নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি অন্য সবার মতো নই। কারন আমি অন্য সবদের দলে নেই। আমার পরিচয় যে আমি ই।

আহমদ আতিকুজ্জামান

শত সহস্র শ্রেষ্ট সব স্বত্ত্বার ভীড়ে আমি কেউ ই না। ভালোবাসি ফুটবল। ফুটবল ফ্যান- এটাই সময়োপযোগী সেরা পরিচয় ধরা যেতে পারে।

আহমদ আতিকুজ্জামান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্লাব ফুটবলে ২৫ বছর ও একজন স্টিভেন জেরার্ড!

১৯ শে মে, ২০১৬ রাত ৮:৩৬



পেশাদার ফুটবলে এখন কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের ঝনঝনানি । রাতারাতি বদলে যায় গায়ের জার্সি, ড্রেসিং রুম । সেখানে একই ক্লাবে ২৫ বছর! খুব অবাক লাগে যখন আজও এমন কিছু খেলোয়াড় দেখি যারা কেবল ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা,আত্মার টানে কখনও অন্য কোথাও পা বাড়াননি । রোমার টট্টি ,মিলানের মালদিনি, বার্সার জাভি, রিয়ালের ক্যাসিয়াস, ম্যান ইউ'র গিগস ... আরও অনেকেই আছেন । এ ভালোবাসার কোন ব্যাখ্যা নেই । ইয়েস, টিল ইটস এ্যা বেটার লাভ স্টোরী দ্যান টুয়ালাইট !!



১৯৮০ সালের ৩০মে, ইংল্যান্ডের মার্সিসাইডের হুইস্টন শহরে জন্ম নেন স্টিভেন জর্জ জেরার্ড । হুইস্টন জুনিয়র ক্লাবের হয়ে ফুটবলের শুরু, সেখানেই লিভারপুলের ফুটবল স্কাউটরা তাকে প্রথম নোটিস করে । ৯ বছর বয়সে সে লিভারপুল একাডেমিতে যোগ দেয় । পরবর্তীতে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ম্যান ইউ সহ অন্য অনেক ক্লাবে ট্রায়াল দিতে থাকেন।

১৯৯৭ সালের ৫ নভেম্বর লিভারপুল তার সাথে প্রফেশনাল কনট্রাক্ট সাইন করে । এক বছর পর ২৯ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে 'ব্লাকবার্ন রোভার্সের' বিপক্ষে সাবস্টিটিউট হিসেবে প্রথমবারের মত তাকে মাঠে নামানো হয় ।সে সিজনে মোট ১৩ বার মাঠে নামার সুযোগ পায় ( ক্যাপ্টেন হ্যারি রেডন্যাপ এর জায়গায়, সেন্টার মিডফিল্ডে ) । ১৯৯৯-২০০০ সিজনে ক্যাপ্টেন হ্যারি রেডন্যাপের সাথে সেন্টার মিডফিল্ডে তাকে প্রায়ই সুযোগ দেয়া হতে থাকে । এই সিজনেই তিনি তার প্রথম গোল এবং প্রথম লাল কার্ড পান! ২০০০-২০০১ সিজনে তিনি প্রথম লাইমলাইটে আসেন । প্রায় ৫০টি ম্যাচের শুরুর একাদশে সুযোগ পান,১০টি গোল করেন এবং এফ এ কাপ, লীগ কাপ ও উয়েফা কাপ জেতেন। 'বেস্ট ইয়াং টেলেন্ট' ঘোষিত হন । পরের বছর তিনি সহ অধিনায়ক হন এবং ২০০৩ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মত লিভারপুলের অধিনায়কত্ব পান! সে বছরই ক্লাবের সাথে ৪ বছরের নতুন চুক্তি করেন । ২০০৩-০৪ সিজন লিভারপুলের ট্রফিলেস যায়, ম্যানেজার জেরার্ড হাউলার পদত্যাগ করেন । জেরার্ড সেবার প্রথম ও শেষবারের মত লিভারপুল ছেড়ে চেলসিতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন! কিন্তু নতুন কোচ রাফায়েল বেনিতেজের অনুরোধে তিনি থেকে যান ।২০০৪-০৫ সিজনে তিনি ইনজুরিতে পড়েন এবং নভেম্বরের শেষে চ্যাম্পিয়নস লীগের গ্রুপ ম্যাচে 'অলিম্পিয়াকোস'' এর বিপক্ষে ৫ মিনিটের জন্য মাঠে নেমেই উইনিং গোল করেন । যেটা তার ভাষায় তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল । ২০০৫ সালে লীগ কাপের ফাইনালে চেলসির সাথে ২-২ সমতায় থাকা ম্যাচে তার আত্মঘাতী গোলে চেলসি ৩-২ এ কাপ জিতে যায়। ২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল , এসি মিলানের সাথে জেরার্ডের শেষ মুহূর্তের গোলে ম্যাচ ৩-৩ এ সমতা । সেকেন্ড হাফে তার অসাধারণ পারফরমেন্সের কারণে ৩-০ তে পিছিয়ে থাকার পরও দল ৩-৩ এ ম্যাচ ড্র করে পেনাল্টি শুটআউটে ৩-২ গোলে ২০ বছর পর লিভারপুল চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতে । জেরার্ড হন ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ এবং সে বছর তিনি 'উয়েফা ক্লাব ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার' ট্রফি জেতেন ।এর মধ্যে চেলসি উঠে পড়ে লাগে, তাকে সপ্তাহে ১ লাখ ইউরো প্রস্তাব দেয়া হয় । লিভারপুল সিইও রিক প্যারি প্রেসে ঘোষণা দেন তাদের পক্ষে জেরার্ডকে আর আটকে রাখা পসিবল না । পরের দিনই সবাইকে অবাক করে জেরার্ড ক্লাবের সাথে ৪ বছরের নতুন চুক্তি করে!

