নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট ও ইভ্যালুয়েশনের প্রাথমিক পাঠ

২৪ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:৩১

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে পারফর্মেন্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে প্রচুর গবেষনা হয়।

KPI নাকি ৩৬০ ডিগ্রী মেথড, নাকি সাবেক দিনের মতো করে এক বা দুই পৃষ্ঠার তথাকথিত Performance evaluation form বা ACR এর মাধ্যমে বসের একচেটিয়া মর্জিতে পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করে শেষ করবেন কিনা-তা নিয়ে এখনো কোনো চুড়ান্ত অবস্থান ঠিক হয়নি।

এই প্রতিটি মেথডেরই কিছু তুলনামূলক সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। হ্যা, তুলনামূলকভাবে KPI, OKR বা ৩৬০ ডিগ্রী মেথডগুলো বেশি বৈজ্ঞানিক।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে প্রাইভেট খাত ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হলেও সেই অর্থে ওগুলোর বেশিরভাগের বিজনেস ও অপারেশন ম্যানেজমেন্টে কর্পোরেট কালচার ও কর্পোরেট স্ট্রাকচারের ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি।

কর্পোরেট কালচার নেই বলেই আমাদের এই সো কলড কর্পোরেটের একটা বড় সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে পারফর্ম্যান্সকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে বা পারফর্ম্যান্স বলতে ঠিক কোন কোন ইস্যুকে ধরা হবে সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা যায়। সহজ করে বললে, পারফরম্যান্সের স্বরুপ বা সংজ্ঞা নির্ধারনই হয়ে ওঠেনি অনেক স্থানে।

শুনলে খুব অবাক হবেন, ইংরেজি Performance শব্দটির যথোপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ পাবেন না। বিশ্বাস না হলে খুঁজে দেখুন। আপনিই বলুন তো, পারফরম্যান্স বলতে আপনি কী বোঝেন?

উত্তরটি দেবার আগে, একটু পেছন হতে বলি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠনের একটি গোল থাকে। তার অফিশিয়াল মিশন, ভিশন ও ভ্যালুজের সাথে সমন্বয়, সংযোগ ও এলাইনমেন্টের ভেতর দিয়ে সেই গোল সে অর্জন করতে চায়, অথবা, অন্যভাবে বলা যায়, তার কর্মীদের মাধ্যমে সেই গোল পূরণ করতে চায়। এখন, ওই গোল নির্ধারন দিয়েই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের শুরু হয়। কীভাবে?

বিষয়টা পিরামিডের মতো। একদম টপে থাকে প্রতিষ্ঠান। সবার নিচে কর্মী। এখন এই পিরামিডের টপে প্রতিষ্ঠানকে তার গোল নির্ধারনের কয়েকটা ধাপ পেরোতে হয়। যেমন: -

এক; রিকয়ার্ড বা এক্সপেকটেড টারগেট; (এটা কিছুটা ক্রিকেটের রিকয়ার্ড রান রেটের মতো।)
দুই; গিভেন বা সেট টারগেট (এটাকে মনে করতে পারেন, ক্রিকেটের সেকেন্ড ইনিংস শুরুর পরের টারগেটেড রানের মতো।);
তিন; রিভাইজড বা এ্যাডজাসটেড টারগেট; (যেটা DL মেথডে হয়ে থাকে।)

আমার কেন যেন মনে হয়, আমাদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ওই প্রথম দুটোর মধ্যেই ভেদ নির্ধারন করে উঠতে পারে না।

মনে করুন, আপনি একটি ব্যবসা দিয়ে বসেছেন। একটি দোকান। সেটিকে দাড় করাবার পেছনে মোট ১ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এবং, আপনার বিজনেস এনালিসিস ও প্ল্যান বলছে, আপনাকে টিকে থাকা, গ্রো করা এবং রাইজ করার গোল অর্জন করতে হলে একদম মাইক্রো লেভেলে প্রতি দিন আপনাকে ১০০ টাকা প্রফিট করতে হবে। তাহলে আপনার গোল বা আলটিমেট টারগেট ১০০ টাকা পার ডে।

