নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনোয়ার কামাল

আনোয়ার কামাল

আমি কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ,বই ও লিটলম্যাগ আলোচনা লিখে থাকি । ‘এবং মানুষ’ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করি। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ব্লগারের অনুমতি ছাড়া কোন লেখা কপি করে অন্য কোথাও ছাপানো নিষেধ।

আনোয়ার কামাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

হত্যা করে মুক্তচিন্তা রোধ করা যায় না

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:২৬

একুশে বইমেলায় রিসি দলাই সম্পাদিত ‘সরলরেখা’ পত্রিকায় ‘হত্যা বনাম মুক্ত চিন্তা’ বিষয় নিয়ে প্রকাশিত সংখ্যায় আমার নিচের লেখটি ছাপা পেয়েছে।বন্ধুদের পড়ার সুবিধার্থে দেয়া হলো।
হত্যা করে মুক্তচিন্তা রোধ করা যায় না
আনোয়ার কামাল
মুক্তচিন্তার মানুষ যুগ যুগ ধরে জন্ম নেবে। এদের রোধ করা যাবে না। পৃথিবীর আদিকাল থেকেই সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকে তার চিন্তার স্ফুরণ ঘটানোর জন্য স্ব-স্ব মস্তিষ্কে কিছু জায়গা খালি রেখেছেন, যা থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে আসে। অন্যদের মাঝে তার চিন্তার বা ভাবনার খোরাক শেয়ার করার জন্য, ছড়িয়ে দেয়। সে যদি তার নিজস্ব মতবাদ ছড়াতে চায় তাকে আপনি আপনার মতবাদের জোরালো বা শাণিত যুক্তির সামনে দাঁড় করিয়ে প্রমাণ করেন, তার যুক্তিকে খণ্ডন করেন। আপনার যুক্তিতে তাকে পরাস্ত করেন। আর যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি কাপুরুষ। যুক্তিকে আপনি ভয় পান। যুতসই যুক্তি দিয়ে আপনার মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার মতো যুক্তি আপনার ধড়ে নাই, যে কারণেই আপনি গোপনে আড়ালে আবডালে থেকে গুপ্ত হত্যা করছেন। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তার আশরাফুল মখলুকাতের বিচার করার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আর কিছু নাদান না বুঝে, না জেনে ধর্মের নামে অধার্মিক সুলভ আচরণ করছেন। এর জন্য নিশ্চয় আপনার সৃষ্টিকর্তা আপনাকেও সওয়ালের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন।
আমরা ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেখতে পাই বিভিন্ন ব্লগে বা পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন এমন ব্যক্তিদের নাস্তিক নাম দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যারা প্রকৃত মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত নির্ভিক সৈনিক ছিলেন। তারা বিভিন্ন ব্লগে বা পত্র পত্রিকায় তাদের মুক্তচিন্তার মতামত লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। অন্যদের ভাবনার জায়গায় টোকা দিয়েছেন। সেটা এক ধরনের মূর্খ-নাদানদের চরম অপছন্দের তালিকায় থাকা কয়েকজনকে চরম নির্মমতায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা এ কাজটি করেছে, তারা মনে করে তাদের উপর ন্যস্ত ঈমানী দায়িত্ব পালন করছে। এই মুক্তচিন্তার বা প্রগতিশীল চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়ে যুব সমাজকে অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধারণা নিয়ে যিনি কাজটি শুরু করেছিল, তিনি হলেন সোমেন চন্দ। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে প্রথম মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল কর্মীদের হত্যার কাজটি শুরু হয়েছিল।
১৯৩৬ সালে ভারতবর্ষের লক্ষৌ প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীরা সমবেত হয়ে পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেরা সংগঠিত হয়ে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’ গঠন করেন। সেই সময়পর্বে সারা দুনিয়ার প্রগতিশীল, মুক্তি ও মানবতার পক্ষের লেখক-শিল্পীরা এক পতাকায় মিলিত হতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পূর্ববাংলার লেখক-শিল্পীদেরকেও আলোড়িত করে। ১৯৩৬ সালের শেষের দিকে ঢাকায় ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ এর শাখা খোলার জন্য সাহিত্যিক সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে এভাবেই ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে ঢাকা জেলা ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র প্রথম সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে গেণ্ডারিয়া হাই স্কুল মাঠে সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সেই কমিটিতে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর সংগঠক কাজী আব্দুল ওদুদকে সভাপতি, রণেশ দাশগুপ্তকে সম্পাদক এবং সোমেন চন্দকে সহ-সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