২০০৫-০৬ মৌসুমে ৫৩ ম্যাচে তিনি ২৩ গোল করেন । ইংলিশ লীগের সমস্ত খেলোয়াড়দের ভোটে প্রথমবারের মত 'প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার' হন । ২০০৬ এ 'এফ এ কাপ' ফাইনালে তার ২ গোলের সুবাদে লিভারপুল কাপ জেতে । সেই গোলে তিনি প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এফ এ কাপ, লীগ কাপ, ইউয়েফা কাপ এবং চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে গোল করার কৃতিত্ব দেখান! ২০০৬-০৭ চ্যাম্পিয়ন লীগে চেলসিকে হারিয়ে তিন বছরের মধ্যে ২য় বার তারা ফাইনালে ওঠে যাতে মিলানের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায়। ২৮ অক্টোবর,২০০৭ ও আর্সেনালের বিপক্ষে ক্লাবের হয়ে ৪০০তম ম্যাচটি তিনি খেলেন এবং গোলও করেন । সে বছর ভিন্ন ভিন্ন পরপর ৭টি ম্যাচে গোল করে তিনি লিভারপুলের জন অলড্রিচকে ছাড়িয়ে যান! ১৩ এপ্রিল ২০০৮ এ তিনি ইপিএল এ লিভারপুলের পক্ষে ৩০০তম ম্যাচটি খেলেন (এ ম্যাচেও তিনি গোল করেন এবং ৩-১ এ লিভারপুল জিতে যায় ) । সে বছর ২১ গোল করে তিনি সতীর্থ ফার্নান্দো তোরেসের সাথে 'PFA Player of the Year' নমিনেটেড হন।২০০৮-০৯ সিজনে তিনি গ্রোয়েন ইনজুরিতে পড়েন,পরে মাঠে ফিরেই লিভারপুলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন লীগের ম্যাচে তার ১০০তম গোলটি করেন । ১০ মার্চ ২০০৯ সালে ইউরোপিয়ান ক্লাবের বিপক্ষে তার ১০০ তম ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে তার ২ গোলে লিভারপুল ৪-০ তে সে ম্যাচ জেতে । ৪ দিন পর ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার পেনাল্টিতে ম্যান ইউ'র বিপক্ষে ৪-১ এ লিভারপুল সে ম্যাচ জেতে। এ ম্যাচের পর জিদান তাকে 'বেস্ট প্লেয়ার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড' বলে অবিহিত করেন! ২২ মার্চ ২০০৯ এ এ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে তিনি ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাট্টিক করেন। ১৩মে ২০০৯ সালে রায়ান গিগসকে ১০ ভোটে পেছনে ফেলে তিনি ফুটবল রাইটার্স এসোসিয়েশন এর দেয়া 'ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার'' খেতাব জেতেন । ১৯ বছরের মধ্যে প্রথম লিভারপুল খেলোয়াড় হিসেবে তার এ কৃতিত্ব । সে বছর ৫ ডিসেম্বর তিনি লিভারপুলের হয়ে তার ৫০০ তম ম্যাচ খেলেন । ২০০৯-১০ সিজনে ৪৬ ম্যাচে ১২
গোল ও ৯টি এ্যাসিস্ট করেন ।২০০৯-১০ সিজন শেষে ৬ বছর পর রাফায়েল বেনিতেজ লিভারপুল ছেড়ে যান । নতুন ম্যানেজার রয় হজসন এসেই জেরার্ডকে 'নট ফর সোল্ড' ট্যাগ লাগিয়ে দেন । ২০১২ সালে ম্যানচেষ্টার সিটির সাথে উভয় লেগে তার গোলে ৬ বছর পর লিভারপুল ফাইনালে ওঠে যেখানে কার্ডিফ সিটিকে হারিয়ে তারা কাপ জেতে । ২০১২ সালের ১৩ মার্চ এভারটনের বিপক্ষে ডার্বিতে তার ৪০০তম লীগ ম্যাচে ক্যারিয়ারের তৃতীয় হ্যাট্টিক করেন ।২০১২ সালের ১৮ আগষ্ট লিভারপুলের ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি তার ২৫০তম ম্যাচটি খেলেন । ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই তিনি পুনরায় নতুন চুক্তিতে সাইন করেন । ৩আগষ্ট ২০১৩ সালে তার চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের জন্য অলিম্পিয়াকোসের সাথে এক ম্যাচ এ্যানফিল্ডে অনুষ্ঠিত হয় । যেখানে জেমি ক্যারাগার,রবি ফাউলার এর মতো পুরোনোরা অংশ নেন । এ ম্যাচ থেকে ৫ লাখ ইউরো সংগৃহীত হয় । এ বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন হিসেবে তার ৪০০তম ম্যাচটি খেলেন।

৫ অক্টোবর ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে ম্যাচে গোল করে প্রথম লিভারপুল খেলোয়াড় হিসেবে ১৫ মৌসুমে গোল করার কৃতিত্ব দেখান । ১৯
অক্টোবর প্রিমিয়ার লীগে তার ১০০তম গোলটি করেন। লিভারপুলের জার্সিতে ৭০৯তম ম্যাচ। অ্যানফিল্ডের রাজা মাঠে এলেন তার তিন
রাজকন্যাকে নিয়ে। রাজকন্যারা এতো ছোট যে, কারোরই বোঝার বয়স হয়নি, বাবার মনে কতখানি কষ্টের ঝড়ঝাপটা। রাজার রাজত্ব যে অবসান হোতে চললো। অ্যানফিল্ডে ক্যারিয়ারে শেষ ম্যাচের আগে-পারে দর্শক আর সতীর্থরা ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিককে যে রকম অভ্যর্থনা জানালেন, তা প্রত্যাশিতই ছিলো। তবে যেটা সবচে বেশি প্রত্যাশা করেছিলেন, সেই জয় নিয়ে অ্যানফিল্ড থেকে যেতে পারলেন না অলরেড গ্রেট। ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর লিভারপুলের হয়ে প্রথম খেলতে নেমেছিলেন স্টিভেন জর্জ জেরার্ড।মাত্র সতের বছর বয়সে। এরপর কত কিছু বদলে গেছে পৃথিবীতে, শুধু বদলায়নি জেরার্ডের অলরেড পরিচয়। ওই লাল জার্সতেই হয়েছেন বিশ্বসেরা ফুটবলারদের একজন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ জিতেছেন দশটি শিরোপা। তার সময়ে ইংল্যান্ডের অবিসংবাদিত সেরা ফুটবলার হোয়েও জিততে পারেননি কোন লিগ শিরোপা। অথচ চাইলেই হতো। ইউরোপের এমন কোনো বড় ক্লাব নেই, যারা এই মিডফিল্ডারকে দলে ভেড়াতে চায়নি। কিন্তু জেরার্ড শুধুই লিভারপুলের। লিভারপুলও জেরার্ডের। অর্থের চেয়েও একটা দলের প্রতীক হওয়া যে অনেক বড় কিছু, তা বুঝতেন তিনি। তাই অন্য যে কোন উঠতি ফুটবলারের কাছে দল অন্ত:প্রাণ হিসেবে যুগে যুগে ‘আইডল’ হয়ে
থাকবেন স্টিভি।