এখন, আপনার বিজনেস হেড দেখলেন, একদম শুরুতে প্রতিদিন ১০০ টাকা প্রফিট করাটা ভায়াবল না। তো, তিনি সেটিকে প্রথম বছরের জন্য কমিয়ে ঠিক করে দিলেন ৭৫ টাকা প্রতিদিন। এই ৭৫ টাকা/ডে হলে তাহলে গিভেন টারগেট। যেটি অর্জন করতে পারলে আপনি হয়তো ব্রেক ইভেনে আসবেন। আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠান লঞ্চিং, তারপরে সারভাইভাল, আর তারও পরে কিছু বছর পরে গ্রোথ ও রাইজে চলে যাবে।

সুতরাং, আগে প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করতে হবে, তার সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট, সু-হিসেবিত গোল ও টারগেট। এবং অবশ্যই একটি দারুন ও স্বচ্ছ একাউন্টস-ফিন্যান্স বিভাগ ও সিস্টেম। যাতে করে, প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় সংখ্যাতাত্বিক দিকগুলো সবার কাছে প্রতিভাত থাকে। রাখ ঢাক গুড় গুড় করলে পারফরম্যান্স আসবে না। প্রতিষ্ঠানকে জানতে হবে, তার কী চাওয়া উচিত ছিল, সে কী চেয়েছিল, আর সে কতটা পেয়েছে। যাতে করে, প্রতিষ্ঠান প্রফিট করেছে কি করেনি-তা নিজেও জানে না বা জানলেও কর্মীরা জানেন না। আর তারপরে প্রতিষ্ঠান বলে দেয়, এ বছর ৩ কোটি টাকা লস গেছে, ইনক্রিমেন্ট নেই, ছাঁটাই, পে-কাট ইমপোজ করো। সেলস ম্যানেজার জানেন, তিনি এ বছর ১.৫ কোটি টাকার বেশি সেলস করেছেন। অথচ, হেড অব সেলস বলে দিয়েছেন, আপনার এ ব্ছর পারফরম্যান্স খারাপ।

এবার আমার মতো করে বলি, পারফরম্যান্স বলতে আমি কী বুঝি।

আমি একজন কর্মী, প্রোফেশনাল হিসেবে, সে হোক আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত, আমার প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি আমার লক্ষ্যের সাথে মিল রেখে, আমার পেছনে আমার বা প্রতিষ্ঠানের যে বিনিয়োগ, তার ভিত্তিতে, আমার কাছ হতে আমার বা প্রতিষ্ঠানের যে প্রত্যাশিত রিটার্ন, সেটি কতটা করতে পারছি, সেটিই আমার পারফরম্যান্স। পারফরম্যান্স ভ্যারি করবে প্রতিষ্ঠান হতে প্রতিষ্ঠান, বিভাগ টু বিভাগ, ব্যক্তি টু ব্যক্তি। সেটির কোর দায়ীত্ব, এক্সপেকটেড টারগেট এবং রেট অব ফুলফিলমেন্ট তিনের ভিত্তিতে। পারফরম্যান্স এর সংজ্ঞা নির্ধারন বা তার স্বরুপ অনুধাবনে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে-গোল, এফোর্ট, কনট্রিবিউশন, ভ্যালু এ্যাডিশন। এই চার মিলে একজন কর্মী, একটি ইনিশিয়েটিভ, একটি যন্ত্র, একটি সিদ্ধান্ত, একটি বিষয়, একটি বিভাগ, একটি প্রতিষ্ঠানের যে কর্মযজ্ঞ, সেটাই পারফরম্যান্স।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা বিভিন্ন পজিশনে থেকে আমাদের অভ্যন্তরীন অধস্তন কর্মী কিংবা বাইরে হতে আসা চাকরী প্রার্থীদের পারফরম্যান্স কিংবা যোগ্যতা মূল্যায়ন করার কাজ করে থাকি।

আমার কর্মজীবনে এই দুটি কাজ করতে দেখার অভিজ্ঞতার সিংহভাগই হতাশাজনক।

মূল্যায়নকারী, তা তিনি ইন্টারভিউয়ারের ভূমিকায়ই থাকুন, কিংবা পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েটরের,
মূল্যায়নের মৌলিক প্রিন্সিপাল, প্রক্রিয়া আর ক্রাইটেরিয়া সম্পর্কেও ধারনা থাকেনা-এমন লোকের হাতে অন্যদের ভাগ্য নির্ধারনের দায়ীত্ব পড়ে। মূল্যায়ক নিজেই জানেন না, ঠিক কীসের ভিত্তিতে ও কীসের মূল্যায়ন তিনি করবেন।