১৯৪১ সালের অক্টোবর সদরঘাটের নিকটবর্তী ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ ঢাকা জেলা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সোমেন চন্দ সংগঠনের সম্পাদক নির্বাচিত হন। সোমেন চন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমে অল্প দিনের মধ্যেই ‘ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমত গড়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করেন। তাই সোমেন চন্দকে ফ্যাসিস্টরা সনাক্ত করে হত্যার জন্য এবং ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ এই প্রগতিশীল লেখককে ফ্যাসিস্ট শক্তির লেলিয়ে দেয়া ভাড়াটিয়া গুণ্ডাবাহিনী হত্যা করে। সোমেন চন্দের বিষয়টি এই কারণেই অবতারণা করলাম যে, সেই থেকে শুরু হয়েছে মুক্তচিন্তক ও প্রগতিশীল লেখকদের হত্যার নীলনকশা, যা এখনো পর্যন্ত তাদের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। মুক্তচিন্তকদের ব্লগার বা নাস্তিক নাম দিয়ে প্রথমেই ধর্মে অতিশয় কাতর ব্যক্তিদের মগজে বিরূপ ধারণা দেয়া হয়। তাদের পরকালে বেহেশতে যাওয়ার আশায় এসব মুক্তচিন্তকদের হত্যা করার পরামর্শ দেয়া হয়। আসলে তারা সঠিক কাজটি করছে কিনা! বা যাকে হত্যা করছে সে কতটুকু অপরাধী বা তার দ্বারা সমাজে কতটুকু ক্ষতি সাধিত হলো, তা তারা কিন্তু আদপেই জানে না। তারা কেবলমাত্র ধারণা করে যে, ঈমানী দায়িত্ব পালন করবার জন্য টার্গেট করে এদের হত্যা করছে বা সিনিয়রদের দেয়া তালিকা অনুয়ায়ী ঈমানী দায়িত্ব পালন করছে; এর বেশি আর কিছুই তারা জানে না। তারা একে অপরকে চেনে না জানে না। যারা ধরা পড়ছে তাদের জবানীতে পুলিশি জেরার সুবাদে এসবই জানা যাচ্ছে।
বর্তমানে দুনিয়াজুড়ে ফ্যাসিস্ট ও উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠির উদ্ভব হয়েছে। ধর্মকে পুঁজি করে নানান ছলছুতোয় তারা প্রগতিশীল লেখক ও মুক্তচিন্তক ব্যক্তিবর্গকে লক্ষ্য করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয়েছে মুক্তচিন্তার লেখক ব্লগার রাজীব হায়দারকে। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যুব সমাজ একাট্টা হয়ে শাহবাগে সমবেত হয়েছিল, গড়ে তুলেছিল গণজাগরণ মঞ্চ; ঠিক সেই সময়ই ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসার কাছেই তাকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালে টিএসসির সন্নিকটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে প্রকাশ্যে প্রধান সড়কে অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রীকে কুপিয়ে যখম করা হয়। অভিজিৎ রায় ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, আর তার স্ত্রী গুরুতর জখম হয়ে প্রাণে বেঁচে যান। সে এখন আমেরিকায় বসবাস করছেন। অভিজিৎ বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক ছিলেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রাণের টানে ছুটে আসেন সুদূর আমেরিকা থেকে অভাগা এ দেশে। যার পরিণতিতে তাকে জীবন দিতে হলো প্রিয় মাতৃভ‚মিতে। তার অপরাধ সে মুক্তচিন্তক, বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তাশীল কর্মকাণ্ড ব্যাপৃত ছিলেন। বিজ্ঞানের নানান যুক্তি উপস্থাপন করতেন সহজ সরল ভঙ্গিতে। এরপর ২০১৫ সালে এক এক করে আরো তিনজন মুক্তচিন্তার তরতাজা যুবকদের হত্যা করা হলো। গত ৩০ মার্চ ওয়াসিকুর রহমান বাবুকে তেজগাঁওয়ে দিবালোকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অপরদিকে অনন্ত বিজয় দাসকে ১২ মে সকালে দিবালোকে একই স্টাইলে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। নীলাদ্রি চ্যাটার্জিকে ৭ আগস্ট