নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রসিকতা প্রাথমিক বিদ্যালয়

০৩ রা আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:৪২

আমাদের শহরে সবচেয়ে পুরনো যে স্কুলটা, যেটার গায়ে কোনো প্লাস্টার নেই, তার নাম ’রসিকতা প্রাথমিক বিদ্যালয়’। স্কুলটার ইটের পুরনো গাথুনির ওপর সবুজ শ্যাওলার আবরণ। সেখানে না আছে বেঞ্চ না আছে চেয়ার টেবিল। একেবারে যাচ্ছেতাই! কিন্তু ওটার আছে প্রাণ যা শহরের অন্য স্কুলে দেখিনি আমি। ছোটো বেলায় একবার এই স্কুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ওদের গাওয়া গান শুনে আমি চমকে গিয়েছিলাম। সেই যে শুনলাম তারপর থেকে মন আমার উথাল-পাতাল। বাবাকে বললাম যে আমি ওই স্কুলে পড়ব। শুনে তিনি ভয়ানক ক্ষেপলেন। বললেন, ওই রসাতল স্কুলে? ওখানকার ছেলে-মেয়েরা চাকরি পায় না, সব বাউ-েলে - লেখাপড়া কিছু হয় সেখানে? বাবার কথায় কষ্ট পেলাম কিন্তু দ্বিতীয় বার তাকে বলার সাহস হলো না যে আমি ’রসিকতা প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ পড়বো।



কিন্তু পড়তে না পারি সেখানে পড়াবার সময় বয়ে যায়নি। এম. এ. পাশ করে তাই একদিন ’ভুতের বাড়ি’ নামে কুখ্যাত সেই স্কুলে গেলাম। তখন সেখানে সবাই গাচ্ছিল বহু বর্ষ প্রাচীন সেই গান -



এবার রসের ভাঙবো হাড়ি,

রসিক যে জন তারই সাথে

করবো যাত্রা রসের বাড়ি।

রসমালাই রসগোল্লা রসম-ি সাথে নিয়ে

দেশসুদ্ধ জনতাকে সব জাগিয়ে দেব

রসিক রসের রঙ্গ দিয়ে।

রস ছাড়া সব ছিবড়ে পানা জাবর কাটা।

রসের যতো রসিক নাগর বাদ্য বাজাও

বিরাট করে; সরব তালে চলো সবাই

হাবুডুবু সাতার দিয়ে যাব বলে

রসের দেশে রসের তলে, বাঁধব বাসা রসাতলে।



ছেলে-মেয়েরা সব হাসছে গাচ্ছে খেলছে ছুটছে। যা কিছু ওরা করছে সব করছে মনের আনন্দে। এদের নেই কোনো স্কুলের পোশাক, নেই পড়া না পারার ভয় বা পরীক্ষায় ফেলের আশংকা। ওরা যা করে সব করে প্রাণের আনন্দে।



সব শুনে বাবা বললেন, অত প্রাণের আনন্দ দেখতে গেলে জীবন যে রসাতলে যাবে! বলি, চাকরি না হয় না করতে তাই বলে ওই ভুতের বাড়ি! আমি আমার এক বন্ধুকে বলে রেখেছি। চাকরিটাতে অনেক উপরি পাবে, তোমার সংসার ভালোই চলে যাবে। তাছাড়া তোমার বিয়ের ব্যাপারটাও তো ভাবতে হবে। ওই ভুতের বাড়িতে পড়াও শুনলে কোনো ভদ্র ঘরের অভদ্র মেয়েও কপালে জুটবে না বলে রাখছি।



’তা ওরা তোমাকে কেমন দেবে থোবে?’ আমি বললাম, বাবা! ওরা তো খুব গরীব। নেহায়েত গরীব ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়তে আসে। তা ওদের কোনো বাঁধা-ধরা বেতন নেই। যে যেমন পারে দেয়। দু’ টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা এই আর কি! ’ও বাবা! এ যে দেখছি রীতিমতো ভিক্ষাবৃত্তি! না, না, দরকার নেই এসব কাজের। তুমি বরং বাড়িতে আমার জামা কাপড় ইস্ত্রি করে দিও। আমি প্রত্যেকটার জন্য ৫০ টাকা করে দেব।’ বাবা বললেন, ’দেখ, তুমি আমার সম্ভ্রম নিয়ে টানাটানি করো না। এটা অর্জন করতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।’



বাবা,ওখানে মাত্র দু’জন শিক্ষক। তা একজন মারা গেছেন কয়েক দিন আগে। এখন আমি একা। ছাত্র-ছাত্রীদের ফেলে রেখে এখন তো আমি কোনভাবে আসতে পারব না।