যেমন ধরুন, একজন ইন্টারভিউয়ার যদি তার ইন্টারভিউ মূল্যায়নে বলেন, “প্রার্থীর টেকনিক্যাল নলেজ হতাশাজনক। তবে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনা খুব ভাল” কিংবা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের মূল্যায়নে তার ইন্টারভিউয়ারের সুপারিশ হল, “বিষয়গত জ্ঞান দুর্বল। তবে প্রার্থী অত্যন্ত চটপটে ও উদ্যমী। নেয়ার সুপারিশ করা হল।”

কিংবা, এ্যাডমিন অফিসারের ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করেন, “বাড়ি কই, বিয়া করছ, কোন ইউনিভার্সিটি, আগে কোথায় ছিলা, কয়টা পর্যন্ত অফিস করতে পারবা, কত বেতন চাও, কবে আসবা?” আর তারপর চুড়ান্ত রায় দেন, “প্রার্থী চলনসই। তবে বেশিদিন থাকবে না।”

”বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা,
আজ জেগেছে সেই জনতা।”

না, বিচার কেউ চাইবে না। তবে বিচারককে অন্তত কেউ জিজ্ঞেস কি করবে, “তা, আপনি কি জানেন, আপনি যার মূল্যায়ন করছেন, তার কী কী ও কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?”

বসেরা প্রায়শই অভিযোগ করে থাকেন, তার অধীনস্থ অমুক লোকটি অদক্ষ। তমুক লোকটি পারফরমার না। অমুক একটা বোঝা। অনেক সময়ই পারফরম না করার অপরাধে চাকরি চলে যায় কোনো কর্মীর।

প্রশ্ন হল, যেহেতু প্রায় (আনুমানিক) ৯৯% প্রতিষ্ঠানেই KPI ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন হয় না, সেক্ষেত্রে বসেরা বা এইচআর কীসের ভিত্তিতে নির্ধারন করেন, কে পারফরমার আর কে নন? যেহেতু কারো পারফরম্যান্সের প্যারামিটার কিংবা এক্সপেকটেড পারফরম্যান্স টার্গেটই সেট হয়নি।

সেটা কি স্রেফ বসদের মতামত? নাকি চোখের দেখা দৌড়ঝাঁপের মাত্রা? নাকি মোটামুটি এক ধরনের গড়পড়তা ধারনা, যে, “অমুক লোকটা খুব একটা ভাল না?” "তমুক একজন সুপারম্যান "?

গতানুগতিক ACR/Performance Evaluation Form/Performance Appraisal Form দিয়ে কেবলমাত্র বসের মতামত কিংবা বস, টীম, সেলফ ইভ্যালুয়েশনের ৩৬০ পদ্ধতিতে পারফরম্যান্স বিচার এই ২০১৯ সালের পৃথিবীতে কতটা যুক্তিযুক্ত আর সেই মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে কর্মীকে ক্লাসিফাই করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

লম্বা সময়ের ক্যারিয়ার যাদের, তাদের নিজেদের ভিতরে, কিংবা তাদের নিয়ে অন্যদের ভিতরেও একটি অন্ধ ও বদ্ধমূল ধারনা বা বিশ্বাস থাকে। তা হল, এত বছর ধরে কোম্পানীতে কাজ করেছি/করেছে। আজ এত বছর পরে কীভাবে এইচআর/কোম্পানী বলে যে, আমি/তিনি অযোগ্য বা তার সার্ভিস মানসম্পন্ন না?

হ্যা, বহু বছর আপনি আমি একটি প্রতিষ্ঠানে/বিভাগে/প্রসেসে কাজ করলে এটি ভাবা খুব অবান্তর নয়। প্রতিটি দিন কাজের বিপরীতে আমাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, যোগ্যতা অবশ্যই বাড়ার কথা। বাড়ার কথা আমাদের অবদানও। বাড়ার কথা আমাদের যোগ করা ভ্যালুও।

তবে তার মানে এই নয়, ১২ বছর একটি বিভাগে বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যেতে পারা মানেই, “আমার কোনো অযোগ্যতা থাকার কোনো সুযোগ নেই” কিংবা “আমার পারফরম্যান্স খারাপ বলার কোনো অধিকারই নেই”।

