নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

অর্ক

...

অর্ক › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার বন্ধু সুরাজ নামদেভ

০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ২:০৩



ওর সাথে আমার পরিচয় মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিভাজি টার্মিনাস (সি এস টি) রেল স্টেশনে। 'ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স', বা 'ইন্ডিয়া গট ট্যালেন্টস' এমন কোনও একটা নাচের ভারতীয় রিয়েলিটি টিভি শোতে অংশগ্রহণের জন্য অডিশন দিতে এসেছিল ও মুম্বাইয়ে। সেটাই ওর সেখানে প্রথমবার আসা। আমার মতোই একেবারে নতুন মায়া নগরীতে। ওর বাড়ি ভারতের ছত্তিসগড়ে। বছর বিশেকের যুবক। বয়সে বেশ ছোট আমার থেকে। মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে ওর সাথে পরিচয় হয়। টিকিট কাউন্টারের সামনে বসে ও ওর স্মার্টফোন চার্জ দিচ্ছিল নির্ধারিত পোলে। আমিও কোথাও থেকে এসে, স্মার্টফোনের চার্জ শেষ হওয়ায় কিছুক্ষণের জন্য সেখানে আরেক সকেটে ফোন চার্জ দিচ্ছিলাম। বেশ রাত তখন। সেখানেই পরিচয় হয় ওর সাথে। এভাবে এক কথা, দু'কথায় ধীরে ধীরে দারুণ আড্ডা জমে গেল দুজনের। একে একে অনেক কথা বলা হলো। গল্প গল্প আর গল্প। রাত বেড়ে চললো। এভাবে এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম, আমরা পরস্পরের বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি। সত্যি সেদিন সি এস টি'র মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে সুরাজের সাথে গল্পগুজব করে আমার এতো ভালো সময় কেটেছিল যে ভুলেই গিয়েছিলাম রাত তখন প্রায় ভোরের কাছাকাছি চলে এসেছে। সহজ সরল একেবারে মাটির মানুষ সুরাজ নামদেভ। শিশুর মতো পবিত্র ওর মন। গল্পগুজবে পরস্পরের অনেককিছু জানা হলো।
সুরাজের অডিশন ছিল মুম্বাই ফিল্ম সিটিতে। দুদিন আগেই আমি ট্রেনে গিয়েছিলাম সেখানে। 'বিনা অনুমতিতে ভিতরে প্রবেশ করলে পুলিশ কর্তৃক আটক, থানায় সোপর্দ, পরবর্তীতে মামলা, জেল জরিমানা', ঢোকার মুখে দরজায় ইত্যাদি লেখা সাইনবোর্ড দেখে ফিরে এসেছিলাম। কী সর্বনাশা কথাবার্তা বাবা! বিদেশ বিঁভুইয়ে একবার জেলে ঢুকলে আবার কবে বেরোবো ঠিক নেই! মানেমানে কেটে পড়েছিলাম সেখান থেকে। পাঁচশ একর আয়তনের ফিল্ম সিটি আমার আর দেখা হলো না। বেকার শুধু ইতিউতি ঘুরে বেড়ালাম! না, পুরোটাই বেকার গেল না অবশেষে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমি তখন সুরাজকে বুঝিয়ে বললাম, 'সুরাজ তুমি এখান থেকে ফিল্ম সিটি যেতে পারবে না। পারলেও দুতিনবার ট্রেন বদল করতে হবে। তোমাকে চার্চগেট যেতে হবে, একমাত্র ওখান থেকেই সরাসরি বোরিভালি'র (মুম্বাই ফিল্ম সিটি বোধহয় বোরিভালিতে অবস্থিত, না হলেও ওখান থেকেই যেতে হয়। দুঃখিত অতো পুঙ্খানুপুঙ্খ আজ আর মনে নেই!) ট্রেন পাওয়া যায়। তোমাকে ওখান থেকেই যেতে হবে।'
সুরাজ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা, রাজি হলো। এভাবে চা কফি খেতে খেতে, গল্পগুজব করে সি এস টি'তে ঘোরাঘুরি করতে করতে, রাত ভোরের কাছাকাছি চলে এলো। আমি তখন সুরাজকে বললাম, 'চলো বেরিয়ে পড়ি চার্চগেটের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে বেশ খানিকটা দূর। হাঁটতে হবে। এতো রাতে গাড়িঘোড়া তো আর পাবো না!'
ও রাজি হলো। দুই বন্ধু সেই মাঝরাতেই বেরিয়ে পড়লাম চার্চগেটের উদ্দেশ্যে। আনুমানিক রাত তিনটা সারে তিনটা বেজে থাকবে সেসময়। এর আগে বেশ কয়েকবার সি এস টি, চার্চগেট যাওয়া আসা করেছি বাসে। দেখতাম খুব অল্প সময়েই গন্তব্যে চলে আসতাম। ভেবেছিলাম হেঁটেও হয়তো তেমন একটা দূর হবে না। কিন্তু পথে নেমে বুঝলাম কী ভুল ছিল আমার ধারণা! হাঁটছি হাঁটছি তো হাঁটছিই! কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। দুয়েকজন মানুষ, নাইট গার্ড একে ওকে বারবার জিজ্ঞেস করে পথ জেনে নেই। সবাই পথ দেখিয়ে দেয় আর বলে, 'এখান থেকে আরও অনেকদূর।' যাই হোক হাঁটা ছাড়া তখন সেই মধ্যরাতে আর কোনও উপায়ও নেই। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিটের মতো হেটে আমরা অবশেষে চার্চগেট স্টেশনে পৌঁছোলাম। আমি হলপ করে বলতে পারি, সুরাজ সারা রাস্তা আমাকে গালিগালাজ করতে করতে এসেছিল, ওকে অহেতুক এভাবে হাঁটানোর জন্য। এমনিতে নৃত্য শিল্পীরা যেমন হয়ে থাকে, ওর চেহারাও বেশ শুকনো ও রূগ্ন। পঞ্চাশ মিনিট হাটার পরে দেখলাম বেচারার অবস্থা খুবই করুণ! কেমন ফ্যালফ্যাল করে অবাক চোখে দেখতে লাগলো আমাকে! আমি নিজেও ঠিক বুঝিনি চার পাচ মিনিটের বাসের পথ হাটতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট লেগে যাবে! আর আমার আরও ধারণা ছিল, চার্চগেট স্টেশনও বোধহয় সি এস টির মতো চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। কিন্তু এখানেও আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল। দেখলাম, স্টেশন তখনও খোলেইনি। আশেপাশে কেউ নেই, বাইরে শুধু একজন চা'য়ালা তার ভ্রাম্যমাণ দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরও দুয়েকজন খদ্দের সেখানে দাঁড়ানো। চা চড়ানোই ছিল চুলায়। কিছুক্ষণ দাড়ালাম সেখানে। আবার গল্পগুজবে মেতে উঠলাম। এক পর্যায়ে চা তৈরি হলো। খেলাম দুবন্ধু। ততক্ষণে স্টেশন খোলার তোরজোড় শুরু করেছে রেলের কর্মচারীরা।