কেউ কেউ বলেন, শুধু লিভারপুল ফুটবল ক্লাবটিই নয়,ওই শহরটারই সবচে বড় দূত স্টিভেন জেরার্ড। সতের বছর যে অ্যানফিল্ডে কাটালেন, সেই মাঠে বিদায়ী ম্যাচে সতীর্থরা তাকে জয় উপহার দিতে পারেননি তাঁকে। ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে লিভারপুল হেরেছে ৩-১ গোলে। একটা লিগ শিরোপা না জেতার দীর্ঘ কষ্টের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটি অনন্ত দীর্ঘশ্বাস। তারপরও কারও প্রতি কোনো অনুযোগ-অভিযোগ নেই জেরার্ডের। এরকম মহৎ না হলে তিনি তো আর গ্রেট হতে পারতে না। জেরার্ডরা যুগে যুগে আসে না। লিভারপুল ভক্তরা সেটা জানেন। আর সেজন্যই তাদের কষ্টের মাত্রাটাও অনেক বেশি। বছরের পর বছর শিরোপাহীন একটা ক্লাবের জন্য অন্তহীন ভালবাসা তৈরি হয় একজন স্টিভেন জেরার্ডের জন্যই। সেই জায়গাটা কি আর কখনো পূরণ করতে পারবেন, আর কোনো অলরেড? সংশয় আছে।জেরার্ডের কাছে চিরঋণী থাকবে লিভারপুল এফসি। কিন্তু ম্যাচ শেষে আবেগে থরোথরো জেরার্ড জানালেন, লিভারপুল তাকে যা দিয়েছে, সেই ঋণ কখনো ফুরাবার নয়। বিশেষ ধন্যবাদ দিয়েছেন সতীর্থ আর ভক্তদের। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেই অ্যানফিল্ডের গ্যালারি ভরিয়ে তোলে অলরেড ভক্তরা। তাদের প্রাণপ্রিয় অধিনায়ককে যে যথাযোগ্য সম্মানে বিদায় জানাতে হবে। জেরার্ডকে যোগ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি ক্লাব কর্তৃপক্ষও। নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখবেন, সেই পণ করে নামলেও চোখে-মুখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। জীবনে অনেক পুরস্কারই পেয়েছেন লিভারপুল অধিনায়ক। তবে ক্ষুদে ভক্তের কাছ থেকে পাওয়া উপহার গোল্ডেন বুটটি নিশ্চয়ই আবেগী করেছে জেরার্ডকে। পরের মৌসুমে এলএ গ্যালাক্সিতে যোগ দেন ৩৪ বছর বয়সী মিডফিল্ডার। জানিয়েছিলেন ,খেলোয়াড় হিসাবে অ্যানফিল্ডে আর কখনোই ফিরবেন না তিনি। আগের দিনই বলেছিলেন, তিনি কাঁদবেন না। শেষ পর্যন্ত কান্না ঠেকাতে পেরেছেন। তবে অতৃপ্তি আর হাহাকার থাকবেই। ইস্তানবুলে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে রূপকথার নায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগটা অধরাই থেকে গেছে। গত বছর খুবই কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পাওয়া হয়নি। আর নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা! চেলসির সঙ্গে ম্যাচে জেরার্ড পা পিছলে পড়াতেই গোল হজম করে লিভারপুল। ওই ম্যাচে হারটাই ডুবিয়েছে লিভারপুলকে। সেই সঙ্গে অ্যানফিল্ডে শেষ ম্যাচে হার…জেরার্ড সত্যই ট্র্যাজেডির নায়ক। শেক্সপিয়রের মতো ট্র্যাজেডি লেখকও বোধ হয় এমন ট্র্যাজেডি কল্পনা করতে পারতেন না। জেরার্ডের অ্যানফিল্ড অধ্যায় ট্র্যাজিকভাবে শেষ হলেও, বর্তমান-পুরনো সতীর্থদের ভালবাসা পেয়েছেন প্রত্যাশামতোই। মারিও বালোতেল্লি প্রিয় স্টিভিকে চিঠি লিখে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন। দুজনের পুরনো একটা ছবি পোস্ট করেছেন ডেভিড ব্যাকহাম। বাদ যাননি লিভারপুল ফ্যান ডেনিস টেনিস তারকা ক্যারোলিন ওযনিয়াকিও।আর টুইটারে জেরার্ড নিয়ে ভালবাসার অক্ষরে পাখির ডাকাডাকি হয়েছে অসংখ্য। নায়ক ট্যাজেডির হোক বা সহজে সব পেয়ে যাওয়া কেউ…মানুষের ভালবাসা পান। তবে ট্র্যাজিক নায়করাই অমর হন বেশি। স্টিভেন জর্জ জেরার্ড সেই ট্র্যাজিক নায়কদের একজন।



বিদায় জানাবেন স্টিভেন জেরার্ড! শব্দগুলো টাইপ করতে করতে একটু কি হাত কাঁপছিল না? হৃদয়ের গহিনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল না ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ স্লোগান? ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেই মহাকাব্যিক ফাইনালের স্মৃতিটাও মনে পড়ারই কথা। ২০০৬ সালে এফএ কাপ জেতানো সেই গোল বা বছর তিনেক আগে এভারটনের সঙ্গে করা সেই হ্যাটট্রিকটির কথাই বা ভোলেন কী করে? স্টিভেন জেরার্ড জানেন, একদিন সবকিছুই গল্প হয়ে যাবে। একদিন না একদিন লিভারপুলের জার্সি তুলে রাখতে হবেই। কিন্তু সেই মুহূর্তটা এত কাছে এসে যাবে, সেটা কে ভেবেছিল? জানিয়ে দিয়েছিলেন, এটাই হবে লিভারপুলে তাঁর শেষ মৌসুম। তবে ফুটবলকে বিদায় জানাচ্ছেন না এখনই, খেলা চালিয়ে যাবেন অন্য কোনো ক্লাবে।পেশাদারি জগতে আবেগের ঠাঁই নেই। অশ্রুপাত এখানে মূল্যহীন, সাফল্যই মুখ্য। এর মধ্যেও জেরার্ড আশ্চর্য ব্যতিক্রম, লিভারপুলের হয়ে গোল করার পর যেমন ভেসে গেছেন উচ্ছ্বাসে, তেমনি ঠোঁট
কামড়ে চোখের জল ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছেন। ক্যারিয়ারে কত বড় বড় ক্লাবের প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু ফর্মের তুঙ্গে থাকা
অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন সবাইকে, লিভারপুলকেই করেছেন জীবনের ধ্রুবতারা। বিদায়বেলায় ক্লাবের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া চিঠিতে উপচে পড়ল তাঁর আবেগের জোয়ার, ‘এটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত। লিভারপুল ক্লাবটা আমাদের সবার
জীবনে এতটাই বিশাল জায়গা দখল করে আছে, বিদায় বলাটা খুব কঠিন। তবে আমি বলব, সবার ভালোর জন্যই এটা নিতে হয়েছে, আমার পরিবার ও ক্লাবের জন্যও বটে।’