পারফরম্যান্স কোনো ধ্রূবক নয়। এটি কোনো চিরন্তন সত্যও নয়। পারফরম্যান্স ও যোগ্যতা একটি চির ভ্যারিয়েবল কনসেপ্ট। যেটি প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় ধার দিতে হয়, যত্ন করতে হয়, বাড়িয়ে তুলতে হয়। চাকরির বয়সে বৃদ্ধি মানেই যোগ্যতা বা পারফরম্যান্স বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবি নয়। গত ১২ বছর আপনি সুপার পারফরমার ছিলেন, মানেই এখনো আপনি তাই থাকবেনই-এমনটা ধ্রূব সত্য নয়। ”১২ বছর একটি বিভাগে বা কোম্পানীতে থাকলাম, পারফরমার না হলে কি সেটা পারতাম”-এমন প্রশ্ন আসলে নিজেকে মিছে সান্তনা দেবার নামান্তর।

যোগ্যতা অর্থাৎ Employability এবং পারফরম্যান্স কিন্তু এক বিষয় নয়।
আমরা কোনটা খুঁজছি, কোনটা কখন খুঁজব সেটি কিন্তু আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
আমরা এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলতে অভ্যস্ত।

যেখানে দেখব যোগ্যতা, সেখানে প্রশ্ন করি পারফরম্যান্সের।

যখন পারফরম্যান্সের প্রশ্ন হবে, বিচার হবে, তখন খুঁজি তার যোগ্যতা। এবং, মনে করি, যোগ্যতাই হল পারফরম্যান্স।
বিষয় দুটো আলাদা। ঠিক যেমন আলাদা হল জ্ঞান, দক্ষতা, সক্ষমতা, ইফিশিয়েন্সী আর কনট্রিবিউশন।

ধরুন, আপনি একটি কুকুর কিনবেন। উদ্দেশ্য হল, সে আপনাকে পার্কে হাঁটার সময় সঙ্গ দেবে।
তো, আপনি কুকুর কিনলেন। সে রোজ আপনার সাথে হাঁটতে যায়। আপনি খুশি। সে তার টারগেট অনুযায়ী জব করছে, পারফর্ম করছে।
কিন্তু, কিছুদিন পরে ভেবে দেখলেন, কুকুরটা, যে প্রাথমিক পর্যায়ে পারফর্ম করছে বলে আপনার মনে হয়েছিল, সে, আপনি পার্ক হতে বাড়িতে ফিরলে বাকি সময়টা শুয়ে বসে কাটায়। আর কোনো কাজ নেই।
তো, আপনি ভাবলেন, ঠিক আছে, সে তো অবসরই থাকে। তাহলে, এখন হতে তাকে বাসার বিড়ালগুলোকে শাসনের দায়ীত্ব নিতে হবে।
যেই কথা, সেই কাজ। কুকুরটা বেড়ালদের ওপর খবরদারীও শুরু করল, যাতে তারা লাইন ছাড়া না হয়ে যায়। আপনি খুশি। কুকুরও সামান্য বিরক্ত হলেও অখুশি নয়।
কিছুদিন পরে আপনার বউ আপনাকে নতুন করে আবার কু-বুদ্ধি মাথায় দিল। যে, কুকুর শুধু সকালে ১ ঘন্টা পার্কে হাঁটে, আর হাউ-ঘেঁউ করে বেড়ালদের টাইট রাখে। এটা আর এমন কী কাজ? এর জন্য তাকে একটা দামী কেনেল আর দামী খাদ্য দিয়ে পোষাটা কি ঠিক হচ্ছে?
না, একদমই না-আপনার মনে হল।
তাহলে কী করা?
বউ বুদ্ধি দিল, আপনিও আদেশ দিলেন, এখন হতে কুকুরের কাঙ্খিত পারফরম্যান্স KPI হবে-পার্কে সঙ্গ দেয়া, বেড়ালদের শাসন করা, আর বাজার হতে পত্রিকাটা ঘরে নিয়ে আসা।
কুকুরকে ডেকে তার নতুন পারফরম্যান্স প্যারামিটার ও জে.ডি বুঝিয়ে দিলেন। তার প্রাপ্য সেই একই। দিনে একটা হাড্ডি আর তিন বেলা ডগ ফিড।
কুকুর বিরক্ত ও আহত। কিন্তু, সে তবু কাজে রইল।
আপনারা দু’জনই খুশি। কুকুর তার কাজ করছে, পারফর্ম করছে।
কিন্তু, এরপরও কুকুর বেশ কিছু সময় বিশ্রামে থাকে। বিশেষত সন্ধ্যা হতে পরের দিন সকাল তক তো তার কাজ নেই।
এবার আপনার পাশের বাসার ভাবী এসে বুদ্ধি দিলেন, কুকুরটাতো বসেই থাকে। অলস হয়ে যাচ্ছে। খরচও পোষাতে হবে তো। জিনিসপত্রের যা দাম। তাই, ওকে বলুন, রাতে বাড়ি পাহাড়া দিতে হবে।
ব্যাস, কথাটা মনে ধরল।