সুরাজকে বললাম, 'সুরাজ তোমার ট্রেনের এখনও অনেক দেরি আছে। চলো এই সুযোগে তোমাকে পাশে মেরিন ড্রাইভ ঘুরিয়ে নিয়ো আসি।' যথারীতি রাজি হলো ও। এছাড়া আর করারও তো কিছু নেই! আবার চার্চগের স্টেশন থেকে মিনিট দশেক হেটে দুজন সেই সাতসকালে পৌছলাম মেরিন ড্রাইভ। সকালের আলো ফুটেছে সবে। অনেকেই এক্সারসাইজ করছে এদিক সেদিক, হাটছে, দৌড়চ্ছে। মেরিন ড্রাইভের বিচের স্বচ্ছ, পবিত্র, মিষ্টি বাতাসে আমার মনঃপ্রাণ একেবারে সতেজ ও পবিত্রতায় ভরে উঠলো। জানি সুরাজেরও। খুব ঘুরে বেড়ালাম দুজন। একজন বয়স্ক শিখ ভদ্রলোককে দেখলাম তার বয়সের তুলনায় বেশ কঠিন ব্যায়াম করছে। দুজনেই মুগ্ধ হলাম তার ফিটনেস দেখে। তারপর মেরিন ড্রাইভ থেকে পাশের একটি পার্কে গেলাম। পুরোপুরিভাবে সকাল হয়ে গেছে তখন। আটটা বেজে থাকবে। পার্কে যেয়ে দুজন বসলাম এক জায়গায়। পাশে দেখলাম বেশ কয়েকজন অল্প বয়সী সুন্দরি তরুণী বসে আড্ডা দিচ্ছে। সুরাজ নিজে থেকেই আমাকে ওর নাচ দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। আমি বিস্মিত হলাম, এখানে এভাবে! ও পাত্তা দিল না। দিব্যি ওর হ্যান্ডিক্যামটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো ভিডিও করতে। পার্কের খোলা চত্বরে সবুজ ঘাশের ওপর শুরু হলো ওর নাচ। পাশের মেয়েগুলো ওকে ওভাবে নাচতে দেখে হি হি হি করে হেসে উঠলো। আমি বেশ লজ্জা পেলাম, কিন্তু সুরাজ নির্বিকার; নেচে চললো নিজের মনে। দারুণ নাচতে পারে ও। উপভোগ করলাম ওর মনোমুগ্ধকর নৃত্য শৈলী। এভাবে সময় গড়িয়ে চললো।
তারপর সেখান থেকে ওকে নিয়ে ভারার ট্যাক্সিতে চড়ে গেলাম গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া দর্শনে। সেটা ওর মতো আমারও সেখানে প্রথমবার যাওয়া। সকাল সাড়ে আটটা বা ন'টা তখন। চমৎকার মন ভালো করা মিষ্টি একটি সকাল। ঘুরে ঘুরে দেখলাম গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া ও পাশে প্রাসাদোপম বিখ্যাত পাঁচ তারকা হোটেল, 'হোটেল তাজ'। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়েছিল। আসা যাওয়ার মাঝে কোনও এক ফাকে মুম্বাইয়ের ফুটপাত থেকে পোহা, শিরা, উপমা হালকা খেয়ে নিয়েছি দু'বন্ধু। এভাবে এক পর্যায়ে বেড়ানো শেষে আবার ফিরে এলাম চার্চগেট স্টেশনে। পুরোদমে স্টেশনের কাজ শুরু হয়ে গেছে তখন। স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে একে একে। বুঝতে পারলাম, সুরাজের বিদায়ের সময় আসন্ন। ব্যথিত হয়ে উঠলো মন। কি আর করা! চার্চগেট স্টেশনেও আরেক প্রস্থ চা কফি জুস ডোনাট, জন আহারের পুড়ি সবজি ইত্যাদি খাওয়া হলো। স্টেশনের এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ। আগের কোনও একটা লেখায় লিখেছিলাম চার্চগেট স্টেশন নিয়ে, খুবই সুন্দর, পরিপাটি, আধুনিক একটি রেল স্টেশন। জানি আমার মতো সুরাজকেও মুগ্ধ করেছিল। এভাবে এক পর্যায়ে ওর বিদায়ের ক্ষণ একদম সন্নিকটে চলে এলো। ওর অডিশন ছিল দুপুরবেলায়। দুপুরের কোনও এক সময় ওকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। টিকিট কেটে এলো ও। দুবন্ধু আলিঙ্গন করলাম। সুরাজ আমাকে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে প্লাটফর্মে প্রবেশ করলো। বিদায় বন্ধু, শুভ বিদায়!
খুব মধুর কিছু সময় একসাথে কাটিয়েছি আমরা দুজন। চলার পথে দারুণ চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দুজনের মাঝে। এখনও মনে পড়লে এক মিষ্টি সুখানুভবে ভরে ওঠে মন। সত্যি পথ চলতে চলতে সেদিন মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিভাজি টার্মিনাসে খুব ভালো একজন বন্ধু জুটেছিল। প্রকৃত বন্ধুত্ব চিরদিন থেকে যায়, কখনও হারায় না। আমার ঠিক তেমনই একজন বন্ধু সুরাজ নামদেভ। এক রাতে, মাত্র কয়েক ঘন্টায় আমরা পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল দুজনের মাঝে। আমি আমৃত্যু ওকে মনে রাখবো।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৭:০৩

