিন্তু বল কোথায়? বড় বড় কচুরিপানার নিচেই শিপ্রার গলিত লাশ লুকিয়ে রয়েছে। ও মা গো- বলেই সাঁতার কেটে জান নিয়ে ফেরৎ আসে ছেলেটি। সাতচাড়া খেলার কথা আর কারো মনেই আসলো না। পুলিশ এসে শিপ্রাকে যখন পুকুর থেকে তুললো, তখনও তার হাতে বেলোয়াড়ি চুড়ি, কানে দুল, মাথায় হেয়ারব্যান্ড। লাশ দেখতে ভিড়ে গাদাগাদি অবস্থা। থানার পুলিশ অফিসার চঞ্চলকে বললো, মনে হয় তাকে খুনের আগে তার শ্লীলতাহানিও হয়েছিলো। আপনি থানায় আসুন পুরো অভিযোগটি লিখে দিতে, মামলা হিসেবে আমরা নথিভুক্ত করে নেবো। চঞ্চল কর্মকার পুলিশের এ কথার উত্তরে কবিতা আবৃত্তি শুরু করে। বলে, আমি কেন বঞ্চনার এই ইতিহাস হয়ে বাঁচবো, আমার শরীরে কি রক্ত নেই? আমি কি পারি না রক্তে রক্তে সবকিছুকে রঞ্জিত করে দিতে? পুলিশ অফিসার আর কিছুই বলে না। শুধু চঞ্চলের মুখের দিকে নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী চঞ্চল কর্মকার। মাঝে মাঝে কিছু ছোটগল্পও লিখে। কখনো দেখা করে ছোটকাগজ ‘লিরিক’ সম্পাদক এজাজ ইউসুফীর সঙ্গে। ২৪, পাচঁলাইশ আ/এ চট্টগ্রাম। লেখা পাঠায় ‘অক্ষর’ সম্পাদক গাজী মোবারক হোসেনের কাছে মোক্তারপাড়া, নেত্রকোনায়। বই কিনতে যায় ১৭/এ ঢাকার শাহবাগের আজিজ মার্কেটের নিচতলায় ‘পাঠক সমাবেশে’ অথবা ৪৬ বৌদ্ধ মন্দির সড়ক নন্দনকানন চট্টগ্রামের বুকস্টল ‘ডিরোজিও’- তে। সেই চঞ্চল কর্মকারের জীবন এমন এলোমেলো হয়ে গেলো? আখতারের দিকে চঞ্চলের সন্দেহের চোখ গেলেও তার হাতে তো এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। আখতারের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে জমির মূল্য বেশি। যার কিছুই নেই, না ঘর- না জমি, সেই নারীর দিকেও চোখ যায় তার। জমি একবার কারো নিতে পারলে আর ফেরৎ দেয় না। অনেকেই জমির জন্য জীবন দিয়েছে, কিন্তু আখতার তাঁদের জমি দখল করে ধানচাষ করিয়ে নিয়েছে। গ্রামে অনেকদিন কেউ না থাকলে তার দিকেও চোখ যায় তার। কোনোদিন বিপদে পড়লে সে দোয়া ইউনুস পড়ার পরিবর্তে একটি রিভলভার রাখাকেই বেশি সমাধান মনে করে। তার হাসিও ভয়ংকর, দাঁত বের করে হাসে। চঞ্চলের মতো মজনু- ফরহাদ মার্কা যুবক দেখলে তার আনন্দ বাড়ে। শিপ্রার মতো সুন্দরী দেখলে মাথায় কাম জাগে। তার হিসাব গোলমেলে হয়ে যায়। অনাবাদী কারো জমি দেখলে দখল করে আবাদী করতে চায়। মহাজনের মতো সে যখন ক্রুর হাসিতে ফেটে পড়ে, তখন এলাকার কৃষক ফসল তোলার উৎসবের আনন্দ ভুলে যায়। জমির জাল দলিল করার ক্ষেত্রে সে রীতিমত ওস্তাদ। নৌকা, মোটর সাইকেল, ট্রাক... কী নেই তার। আছে ভাড়াটিয়া গুন্ডা, যাদের ভয়ে মানুষ মুখ বন্ধ করে রাখে। বিশ বছর আগের এক অর্থ আত্মসাতের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পাঁচবছর কারাদন্ড হয়েছিলো তার। এই ধূর্ত শাস্তি এড়াতে পালিয়ে যায় তখন। পরে ফিরে এসে আদালতে আত্মসমর্পণ করে কিছুদিন জেল খেটেই কিভাবে যেন মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। এসব ইতিহাস নুরুল ইসলাম স্যার জানে। তারপর থেকে সে যে কতো কতো মানুষের শিকড়ে কুড়াল দিয়েছে, হিসেব নেই তার। আগুন দিয়েছে নিরীহ অনেক হিন্দু বসতির খড়কুটোতে। লোকে বলে, দুর্বৃত্তের সাহস কম। কিন্তু আখতারকে দেখলে এ কথা বিশ্বাস হয় না। যদিও চঞ্চলের নস্টালজিক মনোভঙ্গি কখনো কখনো তার জীবনের শান্তি নষ্ট করতো, তবু সে মুক্তির জন্য সীমানা প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার অবিরাম স্বপ্ন দেখতো। অথচ ছোট বোন শিপ্রার খুন হওয়ার পর চঞ্চল কর্মকার পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় উত্তেজিত হয়। গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের কালজয়ী উপন্যাস ‘মাদাম রোভারী’ পড়া মাঝপথে থামায়। তার সহপাঠি বরুন কুমার চাকমাকে তার বাড়িতে আসতে চিঠি লিখে। বরুন একটি পাহাড়ী সংগঠন করার সঙ্গেও জড়িত। তারপর নুরুল ইসলাম স্যারের কাছে গিয়ে জানতে চায় আখতারের অশুভ শক্তির উৎস কোথায়? স্যার বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনে তার লোক আছে না? চঞ্চল বলে, সেটা কেমন স্যার? নুরুল ইসলাম স্যার বলেন, তার বড় শ্যালক পশ্চিমাঞ্চল রেলের একজন ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা। মেজো শ্যালক বরগুনা জেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি)। আর ছোট শ্যালক ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের কী এক অফিসার। তার শ্বশুরবাড়ি তো খুব নামকরা বাড়ি। কিন্তু সে হয়েছে অমানুষ। আরও ইতিহাস আছে। একবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ করেও অপকর্ম করেছিলো সে। সেটাও অনেক বছর আগে। মেয়েটাকে কিভাবে যেন অচেতন করে ফেলেছিলো। কিন্তু মেয়েটির পরিবার ছিলো নিরীহ, নিরাপত্তার কারণে মামলা করতে সাহস পেলো না। অবশ্য পুলিশ পর্যন্ত ঘটনাটা গিয়েছিলো। পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করতে পারতো। কিন্তু এই যুগ তো টাকার। আর সেটা তো তার কাছে ছিলোই। অবশ্য এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর দীর্ঘদিন তার বউ বাপের বাড়িতে ছিলো। চঞ্চল বলে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্যার- তাকে খুনই করে ফেলবো। মাথা ঠান্ডা করো চঞ্চল, তোমার বাবা তোমার মতো এমন গরম মাথার লোক ছিলো না। অবশ্য সে তো আর এতো বিপদের মুখোমুখি হয়নি কখনো। চঞ্চল বলে, তাহলে আমি কী করবো স্যার? সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে। মামলা তো হয়েছেই। এমন সময় চঞ্চলের পাশের বাড়ির কিশোর অশোক সাহা দৌঁড়ে এসে চঞ্চল কর্মকারকে বলে, দাদা আখতাইরা তো মইরা গেছে। চঞ্চল বলে, কী কস? হ্যাঁ, বাজার থাইক্কা খবর আইছে। চিটাগাং যাওয়ার পথে মিরসরাইয়ে বাস এ্যাকসিডেন্টে নাকি মরছে। এমন সময় নুরুল ইসলাম স্যারের ঘরে প্রবেশ করেন। অমৃত ব্যানার্জি স্যার। তিনিও বলেন, ঘটনা সত্য। চিটাগাং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ আনতে লোক গেছে। তার ছোট ভাই বিডি আরের চাকুরি করে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ৪১ ব্যাটালিয়নে। জুড়ী কোম্পানী সদর ক্যাম্পেও খবর পাঠানো হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় কী স্যার, তার সঙ্গে নাকি অনাত্মীয় এক যুবতী ছিলো, সে নাকি আহত হয়েছে, মারা যায়নি। কে সে? ঐ মেয়ের বাড়ি নাকি চট্টগ্রাম সিটির কর্ণফুলী থানার কাছে কোথাও... কিন্তু কে সে? নুরুল ইসলাম স্যার বলেন, সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। হঠাৎ চঞ্চল চিৎকার করে বলে, স্যার আমি তাহলে শিপ্রার খুনের প্রতিশোধ কিভাবে নেবো? নুরুল ইসলাম স্যার এ প্রশ্ন শুনে অবাক হন, ভেবে পান না মৃত্যুর পর কোনো লোকের অপকর্মের প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া যায়!
রচনা: নভেম্বর: ১৯৯৯, কুমিল্লা।

৭০| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:২৫

জসীম অসীম বলেছেন: খেলা
জসীম উদ্দিন অসীম
রচনা: মে-জুন ১৯৯৪, ঢাকা।
মানুষের জীবন যেন ঋতু। পরিবর্তন জীবনের সঙ্গে চলে। আগে সোহানার বাবার অবস্থা ভালো থাকলেও বর্তমানে সে দিন তার নেই । ভিটেবাড়ি ছাড়া সবই ঐ জোতদারের দখলে চলে গেছে শেষ পর্যন্ত এ ভিটেবাড়িটাও যেন আর হাতে রাখতে পারবেন না। বাড়িটা হাতে রাখার চেষ্টা বাবার দিনের টিনের ঘরটি বিক্রি করে সাধারণ একটি কুঁড়ের ঘর তৈরী করে সোহানার বাবা। সোহানা পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। তার বড় ভাই সুনীল পড়ে কলেজে। বাবা মুজিবুর রহমান বেসরকারি হাইস্কুলের এক কেরানী। দারিদ্রের খাঁচায় বসবাস করে বিধ্বস্ত এক মানুষ।তারপরও সময়ে সময়ে স্বপ্নের পর স্বপ দেখেন তিনি সন্তানদের আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। সোহানারা দু’বোন। সংসারে তারা পাঁচ- পাঁচটি মানুষ। মুজিবুর রহমানের স্বল্প আয়ে প্রায়ই অর্ধাহারে কাটাতে হয় তাদের। সোহানার ভাই সুনীল দুঃসময়কে কিভাবে তাড়ানো যায়, সে দুঃশ্চিন্তায় সময়ে সময়ে অস্থির হয়ে ওঠে। সে নিজেকে সংসারের বর্তমান ও ভবিষ্যতে উৎসর্গ করতে চায় কিন্তু এ উৎসর্গ কোন পথে- কেমন করে হবে তা পরিষ্কার বুঝে না। এ বিষয়ে বাবা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, আগে লেখাপড়া শেষ হোক। তারপর দেখা যাবে। একদিনের সন্ধ্যাবেলা পাশের বাড়ির জোতদার সুন্দর আলী থেকে বর্গা চুক্তিতে একটি ছাগল আনে সুনীল। ইচ্ছে এ ছাগল লালন- পালন করে একদিন এক গাভী কিনবে সে। গাভী কিনবে সে। গাভী কিনে দুধ খাবে এবং বিক্রিও করবে। গাভীর দুধ ভীষণ প্রিয় সুনীলের। ছেলেবেলার দুধ খাওয়ার কতো শখ ছিল। কিন্তু তখন শখ পূরণ করার পালা। মন থেকে অতলস্পর্শ সেই যন্ত্রণাকে মুছে দিতে চায় সে। ছাগল দেখে পরিবারের প্রায় সবাই খুশি হয়। সুনীল তার মনের ঘরের পরিকল্পনা কাউকেই খুলে বলে না। ছাগলের সেবায় পাগলের মতো নিজেকে নিয়োজিত করে। এর ফলে লেখাপড়া ও বিকেলের খেলায়ও বিঘœ ঘটে তার। যৌতুকের যন্ত্রণার এ সমাজে সোহানা বয়সে ছোট হলেও প্রায়ই তার বিয়ে নিয়ে ভাবে। ভাবেÑ যদি বাবা তার বিয়েতে তেমন কোনো আয়োজন না করে কিংবা যদি কোন সাধারণ ছেলের সঙ্গেই তার বিয়ে দিয়ে দেয়। সোহানা যেন পাখা কাটা পাখি। মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যায় না। ইদানীং আবার সুনীলের ছাগল নিয়ে খুবই ব্যস্ত সে। সুনীল যখন কলেজে থাকে, তখন সে ছাগলের সেবাতেই মগ্ন থাকে। মনে মনে কল্পনা করে, এ ছাগলের দুটি বাচ্চা হলে একটি বাচ্চা ওদের হবে। সে বাচ্চাটির বংশদের দিয়ে অনেক টাকা হবে। তখন আর তার বিয়ের তেমন সমস্যা খরচে তেমন সমস্যা হবে না। নথ- পরা বউ হয়ে তখন রেললাইন ধরে শ্বশুর বাড়ি যাবে। সহসা তার মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। ছাগল ফেলে মায়ের কাছে দৌড়ে চলে যায়। অনেক মাস পরে একদিন কলেজ থেকে ফিরে আসার পর সুনীল দেখল তার বর্গা ছাগল একটি কালো ফুটফুটে বাচ্চা দিয়েছে। খুশিতে সে প্রায় পাগল হয়ে যায়। ডানা থাকলে আনন্দে যেন আকাশে উড়াল দিতো। সহসা সুনীলের মনটা ঘন কালো রঙে ছেয়ে যায়। আনন্দ ঝরে পড়ে। ছাগলটিকে মনে হয় অক্ষম এক বৃক্ষ যেন। কৃপণ ছাগল! অকৃতজ্ঞ ছাগল! এত আদর, এত যতœ অথচ বাচ্চা দিল মাত্র একটি? ছাগলটি যেন একটি বাচ্চা দিয়ে সুনীলের কাছে মহা অপরাধ করেছে। জোতদার সুন্দর আলীকে খবর পাঠানো হয়। জোতদার এসে সুনীলের মাকে বলে, কইছিলাম তো ছাগলের দুই বাচ্চা হইলে একটি বাচ্চা সুনীল্যারে দিমু। কিন্তু হইছে তো একটা। তাই এ বাচ্চা সুনীল পাইবো। কথাটি শুনেই সুনীল আনন্দে কেঁদে ফেলতে চায়। বড় কষ্টে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলেও নেয়। সুনীলের মাও এ কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হয়। গাছগাছালির প্রতি সুনীলের ভালোবাসা ছিল। বাগান গড়ে তোলার প্রতিও নেশা ছিল অনেক। এখন ছাগলের বাচ্চা পেয়ে যেন সে বাকি সব ভুলে গেছে। এখন সে সেই ছাগলের বাচ্চা নিয়ে পাখির কলকাকলিমুখর প্রকৃতিতে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। সৌন্দর্য পিয়াসী সুনীল এখন আর বাড়ির আঙ্গিনায় ফুল গাছ তেমন পছন্দ করে না। বলে যে অভিযোগ শোনা যায়, তাতে অনেকেই রীতিমত অবাক হয়। এভাবেই কেটে যায় আট- দশটি মাস। সুনীলের পাওনা ছাগল ছানাটি এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। দেখতে নাদুসনুদুস কালো কুচকুচে রং। সুনীল বলে ‘কৃষ্ণমানিক’। কোথাও যদি খেলতে যায় সুনীল কৃষ্ণমানিকও সঙ্গে যায়Ñ সঙ্গী হয়। পাড়ার অনেকের এ কৃষ্ণমানিকের দিকে চোখ পড়ে যেমন দৃষ্টি পড়ে ঝুলে থাকা পাকা ফলের দিকে। জোতদার সুন্দর আলীর মনও আনন্দে নেচে উঠেÑ যখন এ কৃষ্ণমানিকের দিকে চোখ পড়ে যায়। মনে মনে ভাবে, যদি তখন সুনীলকে এটা সম্পূর্ণভাবে না দিয়ে দিতো, তাহলে কতো লাভ হতো। কৃষ্ণমানিককে সুনীল অ আ ক খ পড়াতে চায় কিন্তু ছাগল কি আর মানুষের মতো পড়তে পারে। তবে পড়তে না পারলেও কৃষ্ণমানিক সুনীলের সব কথা বুঝতে পারে। কৃষ্ণমানিককে দেখলে সুনীল যেন প্রকৃতির পরশ পায়। তার আনন্দে সুনীলের মুখ জুড়ে ফুটে হাসি। সুনীলের ইচ্ছে হয় কৃষ্ণমানিককে রূপার নূপুর কিনে দেয়। কিন্তু সেই সামর্থ্য তার নেই। তাই গলায় তার ঘুঙ্গুর বেঁধে দেয়। কৃষ্ণমানিকও ঘুঙ্গুর পেয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে সুনীলের নজর কাড়ার অনেক চেষ্টা করে। সুনীলের সঙ্গে থেকে থেকে কৃষ্ণমানিকের সৌন্দর্য সচেতনতাও বেড়ে যায়। গ্রামের যেসব ছেলেমেয়ে নোংরা পোশাক পরে তার সঙ্গে খেলতে আসে কিংবা গাছের পাতা খাওয়াতে চায়, তাদেরকে পছন্দ করে না সে। তাদের দেয়া পাতাও খেতে চায় না। কৃষ্ণমানিকের অনুভূতির এমন রঙ দেখে সুনীল রীতিমত অবাক হয়। এটা কি করে সম্ভব? সুন্দর প্রিয় এমন ছাগল কার না ভাল? এতদিনে সুনীলের একটি ছাগল হলো এ ছাগলের নাম তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। কেননা এ কৃষ্ণমানিক এখন তার বন্ধু হয়ে গেছে। হয়ে গেছে এক অনুভূতিসম্পন্ন ছাগল। এ ছাগলকে না দেখলে চোখের সামনে কেবল শূণ্যতাকেই অনুভব করে সুনীল। কাউকে যেন খুঁজে পায় না কথা বলার মতো। তাকে ফেলে কোথাও গিয়ে বেড়াতে পর্যন্ত পারে না। কৃষ্ণমানিকের অসাধারণ যৌবনসুলভ দেহশ্রীতে মুগ্ধ হয় পরিবারের সবাই। এমন ছাগলের বিশেষ চাহিদা রয়েছে বাজারে। অনেকেই সুনীলকে বলে “বিক্রি করে দাও- অনেক টাকা পাবে।” কিন্তু সেসব কথায় সুনীলের মন সায় দেয় না। এমনভাবে যতই দিন যেতে থাকে, কৃষ্ণমানিকের প্রতি সুনীলের মায়া বাড়তে থাকে। কোনো ঘাতক ব্যাধি যেন তাকে আক্রমণ করতে না পারে। সেজন্য সে ভীষণ সর্তক থাকে। তার শরীরের প্রতি সর্বদাই সচেতন থাকে- যেন নিজের শরীরের চেয়েও বেশী। ইতিমধ্যে কৃষ্ণমানিক সারা গ্রামে নামকরা হয়ে উঠে। পাড়ার যুবকদের মধ্যে কেউ কৃষ্ণমানিকের কথা জানে না- এমনটি প্রায় দেখাই যায় না। ছাগল প্রেমী সুনীল বড়দের কাছেও তার এ ছাগলের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠে। একদিন এক ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায়ও ধরা পড়ে সুনীল আর তার ছাগল। পত্রিকায় ফটো ফিচার ছাপা হয়। কৃষ্ণমানিকের প্রতি আরও মায়া বেড়ে যায় সুনীলের। কৃষ্ণমানিকের শরীরে যেন একটি মশাও বসতে না পারে- সেজন্য এত অভাবের মধ্যেও কয়েল জ্বালিয়ে দেয়। জোতদারের ছেলে মোতাহের গ্রামে রাজনীতি করে। নিজেকে আগামী দিনের নেতা ভাবে এখন থেকেই। কিন্তু পথে কলেজের মেয়েদের দেখলেই উত্ত্যক্ত করে। বলে, “কুমারী মেয়েদের ডিষ্টার্ব করলে ঝামেলা নাই। ওরা ভবিষ্যতে শ্বশুরবাড়ি চইলা যাইব। ওরা অন্য গ্রামের মাল। ওদের কাছ থাইক্যা ভোট পাওনের আশাও কম।” সে যেন এক অকাল মৃত্যুর ছায়া। তার সামনে গ্রামের মেয়েরা অসহায় আর প্রতিবাদহীন থাকে। ভয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলে। সেই মোতাহের। ভয়াল মোতাহের। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে পেছন থেকে সুনীলের হাত স্পর্শ করে। সুনীলের বুকে অথৈ ভয়। মোতাহের বলে, “সুনীল তোমার খাসীটা বড় সুন্দর। আমি পরান ভইরা সেইদিন দেখছি। এইটা তোমার নিজস্ব খাসী হইছে। আগামীতে তুমি আমারে এর দ্বিগুণ একটা খাসি দিবা।” সুনীল কিছুই বলে না। শুধু বলে “আমার তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওন লাগবো।” “মোতাহের বলে, “যাওÑ তবে আমার এ বেলীফুলগুলো নিয়া যাও। এগুলো আমি তোমার জন্য রাখছি। ভালো একটা খাসি তোমার জন্য রাখছি। ভালো একটা খাসি তৈরির পুরস্কার। আমারে ছাড়া এ গ্রামে তোমারে আর কে পুরস্কার দিব।” মোতাহেরের ফুল না নিয়েই বাড়িতে চলে আসে সুনীল। পেছনের দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকায় না। বাড়িতে ফিরে আসতেই সুনীলের বোন সোহানা দৌড়ে গিয়ে সুনীলকে বলে “ দুপুর থাইকাই মানিককে আর পাওয়া যাইতেছে না। সারা গেরাম খোঁজাখুঁজি করছি। কোথাও নাই। আমি ছিলাম স্কুলে। মা ছিল কাজে। “ সুনীল বললো, “ মা গেছে কই ” সোহানা বললো, “ সুন্দর আলীর বাড়িতে। ” সুনীল অনাহারী মুখ ধাতু ভাস্কর্যের মতো শক্ত হয়। সন্ধ্যা নেমে আসে। তারপর রাত। সুনীল তার কৃষ্ণমানিককে সারা গ্রাম খুঁজে। কোথাও পায় না আর। কোন রকমে বেঁচে থাকে। এমনি করে ক’ মাস কেটে যায়। নিজে না খেয়ে যে খাওয়ায়ে ফেলতো, তাকে কি সহজে ভুলে থাকা যায়? সুনীলের বিস্তীর্ণ মন জুড়ে কষ্টের ধু- ধু বালুচর। সুনীল এখন আর কৃষ্ণ মানিককে ফিরে পাবার আশা করে নাÑ যদিও সে জেনে গেছে কে তার কৃষ্ণ মানিককে রহস্যজনকভাবে চুরি করেছে। একদিন সকালে সুনীল বাড়ির পাশের বটতলায় বসে ছিল। সঙ্গে কেউ ছিল না। এমন সময় মোতাহের দৌড়ে এসে সুনীলকে বললো, “ ভাই সুনীল, আমার ছেলে রতনকে গতকাল সকাল থাইকা পাওয়া যাইতেছে না। সে তার মায়ের সঙ্গে তার মামার বাড়িতেই ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। থানাতেও খবর দেয়া হইছে; কিন্তু পুলিশ কিচ্ছুই করতে পারে নাই। আমি অহন কী করমো। “সুনীল বলে, ভালো কইরা খোঁজ খবর লও Ñ আমি কী কমু। আমার মানিক তো আজও পাইলাম না।” “মোতাহের সুনীলের কথা শুনে চলে যায়। সুনীল মনে মনে বলে, মোতাহের, তোর ছেলে পাইবি। তো অহন নাÑ অত সহজে না। অনেক অনেক দিন পরে পাইবিÑ একটু খেলা দ্যাখ। ততক্ষণে দু‘চোখের পানিতে সুনীলের শুকনো মুখ ভিজে যায়। ভেজা মুখ কেউ দেখে ফেলবে ভেবে সহসা সে গায়ে জড়ানো ছেঁড়া জামা দিয়ে নিজের মুখটি মুছে নেয়।

৭১| ১৩ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:৪৫

জসীম অসীম বলেছেন: শ্রীধরের চোখের জল
জসীম উদ্দিন অসীম:
শ্রীধরের বাড়ি গোমতি নদীর পারে। কিন্তু এখন বর্ষাকাল। নদী ভরা ঘোলা পানি। শ্রীধরের লেখাপড়া নিয়েও তাই শঙ্কা দেখা দেয়। ভরা নদী খেয়ানৌকায় পার হয়ে প্রতিদিনই ক্লাসে উপস্থিত হয় শ্রীধর। দ্বিতল বিশিষ্ট গংগামন্ডল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র শ্রীধর চন্দ্রঋষি। রাতের বেলা সে গোমতি নদীর প্রবল পাহাড়ি ¯্রােতের শব্দে যেন ঘুমোতেও পারে না। গোমতি নদীর এত বেশি ¯্রােতের কাছে শ্রীধরের অন্য কোনো বন্ধুবান্ধবের বাড়িঘর নেই। মীরবাড়ির কাছে দিয়ে নদীভাঙ্গছে ভয়ানকভাবে। যে খেয়াঘাটে নদী পার হয় শ্রীধর, সেখানে দিয়ে হাজার হাজার মানুষের পারাপার। এদিক দিয়ে একটি সেতু হলে মানুষের কতো মঙ্গল হতো! এমন কথা প্রায়ই ভাবে শ্রীধর। বেগমাবাদের শ্রী শ্রীমৎ লবচন্দ্র পালের বাড়ির কাছ দিয়েই কোনো এককালে বয়ে যেত গোমতি নদী। এখন এর গতি পরিবর্তন করা হয়েছে। বেগমাবাদেই বাড়ি প্রাণহরি পালের। প্রাণহরি পাল শ্রীধরের বন্ধু। তার সংকট অন্য। সে তার বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলো ভারতে। গিয়েই তার বাবা গেলেন অসুস্থ হয়ে। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া এভাবে ভারতে গিয়ে পরীক্ষার সময়ও আর দেশে ফিরতে পারলো না প্রাণহরি। যে পথে প্রাণহরি ভারতে গিয়েছিলো, ত্রিপুরা রাজ্যের সে পথের কাছেই বনরক্ষী ও স্থানীয় লোকজনের হাতে নিহত হয় দুই বাংলাদেশী। তারপর সেই ঘটনা নিয়ে বিডি আর এবং বিএসএফে- র মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং। সবশেষে চোরাপথে ভারত- বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে আসা- যাওয়া বন্ধ। আর এরই মধ্যে প্রাণহরির অংশগ্রহণ ছাড়াই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। রণজিৎ ভট্টাচার্যদের বাড়িতে শুরু হলো দুর্গাপূজা। রণজিৎ শ্রীধর এবং প্রাণহরির বন্ধু। মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, মহিষাসুর, এবং মহাদেবের রূপ দেখতে দেখতেই তার সময় কাটে। কাঠ- পাট আর মাটি নিয়ে প্রতিমাশিল্পীদের গড়ার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। উলুধ্বনি এবং শঙ্খধ্বনিতে রণজিৎদের বাড়ি এবং মন্দির প্রায় একাকার। মন্ডপের কাছেই মাইকে বেজে উঠলো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান। সেই সঙ্গে আরও অনেক পুরনো দিনের গান। রণজিৎও গুনগুন করে গায় এসব গান। এদিকে সোনাকান্দা দরবার শরীফে সিদ্দিক গিয়েছিলো তার বাবার সঙ্গে। সিদ্দিকও শ্রীধরের সহপাঠি। মুরাদনগর সোনাকান্দা দরবার থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনার মারা যায় সিদ্দিক। শোকের ছায়া নেমে আসে সবার মনে। সেই শোক না কাটতেই শ্রীধরদের বাড়িতে এক মধ্যরাতে উঠে এলো বিষধর সাপ। শ্রীধরের দাদার হাতে লাঠি দেখে পালিয়ে যায় সাপটি। কিন্তু তিনদিন পর শ্রীধরদের তিনবাড়ি পার হয়ে সম্ভবত সেই বিষধর সাপটিই দংশন করে শাফায়াতের বউকে। চন্ডীপুর থেকে ওঝা আনলে ওঝা সাপে কাটা স্থানের পাঁচ ইঞ্চি দূরত্ব বাঁধ দিয়ে দংশিত স্থান ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে বিষাক্ত রক্ত বের করে দেয়। কিন্তু তাতেও শাফায়াতের বউ আর বাঁচে না। তার দেড় বছরের শিশুটি মায়ের বুকের দুধের জন্য প্রাণপণ চিৎকার করে। কেউ শিশুটিকে আর তার মায়ের বুকের দুধ খেতে দেয় না। ওঝা বললো, অনেক দেরি হয়ে গেছে। দংশন করেছে জাতিসাপ খোপরো। আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো ওঝা। শাফায়াতের শিশুপুত্র আনিসের কান্না দেখে শ্রীধরের চোখ বেয়ে জল পড়ে। সেই জল গোমতির জল মেশা মাটিতেই মিশে যায়।

৭২| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:৪১

জসীম অসীম বলেছেন: বাবা আছেন বাংলার হিজলফুলে
জসীম উদ্দিন অসীম:
26 সেপ্টেম্বর, 2004,
মাতৃভবন,
কান্দিরপার,
কুমিল্লা।

====
শুভপুর স্লুইসগ্লেট দেখাতে যেদিন নিয়ে গেলেন বাবা, ঠিক সেদিনই হারিয়ে গেলো আমার শখের আংটিটি। বাবা তখন সারাপথে হিজলফুল দেখালেন। হিজলফুল দেখেও আমার কমলো না বুকের ব্যথা। সেই হিজলফুল আজও চোখে পড়লে পদ্মার ধু ধু বালুচরের কথা মনে পড়ে আমার। যেমন খেয়াঘাট দেখলেই আমার মনে পড়ে হিজলফুলের কথা। সেদিনও উষা রাণী পালকে আমি আমার অহংকারের কথা বলেছি। ভাতশালিকের কাঠশালিকের ডানার গন্ধে আমি সারা আকাশে বাবার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি আঁকি। ডব্লিউ হান্টারের পল্লী বাংলার ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমি যেমন ছিদ্দিক মামাকে দেখি, তেমনি ঢাকার নর্থব্রুক হল রোড দিয়েও যেতে যেতে আমার বাবার কথা বারবার মনে হয়েছে। আমার বাবা আমার অহংকার। তাঁর কথা আমি সকলকেই বলি। সূর্য যদি ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরত্বে বাস করে, বাবা আছেন কতো দূরে এখন? কিন্তু বাবা আছেন। বাবা আছেন প্রতি মুহর্তে আমার সঙ্গেই
আগরতলার দুর্জয়নগরের গল্পে। শুভপুরের স্লুইসগেটের স্মৃতিতে, বাংলার সকল হিজলফুলে, ধলেশ্বরী নদীর জলে, রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠে। আর আমার ছাঁটাচুলে ছোট চুলে, শুদ্ধ প্রমিত বচনেও নিশ্চিত বাবা আছেন।
================
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।

৭৩| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: খেলা
জসীম উদ্দিন অসীম
রচনা: মে-জুন ১৯৯৪, ঢাকা।

মানুষের জীবন যেন ঋতু। পরিবর্তন জীবনের সঙ্গে চলে। আগে সোহানার বাবার অবস্থা ভালো থাকলেও বর্তমানে সে দিন তার নেই । ভিটেবাড়ি ছাড়া সবই ঐ জোতদারের দখলে চলে গেছে শেষ পর্যন্ত এ ভিটেবাড়িটাও যেন আর হাতে রাখতে পারবেন না। বাড়িটা হাতে রাখার চেষ্টা বাবার দিনের টিনের ঘরটি বিক্রি করে সাধারণ একটি কুঁড়ের ঘর তৈরী করে সোহানার বাবা। সোহানা পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। তার বড় ভাই সুনীল পড়ে কলেজে। বাবা মুজিবুর রহমান বেসরকারি হাইস্কুলের এক কেরানী। দারিদ্রের খাঁচায় বসবাস করে বিধ্বস্ত এক মানুষ।তারপরও সময়ে সময়ে স্বপ্নের পর স্বপ দেখেন তিনি সন্তানদের আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। সোহানারা দু’বোন। সংসারে তারা পাঁচ- পাঁচটি মানুষ। মুজিবুর রহমানের স্বল্প আয়ে প্রায়ই অর্ধাহারে কাটাতে হয় তাদের। সোহানার ভাই সুনীল দুঃসময়কে কিভাবে তাড়ানো যায়, সে দুঃশ্চিন্তায় সময়ে সময়ে অস্থির হয়ে ওঠে। সে নিজেকে সংসারের বর্তমান ও ভবিষ্যতে উৎসর্গ করতে চায় কিন্তু এ উৎসর্গ কোন পথে- কেমন করে হবে তা পরিষ্কার বুঝে না। এ বিষয়ে বাবা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, আগে লেখাপড়া শেষ হোক। তারপর দেখা যাবে। একদিনের সন্ধ্যাবেলা পাশের বাড়ির জোতদার সুন্দর আলী থেকে বর্গা চুক্তিতে একটি ছাগল আনে সুনীল। ইচ্ছে এ ছাগল লালন- পালন করে একদিন এক গাভী কিনবে সে। গাভী কিনবে সে। গাভী কিনে দুধ খাবে এবং বিক্রিও করবে। গাভীর দুধ ভীষণ প্রিয় সুনীলের। ছেলেবেলার দুধ খাওয়ার কতো শখ ছিল। কিন্তু তখন শখ পূরণ করার পালা। মন থেকে অতলস্পর্শ সেই যন্ত্রণাকে মুছে দিতে চায় সে। ছাগল দেখে পরিবারের প্রায় সবাই খুশি হয়। সুনীল তার মনের ঘরের পরিকল্পনা কাউকেই খুলে বলে না। ছাগলের সেবায় পাগলের মতো নিজেকে নিয়োজিত করে। এর ফলে লেখাপড়া ও বিকেলের খেলায়ও বিঘœ ঘটে তার। যৌতুকের যন্ত্রণার এ সমাজে সোহানা বয়সে ছোট হলেও প্রায়ই তার বিয়ে নিয়ে ভাবে। ভাবেÑ যদি বাবা তার বিয়েতে তেমন কোনো আয়োজন না করে কিংবা যদি কোন সাধারণ ছেলের সঙ্গেই তার বিয়ে দিয়ে দেয়। সোহানা যেন পাখা কাটা পাখি। মাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যায় না। ইদানীং আবার সুনীলের ছাগল নিয়ে খুবই ব্যস্ত সে। সুনীল যখন কলেজে থাকে, তখন সে ছাগলের সেবাতেই মগ্ন থাকে। মনে মনে কল্পনা করে, এ ছাগলের দুটি বাচ্চা হলে একটি বাচ্চা ওদের হবে। সে বাচ্চাটির বংশদের দিয়ে অনেক টাকা হবে। তখন আর তার বিয়ের তেমন সমস্যা খরচে তেমন সমস্যা হবে না। নথ- পরা বউ হয়ে তখন রেললাইন ধরে শ্বশুর বাড়ি যাবে। সহসা তার মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। ছাগল ফেলে মায়ের কাছে দৌড়ে চলে যায়। অনেক মাস পরে একদিন কলেজ থেকে ফিরে আসার পর সুনীল দেখল তার বর্গা ছাগল একটি কালো ফুটফুটে বাচ্চা দিয়েছে। খুশিতে সে প্রায় পাগল হয়ে যায়। ডানা থাকলে আনন্দে যেন আকাশে উড়াল দিতো। সহসা সুনীলের মনটা ঘন কালো রঙে ছেয়ে যায়। আনন্দ ঝরে পড়ে। ছাগলটিকে মনে হয় অক্ষম এক বৃক্ষ যেন। কৃপণ ছাগল! অকৃতজ্ঞ ছাগল! এত আদর, এত যতœ অথচ বাচ্চা দিল মাত্র একটি? ছাগলটি যেন একটি বাচ্চা দিয়ে সুনীলের কাছে মহা অপরাধ করেছে। জোতদার সুন্দর আলীকে খবর পাঠানো হয়। জোতদার এসে সুনীলের মাকে বলে, কইছিলাম তো ছাগলের দুই বাচ্চা হইলে একটি বাচ্চা সুনীল্যারে দিমু। কিন্তু হইছে তো একটা। তাই এ বাচ্চা সুনীল পাইবো। কথাটি শুনেই সুনীল আনন্দে কেঁদে ফেলতে চায়। বড় কষ্টে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলেও নেয়। সুনীলের মাও এ কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হয়। গাছগাছালির প্রতি সুনীলের ভালোবাসা ছিল। বাগান গড়ে তোলার প্রতিও নেশা ছিল অনেক। এখন ছাগলের বাচ্চা পেয়ে যেন সে বাকি সব ভুলে গেছে। এখন সে সেই ছাগলের বাচ্চা নিয়ে পাখির কলকাকলিমুখর প্রকৃতিতে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। সৌন্দর্য পিয়াসী সুনীল এখন আর বাড়ির আঙ্গিনায় ফুল গাছ তেমন পছন্দ করে না। বলে যে অভিযোগ শোনা যায়, তাতে অনেকেই রীতিমত অবাক হয়। এভাবেই কেটে যায় আট- দশটি মাস। সুনীলের পাওনা ছাগল ছানাটি এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। দেখতে নাদুসনুদুস কালো কুচকুচে রং। সুনীল বলে ‘কৃষ্ণমানিক’। কোথাও যদি খেলতে যায় সুনীল কৃষ্ণমানিকও সঙ্গে যায়Ñ সঙ্গী হয়। পাড়ার অনেকের এ কৃষ্ণমানিকের দিকে চোখ পড়ে যেমন দৃষ্টি পড়ে ঝুলে থাকা পাকা ফলের দিকে। জোতদার সুন্দর আলীর মনও আনন্দে নেচে উঠেÑ যখন এ কৃষ্ণমানিকের দিকে চোখ পড়ে যায়। মনে মনে ভাবে, যদি তখন সুনীলকে এটা সম্পূর্ণভাবে না দিয়ে দিতো, তাহলে কতো লাভ হতো। কৃষ্ণমানিককে সুনীল অ আ ক খ পড়াতে চায় কিন্তু ছাগল কি আর মানুষের মতো পড়তে পারে। তবে পড়তে না পারলেও কৃষ্ণমানিক সুনীলের সব কথা বুঝতে পারে। কৃষ্ণমানিককে দেখলে সুনীল যেন প্রকৃতির পরশ পায়। তার আনন্দে সুনীলের মুখ জুড়ে ফুটে হাসি। সুনীলের ইচ্ছে হয় কৃষ্ণমানিককে রূপার নূপুর কিনে দেয়। কিন্তু সেই সামর্থ্য তার নেই। তাই গলায় তার ঘুঙ্গুর বেঁধে দেয়। কৃষ্ণমানিকও ঘুঙ্গুর পেয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে সুনীলের নজর কাড়ার অনেক চেষ্টা করে। সুনীলের সঙ্গে থেকে থেকে কৃষ্ণমানিকের সৌন্দর্য সচেতনতাও বেড়ে যায়। গ্রামের যেসব ছেলেমেয়ে নোংরা পোশাক পরে তার সঙ্গে খেলতে আসে কিংবা গাছের পাতা খাওয়াতে চায়, তাদেরকে পছন্দ করে না সে। তাদের দেয়া পাতাও খেতে চায় না। কৃষ্ণমানিকের অনুভূতির এমন রঙ দেখে সুনীল রীতিমত অবাক হয়। এটা কি করে সম্ভব? সুন্দর প্রিয় এমন ছাগল কার না ভাল? এতদিনে সুনীলের একটি ছাগল হলো এ ছাগলের নাম তার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। কেননা এ কৃষ্ণমানিক এখন তার বন্ধু হয়ে গেছে। হয়ে গেছে এক অনুভূতিসম্পন্ন ছাগল। এ ছাগলকে না দেখলে চোখের সামনে কেবল শূণ্যতাকেই অনুভব করে সুনীল। কাউকে যেন খুঁজে পায় না কথা বলার মতো। তাকে ফেলে কোথাও গিয়ে বেড়াতে পর্যন্ত পারে না। কৃষ্ণমানিকের অসাধারণ যৌবনসুলভ দেহশ্রীতে মুগ্ধ হয় পরিবারের সবাই। এমন ছাগলের বিশেষ চাহিদা রয়েছে বাজারে। অনেকেই সুনীলকে বলে “বিক্রি করে দাও- অনেক টাকা পাবে।” কিন্তু সেসব কথায় সুনীলের মন সায় দেয় না। এমনভাবে যতই দিন যেতে থাকে, কৃষ্ণমানিকের প্রতি সুনীলের মায়া বাড়তে থাকে। কোনো ঘাতক ব্যাধি যেন তাকে আক্রমণ করতে না পারে। সেজন্য সে ভীষণ সর্তক থাকে। তার শরীরের প্রতি সর্বদাই সচেতন থাকে- যেন নিজের শরীরের চেয়েও বেশী। ইতিমধ্যে কৃষ্ণমানিক সারা গ্রামে নামকরা হয়ে উঠে। পাড়ার যুবকদের মধ্যে কেউ কৃষ্ণমানিকের কথা জানে না- এমনটি প্রায় দেখাই যায় না। ছাগল প্রেমী সুনীল বড়দের কাছেও তার এ ছাগলের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠে। একদিন এক ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায়ও ধরা পড়ে সুনীল আর তার ছাগল। পত্রিকায় ফটো ফিচার ছাপা হয়। কৃষ্ণমানিকের প্রতি আরও মায়া বেড়ে যায় সুনীলের। কৃষ্ণমানিকের শরীরে যেন একটি মশাও বসতে না পারে- সেজন্য এত অভাবের মধ্যেও কয়েল জ্বালিয়ে দেয়। জোতদারের ছেলে মোতাহের গ্রামে রাজনীতি করে। নিজেকে আগামী দিনের নেতা ভাবে এখন থেকেই। কিন্তু পথে কলেজের মেয়েদের দেখলেই উত্ত্যক্ত করে। বলে, “কুমারী মেয়েদের ডিষ্টার্ব করলে ঝামেলা নাই। ওরা ভবিষ্যতে শ্বশুরবাড়ি চইলা যাইব। ওরা অন্য গ্রামের মাল। ওদের কাছ থাইক্যা ভোট পাওনের আশাও কম।” সে যেন এক অকাল মৃত্যুর ছায়া। তার সামনে গ্রামের মেয়েরা অসহায় আর প্রতিবাদহীন থাকে। ভয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলে। সেই মোতাহের। ভয়াল মোতাহের। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে পেছন থেকে সুনীলের হাত স্পর্শ করে। সুনীলের বুকে অথৈ ভয়। মোতাহের বলে, “সুনীল তোমার খাসীটা বড় সুন্দর। আমি পরান ভইরা সেইদিন দেখছি। এইটা তোমার নিজস্ব খাসী হইছে। আগামীতে তুমি আমারে এর দ্বিগুণ একটা খাসি দিবা।” সুনীল কিছুই বলে না। শুধু বলে “আমার তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওন লাগবো।” “মোতাহের বলে, “যাওÑ তবে আমার এ বেলীফুলগুলো নিয়া যাও। এগুলো আমি তোমার জন্য রাখছি। ভালো একটা খাসি তোমার জন্য রাখছি। ভালো একটা খাসি তৈরির পুরস্কার। আমারে ছাড়া এ গ্রামে তোমারে আর কে পুরস্কার দিব।” মোতাহেরের ফুল না নিয়েই বাড়িতে চলে আসে সুনীল। পেছনের দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকায় না। বাড়িতে ফিরে আসতেই সুনীলের বোন সোহানা দৌড়ে গিয়ে সুনীলকে বলে “ দুপুর থাইকাই মানিককে আর পাওয়া যাইতেছে না। সারা গেরাম খোঁজাখুঁজি করছি। কোথাও নাই। আমি ছিলাম স্কুলে। মা ছিল কাজে। “ সুনীল বললো, “ মা গেছে কই ” সোহানা বললো, “ সুন্দর আলীর বাড়িতে। ” সুনীল অনাহারী মুখ ধাতু ভাস্কর্যের মতো শক্ত হয়। সন্ধ্যা নেমে আসে। তারপর রাত। সুনীল তার কৃষ্ণমানিককে সারা গ্রাম খুঁজে। কোথাও পায় না আর। কোন রকমে বেঁচে থাকে। এমনি করে ক’ মাস কেটে যায়। নিজে না খেয়ে যে খাওয়ায়ে ফেলতো, তাকে কি সহজে ভুলে থাকা যায়? সুনীলের বিস্তীর্ণ মন জুড়ে কষ্টের ধু- ধু বালুচর। সুনীল এখন আর কৃষ্ণ মানিককে ফিরে পাবার আশা করে নাÑ যদিও সে জেনে গেছে কে তার কৃষ্ণ মানিককে রহস্যজনকভাবে চুরি করেছে। একদিন সকালে সুনীল বাড়ির পাশের বটতলায় বসে ছিল। সঙ্গে কেউ ছিল না। এমন সময় মোতাহের দৌড়ে এসে সুনীলকে বললো, “ ভাই সুনীল, আমার ছেলে রতনকে গতকাল সকাল থাইকা পাওয়া যাইতেছে না। সে তার মায়ের সঙ্গে তার মামার বাড়িতেই ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। থানাতেও খবর দেয়া হইছে; কিন্তু পুলিশ কিচ্ছুই করতে পারে নাই। আমি অহন কী করমো। “সুনীল বলে, ভালো কইরা খোঁজ খবর লও Ñ আমি কী কমু। আমার মানিক তো আজও পাইলাম না।” “মোতাহের সুনীলের কথা শুনে চলে যায়। সুনীল মনে মনে বলে, মোতাহের, তোর ছেলে পাইবি। তো অহন নাÑ অত সহজে না। অনেক অনেক দিন পরে পাইবিÑ একটু খেলা দ্যাখ। ততক্ষণে দু‘চোখের পানিতে সুনীলের শুকনো মুখ ভিজে যায়। ভেজা মুখ কেউ দেখে ফেলবে ভেবে সহসা সে গায়ে জড়ানো ছেঁড়া জামা দিয়ে নিজের মুখটি মুছে নেয়।