কুকুরকে ডেকে মিটিং করে বলে দিলেন, আজ হতে তোমার জে.ডি ৪ টা। বাড়িও পাহাড়া দিতে হবে রাতে।

এভাবে, দিনে দিনে যোগ হল, শুধু পাহাড়া দিলে হবে না, সকালে লিখিত রিপোর্টও দিতে হবে। পাশের বাসার কুকুর যাতে এ বাসায় এসে কিছু নিয়ে যেতে না পারে, সেটাও নজর দিতে হবে। যোগ হল-মাসে তিনদিন স্থানীয় পুলিশের সাথে আসামী ধরতে যেতে হবে। যোগ হল-তাকে মাঝে সাঝে, মানে সপ্তাহে এক দিন পাড়ার অন্য কুকুরদের সবক, মানে ট্রেনিংয়ের জন্য কাজ করতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সবই মেনে নিল। সূচারুভাবে সব করতে থাকল।

অতঃপর একদিন কুকুরের অরিজিনাল মালিক, যার হতে আপনি কিনেছিলেন, তিনি আপনাকে একদিন পথে দেখে জানতে চাইলেন, কুকুরটা কেমন পারফর্ম করছে?

আপনি হতাশা ভরে বললেন,
”তা, কাজকাম সামান্য করে বটে। কিন্তু আপনার দেয়া কুকুর গান করতে পারে না, ব্রেকফাস্ট বানাতে পারে না, খরগোশ ধরতে পারে না, নিজে নিজে গোসল করতে পারে না, বারবার পটি করে, সে এখনো তো ঘেউ ঘেউ করেই ডাকে-বিলেতি কুকুরের মতো ডাকে না, সে শিকার ধরতে পারে না, সে সারাদিন ঢোলে, সে এখনো বাজার করতে পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
মানে, কুকুরটা পারফর্ম করতে পারছে না, সে নেহাতই অকেজো আর অথর্ব।
পারফরম্যান্স কী, কেমন ও কতটা; আর সেটা কীভাবে মাপা হবে-সেটা আগে ঠিক করুন।

কর্মীদের পারফরম্যান্স মেজার করা ও তার রিটার্ন দেয়া নিয়ে সেই শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানগুলো হিমশিম খেয়ে আসছে। অধীনস্থদের বার্ষিক পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশনের সময়ে বসেরা চিন্তায় পড়ে যান, কীভাবে বিচার করবেন আর কী মতামত দেবেন। বস্তুত পারফরম্যান্স ও তার মূল্যায়ন বেশ জটিল একটি ধারনা। তাই এর খুঁটিনাটি নিয়ে চলুন বিস্তারিত ভাবি:-

