নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলমগীর হোসেন আবীর

আলমগীর হোসেন আবীর

আলমগীর হোসেন আবীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মরীচিকা (১ম পর্ব)

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:৫৭

এক



খুব বেশিদিন হয়নি রাস্তাটি ইটের পাকা করা হয়েছিল। তখন মোনা কলেজে পা দিয়েছে মাত্র। খুব খুশি হয়েছিল সে। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় কাদা হয়ে যেত । স্কুলে যেতে কষ্ট হত। জুতায় কাদা লেগে থাকত। খুব বিশ্রী লাগত দেখতে।

ছেলেকে হাতে ধরে খুব সাবধানে হাঁটে মোনা। এর মধ্যে রাস্তার মাঝে মাঝে প্রায় জায়গায় ইট উঠে গেছে। কোথাও কোথাও পাশ ভেঙে ক্ষেতের সাথে মিশে গেছে। একটু অসাবধান হলে পায়ে চোট লাগতে পারে।

রাফি দাড়াও! পিছন থেকে ইফতির ডাক শোনা গেল।

রাফি ফিছন ফিরে তাকাল। মোনাও তাকাল। ইফতি গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাত জাগিয়ে বলছে , রাফি দাড়াও । তোমরা আমার সাথে যাবে।

কয়েকদিন ধরে ইফতি পথে পেয়ে রাফিকে ওদের গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে যায়। আজকেও ইফতি তাই করবে। মোনা রাফির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। রাফি মায়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার কয়েকবার ব্যথ্য চেষ্টা করে। জোরাজুরি করে মায়ের সাথে না পেরে ফুঁসিয়ে কেঁদে ওঠে। আমি ইফতির সাথে যাব। আমাকে ছেড়ে দাও। মোনা ছেলেকে ধমকায়, একদম কাঁদবে না বলছি। পরের গাড়িতে করে যাবে কেন? তোমার এত গাড়িতে চড়ার শখ কেন? রাফির কন্ঠে প্রতিবাদ, ইফতি কি আমার পর?

হ্যা পর।

ইফতি আমার বন্ধু না?

তুমি বন্ধুর কি বুঝ? সে বয়স কি তোমার হয়েছে? ছোটদের বন্ধু থাকা ভাল নয়।

ততক্ষণে গাড়িটা এসে সামনে থামল। ইফতি গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে রাফির হাত টানতে টানতে বলল, আন্টি আপনিও আসেন। আমার আব্বু খুব ভাল। আমাকে কিচ্ছু বলবে না।

আমরা তোমাদের সাথে যাব কেন? খুব ঝাঁজাল স্বরে বলতে চেয়েও কথাটা মুখের মধ্যেই ধরে রাখল মোনা। নিজেকে শান্ত করে কোমল স্বরে বলল, তোমরা যাও। আমি হেঁটে যেতে পারব। রাফি গাড়িতে চড়ে বলল, আম্মু তুমি রিকসা নিয়ে আস। আমি কিন্তু তোমার জন্য স্কুলের সামনে ওয়েট করব। গাড়ির শব্দে কিছু শোনা গেল না। শোভনের দিকে চোখ পড়ল তার । শোভন গম্ভীর হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। তাকে না দেখার ভান করছে। এতদিন পর দেখা হচ্ছে। একটি বারের জন্যও তার দিকে তাকাল না? একটি কথাও বলতে চাইল না? খুব খারাপ লাগছে তার। অন্তত কেমন আছি জানতে চাইতে পারত। এতটুকু ভদ্রতা কি ওর কাছে আশা করা যায় না? খুব অসম্মান লাগে । জীবনের এই জটিল পথে মানুষের ভুল হতে পারে। সে ভুল হতে পারে ছোট , হতে পারে বড় । তাই বলে তা আজীবন মনে রাখতে হবে? ওর কাছে ক্ষমা পাওয়ার অধিকারটুকুও কি নেই? মানুষ এত সহজে সবকিছু ভুলতে পারে? এত সহজে নিষ্ঠুর হতে পারে? বিয়ে হয়ত ওর সাথে হয় নি। বিধাতা ভাগ্যে তা লিখেনি। কিন্তু কখনো কি ওকে ভুলতে পেরেছি? ওর জন্য কি এক ফোঁটা চোখের জলও বিসর্জন দেইনি? চোখের জলের বিনিময়েও ক্ষমা পাওয়া যায় না? টিস্যু বের করে চোখ মুছতে থাকে সে।