৭৪| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:২০

জসীম অসীম বলেছেন: ভগ্নিপতি যখন নিজেরও পতি হয়
অক্টোবর ২০১৫, কলাবাগ হাউজিং, ধর্মপুর, কুমিল্লা।

মান্নানের শ্যালিকা মান্নানের জন্য রীতিমত উন্মাদ। মান্নানের স্ত্রী মনি এক লক্ষ্মী বউ। কিন্তু মান্নান নিজেও সাধু পুরুষ নন। এমন ভালো বউ পাওয়ার পরও তার মন পড়ে থাকে প্রায়ই শ্যালিকা রাণীর কাছেই। মনি পছন্দ করে রবীন্দ্র সংগীত। রাণীর প্রথম পছন্দ হিন্দী গান। রাণীর বান্ধবী ঝিলমিল রাণীর এ উন্মাদ অবস্থার কথা তার মনি আপুকে বলে দিয়েছে। মনি আপু বলেছেন, আমার বোনকে আমি কিছুই বলবো না। বারণও করবো না। তবে তার শেষ অবস্থা হবে ওই লোভী কৃষকের মতো, যে অনেক সোনার ডিমের আশায় সেই দুর্লভ হাঁসটিকে জবাই করে দিয়েছিল। আবদুল মান্নান ‘প্রতিমা দেবী মহিলা কলেজে’র অধ্যক্ষ। বেসরকারি কলেজ। আর রাণী মায়াবিনী সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মনি বাংলা সাহিত্যে অনার্স কমপ্লিট করলেও মাস্টার্স শেষ করেননি। এখন এক কন্যা সন্তানের জননী এবং গৃহবধূ। মান্নানের সঙ্গে তার শ্যালিকার একটি মিল রয়েছে। মান্নানও ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যেরই ছাত্র। ফলে ইংরেজিসহ বিদেশি অনেক সাহিত্যের পড়া রয়েছে তার। সেদিন তিনি তার শ্যালিকা রাণীকে কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয়ের ‘ আন্না কারেনিনা’ গিফট করেছেন। এই রুশ উপন্যাস পড়ে তো রাণীর মাথাই খারাপ। রাণী ঘুরে ঘুরেই প্রিন্স স্তেপান আর্কাদিচ অবলোনস্কি বা স্তিভা এবং আন্না সম্পর্কে তার দুলাভাই আবদুল মান্নানকে অনেক প্রশ্ন করে। টিভি- তে আফগান যুদ্ধের একটি খবর দেখছিলেন মনি। যুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্য দেখাচ্ছিল খবরে। কিন্তু ড্রয়িংরুমে দুলাভাই আর শ্যালিকার এই রুশ সাহিত্যের মশগুল আড্ডা থেকে নিজেকে সরাতে টিভি দেখা বন্ধ করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। রাতে বিছানায় শুয়ে মনি তার স্বামীকে বললেন, আব্বা মারা গেলেন অনেক বছর। আম্মাও মারা গেলেন চার মাস হলো। রাণী আর কতোদিন আমাদের বাসায় থাকবে! যদি আমাদের একটা ভাই থাকতো কিংবা আমাদের পড়াতে কিংবা বাঁচাতে গিয়ে আম্মা শহরের বাড়িটা বিক্রি না করতে বাধ্য হতেন, তাহলে একটা কথা ছিলো। এই মেয়ের এখন দায়িত্ব নেবে কে? মনির মুখে সহসা এমন কথা শুনে অনেকটা অবাকই হলেন মান্নান। বললেন, বাপ- মা মরা মেয়েটাকে তুমি তাড়িয়ে দিতে চাও? নাকি তুমি আমাকে কোনো কারণে বিশ্বাস করতে পারছো না? তার লেখাপড়াটা আগে শেষ করা দরকার। মনি বললেন, বিশ্বাস- অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। আমি ভাবছি রাণীর ভবিষ্যৎ কী হবে। তাছাড়া আমিও পড়লাম সাহিত্য নিয়ে, সেও আবার পড়ছে এখন সাহিত্যই। অবশ্য ইংরেজি সাহিত্য কিন্তু এতে ভবিষ্যৎ কী হবে! মান্নান বললেন, আমিও তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। একটি কলেজের অধ্যক্ষ তো হয়েছি। তাছাড়া আমার নিজের জীবনের কাছে চাওয়াও বেশি ছিলো না। মনি বললেন, তোমার তো রেজাল্ট খুব ভালো ছিলো। আবার হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমি পড়লাম একটি কলেজে। তাও লেখাপড়া শেষ করলাম না। রাণীও এখন ওই কলেজেই পড়ছে। আমি বলি কী, রাণী নৌবাহিনীতে চলে যাক। ওর যা সুঠাম স্বাস্থ্য। আমাদের রবিউল মামা নৌবাহিনীর অফিসার। তিনি বলেছেন, অফিসার ক্যাডেট ব্যাচে রাণী যেন অ্যাপ্লিকেশন করে। মামা জানেন, রাণী এসএস সি ও ইন্টারমিডিয়েটে পিওর সাইন্সে ছিলো। মান্নান গম্ভীর স্বরে বললেন, বোন যেহেতু তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার। মান্নানের এ কথায় মর্মাহত হোন মনি। বলেন, আমার বোন মানে? তুমি তো তার একমাত্র গার্ডিয়ান। তুমিই বলো সাহিত্য পড়ে কী করবে সে? একটা পরিবারের সবাই আমরা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী। কিন্তু জীবনে বাঁচতে টাকাপয়সাও তো চাই। তাকে বারবার বলেছিলাম, ম্যাথমেটিক্স কিংবা কেমেস্ট্রিতে ভর্তি হতে। সে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো ইংরেজি সাহিত্য ভর্তি হলো। তুমিও বললে, ইংরেজি পড়লে জীবনের সার্থকতা উপলব্ধি করবে সে। আব্বার সারাজীবনের ইচ্ছে ছিলো আমাদের দুই বোনকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু আমি বরাবরই লেখাপড়ায় দুর্বল ছিলাম। কিন্তু রাণী পদার্থ, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান ও গণিতসহ ইন্টারমিডিয়েট জিপিএ- ৫ পেল। যে কারণেই হোক বুঝলাম তোর মেডিক্যালে পড়া হলো না। তাই বলে ইংরেজি সাহিত্য কেন পড়বি? শুরুতেই আমি এর বিরোধীতা করেছিলাম। মান্নান বললেন, আমি তো রাণীকে বেসরকারী একটি মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেই চেয়েছিলাম। বারণ করলে তো তুমি। মনি বললেন, শহরে তোমার একটি বাড়ি থাকলে না হয় কথা ছিলো। একদিকে আমরা ভাড়া থাকি, অন্যদিকে আমি আবার হাউজওয়াইফ। আমরা সবাই মিলে তো রাণীর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে পারি না। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে পড়ার এতো খরচ কোথা থেকে আসবে? সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বসে মনি তার ছোটবোন রাণীকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট ব্যাচে অ্যাপ্লিকেশন করার কথা বললে বাসার শান্তির পরিবেশটা এই প্রথম উত্তাল হয়ে উঠে। রাণী মনিকে বলে, তোর যদি ইচ্ছে করে, তুই গিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে বাড়ি করে বসবাস কর। আমাকে সমুদ্রে পাঠাবি না। সমুদ্রের প্রবাল চিরকালই তোর পছন্দের জিনিস। নিজের পছন্দ আমার জীবনে চাপিয়ে দেওয়ার কল্পনাও করিস না। তোর হিন্দু বন্ধু নিশিকান্ত একবার ঠিকই বলেছিলো যে তুই নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের জীবনে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে থাকিস। আজ আজ আবার আমি কথাটার প্রমাণ পেলাম। মনি বললেন, কথাটা ঠিক নয়। আমি চাই তোর জীবনটা হোক একেবারেই ব্যতিক্রম। উদাহরণযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্য পড়ে তোর হবে এক সাদামাটা জীবন। এই সাদামাটা জীবনে আমি সুখি এবং অভ্যস্থ। কিন্তু তোর সুঠাম স্বাস্থ্য- রূপ- দুর্জয় মনোবল কিংবা সাহসের জন্য আমার মনে হয় নৌবাহিনীতে তুই ভীষণ ভালো করবি। কারণ আমি কোনোকালেই তোর মতো ভালো ছাত্রী ছিলাম না। রাণী এ কথায় আরও ক্ষেপে গিয়ে তার দুলাভাই মান্নানকে বললো, দুলাভাই আপনি আজ থেকে আমাকে আপনার বন্ধু নজরুলের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। বেলারুশের মিনস্কে। আমি এই দেশেই থাকবো না। মনি আপু আমার চেহারা দেখাটাও সহ্য করতে পারছে না। আব্বা ছিলেন কলেজের শিক্ষক। তিনি বেঁচে থাকলে তার কোনো মেয়েকেই সমুদ্রে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করতেন না। মনিও রাণী দুইবোনের তর্কযুদ্ধের পর রাণী যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, সন্ধ্যায় এমনকি রাতেও আর বাসায় ফিরে না। বাসা থেকে যাওয়ার পর পরই মোবাইলও বন্ধ রাখে। রাত দশটার পর মান্নান ফেসবুকে পান তার এই শ্যালিকাকে। কিন্তু রাণী ফেসবুকে মান্নানের কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেয় না। শুধুমাত্র এইটুকুই জানায় যে, সে তার এক বান্ধবীর বাসায় রয়েছে। কয়েকদিন পর কলেজের হোস্টেলে উঠতে চেষ্টা করছে। মনি- মান্নানের বাসায় আর সে থাকবে না। শ্যালিকার সংস্পর্শ হারিয়ে দুলাভাই মান্নানেরও মন যেন ভালো নেই। তাই পরদিন থেকে তিনি বিভিন্নভাবে রাণীর প্রতি নজর রাখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো খোঁজ পেলেন না। কেন না রাণী তার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। দুপুরে মোবাইলে কোনো প্রকার যোগাযোগ না করেই রাণী এলো মান্নানের কলেজে। এসেই কিছু টাকা চাইলো এবং বললো তার কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে একটি ফোন দিতে যেন তার কলেজ হোস্টেলে রাণীর জন্য একটি সিটের ব্যবস্থা করে। দুলাভাই মান্নান তার শ্যালিকাকে বাসায় ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেন। রাণী আর ফিরতে রাজি হয় না। শুধু বলে, আমি আমার বান্ধবী মিতালির বাসায় থাকছি। আপু যেন এ কথাটি না জানে। মান্নান বলেন, আমি তোমার বোনকে এ কথা না জানিয়ে ফাঁকি দিতে পারবো না। রাণী বলে, তাহলে আপনার সঙ্গেও আমার আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না এবং আপনার কোনো সহযোগিতাও আমি আর নেবো না। মিতালি শহরের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। রাণীর খুব ভালো বান্ধবী। রাণীর বাবার সঙ্গেও মিতালির বাবার পরিচয় ছিলো। তার বাবা অবশ্য উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা একমাত্র ভাই ডাক্তারী পড়ে ঢাকায়। ওরা অবশ্য কুমিল্লায়ই সেটেল্ড। কিছুদিন আগে এক ফরেনার ব্রাহ্মণ পাত্রের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল মিতালির জন্য। কিন্তু তার বাবা লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে তার বিয়ের বিষয়ে সম্মত নন। এদিকে রাণী বাসার না ফেরায় দু’দিন ধরে রাতের বেলা অনেক কাঁদলেন মনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে টেলিভিশনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনুষ্ঠান দেখছিলেন মান্নান। মনি তার হাত ধরে কেঁদে বললেন, যেখান থেকে পারো, আমার বোনকে খুঁজে বের করে আনো। মান্নান বললেন, কোথায় খোঁজ করবো আমি? সময় কোথায়? আজ আবার কলেজে যাওয়ার আগেই আমাকে ওয়ারিদ টেলিকমের অফিসে একটু কাজে যেতে হবে। মনি বললেন, আজ তুমি সব কাজ বাদ দিয়ে রাণীর খোঁজ নাও। দুইদিন ধরে সে বাসায় ফিরলো না। খোঁজ পেলে বলবে তাকে আমি আর কোনোদিনও তাকে চাকরির কথা বলবো না। কলেজে যাওয়ার আগেই মান্নান মিতালিদের বাসায় গেল। রাণী তার দুলাভাইকে দেখেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি আমার থাকার ঠিকানা আপুকে বলে দিয়েছেন? মান্নান বলেন, এতোটা বোকা হইনি। এতো বোকা লোক কি সংসার করতে পারে? রাণী বলে, ভালো করেছেন। বললে আবার আপু এখানে এসে অঘটন ঘটাতো। তার যখন তখন কান্নাকাটি আমার একদম ভালো লাগে না। মান্নান বলেন, কিন্তু আমার ছোট্ট মেয়ে রাজেশ্বরী, তার কী অপরাধ? তাছাড়া তোমার বোনও এখন আবার ডিমঅলা মাছ। তার কথাও ভাবতে হবে তোমাকে। রাণী বলে, দুলাভাই আপনি এখন চা- খেয়ে কলেজ চলে যান। আজ আমি আপুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলবো। কিন্তু বাসায় যাবো না। রাজেশ্বরীকে না দেখে তো খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু আপুর পেটের সন্তানের জিম্মাদারি তো আপনার উপরই বেশি নির্ভরশীল। আপনি তো আবার...। মান্নান বলেন, তোমার এখন বাসায় ফেরা দরকার। মনি তো তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করেনি। রাণী বলে, বাসায় ফিরলেও আমি কখনো হোস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবো না। মান্নান বলেন, আমাদের অপরাধটা কোথায়? রাণী মান্নানের মুখের কাছে ঝুঁকে গিয়ে বললো, আপনি এখন চা খেয়ে কলেজে চলে যান। সন্ধ্যায় আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন এশিয়া ক্যাফেতে। আমি যাবো মিতালিকে সঙ্গে নিয়ে। একা একা বসে কথা বলাটা খারাপ দেখাবে। মিতালি ব্ল্যাক কফি পছন্দ করে। বাকি তা খাওয়াবেন, যা আপনার পছন্দ। আপনি মোটর সাইকেলে চড়ে আসবেন না। রিকশায় আসবেন। সাইকেল- আর মোটর সাইকেল আমার কাছে একই রকম লাগে। সন্ধ্যায় এশিয়া ক্যাফেতে বসে রাণীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মান্নানের মনে অতীত এসে ভিড় করে। জীবনানন্দ দাশের একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারের কথা অনেকদিন তেমন করে মনে পড়েনি তার। বৈচিত্র্যে ভরা ঝরণাধারায় এখনো যেন পুরোপুরি যৌবনবতী হয়নি তার জীবন- তটিনী। হঠাৎই মান্নান আবেগপ্লুত হন। রাণীর একটি হাত ধরে বলেন, রাণী সমুদ্র দেখতে যাবে? পতেঙ্গায়? ওখানে আমার এক বন্ধু আছে একটি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সমুদ্র দেখলে তোমার মন খুব ভালো হয়ে যাবে।...। মান্নানের কথা শেষ না হতেই মিতালি ফিরে আসে এশিয়া ক্যাফের ওয়াশরুম থেকে। তিনতলার এ ক্যাফের একপাশে একটি কদমবৃক্ষ কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখতে চমৎকার লাগে। [ রাণী বলে, আমি সমুদ্রকে ভয় করি। এই সমুদ্র নিয়েই তো আপুর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। অথচ আপনার হওয়ার দরকার ছিলো নৌবাহিনীর অফিসার। মান্নান হেসে বলেন, হঠাৎ কেন নৌবাহিনী আর সমুদ্রের প্রতি ক্ষেপে গেলে রাণী? রাণী বলে, আমি সাঁতার জানি না। শিখতেও চাইনি কোনোদিন। আমার শরীরে তো নতুন করে এখন কোনো এয়ার ব্লাডারও সৃষ্টি হয়নি যে আপু আমাকে সমুদ্রে পাঠানোর পরিকল্পনা করলো। আর এটা কি পরিকল্পনা নাকি ষড়যন্ত্র? আমি কি তার পাকা ধানে মই দিয়েছি? মান্নান বলেন, আমার মনে হয় তোমার আপু এমন কিছু ভেবে কথাগুলো বলেনি। তাহলে কি বোনের জন্য আবার এভাবে কাঁদতে পারে? মহড়াকালে যে অনেক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায়, সে কথা তোমার আপু বলবে কী করে? রাণী বলে, ঠিক আছে আমার মামা নৌবাহিনীর অফিসার। কিন্তু আমাদের বংশের কোনো নারী কোনোদিনও নেভি- তে চাকরি করেনি। অথচ আপু আমার জন্য এমনই চিন্তা করেছে। এ হলো পানিতে ডুবিয়ে মারার এই যুগের অত্যাধুনিক পরিকল্পনা। ঠান্ডা মাথায় খুন। আরে যে মেয়ে সাহিত্যের ছাত্রী, সমুদ্রকে ভয় পায়, সাঁতার জানে না, তাকে পাঠাবে নৌবাহিনীর চাকরিতে! অনেকক্ষণ ধরে কথা শুনছিলো মিতালি। এবারে একটু মুখ খুললো। বললো, রাণী এখন কিন্তু দিন বদল হয়েছে। তা না হলে সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে, পুলিশে বা মিলিটারীতে এতো নারী নেয়? আমার মনে হয়, ওই ভেবেই আপু কথাটা বলেছে। এতকিছু ভেবে বলেনি। রাণী হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। বলে, মিতালি তুই আপুর পক্ষ নিয়ে কথা বললে আমি তোর বাসা ছেড়ে এখনই চলে যাবো। আমি করি সমুদ্রকে ভয়। আর আপু করে আমাকে ভয়। আমিই তার সমুদ্র। আর দুলাভাই? তিনি মনে করেন তার সমুদ্র মনি আপু। তাই তিনি বউকে মারাত্মক ভয় করেন। আসলে ভয় রয়েছে সবারই অন্তরে। হঠাৎ মিতালি উঠে দাঁড়ায়। রাণীকে বলে, চল রাণী- বাসায় চল। দেরি হলে আবার বাবা বকবে। তাছাড়া যাওয়ার পথে জিলা স্কুল রোড থেকে মিল্টনের ‘এ্যারিও প্যাজিটিকা’ কিনে নিতে হবে। আরেকদিন কোনো দোকানেই পাইনি। রাণী বলে, মিতালি তুই একটু নিচে গিয়ে দাঁড়া। আমি আর দশ মিনিট দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসি। মিতালি নিচে চলে গেলে রাণী বলে, দুলাভাই, যদি সুযোগ হয় ফরাসী চিত্রশিল্পীদের কিছু কাজ দেখবেন। ইন্টারনেটে গগ্যাঁ- র কিছু ছবি দেখবেন। সাহস বাড়বে। মিনমিন করা পুরুষ আমি দেখতেই পারি না। আমি হলাম তেঁতুল কাঠ। ঝাঁজও মারাত্মক। তাই আমি বাসা ছেড়ে চলে এসেছি। আমাদের কলেজের বাংলা বিভাগের রুচিরা তার দুলাভাইকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু আমি কি সে রকম মেয়ে? আপু তো আমাকে রীতিমত সন্দেহ শুরু করেছে। বাসায় আমি আর থাকি কী করে? মান্নান বলেন, আমার কিন্তু রাণী তেমন মনে হয় না। তোমার বোন আসলে তোমার মঙ্গল কামনা করতে গিয়ে অনেক সময় অতিরিক্ত ভাবনা ভাবে। দেখলে না, তিন মাস আগে তোমার বিয়ে প্রায় ঠিকই করে ফেললো দিনাজপুরের চিররবন্দর শাখার জনতা ব্যাংকের এক অফিসারের সঙ্গে। তোমার মামাও রাজি হয়ে গেলেন। বাধা দিলাম আমি। রাণী বললো, আপনি বাধা দিয়েছেন আপনার স্বার্থে। আমার স্বার্থে নয়। মান্নান বললেন, সেটা কী রকম? রাণী বলে, আপনি নিজেকে সাধু বলে দাবী করবেন না। আপন বোনের সঙ্গে সংসার না করলে আপনার সাধুগিরি যে কতো ঠুনকো, তা আমি প্রমাণ করে দিতাম। আমার বোন ঘরকুনো স্বভাবের। কিন্তু আমি অন্যরকম। আপনার মতো দশ পুরুষকে নাকে দড়ি দিয়ে টানার সাহস রাখি। মান্নান বললেন, তোমার এ মতামত আমি মানতে পারলাম না রাণী। আমার কলেজে তোমার মতো হাজারো ছাত্রী রয়েছে। রাণী বলে, কিন্তু আমি আপনার ছাত্রী নই। মান্নান বলেন, তাই বলে কি আমি কখনো অন্যায় কিছু করেছি? রাণী বলে, দিঘিওয়ালি সম্মতিই দিলো না। আপনি কোথায় সাঁতার কাটবেন? মান্নান বলেন, আমি কি কখনো সে রকম আচরণ করেছি? রাণী বলে, সেদিন আপনি- আমাকে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ঠোঁটে চুমো দিয়েছেন। মান্নান বলেন, আমি তোমাকে দেবী মনে করে এটা করেছি। পাপদৃষ্টিতে করিনি। রাণী বলে, পাপ দৃষ্টিতেই করেছেন। দানবের দৃষ্টিতে করেছেন। আপনি আমাকে ভোগ করেছেন। সম্ভোগ করেছেন। উপভোগ করেননি। আপনি আমাকে নষ্ট করে বুকের কষ্ট শতগুণ বাড়িয়েছেন। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। ততক্ষণে নিচে থেকে মিতালি আবার এশিয়া ক্যাফেতে উঠে আসে। বলে, রাণী প্লিজ এক্ষুণি চল। বাবা আজ খুব বকবে। রাণী বলে, প্লিজ মিতা আর পাঁচ মিনিট একটু সহ্য কর। এক্ষুণি আসছি। এমন সময় মান্নান রাণীর আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, রাণী তোমার প্রশ্রয়েই আমি এতটা এগিয়ে এসেছি। সব দোষ তাই আমার নয়। তুমি এ পর্যন্ত প্রায় দশবার আমার নাকে তোমার স্তন ঘষে দিয়েছো। তুমি ভাব দেখিয়েছো তোমার অলক্ষ্যেই এটা হয়েছে। কিন্তু আমি জানি প্রতিবারই তুমি এসব ইচ্ছে করেই করেছো। তোমার বোন আমার স্ত্রী না হলে তক্ষুণি আমি তোমাকে ছিঁড়ে দেখতাম। রাণী বলে, দেখলেন আপনি কতো খারাপভাবে ভাবতে পারেন? অথচ আমি আপনার সঙ্গে শুয়ে থাকতে পারবো কোনো পাপচিন্তা ছাড়াই। আমি জানি, কোরআন শরীফে মৃত পশুর গোশত এবং আপন ভগ্নিপতির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক হারাম করা হয়েছে। মান্নœান বললেন, এসব জেনেও তুমি আমার সামনে একটা ওড়না জড়িয়ে দিব্যি পোশাক বদল করে ফেলো। রাণী বলে, আমি তো সবকিছুকেই সহজ করে নেই। পাপদৃষ্টি আমার মাথায় নেই। মান্নান বলেন, সহজ করে নিলে মনি তোমাকে নৌবাহিনীর ক্যাডেট ব্যাচে অ্যাপ্লিকেশনের কথা বলাটা সহজ করে নিলে না কেন? রাণী বলে, যদি আপনিও চান আমি সমুদ্রে ডুবে মরি, তাহলে আমি এক্ষুণি অ্যাপ্লিকেশনের সিদ্ধান্ত নেবো। পরে কিন্তু ফেরাতে পারবেন না আর। মান্নান হেসে বলেন, আমি আমার আদরের একমাত্র শ্যালিকাকে নিশ্চয়ই ডুবে মরতে দিতে পারি না। ততক্ষণে মিতালি আবার এসে রাণীকে ফেরার তাড়া দেয়। মিতালি আর রাণী বাসায় ফেরার পর এবার যেন মান্নানের বিবেক জাগ্রত হয়। নিজের স্ত্রী মনির কাছে অনেক কথাই লুকানো শিখেছেন তিনি। বিশেষ করে আপন শ্যালিকার সঙ্গের সর্ম্পকটিকে তিনি যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তা যে শুভকর নয়, তা জেনেও ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছেন। তার স্ত্রী মনি সহসা অসুস্থ হলেও নামাজের বিষয়ে কোনো ওজর তুলেন না। সেক্ষেত্রে তারা শ্যালিকা আর দুলাভাইয়ের ফাঁকিবাজির শেষ নেই। দোকান থেকে একটি কোম্পানীর ২৫ মিলি লিটারের ঝাঁঝালো পানীয় কিনে দোকানের সামনেই গিলতে থাকেন আবদুল মান্নান। এশিয়া ক্যাফে- তেও এতক্ষণ অনেক পানীয় পান করেছেন। তবু যেন তৃষ্ণা মিটছে না তার। এক প্যাকেট কয়েল কিনে ছুটলেন বাসার দিকে। বাসায় ফিরতেই মনি মান্নানকে বললেন, রাণী কোথায়? আজও কেন আসলো না সে? মান্নান বলেন, তুমি তাকে সমুদ্রে পাঠানোর পরিকল্পনা করবে, সে থাকবে তোমার বাসায়? মনি বলেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সেই দেশের একজন বাসিন্দা হয়ে নিজের বোনকে নৌবাহিনীতে যেতে বলে অপরাধ কিছু করিনি। মান্নান বলেন, রাণী তো সমুদ্রকে ভয় করে। মনি বলেন, আর আমি ভয় করি তোমাকে। কারণ সমুদ্র জয়ের নেশা তো তোমার রয়েছে। আমাকে কিভাবে জয় করেছো, সেটাও মাথায় রয়েছে। মান্নান এবারে একটি সিগ্রেট ধরান। তারপর বলেন, তুমি রাণীর প্রথম প্রেমটা ভেঙে দিয়েছিলো। কেন? মনি বলেন, কারণ তখন তার প্রেমের বয়স হয়নি। নবম শ্রেণিতে পড়তো। এখন তার এভারেস্ট বিজয়ের বয়স। সে তো স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও বিজয়ী হয়ে পুরস্কার নিয়ে ফিরতো। ইদানিং সে সব ছেড়ে বই কিংবা মোবাইলে ব্যস্ত বেশি। মান্নান বলেন, এটা তো দোষের কিছু নয়। মনি বলেন, তার বিয়েশাদীর কথাও আমাদের ভাবতে হবে। আব্বা- আম্মা বেঁচে থাকলে না হয় লেখাপড়া শেষ হলে এসব ভাবতাম। মান্নান বলেন, এখন রাণীর বিয়ের কথা ভাবার তো কারণ নেই। টাকা পয়সা লাগবে না? আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার তোমার দেনমোহরই সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে পারলাম না। মনি বলেন, হঠাৎ কেন দেনমোহরের প্রসঙ্গ আসলো। আমি তো কতোবার বলেছি ওটা আমি পেয়েছি ধরে নিয়েছি। পরিশোধের আর প্রয়োজন নেই। মান্নান বলেন, কিন্তু আমি একজন সচেতন লোক হয়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে এটা পরিশোধ করবো না? ধর্মে তো এটা ফরয। মিতালি রাণীকে বলে, তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে তোর এত মাখামাখি আমার ঠিক ভালো লাগেনি। রাণী বলে, দুলাভাই আমাকে ভালোবাসেন। মিতালি বলে, আর তুই? রাণী বলে, আমি এর উত্তর জানি না। আমি তাকে দিয়ে আমার বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতেও চাই। ব্যাঙ্কে দুলাভাই আমার নামে একটি অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন। টাকা জমাও রাখেন। আমি তুলে তুলে খরচ করি। অ্যাকাউন্ট খালি হলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমার অনেক খরচের দোষ রয়েছে। দুলাভাই আমার জন্য ইদানিং তার ছাত্রছাত্রীদের ওপর নাকি সামান্য চাঁদাবাজিও শুরু করেছেন। এক সংসারের ভিতর তিনি দুই সংসার লালন করছেন। কেন, আমি তা জানি না। মিতালি বলে, তোর দুলাভাই একজন শিক্ষিত লম্পট। তিনি তোর শরীরের পাগল। রাণী বলে, শরীর তো মনি আপুর কাছেও রয়েছে। মিতালি বলে, তার এটা অসুখ। তোকে ভোগ করে আবার আমার দিকে কিংবা কলেজের কোনো ছাত্রীর দিকেও চোখ দিতে পারেন। রাণী বলে, তিনি এমনই পুরুষই নন। তার বন্ধু নুরুল ইসলাম বলেছেন, তিনি নাকি ছাত্রজীবনে প্রেমপ্রীতি ছেড়ে শুধু লেখাপড়াতেই মনোযোগী ছিলেন। নুরুল ইসলাম ভাইয়া এখন ঢাকার শাহবাগ এলাকার পরিবাগে ব্যবসা করেন। রাতে বিছানায় শুয়ে মনি তার স্বামীকে বললেন, রাণী কোথায় আছে, তুমি তা নিশ্চিত জানো। আগামীকাল যেভাবেই হোক বাসায় নিয়ে আসো। দেখো আমাদের বাসাটি কখনো এমন থমথমে ছিলো না। সব সময় সে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। আর এখন? কাজের মহিলা ঝন্টুর মা পর্যন্ত বলেছে আজ, রাণী ছাড়া পুরো বাসাটিই আমাদের ফাঁকা। মান্নান বলেন, ঝন্টুর মাকে কয়েকদিন আমাদের বাসায় থাকতে বলো। তোমার স্বাস্থ্যটাও তো এখন খুব একটা ভালো না। যে কোনো সময় আবার হাসপাতালে যেতে হবে। মনি বলেন, ঝন্টুর মা দূরে থাকে। স্বামী- সন্তান নিয়ে কোনো এক টিনের ছাপড়া ঘরে। থাকতে পারবে না। আমি শুধু আমার বোনের কথা ভেবে তাজ্জব হয়ে গেলাম। আমার এখন বাচ্চা হবে। আর তুই আমার সঙ্গে সামান্য কারণেই রেগে বাসা ছাড়লি? মান্নান বলেন, আমি দ্রুতই তাকে বাসায় ফেরানোর সকল চেষ্টা করবো। তুমি এখন সব দুশ্চিন্তা ছাড়ো। হঠাৎ মনি তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কাঁদতে থাকেন। তারপর বলেন, স্বামী- স্ত্রী উভয়ে কিংবা দু’জনের একজন যৌন অনাচার করলে নাকি তাদের সন্তান প্রতিবন্ধী হয়। মান্নান বলেন, তুমি শিক্ষিত হয়েও কুসংস্কারে বিশ্বাস করো। তাছাড়া আমরা কেউ তো এমন অনাচারে নেই। মনি বলেন, রাজেশ্বরী যখন পেটে ছিলো, প্রতি মুহূর্তে আমার সঙ্গে সাড়া দিতো। কিন্তু আমার এবারের সন্তান আজ কয়েকদিন তেমন সাড়া দিচ্ছে না। মনি আবারও কাঁদতে থাকেন। মান্নান বলেন, তুমি কান্না বন্ধ করো। ওসব তোমার মনের ভুল। মনি বলেন, আমার ছোট বোন পছন্দ করে কার্বনেটেড ড্রিংকস। আর আমি সাদা পানি। আর তুমি সাদা পানি, ফলের রস, কোমল পানীয় ... এমনকি উন্নত মদও একইসঙ্গে পছন্দ করো। তোমাকে তাই বুঝতে পারি না আমি। মান্নান আর এ কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে ঘুমোতে চেষ্টা করেন। পরদিন মনি- র স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়। খবর পাঠানো হয় রাণীকে। রাণী মিতালির মামাতো বোন ভারতীকে নিয়ে খুব দ্রুতই বাসায় উপস্থিত হয়। মিতালি তখন বাসায়ও ছিলো না। দুইজন নার্স সহ অ্যাম্বুলেন্স আসে বাসার সামনেই। রাণী, ভারতী আর ঝন্টুর মাকে বাসায় রেখে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে মনিকে নিয়ে শহরের একটি নামী ক্লিনিকে যায়। ততক্ষণে মোবাইলে যোগাযোগ করে মিতালিও হাসপাতালে উপস্থিত হয়। মিতালি রাণীকে বলে, তোর বোনকে এভাবে রেখে তুই বাসা ছাড়তে পারলি? রাণী বলে, যুদ্ধে-প্রেমে কিংবা রাগে মানুষ যা করে, তা দিয়ে তাকে বিচার করা ঠিক নয়। তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মিতালি বলে, এখন যদি তোর বোন মরে যায়, তুই সবচেয়ে বেশি খুশি হবি। কারণ আমি তোর ভিতরটা পাঠ করে ফেলেছি। মিতালির এ কথায় রাণী ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। এদিকে মান্নানকে ডাক্তার কিছু ওষুধের তালিকা দিলেন। ওষুধ কেনার পর মনিকে ওটি- তে পাঠানো হলো। ওটি ইনচার্জ রাণীকে বললেন, আপনারা ঘাবড়ে গিয়েছেন কেন? ভয়ের তো কিছু নেই। আরও কিছু টাকা তুলতে মিতালিকে একটি চেক দিয়ে ব্যাঙ্কে পাঠালেন মান্নান। ফেরার পথে মিতালির রিকশা তাৎক্ষনিকভাবে আটকে কিছু দুর্বৃত্ত তার মোবাইল ও টাকার ব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে যায়। একজন পুলিশ তাড়া করেও ছিনতাইকারীদের ধরতে পারেনি। সন্ধ্যার দিকে মিতালি আর ভারতী নিজেদের বাসায় ফিরে। টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার পর মিতালি প্রায় নির্বাক হয়ে যায়। সবাই আরও বেশি নির্বাক হয় মনি- র মৃত সন্তান প্রসবের ঘটনায়। রান্না করতে বাসায় চলে আসে রাণী। ঝন্টুর মা মনি-র পছন্দের সব রান্নাই করে দেয়। ক্লিনিকে মনির কাছে সময় দেয় রাজেশ্বরী আর মান্নানের এক ফুপু রাশিদা বেগম। রাত দশটার দিকে খাবার নিতে বাসায় আসেন মান্নান। তার মন খুবই খারাপ। তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে রাণী। বলে, দুলাভাই সব দুর্ঘটনার জন্য দায়ি একমাত্র আমিই। মান্নান বলেন, দায়ি কেউ নয়, এসব আমার কপালের লিখন। অথবা আমি নিজেই দায়ি। কারণ আমিই তো এই সংসার গাড়ির ইঞ্জিন। গলদ ছিলো ইঞ্জিনই। রাণী বলে, গাড়িতে কি চাকার ভূমিকা নেই? মান্নান বলে, চাকা যদি তোমার বোন হয়, তাহলে চাকার হাওয়া হলে তুমি। তোমার বোন চাকার হাওয়া বের করতেই তো ঘটলো দুর্ঘটনা। ডিসেম্বরের কড়া শীত। বাসার সব দরজা- জানালা বন্ধ। গরম- ঠান্ডা জল মিশিয়ে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেন মান্নান। রাণী বলে, ছোট বালতিটা দিন। মান্নান বালতি এগিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে শেভ করতে নিজের মুখে শেভিং ক্রীম মাখেন। দরজায় আবার নক করে রাণী। কী আবার দরকার? বলেই দরজা খুলেন মান্নান। এবার রাণী নিজেই ভিতর থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর বলে, দুলাভাই প্লিজ একটা রিকোয়েস্ট। জগতের কেউ জানবে না এ কথা ...। রাণীর এমন আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খান মান্নান। যদিও তিনি এমন কোনো ঘটনার আশায় ওঁৎ পেতেই ছিলেন। মনির জীবনের এমন আর্তির রাতটায় দুলাভাই মান্নান আর শ্যালিকা রাণীর ফুর্তি যেন শত শতগুণ বেড়ে যায়। ঝন্টুর মা ততক্ষণে পৌঁছে যায় নিজ বাসায়। স্ত্রী মনি আর ফুপু রাশিদার জন্য খাবার নিয়ে জেলা বেসরকারী কলেজ শিক্ষক পরিষদের সভাপতি আবদুল মান্নান ক্লিনিকের দিকে যখন বাসা থেকে বের হন, তখন রাত সাড়ে এগারোটা। ক্লিনিকে খাবার নিয়ে আসতেই মান্নানের ফুপু বললেন, তোর কলেজের সুজিত স্যার মনিকে দেখতে এসেছিলেন। মান্নান বলেন, আমি জানি। মোবাইলে কথা হয়েছে। ফুপু বলেন, এত দেরি করলি কেন? মনি তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মান্নান বলেন, ঝন্টুর মা কী এক সমস্যায় দেরি করে এলেন। ততক্ষণে ঘুম ভেঙ্গে যায় মনির। তার খুব কাছে গিয়ে বসেন মান্নান। হাতে হাত রাখেন। মনি চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন, আমার জীবনের আজকের ঘূর্ণিঝড়টা বঁড়শির মতো করে সারাজীবন বুকে গেঁথে থাকবে। মান্নান মনির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলেন, সব ভুলে যাও মনি। শক্ত করো নিজেকে। মনি বলেন, আজ আমার এমন দুঃখের দিনে তুমি কিভাবে শরীরে সুগন্ধী স্প্রে করলে? মান্নান বলেন, ধুলাবালিতে- ঘামে কালিতে সারাদিন কি কম ধকল গেল? মনি বলেন, আমি ক্লিনটনের লিউইনস্কি মনিকা নই। যে তোমাকে বিচারের মুখোমুখি নেবো। কিন্তু আমি লজ্জায় আর কষ্টে মরে যাই। চোখের জলে ভেজানো এমন দিনে তুমি শরীরে কিভাবে সুগন্ধী মাখাতে পারো। ততক্ষণে ক্লিনিকের বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে মান্নানের ফুপু আসেন সবাইকে খাবার খাওয়াতে। রাত একটু বাড়লে মনি তার স্বামী মান্নানকে বলেন, তুমি বরং বাসায় চলে যাও। ফুপু আছেন। না ঘুমিয়ে কষ্ট করার কী দরকার? মান্নান বলেন, তোমার কি মাথা খারাপ তোমাকে ফেলে বাসায় যাবো আমি! মনি বলেন, রাণী বাসায় একা। ভয় পাবে। মান্নান বলেন, ও কি দুধের কচি খুকি নাকি! তাছাড়া সে তো সমুদ্রকে ভয় করে। আমাদের বাসাটি নিশ্চয়ই বঙ্গোপসাগর নয়।