এক;
কর্মীর কোন বিষয়টা পারফরম্যান্স আর কোনটি কোয়ালিফিকেশন বা কম্পিট্যান্সি-সেটি বুঝে নিন।
আপনি কিন্তু পারফরম্যান্স বিচার করছেন, কোয়ালিফিকেশন নয়। ধরুন, একজন কর্মীর কাজের জন্য গ্রাফিক্স ডিজাইন জানতে হয়। তো সেটি যদি তিনি জানেন, সেটি তার কোয়ালিফিকেশন। সেটি জানা বা না জানার জন্য প্রতিবছর তিনি সু-মূল্যায়ন বা কু-মূল্যায়ন পেতে পারেন না। সেটি একবারই মূল্য পাবে, আর তা হল তার নিয়োগের সময়।
কিংবা মনে করুন, একজন মানুষ যখন চাকরীতে ঢোকেন তখন তার প্রোফাইলে আগের চাকরীতে একটা বড় জরিমানার কেস ফাইলড ছিল। তবু তাকে জব দেয়া হয়েছে ওটাকে জেনেও।
কিন্তু যখনি তার পারফর্ম্যান্স নিয়ে কথা ওঠে তখনি এইচআর বলে, ‘আরে না না, ওরতো আগের জবে একটা বিরাট ফল্ট আছে’।
না ভাইজান, আগের জবে জরিমানা, ফল্ট যাই থাকুক, সেটা জানা স্বত্বেও যদি তাকে জব দেন তার মানে হল, ওটাকে কোম্পানী ইগনোরেবল মনে করেই তাকে নিয়েছে। তাই চাকরীতে ঢোকার পর ওটা তার পারফর্ম্যান্স মেজারমেন্টের ইনডেক্স হতে পারেনা। ওটা তার পার্ট অব জব কোয়ালিফিকেশন আর রেকর্ড।

দুই;
কোন কর্মীর কাছে কেমন পারফরম্যান্স এক্সপেকটেড সেটা আগে নির্ধারন করে নিতে হবে।
নির্ধারন করতে হবে কোম্পানীর Goal ও KPI এর সাথে সামঞ্জস্য করে তার কর্মতালিকা বা জেডি বা KRA। অফিসারের কাছে জিএমের পারফর্ম্যান্স চাওয়া যাবে না। তার ভিত্তিতে তাকে বিচারও করা যাবে না।
একটা মাছকে যদি বলেন সে কতটা দ্রূত গাছে উঠতে পারে কিংবা একটা পাখিকে বলেন, কত বেশি দুধ সে দিতে পারে-তবে তো আপনি পারফর্ম্যান্সের KRA ই ঠিক করতে পারেননি। আবার পারফরম্যান্স মেজারমেন্টের সময় ডিপার্টমেন্ট, র‌্যাংক, চাকরীর বয়স, বেতন-এগুলোকেও বিবেচনায় রাখতে হবে।

আপনি কোর পারফর্ম্যান্সকে কর্মীর অপশনাল ওয়ার্ক, বিহ্যাভিওরাল প্যাটার্ন, পিআর ফ্যাক্টর, নন-রিলেভ্যান্ট ফ্যাক্টরস বা লেস ইম্পর্টান্ট ফ্যাক্টরসের সাথে মিলিয়ে বিচার করছেন। অথচ হওয়া উচিৎ ছিল, সেলস যদি আপনার কোর জব হয় তবে সেলসে আপনার পরিমান, আর্থিক রিটার্ন বা মূল্য ও তার যাবতীয় রেটিং বিবেচনায় নিয়ে আপনার পারফর্ম্যান্স মেজার করা।

তারপর সেখান হতে খুব সামান্য রেটিং পয়েন্ট কাটা হতে পারে আপনার অন্যান্য সাইড ইস্যুর ডেভিয়েশনের কারনে। সেটা করা হয়না ওই যে পারফর্ম্যান্সের সংজ্ঞা ও ডিসকোর্স ঠিক না থাকার কারনে।
দেখা গেল সারাবছর সুপার প্রোডাকশন করলেন আর বছর শেষে ইভ্যালুয়েশনের একদিন আগে হঠাৎ একদিন এবসেন্ট করলেন। ব্যাস, আপনাকে ব্যাড পারফর্মারের তালিকায় ফেলে দেয়া হল।

অথচ হওয়া উচিৎ ছিল-এক; আপনার সারা বছরের এটেনডেন্স রেকর্ড দেখা। দুই; এটেনডেন্স যাই হোক, আপনার মূল কাজ সেল করা। সুতরাং আপনি যদি সেটা সুপার লেভেলে করে থাকেন তাহলে কখন অফিসে এসেছেন বা কখন বেরিয়েছেন সেটা তেমন পাত্তা পাবার কথা না।

আবার, মনে করুন, একজন এইচআর অফিসার আছেন যার কাজ ওয়ার্কার রিক্রূট করা। আরেকজন আছেন পিআরে যার কাজ ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট তৈরী। তো প্রতিদিন এইচআরের লোকটি গেটে মানুষ রিক্রূট করে আর ট্যালি খাতায় লেখে। গরমে ঘামে ভিজে কাজ করে ঠান্ডা লাগে বছরে ৫ বার।