নিকুচি করেছে তোমার শিক্ষকতার! যতসব ফকির ঘরের ছেলে মেয়ে। তাদের জন্য উনার দরদ একেবারে ছা রে গা মা পা ধা নি ছা।



একজন বিজ্ঞ মানুষ হয়ে একথা আপনি বলতে পারলেন বাবা? তারা আমাদের সমাজের অংশ। আমদের সব অর্জন উপার্জনে তাদের অংশ আছে। বাবা তার গলার টাই সোজা করতে করতে বললেন, আর কি বলব? কর, ওসব আউল-ফাউল কাজই কর। আমি শিঘ্রি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি। পৃথিবীর নিয়ম-কানুন তুমি না হয় না জান কিন্তু তোমার বউ এসে তোমাকে সেসব খুব শিখিয়ে দিতে পারবে। তখন বুঝবে নিজের রক্তের লোক ছাড়া কেউ আপন নয়।



পরদিন সকালে আমার ’ভূতের বাড়ি’তে যাওয়ার পথে ভাবলাম, এভাবে আর হবে না। আমাকে আলাদা থাকতে হবে। দরকার হলে আমি আরেকটা কাজ খুঁজে নেব। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা না থাকলে মনের স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যায়!



সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পড়িয়ে বেরলাম একটা পার্ট-টাইম কাজের আশায়। তেমন কোনো পছন্দসই কাজ পেলাম না। তবে দিন কয়েকের মধ্যে একটা ছাপাখানায় বই বাধাঁয়ের কাজ পেলাম। বাবা তাতে নিজেকে রাবণ ভেবে সংসার লঙ্কায় যত্র তত্র যা কিছু করতে থাকলেন। আমি তার মহাপ্রতাপের সামনে শুকনো খড়ের বেশি নই। একদিন পালিয়ে চলে এলাম বাড়ি থেকে। এক ঘরের একটা বাসা ভাড়া নিলাম - ভাগ্যিস মা গেছেন পটল তুলতে! না হলে আপন মনের এই স্বাধীনতাটুকু কেবল মনের আকাশে ছুটোছুটি করেই মরত, বাস্তবতার জমিনে বৃষ্টির মতো সহজ সত্য হয়ে নামত না কখনো।



অল্প দিনেই বই বাঁধায়ে আমার হাত এসে গেল। বেতনও বাড়ল। হঠাৎ একদিন বইয়ের দোকানে এসে আমি অবাক। এখানে সবাই আমাকে ’স্যার’ ’স্যার’ বলতে শুরু করেছে। দোকানের মালিক হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন। দুঃখিত স্যার! আপনি যে আমাদের বড় স্যারের ছেলে তা বুঝতে পারিনি। আসলে আমি লজ্জার মধ্যে পড়ে গেলাম! এসব দোকান-পাট সব তো আপনাদের।



আমার জানা ছিল না যে এসব দোকান ঘরের অধিকারী আমার বাবা। তার অর্থ-বিত্ত যে কী বাড়াবাড়ি রকম ফুলে ফেঁপে উঠেছে তা অনুমান করে আমার অতঙ্ক লাগল। নিশ্চয় পরের ধনে পোদ্দারি করার কায়দাটা তার রপ্ত হয়ে গেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের অগণিত অর্থগৃধ মানুষদের একজন। তাদের পিতারা সব ছিলেন অভুক্ত কৃষক গনি মিয়া। কিন্তু সুযোগের নর্দমা খুলে যাওয়ায় আজকাল তারা পান্তা-ভোগী পিতার রাজভোগী সন্তান হবার মহিমা লাভ করেছেন।



তা হোক। কেউ মহিমান্বিত হতে চাইলে তাকে রোখা দায়। তবে আমার সামান্য উপার্জনটা একেবারে পথে মারা পড়ল। অগত্যা ভাড়া বাসাটা ছাড়তে হলো। আমার আশ্রয় হলো স্যাঁতসেতে শ্যাওলা ধরা সেই ভূতের বাড়িতে। আমার বেদনায় ছাত্র-ছাত্রীরা উথলে উঠলো। বলল, কোন চিন্তা নেই স্যার। আমরা আছি আপনার সাথে।



এরই মধ্যে বাবা আমায় ডেকে পাঠালেন। দেখা হতেই বললেন, আমার সম্ভ্রম নিয়ে যতটা টানাটানি করা সম্ভব তা তো করেইছো। এবার ক্ষান্ত দাও। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো। ’তা হয় না বাবা!’ আমি বললাম, এতগুলো ছেলে-মেয়ে! এদের অনেকের বাবা নেই, অনেকের মা নেই, আবার কেউ কেউ বা সকল কূল গোত্র হারা।