৭৫| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:২৩

জসীম অসীম বলেছেন: বকদিঘির উত্তর পাড়ের অশ্বত্থ বট

আমাদের পরিচিত এক বাড়িতে ভূত থাকে বলেই জানতাম। একদিন সন্ধ্যায় গেলাম সেই বাড়িতে। এটা ছিল অশোকের পিসির বাড়ি। এটা আমার শৈশবের এক ঘটনা। সেই বাড়িতে ঢুকতেই একটি গাছের নিচু ডালের বাসায় বসে ডিমে তা দিতে দেখলাম একটি ঘুঘুকে। ঢিল ছুঁড়ে দিলাম। পাখিটির কাছ দিয়ে গেল। অবশেষে পাখিটি উড়ে গেল। প্রভারাণী বসুদের ঘরের কাছেই ছিল একটি অর্জুন বৃক্ষ। সন্ধ্যা হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে নানা প্রকার পাখি বসছিল সে বৃক্ষে। সেই বৃক্ষের ঠিক পেছনেই বকদিঘি। আমাদের নজর ছিল বকদিঘির উত্তরপাড়ের গহিন মাঠের অশ্বত্থ বটের গাছটির দিকে। ওখানে নাকি মধ্যরাতে ভূূতদের আসর বসে। আমি, অশোক, প্রশান্ত, একই সঙ্গে সঞ্চিতা, প্রিয়াংকা, পার্থ, পূর্ণা, ও প্রমিলাদের ঘর পার হয়ে যেতে লাগলাম সেই অশ্বত্থ বটের গাছটির দিকে। পথেই সমীর এবং সুমেন্দুর সঙ্গে দেখা। যেতে বারণ করলো ওদিকে। ভয়ও দেখালো। বটতলা তখন অন্ধকারে ডুবছে। তার আগেই বিশাল এক কদমগাছ। তারপর এক ছাতিম বৃক্ষ। সবশেষে অশ্বত্থ বট। বটের কাছে যেতেই পটপট করে অনেক শব্দ হলো। আমরা কোনো ভয়ই পেলাম না। বকদিঘির উত্তরপাড়টা রীতিমত বনের মতোই। হঠাৎ আমাদের নজরে এলো একটি কালো রঙের ছোট হাঁস। ধরতে গেলেই শব্দ না করে উড়াল দিয়ে ছাতিম বৃক্ষে মিশে গেল। ভয়ে তখন কাঁপছিল প্রশান্ত। তখন ছিল শীতকাল। অশোকের পায়ের নিচে চাপা পড়লো একটি ব্যাঙ। সঙ্গে সঙ্গেই ধাপ করে লাফ দিলো অশোক। আমিও গেলাম একটু ভয় পেয়ে। কিছু বাদুর ও চামচিকার দেখা পেয়ে আমারও ভয় ভয় লাগছিলো। ভাবলাম পেঁচার দেখাও পাবো। আরেকটু এগিয়ে যেতেই মরা ছাগল কিংবা গরুর গন্ধ নাকে এলো ভাগাড় থেকে। প্রশান্তকে বললাম, শকুনের ডাক শুনলে আবার ভয় পাস না যেন। অশোক বললো, একটা দেয়াশলাই বক্স আনার দরকার ছিল। অবশেষে চলে এলাম সন্ধ্যার মধ্যেই অশ্বত্থতলা থেকে। ভূতের দেখা পেলাম না আর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পরদিন সকালেই সবাই গিয়ে সেই অশ্বত্থ বটের নিচু ডালে অশোকের পিসাতো বোন উমিলাদিকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে দেখালো। এটা কি ঠিক আত্মহত্যা নাকি হত্যা, এ নিয়ে চতুর্দিকে গবেষণা ও শুরু হয়ে গেলো। তারপর থেকে আর কখনো দিনের বেলায়ও একা একা সেই বক দিঘির উত্তরপাড়ের অশ্বত্থ বটের কাছে যাইনি আমরা। এখন অবশ্য ওখানটায় ছাতিম কিংবা অশ্বত্থ বটবৃক্ষ আর নেই। কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু অতীত স্মৃতিকে তো আর কেটে ফেলা যায় না।

৭৬| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:২৯

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প
বাইসাইকে
======
আবুল কালামের শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি পাশ। কিন্তু তার এখন একটি চাকরি দরকার। চারিত্রিক সনদপত্র এবং দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে সে ঢাকা শহরে এক বন্ধুর কাছে এসেছে। বন্ধুটির নাম আবদুল হক। সে অনেক আলাপ করে বুঝলো যে আবুল কালামের চাকরির একটি যোগ্যতা ভালোই রয়েছে, আর সেটা হলো তার বাইসাইকেল চালানোর দক্ষতা। যদিও হক কিংবা আবুল কালাম, তাদের উভয়েরই নিজস্ব কোনো বাইসাইকেল নেই। আবদুল হক ঢাকায় একটি চাকরি করে মেডিক্যাল এডমিশন কোচিং সেন্টারে। সেই সেন্টারের পাশেই এক বিউটি পার্লারের পরিচিত আপার কাছে গেলো হক। আপা কোনো আশ্বাসই দিতে পারলেন না। রাতে আবুল কালামকে সংসদ ভবন দেখাতে নিয়ে গেলো হক। সংসদ ভবন দেখে কালাম মুগ্ধ হয়ে গেলো। ঢাকায় তার চাকরি না হোক, চাকরির জন্য এসে তো কমপক্ষে সংসদ ভবনটা দেখেছে। গ্রামে আবুল কালামদের কুঁড়ে ঘরে বসবাস। সেই ছেলে লোকাল ট্রেনে করে ঢাকায় আসতে আসতে পুরো বাংলাদেশটাকে দেখেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদের রাতে আবুল কালামের পিতাকে হত্যা করে পাকিস্তানী আর্মি। আবুল কালামের পিতার একটি বাইসাইকেল ছিলো। এই বাইসাইকেল নিয়ে আবুল কালামের পিতা আর্মি আসার খবর আগেই বাড়ি বাড়ি বলে দিতো। তার এই ছিলো বড় অপরাধ। ঢাকা শহরে এতো নিচে দিয়ে বিমান যায়, দেখে তো মুগ্ধ আবুল কালাম। গ্রামে তার ফিরতে ইচ্ছে করে না। কিছুদিন আগেও আবুল কালামদের পাশের বাড়ি সৌদি প্রবাসী নুরুল আমিনদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। আবদুল হকের ঢাকায় থাকা এক বন্ধু হলো বরিশালের হাবীব। হাবীবের বাড়ি বরিশালের কলেজ রোড এলাকায়। হাবীবও আবুল কালামের জন্য চাকরির চেষ্টা করে। কিন্তু আবুল কালামের ভাগ্য খারাপ। তার কপালে চাকরির দেখা নেই। আবুল কালাম ভাবে, বড় বড় বাড়ি অথবা অফিসের গেটের অনেক নিরাপত্তারক্ষী কুকুরও তার চেয়ে সুখে বসবাস করছে। ঢাকায় এসে আবুল কালাম এরই মধ্যে যা দেখে ফেলেছে, এখন আর তার গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। গ্যাস দিয়ে রান্নার কথা শুনেছিলো। এখন গ্যাসের চুলাও দেখেছে। দেখেছে প্রেশার কুকার। তবে বুঝেনি কিভাবে গ্যাস চুরির ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল খাটিয়ে এই শহরেরই কিছু লোক বাড়ি- গাড়ি করছে। বাড়িতে আবুল কালামের একটি গাভী ছিলো। এই গাভীর দুধ বাজারে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতো সে। অভাবে কিছুদিন আগে গাভীটি বিক্রি করে দিয়েছে। মূলত একমাত্র বোনের বিয়ের খরচাপাতি যোগাতেই গাভীটিকে বিক্রি করে বেকার হয় আবুল কালাম। তারপর উপায় না দেখে বন্ধ আবদুল হকের শরণাপন্ন হয়। চলে আসে ঢাকায়। রাতের বেলা আবদুল হকের একই বিছানায় শুয়ে শুয়ে আবুল কালাম ভাবে পাশের গ্রাম জয়নগরের নীলার কথা। নীলাদের সারাবাড়ি রক্তকাঞ্চনে ভরা। ঠিক রক্তকাঞ্চনের মতোই পরমা সুন্দরী নীলা। ঢাকায় একটি চাকরি পেলে নীলার কথা ভাববে আবুল কালাম কিন্তু পরদিন সকালে বন্ধু আবদুল হক বলে, ভাই আবুল কালাম, তুই বাড়িতে চলে যা। চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলেই আমি তোকে চিঠি লিখে জানাবো। তা না হলে আমার থাকার ব্যবস্থাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। এটা ঢাকা শহর। খুবই কঠিন। মানুষ এখানে ভীষণই হিসাবী ভাই। আবুল কালাম আবদুল হককে আর কিছুই বলতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতে গিয়ে যে করেই হোক পুরনো একটি বাইসাইকেল কিনবে সে। পত্রিকার হকারগিরি করবে। এই বাইসাইকেলই সঙ্গী ছিলো তার পিতা আনোয়ারুল আবেদীনের। বাজারের একটি কদম গাছের নিচে ছিলো আনোয়ারুলের দোকান। সাইকেল ভাড়ার দোকান। স্কুলের যুবক ছেলেরা ‘ঘন্টা হিসাবে ভাড়া’য় নিতো সাইকেল চালানো শিখতে। তাছাড়া সেই সাইকেল সমাজসেবায়ও কাজে লাগতো। সেই বাইসাইকেলটি শ্রীপুরের শাহজাহান রাজাকার নিয়ে গিয়েছিলো।

৭৭| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৬

জসীম অসীম বলেছেন:
ভগ্নিপতি যখন নিজেরও পতি হয়
অক্টোবর ২০১৫, কলাবাগ হাউজিং, ধর্মপুর, কুমিল্লা।

মান্নানের শ্যালিকা মান্নানের জন্য রীতিমত উন্মাদ। মান্নানের স্ত্রী মনি এক লক্ষ্মী বউ। কিন্তু মান্নান নিজেও সাধু পুরুষ নন। এমন ভালো বউ পাওয়ার পরও তার মন পড়ে থাকে প্রায়ই শ্যালিকা রাণীর কাছেই। মনি পছন্দ করে রবীন্দ্র সংগীত। রাণীর প্রথম পছন্দ হিন্দী গান। রাণীর বান্ধবী ঝিলমিল রাণীর এ উন্মাদ অবস্থার কথা তার মনি আপুকে বলে দিয়েছে। মনি আপু বলেছেন, আমার বোনকে আমি কিছুই বলবো না। বারণও করবো না। তবে তার শেষ অবস্থা হবে ওই লোভী কৃষকের মতো, যে অনেক সোনার ডিমের আশায় সেই দুর্লভ হাঁসটিকে জবাই করে দিয়েছিল। আবদুল মান্নান ‘প্রতিমা দেবী মহিলা কলেজে’র অধ্যক্ষ। বেসরকারি কলেজ। আর রাণী মায়াবিনী সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মনি বাংলা সাহিত্যে অনার্স কমপ্লিট করলেও মাস্টার্স শেষ করেননি। এখন এক কন্যা সন্তানের জননী এবং গৃহবধূ। মান্নানের সঙ্গে তার শ্যালিকার একটি মিল রয়েছে। মান্নানও ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যেরই ছাত্র। ফলে ইংরেজিসহ বিদেশি অনেক সাহিত্যের পড়া রয়েছে তার। সেদিন তিনি তার শ্যালিকা রাণীকে কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয়ের ‘ আন্না কারেনিনা’ গিফট করেছেন। এই রুশ উপন্যাস পড়ে তো রাণীর মাথাই খারাপ। রাণী ঘুরে ঘুরেই প্রিন্স স্তেপান আর্কাদিচ অবলোনস্কি বা স্তিভা এবং আন্না সম্পর্কে তার দুলাভাই আবদুল মান্নানকে অনেক প্রশ্ন করে। টিভি- তে আফগান যুদ্ধের একটি খবর দেখছিলেন মনি। যুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্য দেখাচ্ছিল খবরে। কিন্তু ড্রয়িংরুমে দুলাভাই আর শ্যালিকার এই রুশ সাহিত্যের মশগুল আড্ডা থেকে নিজেকে সরাতে টিভি দেখা বন্ধ করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। রাতে বিছানায় শুয়ে মনি তার স্বামীকে বললেন, আব্বা মারা গেলেন অনেক বছর। আম্মাও মারা গেলেন চার মাস হলো। রাণী আর কতোদিন আমাদের বাসায় থাকবে! যদি আমাদের একটা ভাই থাকতো কিংবা আমাদের পড়াতে কিংবা বাঁচাতে গিয়ে আম্মা শহরের বাড়িটা বিক্রি না করতে বাধ্য হতেন, তাহলে একটা কথা ছিলো। এই মেয়ের এখন দায়িত্ব নেবে কে? মনির মুখে সহসা এমন কথা শুনে অনেকটা অবাকই হলেন মান্নান। বললেন, বাপ- মা মরা মেয়েটাকে তুমি তাড়িয়ে দিতে চাও? নাকি তুমি আমাকে কোনো কারণে বিশ্বাস করতে পারছো না? তার লেখাপড়াটা আগে শেষ করা দরকার। মনি বললেন, বিশ্বাস- অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। আমি ভাবছি রাণীর ভবিষ্যৎ কী হবে। তাছাড়া আমিও পড়লাম সাহিত্য নিয়ে, সেও আবার পড়ছে এখন সাহিত্যই। অবশ্য ইংরেজি সাহিত্য কিন্তু এতে ভবিষ্যৎ কী হবে! মান্নান বললেন, আমিও তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। একটি কলেজের অধ্যক্ষ তো হয়েছি। তাছাড়া আমার নিজের জীবনের কাছে চাওয়াও বেশি ছিলো না। মনি বললেন, তোমার তো রেজাল্ট খুব ভালো ছিলো। আবার হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমি পড়লাম একটি কলেজে। তাও লেখাপড়া শেষ করলাম না। রাণীও এখন ওই কলেজেই পড়ছে। আমি বলি কী, রাণী নৌবাহিনীতে চলে যাক। ওর যা সুঠাম স্বাস্থ্য। আমাদের রবিউল মামা নৌবাহিনীর অফিসার। তিনি বলেছেন, অফিসার ক্যাডেট ব্যাচে রাণী যেন অ্যাপ্লিকেশন করে। মামা জানেন, রাণী এসএস সি ও ইন্টারমিডিয়েটে পিওর সাইন্সে ছিলো। মান্নান গম্ভীর স্বরে বললেন, বোন যেহেতু তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার। মান্নানের এ কথায় মর্মাহত হোন মনি। বলেন, আমার বোন মানে? তুমি তো তার একমাত্র গার্ডিয়ান। তুমিই বলো সাহিত্য পড়ে কী করবে সে? একটা পরিবারের সবাই আমরা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী। কিন্তু জীবনে বাঁচতে টাকাপয়সাও তো চাই। তাকে বারবার বলেছিলাম, ম্যাথমেটিক্স কিংবা কেমেস্ট্রিতে ভর্তি হতে। সে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো ইংরেজি সাহিত্য ভর্তি হলো। তুমিও বললে, ইংরেজি পড়লে জীবনের সার্থকতা উপলব্ধি করবে সে। আব্বার সারাজীবনের ইচ্ছে ছিলো আমাদের দুই বোনকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু আমি বরাবরই লেখাপড়ায় দুর্বল ছিলাম। কিন্তু রাণী পদার্থ, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান ও গণিতসহ ইন্টারমিডিয়েট জিপিএ- ৫ পেল। যে কারণেই হোক বুঝলাম তোর মেডিক্যালে পড়া হলো না। তাই বলে ইংরেজি সাহিত্য কেন পড়বি? শুরুতেই আমি এর বিরোধীতা করেছিলাম। মান্নান বললেন, আমি তো রাণীকে বেসরকারী একটি মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেই চেয়েছিলাম। বারণ করলে তো তুমি। মনি বললেন, শহরে তোমার একটি বাড়ি থাকলে না হয় কথা ছিলো। একদিকে আমরা ভাড়া থাকি, অন্যদিকে আমি আবার হাউজওয়াইফ। আমরা সবাই মিলে তো রাণীর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে পারি না। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে পড়ার এতো খরচ কোথা থেকে আসবে? সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বসে মনি তার ছোটবোন রাণীকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট ব্যাচে অ্যাপ্লিকেশন করার কথা বললে বাসার শান্তির পরিবেশটা এই প্রথম উত্তাল হয়ে উঠে। রাণী মনিকে বলে, তোর যদি ইচ্ছে করে, তুই গিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে বাড়ি করে বসবাস কর। আমাকে সমুদ্রে পাঠাবি না। সমুদ্রের প্রবাল চিরকালই তোর পছন্দের জিনিস। নিজের পছন্দ আমার জীবনে চাপিয়ে দেওয়ার কল্পনাও করিস না। তোর হিন্দু বন্ধু নিশিকান্ত একবার ঠিকই বলেছিলো যে তুই নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের জীবনে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে থাকিস। আজ আজ আবার আমি কথাটার প্রমাণ পেলাম। মনি বললেন, কথাটা ঠিক নয়। আমি চাই তোর জীবনটা হোক একেবারেই ব্যতিক্রম। উদাহরণযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্য পড়ে তোর হবে এক সাদামাটা জীবন। এই সাদামাটা জীবনে আমি সুখি এবং অভ্যস্থ। কিন্তু তোর সুঠাম স্বাস্থ্য- রূপ- দুর্জয় মনোবল কিংবা সাহসের জন্য আমার মনে হয় নৌবাহিনীতে তুই ভীষণ ভালো করবি। কারণ আমি কোনোকালেই তোর মতো ভালো ছাত্রী ছিলাম না। রাণী এ কথায় আরও ক্ষেপে গিয়ে তার দুলাভাই মান্নানকে বললো, দুলাভাই আপনি আজ থেকে আমাকে আপনার বন্ধু নজরুলের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। বেলারুশের মিনস্কে। আমি এই দেশেই থাকবো না। মনি আপু আমার চেহারা দেখাটাও সহ্য করতে পারছে না। আব্বা ছিলেন কলেজের শিক্ষক। তিনি বেঁচে থাকলে তার কোনো মেয়েকেই সমুদ্রে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করতেন না। মনিও রাণী দুইবোনের তর্কযুদ্ধের পর রাণী যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, সন্ধ্যায় এমনকি রাতেও আর বাসায় ফিরে না। বাসা থেকে যাওয়ার পর পরই মোবাইলও বন্ধ রাখে। রাত দশটার পর মান্নান ফেসবুকে পান তার এই শ্যালিকাকে। কিন্তু রাণী ফেসবুকে মান্নানের কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেয় না। শুধুমাত্র এইটুকুই জানায় যে, সে তার এক বান্ধবীর বাসায় রয়েছে। কয়েকদিন পর কলেজের হোস্টেলে উঠতে চেষ্টা করছে। মনি- মান্নানের বাসায় আর সে থাকবে না। শ্যালিকার সংস্পর্শ হারিয়ে দুলাভাই মান্নানেরও মন যেন ভালো নেই। তাই পরদিন থেকে তিনি বিভিন্নভাবে রাণীর প্রতি নজর রাখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো খোঁজ পেলেন না। কেন না রাণী তার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। দুপুরে মোবাইলে কোনো প্রকার যোগাযোগ না করেই রাণী এলো মান্নানের কলেজে। এসেই কিছু টাকা চাইলো এবং বললো তার কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে একটি ফোন দিতে যেন তার কলেজ হোস্টেলে রাণীর জন্য একটি সিটের ব্যবস্থা করে। দুলাভাই মান্নান তার শ্যালিকাকে বাসায় ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেন। রাণী আর ফিরতে রাজি হয় না। শুধু বলে, আমি আমার বান্ধবী মিতালির বাসায় থাকছি। আপু যেন এ কথাটি না জানে। মান্নান বলেন, আমি তোমার বোনকে এ কথা না জানিয়ে ফাঁকি দিতে পারবো না। রাণী বলে, তাহলে আপনার সঙ্গেও আমার আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না এবং আপনার কোনো সহযোগিতাও আমি আর নেবো না। মিতালি শহরের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। রাণীর খুব ভালো বান্ধবী। রাণীর বাবার সঙ্গেও মিতালির বাবার পরিচয় ছিলো। তার বাবা অবশ্য উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা একমাত্র ভাই ডাক্তারী পড়ে ঢাকায়। ওরা অবশ্য কুমিল্লায়ই সেটেল্ড। কিছুদিন আগে এক ফরেনার ব্রাহ্মণ পাত্রের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল মিতালির জন্য। কিন্তু তার বাবা লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে তার বিয়ের বিষয়ে সম্মত নন। এদিকে রাণী বাসার না ফেরায় দু’দিন ধরে রাতের বেলা অনেক কাঁদলেন মনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে টেলিভিশনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনুষ্ঠান দেখছিলেন মান্নান। মনি তার হাত ধরে কেঁদে বললেন, যেখান থেকে পারো, আমার বোনকে খুঁজে বের করে আনো। মান্নান বললেন, কোথায় খোঁজ করবো আমি? সময় কোথায়? আজ আবার কলেজে যাওয়ার আগেই আমাকে ওয়ারিদ টেলিকমের অফিসে একটু কাজে যেতে হবে। মনি বললেন, আজ তুমি সব কাজ বাদ দিয়ে রাণীর খোঁজ নাও। দুইদিন ধরে সে বাসায় ফিরলো না। খোঁজ পেলে বলবে তাকে আমি আর কোনোদিনও তাকে চাকরির কথা বলবো না। কলেজে যাওয়ার আগেই মান্নান মিতালিদের বাসায় গেল। রাণী তার দুলাভাইকে দেখেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি আমার থাকার ঠিকানা আপুকে বলে দিয়েছেন? মান্নান বলেন, এতোটা বোকা হইনি। এতো বোকা লোক কি সংসার করতে পারে? রাণী বলে, ভালো করেছেন। বললে আবার আপু এখানে এসে অঘটন ঘটাতো। তার যখন তখন কান্নাকাটি আমার একদম ভালো লাগে না। মান্নান বলেন, কিন্তু আমার ছোট্ট মেয়ে রাজেশ্বরী, তার কী অপরাধ? তাছাড়া তোমার বোনও এখন আবার ডিমঅলা মাছ। তার কথাও ভাবতে হবে তোমাকে। রাণী বলে, দুলাভাই আপনি এখন চা- খেয়ে কলেজ চলে যান। আজ আমি আপুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলবো। কিন্তু বাসায় যাবো না। রাজেশ্বরীকে না দেখে তো খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু আপুর পেটের সন্তানের জিম্মাদারি তো আপনার উপরই বেশি নির্ভরশীল। আপনি তো আবার...। মান্নান বলেন, তোমার এখন বাসায় ফেরা দরকার। মনি তো তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করেনি। রাণী বলে, বাসায় ফিরলেও আমি কখনো হোস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবো না। মান্নান বলেন, আমাদের অপরাধটা কোথায়? রাণী মান্নানের মুখের কাছে ঝুঁকে গিয়ে বললো, আপনি এখন চা খেয়ে কলেজে চলে যান। সন্ধ্যায় আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন এশিয়া ক্যাফেতে। আমি যাবো মিতালিকে সঙ্গে নিয়ে। একা একা বসে কথা বলাটা খারাপ দেখাবে। মিতালি ব্ল্যাক কফি পছন্দ করে। বাকি তা খাওয়াবেন, যা আপনার পছন্দ। আপনি মোটর সাইকেলে চড়ে আসবেন না। রিকশায় আসবেন। সাইকেল- আর মোটর সাইকেল আমার কাছে একই রকম লাগে। সন্ধ্যায় এশিয়া ক্যাফেতে বসে রাণীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মান্নানের মনে অতীত এসে ভিড় করে। জীবনানন্দ দাশের একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারের কথা অনেকদিন তেমন করে মনে পড়েনি তার। বৈচিত্র্যে ভরা ঝরণাধারায় এখনো যেন পুরোপুরি যৌবনবতী হয়নি তার জীবন- তটিনী। হঠাৎই মান্নান আবেগপ্লুত হন। রাণীর একটি হাত ধরে বলেন, রাণী সমুদ্র দেখতে যাবে? পতেঙ্গায়? ওখানে আমার এক বন্ধু আছে একটি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সমুদ্র দেখলে তোমার মন খুব ভালো হয়ে যাবে।...। মান্নানের কথা শেষ না হতেই মিতালি ফিরে আসে এশিয়া ক্যাফের ওয়াশরুম থেকে। তিনতলার এ ক্যাফের একপাশে একটি কদমবৃক্ষ কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখতে চমৎকার লাগে। [ রাণী বলে, আমি সমুদ্রকে ভয় করি। এই সমুদ্র নিয়েই তো আপুর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। অথচ আপনার হওয়ার দরকার ছিলো নৌবাহিনীর অফিসার। মান্নান হেসে বলেন, হঠাৎ কেন নৌবাহিনী আর সমুদ্রের প্রতি ক্ষেপে গেলে রাণী? রাণী বলে, আমি সাঁতার জানি না। শিখতেও চাইনি কোনোদিন। আমার শরীরে তো নতুন করে এখন কোনো এয়ার ব্লাডারও সৃষ্টি হয়নি যে আপু আমাকে সমুদ্রে পাঠানোর পরিকল্পনা করলো। আর এটা কি পরিকল্পনা নাকি ষড়যন্ত্র? আমি কি তার পাকা ধানে মই দিয়েছি? মান্নান বলেন, আমার মনে হয় তোমার আপু এমন কিছু ভেবে কথাগুলো বলেনি। তাহলে কি বোনের জন্য আবার এভাবে কাঁদতে পারে? মহড়াকালে যে অনেক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, যুদ্ধজাহাজ ডুবে যায়, সে কথা তোমার আপু বলবে কী করে? রাণী বলে, ঠিক আছে আমার মামা নৌবাহিনীর অফিসার। কিন্তু আমাদের বংশের কোনো নারী কোনোদিনও নেভি- তে চাকরি করেনি। অথচ আপু আমার জন্য এমনই চিন্তা করেছে। এ হলো পানিতে ডুবিয়ে মারার এই যুগের অত্যাধুনিক পরিকল্পনা। ঠান্ডা মাথায় খুন। আরে যে মেয়ে সাহিত্যের ছাত্রী, সমুদ্রকে ভয় পায়, সাঁতার জানে না, তাকে পাঠাবে নৌবাহিনীর চাকরিতে! অনেকক্ষণ ধরে কথা শুনছিলো মিতালি। এবারে একটু মুখ খুললো। বললো, রাণী এখন কিন্তু দিন বদল হয়েছে। তা না হলে সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে, পুলিশে বা মিলিটারীতে এতো নারী নেয়? আমার মনে হয়, ওই ভেবেই আপু কথাটা বলেছে। এতকিছু ভেবে বলেনি। রাণী হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। বলে, মিতালি তুই আপুর পক্ষ নিয়ে কথা বললে আমি তোর বাসা ছেড়ে এখনই চলে যাবো। আমি করি সমুদ্রকে ভয়। আর আপু করে আমাকে ভয়। আমিই তার সমুদ্র। আর দুলাভাই? তিনি মনে করেন তার সমুদ্র মনি আপু। তাই তিনি বউকে মারাত্মক ভয় করেন। আসলে ভয় রয়েছে সবারই অন্তরে। হঠাৎ মিতালি উঠে দাঁড়ায়। রাণীকে বলে, চল রাণী- বাসায় চল। দেরি হলে আবার বাবা বকবে। তাছাড়া যাওয়ার পথে জিলা স্কুল রোড থেকে মিল্টনের ‘এ্যারিও প্যাজিটিকা’ কিনে নিতে হবে। আরেকদিন কোনো দোকানেই পাইনি। রাণী বলে, মিতালি তুই একটু নিচে গিয়ে দাঁড়া। আমি আর দশ মিনিট দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসি। মিতালি নিচে চলে গেলে রাণী বলে, দুলাভাই, যদি সুযোগ হয় ফরাসী চিত্রশিল্পীদের কিছু কাজ দেখবেন। ইন্টারনেটে গগ্যাঁ- র কিছু ছবি দেখবেন। সাহস বাড়বে। মিনমিন করা পুরুষ আমি দেখতেই পারি না। আমি হলাম তেঁতুল কাঠ। ঝাঁজও মারাত্মক। তাই আমি বাসা ছেড়ে চলে এসেছি। আমাদের কলেজের বাংলা বিভাগের রুচিরা তার দুলাভাইকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু আমি কি সে রকম মেয়ে? আপু তো আমাকে রীতিমত সন্দেহ শুরু করেছে। বাসায় আমি আর থাকি কী করে? মান্নান বলেন, আমার কিন্তু রাণী তেমন মনে হয় না। তোমার বোন আসলে তোমার মঙ্গল কামনা করতে গিয়ে অনেক সময় অতিরিক্ত ভাবনা ভাবে। দেখলে না, তিন মাস আগে তোমার বিয়ে প্রায় ঠিকই করে ফেললো দিনাজপুরের চিররবন্দর শাখার জনতা ব্যাংকের এক অফিসারের সঙ্গে। তোমার মামাও রাজি হয়ে গেলেন। বাধা দিলাম আমি। রাণী বললো, আপনি বাধা দিয়েছেন আপনার স্বার্থে। আমার স্বার্থে নয়। মান্নান বললেন, সেটা কী রকম? রাণী বলে, আপনি নিজেকে সাধু বলে দাবী করবেন না। আপন বোনের সঙ্গে সংসার না করলে আপনার সাধুগিরি যে কতো ঠুনকো, তা আমি প্রমাণ করে দিতাম। আমার বোন ঘরকুনো স্বভাবের। কিন্তু আমি অন্যরকম। আপনার মতো দশ পুরুষকে নাকে দড়ি দিয়ে টানার সাহস রাখি। মান্নান বললেন, তোমার এ মতামত আমি মানতে পারলাম না রাণী। আমার কলেজে তোমার মতো হাজারো ছাত্রী রয়েছে। রাণী বলে, কিন্তু আমি আপনার ছাত্রী নই। মান্নান বলেন, তাই বলে কি আমি কখনো অন্যায় কিছু করেছি? রাণী বলে, দিঘিওয়ালি সম্মতিই দিলো না। আপনি কোথায় সাঁতার কাটবেন? মান্নান বলেন, আমি কি কখনো সে রকম আচরণ করেছি? রাণী বলে, সেদিন আপনি- আমাকে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ঠোঁটে চুমো দিয়েছেন। মান্নান বলেন, আমি তোমাকে দেবী মনে করে এটা করেছি। পাপদৃষ্টিতে করিনি। রাণী বলে, পাপ দৃষ্টিতেই করেছেন। দানবের দৃষ্টিতে করেছেন। আপনি আমাকে ভোগ করেছেন। সম্ভোগ করেছেন। উপভোগ করেননি। আপনি আমাকে নষ্ট করে বুকের কষ্ট শতগুণ বাড়িয়েছেন। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। ততক্ষণে নিচে থেকে মিতালি আবার এশিয়া ক্যাফেতে উঠে আসে। বলে, রাণী প্লিজ এক্ষুণি চল। বাবা আজ খুব বকবে। রাণী বলে, প্লিজ মিতা আর পাঁচ মিনিট একটু সহ্য কর। এক্ষুণি আসছি। এমন সময় মান্নান রাণীর আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, রাণী তোমার প্রশ্রয়েই আমি এতটা এগিয়ে এসেছি। সব দোষ তাই আমার নয়। তুমি এ পর্যন্ত প্রায় দশবার আমার নাকে তোমার স্তন ঘষে দিয়েছো। তুমি ভাব দেখিয়েছো তোমার অলক্ষ্যেই এটা হয়েছে। কিন্তু আমি জানি প্রতিবারই তুমি এসব ইচ্ছে করেই করেছো। তোমার বোন আমার স্ত্রী না হলে তক্ষুণি আমি তোমাকে ছিঁড়ে দেখতাম। রাণী বলে, দেখলেন আপনি কতো খারাপভাবে ভাবতে পারেন? অথচ আমি আপনার সঙ্গে শুয়ে থাকতে পারবো কোনো পাপচিন্তা ছাড়াই। আমি জানি, কোরআন শরীফে মৃত পশুর গোশত এবং আপন ভগ্নিপতির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক হারাম করা হয়েছে। মান্নœান বললেন, এসব জেনেও তুমি আমার সামনে একটা ওড়না জড়িয়ে দিব্যি পোশাক বদল করে ফেলো। রাণী বলে, আমি তো সবকিছুকেই সহজ করে নেই। পাপদৃষ্টি আমার মাথায় নেই। মান্নান বলেন, সহজ করে নিলে মনি তোমাকে নৌবাহিনীর ক্যাডেট ব্যাচে অ্যাপ্লিকেশনের কথা বলাটা সহজ করে নিলে না কেন? রাণী বলে, যদি আপনিও চান আমি সমুদ্রে ডুবে মরি, তাহলে আমি এক্ষুণি অ্যাপ্লিকেশনের সিদ্ধান্ত নেবো। পরে কিন্তু ফেরাতে পারবেন না আর। মান্নান হেসে বলেন, আমি আমার আদরের একমাত্র শ্যালিকাকে নিশ্চয়ই ডুবে মরতে দিতে পারি না। ততক্ষণে মিতালি আবার এসে রাণীকে ফেরার তাড়া দেয়। মিতালি আর রাণী বাসায় ফেরার পর এবার যেন মান্নানের বিবেক জাগ্রত হয়। নিজের স্ত্রী মনির কাছে অনেক কথাই লুকানো শিখেছেন তিনি। বিশেষ করে আপন শ্যালিকার সঙ্গের সর্ম্পকটিকে তিনি যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তা যে শুভকর নয়, তা জেনেও ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছেন। তার স্ত্রী মনি সহসা অসুস্থ হলেও নামাজের বিষয়ে কোনো ওজর তুলেন না। সেক্ষেত্রে তারা শ্যালিকা আর দুলাভাইয়ের ফাঁকিবাজির শেষ নেই। দোকান থেকে একটি কোম্পানীর ২৫ মিলি লিটারের ঝাঁঝালো পানীয় কিনে দোকানের সামনেই গিলতে থাকেন আবদুল মান্নান। এশিয়া ক্যাফে- তেও এতক্ষণ অনেক পানীয় পান করেছেন। তবু যেন তৃষ্ণা মিটছে না তার। এক প্যাকেট কয়েল কিনে ছুটলেন বাসার দিকে। বাসায় ফিরতেই মনি মান্নানকে বললেন, রাণী কোথায়? আজও কেন আসলো না সে? মান্নান বলেন, তুমি তাকে সমুদ্রে পাঠানোর পরিকল্পনা করবে, সে থাকবে তোমার বাসায়? মনি বলেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সেই দেশের একজন বাসিন্দা হয়ে নিজের বোনকে নৌবাহিনীতে যেতে বলে অপরাধ কিছু করিনি। মান্নান বলেন, রাণী তো সমুদ্রকে ভয় করে। মনি বলেন, আর আমি ভয় করি তোমাকে। কারণ সমুদ্র জয়ের নেশা তো তোমার রয়েছে। আমাকে কিভাবে জয় করেছো, সেটাও মাথায় রয়েছে। মান্নান এবারে একটি সিগ্রেট ধরান। তারপর বলেন, তুমি রাণীর প্রথম প্রেমটা ভেঙে দিয়েছিলো। কেন? মনি বলেন, কারণ তখন তার প্রেমের বয়স হয়নি। নবম শ্রেণিতে পড়তো। এখন তার এভারেস্ট বিজয়ের বয়স। সে তো স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও বিজয়ী হয়ে পুরস্কার নিয়ে ফিরতো। ইদানিং সে সব ছেড়ে বই কিংবা মোবাইলে ব্যস্ত বেশি। মান্নান বলেন, এটা তো দোষের কিছু নয়। মনি বলেন, তার বিয়েশাদীর কথাও আমাদের ভাবতে হবে। আব্বা- আম্মা বেঁচে থাকলে না হয় লেখাপড়া শেষ হলে এসব ভাবতাম। মান্নান বলেন, এখন রাণীর বিয়ের কথা ভাবার তো কারণ নেই। টাকা পয়সা লাগবে না? আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার তোমার দেনমোহরই সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে পারলাম না। মনি বলেন, হঠাৎ কেন দেনমোহরের প্রসঙ্গ আসলো। আমি তো কতোবার বলেছি ওটা আমি পেয়েছি ধরে নিয়েছি। পরিশোধের আর প্রয়োজন নেই। মান্নান বলেন, কিন্তু আমি একজন সচেতন লোক হয়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে এটা পরিশোধ করবো না? ধর্মে তো এটা ফরয। মিতালি রাণীকে বলে, তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে তোর এত মাখামাখি আমার ঠিক ভালো লাগেনি। রাণী বলে, দুলাভাই আমাকে ভালোবাসেন। মিতালি বলে, আর তুই? রাণী বলে, আমি এর উত্তর জানি না। আমি তাকে দিয়ে আমার বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতেও চাই। ব্যাঙ্কে দুলাভাই আমার নামে একটি অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন। টাকা জমাও রাখেন। আমি তুলে তুলে খরচ করি। অ্যাকাউন্ট খালি হলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমার অনেক খরচের দোষ রয়েছে। দুলাভাই আমার জন্য ইদানিং তার ছাত্রছাত্রীদের ওপর নাকি সামান্য চাঁদাবাজিও শুরু করেছেন। এক সংসারের ভিতর তিনি দুই সংসার লালন করছেন। কেন, আমি তা জানি না। মিতালি বলে, তোর দুলাভাই একজন শিক্ষিত লম্পট। তিনি তোর শরীরের পাগল। রাণী বলে, শরীর তো মনি আপুর কাছেও রয়েছে। মিতালি বলে, তার এটা অসুখ। তোকে ভোগ করে আবার আমার দিকে কিংবা কলেজের কোনো ছাত্রীর দিকেও চোখ দিতে পারেন। রাণী বলে, তিনি এমনই পুরুষই নন। তার বন্ধু নুরুল ইসলাম বলেছেন, তিনি নাকি ছাত্রজীবনে প্রেমপ্রীতি ছেড়ে শুধু লেখাপড়াতেই মনোযোগী ছিলেন। নুরুল ইসলাম ভাইয়া এখন ঢাকার শাহবাগ এলাকার পরিবাগে ব্যবসা করেন। রাতে বিছানায় শুয়ে মনি তার স্বামীকে বললেন, রাণী কোথায় আছে, তুমি তা নিশ্চিত জানো। আগামীকাল যেভাবেই হোক বাসায় নিয়ে আসো। দেখো আমাদের বাসাটি কখনো এমন থমথমে ছিলো না। সব সময় সে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। আর এখন? কাজের মহিলা ঝন্টুর মা পর্যন্ত বলেছে আজ, রাণী ছাড়া পুরো বাসাটিই আমাদের ফাঁকা। মান্নান বলেন, ঝন্টুর মাকে কয়েকদিন আমাদের বাসায় থাকতে বলো। তোমার স্বাস্থ্যটাও তো এখন খুব একটা ভালো না। যে কোনো সময় আবার হাসপাতালে যেতে হবে। মনি বলেন, ঝন্টুর মা দূরে থাকে। স্বামী- সন্তান নিয়ে কোনো এক টিনের ছাপড়া ঘরে। থাকতে পারবে না। আমি শুধু আমার বোনের কথা ভেবে তাজ্জব হয়ে গেলাম। আমার এখন বাচ্চা হবে। আর তুই আমার সঙ্গে সামান্য কারণেই রেগে বাসা ছাড়লি? মান্নান বলেন, আমি দ্রুতই তাকে বাসায় ফেরানোর সকল চেষ্টা করবো। তুমি এখন সব দুশ্চিন্তা ছাড়ো। হঠাৎ মনি তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কাঁদতে থাকেন। তারপর বলেন, স্বামী- স্ত্রী উভয়ে কিংবা দু’জনের একজন যৌন অনাচার করলে নাকি তাদের সন্তান প্রতিবন্ধী হয়। মান্নান বলেন, তুমি শিক্ষিত হয়েও কুসংস্কারে বিশ্বাস করো। তাছাড়া আমরা কেউ তো এমন অনাচারে নেই। মনি বলেন, রাজেশ্বরী যখন পেটে ছিলো, প্রতি মুহূর্তে আমার সঙ্গে সাড়া দিতো। কিন্তু আমার এবারের সন্তান আজ কয়েকদিন তেমন সাড়া দিচ্ছে না। মনি আবারও কাঁদতে থাকেন। মান্নান বলেন, তুমি কান্না বন্ধ করো। ওসব তোমার মনের ভুল। মনি বলেন, আমার ছোট বোন পছন্দ করে কার্বনেটেড ড্রিংকস। আর আমি সাদা পানি। আর তুমি সাদা পানি, ফলের রস, কোমল পানীয় ... এমনকি উন্নত মদও একইসঙ্গে পছন্দ করো। তোমাকে তাই বুঝতে পারি না আমি। মান্নান আর এ কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে ঘুমোতে চেষ্টা করেন। পরদিন মনি- র স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়। খবর পাঠানো হয় রাণীকে। রাণী মিতালির মামাতো বোন ভারতীকে নিয়ে খুব দ্রুতই বাসায় উপস্থিত হয়। মিতালি তখন বাসায়ও ছিলো না। দুইজন নার্স সহ অ্যাম্বুলেন্স আসে বাসার সামনেই। রাণী, ভারতী আর ঝন্টুর মাকে বাসায় রেখে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে মনিকে নিয়ে শহরের একটি নামী ক্লিনিকে যায়। ততক্ষণে মোবাইলে যোগাযোগ করে মিতালিও হাসপাতালে উপস্থিত হয়। মিতালি রাণীকে বলে, তোর বোনকে এভাবে রেখে তুই বাসা ছাড়তে পারলি? রাণী বলে, যুদ্ধে-প্রেমে কিংবা রাগে মানুষ যা করে, তা দিয়ে তাকে বিচার করা ঠিক নয়। তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মিতালি বলে, এখন যদি তোর বোন মরে যায়, তুই সবচেয়ে বেশি খুশি হবি। কারণ আমি তোর ভিতরটা পাঠ করে ফেলেছি। মিতালির এ কথায় রাণী ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। এদিকে মান্নানকে ডাক্তার কিছু ওষুধের তালিকা দিলেন। ওষুধ কেনার পর মনিকে ওটি- তে পাঠানো হলো। ওটি ইনচার্জ রাণীকে বললেন, আপনারা ঘাবড়ে গিয়েছেন কেন? ভয়ের তো কিছু নেই। আরও কিছু টাকা তুলতে মিতালিকে একটি চেক দিয়ে ব্যাঙ্কে পাঠালেন মান্নান। ফেরার পথে মিতালির রিকশা তাৎক্ষনিকভাবে আটকে কিছু দুর্বৃত্ত তার মোবাইল ও টাকার ব্যাগ ছিনতাই করে নিয়ে যায়। একজন পুলিশ তাড়া করেও ছিনতাইকারীদের ধরতে পারেনি। সন্ধ্যার দিকে মিতালি আর ভারতী নিজেদের বাসায় ফিরে। টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার পর মিতালি প্রায় নির্বাক হয়ে যায়। সবাই আরও বেশি নির্বাক হয় মনি- র মৃত সন্তান প্রসবের ঘটনায়। রান্না করতে বাসায় চলে আসে রাণী। ঝন্টুর মা মনি-র পছন্দের সব রান্নাই করে দেয়। ক্লিনিকে মনির কাছে সময় দেয় রাজেশ্বরী আর মান্নানের এক ফুপু রাশিদা বেগম। রাত দশটার দিকে খাবার নিতে বাসায় আসেন মান্নান। তার মন খুবই খারাপ। তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে রাণী। বলে, দুলাভাই সব দুর্ঘটনার জন্য দায়ি একমাত্র আমিই। মান্নান বলেন, দায়ি কেউ নয়, এসব আমার কপালের লিখন। অথবা আমি নিজেই দায়ি। কারণ আমিই তো এই সংসার গাড়ির ইঞ্জিন। গলদ ছিলো ইঞ্জিনই। রাণী বলে, গাড়িতে কি চাকার ভূমিকা নেই? মান্নান বলে, চাকা যদি তোমার বোন হয়, তাহলে চাকার হাওয়া হলে তুমি। তোমার বোন চাকার হাওয়া বের করতেই তো ঘটলো দুর্ঘটনা। ডিসেম্বরের কড়া শীত। বাসার সব দরজা- জানালা বন্ধ। গরম- ঠান্ডা জল মিশিয়ে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেন মান্নান। রাণী বলে, ছোট বালতিটা দিন। মান্নান বালতি এগিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে শেভ করতে নিজের মুখে শেভিং ক্রীম মাখেন। দরজায় আবার নক করে রাণী। কী আবার দরকার? বলেই দরজা খুলেন মান্নান। এবার রাণী নিজেই ভিতর থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর বলে, দুলাভাই প্লিজ একটা রিকোয়েস্ট। জগতের কেউ জানবে না এ কথা ...। রাণীর এমন আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খান মান্নান। যদিও তিনি এমন কোনো ঘটনার আশায় ওঁৎ পেতেই ছিলেন। মনির জীবনের এমন আর্তির রাতটায় দুলাভাই মান্নান আর শ্যালিকা রাণীর ফুর্তি যেন শত শতগুণ বেড়ে যায়। ঝন্টুর মা ততক্ষণে পৌঁছে যায় নিজ বাসায়। স্ত্রী মনি আর ফুপু রাশিদার জন্য খাবার নিয়ে জেলা বেসরকারী কলেজ শিক্ষক পরিষদের সভাপতি আবদুল মান্নান ক্লিনিকের দিকে যখন বাসা থেকে বের হন, তখন রাত সাড়ে এগারোটা। ক্লিনিকে খাবার নিয়ে আসতেই মান্নানের ফুপু বললেন, তোর কলেজের সুজিত স্যার মনিকে দেখতে এসেছিলেন। মান্নান বলেন, আমি জানি। মোবাইলে কথা হয়েছে। ফুপু বলেন, এত দেরি করলি কেন? মনি তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মান্নান বলেন, ঝন্টুর মা কী এক সমস্যায় দেরি করে এলেন। ততক্ষণে ঘুম ভেঙ্গে যায় মনির। তার খুব কাছে গিয়ে বসেন মান্নান। হাতে হাত রাখেন। মনি চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন, আমার জীবনের আজকের ঘূর্ণিঝড়টা বঁড়শির মতো করে সারাজীবন বুকে গেঁথে থাকবে। মান্নান মনির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলেন, সব ভুলে যাও মনি। শক্ত করো নিজেকে। মনি বলেন, আজ আমার এমন দুঃখের দিনে তুমি কিভাবে শরীরে সুগন্ধী স্প্রে করলে? মান্নান বলেন, ধুলাবালিতে- ঘামে কালিতে সারাদিন কি কম ধকল গেল? মনি বলেন, আমি ক্লিনটনের লিউইনস্কি মনিকা নই। যে তোমাকে বিচারের মুখোমুখি নেবো। কিন্তু আমি লজ্জায় আর কষ্টে মরে যাই। চোখের জলে ভেজানো এমন দিনে তুমি শরীরে কিভাবে সুগন্ধী মাখাতে পারো। ততক্ষণে ক্লিনিকের বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে মান্নানের ফুপু আসেন সবাইকে খাবার খাওয়াতে। রাত একটু বাড়লে মনি তার স্বামী মান্নানকে বলেন, তুমি বরং বাসায় চলে যাও। ফুপু আছেন। না ঘুমিয়ে কষ্ট করার কী দরকার? মান্নান বলেন, তোমার কি মাথা খারাপ তোমাকে ফেলে বাসায় যাবো আমি! মনি বলেন, রাণী বাসায় একা। ভয় পাবে। মান্নান বলেন, ও কি দুধের কচি খুকি নাকি! তাছাড়া সে তো সমুদ্রকে ভয় করে। আমাদের বাসাটি নিশ্চয়ই বঙ্গোপসাগর নয়।