অফিস দেখে লোকটা কাজ করতে করতে জান দিয়ে দিচ্ছে। আর ওই যে ক্রিয়েটিভ রাইটার সে সারাবছর এসি রুমে বসে থাকে, ফেসবুক করে, ইউটিউব দেখে আর মাসে দু’মাসে একটা কনটেন্ট বানায়।
বছর শেষে ওই এইচআর অফিসারকে বেশি বেতন বাড়ায়।
কেন? ওর কাজ প্রচুর। ক্রিয়েটিভ রাইটার বঞ্চিত। কারন তার কাজের সংখ্যা ৩ কি ৪ টা।
এই দু’জনের মধ্যে তুলনাটা কিন্তু পারফর্ম্যান্সেই কিন্তু পারফর্ম্যান্সের ক্যাটেগোরাইজেশন ও ডেফিনিশন ভুল। দু’জনের তুলনার প্যারামিটারটা ভুল।
তিন;
যিনি পারফর্ম্যান্স বিচার করবেন মানে, এসেজর বা বসকেও পারফরম্যান্স মেজারমেন্টে দক্ষ হতে হবে।
ধরেন, আপনি একজন সেলস ম্যানেজার। সারাবছর কাজ করে আপনি টার্গেটের চেয়ে বেশি সেল করেছেন। আপনি বা আপনার কাছের লোকেরা ভাবছেন আপনি ভাল পারফর্ম করছেন বলেই কোম্পানী মনে করছে।
কিন্তু কোম্পানীর এইচআর ম্যানেজার আবার সেলস খুব ভাল বোঝেন না বা সেলসকে খুব উঁচু নজরে দেখেন না। বিধায় তিনি আপনার সেলস পারফর্ম্যান্স নিয়ে খুব গুরুত্ব না দিয়ে আপনি কোন জেলার মানুষ, আপনার কাপড় চোপড় কতটা গর্জিয়াস, আপনি সিনিয়রদের দেখলে সালাম দেন কিনা, কোম্পানীর পিকনিকে আপনি আগ বাড়িয়ে অংশ নেন কিনা-তার ভিত্তিতে আপনাকে রেটিং করে আপনাকে একদম অকেজোর স্থানে ফেলে রেখেছেন।
বার্ষিক পারফর্ম্যান্স মূল্যায়নে বসদের বিবেচনার বিষয় কী কী?
১. ওই ব্যাক্তির সারা বছরের পারফর্ম্যান্স মাথায় রাখবেন।
২. ব্যক্তির যোগ্যতা নয়, কোম্পানীর স্বার্থ ও প্রয়োজনীয়তার বিচারে র্যাংক অনুযায়ী কাজ বন্টন করতে হবে। দেখা যায় যে কম যোগ্য তাকে কাজ দেন কম (আরে ওতো কিছু পারে না।) আর যে কাজ পারে ও করে, তাকে সব কাজ চাপিয়ে দিলেন আর সে কাজের চাপে পারফর্ম্যান্স খারাপ করে। শেষতক যে কাজ করে না বা পারে না, লাভ হয় তারই।
৩. ব্যাক্তির কোনটা পারফর্ম্যান্স আর কোনটা কোয়ালিফিকেশন সেই পার্থক্যটা মনে রাখতে হবে। আপনি মূল্যায়ন করছেন পারফর্ম্যান্স। কোয়ালিফিকেশন না।
৪. মানবতা জিনিসটাকে বার্ষিক মূল্যায়নের সময় একটু দুরে সরিয়ে রাখুন। প্রফেশনাল হোন।
৫. শুধু ভাল-মন্দ টিক দেয়া নয়, কর্মীর ব্যাপারে উম্মুক্ত মতামত দেবার অপশন আছে ফরমে। আপনার সুচিন্তিত মতামত দিন। তার পজিটিভ নেগেটিভ দুই দিকের বিস্তারিত লিখুন।
৬. ফরম পূরনের সময় তার ক্লোজ সুপারভাইজারকে সাথে নিন।
৭. কর্মীদের ৪টি লেভেল থাকে-অফিসার, ম্যানেজার, জিএম ও ডিরেক্টর। প্রতিটি র্যাংকের দায়ীত্বের ওজন আলাদা। প্রত্যেককে তার র্যাংকের সাথে মিল রেখে এসেস করুন।
৮. নিরপেক্ষ থাকুন।
