নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি...খুব সাধারণ একটা ছেলে,নিরামিষ টাইপ। জন্মেছিলাম কোনো একদিন,এখন মৃত্যুর জন্যে নিজেকে তৈরী করছি। বুকের মধ্যে কোথায় যেন হাহাকার-মৃত্যু চিন্তার হাহাকার। এই হাহাকার আরো বেড়ে যায় জোছনা রাতে। মমতাময়ী জোছনা আর নিভু নিভু কিছু নক্ষত্রের রাতে নিজেকে খুব একা মনে হয়। গভীর একাকিত্ব গ্রাস করে আমাকে। আসলেই তো,আমার তো আসলেই কেউ নেই। আমার মতন অনেক নিরামিষ-মানুষ নিঃসঙ্গ,অনেকটা আকাশ ভরা তারার মতন। অযুত-কোটি তারার মাঝেও প্রতিটা তারার চোখ ভরা গভীর বিষাদ-একাকিত্বের বিষাদ। একদিন সেইখানে ওদের মাঝে চলে যাবো,তাই পৃথিবীতে আর এখন বিষাদ খুঁজি না। নিষ্পাপ শিশুর আদ্রতামাখা হাসিমুখ খুঁজে বেড়াই...এইতো আমি। আরো অনেক বিচিত্র \'আমি\' কে আমি চিনি। সেসব নাহয় অন্য কোনো দিন লিখতে বসব !
(১)
আতাউল সাহেব ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। তার সামনের টেবিলে কাঁচের গ্লাসভর্তি আধাগ্লাস পানি। তার দৃষ্টি সেই স্থির পানির দিকে। তার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। রাগে তার হাত-পা কাঁপছে। সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ হলে সারাটা দিন খারাপ যায়। আজো সেরকম একটা দিন। রাগটা কারো ওপর ঝাড়তে পারলে ভালো হত। তবে সে উপায় নেই। রাগ ঝাড়ার একমাত্র ব্যক্তি তার স্ত্রী রাহেলা। রাহেলা আজ দু সপ্তাহ হল বাসায় নেই। সে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। সাথে করে মেয়ে রিনকিকেও নিয়ে গেছে। এমনকি যাবার আগে কাজের বুয়াকেও বলেছে, “শোনো বিলকিসের মা,যে বাড়িতে আমার কোনো শান্তি নেই সেই বাসায় তুমি আর কাজ করবে?” বিলকিসের মা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছে, “জ্বে না আম্মা। জান গেলেও না।” এরপর তিনজনকে বাসা থেকে একসাথে বের হতে দেখা গেছে। নিয়ম মতন রাহেলার ফোনটাও অফ পাওয়া যাচ্ছে। আর রিনকির তো কোনো ফোন নেই। আতাউল সাহেব ভাবছেন প্রতিবারের মতন এবারো শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হবেন। এ বয়সে যদিও এ কাজ করতে তাঁর বেশ সঙ্কোচ হয় তবুও কিছু করার নেই। একবার টগরকে বলে দেখলে হয়। আতাউল সাহেব পা বাড়ালেন ছেলের ঘরের দিকে।
-টগর! এই টগর!
টগর হাই তুলতে তুলতে ঘুম থেকে উঠলো।
-কি ব্যাপার মাই ডিয়ার ফাদার? এনিথিং রং?
-চুপ থাক। No English,খবরদার! যা তোর মা আর রিনকিকে গিয়ে নিয়ে আয়। হোটেলের খাবার আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
-কেন বাবা! Loose Motion নাকি?
-থাপ্পড় খাবি বেয়াদব! যা বলেছি তা কর।
-আজ পারব না বাবা। আজকে একটু রাজপথ ভ্রমনে বের হব। দেখেছ কেমন রোদ উঠেছে? এই রোদে না হাঁটলে কবিতা আসবে না।
আতাউল সাহেব থমথমে মুখে দেখলেন টগর হাই তুলতে তুলতে বাথরুমে ঢুকল। তিনি রাগ সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে ঘড়িটা নিয়ে বাথরুমের দরজায় ছুঁড়ে মারলেন। ভেতর থেকে টগর হঠাৎ মাথা বের করে বলল, ‘ বাবা,বেশী উত্তেজিত হওয়া কিন্তু ঠিক না। শেষে স্ট্রোক-ফোক হয়ে গেলে কে দেখবে? মা তো আর বাসায় নেই। এক কাজ কর,৪৮০ টাকার ঘড়িটা তো ভেঙ্গে ফেললে..টেবিলের ওপর ৫০০ টাকা রেখে বিদায় হও। Good Day! Be Happy!!