দুপুরে নিজ বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। সর্বশেষ ৭ নভেম্বর জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই দিন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদ রশীদ টুটুল, ব্লগার ও প্রকৌশলী তারেক রহিম, কবি ও ব্লগার রণদীপম বসুকে হত্যার লক্ষ্যে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। এ লেখা ছাপা হতে হতে আরো হয়তো কেউ হারিয়ে গেলে তাতে আশ্চর্য হবার কোন অবকাশ থাকবে না। এসব হত্যার ধরণ যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে দেখা যাবে সবগুলো হত্যার স্টাইল একই। তাহলে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায়, যারা এসব ঘটাচ্ছে তারা একই গোষ্ঠীর বা একই গুরুর শিষ্য। এছাড়া অব্যাহতভাবে তারা হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী, সংগঠক, শিক্ষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের।
এ ধরনের হীণ জঘন্যতম কর্মকাণ্ড নিয়ে পত্রপত্রিকাতেও লেখালেখি হচ্ছে। এমন একটি লেখা থেকে কিঞ্চিত উদ্ধৃতি দিলাম। “স্বচ্ছলতার জীবন বন্ধক রেখে একটা জীবন ঘোরতর সংকটের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার উৎকট খেয়াল এই সমাজের একদল লোকের মধ্যে আছে। দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে ভাংচুর হাড়-পাঁজর নিয়েও শৈল্পিক উচ্চারণে যারা বলতে পারেন সমাজে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ঋষিসুলভ এই নৈব্যক্তিক উচ্চারণ সমাজের চতুর লোকেরা বুঝবেন, আজকের কৌশলী দিনে এটা অন্যায় আশা।” ‘‘জীবন উপভোগের অনন্ত উপকরণ কতভাবেই না ছড়িয়ে আছে চারপাশে। আরাম-আয়েশ, বিলাস-ব্যসনের সেসব চকচকে জিনিস ছেড়ে কে আর হৃদয় খুঁড়ে শুধু বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। নিশ্চয় একদল লোক বাসে। তারা হৃদয় খুঁড়ে বেদনাই জাগায় না, চাপাতি আর গুলির আঘাতে মৃত্যুও ডেকে আনে। কেউ হয়তো লেখার মাধ্যমে ইতিহাসের দুর্গম খনি খুঁড়ে একাত্তরের গৌরবদীপ্ত মণিমাণিক্য তুলে আনার দায়ে জীবন দিচ্ছেন। কেউ জীবন দিচ্ছেন নিছক বিজ্ঞানের সঙ্গে থাকার অপরাধে। লেখার বিষয়-ভাবনার ভিন্নতার জবাব লেখা দিয়ে দিতে হবে- এই আপ্তবাক্য এখন ক্লিশে। পরিষ্কার হয়েছে লেখার জবাব চাপতি।” (আত্মঘাতি বিভাজন নয়, দরকার প্রজ্ঞার প্রসার, জয়া ফারহানা, উপসম্পাদকীয়, সমকাল ১৮ নভেম্বর ২০১৫)।
জঙ্গিবাদ এখন কোন একটি বা দুটি দেশের বিষয় নয়, বিষয়টি কেবলমাত্র কোন একটি সীমান্ত ঘিরে নয়। একক কোন দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জাতীয় থেকে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন দেশে দেশে জঙ্গিদের তাণ্ডবলীলা সংঘটিত হচ্ছে। প্যারিসের ঘটনা সারা বিশ্বকে শিউরে দিয়েছে। একদিন সবাই ভুলে যাবে এ ঘটনাকে। কিন্তু প্যারিসের এ বর্বরোচিত হামলা মানুষের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তা কোনদিনই শুকোবে না।
বাংলাদেশের যে চিরায়ত ঐতিহ্য, বিশ্বের তাবদ মানুষের কাছে আমাদের যে সহজিয়া পরিচিতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ হিসেবে আজ আমরা সারা বিশ্বে যে মাথা উঁচু করে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমরা বীরের জাতি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের আপমার জনতা জীবন বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাকে হেয় করবার জন্য, ধাক্কা দেয়ার জন্য, তার মূলে চপেটাঘাত করবার জন্য এ ধরনের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহল ধারণা পোষণ করেন। ইসলাম জঙ্গিবাদকে কখনো আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। সংখ্যালঘুদের হেফাজতকারী ধর্ম ইসলাম। আজ এ কথাগুলো যেন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। আজ ইসলামের নামে একটি গোষ্ঠী আমাদের প্রিয় ধর্মকেই যেন প্রশ্নের সন্মুখিন করছেন, এখন অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামকে ভিন্ন চোখে দেখছে। যা ইসলাম ধর্মের জন্য চরম লজ্জাজনক।
ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন হত্যাকারী সন্দেহে ধরা পড়েছে। তারা জবানবন্দিতে বলেছেন, তাদেরকে টার্গেট বলে দেয়া হয়। লোকেশন এবং ব্যক্তিকে চিনিয়ে দেয়া হয়। আর তোতাপাখির মতো শিখিয়ে দেয়া হয়, চিহ্নিত ব্যক্তি ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, কাজেই তাকে কতল করতে হবে। কি লিখেছে! কি বলেছে! এসব তারা আদৌও জানার চেষ্টা করে না। কেবলমাত্র হুকুম তামিল করার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাদের বলে দেয়া হয় ব্লগার! ব্লগার মানে জঘন্য, খারাপ, ধর্মবিরোধী, নাস্তিক। এদের হত্যা করতে হবে। এসবই নাকি তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়। যা আমরা রিমান্ডের ভাষ্য হিসেবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য পড়ে জানতে পারি। যাদের দিয়ে এসব অপকর্ম করানো হচ্ছে তারা আদৌও জানতে পারলো না ব্লগার কথার অর্থ কি? ব্লগে কি লেখা হয়। যারা ধর্মীয় চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন তারাও যে ব্লগে লিখে থাকেন তা এসব নির্বোধরা কস্মিৎকালেও জানতে পারবে না। আজ যেমন এদের ‘ব্লগার’ বলে গালি দেয়া, হত্যা করানো শেখানো হচ্ছে, হয়তো এমন একদিন আসবে যখন এমএ পাশ, বিএ পাশ করা লোককেও ব্লগারদের মতো গাল-মন্দ করা হবে। হত্যা করা হবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই। এই নাদান মূর্খরাতো বাংলা-ইংরেজি কিছুই পড়েনা। পড়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। তাই তাদের কাছে ‘ব্লগ’ কি তা জানার অবকাশ কোথায়!
শাসকগোষ্ঠির সব ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আপন মত প্রকাশ করেছিলেন খনা, কাঙাল হরিনাথ, লালন সাঁই কিংবা আরজ আলী মাতুব্বর তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে মতপ্রকাশে ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ী। তেমনি আমরা দেখতে পাই বর্তমান সময়ের সাহসী লেখক-মুক্তচিন্তক রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াসিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস ও নীলাদ্রি চ্যাটাজিকে। নীলাদ্রি বার বার তার নিরাপত্তা চেয়েছে, পুলিশের কাছে জিডি করতে গেছে। সংবাদপত্রে জানা যায়, পুলিশ তার জিডি না নিয়েই তাকে বিদেশ চলে যেতে বলেছে। হায়রে স্বাধীন দেশ! তাহলে কি মুক্তচিন্তকরা পালিয়ে বেড়াবে, দেশ ত্যাগ করে বিদেশ পাড়ি দেবে! আজ এ প্রশ্নটি স্পষ্টভাবে সামনে চলে এসেছে। রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের জান-মালের হেফাজত করা। রাষ্ট্র এ সব মুক্তচিন্তকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আরো একজন প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ হুমকির মুখে দেশ ত্যাগ করে জার্মানী যেতে বাধ্য হয়েছে। এখানে উল্লেখ করবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকেও একই কায়দায় টিএসসির কাছে বই মেলা চলাকালে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কাজেই এরা সবাই একই গোত্রের লোক এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসে জন্ম নিতেই পারে।
‘ব্লগ’ কি? এখানে কি হয়? এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে-ব্লগ “কোন প্রকার ওয়েবসাইট? নাস্তিকের ওয়েবসাইট?” নাস্তিকতা নিয়ে ব্লগিং করে ব্লগার হিসেবে খ্যাতি পেতে গিয়ে খুন হয়েছে বা হচ্ছে। এ ধরণের একটা সস্তা ধারণা বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক শ্রেণির সচতুর ধর্ম লেবাসধারী। সেহেতু আপনার মনে এই প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক যে, সব ব্লগাররা কি নাস্তিক! অথবা ব্লগার নাম মাত্রই সবাই নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী। না, মোটেই না। আপনারা যারা ফেসবুকে লিখছেন, পত্র-পত্রিকায় লিখছেন ঠিক তেমনি লেখার একটি ওয়েব পেজ হচ্ছে ‘ব্লগ’। আর যারা এখানে লেখেন তারাই ব্লগার । সে লেখা হতে পারে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, রাজনৈতিক কলাম, যে কোন বিষয়ের আলোচনা, মুক্তচিন্তা বা মতামত প্রভৃতি। সেখানে কেউ ধর্ম নিয়ে লিখতে পারে। সমাজ, জাতি, প্রগতি, অন্ধত্ব, মূর্খতা সবই লেখা যেতে পারে। ধর্মের নানা কল্যাণকর দিকগুলো নিয়ে মন্তব্য প্রতিবেদনমুলক লেখা যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। এখানে