৭৮| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:০৮

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প
বাইসাইকেল
আবুল কালামের শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি পাশ। কিন্তু তার এখন একটি চাকরি দরকার। চারিত্রিক সনদপত্র এবং দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে সে ঢাকা শহরে এক বন্ধুর কাছে এসেছে। বন্ধুটির নাম আবদুল হক। সে অনেক আলাপ করে বুঝলো যে আবুল কালামের চাকরির একটি যোগ্যতা ভালোই রয়েছে, আর সেটা হলো তার বাইসাইকেল চালানোর দক্ষতা। যদিও হক কিংবা আবুল কালাম, তাদের উভয়েরই নিজস্ব কোনো বাইসাইকেল নেই। আবদুল হক ঢাকায় একটি চাকরি করে মেডিক্যাল এডমিশন কোচিং সেন্টারে। সেই সেন্টারের পাশেই এক বিউটি পার্লারের পরিচিত আপার কাছে গেলো হক। আপা কোনো আশ্বাসই দিতে পারলেন না। রাতে আবুল কালামকে সংসদ ভবন দেখাতে নিয়ে গেলো হক। সংসদ ভবন দেখে কালাম মুগ্ধ হয়ে গেলো। ঢাকায় তার চাকরি না হোক, চাকরির জন্য এসে তো কমপক্ষে সংসদ ভবনটা দেখেছে। গ্রামে আবুল কালামদের কুঁড়ে ঘরে বসবাস। সেই ছেলে লোকাল ট্রেনে করে ঢাকায় আসতে আসতে পুরো বাংলাদেশটাকে দেখেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদের রাতে আবুল কালামের পিতাকে হত্যা করে পাকিস্তানী আর্মি। আবুল কালামের পিতার একটি বাইসাইকেল ছিলো। এই বাইসাইকেল নিয়ে আবুল কালামের পিতা আর্মি আসার খবর আগেই বাড়ি বাড়ি বলে দিতো। তার এই ছিলো বড় অপরাধ। ঢাকা শহরে এতো নিচে দিয়ে বিমান যায়, দেখে তো মুগ্ধ আবুল কালাম। গ্রামে তার ফিরতে ইচ্ছে করে না। কিছুদিন আগেও আবুল কালামদের পাশের বাড়ি সৌদি প্রবাসী নুরুল আমিনদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। আবদুল হকের ঢাকায় থাকা এক বন্ধু হলো বরিশালের হাবীব। হাবীবের বাড়ি বরিশালের কলেজ রোড এলাকায়। হাবীবও আবুল কালামের জন্য চাকরির চেষ্টা করে। কিন্তু আবুল কালামের ভাগ্য খারাপ। তার কপালে চাকরির দেখা নেই। আবুল কালাম ভাবে, বড় বড় বাড়ি অথবা অফিসের গেটের অনেক নিরাপত্তারক্ষী কুকুরও তার চেয়ে সুখে বসবাস করছে। ঢাকায় এসে আবুল কালাম এরই মধ্যে যা দেখে ফেলেছে, এখন আর তার গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। গ্যাস দিয়ে রান্নার কথা শুনেছিলো। এখন গ্যাসের চুলাও দেখেছে। দেখেছে প্রেশার কুকার। তবে বুঝেনি কিভাবে গ্যাস চুরির ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল খাটিয়ে এই শহরেরই কিছু লোক বাড়ি- গাড়ি করছে। বাড়িতে আবুল কালামের একটি গাভী ছিলো। এই গাভীর দুধ বাজারে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতো সে। অভাবে কিছুদিন আগে গাভীটি বিক্রি করে দিয়েছে। মূলত একমাত্র বোনের বিয়ের খরচাপাতি যোগাতেই গাভীটিকে বিক্রি করে বেকার হয় আবুল কালাম। তারপর উপায় না দেখে বন্ধ আবদুল হকের শরণাপন্ন হয়। চলে আসে ঢাকায়। রাতের বেলা আবদুল হকের একই বিছানায় শুয়ে শুয়ে আবুল কালাম ভাবে পাশের গ্রাম জয়নগরের নীলার কথা। নীলাদের সারাবাড়ি রক্তকাঞ্চনে ভরা। ঠিক রক্তকাঞ্চনের মতোই পরমা সুন্দরী নীলা। ঢাকায় একটি চাকরি পেলে নীলার কথা ভাববে আবুল কালাম কিন্তু পরদিন সকালে বন্ধু আবদুল হক বলে, ভাই আবুল কালাম, তুই বাড়িতে চলে যা। চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলেই আমি তোকে চিঠি লিখে জানাবো। তা না হলে আমার থাকার ব্যবস্থাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। এটা ঢাকা শহর। খুবই কঠিন। মানুষ এখানে ভীষণই হিসাবী ভাই। আবুল কালাম আবদুল হককে আর কিছুই বলতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতে গিয়ে যে করেই হোক পুরনো একটি বাইসাইকেল কিনবে সে। পত্রিকার হকারগিরি করবে। এই বাইসাইকেলই সঙ্গী ছিলো তার পিতা আনোয়ারুল আবেদীনের। বাজারের একটি কদম গাছের নিচে ছিলো আনোয়ারুলের দোকান। সাইকেল ভাড়ার দোকান। স্কুলের যুবক ছেলেরা ‘ঘন্টা হিসাবে ভাড়া’য় নিতো সাইকেল চালানো শিখতে। তাছাড়া সেই সাইকেল সমাজসেবায়ও কাজে লাগতো। সেই বাইসাইকেলটি শ্রীপুরের শাহজাহান রাজাকার নিয়ে গিয়েছিলো।

৭৯| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:২২

জসীম অসীম বলেছেন: দেলুর জীবন- সংগ্রাম
বাড়ি থেকে মামার বাড়িতে যাবে বলে দেলু ঢাকা শহরে গিয়ে উঠে। অথচ তার মামার বাড়ি ঢাকা শহরে নয়। ঢাকায় তার আপন কেউ থাকে না। দূরের কেউ কেউ থাকলেও তারা কোথায় থাকে, সে তা জানে না। গ্রামে থাকতে দেলুু কয়েকটি উপন্যাসের বই পড়েছে। বিশেষ করে এই কারণেই তার এ ঢাকা আসা। সে ভেবেছে ঢাকা শহরে গিয়ে কোন লেখক সাহিত্যিকের বাসায় গিয়ে নিজের একটা আশ্রয় করে নেবে। গাড়ীতে উঠে ঢাকা যাবার সময় সমস্ত পথে তার মায়ের কথা মনে পড়েছে। কারণ মাকে সে মিথ্যা কথা বলে এসেছে। তার মা জানে সে তার মামার বাড়িতে যাবে। দেলুর স্বপ্ন ঢাকায় গিয়ে একটা চাকুরী পাবে সে। যদিও সে এস.এস.সি ও পাস করেনি। সে ভেবেছে যেহেতু তার লেখালেখির প্রতি এত টান, সুতরাং ঢাকার লেখক সাহিত্যিকরা তাকে একটানা একটা ব্যবস্থা করে দেবেই। এই প্রথম ঢাকা যাচ্ছে দেলু। সঙ্গে পাচঁটি উপন্যাসের পান্ডুলিপি দেখাতে পারে, তাহলে প্রকাশকরা তাকে ছাড়বেই না। কয়েকটি উপন্যাসের বই থেকে কয়েকজন প্রকাশকের ঠিকানাও সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। তার ভাবনা, কোনো একটা কাজ পেয়ে গেলেই তার মাকে সব লিখে চিঠি দেবে। দেলুর গ্রাম ছেড়ে আসার অনেক কারণ রয়েছে। তার প্রধান কারণ হলো যে মেয়েটি কে সে ভালোবাসতো, সে মেয়েটির আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে। যদিও সে তার ভালোবাসার কথা কোনদিনও তাকে মুখ খুলে জানাতে পারেনি। গ্রাম ছাড়ার তার আরেকটি কারণ হলো- লেখাপড়ার তার মন বসেনা। বছর বছর পরীক্ষায় ফেল করে। তবে নকল করে বন্ধুদের মতো পরীক্ষায় পাশের পক্ষেও সে নয়। তাই গ্রামে বসে থেকে তার আর কোন লাভ আছে বলে তার মনে হয় না। ঢাকা শহরের মাটিতে পা ফেলে দেলুর বুক কেঁপে উঠে। ঢাকা কি এতবড়? রাস্তায় মধ্যে হাজার হাজার গাড়ি। রাস্তাটা পার হবে সে কিভাবে? ভাবল, গাড়িতে উঠে কাজ নেই। রিকশায় ওঠাই ভাল। পকেট থেকে বাংলা বাজারের এক প্রকাশকের ঠিকানা বের করে। এক রিকশাওয়ালাকে ডেকে বলে, “এই যে, ভাই বাংলা বাজার যাইবেন?” সেই রিকশাওয়ালা ঢাকা শহরের এক ঝানু রিকশাওয়ালা। ছেলেটিকে দেখেই সে বুঝতে পারে যে, এ ছেলেটি গ্রাম থেকে এসেছে। তাছাড়া এই ঢাকা শহরে গরীব রিকশাওয়ালাকে পারতপক্ষে কেউ ভাই বলে ডাকে না। বরং বলে “ এই রিকশা যাবে।” রিকশাওয়ালা দেলুর কাছে এসে বলল, যামু। দেলু বলল, ভাড়া কত? রিকশাওয়ালাটি বলল, বিশ টাকা। দেলু বলল, পাচঁ টাকায় যাইবেন? রিকশাওয়ালাটি বলল, এইডা কি গেরামের মাছ বাজার পাইছ নাকি? দেলু বলল, মুখ সামলাইয়া কথা কইয়েন। রিকশাওয়ালাটি খেট্ খেট্ করে হাসি দিয়ে বলল, ঢাকা শহরে নতুন আইছ বুঝি? দেলু রাগে কাঁপতে থাকে। কিন্তু কিছুই বলে না। তারপর সেই রিকশাওয়ালা চলে যায়। শেষ পর্যন্ত অন্য এক রিকশায় পনের টাকা ভাড়া দিয়ে বাংলা বাজার যায় দেলু। যেতে যেতে রিকশা ওয়ালা কে বলে, ঢাকা শহরের রিকশা ভাড়া এত বেশী কেন ভাই? রিকশা ওয়ালা বলে, রিকশা ভাড়া বাড়ে নাই। কিন্তু পুরান ঢাকায় যানজট থাকে বইলা ভাড়া একটু বেশী। দেলু আর কথা বলে না। সঙ্গে আনা প্রকাশকের ঠিকানায় গিয়ে এক অফিসের সামনে রিকশা থেকে নামে দেলু। প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করতে অফিসে ঢুকতে গেলে দারোয়ান দৌড়ে এসে তাকে ঠেকায়, দারোয়ানের বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে। দারোয়ান বলে, কোথায় যাও, দেলু বলে, প্রকাশক আবদুল আলিমের সঙ্গে দেখা করবো। দারোয়ান বলে, উনি তোমার কী হয়? দেলু বলে, দূর সর্ম্পকের মামা হয়। তারপর দারোয়ান দেলুকে ছেড়ে দেয়। দেলু একটু এগিয়ে যেতেই অফিসের এক কর্মকর্তার মুখোমুখি হয় দেলু। কর্মকর্তাটি তখন দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামছিলেন। দেলুর কাঁধে ঝোলানো এক মস্ত বড় ব্যাগ দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? কোথায় যাও? দেলু ভয়ে মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। কিন্তু তারপরও বুকে সাহস সঞ্চয় করে জবাব দেয়। ‘প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করমু।’ কর্মকর্তাটি বললেন, প্রকাশক তোমার কি হয়? দেলু দারোয়ানের সঙ্গে মিথ্যা কথা বললেও কর্মকর্তাটির সঙ্গে মিথ্যে বলতে পারে না। তাই বলে সে, আমি লেখক। গ্রাম থাইক্কা আইছি। আমার সঙ্গে কয়েকটা উপন্যাসের পান্ডুলিপি আছে। এগুলো ছাপার ব্যাপারে আমি প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ করতে চাই। কর্মকর্তাটি বললেন, তুমি লেখক? কি পাস করেছো? দেলু বললো, আমি ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি। কর্মকর্তাটি দেলুর কথা শুনে মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, যেখান থেকে এসেছো, সেখানেই ফিরে যাও। ভালো করে লেখাপড়া কর। দেলু বলল, লেখাপড়া হইব না স্যার। কারণ আমাদের অবস্থা ভালো না। আমরা খুব গরীব। কর্মকর্তাটি বললেন, আরে গরীব বলেই তো মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে। লেখাপড়া না করলে আরো গরীব থাকবে। দেলু বলল, লেখাপড়া আর করুম না। ঢাকা শহরে চাকুরী করুম। কর্মকর্তাটি হা- হা করে হাসি দিয়ে বললেন, চাকুরী? এই শহরে বিএ, এমএ পাশ করেও চাকুরী পাওয়া যায় না। দেলু বললো, বড় চাকুরী করুম না স্যার। ছোট খাটো একটা চাকুরী হইলেই হয়। কর্মকর্তাটি বললেন, এই অল্প বয়সে এতো ছোট চিন্তা করো কেন তুমি? তাছাড়া এ শহরে কেউ কি তোমাকে চেনে যে তোমাকে চাকুরী দেবে। আচ্ছা তুমি বাড়ী থেকে বলে এসেছো তো? কর্মকর্তাটির এমন প্রশ্ন শুনে দেলুর বুক কেঁপে উঠে। কারণ সে বাড়ী থেকে বলে আসেনি। তারপরও মিথ্যে করে বলল, ব.. ব.. বলেই এসেছি। কর্মকর্তাটি বললেন, বলে আস আর নাই আস, ভালো চাইলে গ্রামে ফিরে যাও। সেখানে গিয়ে হাঁস- মুরগী লালন- পালন কর। শাক- সবজির চাষ কর এবং লেখাপড়া কর। দেলু বললো, শাক- সবজি করুম কোনখানে? আমাদের তো জমি নাই। অবশেষে দলু প্রকাশকের সঙ্গে আর দেখা করতে পারেনি। কর্মকর্তাটি তাকে ফিরিয়ে দেয়। দেলু খুব হতাশ হয়ে পড়ে। তাহলে কি সে লেখক হতে পারবে না? কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে দেলু। মস্ত বড় এ ঢাকা শহরে কোথায় যাবে দেলু? কার কাছে যাবে? এ শহরে তার আপন কেইবা আছে? ঢাকা থেকে ফিরে যেতে হবে? এক বাদামওয়ালার কাছে এগিয়ে যায় দেলুু। এক টাকার বাদাম কিনে। তারপর বাদামওয়ালাকে বলে, ভাই আমাকে থাকার একটু জায়গায় ব্যবস্থা কইরা দিবেন? বাদাম ওয়ালা দেলুর ঢাকা আসার কারণ জেনে নিয়ে দেলুকে বললো, সঙ্গে তোমার টাকা আছে কত? দেলু বলল, পঞ্চাশ টাকা। বাদামওয়ালা বলল, আরে বলে কি! এত কম টাকা? এখনও সময় আছে বাড়ী চইলা যাও। কারণ এই ঢাকা শহরে যেমন তেমন হোটেলে থাকতে একরাইতে একশ টাকা লাগে। তাছাড়া তোমাকে কে চিনে যে জায়গা দিব। বাদামওয়ালার কথা শুনে দেলুর বুক ভয়ে কেঁপে উঠে। ওদিকে তখন দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। শেষপর্যন্ত মামার বাড়ীর দিকে রওনা হয় দেলু। কারণ এই সময়ে বাড়ীতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাছাড়া সে যে তার মামার বাড়ি যায়নি, এটা তার মাকে বলবে কিভাবে? অনেক রাতে মামার বাড়ীতে উঠে দেলু। তার মামা তাকে দেখে খুশি হলেও তার মামী তেমন খুশী হয়নি। তারপরও তার মামী ঘুমের বিছানা থেকে উঠে। তারপর কিছু পান্তা ভাত ও একটি ডিম সিদ্ধ করে দেয়। পান্তা ভাত আর ডিম পেয়ে দেলুর মন আনন্দে ভরে উঠে। কারণ সে সারাদিন কিছু খায়নি। খাওয়ার সময় তার মামা তাকে প্রশ্ন করে, এতো রাইতে কইত্তে আইলি দেলু? দেলু তখন তার মামাকে বানিয়ে বানিয়ে নানা কথা বলে। কিন্তু তার আসল কথা বলেনা। তারপর খাওয়া শেষ হলে অন্য এক ঘরে দেলুর ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেলু তার মামার সঙ্গে বাজারে যায়। বাজার থেকে দেলু ব্যাগ নিয়ে আসে। তার বড় মামা অফিসে চলে যায়। বাজার থেকে ফিরে এসে দেলু তার ছোট মামার ঘরে যায়। ছোট মামা কলেজে পড়ে। কিছু উপন্যাসের বইও তার রয়েছে। দেলু এসব উপন্যাসের বই খুলে পড়া শুরু করে। কিন্তু কী করলে টাকা আসবে, সে কথা একবারও ভাবে না। কয়েকদিন এভাবেই চলতে থাকে। একদিন তার মামী এসে বলে, এই পোলা তোর কাজ কাম নাই? তুই কি সারাদিন গল্প কাহিনীই পড়বি নাকি? তারপর থেকে দেলু মামীর ভয়ে উপন্যাস পড়া ছেড়ে দেয়। রাতের বেলা বড় মামা বাড়ীতে এসে দেলুকে বলে, দেলু দুইডা ছাত্র পাওয়া গেছে। একটা ফাইভে পড়ে, আরেকটা পড়ে সিক্সে। পড়াইতে পারবি নাকি? পারলে মাস শেষে কিছু টাকা পাবি। দেলু বলে, পারব না কেন? অবশ্যই পারবো। মামা বলে, তাইলে আমি সামনের সোমবার থাইক্কা ঠিক কইরা ফালাই। দেলু বলে, আইচ্ছা ঠিক করেন। এরই মধ্যে দেলু তার মামাকে মামার বাড়ীতে স্থায়ীভাবে থাকার বিষয়টি খুলে দেলুর মনে শান্তি নেই। কারণ সে অংক পারে না। সিক্সের অংক দূরে থাক, ক্লাস ফোরের অংকও সে পারে না। তাই ছাত্র পড়ানো সোমবার আসার আগেই ঘাট্টি বোচকা নিয়ে মামার কাছে না বলেই দেলু বাড়িতে পালিয়ে আসে। ভাঙ্গা এক মন নিয়ে দেলু আবার বাড়িতে ফিরে। মায়ের কাছে ঢাকা যাওয়ার কিছুই খুলে বলে না। ঢাকা শহরকে তার কাছে এক জটিল শহর মনে হয়। জীবনকে মনে হয় আরো বেশী জটিল। গ্রামের জীবনে টাকা নেই। শহরে টাকা কামাই করার পথও খুব শক্ত। এমন হলে বেঁচে থাকা কিভাবে সম্ভব? চার পাঁচ দিন নানা রকম ভাবনার মধ্যে কাটিয়ে দেয় দেলু। গ্রামে সে কী করবে পথ খুঁজে পায় না। রাত হলে হারিকেন জ্বালিয়ে উপন্যাস পড়তে ভালোই লাগে। কিন্তু এতে টাকা আসে না। জীবন সমস্যার সমাধানও হয় না। আবার লেখাপড়া শুরু করবে, তেমন মানসিক অবস্থাও নেই। কারণ দেলুর মা প্রায় প্রতিদিনই এ ঘর ওঘর থেকে ভাতের চাল যোগাড় করে। সেসব চাল ফেরৎ দিতে না পেরে প্রায় সব সময়ই অপমানিত হয়। এমন অবস্থায় কি লেখাপড়া চলে? দেলুর মামাদের অবস্থা অনেকটা ভালো। কিন্তু তারা দেলুদের অবস্থার তেমন খোঁজ খবর রাখে না। দেলুর মা- ও তার ভাইদের উপকারের আশায় থাকে না। কয়েক দিন এভাবে কাটার পর, দেলু তার নিজের গ্রামের ফতু মেম্বারের কাছ থেকে দশ শতক জমি নেয়। বর্গা চাষ করবে বলে নেয়। ততদিনে শীত নামে নামে অবস্থা। দেলুর হালের বলদ নেই। বাপের আমলে ছিল। এখন বাপও নেই। তাই সে কোদাল দিয়ে জমির মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে জমি চাষ শুরু করে। ফতু মেম্বার দেলুর এই উৎসাহ দেখে ভীষণ অবাক হয়। মনে মনে ভাবে, হারামজাদাডায় করতাছে কী! দশ শতক জমিতে দেলু ফুলকপি ও টমেটোর চাষ করে। ধীরে ধীরে জমি ভরে উঠে। টমেটো ও ফুলকপির গাছগুলোকে দেলুর কাছে নিজের সন্তানের মত ভীষণ আপন মনে হয়। দেলু গাছগুলোকে নিয়ে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু দেলুর কপালে সুখ নেই। দেলুর মার শরীরের দিকে চোখ পড়ে ফতু মেম্বারের। একখন্ড জমি দেলুকে চাষ করতে দিয়েই ফতু মেম্বার দেলুর মার পিছে লাগে। সময়ে অসময়ে আনাগোনা শুরু করে। টাকা- পয়সা নিয়েও সে দেলুর মার সংসারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চায়। দেলুর মা সায় দেয় না। ভিতরে ভিতরে ফতু মেম্বারকে ভীষণ ঘৃণা করে। কিন্তু ফতু মেম্বার দেলুর মায়ের পেছন ছাড়ে না। একদিন রাতে দেলু বাড়িতে ছিল না। দেলুর মা তার ছোট দুই ভাই বোনকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। এমন সময় ফতু মেম্বার দেলুদের ঘরের দরজায় এসে দেলুর মা কে ডাক দেয় বলে: দেলুর মা, দরজা খোল। জরুরী কথা আছে। দেলুর মা প্রথমে জবাব দেয়নি। কিন্তু ফতু মেম্বার আবারও ডাকতে থাকে। দেলুর মা তারপর দরজা খুলে ফতু মেম্বারকে বসতে দেয়। ফতু মেম্বার দেলুর মা’র কাছে এক গ্লাস পানি চায়। দেলুর মা পানি এনে ফতু মেম্বারের হাতে দিতেই ফতু মেম্বার পানির গ্লাস না ধরেই দেলুর মার হাতে ধরে বসে। দেলুর মার হাতে ধরে বসে। দেলুর মা বলে, হাত ছাড়েন। ফতু মেম্বার বলে- দেলুর মা, আমি তোমারে বিয়া করতে চাই। দেলুর মা একথা শুনে ফতু মেম্বারের গালে ‘ঠাস’ করে এক থাপ্পড় কষে দেয়। ডান হাতের গ্লাস মাটিতে পড়ে যায়। ফতু মেম্বার তাড়াতাড়ি চলে যায় নিজের বাড়িতে। পরদিন দেলু তার খালার বাড়ি থেকে বাড়িতে ফিরে আসে। দেলুর মা ঘটে যাওয়া ঘটনা সর্ম্পকে দেলুকে কিছুই বলে না। না বললেও পরদিন ঘটে আরেকটি দূর্ঘটনা। ঘুম থেকে উঠে দেলু তার ক্ষেতে গিয়ে দেখে, কে যেন তার টমেটো এবং ফুলকপির গাছগুলোকে কোদাল দিয়ে কেটে কেটে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। দেলু আর কথা বলতে পারে না। কাঁদতেও পারে না সে। দৌড়ে চলে আসে তার মায়ের কাছে। তার মা কে এসে বলে, আমার এমন সর্বনাশ কে করলো মা? আমি ফতু মেম্বারের কাছে যাই। তার কাছে গিয়ে বিচার দিব। দেলুর মা বলে, বিচার দিলে খোদার কাছে দে। ফতু মেম্বারের কাছে না। দেলু তার মায়ের কথার অর্থ কিছুই বোঝে না। তারপর আরো কয়েকদিন কেটে যায়। কিন্তু দেলুর দিন কাটতে চায় না গ্রামে। দেলুর বাপ মরেছে ছ’ মাস হলো। এরই মধ্যে অনেক কষ্টে দেলুদের দিন কেটেছে। এখন আর দিন কাটতেই চায় না। দেলু তার খালার কাছ থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে। টাকাগুলো তার মায়ের কাছে দিয়ে আবার ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার আগে তার দূর সম্পর্কের এক মামার ঠিকানা সংগ্রহ করে নেয়। তার সেই মামা সরকারী এক অফিসের দারোয়ান। তার মা ঢাকা যাবার ব্যাপারে তাকে একটু ও সায় দেয় না। তারপরও অর্থের সন্ধানে জীবনের সন্ধানে ঢাকা যাওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় দেলু। ঢাকা শহরে গিয়ে তার মামাকে খুঁেজ খুঁেজ হয়রান হয়ে যায়। দেলুু যে ঠিকানা সঙ্গে করে নেয়, সে ঠিকানায় তার মামাকে খুঁেজ পেতে দিন শেষ হয়ে যায়। তার সেই মামা তাদের পরিবারের কাহিনী শুনে তাকে জায়গা দেয়। তার কয়েকদিন পরেই সেই মামা বাংলা বাজারের এক প্রকাশনী সংস্থায় কাগজ ভাঁজ করার চাকুরী খুঁেজ দেয় তাকে। চাকুরীটা তার খুবই পছন্দ হয়। যেখানে বসে কাজ করে দেলু, সেখানে সে শত শত বই দেখে। দেলু আনন্দে পাগল হয়ে যায়। সারাদিন কেবল কাগজই ভাঁজ করে। বই পড়ার বই দেখার সময় একটু পায় না। তবু সে কাজ করে। মায়ের কথা, ছোট ভাই- বোনের কথা মনে রেখে কাজ করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনে পড়ে