এই বলে টগরের মাথা যেমন ভাবে বেরিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই ভেতরে ঢুকে গেল। আতাউল সাহেব টেবিলে ৫০০ টাকা রেখে বের হয়ে এলেন।
(২)
টগর আয়নাতে নিজেকে দেখছে। বেশ একটা সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব এসেছে চেহারায়। তূর্ণাকে ভড়কে দেয়া যাবে। প্রায় ১ মাস পর ওর সাথে দেখা হবে। পাঞ্জাবীটা গায়ে চাপালো টগর। এটা তূর্ণার দেয়া পাঞ্জাবী। গিফট নয়,এটা ওর কাছ থেকে নেয়া ৬০০ টাকা দিয়ে কেনা। ঘটনাটা মনে করে টগর হেসে ফেলল। সেদিন টগরের মাথায় ভূত চাপলো ওকে ভড়কে দেবে। সেইদিন সন্ধ্যাতেই ও তূর্ণাদের মালিবাগের বাসায় উপস্থিত। তিনতলায় উঠে বেল বাজাতেই তূর্ণার বাবা দরজা খুললেন। ভদ্রলোক খালিগায়ে টিভি রিমোট হাতে উঠে এসেছেন। তার কপাল কুঁচকে আছে।
-কাকে চাই?
-স্লামালিকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন? আন্টি কই?
- কি বেয়াদব! এ্যাই তুই কে?
ভদ্রলোক রেগে গেছেন। একটু দূরে তূর্ণার মা কে দেখা গেল। তিনি রান্নাঘর থেকে ময়দামাখা বেলন নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। তূর্ণার ছোটভাই খেলনা গাড়ি হাতে দরজার বাইরেই এসে পড়েছে। সে টগরের পাঞ্জাবী ধরে টানছে। সে কথা শেখেনি,শুধু ‘থ’ ‘থ’ জাতীয় শব্দ করছে। মনে হচ্ছে সে টগরকে দেখে খুবই খুশী। গোলমাল শুনে তূর্ণা ছুটে এলো। ওর চোখে চশমা,হাতে মোটা বই। তূর্ণার চেহারায় রাজ্যার যত বিস্ময় আছে সব এসে ভর করেছে। সে হাত থেকে ধপ করে বইটা ফেলে দিলো। টগর মহাউৎসাহে বলল, ‘ওই তো! আমি ঐ আফামনির কাছে আসছি! হের কাছে আমি ৫০০ টেকা পাই।
- তুই কি বললি বেয়াদব! বের হ তুই! (তূর্ণার বাবা আরো রেগে গেছেন)
- আফায় আমার নয়া পাঞ্জাবীতে গত শুক্কুরবার বাসে বইস্যা পানের পিক ফেলছে। আমার নয়া খরিদ করা পাঞ্জাবী পুরাটাই বরবাদ।
এর মধ্যে তূর্ণার মায়ের গলা শোনা গেল।
-কি বলে এই ছেলে! এই তূর্ণা তুই এই কাজ করেছিস? তুই পান
খেয়েছিস? পানের পিক এর গায়ে ফেলেছিস!!
তূর্ণা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হুঁ।
-একে তুই বাসার ঠিকানা দিয়েছিস?
- হুঁ দিয়েছি। (এবার তূর্ণা কেঁদে ফেলল)
ওর কান্না দেখে টগর ভীষণ বিব্রত হয়ে গিয়েছিল। তাও পরিস্থিতি তূর্ণা ভালভাবেই সামাল দিলো। ভেতর থেকে ৬০০ টাকা এনে সে টগরকে দিল।
-এই নিন টাকা। পাঞ্জাবী কিনবেন।
-আফামনি শুকরিয়া!
- আপনি এখন আসুন।
টগর তূর্ণার ছোটভাইকে ধরতে ধরতে বলল, বাবুটারে এট্টু আদর কইরা যাই?
-কোনো দরকার নেই,আপনি আসুন।
তূর্ণার বাবা তূর্ণাকে সরিয়ে দিয়ে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
সেদিনের পর থেকেই তূর্ণার ফোন বন্ধ। তবে সেই ঘটনার আধঘন্টা পর তূর্ণার এসএমএস। লেখা- টগর,তুমি মানসিক ভাবে অসুস্থ। তোমার চিকিৎসা দরকার। আমি কোনো পাগলের সাথে প্রেম করতে চাই না। So বিদায়।
কিন্তু গতকাল রাতে আবার তূর্ণার এসএমএস। তাতে লেখা- আশা করি তোমার আচরণে পরিবর্তন এসেছে। আমি আগামিকাল ১২ টায় KFC তে থাকবো। দেখা হবে।
তূর্ণার সমস্যা গুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। সে KFC কিংবা Pizza Hut-এসব জায়গা ছাড়া আর কোথাও দেখা করেনা। টগরের দম আটকে আসে। রোবট টাইপ তূর্ণার জীবনটা ডেন্টালের মোটা বই আর KFCর চিকেন ফ্রাই-তেই সীমাবদ্ধ। খোলা আকাশের নীচে হাত ধরে বসে থাকা অথবা বাতাসে চুল উড়িয়ে,দুচোখ বুজে রিকশায় চড়ে ইচ্ছেমতন ঘুড়ে বেড়ানোর স্বাদ ও কখনোই পেতে চায়না। টগর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বের হল। দেখল আতাউল সাহেব গোমড়া মুখে ডাইনিং এ বসে আছেন।
কাঁচের দরজা ঠেলে টগর KFCর ভেতরে ঢুকল। ভেতরে আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস। ভেতরের সব মানুষগুলোকেই রোবটের মত লাগছে। দরজায় দারোয়ানের মুখটাও ভাবলেশহীন। টগর দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ভাই ভালো? দারোয়ান উত্তর দিলো না। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। সম্ভবত ঘামে ভেজা পাঞ্জাবী নিয়ে কেউ এখানে আসে না। ওই তো,কোনার টেবিলটায় তূর্ণা বসে আছে। পরনে নীল শাড়ী। তূর্ণা বারবার ঘড়ি দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। টগরের চোখে চোখ পরলেও হয়তো চিনতে পারলো না। ব্যাপারটায় টগর বেশ মজা পেলো। ছদ্মবেশে কাজ হয়েছে। এখন কাজ হল তূর্ণাকে চমকে দেয়া। টগর তূর্ণার দিকে এগিয়ে গেল। আর ধপ করে বসে পড়লো তূর্ণার সামনের চেয়ারে। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কারন তূর্ণার অবস্থা শোচনীয়। ভয়ের চোটে সে চিৎকার করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছে,গ্লাসের পানি ফেলে খানিকটা শাড়িও ভিজিয়ে ফেলেছে। সে এখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে শাড়ি মুছছে। টগর একটা টিস্যু নিয়ে মুছতে গেল।
- কি আশ্চর্য! কে আপনি? অসভ্য কোথাকার!