১৯৯৮ সালে অভিষেকের পর থেকে লিভারপুল ও জেরার্ড একরকম সমার্থক। ৩৪ বছরের জীবনে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তাঁর হাতে লিভারপুল অধিনায়কের বাহুবন্ধনী, ‘স্টিভি জি’র হৃদয়ে লিভারপুল কতটা জায়গা দখল করে আছে সেটা বলবে এই কথাগুলোই,
‘আমি খেলা ছেড়ে দিচ্ছি না। তবে কোথায় যাচ্ছি সেটা এখনই বলতে পারছি না। এটুকুই শুধু বলতে পারি, সেটি বড় কোনো ক্লাব হচ্ছে না। তার মানে লিভারপুলের বিপক্ষে আমি খেলছি না, এটা তো আমার জন্য ভাবাও কঠিন।’বখেলোয়াড় হিসেবে বিদায় নিচ্ছেন, ডাগআউটে কি ফিরবেন কখনো? জেরার্ডের কণ্ঠে ‘আবার আসিব ফিরে, অ্যানফিল্ডের তীরে’ অনুরণন, ‘আমার ইচ্ছা একদিন লিভারপুলে ফেরার, সেটা ক্লাবকে যেভাবেই সাহায্য করুক।’ খেলোয়াড় হিসেবে কখনো প্রিমিয়ার লিগ জিততে না পারার যে অতৃপ্তি নিয়ে সম্ভবত যেতে হচ্ছে, কোচ হিসেবে সেটা অর্জন করতে চাইবেনই।সতীর্থরাও টুইটারে তাঁকে ভাসিয়ে দিয়েছেন প্রশংসায়। মারিও বালোতেল্লি বলছেন জেরার্ড যেকোনো কিছুই করতে পারেন। ড্যানিয়েল স্টারিজের চোখে জেরার্ড তাঁর সময়ের সেরাদের একজন। তবে কোচ ব্রেন্ডন রজার্সের কথাটা হয়তো আলাদাভাবেই মনে রাখবেন জেরার্ড, ‘এই যুগে কিংবদন্তি শব্দটা অতিব্যবহারে খেলো হয়ে গেছে। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে সেটাও যথেষ্ট নয়।’ একনজরে লিভারপুলের জেরার্ড-

★অভিষেক: ২৯ নভেম্বর, ১৯৯৮।
★প্রথম গোল: ৫ ডিসেম্বর, ১৯৯৯।
★প্রিমিয়ার লিগ ৪৯৪ ম্যাচ ১১৬ গোল।
★সব প্রতিযোগিতা ৬৯৫ ম্যাচ ১৮০ গোল।

★অর্জন-

→উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০০৫।
→উয়েফা কাপ ২০০১।
→উয়েফা সুপার কাপ ২০০১, ২০০৫।
→এফএ কাপ ২০০১, ২০০৬।
→লিগ কাপ ২০০১, ২০০৩, ২০১২।
→পিএফএ বর্ষসেরা তরুণ খেলোয়াড় ২০০১।
→পিএফএ বর্ষসেরা খেলোয়াড় ২০০৬।

জেরার্ড সম্পর্কে তাই কয়েকজন বিখ্যাত ফুটবলারের মন্তব্য তুলে ধরলাম-

" দশ বছর ধরে জেরার্ড আমার আদর্শ ছিল এবং সে বিশ্বের একজন সেরা খেলোয়াড় । বিশ্বের সকল মিডফিল্ড খেলোয়াড়দের কাছে সে একজন আদর্শ ।"

- ডেনিয়েল ডি রসি।

"আমি বিশ্বের এমন একজন স্ট্রাইকারের কথা মনে করতে পারিনা যে তার মতো এতো গুরুত্বর্পূর্ণ সব গোল করেছে ।আমার কাছে সেই লিভারপুল।"

- থিয়েরি অঁরি।

"আমি স্টিভের জেরার্ডের একজন বড় ফ্যান । তার সিংহের মত বিশাল হৃদয় আছে, এবং আক্রমনের ক্ষমতা ও ডিফেন্স করার গুণে সে একজন পরিপূর্ণ আধুনিক ফুটবলার।"

- রিকার্ডো কাকা।

" আমি খুব সহজভাবেই বলবো যে ফুটবল বোঝে এমন যাদের সাথে আমি কাজ করেছি জেরার্ডই তাদের সেরা ।"

- ব্রেন্ডন রজার্স।

" আমার কাছে, যে পজিশনে সে খেলে সেখানে
বিশ্বের একজন সেরা খেলোয়াড় সে । সে যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে খেলে আমার কাছে সে গ্রেটদের একজন।"

- রোনালদিনহো গাউচো।

" স্টিভেন জেরার্ড আমার বিশ্বসেরা স্বপ্নের দলের
ক্যাপ্টেন।"

- ফ্রান্সিস্কো টট্টি।

" সে কি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ?? মেসি এবং
রোনালদোর কারণে সে হয়তো মনযোগ পায়না কিন্তু আমি মনে সে হতে পারতো।"

- জিনেদিন জিদান।

একব্যাসন ফুটবল ফ্যান হিসেবে এটা নিশ্চিতভাবে ই বলতে পারি, একজন মানুষ ও ফুটবলার হিসেবে জেরার্ডের কোনো হেটার্স নেই।অলরেডদের হয়ে শুধু ২৫ বছর ফুটবল ই খেলেননি, জয় করেছেন লাখো-কোটি ফুটবল ভক্তের মন।সারাবিশ্বে যদি জেরার্ডের একজন মাত্র রয়্যাল ফ্যান তাকে, তাহলে আমিই সেই ফ্যান! ব্যস, আর লিখতে পারলাম নাহ!