প্রচুর ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের কল্যাণে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে মানুষকে ধর্মের প্রতি গভীর মনোনিবেশ করার জন্য আহবান জানিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। অপরদিকে কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ধর্মের নানান দিক নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখেন। এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তার জন্য ঢালাওভাবে ‘ব্লগ’ বা ব্লগারদের কটাক্ষ করে আক্রমণ করা কক্ষনো সমীচীন হবে না। হওয়া উচিৎ না।
আপনি চাইলে এখানে প্রযুক্তি, কাব্য, উপন্যাস, গল্প, প্রতিদিনের বিভিন্ন আপডেট কিছু কিংবা নিজের যা মনে চায় তা লিখতে পারেন। আপনাকে কেউ বাধা দেবে না। আপনি যদি ফটোগ্রাফার হন তাহলে আপনার সকল ছবি আপনার ব্লগে আপলোড দিয়ে সবার জন্যে উন্মুক্ত করতে পারেন, এটাও ব্লগিং এর মধ্যে পরে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের অনেক অনলাইন নিউজ পেপারও এক একটা ‘ব্লগ’। অর্থাৎ ‘ব্লগ’ হচ্ছে এমন এক উন্মুক্ত প্লাটফর্ম যেখানে আপনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা শেয়ার করতে পারবেন এবং সেখানে সকলে মতামতও প্রকাশ করতে পারবে। সকলের মতামতের প্রতিফলন সেখানে প্রস্ফুটিত হবে, প্রতিফলিত হবে এতে কোন বাধা নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ব্লগিং করে আমাদের মস্তিষ্কে ‘ব্লগ’ এবং ‘নাস্তিক’ এই দুটি শব্দকে এক করে ফেলেছে, তাই আমাদের ব্লগিং শব্দটা শুনলে মনে মনে শুরু হয়ে যায় গোলযোগ এবং কেউ ব্লগার শুনলেই প্রথমেই যে কথাটা মাথায় নিয়ে নেয় সেটা হচ্ছে সে ব্যাক্তি একজন নাস্তিক! একটি ভ্রান্ত ধারণা অনেককে কুরে কুরে খাচ্ছে।
অপর দিকে স্বভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন আসতে পারে ব্লগ কি নাস্তিকের জন্যে? নিশ্চয় না। অবশ্যই না। এক শ্রেণীর অপতৎপরতায় লিপ্ত কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠি ব্লগে লেখালিখিকে নাস্তিকদের লেখার স্থান বলে সরলীকরণ ব্যখ্যা দেন। আর ধুয়ো তুলে পরিবেশ বিষাক্ত করে তোলেন। এতে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হীন অর্থে ব্যবহার করার খায়েস পূরণ হয় খানিকটা। যাই হোক তার উত্তরটা হলো- না, ‘ব্লগ’ এ ব্লগিং করা শুধু নাস্তিকের জন্যে সীমাবদ্ধ না। আস্তিক-নাস্তিক যেই হোন না কেন, প্রত্যেকেই লিখতে পারেন ব্লগে। প্রত্যেকের লেখার সমান সুযোগ রয়েছে। কেউ ধর্মীয় চিন্তাকে আঘাত করলে তার বিরুদ্ধে দেশে প্রচলিত আইন রয়েছে। তাকে আইনের আওতায় আমরা আনতে পারি। তার যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্য পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করতে পারি, এবং ইসলাম ধর্মে তাই বলাও হয়েছে। সহনশীলতা, ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করে প্রতিপক্ষকে আঘাত নয় যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে পরাস্ত করতে পারি। তা না করে সরাসরি তাকে হত্যা করা, ধর্ম কি সমর্থন করে? একজন মানুষের পাপ-পূণ্যের হিসাব করবার জন্য মহান আল্লাহ্ তাআলা তার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আর আমি আপনি বুঝে, না বুঝে, সজ্ঞানে-অজ্ঞানে তার মুণ্ডুনিপাত করছি। হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে মনে করছি, এটা করতে পারলেই আমার জন্য পরকালে বেহেশত্ অবধারিত! সত্যিই নির্মম এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠের দিকে আমাদের একটি শ্রেণি ধাবিত হচ্ছে। তাদের প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে, ধর্মের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত করে সুপথে ফিরিয়ে আনতে পারি। নইলে কিছু যুবক ধর্মের অপব্যাখ্যায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রকৃত ধার্মিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়বে। তাদের অচিরেই ফিরিয়ে আনতে হবে, নইলে এর পরিণাম ভয়াবহতম হতে পারে। আর এ কাজটি কেবল পারেন কবি, সাহিত্যিক,সাংবাদিক, মুফতি, মসজিদের ইমাম আর ইসলামী চিন্তাবীদরা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.