’তাহলে এই তোমার শেষ কথা?’, বাবা ক্ষেপলেন। ’এখন দেখছি তোমাকে লেখাপড়া শেখানো ভুল হয়েছে আমার। আমার কয়েক লাখ টাকা খরচ করে এই আদব-কায়দা তুমি শিখেছ!’ ’বাবা, অপরাধ নেবেন না’, আমি বললাম, ’লেখাপড়া শিখেছি বলে আপনার ভুলগুলো এত সহজে চোখে পড়ছে আমার।’ ’আমার ছেলে হয়ে তুমি আমার ভুল ধরতে যাও?’ বাবা ভয়ানক চিৎকার করে উঠলেন।



একটা খারাপ কাজ খারাপই এবং একটা ভুল কাজ ভুলই তা সে যে মানুষই করুক। আপনার ছেলে হলেও আমি বুঝতে পারি আপনার এত অর্থের উৎস কোথায়? কোন বলে আপনি হয়ে উঠেছেন এত ক্ষমতাবান?



তার ক্রোধ সর্বচরাচরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তিনি হুঙ্কার দিলেন, জান তুমি আমি তোমায় ত্যাজ্য করতে পারি? তার হুঙ্কারে আমি বিনীত নিবেদন করলাম, আপনার সাথে আমার রক্তের যতটা মিল মানসিকতার অমিল ঠিক ততটা। আমি এখন আসি। একজন পরজীবী হবার থেকে আমি একটা আত্মনির্ভর ঘাস হব। ভোরের শিশির মাথায় নিয়ে মানুষকে অনুপ্রেরণা দেব। আমার মানবজন্ম তাতে স্বার্থক সমুজ্জল হয়ে উঠবে।



মাস কয়েক পর। এক বিকেল বেলা আমি আমার ছেড়া জামা সূচ চালিয়ে ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছি। হঠাৎ জোরে জোরে গাড়ির হর্নের শব্দ। একজন কোট-টাই তার এক কর্মচারী সহ হাজির। আমাদের এক ছাত্রের কান ডলতে ডলতে লাল করে ফেলেছেন। এই হারামি বাঞ্চোৎ পকেট মারবার লাগছিল! হাতে নাতে হালার পুত খাইছে ধরা, লোকটা বলে গেল, আপনি বুঝি এই সব শিখাইতাছেন? , তয় কইয়া রাকতাছি ভাতিজা, আপনের বিচ্ছু গুলানরে সামলাইয়া রাইখেন। নাইলে কইলাম খবর আছে।



যে ছাত্রটা সবার থেকে শান্ত তার এরকম অবস্থা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। তার সাথে কথা বলে বুঝলাম যে তারা আমার জামাটার করুণ হাল দেখে বিচলিত। তারা বাজারে নানান ধরনের ছোটো খাটো কাজ করে টাকা আয় করছে। ওই লোকটা ভুল বুঝে তাকে পাকড়াও করে এনেছে। ’একশ টাকা জমে গেছে স্যার’, সে বলল আমাকে।



ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না। আমি ভাবলাম, এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। এবার আয় উপার্জনের দিকটাও ভাবা দরকার। যখন সবাই আমরা এটা ভাবছি এক ছাত্রী বলল, আমরা সবাই বই বাঁধায়ের কাজ করতে পারি - আপনি আমাদের শিখিয়ে দেবেন স্যার। তার কথাটা বেশ লাগল আমার। আজ থেকে আমাদের জ্ঞানশালা আমাদের কর্মশালাও হলো। কর্মশালার জন্য লেখা হলো নতুন গান -



আমরা করব রসিকতা

যতসব ভ- প্রথা মুখোশ পরা

ভদ্রতা!



যতসব সমাজ বিমুখ আত্মমুখী

কর্মকে আর ছাড়বনা।

নিপাত যাক! নিপাত যাক!

যতসব অর্থলোভী হায়েনা।

আমরা করব রসিকতা।



আমরা করব রসিকতা

যত শত সব শঠ প্রবঞ্চক অমানুষদের;

অন্যের ধন হাতিয়ে বড়

নিগ্রহ যারা চালায় খুব -

ভাজব তাদের ব্যঙ্গের তেলে,

জ্বালাব শত বিদ্রুপ দিয়ে

সকল তাদের অসততা।

জীবন মরণ কর্ম দিয়ে

আমরা করব রসিকতা।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:১০

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অমন আর হল কই!!!

সবই যে বিত্তের তলে চাপা পড়ে গেল!

ব্যবধানটাও তাই বাড়ছে দ্রুত!!!!!

২| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:০৭

আবু সিদ বলেছেন: প্রিয় বিদ্রোহী ভৃগু, মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

৩| ১১ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৫৮

আজমান আন্দালিব বলেছেন: বেশ তো!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.