©আহমদ আতিকুজ্জামান
পেশাদার ফুটবলে এখন কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের ঝনঝনানি । রাতারাতি বদলে যায় গায়ের জার্সি, ড্রেসিং রুম । সেখানে একই ক্লাবে ২৫ বছর! খুব অবাক লাগে যখন আজও এমন কিছু খেলোয়াড় দেখি যারা কেবল ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা,আত্মার টানে কখনও অন্য কোথাও পা বাড়াননি । রোমার টট্টি ,মিলানের মালদিনি, বার্সার জাভি, রিয়ালের ক্যাসিয়াস, ম্যান ইউ'র গিগস ... আরও অনেকেই আছেন । এ ভালোবাসার কোন ব্যাখ্যা নেই । ইয়েস, টিল ইটস এ্যা বেটার লাভ স্টোরী দ্যান টুয়ালাইট !!



১৯৮০ সালের ৩০মে, ইংল্যান্ডের মার্সিসাইডের হুইস্টন শহরে জন্ম নেন স্টিভেন জর্জ জেরার্ড । হুইস্টন জুনিয়র ক্লাবের হয়ে ফুটবলের শুরু, সেখানেই লিভারপুলের ফুটবল স্কাউটরা তাকে প্রথম নোটিস করে । ৯ বছর বয়সে সে লিভারপুল একাডেমিতে যোগ দেয় । পরবর্তীতে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ম্যান ইউ সহ অন্য অনেক ক্লাবে ট্রায়াল দিতে থাকেন।

১৯৯৭ সালের ৫ নভেম্বর লিভারপুল তার সাথে প্রফেশনাল কনট্রাক্ট সাইন করে । এক বছর পর ২৯ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে 'ব্লাকবার্ন রোভার্সের' বিপক্ষে সাবস্টিটিউট হিসেবে প্রথমবারের মত তাকে মাঠে নামানো হয় ।সে সিজনে মোট ১৩ বার মাঠে নামার সুযোগ পায় ( ক্যাপ্টেন হ্যারি রেডন্যাপ এর জায়গায়, সেন্টার মিডফিল্ডে ) । ১৯৯৯-২০০০ সিজনে ক্যাপ্টেন হ্যারি রেডন্যাপের সাথে সেন্টার মিডফিল্ডে তাকে প্রায়ই সুযোগ দেয়া হতে থাকে । এই সিজনেই তিনি তার প্রথম গোল এবং প্রথম লাল কার্ড পান! ২০০০-২০০১ সিজনে তিনি প্রথম লাইমলাইটে আসেন । প্রায় ৫০টি ম্যাচের শুরুর একাদশে সুযোগ পান,১০টি গোল করেন এবং এফ এ কাপ, লীগ কাপ ও উয়েফা কাপ জেতেন। 'বেস্ট ইয়াং টেলেন্ট' ঘোষিত হন । পরের বছর তিনি সহ অধিনায়ক হন এবং ২০০৩ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মত লিভারপুলের অধিনায়কত্ব পান! সে বছরই ক্লাবের সাথে ৪ বছরের নতুন চুক্তি করেন । ২০০৩-০৪ সিজন লিভারপুলের ট্রফিলেস যায়, ম্যানেজার জেরার্ড হাউলার পদত্যাগ করেন । জেরার্ড সেবার প্রথম ও শেষবারের মত লিভারপুল ছেড়ে চেলসিতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন! কিন্তু নতুন কোচ রাফায়েল বেনিতেজের অনুরোধে তিনি থেকে যান ।২০০৪-০৫ সিজনে তিনি ইনজুরিতে পড়েন এবং নভেম্বরের শেষে চ্যাম্পিয়নস লীগের গ্রুপ ম্যাচে 'অলিম্পিয়াকোস'' এর বিপক্ষে ৫ মিনিটের জন্য মাঠে নেমেই উইনিং গোল করেন । যেটা তার ভাষায় তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল । ২০০৫ সালে লীগ কাপের ফাইনালে চেলসির সাথে ২-২ সমতায় থাকা ম্যাচে তার আত্মঘাতী গোলে চেলসি ৩-২ এ কাপ জিতে যায়। ২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল , এসি মিলানের সাথে জেরার্ডের শেষ মুহূর্তের গোলে ম্যাচ ৩-৩ এ সমতা । সেকেন্ড হাফে তার অসাধারণ পারফরমেন্সের কারণে ৩-০ তে পিছিয়ে থাকার পরও দল ৩-৩ এ ম্যাচ ড্র করে পেনাল্টি শুটআউটে ৩-২ গোলে ২০ বছর পর লিভারপুল চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতে । জেরার্ড হন ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ এবং সে বছর তিনি 'উয়েফা ক্লাব ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার' ট্রফি জেতেন ।এর মধ্যে চেলসি উঠে পড়ে লাগে, তাকে সপ্তাহে ১ লাখ ইউরো প্রস্তাব দেয়া হয় । লিভারপুল সিইও রিক প্যারি প্রেসে ঘোষণা দেন তাদের পক্ষে জেরার্ডকে আর আটকে রাখা পসিবল না । পরের দিনই সবাইকে অবাক করে জেরার্ড ক্লাবের সাথে ৪ বছরের নতুন চুক্তি করে!