৮০| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:২৭

জসীম অসীম বলেছেন: দেলুর জীবন- সংগ্রাম
বাড়ি থেকে মামার বাড়িতে যাবে বলে দেলু ঢাকা শহরে গিয়ে উঠে। অথচ তার মামার বাড়ি ঢাকা শহরে নয়। ঢাকায় তার আপন কেউ থাকে না। দূরের কেউ কেউ থাকলেও তারা কোথায় থাকে, সে তা জানে না। গ্রামে থাকতে দেলুু কয়েকটি উপন্যাসের বই পড়েছে। বিশেষ করে এই কারণেই তার এ ঢাকা আসা। সে ভেবেছে ঢাকা শহরে গিয়ে কোন লেখক সাহিত্যিকের বাসায় গিয়ে নিজের একটা আশ্রয় করে নেবে। গাড়ীতে উঠে ঢাকা যাবার সময় সমস্ত পথে তার মায়ের কথা মনে পড়েছে। কারণ মাকে সে মিথ্যা কথা বলে এসেছে। তার মা জানে সে তার মামার বাড়িতে যাবে। দেলুর স্বপ্ন ঢাকায় গিয়ে একটা চাকুরী পাবে সে। যদিও সে এস.এস.সি ও পাস করেনি। সে ভেবেছে যেহেতু তার লেখালেখির প্রতি এত টান, সুতরাং ঢাকার লেখক সাহিত্যিকরা তাকে একটানা একটা ব্যবস্থা করে দেবেই। এই প্রথম ঢাকা যাচ্ছে দেলু। সঙ্গে পাচঁটি উপন্যাসের পান্ডুলিপি দেখাতে পারে, তাহলে প্রকাশকরা তাকে ছাড়বেই না। কয়েকটি উপন্যাসের বই থেকে কয়েকজন প্রকাশকের ঠিকানাও সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। তার ভাবনা, কোনো একটা কাজ পেয়ে গেলেই তার মাকে সব লিখে চিঠি দেবে। দেলুর গ্রাম ছেড়ে আসার অনেক কারণ রয়েছে। তার প্রধান কারণ হলো যে মেয়েটি কে সে ভালোবাসতো, সে মেয়েটির আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে। যদিও সে তার ভালোবাসার কথা কোনদিনও তাকে মুখ খুলে জানাতে পারেনি। গ্রাম ছাড়ার তার আরেকটি কারণ হলো- লেখাপড়ার তার মন বসেনা। বছর বছর পরীক্ষায় ফেল করে। তবে নকল করে বন্ধুদের মতো পরীক্ষায় পাশের পক্ষেও সে নয়। তাই গ্রামে বসে থেকে তার আর কোন লাভ আছে বলে তার মনে হয় না। ঢাকা শহরের মাটিতে পা ফেলে দেলুর বুক কেঁপে উঠে। ঢাকা কি এতবড়? রাস্তায় মধ্যে হাজার হাজার গাড়ি। রাস্তাটা পার হবে সে কিভাবে? ভাবল, গাড়িতে উঠে কাজ নেই। রিকশায় ওঠাই ভাল। পকেট থেকে বাংলা বাজারের এক প্রকাশকের ঠিকানা বের করে। এক রিকশাওয়ালাকে ডেকে বলে, “এই যে, ভাই বাংলা বাজার যাইবেন?” সেই রিকশাওয়ালা ঢাকা শহরের এক ঝানু রিকশাওয়ালা। ছেলেটিকে দেখেই সে বুঝতে পারে যে, এ ছেলেটি গ্রাম থেকে এসেছে। তাছাড়া এই ঢাকা শহরে গরীব রিকশাওয়ালাকে পারতপক্ষে কেউ ভাই বলে ডাকে না। বরং বলে “ এই রিকশা যাবে।” রিকশাওয়ালা দেলুর কাছে এসে বলল, যামু। দেলু বলল, ভাড়া কত? রিকশাওয়ালাটি বলল, বিশ টাকা। দেলু বলল, পাচঁ টাকায় যাইবেন? রিকশাওয়ালাটি বলল, এইডা কি গেরামের মাছ বাজার পাইছ নাকি? দেলু বলল, মুখ সামলাইয়া কথা কইয়েন। রিকশাওয়ালাটি খেট্ খেট্ করে হাসি দিয়ে বলল, ঢাকা শহরে নতুন আইছ বুঝি? দেলু রাগে কাঁপতে থাকে। কিন্তু কিছুই বলে না। তারপর সেই রিকশাওয়ালা চলে যায়। শেষ পর্যন্ত অন্য এক রিকশায় পনের টাকা ভাড়া দিয়ে বাংলা বাজার যায় দেলু। যেতে যেতে রিকশা ওয়ালা কে বলে, ঢাকা শহরের রিকশা ভাড়া এত বেশী কেন ভাই? রিকশা ওয়ালা বলে, রিকশা ভাড়া বাড়ে নাই। কিন্তু পুরান ঢাকায় যানজট থাকে বইলা ভাড়া একটু বেশী। দেলু আর কথা বলে না। সঙ্গে আনা প্রকাশকের ঠিকানায় গিয়ে এক অফিসের সামনে রিকশা থেকে নামে দেলু। প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করতে অফিসে ঢুকতে গেলে দারোয়ান দৌড়ে এসে তাকে ঠেকায়, দারোয়ানের বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে। দারোয়ান বলে, কোথায় যাও, দেলু বলে, প্রকাশক আবদুল আলিমের সঙ্গে দেখা করবো। দারোয়ান বলে, উনি তোমার কী হয়? দেলু বলে, দূর সর্ম্পকের মামা হয়। তারপর দারোয়ান দেলুকে ছেড়ে দেয়। দেলু একটু এগিয়ে যেতেই অফিসের এক কর্মকর্তার মুখোমুখি হয় দেলু। কর্মকর্তাটি তখন দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামছিলেন। দেলুর কাঁধে ঝোলানো এক মস্ত বড় ব্যাগ দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? কোথায় যাও? দেলু ভয়ে মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। কিন্তু তারপরও বুকে সাহস সঞ্চয় করে জবাব দেয়। ‘প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করমু।’ কর্মকর্তাটি বললেন, প্রকাশক তোমার কি হয়? দেলু দারোয়ানের সঙ্গে মিথ্যা কথা বললেও কর্মকর্তাটির সঙ্গে মিথ্যে বলতে পারে না। তাই বলে সে, আমি লেখক। গ্রাম থাইক্কা আইছি। আমার সঙ্গে কয়েকটা উপন্যাসের পান্ডুলিপি আছে। এগুলো ছাপার ব্যাপারে আমি প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ করতে চাই। কর্মকর্তাটি বললেন, তুমি লেখক? কি পাস করেছো? দেলু বললো, আমি ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি। কর্মকর্তাটি দেলুর কথা শুনে মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, যেখান থেকে এসেছো, সেখানেই ফিরে যাও। ভালো করে লেখাপড়া কর। দেলু বলল, লেখাপড়া হইব না স্যার। কারণ আমাদের অবস্থা ভালো না। আমরা খুব গরীব। কর্মকর্তাটি বললেন, আরে গরীব বলেই তো মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে। লেখাপড়া না করলে আরো গরীব থাকবে। দেলু বলল, লেখাপড়া আর করুম না। ঢাকা শহরে চাকুরী করুম। কর্মকর্তাটি হা- হা করে হাসি দিয়ে বললেন, চাকুরী? এই শহরে বিএ, এমএ পাশ করেও চাকুরী পাওয়া যায় না। দেলু বললো, বড় চাকুরী করুম না স্যার। ছোট খাটো একটা চাকুরী হইলেই হয়। কর্মকর্তাটি বললেন, এই অল্প বয়সে এতো ছোট চিন্তা করো কেন তুমি? তাছাড়া এ শহরে কেউ কি তোমাকে চেনে যে তোমাকে চাকুরী দেবে। আচ্ছা তুমি বাড়ী থেকে বলে এসেছো তো? কর্মকর্তাটির এমন প্রশ্ন শুনে দেলুর বুক কেঁপে উঠে। কারণ সে বাড়ী থেকে বলে আসেনি। তারপরও মিথ্যে করে বলল, ব.. ব.. বলেই এসেছি। কর্মকর্তাটি বললেন, বলে আস আর নাই আস, ভালো চাইলে গ্রামে ফিরে যাও। সেখানে গিয়ে হাঁস- মুরগী লালন- পালন কর। শাক- সবজির চাষ কর এবং লেখাপড়া কর। দেলু বললো, শাক- সবজি করুম কোনখানে? আমাদের তো জমি নাই। অবশেষে দলু প্রকাশকের সঙ্গে আর দেখা করতে পারেনি। কর্মকর্তাটি তাকে ফিরিয়ে দেয়। দেলু খুব হতাশ হয়ে পড়ে। তাহলে কি সে লেখক হতে পারবে না? কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে দেলু। মস্ত বড় এ ঢাকা শহরে কোথায় যাবে দেলু? কার কাছে যাবে? এ শহরে তার আপন কেইবা আছে? ঢাকা থেকে ফিরে যেতে হবে? এক বাদামওয়ালার কাছে এগিয়ে যায় দেলুু। এক টাকার বাদাম কিনে। তারপর বাদামওয়ালাকে বলে, ভাই আমাকে থাকার একটু জায়গায় ব্যবস্থা কইরা দিবেন? বাদাম ওয়ালা দেলুর ঢাকা আসার কারণ জেনে নিয়ে দেলুকে বললো, সঙ্গে তোমার টাকা আছে কত? দেলু বলল, পঞ্চাশ টাকা। বাদামওয়ালা বলল, আরে বলে কি! এত কম টাকা? এখনও সময় আছে বাড়ী চইলা যাও। কারণ এই ঢাকা শহরে যেমন তেমন হোটেলে থাকতে একরাইতে একশ টাকা লাগে। তাছাড়া তোমাকে কে চিনে যে জায়গা দিব। বাদামওয়ালার কথা শুনে দেলুর বুক ভয়ে কেঁপে উঠে। ওদিকে তখন দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। শেষপর্যন্ত মামার বাড়ীর দিকে রওনা হয় দেলু। কারণ এই সময়ে বাড়ীতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাছাড়া সে যে তার মামার বাড়ি যায়নি, এটা তার মাকে বলবে কিভাবে? অনেক রাতে মামার বাড়ীতে উঠে দেলু। তার মামা তাকে দেখে খুশি হলেও তার মামী তেমন খুশী হয়নি। তারপরও তার মামী ঘুমের বিছানা থেকে উঠে। তারপর কিছু পান্তা ভাত ও একটি ডিম সিদ্ধ করে দেয়। পান্তা ভাত আর ডিম পেয়ে দেলুর মন আনন্দে ভরে উঠে। কারণ সে সারাদিন কিছু খায়নি। খাওয়ার সময় তার মামা তাকে প্রশ্ন করে, এতো রাইতে কইত্তে আইলি দেলু? দেলু তখন তার মামাকে বানিয়ে বানিয়ে নানা কথা বলে। কিন্তু তার আসল কথা বলেনা। তারপর খাওয়া শেষ হলে অন্য এক ঘরে দেলুর ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেলু তার মামার সঙ্গে বাজারে যায়। বাজার থেকে দেলু ব্যাগ নিয়ে আসে। তার বড় মামা অফিসে চলে যায়। বাজার থেকে ফিরে এসে দেলু তার ছোট মামার ঘরে যায়। ছোট মামা কলেজে পড়ে। কিছু উপন্যাসের বইও তার রয়েছে। দেলু এসব উপন্যাসের বই খুলে পড়া শুরু করে। কিন্তু কী করলে টাকা আসবে, সে কথা একবারও ভাবে না। কয়েকদিন এভাবেই চলতে থাকে। একদিন তার মামী এসে বলে, এই পোলা তোর কাজ কাম নাই? তুই কি সারাদিন গল্প কাহিনীই পড়বি নাকি? তারপর থেকে দেলু মামীর ভয়ে উপন্যাস পড়া ছেড়ে দেয়। রাতের বেলা বড় মামা বাড়ীতে এসে দেলুকে বলে, দেলু দুইডা ছাত্র পাওয়া গেছে। একটা ফাইভে পড়ে, আরেকটা পড়ে সিক্সে। পড়াইতে পারবি নাকি? পারলে মাস শেষে কিছু টাকা পাবি। দেলু বলে, পারব না কেন? অবশ্যই পারবো। মামা বলে, তাইলে আমি সামনের সোমবার থাইক্কা ঠিক কইরা ফালাই। দেলু বলে, আইচ্ছা ঠিক করেন। এরই মধ্যে দেলু তার মামাকে মামার বাড়ীতে স্থায়ীভাবে থাকার বিষয়টি খুলে দেলুর মনে শান্তি নেই। কারণ সে অংক পারে না। সিক্সের অংক দূরে থাক, ক্লাস ফোরের অংকও সে পারে না। তাই ছাত্র পড়ানো সোমবার আসার আগেই ঘাট্টি বোচকা নিয়ে মামার কাছে না বলেই দেলু বাড়িতে পালিয়ে আসে। ভাঙ্গা এক মন নিয়ে দেলু আবার বাড়িতে ফিরে। মায়ের কাছে ঢাকা যাওয়ার কিছুই খুলে বলে না। ঢাকা শহরকে তার কাছে এক জটিল শহর মনে হয়। জীবনকে মনে হয় আরো বেশী জটিল। গ্রামের জীবনে টাকা নেই। শহরে টাকা কামাই করার পথও খুব শক্ত। এমন হলে বেঁচে থাকা কিভাবে সম্ভব? চার পাঁচ দিন নানা রকম ভাবনার মধ্যে কাটিয়ে দেয় দেলু। গ্রামে সে কী করবে পথ খুঁজে পায় না। রাত হলে হারিকেন জ্বালিয়ে উপন্যাস পড়তে ভালোই লাগে। কিন্তু এতে টাকা আসে না। জীবন সমস্যার সমাধানও হয় না। আবার লেখাপড়া শুরু করবে, তেমন মানসিক অবস্থাও নেই। কারণ দেলুর মা প্রায় প্রতিদিনই এ ঘর ওঘর থেকে ভাতের চাল যোগাড় করে। সেসব চাল ফেরৎ দিতে না পেরে প্রায় সব সময়ই অপমানিত হয়। এমন অবস্থায় কি লেখাপড়া চলে? দেলুর মামাদের অবস্থা অনেকটা ভালো। কিন্তু তারা দেলুদের অবস্থার তেমন খোঁজ খবর রাখে না। দেলুর মা- ও তার ভাইদের উপকারের আশায় থাকে না। কয়েক দিন এভাবে কাটার পর, দেলু তার নিজের গ্রামের ফতু মেম্বারের কাছ থেকে দশ শতক জমি নেয়। বর্গা চাষ করবে বলে নেয়। ততদিনে শীত নামে নামে অবস্থা। দেলুর হালের বলদ নেই। বাপের আমলে ছিল। এখন বাপও নেই। তাই সে কোদাল দিয়ে জমির মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে জমি চাষ শুরু করে। ফতু মেম্বার দেলুর এই উৎসাহ দেখে ভীষণ অবাক হয়। মনে মনে ভাবে, হারামজাদাডায় করতাছে কী! দশ শতক জমিতে দেলু ফুলকপি ও টমেটোর চাষ করে। ধীরে ধীরে জমি ভরে উঠে। টমেটো ও ফুলকপির গাছগুলোকে দেলুর কাছে নিজের সন্তানের মত ভীষণ আপন মনে হয়। দেলু গাছগুলোকে নিয়ে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু দেলুর কপালে সুখ নেই। দেলুর মার শরীরের দিকে চোখ পড়ে ফতু মেম্বারের। একখন্ড জমি দেলুকে চাষ করতে দিয়েই ফতু মেম্বার দেলুর মার পিছে লাগে। সময়ে অসময়ে আনাগোনা শুরু করে। টাকা- পয়সা নিয়েও সে দেলুর মার সংসারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চায়। দেলুর মা সায় দেয় না। ভিতরে ভিতরে ফতু মেম্বারকে ভীষণ ঘৃণা করে। কিন্তু ফতু মেম্বার দেলুর মায়ের পেছন ছাড়ে না। একদিন রাতে দেলু বাড়িতে ছিল না। দেলুর মা তার ছোট দুই ভাই বোনকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। এমন সময় ফতু মেম্বার দেলুদের ঘরের দরজায় এসে দেলুর মা কে ডাক দেয় বলে: দেলুর মা, দরজা খোল। জরুরী কথা আছে। দেলুর মা প্রথমে জবাব দেয়নি। কিন্তু ফতু মেম্বার আবারও ডাকতে থাকে। দেলুর মা তারপর দরজা খুলে ফতু মেম্বারকে বসতে দেয়। ফতু মেম্বার দেলুর মা’র কাছে এক গ্লাস পানি চায়। দেলুর মা পানি এনে ফতু মেম্বারের হাতে দিতেই ফতু মেম্বার পানির গ্লাস না ধরেই দেলুর মার হাতে ধরে বসে। দেলুর মার হাতে ধরে বসে। দেলুর মা বলে, হাত ছাড়েন। ফতু মেম্বার বলে- দেলুর মা, আমি তোমারে বিয়া করতে চাই। দেলুর মা একথা শুনে ফতু মেম্বারের গালে ‘ঠাস’ করে এক থাপ্পড় কষে দেয়। ডান হাতের গ্লাস মাটিতে পড়ে যায়। ফতু মেম্বার তাড়াতাড়ি চলে যায় নিজের বাড়িতে। পরদিন দেলু তার খালার বাড়ি থেকে বাড়িতে ফিরে আসে। দেলুর মা ঘটে যাওয়া ঘটনা সর্ম্পকে দেলুকে কিছুই বলে না। না বললেও পরদিন ঘটে আরেকটি দূর্ঘটনা। ঘুম থেকে উঠে দেলু তার ক্ষেতে গিয়ে দেখে, কে যেন তার টমেটো এবং ফুলকপির গাছগুলোকে কোদাল দিয়ে কেটে কেটে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। দেলু আর কথা বলতে পারে না। কাঁদতেও পারে না সে। দৌড়ে চলে আসে তার মায়ের কাছে। তার মা কে এসে বলে, আমার এমন সর্বনাশ কে করলো মা? আমি ফতু মেম্বারের কাছে যাই। তার কাছে গিয়ে বিচার দিব। দেলুর মা বলে, বিচার দিলে খোদার কাছে দে। ফতু মেম্বারের কাছে না। দেলু তার মায়ের কথার অর্থ কিছুই বোঝে না। তারপর আরো কয়েকদিন কেটে যায়। কিন্তু দেলুর দিন কাটতে চায় না গ্রামে। দেলুর বাপ মরেছে ছ’ মাস হলো। এরই মধ্যে অনেক কষ্টে দেলুদের দিন কেটেছে। এখন আর দিন কাটতেই চায় না। দেলু তার খালার কাছ থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে। টাকাগুলো তার মায়ের কাছে দিয়ে আবার ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার আগে তার দূর সম্পর্কের এক মামার ঠিকানা সংগ্রহ করে নেয়। তার সেই মামা সরকারী এক অফিসের দারোয়ান। তার মা ঢাকা যাবার ব্যাপারে তাকে একটু ও সায় দেয় না। তারপরও অর্থের সন্ধানে জীবনের সন্ধানে ঢাকা যাওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় দেলু। ঢাকা শহরে গিয়ে তার মামাকে খুঁেজ খুঁেজ হয়রান হয়ে যায়। দেলুু যে ঠিকানা সঙ্গে করে নেয়, সে ঠিকানায় তার মামাকে খুঁেজ পেতে দিন শেষ হয়ে যায়। তার সেই মামা তাদের পরিবারের কাহিনী শুনে তাকে জায়গা দেয়। তার কয়েকদিন পরেই সেই মামা বাংলা বাজারের এক প্রকাশনী সংস্থায় কাগজ ভাঁজ করার চাকুরী খুঁেজ দেয় তাকে। চাকুরীটা তার খুবই পছন্দ হয়। যেখানে বসে কাজ করে দেলু, সেখানে সে শত শত বই দেখে। দেলু আনন্দে পাগল হয়ে যায়। সারাদিন কেবল কাগজই ভাঁজ করে। বই পড়ার বই দেখার সময় একটু পায় না। তবু সে কাজ করে। মায়ের কথা, ছোট ভাই- বোনের কথা মনে রেখে কাজ করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনে পড়ে

৮১| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:২৯

জসীম অসীম বলেছেন: পোনরা মেলা
জসীম উদ্দিন অসীম
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এক মেলা হলো পোনরা মেলা। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দেবিদ্বার উপজেলার এ মেলাটি হেলালের খুবই প্রিয়। হচ্ছেনা। মেলার গুরুত্ব তার মতো আর তার কোনো বন্ধুই অনুধাবন করে না। এ মেলা দেখতে প্রতি বছরই ইন্ডিয়া থেকেও অনেক লোক আসে। অনেক দুর্লভ ও দুস্পাপ্য খেলনার ভান্ডার এ মেলা। প্রচুর ব্যবহারিক সামগ্রীও পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় আসবাবপত্র। লোকে ওই মেলাকে বলে ‘কাঠের মেলা’। মেলার নান্দনিক সৌন্দর্য আসলে বাড়িয়েছে মেলার মধ্যের সুপ্রাচীন বটবৃক্ষগুলো। সাতদিঘি গ্রামের অনামিকা দত্তও পোনরা মেলার এমনই পাগল, যেমন হেলাল। অনামিকা পড়ে নিরুপমা বালিকা বিদ্যালয়ে। অবিভক্ত বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ বিদ্যালয়টি। এ এলাকায় এমন প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ আর দ্বিতীয়টি নেই। এদিকে পরবর্তী জীবনে যে হেলাল আর্জেন্টিনা, কিউবা বা ল্যাতিন আমেরিকার ভয়ানক পাগল হয়ে উঠবে, সে এখন শুধু পোনরা মেলারই পাগল। যে ছেলেটি এখন শুধু অনামিকা দত্তকেই ভালোবাসে, এই কয়েকবছর পরেই সে হয়ে উঠবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী এক যুবক। মার্কিন মদদপুষ্ট সকল মানুষকেই করবে ভয়ানক ঘৃণা। প্রচন্ড অস্থির এই যুবকও নবম শ্রেণিরই ছাত্র। হিন্দুপ্রীতির বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রেই সে লাভ করেছে। এখন তার মাথার ভিতর মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। আছে অনামিকা দত্তের জন্য কেনা কিছু গল্পের বই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে ভিয়েতনামের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়েছে, সে গল্প সে তার মায়ের কাছে শুনেছে। সে সারাদিন মাঠে ঘুরে। কৃষকদের চরম দুরাবস্থা দেখে বেড়ায়। স্বৈরশাসক এরশাদের গল্প শুনে মানুষের মুখে। আর্নেস্টো চে গুয়েভারার গল্প এখনো তাকে কেউ শোনায়নি।
হেলাল যেন এক রাজকুমার, এমনই ভাবভঙ্গিমা তার। পোনরা মেলায় এসে মাইকে একটি গান শুনে পাগল হয়ে যায় হেলাল। ‘শোন গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’। এমন গান সে আর জীবনেও শুনেনি। অনামিকা কি এই গানটি শুনেছে? গানের গায়ক একজন বৃদ্ধ লোক হলেও সুর বড়ই মধুর। রেডিওতে সে এর আগে এ গানটি শুনেনি। তার মা প্রায় নিয়মিতই ‘আকাশবাণী’ কলকাতা কেন্দ্রের গান শুনেন। কিন্তু হেলাল এ গান পোনরা মেলার আগে আর কোথাও শুনেনি। তার জ্যাঠার কাছে ভারতের শীর্ষ রেকর্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এইচএমভি-র এত গল্প শুনেছে, অথচ এ গানটি কার, এ প্রশ্নটি তার একবারও করা হয় না। মনের ভুলেই। হেলাল একাধারে কবিতা, গল্প, দিনলিপি, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি লিখে যায় ানয়মিত। ক্লাসেও সে বাংলা গদ্যে-পদ্যে ও ব্যাকরণে খুবই ভালো। তার পিতা সরকারী চাকুরে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার গল্প সে এত বেশিই শুনেছে যে, সে আর এই ভূ-খন্ডে হিন্দু ও মুসলমানের দাঙ্গা দেখতে চায় না। বৃটিশ আর পাকিস্তানের গল্প শুনে শুনে সে এখন ক্লান্ত। কোনো নতুন গল্প শুনতে চায় সে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামী জীবনকে জীবদ্দশায় অনুসরণ করতে চায়। গ্রামীণ পরিবেশে বসা ‘পোনরা মেলা’ যেন এলাকাবাসীর বড় বেশি সাধনার ধন। সবুজ শ্যামলে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে এ মেলার আয়োজন হয়। শ্রীকাইল কলেজের অবস্থান। মেলার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে এত মানুষ আসে, না দেখলে তা বিশ্বাস করাই কঠিন। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অনামিকার বাবা অতীন্দ্রনাথ দত্তের বড় দাদা এই ‘পোনরা মেলা’ পথ দিয়েই কোনো এক রাতে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতের হাতে খুন হন। তার পরপরই ঘটলো ট্রিপল মার্ডারের ঘটনাটি। অনামিকাদের দিঘির শানবাঁধানো ঘাটে বসে এই গল্প হেলাল সেই কবে শুনেছে! অনামিকাদের মন্দির, পুকুর, নিজস্ব বাগান, সত্যিই বিস্ময়ের বস্তু এই হেলালের কাছে। বড় বেশি দুস্প্রাপ্য মেয়ে যেন অনামিকা দত্ত। বড় দুর্লভ নারী। তার পূর্ব পুরুষদের একজন ‘দত্ত মেমোরিয়েল ট্রাষ্ট’ এর নামে ২০ একর ১০ শতক সম্পত্তি দান করে গেছেন। রেকর্ডভুক্ত প্রায় সব সম্পত্তিতেই গড়ে উঠেছে সেই মন্দির ও দিঘি এবং খেলার মাঠ। মন্দিরের একদিকে বাবা লোকনাথের আবক্ষ মূর্তি। দিঘির স্বচ্ছ জলে লাল পদ্মফুলগুলো যেন ১৯৭১ সালের শ্যামাপ্রসাদ দত্তের রক্তকেই এখনো বহন করে বেড়াচ্ছে। আশুতোষ, গৌরাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় শ্যামাপ্রসাদ দত্তকেও নিতে চেয়েছিলেন। ভীতু ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ বাবু। ভয়ে ইন্ডিয়া যেতেও রাজি হননি। পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে সারাদিন বাঁশঝাড়েই লুকিয়ে থাকতেন। তবু শেষ রক্ষা হয়নি তার। বাঙালি হিন্দু শরণার্থী হয়ে ত্রিপুরায় গেলে অস্তিত্ব হয়তো এত খারাপ নাও হতে পারতো। নিজ দেশে যুদ্ধ হলে সব দেশে তো বটেই, নিজের দেশেও মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যায়! বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে চলে গিয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ দত্তের কাকারা। সেটা ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরই। কিন্তু হেলাল বুঝতে পারে না ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি লালন করলেও অনামিকার পরিবার কেন তাকে হেলালের সঙ্গে মিশতে বারণ করে না। সে কি অনামিকা হেলালের বাবার বন্ধুর মেয়ে বলেই! একেবারে উল্টো কোনো কারণও তো থাকতে পারে! ১৯৮৫ সালের রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার নিয়ে কী যেন আলাপ করছিলেন হেলাল আর অনামিকার বাবা। এদিকে অনামিকা আর হেলাল পড়ার ঘরে বসে আলাপ করছিলো যদিও ওদের পড়া নিয়েই, কিন্তু ওদের চোখগুলো ছিলো মেলার সেই গানেই যেন: ‘শোন গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’। হঠাৎই হেলালের বাবা অনামিকার বাবাকে বললেন, ‘একদিন বাংলাদেশের
হিন্দু নিশ্চিহ্নই হয়ে যাবে।’ কথাটি শোনার পরপরই অনামিকা ও হেলালের আলাপও কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ‘ইংরেজদের আমলে বাংলাদেশ অঞ্চলের হিন্দুরা যেমন আরামে ছিলো, সেদিন আর কোনোদিনও আসবে না।’ এ কথা বললেন অনামিকার বাবা অখিল দত্ত। তিনি আরও বলেন, বৃটিশ আমলে কলকাতায়, বৌবাজারে, মিরাটে, লখনৌতে, ঝাঁসিতে, বেরেলীতে, দমদমে, বারাকপুরে এবং বালিগঞ্জে কতো না সুখে ছিলো বাঙ্গালি হিন্দুরা! কিন্তু আজ! শুনেছি কলকাতাতেও হিন্দুরা সুখে নেই!। আরে সেদিনও আমাদের অনিল বাজারে সামান্য একটু অপরাধে লাথি, কিল, ঘুষি কোনোটাই খাওয়া থেকে বাদ থাকেনি। তারপর তাকে জোর একটি বানোয়াট স্বীকারোক্তি পত্রেও স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। সে যদি আজ মুসলমান হতো, তাহলে তোরা এটা পারতি! বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা হলে খুব সহজেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। মানুষ এতটা নির্যাতক হয় কিভাবে!
এই কুমিল্ল¬ায় গোমতী নদীর এপারে প্রমীলা, আর ওই পারে নার্গিস। গোমতি নদীর এপার ওপার দুই পারেই নজরুলের হৃদয় প্রবাহিত। আর আমরা আছি কোথায়! কুমিল্লা শহরে গেলেই আমি মহেশাঙ্গন, বীরচন্দ্রনগর মিলনায়তন, ঝাউতলা, রানীর দীঘিরপার, ধর্মসাগরপারসহ কতো জায়গায় যাই। শহরে কিন্তু এমন বিভেদ নেই। এদিকে হেলাল আর অনামিকার আলাপ আবার শুরু হয়। জ্যাঠার কাছে শোনা গল্প হেলাল অনামিকাকে শোনায়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম কুমিল্লায় আসেন মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কবির বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে। এই আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিসের সাথে কবির বিয়ে হয়। কিন্তু এ বিয়ে ছিলো চাপাচাপির বিয়ে। নজরুল এ বিয়ে মানেননি। তাই রাতের বেলা গোমতি নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে কবি নজরুল গিয়ে উঠেন কুমিল্লা শহরের আশালতা সেনগুপ্তার বাসায়। আশালতাকে সবাই প্রমীলা নামেই ডাকতো। তার সঙ্গেই নজরুলের প্রেম এবং বিয়ে হয়। বলতে বলতে হেলাল তার জ্যাঠার কাছে শোনা গল্পটিকে ইচ্ছেমতো বানায়। অনামিকা জানতে চায়, নার্গিসের কী হলো! হেলালের সোজা উত্তর, তালাক দিয়ে দিলো। আরে এই বিয়ে তো সে নিজের ইচ্ছায় করেনি। সুতরাং তালাক ছাড়া পথ ছিলো না। তারপর হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টে হেলাল অনামিকাকে বললো, তুমি কি আমার একটি কবিতা শুনবে! আমি কিন্তু গানও লিখি। তোমাদের দিঘির পশ্চিম কোণে বসে গতকালও একটি গান লিখেছি। অনামিকা বললো, এই গান-কবিতা আমার একদমই ভালো লাগে না। আমাকে হেলাল ভূতের গল্প শোনাও। হেলাল বললো, কবিতা পছন্দ করো না মানে! আমি তো সব কবিতা তোমাকে নিয়েই লিখি। অনামিকা হেসে বললো, তাই নাকি! তবু আজ ভূতের গল্প শোনাও। হেলাল বললো, ময়মনামতি পাহাড়ের রূপবান ভূতের গল্প শুনবে! অনামিকা বললো, না হেলাল, তুমি আমাকে পোনরা মেলার বটগাছের ভূতের গল্প শোনাও। ওখানে নাকি মহারাজ ভূত বৃটিশ আমল থেকেই থাকে! সে নাকি আবার তিতাস এলাকার বিলাঞ্চলেও মাছ খেতে যায়। পোনরা এলাকায় তো আবার মাছের বড়ই অভাব। হেলাল বলে, আমি জানি অন্য এক ভূতের কথা। পোনরা মেলার বটগাছের কাছেই ছিলো এক প্রাচীন মন্দির। সেটা ৮০০ কিংবা ৯০০ বছর আগের কথা। তখন এক বৌদ্ধ রাজা অন্য এক হিন্দু রাণীর প্রেমে পড়ে। হিন্দু রাণীও সে বিষয়টা বুঝতে পেরে একদিন রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে চলে আসে বৌদ্ধ রাজার কাছে। কিন্তু হিন্দু রাজা ঘটনা টের পেয়ে দুইজনকেই কতল করে। পরে সেই হিন্দু রাজাও বাঘের পেটে যায়। তারপর এলাকার লোক সেই অমর প্রেমকে স্মরণীয় করতে এখানে গড়ে সেই প্রাচীন মন্দির, যা এখন নেই। আছে শুধু বটগাছ, যেখানে এখন পোনরা মেলা বসে। অনামিকা হেলালকে বলে, এসব কি সত্যি? নাকি তোমার বানানো গল্প! হেলাল বলে, আমার দূর সম্পর্কের নানা আছেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তার কাছে শুনেছি। জানি না এসব সত্যি নাকি মিথ্যা। সেই নানা আবার ইন্টারমিডিয়েট পাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এক হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়ে তার লাইফটা-ই বরবাদ। অনামিকা প্রশ্ন করে হেলালকে, লাইফটা-ই বরবাদ কেন? হেলাল বলে, বরবাদ হবে না, তিনি তো মেয়েটাকে না পেয়ে বিষই খেয়ে ফেললেন। তারপর এমন অসুস্থ হলেন, সারা জীবনেও আর কোনো পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। রাজনীতি করেছেন। কারাগারে গিয়েছেন। কিন্তু আর কোনো পরীক্ষায়ই পাশ করতে পারেননি তিনি। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পার্টি করেন। আর সেই হিন্দু মেয়ের কথা মনে পড়লে কিশোর কুমারের রোমান্টিক গান শুনেন। হেলাল আর অনামিকার এই মাখামাখি ভীষণ অপছন্দ করছেন অনামিকার কাকা কুঞ্জলাল দত্ত। তিনি এ নিয়ে বৌদির কাছে দুইবার রিপোর্ট করে এসছেন। বলেছেন, বৌদি ছেলেটা মুসলমান। তোমার মেয়েও বড় হয়েছে। কথাটি খেয়াল রেখো। নালিশ শুনে অনামিকাকে ডাক দেয় তার মা। অনু, আমার কাছে আয়। কাজ আছে।‘আসছি মা’ বলে উত্তর দিয়ে অনু হেলালকে বলে, তোমার সব গল্পে কেন তুমি হিন্দু মেয়েদের নিয়ে আসো! কারণটা কী! হেলাল বলে, সীতা দেবীর এক ভাগিনা ছিলো। সে একদিন আমাকে বললো, ‘পেয়ার’ অর্থ কি তুমি জানো? আমি বললাম, না। সে গান গাইতে শুরু করলো, ‘রূপ তেরা মস্তানা...’। একদিন হঠাৎ আমি সেই গান শুনলাম রেডিওতে। মধ্যরাতে। মা শুনছেন। তারপর আরেকটি গান, ‘অগর তুম না হোতে...’। আর এসব গান শুনে আমি তো গেলাম পাগল হয়ে।একদিন রাতের বেলা পুরনো জমিদার বাড়িতে একা একা চলে গেলাম দুর্গাপূজা দেখতে। গিয়ে ওখানে দেখি ২০০ বছরের পুরনো একটি বটগাছ। বটগাছের মগডালে বসে জমিদার প্রমোদলাল মজুমদারের ভূত আমাকে বলছে, তোকে এই মধ্যরাতে আমি তুলে এনেছি। তোর মরণ সামনেই। বাঁচার মাত্র একটিই উপায়। সে হলো, তোর বয়সী কোনো সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে তুই এই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যা। সকলেই জানে আমি একজন ভূতভীরু যুবক। গেলাম এক সাধুর কাছে। পরামর্শের জন্য। সাধু আবার স্বর্গীয় রণবীর চৌধুরীর পুত্র। তিনি বললেন, কথা তো ঠিক। আমি তো আরও ভয় পেয়ে গেলাম। জগন্নাথ মন্দিরের ধর্মীয় উৎসবে গেলাম। মুখরিত মন্দির প্রাঙ্গনের পেছনের বটগাছ থেকে জমিদার প্রমোদলাল মজুমদারের ভূত আবারো আমার সামনে উপস্থিত। আমাকে বলছে, এ কী তুই যে কথা শুনছিস না! অমঙ্গল হয়ে যাবে কিন্তু! তারপর থেকেই তো মহাকল্যাণ কামনায় তোমাদের দিঘির কোনায় বসি, কীর্তন উৎসবে ও মহাপ্রসাদ বিতরনে অংশ নেই। কিছুদিন আগে জমিদার প্রমোদলাল মজুমদারের ভূত তোমাদের বাড়ির সমাধিস্থল পরিদর্শন করে। তারপর থেকেই সমাধিস্থলের পাশের চিতাটাও আমার বুকে হৃৎপিন্ডে ঢুকে গেছে। রয়েছে। এবারে দেখা গেল হেলালের চোখে জল। অনামিকার মা খুব জোর গলায় ডাক দেয়, অনু...। অনামিকা হেলালকে বলে, আমি তোমার সঙ্গে ‘পোনরা মেলা’য় দেখা করবো পৌষ মাসের শেষ দিন। আজকে পৌষের ১০ তারিখ। তারপর অনামিকা চলে যায় তার মায়ের কাছে। হেলালও তার বাবার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। তারপর আরও দিন যায়। অপেক্ষায় থাকে হেলাল অনামিকা এবং ‘পোনরা মেলা’র কিংবা সেই পৌষ মাসের শেষ দিনের। কিন্তু অনামিকার দেখা আর সে পায় না। সেই থেকে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্থান ‘পোনরা মেলা’য় সে আর যায় না। পৌষ মাসের শেষ দিন দিনের মধ্যরাতে হেলাল নিশ্চিতভাবে খবর পায়, কাউকে কিছু না বলেই অনামিকার পরিবার হঠাৎ দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। হেলালের বাবা তখন চাকুরিতে। খুলনায়। হেলাল মনে মনে গুন গুন করে গায় ‘পোনরা মেলা’য় শোনা সেই গানটি: ‘শোন গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’। ঠিক, অনামিকা দত্তের বাড়িটাও ছিলো হেলালদের বাড়ির সোজা দক্ষিণ দিকেই।
রচনা: অক্টোবর, ১৯৯৮, কুমিল্লা।

৮২| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৩৩

জসীম অসীম বলেছেন: ।। ছোট গল্প।।
অদ্ভুত মৃত্যুর ডাক
জসীম উদ্দিন অসীম
ভোর রাতের আরও অনেকটা সময় বাকী। চারদিক স্তব্ধতায় বন্দী। আমি নওয়াজেশ মোহন বিগ্রেডিয়ার মোহন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। একজন দেশপতির হত্যা- মামলায় আমিও জড়িয়ে গেছি কিংবা আমাকে জড়ানো হয়েছে। হত্যার জন্য আমি কোনোভাবে দায়ী কিনা, সে আলোচনা জটিল। তাই অন্তিম মুহূর্তে সে দিকে যাচ্ছিনা আমি। শুধু বলে রাখছি যে, একটু পরই আমার ফাঁসি হবে- ফাঁসি। জীবনের এ প্রান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে, আমি এখন ইচ্ছে করেই মৃত্যুকে ভুলে আছি। মরতে যখন হবেই, তখন মৃত্যুকে আর ভয় করে কী লাভ। বরং একটু সুখে শান্তিতেই মরণ হোক আমার। স্মরণীয় এক সন্ধ্যামাখা বিকেলের কথা বলি। তখন আমি কিশোর। সেদিন সঙ্গীদের সঙ্গে খেলাধুলো ভুলে গিয়ে বসেছিলাম গোমতী নদীর তীরে, যে গোমতী মিশে গেছে আমার রক্তের সঙ্গে। তখন শরৎকাল। নদীর পাড় সবুজ- সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে। ঘাসের চাঁদরে হেঁটে গরু- ছাগলগুলো তখন ঘাস খাচ্ছিলো। কোনোটির পিঠে আবার ফিঙে পাখি বসে বসে ডাকছিলো। নানান রকমের ডাক। নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো নানা রকমের কচুরিপানা। তাঁর কোনো কোনোটির মধ্যে ছিলো বেগুনি রঙের ফুল। কৃষকরা তখন বর্ষার জোয়ারের জল নেমে যাওয়া চরগুলোতে চাষাবাদ করছিলো। দূরে এক চরে আমার বয়সী অনেক ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখলাম। অন্যদিন হলে দৌড়ে যেতাম, সেদিন যেতে ভালো লাগেনি। ভালো লেগেছিল শুধু বসে বসে গোমতী নদীর এপার- ওপার দেখতে। খুব দূরে অবস্থিত একটা বাড়ীর ঘন গাছপালাকে বনের মতো মনে হচ্ছিল আমার। সবুজ সবুজ গাঢ় সবুজ। শুধু সবুজের সমারোহ। সেই সবুজের কথা কখনোই আমি ভুলে যেতে পারবো না। নদীর একপাশে মাছ ধরছিলো কয়েকজন জেলে। এক সময় একটি বড় মাছ পেয়ে ওরা আনন্দে হৈ- হল্লা শুরু করলো। অন্যদিন হলে দৌড়ে যেতাম। মাছের চোখ দেখতাম, লেজ দেখতাম। কেন জানিনা, সেদিন আমার দৌড়াদৌড়িতে একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। নদী বয়ে যাচ্ছিল ঠিক আশ্বিনের নদীর মতোই। বুঝাই যাচ্ছিল না এ নদী আষাঢ়ে এতো ভীষণ উত্তেজিত হয়। নদী দিয়ে এপার - ওপার করছিলো দুপাড়ের যাত্রী নিয়ে মাঝি। যাত্রীদের অধিকাংশেরই পরনে ছিল লুঙ্গি। অনেকের গায়ে আবার পাঞ্জাবী বা গেঞ্জি। কেউবা ছিল শুধু খালি গায়েই। টুপি ছিল আরো অনেকের মাথায়। একই মাঝি সব বয়সী, সব ধর্মীয়, সব চেতনার, সব পেশার মানুষকে পাড় করে দিচ্ছিল। আমি সেদিনই প্রথম এতো গভীর করে এই ব্যাপারটি দেখেছিলাম। নদীর ওপারে ছিলো বাজার। বাজার থেকে সন্ধ্যামাখা বিকেলে খরচের ব্যাগ- পোটলা নিয়ে বাড়ী ফিরছিলো লোকজন। কেউবা ধীরে, কেউবা দ্রুত। কিন্তু বাড়ী ফিরছিলো সবাই। ওপারে যে বাজার ছিল, তারই নীচে ছিল একটি প্রাইমারী স্কুল। সে স্কুলেই পড়তাম আমরা। স্কুল প্রাঙ্গণে শীতকালে বছরে একবার মেলা হতো। মেলার সময় খেয়া নৌকো খুব খুব যাত্রী বোঝাই করে মাঝি এপার- ওপার করতো। একবার এই মেলার সময় নৌকো ডুবিতে আমার চাচাত ভাই রবিন মারা গিয়েছিলো। সে দুঃখের স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলবোনা, ভুলে যেতে পারবো না। নদীর পাড় দিয়ে সেদিন যাচ্ছিল এক ফেরিওয়ালা। স্বাস্থ্য বেশি ভালো ছিল না তাঁর। পরনে ছিল নীল রঙের লুঙ্গি- ঠিক শরতের আকাশটারই মতো। তাঁর এ দ্রুত বাড়ীর দিকে হাঁটার মধ্যে, এক ধরনের সুখ আমি দেখেছিলাম সেদিন। হঠাৎ রেলের ডাক শুনলাম আমি। রেলগাড়িটা আসলো এবং গেলো। নদীর ওপরের লাল ব্রীজটা দিয়ে। শব্দ করলো নানা রকমের শব্দ। ওর দৌড়ের দাপটে মাটি এবং নদীর পানিও কেঁপেছিলো সেদিন। দেখেছিলাম খুব কাছ থেকেই। কিশোর একজন রাখাল যাচ্ছিলো বিড়ি খেতে খেতে। তারই পেছন দিক থেকে আমাদের ওসমান স্যার আসছিলেন কালো সাইকেল চেপে। বোধ হয় শ্বশুরবাড়ী থেকে। কারণ সেদিন ছিল রবিবার, স্কুল ছুটির দিন। ছুটির দিনে কতো খেলা খেলতাম। সেদিন শুধু দেখার খেলা খেলেছিলাম আমি। দেখা-দেখা শুধুই দেখা। এ দেখার আর শেষ ছিল না সেদিন। হঠাৎ একজন মহিলাকে একটি শিশু কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখেছিলাম। শিশুটির হাত- পা ও পেট দেখে বুঝেছিলাম শিশুটি ভীষণ অপুষ্টির শিকার। মহিলার পরনের শাড়ীতে অনেকগুলো তালি দেখেছিলাম আমি। শাড়ির একদিকের ছিঁড়ে জায়গা দিয়ে মহিলাটির হাঁটু দেখা যাচ্ছিলো। রাগে- ঘৃণায়- দুঃখে আমার কান্না এসেছিলো সেদিন। জানিনা এ কিসের রাগ কিসের ঘৃণা কিংবা কিসের দুঃখ। হয়তো মহিলার কষ্ট দেখেই এমন হয়েছিলো। হঠাৎ সামনে দেখেছিলাম মশার ঝাঁক। ততক্ষণে ওঠে দাঁড়ালাম আমি। আকাশে তখন অনেক উড়ন্ত বাদুর। মেঘগুলোও নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা ছিল না তখন। অস্ত যাওয়া সূর্যের রঙে রক্তের মতো লাগছিলো। এবার আমিও উঠি বন্ধু। ডাক এসেছে- ফাঁসির ডাক। করুন অস্ত যাওয়া রক্তের মতো সূর্যের রঙা ডাক। এ ডাক অদ্ভুত এক মৃত্যুর ডাক। এ ডাক ছেলেবেলার সেই নদীতে দেখা কচুরিপানার শোনা ডাক। কেবল ভেসে চলা। ফেরার উপায় নেই। কিংবা যেন রবিনের মতো নৌকাডুবিতে মরার ডাক, যে ডাক থেকে ফেরার উপায় নেই। আর কোনোদিন না। মানুষকে এমন মৃত্যু কেন ডাকে?
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক রূপসী === সাহিত্য। রচনাকাল: ১৯৯০।