কি করি আজ ভেবে না পাই বলেছেন: খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল দুজনের মাঝে। আমি আমৃত্যু ওকে মনে রাখবো। !!!

ফেবু কিংবা ফোনে যোগাযোগ নেই?
পোষ্টে ভালো লাগা.......................

০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:৪৫

অর্ক বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ কি করি আজ ভেবে না পাই। ফোন নাম্বার ছিল আমার কাছে। হয়তো কোলকাতারর সিম কার্ডে এখনও পাওয়া যাবে! এছাড়া আর কোনও যোগাযোগের সুযোগ নেই।
বড্ড তাড়াহুড়ো করে লেখা ও পোস্ট করা। আপনার ভালো লাগায় প্রীত হলাম। শুভকামনা রইলো। ভালো থাকবেন।

২| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৯:৪২

মোস্তফা সোহেল বলেছেন: লেখাটি পড়ে ভাল লেগেছে।
মানুষের জীবনে এমন হুট করে হয়তো অনেকেই আসে যাকে মানুষ সহজেই ভুলতে পারেনা।

০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:৪৯

অর্ক বলেছেন: খুব উপভোগ্য সময় কাটিয়েছি দুজন একসাথে মুম্বাইয়ে। আর ওর ছবি দেখেই হয়তো অনেকটাই বোঝা যায়, একেবারে পানির মতো সহজসরল একজন মানুষ। আমি ওর মঙ্গল কামনা করি।
আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা। ভালো থাকবেন।

৩| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:১৪

রাতু০১ বলেছেন: প্রকৃত বন্ধুত্ব চিরদিন থেকে যায়, কখনও হারায় না। ভাললাগা এবং শুভকামনা।

০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৯

অর্ক বলেছেন: ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

৪| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৯:৩০

শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া) বলেছেন: এই বন্ধুত্বের সময়টা আরো দীর্ঘ হলে উপভোগ্য হত।

১০ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৭

অর্ক বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া)।

৫| ২০ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:০৬

হাসান রাজু বলেছেন: পড়ে ভাল লাগলো ।

২০ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:২৬

অর্ক বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.