২০০৫-০৬ মৌসুমে ৫৩ ম্যাচে তিনি ২৩ গোল করেন । ইংলিশ লীগের সমস্ত খেলোয়াড়দের ভোটে প্রথমবারের মত 'প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার' হন । ২০০৬ এ 'এফ এ কাপ' ফাইনালে তার ২ গোলের সুবাদে লিভারপুল কাপ জেতে । সেই গোলে তিনি প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এফ এ কাপ, লীগ কাপ, ইউয়েফা কাপ এবং চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে গোল করার কৃতিত্ব দেখান! ২০০৬-০৭ চ্যাম্পিয়ন লীগে চেলসিকে হারিয়ে তিন বছরের মধ্যে ২য় বার তারা ফাইনালে ওঠে যাতে মিলানের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায়। ২৮ অক্টোবর,২০০৭ ও আর্সেনালের বিপক্ষে ক্লাবের হয়ে ৪০০তম ম্যাচটি তিনি খেলেন এবং গোলও করেন । সে বছর ভিন্ন ভিন্ন পরপর ৭টি ম্যাচে গোল করে তিনি লিভারপুলের জন অলড্রিচকে ছাড়িয়ে যান! ১৩ এপ্রিল ২০০৮ এ তিনি ইপিএল এ লিভারপুলের পক্ষে ৩০০তম ম্যাচটি খেলেন (এ ম্যাচেও তিনি গোল করেন এবং ৩-১ এ লিভারপুল জিতে যায় ) । সে বছর ২১ গোল করে তিনি সতীর্থ ফার্নান্দো তোরেসের সাথে 'PFA Player of the Year' নমিনেটেড হন।২০০৮-০৯ সিজনে তিনি গ্রোয়েন ইনজুরিতে পড়েন,পরে মাঠে ফিরেই লিভারপুলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন লীগের ম্যাচে তার ১০০তম গোলটি করেন । ১০ মার্চ ২০০৯ সালে ইউরোপিয়ান ক্লাবের বিপক্ষে তার ১০০ তম ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে তার ২ গোলে লিভারপুল ৪-০ তে সে ম্যাচ জেতে । ৪ দিন পর ওল্ড ট্রাফোর্ডে তার পেনাল্টিতে ম্যান ইউ'র বিপক্ষে ৪-১ এ লিভারপুল সে ম্যাচ জেতে। এ ম্যাচের পর জিদান তাকে 'বেস্ট প্লেয়ার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড' বলে অবিহিত করেন! ২২ মার্চ ২০০৯ এ এ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে তিনি ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাট্টিক করেন। ১৩মে ২০০৯ সালে রায়ান গিগসকে ১০ ভোটে পেছনে ফেলে তিনি ফুটবল রাইটার্স এসোসিয়েশন এর দেয়া 'ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার'' খেতাব জেতেন । ১৯ বছরের মধ্যে প্রথম লিভারপুল খেলোয়াড় হিসেবে তার এ কৃতিত্ব । সে বছর ৫ ডিসেম্বর তিনি লিভারপুলের হয়ে তার ৫০০ তম ম্যাচ খেলেন । ২০০৯-১০ সিজনে ৪৬ ম্যাচে ১২
গোল ও ৯টি এ্যাসিস্ট করেন ।২০০৯-১০ সিজন শেষে ৬ বছর পর রাফায়েল বেনিতেজ লিভারপুল ছেড়ে যান । নতুন ম্যানেজার রয় হজসন এসেই জেরার্ডকে 'নট ফর সোল্ড' ট্যাগ লাগিয়ে দেন । ২০১২ সালে ম্যানচেষ্টার সিটির সাথে উভয় লেগে তার গোলে ৬ বছর পর লিভারপুল ফাইনালে ওঠে যেখানে কার্ডিফ সিটিকে হারিয়ে তারা কাপ জেতে । ২০১২ সালের ১৩ মার্চ এভারটনের বিপক্ষে ডার্বিতে তার ৪০০তম লীগ ম্যাচে ক্যারিয়ারের তৃতীয় হ্যাট্টিক করেন ।২০১২ সালের ১৮ আগষ্ট লিভারপুলের ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি তার ২৫০তম ম্যাচটি খেলেন । ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই তিনি পুনরায় নতুন চুক্তিতে সাইন করেন । ৩আগষ্ট ২০১৩ সালে তার চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের জন্য অলিম্পিয়াকোসের সাথে এক ম্যাচ এ্যানফিল্ডে অনুষ্ঠিত হয় । যেখানে জেমি ক্যারাগার,রবি ফাউলার এর মতো পুরোনোরা অংশ নেন । এ ম্যাচ থেকে ৫ লাখ ইউরো সংগৃহীত হয় । এ বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন হিসেবে তার ৪০০তম ম্যাচটি খেলেন।

৫ অক্টোবর ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে ম্যাচে গোল করে প্রথম লিভারপুল খেলোয়াড় হিসেবে ১৫ মৌসুমে গোল করার কৃতিত্ব দেখান । ১৯
অক্টোবর প্রিমিয়ার লীগে তার ১০০তম গোলটি করেন। লিভারপুলের জার্সিতে ৭০৯তম ম্যাচ। অ্যানফিল্ডের রাজা মাঠে এলেন তার তিন
রাজকন্যাকে নিয়ে। রাজকন্যারা এতো ছোট যে, কারোরই বোঝার বয়স হয়নি, বাবার মনে কতখানি কষ্টের ঝড়ঝাপটা। রাজার রাজত্ব যে অবসান হোতে চললো। অ্যানফিল্ডে ক্যারিয়ারে শেষ ম্যাচের আগে-পারে দর্শক আর সতীর্থরা ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিককে যে রকম অভ্যর্থনা জানালেন, তা প্রত্যাশিতই ছিলো। তবে যেটা সবচে বেশি প্রত্যাশা করেছিলেন, সেই জয় নিয়ে অ্যানফিল্ড থেকে যেতে পারলেন না অলরেড গ্রেট। ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর লিভারপুলের হয়ে প্রথম খেলতে নেমেছিলেন স্টিভেন জর্জ জেরার্ড।মাত্র সতের বছর বয়সে। এরপর কত কিছু বদলে গেছে পৃথিবীতে, শুধু বদলায়নি জেরার্ডের অলরেড পরিচয়। ওই লাল জার্সতেই হয়েছেন বিশ্বসেরা ফুটবলারদের একজন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ জিতেছেন দশটি শিরোপা। তার সময়ে ইংল্যান্ডের অবিসংবাদিত সেরা ফুটবলার হোয়েও জিততে পারেননি কোন লিগ শিরোপা। অথচ চাইলেই হতো। ইউরোপের এমন কোনো বড় ক্লাব নেই, যারা এই মিডফিল্ডারকে দলে ভেড়াতে চায়নি। কিন্তু জেরার্ড শুধুই লিভারপুলের। লিভারপুলও জেরার্ডের। অর্থের চেয়েও একটা দলের প্রতীক হওয়া যে অনেক বড় কিছু, তা বুঝতেন তিনি। তাই অন্য যে কোন উঠতি ফুটবলারের কাছে দল অন্ত:প্রাণ হিসেবে যুগে যুগে ‘আইডল’ হয়ে
থাকবেন স্টিভি।