৮৩| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৪০

জসীম অসীম বলেছেন: আমার সোনার বাংলা
জসীম উদ্দিন অসীম
চর্যাপদের বাস্তব চিত্রের সোপান বেয়ে
জীবনে দেখা দেয় প্রেম। মানুষকে পাগল
করে দেয় শ্যাম

কিন্তু শ্যামের প্রেমেও অনেক জ্বালা।
সে জ্বালা কেবলি কাঁদায়।
প্রেম এবং বিরহের জীবন
এঁকেছেন কালিদাস। বিরহ সেখানে রূপ ও রসোত্তীর্ণ মাত্রা পেয়েছে।

কিন্তু প্রেম এবং জীবনের উপলব্ধির রূপ
ক্রমাগতই বদল হতে থাকে। বর্গির উপদ্রবে
বাংলা হয় উত্তাল এক দেশ

বর্গির আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এলো
আমার সোনার বাংলা ভাষার ওপর
অবজ্ঞা। সেই অবজ্ঞার প্রতিবাদও করলো
প্রতিরোধী মানুষ।
এখানকার মানুষ মাতৃভাষা- মাতৃভূমি রক্ষা
করতে সাহসী রূপ ধারন করলো।

কিন্তু বারবার নির্যাতিতা হলো এ দেশ।
বিচারের বদলে নির্বিচারে মারা হলো মানুষ।
অবিচার হলো পুরস্কৃত।

তাই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মানুষ
মানুষের কাতারে মানুষ নেমে আসে
সমাজের পঙ্কিল পথ থেকে।

মানুষের সন্ধানে মানুষ পাগল
হয়ে ওঠে। অপেক্ষা করে যুগের পর যুগ।

তেমন মানুষ আর আসে না। অন্যদিকে
শ্রমজীবি মানুষ মুক্তি পায় না এতদিন পরেও।

তবু কোনো কোনো মানুষ কঠিন জেনেও
জীবন ভালোবাসে।

তবু কোনো কোনো মানুষ কঠিন জেনেও দেশকে
ভালোবাসে, ভালোবাসে পৃথিবীকে।
স্বপ্ন দেখে বৈষম্যহীন পৃথিবীর। যুগের দাবিতে
চাঁদ ও কবিতার সংজ্ঞা পাল্টে যায়।
রচনা: জুন, ১৯৯৭।

৮৪| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন: আমরা কখনোই হতে পারবো না
জ্যোৎ¯œা কিংবা রোদ্দুর
জসীম উদ্দিন অসীম

‘অমলকান্তি’ কবিতাটি আমাদের বাসার সবাই পছন্দ করে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র কবিতা। আসলে এই কবিতাটিতে করুণ এক গল্প রয়েছে। এই কারণেই এ কবিতার প্রতি ভালো লাগা। অমলকান্তির বন্ধু চমৎকার করে বলে এ গল্প। ইস্কুলে ‘অমলকান্তি’ রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে, দেখে ভারী কষ্ট হত। কিন্তু পিয়াস খুব ভালো ছাত্র হয়েও এবং রোজ দেরি করে ক্লাসে না গিয়েও অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেটা কি অমলকান্তির কথা মনে করে! অমলকান্তির বন্ধুরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিল, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। কিন্তু পিয়াস কী হতে চায়! কেন তার এ উদাসীনতা! অবাক হয়ে কেন সে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে! অমলকান্তি মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! পিয়াসও কি তবে তেমন ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎ¯œা হতে চায়! কেন সে মাকে ফাঁকি দিয়ে এমন দূরে হারিয়ে যায়! কেন সে মায়ের চোখের জল এভাবে ঝরায়! পিয়াস কি তবে ছবিই আঁকবে শেষে! মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল কিছুই হতে পারবে না! অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই দুঃখে পিয়াসের বড় কিন্তু আমার ছোট ভাই দামাল ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়। অমলকান্তি শেষে অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। মাঝে মধ্যে আমারও মনে হয়, অমলকান্তির মতো ছাপাখানায় কাজ করেই পিয়াস তার জীবনটা পার করে দেবে। তা না হলে স্কুলে পড়া কোনো বালক গোমতি নদীকে এত ভালোবাসে! প্রায়ই সে গোমতি নদীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারপর আবারও মায়ের কাছে ফিরে। সে কি তাহলে অমলকান্তিই হবে! অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই অমলকান্তি রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পিয়াসও কি শেষ পর্যন্ত জ্যোৎ¯œা হতে পারবে! নাকি রক্তখেকো ভয়ংকর সব রাক্ষসীরা তার জ্যোৎ¯œা খেয়ে ফেলবে! নাকি একদিন হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে জ্যোৎ¯œা ধরে মায়ের কাছে ফিরবে! আমি শৈশবে মামার বাড়ির তেতুলগাছে উঠে ভূত দেখিনি কোনোদিনও। তবে রোদ্দুর আর জ্যোৎ¯œা দেখেছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি শেষ রাতের ট্রেনে করে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় ফেরার পথে আমি অন্ধকার রাতেও জ্যোৎ¯œা দেখতে পাই। এমনকি আমি কঙ্কালের ভিতরও জ্যোৎ¯œা দেখতে পাই। রাত হলেই তাই আমি ট্রেনষ্টেশনে চলে যাই বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎ¯œা দেখবো বলে। কিন্তু আমিও পারিনি জ্যোৎ¯œা ছুঁতে কখনো। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। আমিও পারিনি জ্যোৎ¯œা ছুঁতে। চাঁদ থেকে জ্যোৎ¯œা তো অনেক আগেই খসে গেছে। সেই অমলকান্তিও রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পিয়াসও কি শেষ পর্যন্ত জ্যোৎ¯œা হতে পারবে! পিয়াসও কি শেষে জ্যোৎ¯œার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে এখন জ্যোৎ¯œা হতে চায়! আমিও যেমন জ্যোৎ¯œার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে আমি জ্যোৎ¯œা হতে চেয়েছিলাম। তারপরও কেন রাত হলেই আমি গোমতি নদীর পারে কিংবা ট্রেনষ্টেশনে চলে যাই বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎ¯œা দেখবো বলে? ট্রেনষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে কি জ্যোৎ¯œার টিকেট পাওয়া যায়! যে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখিনা, যে আমি শৈশবে চাঁদকেই ঈশ্বর ভেবে বড় হয়েছি, সে আমি কেন এখনও ঈশ্বরের বদলে জ্যোৎ¯œা খুঁজে মরি! কারণ শৈশবে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝেও জ্যোৎ¯œার দেখা পেতাম। ছিলো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আমার বাড়ি বরিশাল জেলার কীর্তনখোলা নদীর পাশেও যদি হতো, আমি তবু এই গোমতি নদীর কাছেই চলে আসতাম জ্যোৎ¯œার খোঁজ করে করে। ছোটবেলা থেকেই আমি এমনই ছিলাম। কিন্তু কথা তো ছিলো আমাদের পরিবারে শুধু একজনই অমলকান্তি হবে। পিয়াস কেন আবার অমলকান্তি হতে চায় এখন! সে কেন এমন নদী ভালোবাসে! সে কেন জ্যোৎ¯œা হতে চায়! সন্ধ্যার পর গোমতি নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আগেও একটু-আধটু জ্যোৎ¯œার দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর জ্যোৎ¯œার দেখা পাওয়া যায় না। আমিও পারিনি জ্যোৎ¯œা ছুঁতে তাই। কারণ চাঁদ থেকে জ্যোৎ¯œা তো অনেক আগেই খসে গেছে। আর নৌকায় বসে যে জ্যোৎ¯œা দেখে, সে কি আর মাস্টার-ডাক্তার-উকিল হতে পারে! তাই আমি পারিনি। আমার বাবাও গিয়েছিলেন কতো কিছু করতে। পারেননি। অমলকান্তি শেষে অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। আমি মনে হয় একটি ছাপাখানায়ও কাজ করতে পারবো না। মাঝে মধ্যে আমারও মনে হয়, অমলকান্তির মতো ছাপাখানায় কাজ করেও পিয়াস তার জীবনটা পার করতে পারবে না। যেমন পারছি না আমি। কারণ ছাপাখানার কাজও এত সহজ নয়। স্কুল জীবনেই আমি এই গোমতি নদীকে ভালোবেসেছিলাম। স্কুলে পড়া কোনো বালক গোমতি নদীকে যদি এত ভালোবাসে, তা হলে আর এই দেশে এই ছেলে কোনো কাজেই লাগে না। এমনকি ‘অমলকান্তি’ও হতে পারে না। পিয়াস প্রায়ই গোমতি নদীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। মাকে খুব একা করে না বলেও যায়। আর তার গোমতি নদী দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়ই খুব সন্ধ্যা হয়ে যায়। ফেরার সময় সে হনহন করে হাঁটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বর্বর সৈনিকদের মারবে বলে যেমন করে মুক্তিযোদ্ধারাও কখনো কখনো হনহন করে হাঁটতো। কোনো কোনো ছাতিম অথবা হিজল গাছের পাশ দিয়ে। ইস্কুলে ‘অমলকান্তি’ রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে, দেখে তার কবি বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভারী কষ্ট হত। কিন্তু পিয়াস খুব ভালো ছাত্র হয়েও এবং রোজ দেরি করে ক্লাসে না গিয়েও অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেটা কি অমলকান্তির কথা মনে করে! অমলকান্তির বন্ধুরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিল, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। কিন্তু পিয়াস কী হতে চায়! কেন তার এ উদাসীনতা! নাকি সে নদী হতে চায়! অবাক হয়ে কেন সে জানলার দিকে এমন তাকিয়ে থাকে! অমলকান্তি মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! পিয়াসও কি তবে তেমন ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎ¯œা হতে চায়! কেন সে মাকে ফাঁকি দিয়ে এমন দূরে হারিয়ে যায়! কেন সে মায়ের চোখের জল এভাবে ঝরায়! পিয়াস কি তবে ছবিই আঁকবে শেষে! মাষ্টার-ডাক্তার-উকিল কিছুই হতে পারবে না! অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই দুঃখে পিয়াসের বড় কিন্তু আমার ছোট ভাই দামাল এখনও ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়। অমলকান্তি শেষে অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। কিন্তু আমরা কি শেষে কোনো ছাপাখানায়ও স্থির হয়ে কাজ করতে পারবো শেষে! নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তির মতো! স্কুলে পড়া কোনো বালক গোমতি নদীকে কিংবা জ্যোৎ¯œাকে যদি এত ভালোবাসে, তা হলে এই দেশে এই ছেলেরা আর কোনো কাজেই লাগে না। এমনকি ‘অমলকান্তি’ও হতে পারে না। রাত হলেই তারা হয়তো ট্রেনষ্টেশনে যায় বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎ¯œা দেখবে বলে। কিন্তু তারা পারে না জ্যোৎ¯œা ছুঁতে কখনোই। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। আমি এবং পিয়াসও পারিনি জ্যোৎ¯œা ছুঁতে। তাই। চাঁদ থেকে জ্যোৎ¯œা তো অনেক আগেই খসে গেছে। সেই অমলকান্তিও রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। পিয়াসও কি শেষে জ্যোৎ¯œার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে...যে এখনও জ্যোৎ¯œা হতে চায়! আমিও যেমন জ্যোৎ¯œার কথা ভাবতে-ভাবতে ভাবতে-ভাবতে...যে আমি জ্যোৎ¯œা হতে চেয়েছিলাম। তারপরও কেন রাত হলেই আমি এখনও গোমতি নদীর পারে কিংবা ট্রেনষ্টেশনে চলে যাই বটগাছের চূড়ায় জ্যোৎ¯œা দেখবো বলে? ট্রেনষ্টেশনের টিকিট কাউন্টারে কি জ্যোৎ¯œার টিকেট পাওয়া যায়! নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’ শেষে ছাপাখানার কাজটা কোনোরকমে করতে পেরেছিলো। রবীন্দ্রনাথ বিলাত গিয়েও ব্যারিষ্টার হতে পারেননি। অবহেলায়-অনাদরে-অবজ্ঞায় বেঁচে থাকা রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে জ্যোৎ¯œা অথবা রোদ্দুরের দেখা একটু পেয়েছিলেন। তাই রক্ষা পেলেন। কিন্তু আমি অথবা পিয়াস কিংবা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’...আমরা কখনোই হতে পারবো না জ্যোৎ¯œা কিংবা রোদ্দুর।
এপ্রিল ১৯৯৭, পশ্চিম চানপুর. পেয়ারাবাগিচা রোড, কুমিল্লা


৮৫| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৫২

জসীম অসীম বলেছেন: জীবনানন্দ দাশ
‘তার হৃদয় আজ ঘাস’
জসীম অসীম:
২২ অক্টোবর বাংলা কবিতার রাজা ‘রূপসী বাংলার কবি’ জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকী। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ হইতে হইবে, এই যার পণ।...’
এই কবিতা কার? কুসুমকুমারী দাশের (১৮৮২-১৯৪৮)। কে এই কুসুমকুমারী দাশ? আমাদের বাংলা কবিতার মহারাজ জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) জননী। মা নিজেই যেখানে কবি, সেখানে ছেলে তো এমন কবিতার মহারাজ হবেনই। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, কবিতার কেমন মহারাজ তিনি? কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো কেমন? আজকাল অধিকাংশ লোকেরই সেরা পছন্দের তালিকায় থাকেন জীবনানন্দ দাশ-বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। তাই কি কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা চলে বাংলা কবিতার সম্রাট। নাকি অন্য কোনো কারণে তিনি বাংলা কবিতার সম্রাট? কিন্তু কেমন সম্রাট তিনি?
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবননানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা কবি কুসুমকুমারী দেবীর প্রভাবে ছেলেবেলা থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। তখন তিনি ‘শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত’ নামে লিখতেন। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামে লিখতে শুরু করেন। জীবদ্দশায় তাঁর সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’। জীবনানন্দ প্রায় সাড়ে ৮০০ কবিতা লিখলেও জীবদ্দশায় মাত্র তার অল্পই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও কাব্য সংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় এবং ‘রূপসী বাংলা’ নামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পান্ডুলিপি জীবনানন্দের মৃত্যু পরবর্তীকালে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ নামে প্রকাশিত হয়। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন। ১৯৪৫ সালের ২২ অক্টোবর ট্রাম দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যুর আগে তিনি ১৪টি উপন্যাস এবং শতাধিক ছোটগল্প রচনা করেছেন, যার একটিও জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। জীবন কেটেছে তাঁর চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় প্রধান কবি হিসেবে তিনিই স্বীকৃত। তিনি ছিলেন একজন হতাশাগ্রস্থ মানুষ। এ সমাজের বিশৃঙ্খলতার সঙ্গে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাই এতো মেধাবী শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও বারবার চাকুরি ছেড়েছেন-বেকার থেকেছেন। একজন কবি অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে সহজ দু:খে কি ইনসিওরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হয়? কিংবা ঐ যে ট্রাম দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু, এটাও কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, কেউ কেউ তো একে আত্মহত্যাও বলেছেন।
৩০ বছর বয়সে জীবনানন্দ দাশ বিয়ে করেন লাবণ্যগুপ্তকে। লাবণ্য ছিলেন ঢাকার মেয়ে। জীবনানন্দ বরিশালের। এখানেও বিশেষ পার্থক্য ছিল। দু’জনের মতের অনেক অনেক পার্থক্য ছিল বলেও জানা যায়। এটাও তার হতাশাগ্রস্থ জীবনের জন্য দায়ি হতে পারে। তারপরও কবিতায় তিনি ছিলেন রাজা। সম্রাট। বাংলার প্রকৃতির চিত্রায়নের রাজচিত্রকর, জীবনের হতাশার রাজা, নি:সঙ্গতার রাজা, রোমান্টিকতার রাজা কিংবা সম্রাট। এককথায় তিনি ছিলেন এক আধুনিক জীবনসম্রাট।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম দিককার কিছু কবিতা পড়লে মনে হবে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাই পড়ছি। কী ছন্দে, কী বক্তব্যে। কিন্তু এ অবস্থা থেকে খুব দ্রুতই উত্তীর্ণ হন তিনি। যেমন, হিন্দু-মুসলিম মিলনের পক্ষের তার এ কবিতাংশও সে কথার প্রমাণ দেয়। ‘মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে/পুণ্য ভারতপুরে/পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে/নামাজের সুরে সুরে/এ ভারতভূমি নহেকো তোমার/নহেকো আমার একা/, হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ/মুসলমানের রেখা.../...
কাফের যবন টুটিয়া গিয়াছে/ ছুটিয়া গিয়াছে ঘৃণা/, মোস্লেম বিনা ভারত বিফল/, বিফল হিন্দু বিনা।’
কিন্তু যখন তিনি বলেন ‘আবার আসিব ফিরে/ধানসিঁড়িটির তীরে/ এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল/ শালিকের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে/ এ কার্তিকের নবান্নের দেশে। ...’ [রূপসী বাংলা]
তখন কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ নতুন এক কবি মনে হয়। কারণ ঠিক এভাবে আমরা আর কাউকেই তেমন পাইনা। দেশের কথা তো আমরা রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তে অনেক পাই, কিন্তু এভাবে নয়। সত্যেন্দ্রনাথ যখন বলেন-‘মধুর চেয়ে আছে মধুর/সে আমার দেশের মাটি/, আমার দেশের পথের ধুলা/খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।’ তখন কিন্তু দেশকে কম বড় করে তোলা হয় না। অথবা যখন এই সত্যেন্দ্রনাথই বলেন,
‘কোন দেশেতে চলতে গেলে/ দলতে হয়রে দুর্বা কোমল/ কোথায় ফলে সোনার ফসল/ সোনার কমল ফোটে রে/সে আমাদের বাংলাদেশ/আমাদেরি বাংলারে।’ তখন কিন্তু ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথকে খুব শক্তিধর এক কবিই মনে হয়। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের সুর ভিন্ন। শুধু দেশ নিয়ে নয়, প্রেম-মৃত্যু-নগরজীবন-হতাশা সব নিয়ে।
প্রেম নিয়ে জীবনানন্দের একদম সাদামাটা অথচ দৃঢ় উচ্চারণ :
‘সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে
প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি।’
অথবা
‘কেমনে ধরিব প্রাণ
তোমার বিহনে।’
অথবা
‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে
(হায় চিল)
(বনলতা সেন)
-জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় বলার পরও তিনি নিজেই ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবেসেছেন’। আসলে প্রায় সব মানুষই প্রেমের বিষয়ে এমন।
কাঙ্খিত নারী জীবন থেকে হারানোর যে বেদনা-অথবা প্রেমের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে যাওয়ার যন্ত্রণাও তার কবিতায় দীপ্ত রূপ লাভ করেছে। জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা এতই গভীর-এতই দৃঢ়-এতই প্রশান্ত যে-প্রেমের নামে এখানে কোনো শ্লোগান নেই। কবিতার ছন্দও কেমন ধীর-প্রশান্ত।
‘সেই নারী ঢের দিন আগে
এই জীবনের থেকে চলে গেছে।’
অথবা
‘তোমার সংকল্প থেকে
খ’সে গিয়ে
ঢের দূরে চলে গেলে তুমি;’
(প্রেম অপ্রেমের কবিতা)
(মহাপৃথিবী) জীবনানন্দ
সংশয়বাদেরও তিনি এক স্রষ্টা। সংশয়ের শিল্পরূপ দিয়েছেন তিনি।
‘চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল;
উনিশশো বেয়াল্লিশ ব’লে মনে হয়
তবুও কি উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল।’
(ক্ষেতে প্রান্তরে)
(সাতটি তারার তিমির)
জীবনানন্দ দাশ
পৃথিবীর সব ভাষাতেই এই সংশয় প্রধান কিংবা অন্যতম বিষয় হয়ে কবিতার স্থান দখল করেছে। কেন এই সংশয় ? তারও এক উত্তর জীবনানন্দ দাশ দিয়েছেন তার কবিতায় :
‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর
অসুখ এখন।’
(সুচেতন)
(বনলতা সেন) তাই আধুনিক নগর জীবনের ক্লান্তি জীবনানন্দ দাশকে ভয়ংকররূপে আহত করেছে। কবি এমন সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করতে নারাজ। তাই তার শিল্পিত উচ্চারণ :
‘কোন দূর সবুজ, ঘাসের দেশ নদী
জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার
তারা কোথায়?
তারা কি হারিয়ে গেছে?
পায়ের তলে লিকলিকে-
ট্রামের লাইন,-
মাথার ওপরে অসংখ্য জটিল-
তারের জাল
শাসন করছে আমাকে।’
(ফুটপাথে)
(মহাপৃথিবী)
এই যে মাথার ওপরে অসংখ্য জটিল তারের জাল, [যন্ত্রসভ্যতা?] তা জীবনানন্দ দাশের শ্বাস বন্ধ করেছে বারবার। আর ঐ যে সবুজ ঘাসের বদলে লিকলিকে ট্রামের লাইন? এমন পথেও তিনি হাঁটতে অপারগ। তাই মারা গেলেনও এই ট্রাম লাইনেই। কলকাতায়। নগরে। এই মৃত্যু কি আত্মহত্যা? স্বেচ্ছামৃত্যু? কে দেবে তার উত্তর?
তিনিই বলেছেন-
‘গলিত স্থবির ব্যাং
আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়-’
[আট বছর আগের একদিন]
[মহাপৃথিবী]
কিন্তু তিনি আর একমুহূর্তকাল বেঁচে থাকারও চেষ্টা করলেন না। তবে কি তিনি আর নি:সঙ্গতার যন্ত্রণা বহন করতে পারছিলেন না? তার একাকীত্বের যন্ত্রণার কথা তিনি বলেন অনেকটা এভাবেই :
‘উড়ে গেলে মনে হয়,
দুই পায়ে হেঁটে
কতো দূর যেতে পারে
মানুষ একাকী।’
[বিভিন্ন কোরাস (২)Ñ]
(মহাপৃথিবী)
বরং তিনি মৃত্যুকে আহবান করেন বিভিন্নভাবে-বিভিন্ন নামে। এমনকি তিনি সাহসের সঙ্গে কুণ্ঠাহীনভাবে উচ্চারণ করেন :
‘মৃত্যুরে ডেকেছি আমি
প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে।’
[জীবন ২৬)]
(ধূসর পান্ডুলিপি)
আসলে যারা জীবন নিয়ে নোংরা রাজনীতি করেন-সেসব সাহিত্য সমালোচকদের কাছে জীবনানন্দ দাশের যোগ্য মূল্যায়ন আশা করা যায় না। কারণ রাজনীতি আর নন্দননীতি এক নয়। জীবনানন্দের কবিতায় নন্দনের ছড়াছড়ি-কিন্তু প্রচলিত সমাজের কাছে তার মূল্যায়ন আশা করা বৃথা। তাই কবি যখন বলেন-
‘মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো-
প্রিয়ার মতন!
চকিত শিশুর মতো তার কোলে
লুকায়েছি মুখ’
[জীবন (২৫) ধূসর পান্ডুলিপি]
তখন তাকে কিন্তু স্বাভাবিক মানুষ বলেও মনে হতে চায় না।
‘সব ভালোবাসা যার বোঝা হল,
দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে।’
জীবন (১৭)-ধূসর পান্ডুলিপি]
মৃত্যু-মৃত্যু-শুধুই মৃত্যু...মৃত্যুর ছড়াছড়ি। মৃত্যুই স্বপ্ন-মৃত্যুই গন্তব্য। মৃত্যুকে এত আপন করে বাংলা সাহিত্যের আর কোনো কবি উপস্থাপন করেছেন কি? মৃত্যুকে চুমো দেয়ার আনন্দ সিংহাসন জয়ের চেয়েও বেশি। তাই তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেন-
‘পাখির মতন উড়ে পায়নি যা পৃথিবীর কোলে-
মৃত্যুর চোখের ‘পরে চুমো দেয়-
তাই পাবে বলে।’
অথবা
‘কারণ, সাম্রাজ্য-রাজ্য-সিংহাসন জয়
মৃত্যুর মতন নয়, মৃত্যুর শান্তির মতো নয়।’
অথবা
‘মানুষের মতো পায়ে চলিতেছি-
যতো দিন, তাই ক্লান্তির পরে ঘুম,-
মৃত্যুর মতন শান্তি চাই!’
[প্রেম-ধূসর পান্ডুলিপি]
অর্থ্যাৎ কবি জীবনানন্দ দাশ বলছেন, শান্তি আর কোথাও নেই, আছে মৃত্যুর কাছে। শান্তির অপর নামই মৃত্যু। এমন জীবনদর্শন-খুব একটা প্রচলিত নয়। তাই কবি জীবনানন্দ দাশও অপ্রচলিত কবি। রবীন্দ্র-নজরুলের মতো তিনি ধার্মিকও নন। নজরুলের মতো রাষ্ট্ররটানো প্রেমিকাও তার দেখা যায় না। বিবাহিতা স্ত্রী লাবন্য দাশের বাইরে কোনো নারীকে তার জীবনে সরাসরি পাওয়া যায়নি। অথচ তার প্রেমের কবিতাগুলো গভীর। গভীরতর গভীর। রাষ্ট্র তাকে নিয়ে কী ভাববে-সমাজ তাকে নিয়ে কী বলবে-তার ধারেকাছেও থাকেন না তিনি। মূর্খ সাহিত্যবোদ্ধাদের করেন না একবিন্দুও তোয়াক্কা। তারই নাম জীবনানন্দ দাশ। যার হৃদয়ে শুধু হৃদয় নয়-‘তার হৃদয় আজ ঘাস’। বরং বলা চলে তার হৃদয় চিরকালের চিরসবুজ চিরন্তন ঘাস।
সেপ্টেম্বর ১৯৯৬
পশ্চিম চানপুর, কুমিল্লা।
প্রথম প্রকাশ:

৮৬| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৫৮

জসীম অসীম বলেছেন: সিডিউল কাস্টের মেয়ে
জসীম উদ্দিন অসীম

বাড়ির উঠানের পাশে বৈঠকখানার সামনেই যেখানে বকুলের সবুজ গাছ, তার নিচেই বান্ধবীদের নিয়ে আনন্দে আড্ডায় বিভোর ছিলো বকুল। ষোড়শী বকুল। সুলতানা বকুল। বকুল ফুলের গাছের নামেই মেয়ে। মেয়ের নামেই গাছ। বকুল ফুলের গাছ। রোস্তম শেখের একমাত্র সন্তান এই বকুল। রোস্তম শেখ বাড়িতে ফিরতেই আড্ডায় ছেদ পড়ে যায় মেয়ের। এগিয়ে এসে বাবার ব্যাগটা হাতে নেয়। বাবাকে বলে, বাবা আমার নতুন জ্যামিতি বক্স এনেছো?
রোস্তম শেখ বলে, আজও ভুলে গেলাম মা। আগামীকাল আর ভুল হবে না।
বকুল বলে, বাবা তুমি আগামীকালও ভুলে যাবে। রোস্তম বলে, না মা। আর ভুল হবেই না। বকুল বলে, তোমার নাম রোস্তম শেখ নয়, তোমার নাম বাবা ভোলানাথ।
মেয়ের কথা শুনে হাসে রোস্তম শেখ। বাবাকে ঘর আর দাদীর কাছে পৌঁছে দিয়েই বকুল চলে যায় বান্ধবীদের কাছে, সেই উঠানের বকুলতলায়।
ঘড়ি ংঃধৎঃরহম ভৎড়স ঃযব নধপশ:
‘হিন্দু মেয়েকে মুসলমান করিয়ে বিয়ে করতে পারলে হজ্জ্বের সওয়াব পাওয়া যায়।’ এমন একটি কথা অনেকবারই শুনেছে রোস্তম । কিন্তু সে আসলে হিন্দু মেয়ে নিরুপমাকে ওই কারণে বিয়ে করেনি। বিয়ে করেছে মেয়েটির প্রেমে পড়েই। তবে বিয়ের পর সামাজিক নানা চাপে যেন ধীরে ধীরে তার প্রেম হয়ে যায় হাওয়া।
যৌবনে নিরুপমা দেবকে রোস্তম শেখ নীলরক্তের অধিকারিনীই ভেবেছিলো। কিন্তু এখন দেখছে নাম তার যেমনই হোক, সে যেন কোনো সিডিউল কাস্টের মেয়ে। লোয়ার ক্লাস। মানে ছোটজাত। অনেক গুণাগুনের কথা বলে তাকে গরুর মাংস খাওয়া শেখানো হয়েছিলো। ইদানীং সে গরুর মাংস মুখে নিলেই বমি করে দেয়। তাহলে সে যে তার হিন্দুত্ব ত্যাগ করলো, সেটা কি অভিনয়? এক টুকরা গরুর মাংস খেলে তিনদিন তোর শরীর খারাপ করে। বাটপারি? রোস্তমের সঙ্গে? তাহলে তোর নিরুপমা নাম বাদ দিয়ে এই ‘সুলতানা’ নাম নিয়ে কী লাভ হলো? দু’দিন পরেই তো এসব নিয়ে ধরবে এই সমাজ।
ইদানীং মেয়েটা আবার সবার সঙ্গে কড়া ভাষায় কথা বলে। অথচ তার বাবা নাকি শিক্ষিত ভদ্রলোক। প্রমাণটা কোথায়? সেদিন রোস্তমের মায়ের সঙ্গেও করে বসলো এক বেয়াদবী। সংসারে তার এতোগুলো দিন চলে গেলেও কোরআন শরীফের দুই-তিনটা সুরাও মুখস্থ করতে পারেনি। এ নিয়ে রোস্তমের মা ধমক দিলে নিরুপমা ওরফে সুলতানা বলে, বিয়ের আগে তো মা আপনার ছেলে বলেছিলো, তোমার ধর্ম তোমার এবং আমার ধর্ম আমার। শুধু বিয়ের জন্য একবার তোমাকে মুসলমানের একটি নাম নিতে হবে। পরে সেটা পরিধেয় বস্ত্রের মতো করেই খুলে ফেললে হবে। আমি তোমাকে ‘নিরু...’ বলেই ডাকবো।
এ কথা শুনে রোস্তমের মা বলে, সেটা বিয়ের আগে বলেছিল। এখন এসবং বলে লাভ নেই। শ্বাশুড়ির এই কথাকে নিরুমপার প্রতারণাই মনে হয়। মাঝে মাঝে শ্বাশুড়ি আর স্বামী তাকে এমনই আক্রমণ করে কথা বলে যে, নিরুপমা ঠিক বুঝতেই পারে না তারা কথা বলছে নাকি তার পিঠে ছুরি মারছে। এমন প্রতারণার কথা মনে হলে নিরুপমা তার চোখের জল আর ধরে রাখতেই পারে না। প্রেমের নামে প্রতারণা? ধর্মান্তরিত করা? আর নিরুপমারও সমস্যা অনেক। কাগজেকলমে সে মুসলমান হলেও আসলে সে হিন্দুই রয়ে গিয়েছে। তা না হলে এইবারের দুর্গাপূজার সময়েও সে রোস্তমকে বলেছে, চলো না কোথাও গিয়ে মা দুর্গার প্রতিমা দেখে আসি। মা উমাকে না দেখে মনে কষ্ট পাই। সংসারতো চিরতরেই ছাড়লাম, মা দুর্গাকেও কি আর কোনোদিন দেখতে পারবো না? রোস্তম বলে, চুপ করো তুমি। মা-বাবা শুনলে আগুন লাগবে বাড়িতে। এটা গ্রাম। বুঝলে, মুসলমানদের গ্রাম। পাশের গ্রামে কিংবা বাজারে না গেলে দুর্গা প্রতিমা দেখা সম্ভব নয়। তাছাড়া লুকিয়েও যাওয়া যাবে না। গেলে আর তা প্রচার হয়ে গেলে আব্বা বিপদে পড়বেন। তিনি এখানকার মসজিদ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
নিরুপমা আর কথা বলে না। কারণ সেও গ্রামের মেয়ে, যদিও শহরের কলেজে পড়তে গিয়েই রোস্তমের সঙ্গে পরিচয় এবং প্রেম...তারপর তাদের বিয়ে। বিয়ের আগে রোস্তম নিরুপমার কোলে মাথা রেখে খুবই কেঁদেকেটে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া...। কিন্তু আজ দিন বদল হয়েছে।
সেদিন নিরুপমা তার শ্বাশুড়িকে বলেছে, মা আপনাদের সারাবাড়িতে একটি অর্জুন গাছও নেই। অর্জুনের কতো গুণ। একটি চারা লাগালে হয় না? কদমগাছ তো আছে, একটি বটের চারাও যদি লাগাতেন, কী সুন্দর গাছ!
এ কথা শুনে শ্বাশুড়ি বলেছেন, এসব গাছ তো তোমাদের হিন্দু বাড়িতেই বেশি থাকে। তবে এটা ঠিক অর্জুনের অনেক গুণ। কিন্তু বাড়িতে কেউ বটগাছ লাগায়? বোকা মেয়ে। সারাবাড়ি ঢেকে ফেলবে না? ধান শুকাবো কোথায়? বটগাছ তো বেশি থাকে তোমাদের হিন্দু মন্দিরে বা আশ্রমেই।
নিরুপমা বলে, মা আমাকে হিন্দু বললেন যে, আমি না এখন মুসলমান হয়ে গেছি। শ্বাশুড়ি আর কথা বাড়ান না। কিন্তু বুঝেন, মেয়েটা আজকাল প্রায়ই খুব উগ্র হয়ে কথা বলে যায়। সেটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। নিচুতলার মানুষেরই লক্ষণ। সেদিন সে আবার কী না ঘরের কোনের চড়–ইপাখির বাচ্চা নামিয়ে এনেছে। বাচ্চাগুলো এতোই ছোট ছিল যে, গায়ে ওদের লোমও হয়নি, চোখও ফোটেনি। এ মুখ সে মুখ হয়ে যখন এ কথা রোস্তমের কানে যায়, রোস্তম খুব ক্ষেপে যায়। ‘মা-বাবা কোনো শিক্ষাই দেয় নাই?’ রোস্তমের এই কথায় নিরুপমার চোখ ভিজে যায় জলে। কারণ তার ধর্মত্যাগের-পরিবার ত্যাগের কারণে তার মা-বাবা শোকাহত হৃদয়ে তার ছোটবোনটিকে নিয়ে চিরতরেই পাশের রাষ্ট্র ‘ইন্ডিয়া’য় চলে গিয়েছে। বাড়িটা বিক্রি করে গিয়েছে তার কাকার কাছেই। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো নিরুপমার কাছে খবর পাঠিয়েছিল সে যাবে কী না। নিরুপমা পরিষ্কারভাবেই ‘না’ বলে দিয়েছিল। অথচ আজ শ্বশুরবাড়িতে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময়ে ‘নয় থেকে দশ’ হলেই তার ‘ধর্ম’ কিংবা ‘জাত-বংশ’ নিয়েও তাকে কথা বলে অনেকে। বিশেষ করে তার মা-বাবাকে অপমান করা হলে সেটা তার সহ্যই হয় না।
অনেক অপমানের পরও নিরুপমার উগ্র স্বভাব কিন্তু পাল্টায় না। এ নিয়ে রোস্তমের আত্মীয় স্বজনদের অনেকে মনে করেন রোস্তম এ মেয়েটিকে বিয়ে করে এক ধরনের ধোঁকাই খেয়েছে। মুখে মুখে তর্ক করে এ মেয়ে। এমনকি শ্বশুরের সঙ্গেও কথার জবাব দিয়ে বসে। লোকে বলে ‘কথাকে নিরুপমাকে মাটিতেই নামতে দেয় না’। এমনকি যে বিষয়ে তার কথা বলারও প্রয়োজন নেই, সেই বিষয়েও অনেক সময় যেচে এসে কথা বলতে থাকে। তার এই স্বভাবটি রোস্তমদের পরিবারে অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়। আর এ নিয়ে প্রতিটি জনের আলোচনা-সমালোচনা চলতেই থাকে। তাই অনেকেই বলতে থাকে যে, এ মেয়ে বড় ঘরের কোনো মেয়ে হতেই পারে না। নিশ্চিত ‘সিডিউল কাস্ট’। তার আচরণই বলে। গেলো সে গোসল করতে পুকুরে, ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে ফিরলো ডাহুকের ফিকে সবুজ ডিম। অথচ মেয়ে তোর নিজের পেটেই চারমাসের বাচ্চা। আবার বলে কী না, ‘শালিক পাখির ডিম নীল, দেখতে খুবই সুন্দর। আমি দেখেছি। কিন্তু চিলের ডিম দেখার বড়ই শখ। আমি শুনেছি চিলের ডিম নাকি গাঢ় গোলাপি বা লাল।’ মেয়ে বলে কী। এটা কি মেয়ে, নাকি গেছো ব্যাঙ? নিশ্চিতই ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’। ভদ্র ঘরের মেয়ে এমন হতেই পারে না। আর ইদানিং তাকে শুনিয়ে শুনিয়েও অনেক লোক উচ্চকণ্ঠে বলে, ‘শি...ডি...’।
কিন্তু কী এই ‘শি...ডি...’তা নিরুপমা ভালো করেই জানে। সে জানতো হিন্দুদের মুসলিম পরিবারে ‘ডেডাইয়া বা ডেডু’ বলে গাল দেয় বা মস্করা করে। কিন্তু এই ‘শি...ডি...’ বলে কাউকে আক্রমণ করা যায়, এ তার জানা ছিলো না। যাদের সঙ্গে একেবারেই মিশে গেলো সে, তারাই তাকে এই ‘শি...ডি...’ বলে গাল দিয়ে মজা করছে!
এই এই ‘শি...ডি...’ কথাটিই তাকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে। ‘মনে হয় এ মেয়ে সিডিউল কাস্টের মেয়ে।’ হায়! এ কথা এখন তার কানে প্রতি মুহূর্তেই প্রতিধ্বনিত হয়। অনেক উৎসবে, পূজার অনুষ্ঠানে, বনভোজনে, জন্মদিনে, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রসংগীত গাইতো নিরুপমা। এখন আর চর্চাও করে না। সুযোগও নেই। আক্ষেপও নেই। কিন্তু এখন আক্ষেপ বাড়ে ঐ কথাটি শুনে, ‘নাকি মেয়েটা কোনো সিডিউল কাস্টের মেয়ে।’ অথবা এই ‘শি...ডি...’। অথচ নিরুপমা আগে শুনেছে ইসলাম ধর্ম জাতিবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের হিসেব করে। কিন্তু রোস্তমের ফুপুও সেদিন নিরুপমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই রোস্তমের মাকে বলেছে, দেখেন গিয়ে ভাবী, আপনার ছেলে সুন্দরী দেখে আবার কোনো ধোপা-নাপিতের মেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে কী না। মুখে শুধু খই ফুটে। চলার যা ঢঙ, লক্ষণ তো...।’
এই কথাটি শুনে নিরুপমার হাত থেকে চিরুনি খসে পড়েছিল। বুকের ভিতরটা হয়েছিলো ধু-ধু বালুচর। সেই থেকেই এই শ্বশুরবাড়িতে নিরুপমার মনের অসুখ বাড়ে। তার শরীরের রক্তে সৃষ্টি পেটের সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? আত্মদহনে জ্বলে পুড়ে যায় সে। সুখ থাকলে পিঁড়িতেও সুখ, সুখ না থাকলে অলঙ্কৃত সিংহাসনে বসেও থাকে না। শুধু এই বাড়িতে একটি লোকই তাকে ভীষণ ¯েœহ করেন। তিনি রোস্তমের বাবা। নিরুপমাকে একদিন বলেনও তার কারণ। বলেন, ‘‘ইন্ডিয়া ভাগের আগে আমাদের পরিবার এক হিন্দু পরিবার দ্বারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কী ভয়ানক ছিলো সেই পরিবারের লোকজন। নিষ্ঠুরতা কাকে বলে। তারপর পাকিস্তান আমলে আমাদের পরিবারও কম করেনি। কেউ কেউ তো সেই অত্যাচারী পরিবারের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে রাতের বেলা মলমূত্রও ত্যাগ করেছে। অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ওই পরিবার ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। অথচ আমারই সন্তান কী না এক হিন্দু মেয়েকেই বিয়ে করলো! কে ভাবতে পেরেছে তা আগে? কিন্তু তোমাকে দেখে আমার হিন্দু মনে হয়নি মা। মনে হয়েছে কোনো এক মানবসন্তান তুমি। তুমি কেনো আমাদের পরিবারের অনেকের সঙ্গে লড়তে যাও বা তাদের সংশোধন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করো? তারা কি তোমার মুখের রঙটা দেখে? তারা কি তোমার দুঃখের খোঁজ নেয়। তারা মনে করে তুমি একজন হিন্দু যুবতী, যে কী না ভালোবাসার টানে এখন ‘নামকাওয়াস্তে মুসলমান’ মাত্র হয়েছে। তোমার যে ‘আরবী’ শিখতে আসলেই মন চায় না, এটা তো যে কোনো মুসলিম ছেলেমেয়েরও হতে পারে। কিন্তু তুমি যেহেতু হিন্দুর ঘর ছেড়ে এসেছো, এক্ষেত্রে তোমার অনীহাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়।’’ শ্বশুর তাকে এটুকু বুঝেছেন জেনে নিরুপমার অশান্ত মন প্রশান্ত হয়। বলে, বাবা আমি ভালো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারি। ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছি। এটার জন্য আমি অনেকবারই পুরষ্কৃত হয়েছি। কিন্তু আপনাদের পরিবারে কেউ তা জানলোও না। এমনকি আমি বলাতেও সেদিন সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো। মাকে বললো কি, ‘‘তোমার গায়েন পুত্রবধূকে রেডিওতে পাঠিয়ে দাও’। আর এ কথা শুনে মা পর্যন্ত হাসতে লাগলেন! রোস্তমের বাবা বলেন, তুমি এমন এক ঘরে এসেছো মা, আমরা তো গান-বাজনা একেবারেই করি না। গান-বাজনা আমাদের ধর্মেরও অনেকে করে থাকেন। কিন্তু আমাদের পরিবারে তা প্রায় নিষিদ্ধই। তাই তোমার ওই প্রতিভার এখানে কোনো মূল্যই পাবে না। কিন্তু আমার কথা হলো, তুমি তো মনে করেছো যে, শুধু ধর্ম বদল হচ্ছে। ধর্ম বদল তো ধর্ম বদল নয় মা, এতো কালচারেরও পরিবর্তন। এতো ছোট্ট বয়সে তোমার মাথায় এ কথা কিভাবে ঢুকবে? কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, আমার ছেলে তোমার শুধু রূপ দেখেই মুগ্ধ হয়েছে। না সে তোমার ধর্ম নেবে, না তোমার কালচার। আমরা কেউই তা নিতে পারবো না। কারণ আমাদেরও তো নিজস্ব সমাজ বা কালচার রয়েছে। আমরা তো আর বিসর্জন দেওয়ার অবস্থায় নেই। এসব তো মা এখন বাধ্য হয়েই বিসর্জন দেবে তুমি। নিরুপমা বলে, ‘বাবা আমি তো সব বিসর্জন দিয়েই এসেছি।’ রোস্তমের বাবা বলেন, ‘বিসর্জন এতো সহজ নয় মা। তুমি যে তোমার বাবা-মাকে ফেলে এসেছো, সেটা কি বিসর্জন? তোমাদের দুর্গা দেবীর মূর্তি বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফেরার সময় কিন্তু দুর্গাকে আবার তোমরা বুকে নিয়েই ঘরে ফিরে আসো। সুতরাং বিসর্জন এতো সহজ নয়। অন্তত এটা আমি জানি। তাই যদি পারো, তাহলে আমার ছেলেটাকে একটু বদলাও।’ কিন্তু এই মানবিক চেতনার একমাত্র শ্বশুরকে বা তার মতো গোটা কয়েকজনকে নিয়েই কি এ সমাজে টিকে থাকা যায়? তাই নির্মাণের আগেই নিরুপমার সংসারে আগুন বাড়তে থাকে। বাবা-মায়ের সংসারেও আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। রোস্তম ইদানীং অনুভব করে, শ্বশুরবাড়িতে না যেতে পারারও একটি যন্ত্রণা আছে। ঈদে-উৎসবে বন্ধুরা যখন শ্বশুরবাড়িতে যায়, তখন তার মায়ের কাছে ‘কী বিয়া করলিরে পুত, কোনোদিনও শ্বশুরবাড়িতে যেতে পারবি না’ এরকম নানা প্রশ্ন রোস্তমকে শুনতে হয়। রোস্তমের তখন কোনো উত্তরই থাকে না। শ্বশুর মনে কষ্ট পাবেন মনে করে নিরুপমা কেবল নিরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলে। কোনো প্রতিবাদ করে না। মরে গেলেও প্রতিবাদ করবে না বলেও ভাবে। কখনো ভাবে যে, এ ক্ষতি তো আর পূরণ হওয়ারও নয়।
শ্বশুরের কথাগুলো প্রায়ই কানে বাজে নিরুপমার। ধর্ম যে ছেড়েছে নিরুপমা, কতোটা ছেড়েছে, পেরেছি কি? যখন শরৎকাল আসে, সে এখনও কেমন যেন আকুল হয়ে উঠে। কেন? সে কি শিশিরের প্রতি ভালো লাগা, নাকি তার উমার প্রতি আবেগ? কাশফুল দেখলেই তার বকুলের কথা মনে পড়ে। বকুল দেব তার ছোট বোন। এখন চিরতরেই ভারতে চলে গেছে। এই ছোট্ট বোনটিকে না দেখে একদিনও তার কাটতো না কোনোদিনও। হায়! এ জীবনে বকুলের সঙ্গে আর কোনোদিনও দেখা হবে না নিরুপমার। সেটা যেন একেবারে পরপারে যাওয়ার মতোই ঘটনা। কোনো এক বান্ধবীর কাছে শুনেছে নিরুপমা ওরফে বর্তমান ‘সুলতানা’ যে, ভারতে যাওয়ার সময় তাদের পারিবারিক শ্মশানের কাছে গিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন একটি প্রখ্যাত স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার পিতা অনিল দেব। কেন তারা ইন্ডিয়ায় চলে গেলেন? এ কথা যদি ধারনাও করতে পারতো নিরুপমা, তাহলে সে কখনোই মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতো না, ভালোবেসে ফেললেও। সে এতোটা করুণ পরিণতি হবে জানলে নিজের প্রেম-ভালোবাসাকেই বিসর্জন দিতো। সে তো মনে করেছিলো এক সময় সবকিছু স্বাভাবিকই হয়ে যাবে। কিন্তু শেষে হলো কী! এমন জানলে কষ্টটা তার নিজের বুকেই না হয় চেপে রেখে দিতো। তার ধারনা ছিল যেহেতু সে তার পিতার বড় আদরের মেয়ে, কিছুদিন পরই বাবা তাকে বুকে টেনে নেবে। বাবা যে এই ঘটনার পর এতোটাই নিষ্ঠুর হয়ে যাবেন, সারাজীবনের নিষ্ঠুরতা একই সঙ্গে দেখাবেন, চিরতরেই পর করে দেবেন, এটা তার ভাবনায় কোনোদিনও আসেনি আগে। অসাম্প্রদায়িকতার বাণী শেখানো বাবার কাছে তার ধর্মটুকু সন্তানের মায়ার চেয়েও প্রিয় হয়ে গেলো?
নিরুপমার স্বামী রোস্তম পাশের গ্রামের গঞ্জেই দোকান দিয়েছে। তৈরি পোশাকের দোকান। বি.এ পাস করে সে চাকুরি করবে, তার বাবা-মা আগে এটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন চাকুরি তার ভালো লাগে না। তাই এখন ব্যবসা নিয়েই এতো ব্যস্ত। এখন তার বাজারের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের দোকান করার চিন্তা। কিন্তু পুঁজির সঙ্কট। হিন্দু মেয়ে বিয়ে না করলে না চাইলেও শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুটা সাহায্য পাওয়া যেতো। এখন সে পথও বন্ধ। মেয়েটা তো জানতো, এমনটা হতেই পারে। অনেক হিন্দু মেয়ে পালানোর সময় তাই সেই ভবিষ্যতের চিন্তা করে বাবার বাড়ির সোনাগয়না নিয়েই পালায়। অথচ নিরুপমা তার ছোটবোন বকুল দেব এর কথা চিন্তা করে এমনটি করেনি। তাছাড়া রোস্তমও তখন বলেছে, আমার ধনসম্পদ কিছুরই দরকার নেই। আমার দরকার তোমাকে। তখন রোস্তম ছিল ছাত্র। আর এখন ব্যবসায়ী। তাই চিন্তাতেও ব্যবসা ঢুকে গেছে। যদিও সে এ বিষয়ে নিরুপমাকে কোনো মানসিক যাতনা দেয় না। কিন্তু যখন শুনলো, নিরুপমার বাবা-মা জমিজিরেত ও ভিটেবাড়ি সব বিক্রি করে তার মামার কাছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহে চলে গেছে, তখন ভাবলো, জমিজিরেত-বসতবাড়িতে কি নিরুপমার অংশও ছিলো না? ধর্ম ত্যাগ করলো বলেই তাকে তার পাওনা থেকেও বঞ্চিত করা হলো? যাক, এ নিয়ে আর ভাবেনা রোস্তম এখন। কিন্তু বুড়োটা এমন প্রতারণা করেছে বলেই কারণে-অকারণে রাত-দিন রোস্তমের অনেক গাল খায়। ঠিক তখনই আর সহ্য করতে পারে না নিরুপমা। ফলে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়াও বাঁধে। সেদিন তো দুজনের এ নিয়ে খুব মারামারিও হয়েছে। এমন করেই চলতে থাকে নিরুপমার ওরফে সুলতানার সংসার। এটাও সহ্য হয় তার। কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়, যখন সে কারো মুখে শুনে, ‘শি...ডি...’। সে নাকি ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’। তাও যদি সে হতো সে রকম কাস্টের কোনো মেয়ে, তাহলেও না হয় কথা ছিলো। কিন্তু সে তো তা নয়। তার তো নিজস্ব বংশগৌরব রয়েছে। আহারে এই দুর্দিনে কে কাকে কেনো বলবে সেই কথা? তাই নিরুপমা আর কারোর সঙ্গেই তেমন মেশে না। আর এতে করে এই ‘শি...ডি...’ কথাটি আরও বেশি প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকে।
নিরুপমাদের বাড়ির কাছে ছিলো এক দিঘি। গগনবেড় দিঘি। আজকাল প্রায়ই তার এ দিঘিটাকে দেখে আসতে খুব মন চায়। দিঘির চারকিনারে খুন্তে বক আর কোঁচবকগুলো সারাদিন বসে থাকতো। সারাটা দিঘিতে উড়ে বেড়াতো, ঘুরে বেড়াতো পানকৌড়ির দল, ডুবুরি হাঁস, বালিহাঁস আর যতীন্দ্রবাবুর পোষা রাজহাঁসগুলো। যতীন্দ্রবাবু নিরুপমার বাবার পিসাতো ভাই। তার বাড়িতে এই পোষা রাজহাঁসগুলোর ঠোকর খাওয়ার ভয়ে অন্য বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা সহজে ঢুকতে চাইতো না। হ্যাঁ, যতীন্দ্র বাবুর বৈঠকখানার পাশেই ছিলো দুইটি বিশাল অশোক গাছ। গাছের চেয়ে সেসব গাছের ছায়াই প্রিয় ছিলো নিরুপমার। এখনও রাতে ঘুম না এলে কিংবা ঘুম ভেঙ্গে গেলে নিরুপমা তার বিছানার শুয়েই যতীন্দ্রবাবুর মানে যতীন্দ্র জ্যাঠুর অশোকফুলের মিষ্টি গন্ধ পায়। তখন তার চোখ ভিজে যায় জলে। গগনবেড় দিঘির দক্ষিণপাড়ের দ্বিজেনবাবুর বাড়িটা ছিলো জারুল ফুলে ছাওয়া। আহারে জারুলের থোকা থোকা নীল ফুলগুলো এই হাতে সে আর ছিঁড়তে পারবে না। আর ঐ গগনবেড় দিঘির শানবাধাঁনো ঘাটের কোনায় দ্বিজেনবাবুর রক্তকাঞ্চন গাছটা। পাখি দেখতে চাইলে, বিশেষ করে ছোট ছোট অনেক পাখি দেখতে চাইলে দ্বিজেনকাকুর রক্তকাঞ্চন গাছের কাছে যাওয়া চাই। মনপ্রাণ ভরে যাবে। রাজঘুঘু, চন্দনা, কখনো বা কোকিল এবং টিয়া এসে হাজির হতো এ রক্তকাঞ্চন গাছে। দ্বিজেনের ঠাকুরমা এবং ঠানদিরা রক্তকাঞ্চন ফুল কুড়িয়ে নিতো পূজাঅর্চনার কাজে। ছাত্রজীবন থেকেই স্বামী রোস্তমকে অনেকটা জেনেছে নিরুপমা। কিন্তু সেটা কতোটা? কারণ এখন রোস্তম যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণই মনমরা। কেন? নিরুপমার ব্যর্থতা কোথায়? এমন বিষন্নতা তার কখনো দেখেনি নিরুপমা। চাঁদে গেলেই আগ্নেয়গিরির বিষন্নতা চোখে পড়ে। অনেক অনেক দূর থেকে শকুনকেও বাবুই পাখির মতো ছোট বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কাছাকাছি এলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। নিরুপমার কিছু সমস্যা তো রয়েছেই। বিশেষ করে সে যে একটি বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে, তা সে প্রায়ই ভুলে বসে থাকে। তারপর আবার ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিমবাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। স্বামীর ঘরে মাংস-পোলাও-কোর্মা- দধি তার বিশেষ চাহিদার বিষয় নয়, তার চাহিদার গুরুত্ব পায় একটি পাখি যখন পুকুরের কোণায় বাসা বানায় বিভিন্ন লতাপাতা এনে, সেটি। অথবা কোনো পাখি যখন পুকুরের পানিতে হেলে পড়া বাঁশে বসে খপ করে ব্যাঙ কিংবা মাছ ধরে ফেলে, সে বিষয়টি। কিছু পাখি শামুক খায় কিংবা কাঁকড়া, তা তার কাছে দেখার বিষয়। বয়সতো একেবারে কম নয়। বাইশ- তেইশ তো হবেই। তারপরও এমন মেয়েলীপনা বড়ই বিরক্তিকর। এমন মেয়েকে সংসারী করা খুব সহজ কাজ নয়। নিরুপমা একদিন স্বামী রোস্তমকে বলে, তোমাদের পুকুরটায় অনেক পাখি রয়েছে। কিন্তু এতে যদি লাল-নীল-শ্বেতপদ্ম থাকতো, কী দারুণ হতো না? আচ্ছা, আমাদের থাকার ঘরের সামনে দিয়ে কয়েকটি বেলিফুলের চারা লাগানো যায় না? সাদা সাদা বেলিফুলের কী সুমিষ্ট ঘ্রাণ! তোমাদের সারাবাড়িতে তো একটাও রক্তজবার গাছ নেই। জবা ফুটলে বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ে। রোস্তম বলে, যেখানে তুমি বেলী ফুলের চারা লাগানোর কথা ভাবছো, ওখানে মা কামরাঙা মরিচের চারা লাগাবে। আগে এখানে একটি লেবু গাছ ছিলো, মরে গেছে। আর রক্তজবা, স্বর্ণচাঁপা ইত্যাদি ফুলের গন্ধ পেলে বাড়িতে রাতে পরী নামবে। সুতরাং এ পরিকল্পনায় মন দিয়ো না। কল্পনা থাক, পরি বাদ দিয়ে পরীদের আসা ঠেকাও। রোস্তমের মুখে পরীর গল্প শুনে নিরুপমা সারাবাড়ি কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসে। রোস্তমের বাবা মেয়ের চড়া গলা শুনে রাগ করেন। ডেকে বলেন, মা, রাগ করো না। আমাদের ধর্মে, আমাদের সমাজে মেয়েদের এমন উচ্চস্বরে হাসতে নেই। ধীরে ধীরে এই বিষয়টিও তোমাকে শিখতে হবে, জানতে হবে। আমি এটা বলেছি বলে মনে কষ্ট নিয়ো না। আরেকজন তোমাকে বাজেভাবেই শেখাবে। কথাটা শুনে নিরুপমার কষ্টের মধ্যে আরও কষ্ট জমা হয়। মাথায় ঘোমটা আরও টেনে দিয়ে সহ্য শক্তির পরীক্ষায় মগ্ন থাকে। রোস্তম ধীরে ধীরে বউয়ের কানের কাছে গিয়ে বলে, চলাফেরাটা ঠিক করো তুমি। তোমার কারণে আমার বাবা-মা প্রতিবেশীদের অনেক কথাই শুনে। তোমার বাড়ি এখান থেকে অনেক অনেক দূরে। তোমার পরিবার কী উচ্চবংশীয় না নি¤œবংশীয়, সেটা কি তারা বুঝে? তাছাড়া তুমি হিন্দুর ঘরের মেয়ে। একটু উগ্রতা দেখালেই তারা মনে করবে তুমি হয়তো কোনো নিচুজাতের মেয়ে। সুতরাং একটু সংসারী হতে চেষ্টা করো লক্ষীটি। দেখছো না, সিডিউল কাস্টের মেয়ে বা ‘শি...ডি...’ বলে কেমন তোমার অপপ্রচার শুরু হয়েছে। তুমি সবার সঙ্গে মিশে যাও, দেখবে সবার মুখেই তালা পড়েছে। কোন কুত্তার বাচ্চা যে কথাটা প্রথম চালু করেছে...। রোস্তমের মুখে ‘শি...ডি...’ কথাটা শুনে নিরুপমার মাথায় রক্ত উঠে। কী, আমি ‘শি...ডি...’? সিডিউল কাস্টের মেয়ে? কে বলে? আমি তার গলা ছিঁড়ে ফেলবো। জিহ্বা কেটে ফেলবো। যেখানে আমি ধর্মই ছেড়ে দিলাম, সেখানে কেন আবার আমার কাস্ট নিয়ে এতো কথা? রোস্তম বলে, আরে চুপ করো সুলতানা নিরুপমা, প্লিজ। এ কথা তো আমি কিংবা আমার বাবা মা তোমাকে বলেনি। লোকে বলছে। ওতে তুমি কান দেবে কেন? নিরুপমা বলে, প্রতিবাদ করতে পারো না তুমি? রোস্তম বলে, প্রতিবাদ? ওসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কেলেঙ্কারী আরও বাড়বে। যতোই তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো না কেন, পথ দিয়ে চলার সময় লোকে আমাকেও ডেকে বলে, কী রোস্তম, তুমি নাকি হিন্দু মেয়ে বিয়ে করছো? নিরুপমা বলে, তখন তুমি তাদের কী জবাব দাও? রোস্তম বলে, আমি তখন বলি, হিন্দু মেয়েকে তো বিয়ে করিনি। তাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছি। হিন্দু বিয়ে করলাম কোথায়? রোস্তমের মুখে এমন দুর্বল উত্তর প্রদানের কথা ভাবতেও পারে না নিরুপমা। নিজেকে তখন তার আর রোস্তমের প্রেমিকা মনে হয় না। মনে হয় সে বুঝি তাদের বাড়ির পোষা ব্যথিত কুকুর। স্বামীর বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে কতো কিছুই না ভাবে সে। ভাবে নাগকেশর, জুঁই, চামেলির চারা লাগিয়ে বাড়িটাকে বাগান করে দেবে। কিন্তু সবাই বলে, ওসব তোমার কাজ নয়। তোমার কাজ সংসারের কাজ করা এবং পেটের বাচ্চার খেয়ালখবর রাখা। রোস্তম বাজারে যাওয়ার সময় কাগজের এক পোটলা কিসমিস নিরুপমার হাতে দিয়ে যায়। বলে, ধুয়ে খেয়ে নিয়ো। পেটের বাবু কিসমিস পছন্দ করবে। কিন্তু রোস্তম যেতে না যেতেই নিরুপমা পোটলার সব কিসমিস রাগে- দুঃখে পোষা কুকুরটাকে দিয়ে দেয়। ইচ্ছে হয় তার নিজের ধুতুরার বিষ মুখে দিয়ে দেয়। কিন্তু পেটের সন্তান তাকে এতোটা নিষ্ঠুর হতে দেয় না। কষ্টে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে। রোস্তমের মা দেখে ফেলেন। বলেন, কী হয়েছে বৌমা। কাঁদছো কেন? কাঁদছি না মা। গোলমরিচ মুখে দিয়েছিলাম। নিরুপমার উত্তর। কেন গোলমরিচ খেতে গেলে? পেটের বাচ্চা ক্ষতি হবে যে। এ কথা বলেই শ্বাশুড়ি নিরুপমাকে একটি আপেল এনে দেয় খেতে। এখন এই বাড়িতে সবার কাছে নিরুপমা বা সুলতানার চেয়ে তার পেটের বাচ্চার আদরই বেড়ে গেছে। এদিকে তবু শ্বাশুড়ির একটু আদর পেয়েই নিরুপমা বলে, মা আমাদের একটি টিয়ে পাখি পোষলে হয় না? শহরে খাঁচাসহ কিনতে পাওয়া যায়। নিরুপমার শ্বাশুড়ি বলে, সুলতানা মা, তোমার বয়স খুব কম। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলো না, যার কোনো প্রয়োজন নেই। দুইটা-তিনটা মুরগী দেখে রাখতে পারো না, তুমি পোষবে টিয়া? টিয়া পাখির ডিম খাওয়া যাবে? না তার মাংস খাওয়া যাবে? ডেকে বিপদ এনো না। নিরুপমা বলে, মা, টিয়ে পাখি পোষার অভিজ্ঞতা আমার আছে। আপনার ছেলেকে একটি পাখি এনে দিতে বলেন না মা। শ্বাশুড়ি আর কথা বলেন না। নিরুপমার কাছ থেকে অন্য কাজে চলে যান। রোস্তমের পিতা চলে যান বাড়ির কাছের জমিটার একটুখানি ভাঙ্গা আঁল কাজের লোক দিয়ে বাঁধাতে। রোস্তমের মা পাখির হাত থেকে পাকা ধান রক্ষা করতে কয়েকটি কাকতাড়–য়া বানানোর কাজে মন দেন। আর নিরুপমা? বসে বসে কুমড়োপোকার বাসা বানানো দেখে এবং কিছুক্ষণ পর একটি গঙ্গাফড়িং ধরতে তার পিছু পিছু ধানের জমিন পর্যন্ত চলে যায়। কর্দমাক্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসে ওদিকে শ্বশুরের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পর। নিরুপমার গর্ভে যে সন্তান আসে, তা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। ঠিক এ সময়ে তার মা শর্বরী দেবকে খুব মনে পড়ে তার। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে শর্বরী দেব কতো কষ্ট করেছেন, এখন সে তা ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারে। কিন্তু এখন আর তার মাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ নেই। মায়ের খোঁজ জানতে পারেন অনিমেষ মামা। মামা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কোনো এক ফাঁড়িতে বি এস এফে-র চাকুরি করেন। রোস্তম প্রায়ই মজা করে বলে, তোমার মামা তো বর্বরের চাকুরি করেন, চান্স পেলেই বাংলাদেশীদের গুলি করে দেন। নিরুপমা কিছুই বলে না। ভাবে, এসব নিয়ে অহেতুক তর্ক করে কী লাভ? নিরুপমাকে কয়েকবারই ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার মনের ভয় আর কাটে না। অন্যদিকে পেটের সন্তানের জন্য ঝাঁড়ফুক ও তেলপানি পড়াও অবিরাম চলে। তবু তার মনে ভয়। শ্বাশুড়িকে বলে, মা, কোনো মূর্খ ধাইয়ের হাতে যেন আমার সন্তানের প্রসব করানো না হয়। আমি মেয়ে মানুষ। আমার কথা কেউ গুরুত্ব নাও দিতে পারেন। আপনি মা, আপনার কথা সবাই শুনবে। আপনি আমাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। মূর্খ ধাইয়ের হাতে একদা রোস্তমেরও জন্ম হয়। তখন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছিলেন রোস্তমের মা। রোস্তমেরও বাঁচার আশাই ছিলো না। ধীরে ধীরে সুস্থ হয় ওরা। রোস্তমকে দেখে অভিভূত হয় রোস্তমের দাদা। রোস্তমের বাবা কাশেমের সংসারে স্থায়ী হওয়ার লাইসেন্স পান রোস্তমের মা। সে অনেকদিন আগের কথা। তাই তিনি সুলতানার কথায় রাগ না করে বলেন, মা আমি থাকতে তোমার এতো ভয় কিসের? তোমার মা কাছে নেই, তুমি তো আমারই ছেলের বউ। শ্বাশড়ির ¯েœহ পেয়ে কেঁদে দেয় নিরুপমা। বলে, মা, ডাক্তার বলেছে আমার মেয়ে হবে। যদি মেয়েই হয়, তাহলে তার নাম রাখবেন ‘বকুল’। আমার ছোটবোন বকুলকে আমি খুবই ভালোবাসতাম। আর যদি আমি সন্তান জন্মের সময় মরেই যাই, তাহলে আপনার বাড়িতে একটি বকুলগাছ লাগাবেন। আমার মেয়ে মায়ের খোঁজ করলে বলবেন, এই বৃক্ষই তোর মা। বকুল গাছের তলের ছায়ায় বসে প্রাণ জুড়াবে তার। ছেলে হলে নাম রাখবেন পলাশ কিংবা কাঞ্চন। আমার দ্বিজেন কাকুর রক্তকাঞ্চন গাছটা আমার খুবই প্রিয় ছিলো। মনে হয় এ জীবনে সে গাছ আমি আর দেখবো না মা। আরেকটি কথা, আমার মেয়েকে যেন কেউ কোনোদিন ‘শি...ডি...’ বা ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’ না বলে। আমি কোনো ‘সিডিউল কাস্টের মেয়ে’ নই। আমার কোনো ‘কাস্ট’ নেই মা। আমি একজন মানুষ এবং আপনার মতোই একজন নারী। এ পর্যন্ত বলেই কাঁদতে থাকে নিরুপমা। আর কথা বলতে পারে না। নিরুপমার শ্বাশুড়ি বলে, তুমি মানুষের কথায় কান দিয়ো না সুলতানা। মানুষের মুখে তো আর তালা দিতে পারি না। নিরুপমা বলে, সেদিন ফুপু বলেছেন, মেয়েটা তো সুন্দরীই। কিন্তু শুকনা এবং রসকষহীন। মা, আমার কারণে আমার পুরো পরিবার আজ দেশছাড়া। রসকষ আমি কোথায় পাবো বলেন। নিরুপমার শ্বাশুড়ি বলেন, উনি একটু বেশি কথাই বলেন, ওতে তুমি কান দিয়ো না। বয়সে আমার অনেক বড়। কিছু কি বলা যায়? নিরুপমা বলে, আপনাদের কাছে আমার শরীরটা পড়ে আছে মা। কিন্তু প্রাণটা সারাক্ষণ মায়ের কাছেই। আমার বাবা-মা নিরামিষভোজী। দেখেন না আমারও মাছ খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা বিঁধে।
সেদিনই রোস্তম রাতের বেলা বাজার থেকে ফিরে নিরুপমার হাতে বাজারে আসা কতগুলো নতুন দশ টাকার নোট দেয়। নোটে বাংলাদেশের কোনো একটি মসজিদের ছবি। নিরুপমা রোস্তমকে প্রশ্ন করে, অনেক নোটেই অনেক মসজিদের ছবি দেখেছি। কিন্তু কোনো নোটে মন্দিরের ছবি নেই কেন? রোস্তম এ কথার উত্তর দেয় না। বরং এ রকম প্রশ্ন শুনে কিছুটা রাগও করে। তাই চুপ থাকে। নিরুপমাও বুঝতে পারে। হঠাৎ সে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে, আমরা কিছু পায়রা পোষতে পারি না রোস্তম? পায়রা তো খাওয়া যায়। সারাদিন দোকানের খাটাখাটানির পর এসব কথা সহ্য হয় না রোস্তমের। তবু সহ্য করে চুপ থাকে। মনে মনে ভাবে, হায়! এই মেয়েটারে আল্লাহ আর বুদ্ধিসুদ্ধি কোনোদিনও দেবে না। রোস্তম বলে, নামাজ পড়েছো? নিরুপমার সরল উত্তর, না। শরীরটা ভালো লাগছে না। রোস্তম বলে, নামাজ হলো আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। এতে মনেরও প্রশান্তি বাড়ে। নিরুপমার মন তখন আকাশ ছোঁয়। বলে, একটি তারার নাম নাকি রেবতী। সেটা কোনটা তুমি কি তা জানো? রোস্তমের শরীর খুবই ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে এসে নিরুপমার হাত থেকে গামছা নিয়ে মুখ মুছে। নিরুপমার অসংলগ্ন কথা বলার মাত্রা আরও বাড়ে। বলে, আমি আজ চাঁদ ওঠা দেখবো, মধ্যরাতে। তুমি দেখবে? রোস্তম নিরুত্তর। নিরুপমা বলে, রোস্তম, তোমাদের বাড়ির পশ্চিমের ইটাখোলার ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। ভাটাটা এখান থেকে সরানো যায় না? চিমনি থেকে যেভাবে ধোঁয়া উঠে, মনে হয় শ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া ভিতরে ঢুকে আমার ফুসফুসটা কালো হয়ে গেছে। রোস্তমের রাগ বাড়ে। ইচ্ছে হয় সুলতানা নিরুপমাকে একটি কষে থাপ্পড় দেয়। কিন্তু কথা দিয়েও থাপ্পড় দেওয়া যায়। তাই রোস্তম বলে, তুমি কি কখনো কচ্ছপের মাংস খেয়েছো? নিরুপমার সহজ সরল উত্তর, না। নিরুপমা বলে, জানো ছোটবেলায় আমি অনেক কালা বাউস মাছ ধরতে পেরেছিলাম। রোস্তম বলে, ইলিশ মাছ ধরোনি কখনো? নিরুপমা বলে, না, আমি একবার একটি ঢোঁড়াসাপকে পিটিয়ে মেরেছিলাম। সাপটি কিন্তু অনেক বড়ই ছিলো। এ কথা শুনে রোস্তম হেসে দেয়। বলে, কাঁকড়া মারোনি? নিরুপমা বলে, না। তবে একবার কাঁকড়ার কামড় খেয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে একটি শাখানদীর বাঁক আছে। কৃষ্ণমতী নদী। ওখানে বিলঝিলও আছে। আর আছে নানারঙের পাখি। ওখানে যাওয়ার সময় পথে পথে পাখির রঙিন পালক পাওয়া যায়। ওখানে অনেক বুনোপায়রাও আছে। মুনিয়া পাখিরা শরৎকালে বাসা বানাতে কাশফুল ছিঁড়ে নেয়। বালিহাঁস, পানকৌড়ি চোরকাঁটা-উলুখাগড়ার বনে ঘুরে। কিছু পাখি কচি ঘাসও খায়। রোস্তম বলে, ওখানে কচ্ছপ আছে? নিরুপমা বলে, কাঠশোলা, ফুলশোলা, হোগলা, কচুরিপানার ভিতর, বনতুলসীর ঝোপঝাড়ে, কাশবনে-ঘাসবনে বনবিহারী পাখি থাকে। ডাকেও বিভিন্ন শব্দে। এলাকার লোকজন মাঝে মাঝে খরগোসের বাচ্চা ধরে আনে, কেউবা কচ্ছপও। পাখির বাসা সবচেয়ে বেশি শেওড়াগাছগুলোতেই। ওখানে আবার সাপের ভয়ও আছে। রোস্তম বলে, শুধু কি পাখির গল্পই করবে? ভাত খাওয়াবে না? রোস্তমকে ভাত খাওয়ানোর আয়োজন করে নিরুপমা। কিন্তু মুখ চলতেই থাকে। তোমাদের পুকুরের জলও পরিষ্কার। কিন্তু আমাদের গগনবেড় দিঘির জলের মতো টলটলে নয়। আমি শুনেছি সেই দিঘিতে এক জলপরীও থাকে। রাতে সে গগনবেড় দিঘি থেকে কৃষ্ণমতী নদীতে গিয়ে পড়ে। এভাবে সে কথা বলতেই থাকে এবং এক সময় কথা বলা শেষ না হতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রোস্তম দৌড়ে এসে ধরে। দেখে তার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। শরীরেও তখন উচ্চ রক্তচাপ। রোস্তম তার মাকে ডাকে। মা ও ছেলে মিলে নিরুপমাকে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়। অজ্ঞান অবস্থাতেই সে তখন খিঁচুনি দিতে থাকে। কাঁপনিও দেখা দেয়। অবসন্ন নিরুপমাকে দেখে ভয়ে রোস্তমের হৃৎকম্প বাড়ে। দৌড়ে চলে যায় ডাক্তার বাড়ির দিকে।
ঘড়ি ংঃধৎঃরহম ভৎড়স ঃযব ভঁঃঁৎব:
রোস্তমের মৃত্যুর পর নিরুপমার মেয়ে ‘বকুল’ একজন হিন্দু যুবককে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সংসার জীবনে তাকেও ‘শি...ডি...’ গাল শুনতে হয়েছিলো