ইটের রাস্তা পেরিয়ে পিচ ঢালাই রাস্তায় পা রাখল মোনা। পথটা খুব বেশি নয়। বিশ পচিঁশ মিনিট হাটলেই হয়। কিন্তু খুব বিরক্তিকর ঘিঞ্জি এলাকা। বছর পাঁচেক আগেও এখানে দু একটা রিকসা , টেম্পো ছাড়া খুব একটা যানবাহন চলতে দেখা যেত না। দুই পাশে সারি সারি দোকান পাট, কিছুদুর পরপর এত মিলস -ফ্যাক্টরী , গার্মেন্টস এসব কিছুই ছিল না। সেই শান্ত মফস্বল গ্রামটি এখন সম্পূর্ণ ব্যস্ত শিল্প নগরী। বাস, ট্যাক ও কাভার্ডভ্যানের চলার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। রাস্তার পাশে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা শিল্প বর্জ্যের বোটকা গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে। এর মধ্যে হেঁটে যাওয়াটা অতি কষ্টের, অসহ্যের। ইচ্ছে করলেই রিকসায় চড়ে যাওয়া যায় । কিন্তু অনেকগুলো রিকসা, অটো, বাস , ট্রাক যখন এক সাথে জটলা পাকিয়ে যায় তখন চুপচাপ রিকসায় বসে থাকা আরও অধিক বিরক্তিকর। স্কুল জীবনেও হেঁটে যাওয়া্টাই ছিল সবচেয়ে পছন্দের । প্রিয়তি, কলি, সুমনা ও তূর্ণা সহ আরও অনেকে একসাথে দলবেধে স্কুলে যেত। কলি শুধু রাস্তার ছেলেদের খুঁত ধরত।তার মুখে শোনা যেত কার হাঁটা ভাল দেখা যায় না, কে তাদেরকে ফলো করে, কার চোখ খারাপ। সে গবেষকের মত এসব বিষয়ে মন্তব্য করত আর শব্দ করে হাসত। মেয়েদের অট্টহাসি সবার কাছেই বিশ্রী লাগে। রাস্তার লোকেরা শুনে কটু্ক্তি করত। পিছনে অনেক সহপাঠীরাই নির্লজ্জ বলত। সে এতে সে মোটেই বিচলিত হত না। মোনা প্রায়ই শব্দ করে না হাসতে বলত। কিন্তু কলির স্বভাবই ছিল ওরকম। কথায় কথায় খিল খিল করে হেসে উঠত, অনেকটা বোকার মত। জীবনের কাছে নির্দিষ্ট কিছু চাওয়ার ছিল না তার । জীবন তাকে যা দেয় তাতেই সে খুশি। এক কথায় স্বপ্নহীন । তবে হতাশ নয়। সেই কলিই আজ সবচেয়ে সুখে আছে। ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছে । বর খুব একটা শিক্ষিত নয়, তবে ভাল মানুষ। সিধা সিধা টাইপের। ব্যবসা ও পরিবার এর বাইরের কিছুতেই মন দেয় না সে। মাস দুয়েক আগে কলির সাথে দেখা হয়েছিল। রাস্তার পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। উত্তরা যাবে। কিছু কিনাকাটা করবে। কোন বাসে দাড়ানোর জায়গা নেই। এক ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে বাড়ি ফিরে যাবে মনস্থির করছিল। আর একদিন কিনবে। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে তার পাশে থামলে সে ভীত ও হতচকিত হয়ে দু পা পিছিয়ে দাড়াল। কয়েক মুহুর্তে গাড়ি থেকে নেমে হাত ধরে কলি বলল, মোনা না? ওমা! চেহারা এমন হয়েছে কেন?

মোনা কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, কোথায় যাবি? এদিকে?

মাথা নেড়ে মোনা হ্যা বলতে না বলতেই কলি হাত টানতে টানতে বলল, আয় আমার সাথে যাবি।

গাড়িতে উঠে বসলে কলি বলল, তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মন খারাপ?

না।

তো কথা বলছিস না কেন? সেই কবে তোর সাথে কথা হয়েছিল! আচ্ছা তুই বিয়ে করিস না কনে বলতো? আজকাল কেউ বিধবা থাকে? থাকা যায়?

মোনা কিছু বলল না। ড্রাইভার সিগারেট খেয়ে মুখে ধোঁয়া ছাড়ছে । বসে বসে তাই দেখছে সে।

কলি মোনার বাহু ধরে টানতে টানতে বলল, তুই ভাল দেখে আবার বিয়ে করে ফেল। চেহারা থাকলে আজকাল মেয়েদের দু একটা বিয়ে হলেও কিছু আসে যায় না। যৌবনকে এভাবে অবহেলা করা ঠিক নয়। এভাবে জীবনটা নষ্ট করার কোন মানে হয়?

কে বলবে এ সেই কলি? সুখে গায়ের রং টস টস করছে। গলায়, কানে ও হাতে স্বর্ণের ঝিকিমিকি। ভাব অনুভূতিহীন এক সুখী জীবনের প্রতিচ্ছবি। কলির জ্ঞান দান দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিয়ে হলেই মেয়েরা খুব দ্রুত জ্ঞানী হয়ে যায় আর আচরনে সিনিয়র সিনিয়র ভাব চলে আসে। সুযোগ পেলেই সবাইকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে। আর যতটানা জ্ঞান আছে তার চেয়ে নিজেকে অধিক বেশি জ্ঞানী ভাবে। মোনা শুধু বিধবা নয়। একজন মা। বিয়ে করাটা সহজ। বিয়ে করলেই জীবনটা যে এর চেয়ে ভাল কাটবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? যৌনতা মানুষের জীবনের সুখের মুখ্য উপাদান নয়। এই সহজ বিষটা কলির মাথায় কখনো ঢুকবে না।

প্রিয়তি ছিল লাজুক প্রকৃতির। একা কখনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে পারত না। ছেলেদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে তার পা কাঁপত। কাউকে সঙ্গী হিসেবে না পেলে সেদিন স্কুলেই যেত না। নিজে খুব একটা কথা বলত না। শুধু সবার কথা গিলত। কিন্তু যখন কিছু বলত মনে হত সে এক সবজান্তা । চেহারা দেখে বেলে দিত কে কেমন ধরনের মানুষ।

প্রাণোচ্ছল হাসি, অজস্র কথা আর শত গল্পে মুখর হয়ে স্কুলে যাওয়ার সেই দিনগুলো ফিরে আসবে না আর। সেই আনন্দ কিছুটা হলেও খুঁজে পাওয়া যায় অদূরে একটি ছোটদের স্কুলে পড়াতে গিয়ে। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু কপালের উপর কারো হাত নেই। তবে ইদানীং বাচ্চাদের পড়ানোটা মন্দ লাগে না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কচি কচি কথা শুনতে কার না ভাল লাগে?











মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.