কেউ কেউ বলেন, শুধু লিভারপুল ফুটবল ক্লাবটিই নয়,ওই শহরটারই সবচে বড় দূত স্টিভেন জেরার্ড। সতের বছর যে অ্যানফিল্ডে কাটালেন, সেই মাঠে বিদায়ী ম্যাচে সতীর্থরা তাকে জয় উপহার দিতে পারেননি তাঁকে। ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে লিভারপুল হেরেছে ৩-১ গোলে। একটা লিগ শিরোপা না জেতার দীর্ঘ কষ্টের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেকটি অনন্ত দীর্ঘশ্বাস। তারপরও কারও প্রতি কোনো অনুযোগ-অভিযোগ নেই জেরার্ডের। এরকম মহৎ না হলে তিনি তো আর গ্রেট হতে পারতে না। জেরার্ডরা যুগে যুগে আসে না। লিভারপুল ভক্তরা সেটা জানেন। আর সেজন্যই তাদের কষ্টের মাত্রাটাও অনেক বেশি। বছরের পর বছর শিরোপাহীন একটা ক্লাবের জন্য অন্তহীন ভালবাসা তৈরি হয় একজন স্টিভেন জেরার্ডের জন্যই। সেই জায়গাটা কি আর কখনো পূরণ করতে পারবেন, আর কোনো অলরেড? সংশয় আছে।জেরার্ডের কাছে চিরঋণী থাকবে লিভারপুল এফসি। কিন্তু ম্যাচ শেষে আবেগে থরোথরো জেরার্ড জানালেন, লিভারপুল তাকে যা দিয়েছে, সেই ঋণ কখনো ফুরাবার নয়। বিশেষ ধন্যবাদ দিয়েছেন সতীর্থ আর ভক্তদের। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেই অ্যানফিল্ডের গ্যালারি ভরিয়ে তোলে অলরেড ভক্তরা। তাদের প্রাণপ্রিয় অধিনায়ককে যে যথাযোগ্য সম্মানে বিদায় জানাতে হবে। জেরার্ডকে যোগ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি ক্লাব কর্তৃপক্ষও। নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখবেন, সেই পণ করে নামলেও চোখে-মুখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। জীবনে অনেক পুরস্কারই পেয়েছেন লিভারপুল অধিনায়ক। তবে ক্ষুদে ভক্তের কাছ থেকে পাওয়া উপহার গোল্ডেন বুটটি নিশ্চয়ই আবেগী করেছে জেরার্ডকে। পরের মৌসুমে এলএ গ্যালাক্সিতে যোগ দেন ৩৪ বছর বয়সী মিডফিল্ডার। জানিয়েছিলেন ,খেলোয়াড় হিসাবে অ্যানফিল্ডে আর কখনোই ফিরবেন না তিনি। আগের দিনই বলেছিলেন, তিনি কাঁদবেন না। শেষ পর্যন্ত কান্না ঠেকাতে পেরেছেন। তবে অতৃপ্তি আর হাহাকার থাকবেই। ইস্তানবুলে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে রূপকথার নায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগটা অধরাই থেকে গেছে। গত বছর খুবই কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পাওয়া হয়নি। আর নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা! চেলসির সঙ্গে ম্যাচে জেরার্ড পা পিছলে পড়াতেই গোল হজম করে লিভারপুল। ওই ম্যাচে হারটাই ডুবিয়েছে লিভারপুলকে। সেই সঙ্গে অ্যানফিল্ডে শেষ ম্যাচে হার…জেরার্ড সত্যই ট্র্যাজেডির নায়ক। শেক্সপিয়রের মতো ট্র্যাজেডি লেখকও বোধ হয় এমন ট্র্যাজেডি কল্পনা করতে পারতেন না। জেরার্ডের অ্যানফিল্ড অধ্যায় ট্র্যাজিকভাবে শেষ হলেও, বর্তমান-পুরনো সতীর্থদের ভালবাসা পেয়েছেন প্রত্যাশামতোই। মারিও বালোতেল্লি প্রিয় স্টিভিকে চিঠি লিখে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছেন। দুজনের পুরনো একটা ছবি পোস্ট করেছেন ডেভিড ব্যাকহাম। বাদ যাননি লিভারপুল ফ্যান ডেনিস টেনিস তারকা ক্যারোলিন ওযনিয়াকিও।আর টুইটারে জেরার্ড নিয়ে ভালবাসার অক্ষরে পাখির ডাকাডাকি হয়েছে অসংখ্য। নায়ক ট্যাজেডির হোক বা সহজে সব পেয়ে যাওয়া কেউ…মানুষের ভালবাসা পান। তবে ট্র্যাজিক নায়করাই অমর হন বেশি। স্টিভেন জর্জ জেরার্ড সেই ট্র্যাজিক নায়কদের একজন।



বিদায় জানাবেন স্টিভেন জেরার্ড! শব্দগুলো টাইপ করতে করতে একটু কি হাত কাঁপছিল না? হৃদয়ের গহিনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল না ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ স্লোগান? ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেই মহাকাব্যিক ফাইনালের স্মৃতিটাও মনে পড়ারই কথা। ২০০৬ সালে এফএ কাপ জেতানো সেই গোল বা বছর তিনেক আগে এভারটনের সঙ্গে করা সেই হ্যাটট্রিকটির কথাই বা ভোলেন কী করে? স্টিভেন জেরার্ড জানেন, একদিন সবকিছুই গল্প হয়ে যাবে। একদিন না একদিন লিভারপুলের জার্সি তুলে রাখতে হবেই। কিন্তু সেই মুহূর্তটা এত কাছে এসে যাবে, সেটা কে ভেবেছিল? জানিয়ে দিয়েছিলেন, এটাই হবে লিভারপুলে তাঁর শেষ মৌসুম। তবে ফুটবলকে বিদায় জানাচ্ছেন না এখনই, খেলা চালিয়ে যাবেন অন্য কোনো ক্লাবে।পেশাদারি জগতে আবেগের ঠাঁই নেই। অশ্রুপাত এখানে মূল্যহীন, সাফল্যই মুখ্য। এর মধ্যেও জেরার্ড আশ্চর্য ব্যতিক্রম, লিভারপুলের হয়ে গোল করার পর যেমন ভেসে গেছেন উচ্ছ্বাসে, তেমনি ঠোঁট
কামড়ে চোখের জল ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছেন। ক্যারিয়ারে কত বড় বড় ক্লাবের প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু ফর্মের তুঙ্গে থাকা
অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন সবাইকে, লিভারপুলকেই করেছেন জীবনের ধ্রুবতারা। বিদায়বেলায় ক্লাবের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া চিঠিতে উপচে পড়ল তাঁর আবেগের জোয়ার, ‘এটা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত। লিভারপুল ক্লাবটা আমাদের সবার
জীবনে এতটাই বিশাল জায়গা দখল করে আছে, বিদায় বলাটা খুব কঠিন। তবে আমি বলব, সবার ভালোর জন্যই এটা নিতে হয়েছে, আমার পরিবার ও ক্লাবের জন্যও বটে।’