৮৭| ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:০৮

জসীম অসীম বলেছেন: মেলিটারীভাবী:
জসীম উদ্দিন অসীম:
চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ আজ তার শিশু কন্যাকে নিয়ে অন্যঘরে শুয়েছে। শ্বশুর আজ বাড়ি ফিরবেন না এবং এরই মধ্যে শ্বাশুড়ির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ শেফালির। শেফালি অবশ্য এই ঘরেই থাকে, যখন তার স্বামী ইব্রাহিম বাড়িতে থাকে। ইব্রাহিম সেনাবাহিনীর চাকুরি করেন এবং এখন আছেন বান্দরবানে। ছোটবেলা থেকেই ইব্রাহিম ছিলেন দুঃসাহসি। পরে এই দুঃসাহসি পেশা বেছে নিয়েছেন নিজেই। এখন তার চেয়েও দুঃসাহসি কাজ করছেন যেন বিয়ে- সংসার করেই। কারণ মা আর বউয়ের রেষারেষিতে চাকুরি করাই কঠিন। ইব্রাহিম বউ-বাচ্চাকে সঙ্গে রাখতে পারছেন না কিংবা চাচ্ছেন না। অন্যদিকে তার মায়ের প্রায় কোনো নির্দেশই মানতে চায় না তার স্ত্রী শেফালি। তাই মাসে মাসে টাকা পাঠালেও বাড়িতে বউ- শ্বাশুড়ির যুদ্ধ ঠিক লেগেই থাকে। শেফালি ও তার শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম দিনের শুরুতে ঝগড়া শুরু করেছিল শেফালিদের গ্রাম রূপাতালির ‘হাইক্কা চোরা’র প্রসঙ্গ ধরে। হাইক্কা চোরা এখন বেঁচে না থাকলেও রূপাতলি ও তার আশপাশের গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখনও তার চুরির বিভিন্ন গল্প শোনা যায়। কালীগঞ্জের ইব্রাহিমের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া প্রশ্ন করে জানতে চান বউমার বাড়ি কোথায়? ইব্রাহিমের মা জবাব দেন, রূপাতলি গ্রামে হাইক্কা চোরার বাড়ির পেছনের বাড়ি। এই হাইক্কা চোরার নামে বাড়ির পরিচয় দেওয়াতেই শেফালি ক্ষেপে যায়। হাইক্কা চোরার ভাতিজা আবদুল মজিদ এখন কছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই মজিদ মাষ্টারের বাড়ির পেছনের বাড়ি বললেই শেফালিদের বাড়িকে চিনে মানুষ। অথচ শ্বাশুড়ি এই হাইক্কা চোরার নাম ধরে পরিচয় দেওয়াতেই দিনের শুরুটা নষ্ট হয়ে গেল। শেফালি বলে, আম্মা আপনি আর কতোদিন হাইক্কা চোরার নাম নিয়া আমারে অপমান করবেন? শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম বলেন, বউ রাগ করো ক্যান? তোমার মজিদ মাষ্টারকে দুই-তিন গ্রামের মানুষও ভালো করে চিনে না। অথচ হাইক্কা চোরার নাম জানে বিশ গ্রামের মানুষ। শেফালি বলে, তাহলে তো মানুষে চেনার জন্য ভালো কাম ছাইড়া চুরি করনেরই দরকার। বউয়ের এমন কথায় দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ার কাছে লজ্জা পান শ্বাশুড়ি। পরে তাকে পুকুর থেকে ধরা মাছ কাটতে বললে শেফালি সেই মাছ আর বটি এক ঘন্টা ফেলে রাখে। পিয়ারা বেগম আবারও বললে শেফালি এবার মাছ কাটে ঠিকই কিন্তু মাছের উচ্ছিষ্ট ফেলে রাখে আরও ঘন্টাখানেক সময়। এ নিয়ে বউ- শ্বাশুড়ির ঝগড়া বেড়েই চলে। কছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে শেফালি। তখনই তার বিয়ে হয় এবং বন্ধ হয়ে লেখাপড়াও। শ্বাশুড়ি প্রায়ই বলেন, মেট্রিকও পাশ না, তারপরেও এমন। বিএÑ এম এ পাশ করলে কী যে করতো মেয়ে। শেফালি জবাব দেয়, আপনার মেট্রিক ফেল ছেলের জন্য কোন দেশ থেকে বিএ, এম এ পাশ করা পাত্রী আনতেন? এমন সব বিষয় নিয়ে বউ-শ্বাশুড়ির দূরত্ব বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে চেয়ারম্যান তার চেয়ারম্যানগিরি ও ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকেন। তাছাড়া তিনি তার পুত্রবধূকে ধমক দিয়ে কোনো কথাও বলতে পারেন না। এ নিয়েও চেয়ারম্যান আর তার স্ত্রীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে ঝগড়া হয়। তবু পুত্রবধূ শেফালিকে কটূ কথা বলা সম্ভব হয় না তার। ইউনিয়নের এত লোকের বিচার করেন, কিন্তু নিজের পুত্রবধূ বেফাঁস অনেক কথা বললেও কষে একটি ধমক দিতে পারেন না। ইব্রাহিম ও শেফালি দম্পতির এক সন্তানের সংসার তারপরও মন্দ চলছিলো না। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো, যখন ইব্রাহিম তার চাকুরি নিয়ে যত ব্যস্ত থাকলো, তার সিকিভাগও সংসারকে সময় দিতে পারলো না। শ্বাশুড়ির অপমানকে শেফালি তেমন গায়ে মাখলো না। কিন্তু ইব্রাহিমকে সে একেবারেই যেন পাচ্ছে না। শিশুকন্যাটি বেড়ে উঠছে একপ্রকার পিতৃ¯েœহ ছাড়াই। ইব্রাহিম বাড়িতে এলেও বউয়ের জন্য কিছু বইপত্র নিয়ে আসেন। স্কুলের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবু যেন বইপত্র পড়ে স্ত্রী পৃথিবীকে জানতে পারে। অথচ বাস্তবে তেমন সময়ই হয় না শেফালির চাকরবাকর বাড়িতে থাকলেও নিজের অনেক কাজ নিজেকেই করতে হয়। কাজ শেষে সারাদিনের ক্লান্তির পর সন্ধ্যা হতেই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। বই পড়বে আর কখন? এলাকায় বিদ্যুৎও নেই। রাত হলেই মনে হয় গহীন রাত। এর মধ্যে একাকীত্ব। ইব্রাহিম একবার এক রাতে শেফালিকে বুঝাচ্ছিলেন হারামি রেডক্লিফ বাংলার কী ক্ষতি করেছিলেন। বুঝানো শেষ হওয়ার আগেই শেফালি ঘুমিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে। বাড়ির সবদিকেই ধানক্ষেত। ওখানে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক ওঠে। শেফালির খবরও নেই। আরেকদিন এমন রাতের বেলা মেজর রফিকের গল্প বলার সময়ও শেফালি ঘুমিয়ে পড়েছে। ইব্রাহিম বুঝতে পারে তার স্ত্রীর খাটাখাটুনি খুব বেশিই হচ্ছে। ইব্রাহিমদের বাড়িতে থেকে ঐ গ্রামেরই একটি কলেজে পড়ে তার মামাতো ভাই মাহিদুল ইসলাম।মাহিদুলের মা নেই। বাবা খুররমও অসুস্থ। বাড়িতে আছেন তার বড় ভাই ও ভাবী। ভাবী জেসমিন তার শ্বশুরের যতেœ সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকেন। এ ক্ষেত্রে ইব্রাহিমের স্ত্রী শেফালিকেই তার উগ্র মনে হয়। মিলিটারীর চাকুরি করেও ইব্রাহিমের অত তেজ নেই, যত তেজ তার শেফালি ভাবীর। প্রতিবেশি অনেক লোকই শেফালিকে তাই মেলিটারী ভাবী’ বলেও ডাকে। গ্রামের লোক মিলিটারীকে বলে মেলিটারী। সেই থেকেই এই নাম। এক সময় পুরো এলাকাতেই শেফালির এ ‘মেলিটারী ভাবী’ নামটি ছড়িয়ে পড়ে। শুনে ইব্রাহিমও হাসেন। বলেন, মিলিটারীর চাকুরি করেও আমি মিলিটারী হতে পারলাম না। তুমি হয়ে গেলে মিলিটারী? শুনে শেফালি হাসে। বলে, ওটা আমি আমার রাগী স্বভাবের জন্য হইনি। হয়েছি মিলিটারীর বউ বলেই। ইব্রাহিমের একমাত্র বোন পাপড়ি পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তাকে তার পড়াশোনার জটিল অংশ বুঝিয়ে দেয় মাহিদুল। মাহিদুলের লেখাপড়া শেষ হলে যদি চাকুরিবাকুরি করে, তখন তার সঙ্গে পাপড়ির বিয়ে দেয়া যায় কী না, এ নিয়েও অনেকে হিসেবনিকেষ করে। একসময় এ কথা চেয়ারম্যানের কানেও যায়। চেয়ারম্যান বলেন, সময় হোক, ভেবে দেখা যাবে। ছেলেটা আগে দাঁড়াক। কিন্তু ছেলে দাঁড়াবে কি? সে তো সেনাবাহিনীর পুণ্যরক্তের সঙ্গেই মনে মনে বেঈমানী করে বসে আছে। তার বড় ভাই সমতুল্য সৈনিক ইব্রাহিমের স্ত্রীর দিকেই চোখ পড়েছে তার। এ কথা স্বয়ং মেলিটারী ভাবী শেফালিও এখনো বুঝতে পারেনি। এরই মধ্যে ইব্রাহিম স্ত্রীর কাছে ব্যস্ততায় চিঠিও লিখছে কম। ইব্রাহিমের শিশুকন্যা নাফিজাকে সঙ্গ দেয়ার নামে ‘মেলিটারী ভাবী’র খুব কাছে চলে যায় মাহিদুল। কখনো তাকে নিজের পয়সায় খেলনা কিনেও দেয়। এটাকে কেউ সন্দেহের চোখেও দেখে না। কিন্তু ইব্রাহিমের ছোটবোন পাপড়ি মাহিদুলকে একটি প্রেমের চিঠি লিখে বসলে মাহিদুলকে অপমানের স্বরে বলে, প্রেমের বয়স হয়েছে তোমার? আগে মন দিয়ে লেখাপড়া করো। মাথা থেকে ভূত তাড়াও। তারপর যা হওয়ার হবে। লজ্জায় খুব কাঁদে। নিজেকেই তার খুব অপরাধী মনে হয়। শিশু নাফিজার প্রতি মাহিদুলের দায়িত্ববোধ দেখে তার প্রতি সবার কৃতজ্ঞতা বাড়ে। একদিন রাতে নাফিজার উঠলো ভীষণ জ্বর। সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেল আর টর্চলাইট নিয়ে গঞ্জের দিকে ছুটে গেল মাহিদুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ নিয়ে ফিরলো। সেই কৃতজ্ঞতায় ‘মেলিটারী ভাবী’ আজ রাতের জন্য মাহিদুল ভাইকে তার টু-ব্যান্ড রেডিওটা বাজাতে দিয়েছে। এই রেডিও বাজাতে পাওয়া মাহিদুলের কাছে পূর্ণিমার চাঁদের থেকেও বেশি। সারা বাড়িতে দুইটি রেডিও আছে। একটি চেয়ারম্যানের থ্রি-ব্যান্ড রেডিও, অন্যটি টু-ব্যান্ড ‘মেলিটারী ভাবী’র। এই দুই জিনিসে যেন হাত দেওয়ার অধিকার কারোরই নেই। এক বাড়িতে দুই দুইটি রেডিও থাকা কম গর্বের কথা নয়। তাছাড়া গঞ্জের দোকানে চেয়ারম্যানের একটি ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনও রয়েছে। কোনো ফুটবল ফাইনাল খেলার দিন কিংবা কোনো সিনেমা দেখানো হয় যেদিন, শত শত লোক জড় হয় দেখতে। মাহিদুলের সুটকেসে ইদানিং তার মায়ের ছবির সঙ্গে আরেকটি ছবি যুক্ত হয়েছে, সেটা ‘মেলিটারী ভাবী’র ছবি। কিভাবে এ ছবি সংগ্রহ করেছে, কেউ জানে না। এমন কি তার সংগ্রহে যে শেফালির ছবি রয়েছে এটাও কেউ জানে না যখন সে একা থাকে, তখন সে এ ফর্সা নারীর সুন্দরী-স্বাস্থ্যবতী ছবিটা বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখে। এ ছবি দেখলেই তার ঘুম আসেনা, দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয় বিছানায়। অথচ সে আগে অনেক আদর্শবান ছিল। এস এস সি পাশের যোগ্যতায় কোথাও চাকুরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় দেখলে দরখাস্ত করতো। এখন তার ‘মেলিটারী ভাবী’র চুড়ির ঝনঝন শব্দে আগুন ধরে যায় মগজে। ইদানিং আবার বিকেল বেলায় ‘মেলিটারী ভাবী’ সারা শরীরে সুগন্ধি লাগিয়ে ঘুরে। এমন গন্ধে মাহিদুল কামার্ত হয়ে পড়ে। সারাবাড়িতে জারুল গাছগুলো তাকে যেন তখন কবিতা লেখার আহবান জানায়। কয়েকমাস হয়ে গেল ইব্রাহিম বাড়িতে আসছেন না। শুধু চিঠিপত্রই লিখছেন শেফালিকে। এদিকে স্বামীর অপেক্ষা করে করে শেফালি অনেকদিন নিজ গ্রাম রূপাতলিতেও যায়নি। নিজের জীবনটাকে তার এখন জীবন্ত এক আগ্নেয়গিরিই মনে হয়। কখনো কখনো মনে হয়। অনেকগুলো ক্রিমির ওষুধ একসঙ্গে খেয়ে মরে যায়। কিন্তু পারে না নিজ সন্তান নাফিজা এর এখন তার জীবনে যুক্ত হওয়া মাহিদুলের কারণে। এই মাহিদুল বাজার থেকে এসে ময়দা, ডালডা, লবণ, দুধ, চিনির ব্যাগ রেখে তার শেফালি ভাবীর একটি চুমো না খেয়ে যাবে না। সামনে কেউ হাজির থাকলে পাওনা চুমোটা সে পরে কোনো এক সময়ে হলেও আদায় করে নেবে। এসব কথা শেফালি তার স্কুল জীবনের হিন্দু বান্ধবী সুষমার সঙ্গে ভাগাভাগি করলে সুষমা বলেছিল, শেফালি তুই পাপে জড়িয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করিস না। খুবই কষ্ট পাবি। শেফালি মানেনি সুষমার সেই কথা। বরং লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই মাহিদুলের হাতে তুলে দেয় ঘিয়ের ভাজা মচমচে চিড়ার লাড্ডু, বিস্কুট ইত্যাদি। এরই মধ্যে ইব্রাহিম বদলি হয়ে যান কক্সবাজার এরিয়ায়। বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে একদিন একটি চিঠি লিখেন ইব্রাহিম। এই চিঠির পর শেফালিকে লেখা কিছু কিছু চিঠি মেরে দেয় মাহিদুল। এতে স্বামী- স্ত্রীর দূরত্ব আরও বাড়ে। জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে বিডিআর-নৌবাহিনী- সেনাবাহিনীর-বিমানবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে চিঠি লিখেন ইব্রাহিম। সেই চিঠিতে রয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত ভ্রমণের অনেক বৃত্তান্ত। কিন্তু এসব চিঠি হাতে পৌঁছে না শেফালির। মেরে দেয় মাহিদুল। আর ইব্রাহিমের বাবা চেয়ারম্যান ব্যস্ত তার রাজনীতি এবং ব্যবসা নিয়ে। গতকালেও তার সম্মানে একটি সংবর্ধনা সভা ছিল। এসব খবর তিনি কখন রাখবেন? তাছাড়া ইদানিং ডাক পিয়নের সঙ্গেও মাহিদুলের গলায় গলায় ভাব। শেফালিকে একা পেলে আর ভাবী ডাকে না মাহিদুল। বলে, প্রিন্সেস শেফালি। নিজেকে পরিচয় দেয় প্রিন্স মাহিদুল। বারণ করে না শেফালি। অথচ এই শেফালি আবার নিয়মমাফিক প্রতিদিনই ফজর-জোহর-আসর-মাগরিব এবং এশার নামাজও পড়ে। আবার সে-ই মাহিদুলকে এমন প্রশয় দিতে পারে, ভাবাও যায় না। বিষয়টা প্রথমে কিছুটা টের পায় চেয়ারম্যান বাড়িতে বছর বছরব্যাপী থাকা কাজের লোক আবদুল মালেক। সে এটা শেফালির শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগমকে বললে পিয়ারা মালেকের ডান গালে একটি কষে থাপ্পড় দেয়। থাপ্পড় খেয়ে নিরবে কেঁদেছে আবদুল মালেক। কেঁদেছে এই জন্য যে, থাপ্পড় খাওয়ার জন্য তো নয়ই, বরং গত তিন বছর ধরে এ বাড়িতে অনেক অপরাধ করেও কখনো সে কারো হাতে মার খায়নি। বড়জোর বকা খেয়েছে। বরং আজ দেখা সত্য বলতে গিয়েই মার খেলো পিয়ারার, যাকে সে মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করে। পরদিন পিয়ারা বেগমকে আবদুল মালেক বলেছে তিস্তায় পাঁচবার হামাদের বাড়ি নিছে। না হয় হামার মতো চ্যাংরা এহানে কাজ করি? চোখ দুটি তার লাল। তার কথার কোনো জবাব দেন না পিয়ারা বেগম। রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তাপাড়েই আবদুল মালেকের বাড়ি। বিষয়টাকে উড়িয়ে ফেলে দেন না পিয়ারা বেগম। রাতে স্বামীর কানে কথাটা দিতে গিয়ে তিনিও এক থাপ্পড় খান স্বামীর। স্বামী তাকে এভাবে কখনো মেরেছে, তার মনে পড়ে না। স্বামী চেয়ারম্যান বলে তার অনেক দায়িত্ব মাথায়। এই এখন যেমন এলাকার কালীমন্দিরে কে বা কারা গত রাতে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে, এ নিয়ে বসতে হবে। কথা বলতে হবে আবার পুলিশের সঙ্গেও। এ নিয়ে বসতে হবে। কথা বলতে হবে আবার পুলিশের সঙ্গেও। এ অবস্থায় এসব বাজে নালিশ ভালো লাগে! পুুলিশ প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এখনো কাউকে ধরতে পারেনি। তাই আছে উপজেলা প্রশাসনের চাপ। মন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জন চক্রবর্তী এ নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে দুইবার এসেছেন। চেয়ারম্যান প্রথম যখন জানতে চান নিরঞ্জনের কাছে কয়টি প্রতিমা দুুর্বৃত্তরা ভেঙেছে? নিরঞ্জন বলেন, একটি কালী প্রতিমা ও একটি সরস্বতী প্রতিমা ভাঙচুর করেছে ওরা। চেয়ারম্যান পুরোহিত নিরঞ্জনের কাছে জানতে চান কারা এবং কেন ভেঙেছে প্রতিমা? কী মনে হয় আপনার? নিরঞ্জন বলেছেন, আমি এর কোনো কারণও জানি না। শত্রুদেরও দেখিনি। তবু পূজা উদযাপন কমিটির বণিকবাবু ৪/৫ জনের নাম আমার কাছে দিয়েছেন। আগে কখনো সিনেমা দেখতো না মাহিদুল। ইদানিং দেখে। দেখে আবার সেই গল্প শেফালি ভাবীর কাছে বলে। শেফালি ভাবী ওরফে ‘মেলিটারী ভাবী’ ও সেই সিনেমার গল্প উপভোগ করে। শেফালি ভাবী আরও উপভোগ করে সাপ-মইয়ের লুডু খেলা। আগে রাতে শ্বাশুড়ির সঙ্গেই খেলতো শেফালি। এখন সেখানে নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করে যুক্ত হয় মাহিদুল। পিয়ারা বেগম আতঙ্ক অনুভব করেন। নিজের সন্তানের লেখাপড়ায় মন না বসাতেই সেনাবাহিনীর সৈনিকের চাকুরিতে নাম লেখায়। এ চাকুরিতে পিয়ারা বেগমের মন ছিলো না। মারা আর মরার এ পেশা কোনোদিনও ভালো লাগেনি তার। এখন পুত্রবধূর ভাব বুঝতে পারছেন না তিনি। নিরবে চোখের জল ফেলেন। আরও চোখের জল ফেলেন বিনা অপরাধে কাজের লোক আবদুল মালেককে থাপ্পড় মেরেছেন বলে। এদিকে আবার দুইদিন পর। কালীমন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জনের বাবা স্বর্গীয় নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তীর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে। ওখানে চেয়ারম্যানের নিমন্ত্রণ রয়েছে। তার আগেই প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়ে কিছু একটা করা না গেলে চেয়ারম্যানেরও মুখ বাঁচবে না। স্বর্গীয় নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তী বড় ভালো লোক ছিলেন। চেয়ারম্যানের নির্বাচনেও তার পক্ষে কাজ করেছিলেন। তার বিদেহী আত্মার সদগতি কামনায় দুর্বৃত্তদের ধরতে তাই চেয়ারম্যান থানার ওসির সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছেন, যদিও এখনো পর্যন্ত কাউকে সনাক্ত করা যায়নি। এদিকে শেফালি আর মাহিদুলের মাখামাখি এবার পাপড়ির চোখেও পড়লো। পাপড়ি তবু কাউকে কিছু বললো না, যদি কেউ এর পেছনে আবার মাহিদুলের প্রতি পাপড়ির কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায়, তাই। এদিকে এসব কথা ধীরে ধীরে ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালির কানেও আসে। নিজ গ্রাম রূপাতলি থেকে তার এক কাকাতো বোন কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে তার কাছে। রাতে ঘুমের আগে সেই কাকাতো বোন দিলারা শেফালিকে বললো, তোমার আর মাহিদুলের কথা কিন্তু যেভাবেই হোক আমাদের রূপাতলি পর্যন্ত চলে গেছে। ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালি এ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর দিলারাকে বলে, আমরা যা খাই তার কিছু অংশ শরীরে রেখে অদরকারী অংশ মলমূত্র করে বের করে দেই। কথার বেলাও এমনই। অদরকারী কথাগুলো কানে না নিলেই হলো। দিলারা বললো, কিন্তু লোকে তো তোমাকে কলঙ্ক দিচ্ছে শেফালি আপা। তাছাড়া এমন ধনী-গুণি পরিবারে তোমার কিসের অভাব? শেফালি বললো, দিলারা তুইও গ্রামের মেয়ে। দেখেছিস নিশ্চয়ই দোয়েল কখনো গাছের ডালে বাসা গড়ে না। আরও ভালো ডাল পেলেও দোয়েল বাসা গড়ে গাছের ফোঁকরে। আমি ও তেমনি দোয়েল স্বভাবের মেয়ে। বাকিটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না। দিলারা ভাবতেও পারে না এই শেফালিই একদা তাকে রাতের বেলা পড়া দেখিয়ে দিতো। তখন শেফালির কন্ঠে জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটি কতো চমৎকার শোনাতো। দিলারার এখনো যেন কানে লেগে আছে। ‘হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; ... দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’ হায়! সেই শেফালি যেন আজ সত্যিই হারিয়ে গেছে। শেফালি আজ সত্যি সত্যিই যুদ্ধংদেহী ‘মেলিটারী ভাবী’। যে শেফালি অর্জুন গাছের তলায় বসে আড্ডা দিতো, বর্ষায় গাছে উঠে পেড়ে আনতো কদম ফুল কিংবা অশ্বত্থ বটপাতা দিয়ে বানাতো একধরনের বাঁশি, তার ভিতরটা যেন আজ সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকার, ফ্লাইক্র্যাশ, জিপসাম ও স্ল্যাগে পরিপূর্ণ। এদিকে অনেকদিন অসুস্থ থেকে হঠাৎই মারা যান মাহিদুলের বাবা খুররম। এতে শোকের ছায়া সবাইকে ছুঁয়ে গেলেও শেফালিকে যেন একটু বেশিই ছুঁয়েছে। সে তার শ্বাশুড়িকে আবদার করে বসে এ উপলক্ষ্যে মাহিদুলের বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম অনুমতি দেননি। বলেছেন, নাফিজার কাশিটা বেড়েছে। এখন যাওয়ার দরকার নেই। ওদিকে মাহিদুলদের বাড়ি থেকে এসেই তোমার শ্বশুর আবার ঢাকায় যাবেন। এ বছর হজ্জ করার নিয়ত আছে তার। মক্কা-মদিনায় যাওয়ার জন্য আমারও প্রাণটা জ্বলে। কিন্তু যাওয়ার উপায় নাই। নিজের পোলা নিলো আর্মির চাকরি। দেশের জন্য সময় দিয়ে ঘরের জন্য সময় নাই। আবার বলে কী না, মা আমরা হলাম দেশের অতন্দ্র প্রহরী। ওদিকে দুর্গাবাড়িতে কয়েকদিন পরই নামযজ্ঞ উৎসব। তোমার শ্বশুর আবার ওখানে ব্যস্ত হবেন। তার পোলার মতো তারও ঘর দেখার সময় নাই। বিপীন বাবু আগেই নিমন্ত্রণ করেছেন। আবার আজ রাতেই গোরস্থানের জমি নিয়েও বসতে হবে সালিসে তাকে দত্তপাড়ার পশ্চিমবাড়িতে। আমার বালের চেয়ারম্যানগিরি। কার বালে যে তারে চেয়ারম্যান হইতে কইছিলো। দুনিয়ার যেন আর কোনো নেশা নাই। শ্বাশুড়ির মুখে এত কথা শুনে একেবারেই চুপ হয়ে যায় ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালি। ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। তার কাছে মনে হয়, তার জ্বলজ্বলে নাকফুলটি যেন তাকে বলছে, আমি একজন জ্যোতিষরাজ। আমি বলে দিলাম, তুই আগামীতে অন্ধকারেই নিপতিত হবি। হঠাৎ মন কেঁপে ওঠে শেফালির। তার কানে বাজে স্বামী ইব্রাহিমের কিছু কথা। ইব্রাহিম বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর চাকুরি অন্য সব চাকুরি থেকেই ব্যতিক্রম। সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এ চাকুরি পেতে হয়। বয়স হতে হবে নির্ধারিত। উচ্চতা-ওজন-বুকের মাপ-শিক্ষাগত যোগ্যতা-স্বাস্থ্য পরীক্ষা-লিখিত পরীক্ষা এবং আরও কতোকিছু! আর নিয়মভঙ্গ করলেও মারাত্মক সাজা চাকুরি থেকে বরখাস্ত। তেমনিভাবে একজন নারীর জন্যও সংসার প্রতি মুহূর্তেই পরীক্ষাক্ষেত্র। নিয়মভঙ্গ করলেই...। কেঁপে ওঠে ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালির মন ও শরীর। তবে কি সে আর মাহিদুলকে কোনো প্রশ্রয়ই দেবে না? ঘর থেকে বের হয়ে আবার বাইরে যায় শেফালি। গিয়ে ঠিক সোনাইল গাছটির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে এক সন্ধ্যায় প্রথম মাহিদুলকে শরীরে হাত দিতে দিয়েছিল শেফালি। তখন গ্রীষ্মকাল। হলুদ রঙের ঝুলন্ত ফুলের লম্বা লম্বা ছড়ায় গাছটি কেমন সুগন্ধে ভরে উঠেছিল।



৮৮| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১:৪৫

জসীম অসীম বলেছেন:




কবি পিয়াস মজিদ সম্পাদিত
একটি সাহিত্যপত্রে 2002 সালে প্রকাশিত
আমার একটি কবিতা।

৮৯| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:৪৭

জসীম অসীম বলেছেন:
শৈশবে আমি।

৯০| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:৫২

জসীম অসীম বলেছেন:



তপন পাল ও তাঁর ছেলে।
ছবি: জসীম উদ্দিন অসীম। দুর্গাপূজা: ২০১৭

৯১| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:৫৭

জসীম অসীম বলেছেন: আমার ছেলে অপূর্ব।

৯২| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: কামরাঙা ফুল: আলোকচিত্রী: সাদিয়া অসীম পলি।

৯৩| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:২৫

জসীম অসীম বলেছেন:
আমাদের বাসার বারান্দার টবের ফুল।

৯৪| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:২৯

জসীম অসীম বলেছেন:
বাবা।

৯৫| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:৩২

জসীম অসীম বলেছেন: স্ত্রী ও পুত্রধন।

৯৬| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:৩৫

জসীম অসীম বলেছেন: দিনলিপি:
জলপিপির গান
জসীম উদ্দিন অসীম:

নভেম্বর ২০০৮,
১০নং ক্যান্টনমেন্ট গেইট,
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, কুমিল্লা।

===============
যেদিন আমি পাগড়ি-শেরোয়ানি
পরে প্রথম বর হয়েছিলাম
সেদিন আসলে আমি মানুষ হয়েও
ছিলাম কোনো ডাহুক অথবা
এক জলপিপি পাখি
মানুষের নির্দয়তা এতো বেশি
অস্বাভাবিক হতে পারে,
রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া একজন যুবকের পক্ষে
তা জানা সম্ভবও ছিলো না।
যে জীবন কোনো স্পাইডারম্যানের নয়,
নয় কোনো ইউরোলজিস্টের
যে জীবন শুধুমাত্র কবিতার জন্যই নিবেদিত,
সে জীবন তো জালিয়াতি আর প্রতারণার শিকার হবেই।
যেদিন আমি পাগড়ি-শেরোয়ানি পরে প্রথম বর হয়েছিলাম,
তখনও বুঝতে পারিনি
মানুষের ভিতরে বাস করতে পারে
জালিয়াতির এতো ভয়ানক জাল।
জীবনের লটারিতে বিজয়ী জীবন যাদের,
আমার জীবন সে রকম কিছু নয়।
এমনকি আমি অনেক সময় ঈশ্বরের সমর্থনও পাইনি।
ভূমিকম্পে-সুনামিতে তাই বারবার ভেসে ভেসে গেছি।
কারণ জালিয়াত মানুষ বুঝে না কক্ষনোই জলপিপির গান।
==================
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।
আলোকচিত্রী: কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব।

৯৭| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:১৮

জসীম অসীম বলেছেন:

৯৮| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:৪৬

জসীম অসীম বলেছেন: মা ও ছেলে।

৯৯| ১৯ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৩২

জসীম অসীম বলেছেন:
১৯৯১ সালে আমি। ঢাকায়।

১০০| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:১০

জসীম অসীম বলেছেন: ছবি: জসীম উদ্দিন অসীম: ১৯৯৮

১০১| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ১১:৪২

জসীম অসীম বলেছেন: ১৯৯২-৯৩ সালে আমার অাঁকা পাখির একটি ছবি।

১০২| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ১১:৫৯

জসীম অসীম বলেছেন:
আমার ছেলে কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব

১০৩| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:০৬

জসীম অসীম বলেছেন: আমি আর আমার ছেলে।

১০৪| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:১২

জসীম অসীম বলেছেন: ছবি: সাদিয়া অসীম পলি।

দিনলিপি:
আগষ্ট ২০০৬, কান্দিরপার,কুমিল্লা।
জসীম উদ্দিন অসীম:

মোহাম্মদ উল্লাহ এই সমাজকে ঠিকই নিরীক্ষণ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি কথায় কথায় এই দেশের কৃষিকে বাঁচানোর বিষয়ে এতো কথা বলতেন। একবার আমি তাঁর মুখে বাঁশ ও দুগ্ধ শিল্প নিয়ে এমন কিছু কথা শুনলাম, মনে হলো শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আমি যেভাবে কল্পনা করি, তা যথার্থ নয়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। একদা নাট্যোৎসবের স্বপ্ন দেখা একজন যুবক আমি, ইরানের তেল নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতির কী বুঝবো? ধানের দাম কেন কমে, বাড়ে কেন চালের দাম, কারা এবং কিভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করেন, মোহাম্মদ উল্লাহ এসবের নিপুণ বিশ্লেষণ করতে পারতেন। যে লোকটা নেপালের মাওবাদীদের পরিণতি ব্যাখ্যা করতে পারতেন অথবা আমাদের স্বর্ণ অথবা রৌপ্যমুদ্রা কারা হরিলুট করে নিয়ে যায় তা দেখিয়ে দিতে পারতেন, তিনি এই দেশে অসুস্থ হয়ে ওষুধও পেতেন না ঠিকমত। মানুষ কিভাবে অন্যকে নিজের বিশ্বাসে বিশ্বাসান্তরিত করে, তা সব সময় বলতেন মোহাম্মদ উল্লাহ। এখন তাঁর অবর্তমানে কী দুর্দশা তাঁর সেই পরিবারের। অথচ আমি জানি, তাঁর অগাধ অর্থ থাকলে তাঁর মেয়েরাও হতে পারতো বিমানের পাইলট। দিনলিপি:
আগষ্ট ২০০৬, কান্দিরপার,কুমিল্লা।
জসীম উদ্দিন অসীম:

মোহাম্মদ উল্লাহ এই সমাজকে ঠিকই নিরীক্ষণ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি কথায় কথায় এই দেশের কৃষিকে বাঁচানোর বিষয়ে এতো কথা বলতেন। একবার আমি তাঁর মুখে বাঁশ ও দুগ্ধ শিল্প নিয়ে এমন কিছু কথা শুনলাম, মনে হলো শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আমি যেভাবে কল্পনা করি, তা যথার্থ নয়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। একদা নাট্যোৎসবের স্বপ্ন দেখা একজন যুবক আমি, ইরানের তেল নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতির কী বুঝবো? ধানের দাম কেন কমে, বাড়ে কেন চালের দাম, কারা এবং কিভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করেন, মোহাম্মদ উল্লাহ এসবের নিপুণ বিশ্লেষণ করতে পারতেন। যে লোকটা নেপালের মাওবাদীদের পরিণতি ব্যাখ্যা করতে পারতেন অথবা আমাদের স্বর্ণ অথবা রৌপ্যমুদ্রা কারা হরিলুট করে নিয়ে যায় তা দেখিয়ে দিতে পারতেন, তিনি এই দেশে অসুস্থ হয়ে ওষুধও পেতেন না ঠিকমত। মানুষ কিভাবে অন্যকে নিজের বিশ্বাসে বিশ্বাসান্তরিত করে, তা সব সময় বলতেন মোহাম্মদ উল্লাহ। এখন তাঁর অবর্তমানে কী দুর্দশা তাঁর সেই পরিবারের। অথচ আমি জানি, তাঁর অগাধ অর্থ থাকলে তাঁর মেয়েরাও হতে পারতো বিমানের পাইলট।

১০৫| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: মা ও ছেলে।

১০৬| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৪

জসীম অসীম বলেছেন: দিনলিপি:
জলপিপির গান
জসীম উদ্দিন অসীম:

নভেম্বর ২০০৮,
১০নং ক্যান্টনমেন্ট গেইট,
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, কুমিল্লা।

===============
যেদিন আমি পাগড়ি-শেরোয়ানি
পরে প্রথম বর হয়েছিলাম
সেদিন আসলে আমি মানুষ হয়েও
ছিলাম কোনো ডাহুক অথবা
এক জলপিপি পাখি
মানুষের নির্দয়তা এতো বেশি
অস্বাভাবিক হতে পারে,
রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া একজন যুবকের পক্ষে
তা জানা সম্ভবও ছিলো না।
যে জীবন কোনো স্পাইডারম্যানের নয়,
নয় কোনো ইউরোলজিস্টের
যে জীবন শুধুমাত্র কবিতার জন্যই নিবেদিত,
সে জীবন তো জালিয়াতি আর প্রতারণার শিকার হবেই।
যেদিন আমি পাগড়ি-শেরোয়ানি পরে প্রথম বর হয়েছিলাম,
তখনও বুঝতে পারিনি
মানুষের ভিতরে বাস করতে পারে
জালিয়াতির এতো ভয়ানক জাল।
জীবনের লটারিতে বিজয়ী জীবন যাদের,
আমার জীবন সে রকম কিছু নয়।
এমনকি আমি অনেক সময় ঈশ্বরের সমর্থনও পাইনি।
ভূমিকম্পে-সুনামিতে তাই বারবার ভেসে ভেসে গেছি।
কারণ জালিয়াত মানুষ বুঝে না কক্ষনোই জলপিপির গান।
==================
কম্পোজ: সাদিয়া অসীম পলি।
আলোকচিত্রী: কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব।

১০৭| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৪

জসীম অসীম বলেছেন: ছবি: কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব।

১০৮| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:০৯

জসীম অসীম বলেছেন: ছবি: কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব।

১০৯| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৩৮

জসীম অসীম বলেছেন:

১১০| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৫১

জসীম অসীম বলেছেন: ছবি: জসীম উদ্দিন অসীম।

১১১| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৫

জসীম অসীম বলেছেন: আমার ছেলে ভালোবাসে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের রূপকথা পড়তে।

১১২| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:২৯

জসীম অসীম বলেছেন: ছবি: জসীম উদ্দিন অসীম।

১১৩| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৯

করুণাধারা বলেছেন: প্রথম পাতায় লিখতে পারছেন না কেন আপনি? আপনি ইমেইল দিয়ে মডারেটরদের সাথে যোগাযোগ করে দেখুন, প্রথম পাতায় লিখতে দিতে কি অসুবিধা আছে। আপনার কিছু পোস্ট পড়তে গিয়েছিলাম মন্তব্য হিসেবে যেগুলো দিয়েছেন। কিন্তু এত বড় যে কিছুক্ষণ পরে আর পড়ার আগ্রহ পাইনি।

আপনি প্রথম পাতায় যেন লিখতে পারেন, সেই শুভকামনা রইল।

১১৪| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৩

জসীম অসীম বলেছেন: আমার ছেলে কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব ছবি অাঁকতে খুবই ভালোবাসে।

১১৫| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:০৯

জসীম অসীম বলেছেন:
হায়! এই ব্লগের প্রথম পাতায় আবার যদি লিখতে পারতাম আমি।

১১৬| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৩

জসীম অসীম বলেছেন: আমার বউ ও ছেলে ব্লগের নিয়মিত পাঠক।

১১৭| ২০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৭

হাইজেনবার্গ ০৬ বলেছেন: ভাই জরুরী ভিত্তীতে একজন সাইকিয়াস্ট্রীট দেখান।

১১৮| ২১ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:২১

জসীম অসীম বলেছেন: এম.পি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট
জারি হয় না কেন?

দিনলিপি: জুলাই 2006, কুমিল্লা।
জসীম উদ্দিন অসীম:

(ক)
উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা কিংবা এম.পি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কেন ওয়ারেন্ট জারি হয় না? তারাই তো অনেকে বড় বড় অপকর্মের হোতা। অনেক সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা করতেও ভয় পায় মানুষ। আবার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীও ইদানীং প্রকাশক-সম্পাদকদের আশীর্বাদে 'সাংবাদিক' পরিচয় দিয়ে বেড়ায় । সিরামিকস লিমিটেডের কর্মচারী, মিনি-প্যাক বিস্কুট বিক্রেতা কিংবা... তারা সবাই এখন সাংবাদিক।
(খ)
কুমিল্লা সদর উপজেলার কালিরবাজারের ফেনুয়া গ্রামের হীরালাল দেবনাথ একবার আমাকে বলেছিলেন, ইতিহাস বড় নির্মম। সে কাউকে মুক্তি দেয় না। তবে কেন অপরাধী হওয়া? হীরালাল দেবনাথ কি জানেন আমাদের আমলা বা রাজনীতিবিদরা কিভাবে ইতিহাসের কাছ থেকেও মুক্তি পেয়ে যায়?

তিনি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দিরে গীতা কিংবা চৈতন্য চরিতামৃত পাঠ করতেন। কখনো বা প্রসাদ বিতরণ। কুমিল্লার কোটবাড়ি বার্ডে’র পশ্চিমে যে বি.ডি.আর ক্যাম্প, তার পশ্চিমে যে পাহাড় এবং ওখানে যে মসজিদ, সে মসজিদ থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে সেই শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দির। আজও আমি যাইনি হীরালাল দেবনাথদের সেই মন্দিরে। শুনেছি প্রকৃতি ওখানে স্বর্গের ছোঁয়া এনেছে। আর আমাদের এ দেশে কোনো কোনো এমপি-মন্ত্রী সারাক্ষণই নরকের ধোঁয়া ছড়ান। অথচ তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয় না। তারাই তো অনেকে অপকর্মের বড় বড় হোতা । তাদেরকে কে দেবে কেমোথেরাপি আজ? আমি বসে থাকি তত্ত্বে ও সেই নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষায়! কবে আসবে সেই সময়! যখন এসব 'সিস্টেম' নির্মূল হয়ে যাবে, যারা স্বর্গের টিকিট বিক্রি করেন কিংবা ভাঙেন মূর্তি অথবা করেন পরমাণু গবেষণা অথবা যারা মসজিদ আর মাজার নিয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত, আমি তাদের কাউকেই সমর্থন করতে পারি না । বিনিময়ে লাভ করেছি চরম বেকারত্ব । জার্মানীর বিজ্ঞানী আইনস্টাইনতো বেকার ছিলেন প্রায় দুই বছর। আর আমার বেকারত্ব? লাগাতার...। যার প্রিয় কথানাট্য আবার 'চাকা' সেলিম আল দীনের, সেই সাধারণ এক যুবক আমি, এমপি-মন্ত্রীদের বিচার দাবি করি। লোকে হাসে এবং বলে, এই বেকার পাগল নাকি দেশকে ভালোবাসে। আমার দেশপ্রেম তাঁদের হাসির খোরাক হয়। তাঁরাই আবার এই দেশে বড় বড় নেতা হয়। মগজের ঘাটতি আসলে কার? এই দেশে এটা আজ কে প্রমাণ করবে?

১১৯| ২১ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:২২

জসীম অসীম বলেছেন: এম.পি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট
জারি হয় না কেন?

দিনলিপি: জুলাই 2006, কুমিল্লা।
জসীম উদ্দিন অসীম:

(ক)
উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা কিংবা এম.পি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কেন ওয়ারেন্ট জারি হয় না? তারাই তো অনেকে বড় বড় অপকর্মের হোতা। অনেক সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা করতেও ভয় পায় মানুষ। আবার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীও ইদানীং প্রকাশক-সম্পাদকদের আশীর্বাদে 'সাংবাদিক' পরিচয় দিয়ে বেড়ায় । সিরামিকস লিমিটেডের কর্মচারী, মিনি-প্যাক বিস্কুট বিক্রেতা কিংবা... তারা সবাই এখন সাংবাদিক।
(খ)
কুমিল্লা সদর উপজেলার কালিরবাজারের ফেনুয়া গ্রামের হীরালাল দেবনাথ একবার আমাকে বলেছিলেন, ইতিহাস বড় নির্মম। সে কাউকে মুক্তি দেয় না। তবে কেন অপরাধী হওয়া? হীরালাল দেবনাথ কি জানেন আমাদের আমলা বা রাজনীতিবিদরা কিভাবে ইতিহাসের কাছ থেকেও মুক্তি পেয়ে যায়?

তিনি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দিরে গীতা কিংবা চৈতন্য চরিতামৃত পাঠ করতেন। কখনো বা প্রসাদ বিতরণ। কুমিল্লার কোটবাড়ি বার্ডে’র পশ্চিমে যে বি.ডি.আর ক্যাম্প, তার পশ্চিমে যে পাহাড় এবং ওখানে যে মসজিদ, সে মসজিদ থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে সেই শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দির। আজও আমি যাইনি হীরালাল দেবনাথদের সেই মন্দিরে। শুনেছি প্রকৃতি ওখানে স্বর্গের ছোঁয়া এনেছে। আর আমাদের এ দেশে কোনো কোনো এমপি-মন্ত্রী সারাক্ষণই নরকের ধোঁয়া ছড়ান। অথচ তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয় না। তারাই তো অনেকে অপকর্মের বড় বড় হোতা । তাদেরকে কে দেবে কেমোথেরাপি আজ? আমি বসে থাকি তত্ত্বে ও সেই নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষায়! কবে আসবে সেই সময়! যখন এসব 'সিস্টেম' নির্মূল হয়ে যাবে, যারা স্বর্গের টিকিট বিক্রি করেন কিংবা ভাঙেন মূর্তি অথবা করেন পরমাণু গবেষণা অথবা যারা মসজিদ আর মাজার নিয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত, আমি তাদের কাউকেই সমর্থন করতে পারি না । বিনিময়ে লাভ করেছি চরম বেকারত্ব । জার্মানীর বিজ্ঞানী আইনস্টাইনতো বেকার ছিলেন প্রায় দুই বছর। আর আমার বেকারত্ব? লাগাতার...। যার প্রিয় কথানাট্য আবার 'চাকা' সেলিম আল দীনের, সেই সাধারণ এক যুবক আমি, এমপি-মন্ত্রীদের বিচার দাবি করি। লোকে হাসে এবং বলে, এই বেকার পাগল নাকি দেশকে ভালোবাসে। আমার দেশপ্রেম তাঁদের হাসির খোরাক হয়। তাঁরাই আবার এই দেশে বড় বড় নেতা হয়। মগজের ঘাটতি আসলে কার? এই দেশে এটা আজ কে প্রমাণ করবে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.