- তূর্ণা আমি টগর। তোমাকে সুন্দর লাগছে তূর্ণা!
তূর্ণা হঠাৎ থেমে গেল। শান্ত হয়ে বলল,এসবের মানে কি টগর?
- জানি নাতো! বলো কেমন আছো?
- ভালো আছি। তোমার গালভর্তি এসব কি?
- চেনো না? এগুলোকে দাঁড়ি বলে।
- ওফ টগর! সবসময় এরকম আচরণ ভাল্লাগে না। তোমাকে ভাল্লুকের মতন লাগছে।
- অসুবিধা কি? তোমার তো আনন্দ হওয়া উচিত! ঢাকা শহরের কয়টা মেয়ের প্রেমিক ভাল্লুক বলো?
- আমি যা ভেবেছিলাম তা না। তোমার মাথা ঠিক হবেনা। আগে জানলে আমি আসতামই না।
- বাদ দাও,বলোতো পাঞ্জাবীটা কেমন হল? সেই ৬০০ টাকা দিয়ে কিনেছি।
তূর্ণা কথা না বলে উঠে গেল। বাইরে এসে সোজা রিকশায় উঠলো। টগরও লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে বসলো তূর্ণার পাশে। তূর্ণা মূর্তির মত বসে আছে। টগরই প্রথম কথা বলল।
- ইশ। হাতদুটো খুব জ্বলছে তূর্ণা!
টগর এই কথাটা বলল যেন তূর্ণা ওর হাতটা ধরে। কিন্তু তূর্ণা ধরলো না। টগর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বেলীফুলের ছোট্ট মালাটা বের করে তূর্ণার কোলের ওপর রাখলো। সঙ্গে কাল রাতে লেখা কবিতাটাও। তূর্ণা নীরব। তূর্ণা কখনো বলেনি মালাটা ওর খোঁপায় বেঁধে দিতে। আজই বা বলবে কেন? টগর নেমে গেলো রিকশা থেকে। রিকশাটা চলে যাচ্ছে। একটু দূরে যাবার পর টগর দেখলো শ্বেতশুভ্র বেলীফুলের মালাটা রিকশা থেকে ছিটকে এসে রাস্তায় পড়ল। পিচঢালা কালো রাস্তায় সাদা ফুলগুলোকে কি অসহায় লাগছে দেখতে! পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছলো টগর।
(৩)
বাড়ি ফিরে টগর দেখল তার বাবা আর মা ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছেন। তাদের মুখ হাসিহাসি,টগরকে দেখেই হয়তো গল্প করা থামিয়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে এই দুজন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। টগর হাসল।
- কি ব্যাপার মা,তুমি কতক্ষণ?
- এইতো এসেই পড়লাম। তোর বাবা তো আবার আমার রান্না ছাড়া খেতে পারেনা। আবার বাহানা করেছে আলু ভর্তা আর মুগডাল রান্না করে নাকি তার সাথে বসে খেতে হবে। কি জ্বালা বলতো! (রাহেলা বেগমের মুখে লাজুক হাসি)
আতাউল সাহেব কিছু বললেন না। পুত্রের দিকে তাকিয়ে হাসলেন- হেহেহে !!
টগর পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে। ভালোবাসা তো এমনি! দূরে সরে গেলেও ফিরে আসার জন্যে বাহানা বানিয়ে ফেলা যায়! পাশাপাশি বসে আলুভর্তা আর মুগডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতেও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষের মতন প্রাণখুলে হাসা যায়...কি সুন্দর এই ভালোবাসা! কি সুন্দর!!
©somewhere in net ltd.