১৯৯৮ সালে অভিষেকের পর থেকে লিভারপুল ও জেরার্ড একরকম সমার্থক। ৩৪ বছরের জীবনে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে তাঁর হাতে লিভারপুল অধিনায়কের বাহুবন্ধনী, ‘স্টিভি জি’র হৃদয়ে লিভারপুল কতটা জায়গা দখল করে আছে সেটা বলবে এই কথাগুলোই,
‘আমি খেলা ছেড়ে দিচ্ছি না। তবে কোথায় যাচ্ছি সেটা এখনই বলতে পারছি না। এটুকুই শুধু বলতে পারি, সেটি বড় কোনো ক্লাব হচ্ছে না। তার মানে লিভারপুলের বিপক্ষে আমি খেলছি না, এটা তো আমার জন্য ভাবাও কঠিন।’বখেলোয়াড় হিসেবে বিদায় নিচ্ছেন, ডাগআউটে কি ফিরবেন কখনো? জেরার্ডের কণ্ঠে ‘আবার আসিব ফিরে, অ্যানফিল্ডের তীরে’ অনুরণন, ‘আমার ইচ্ছা একদিন লিভারপুলে ফেরার, সেটা ক্লাবকে যেভাবেই সাহায্য করুক।’ খেলোয়াড় হিসেবে কখনো প্রিমিয়ার লিগ জিততে না পারার যে অতৃপ্তি নিয়ে সম্ভবত যেতে হচ্ছে, কোচ হিসেবে সেটা অর্জন করতে চাইবেনই।সতীর্থরাও টুইটারে তাঁকে ভাসিয়ে দিয়েছেন প্রশংসায়। মারিও বালোতেল্লি বলছেন জেরার্ড যেকোনো কিছুই করতে পারেন। ড্যানিয়েল স্টারিজের চোখে জেরার্ড তাঁর সময়ের সেরাদের একজন। তবে কোচ ব্রেন্ডন রজার্সের কথাটা হয়তো আলাদাভাবেই মনে রাখবেন জেরার্ড, ‘এই যুগে কিংবদন্তি শব্দটা অতিব্যবহারে খেলো হয়ে গেছে। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে সেটাও যথেষ্ট নয়।’ একনজরে লিভারপুলের জেরার্ড-

★অভিষেক: ২৯ নভেম্বর, ১৯৯৮।
★প্রথম গোল: ৫ ডিসেম্বর, ১৯৯৯।
★প্রিমিয়ার লিগ ৪৯৪ ম্যাচ ১১৬ গোল।
★সব প্রতিযোগিতা ৬৯৫ ম্যাচ ১৮০ গোল।

★অর্জন-

→উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০০৫।
→উয়েফা কাপ ২০০১।
→উয়েফা সুপার কাপ ২০০১, ২০০৫।
→এফএ কাপ ২০০১, ২০০৬।
→লিগ কাপ ২০০১, ২০০৩, ২০১২।
→পিএফএ বর্ষসেরা তরুণ খেলোয়াড় ২০০১।
→পিএফএ বর্ষসেরা খেলোয়াড় ২০০৬।

জেরার্ড সম্পর্কে তাই কয়েকজন বিখ্যাত ফুটবলারের মন্তব্য তুলে ধরলাম-

" দশ বছর ধরে জেরার্ড আমার আদর্শ ছিল এবং সে বিশ্বের একজন সেরা খেলোয়াড় । বিশ্বের সকল মিডফিল্ড খেলোয়াড়দের কাছে সে একজন আদর্শ ।"

- ডেনিয়েল ডি রসি।

"আমি বিশ্বের এমন একজন স্ট্রাইকারের কথা মনে করতে পারিনা যে তার মতো এতো গুরুত্বর্পূর্ণ সব গোল করেছে ।আমার কাছে সেই লিভারপুল।"

- থিয়েরি অঁরি।

"আমি স্টিভের জেরার্ডের একজন বড় ফ্যান । তার সিংহের মত বিশাল হৃদয় আছে, এবং আক্রমনের ক্ষমতা ও ডিফেন্স করার গুণে সে একজন পরিপূর্ণ আধুনিক ফুটবলার।"

- রিকার্ডো কাকা।

" আমি খুব সহজভাবেই বলবো যে ফুটবল বোঝে এমন যাদের সাথে আমি কাজ করেছি জেরার্ডই তাদের সেরা ।"

- ব্রেন্ডন রজার্স।

" আমার কাছে, যে পজিশনে সে খেলে সেখানে
বিশ্বের একজন সেরা খেলোয়াড় সে । সে যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে খেলে আমার কাছে সে গ্রেটদের একজন।"

- রোনালদিনহো গাউচো।

" স্টিভেন জেরার্ড আমার বিশ্বসেরা স্বপ্নের দলের
ক্যাপ্টেন।"

- ফ্রান্সিস্কো টট্টি।

" সে কি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ?? মেসি এবং
রোনালদোর কারণে সে হয়তো মনযোগ পায়না কিন্তু আমি মনে সে হতে পারতো।"

- জিনেদিন জিদান।

একব্যাসন ফুটবল ফ্যান হিসেবে এটা নিশ্চিতভাবে ই বলতে পারি, একজন মানুষ ও ফুটবলার হিসেবে জেরার্ডের কোনো হেটার্স নেই।অলরেডদের হয়ে শুধু ২৫ বছর ফুটবল ই খেলেননি, জয় করেছেন লাখো-কোটি ফুটবল ভক্তের মন।সারাবিশ্বে যদি জেরার্ডের একজন মাত্র রয়্যাল ফ্যান তাকে, তাহলে আমিই সেই ফ্যান! ব্যস, আর লিখতে পারলাম নাহ!

©আহমদ আতিকুজ্জামান

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.