৯. চাকরীর বয়স বৃদ্ধি মানেই প্রোমোশনের যোগ্যতা বৃদ্ধি-এটা ১০০% সত্যি নয়। যোগ্যতার বৃদ্ধি বয়স বৃদ্ধিসহ আরো অনেক কিছুকে ডিমান্ড/মীন করে।
১০. ব্যক্তির উপরের পোষ্টে যাবার দাবীর চেয়ে বেশি জরুরী হল, কোম্পানীর উপরের পোষ্টে একজন মানুষ দরকার কিনা-সেটা।
চার;
কারো কারো জন্য ফিজিক্যাল লেবার ও ভিজ্যুুয়াল মুভমেন্ট কাজ ও পারফরম্যান্স এর ইন্ডিকেটর হবে।
কারো জন্য আবার কম্পিউটার স্ক্রীনে বসে থাকাটাও হতে পারে পারফরম্যান্স এবং কাজ করার ইন্ডিকেটর।
তাই কাউকে স্ক্রীনের সামনে পেন্সিল গালে লাগিয়ে বসে থাকতে দেখা মানেই এই নয়, তিনি কোনো কাজ করেন না। আবার কাউকে ঘাম ঝরিয়ে হাপিয়ে উঠতে দেখা মানেই এই নয়, তিনি প্রচুর কাজ করছেন।
দেখতে হবে, তাকে ঠিক কোন কাজে কোম্পানী নিয়োগ করেছে, আর ওই কাজের ন্যাচার কী বলে। তিনি যদি ঠিক সেই কাঙ্খিত কাজটিই দ্রূততার সাথে ও ইফেকটিভলী করেন, তাহলেই সেটি পারফরম্যান্স। উন্নত প্রতিষ্ঠানে এমনকি একের কাজ অন্যের করাটাকেও ডেফিশিয়েন্সি হিসেবে দেখা হয়।
পাঁচ;
পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে হবে সারা বছরের।
কোনো বিশেষ ঘটনা বা মাসের না। তাই সারা বছরব্যাপী আপনার অধীনস্থদের কাজের, সফলতার, ব্যর্থতার, খারাপ কাজের রেকর্ড মেইনটেইন করুন। যেমন, একজন কর্মী ২০১৬ সালে একটি ভুল করেছিলেন। তার যথাযথ বিচার ও রায় হয়ে গিয়ে তিনি শাস্তি পেয়েছেন। তার সেই কাজের জন্য ২০১৯ সালেও তাকে কম মার্কস দেবেন না।
এর বিপরীতে কেউ ২০১৫ সালে একটি এয়ার শিপমেন্ট হতে কোম্পানীকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তার মূল্যও তিনি পেয়েছেন নানাভাবে এবং ২০১৬ সালের ইভ্যালুয়েশনে। তিনি ২০২০ সালে কিন্তু তার জন্য তার এসিআরে মার্কস পাবেন না।
হ্যা, সবসময়ই ইভ্যালুয়েশন ফরমে কিছু বিহ্যাভিওরাল, হিউম্যান/পার্সোনাল ট্রেইট রিলেটেড প্রশ্ন থাকে। সেগুলোর উত্তর দিতে তার হিসট্রি বিবেচনায় আসে। যেমন, প্রশ্ন আছে, “তিনি কি সৎ?” এর উত্তর দিতে গেলে আপনাকে তার হিস্ট্রি জানতে হবে।
এখন, তিনি যদি একটি ভুল কাজ ২০১০ সালে করে তার বিচার পেয়ে থাকেন, আর তারপর হতে শুধু সৎ কাজই করে থাকেন, তবে কিন্তু তাকে আপনি ২০১৫ সালে নেগেটিভ মার্কিং দিতে পারেন না।
ছয়;
কর্মী পারফরম করছে নাকি করছেনা, সেই বিচারের পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে, তাকে পারফরম করতে যা কিছু লজিসটিকস, এমপাওয়ারমেন্ট, অপরচুনিটি ও সাপোর্ট দেবার দরকার ছিল, তা তাকে দেয়া হয়েছে কিনা।
ধরুন, কারো জব হল, লোক হায়ার করা। তো যদি এমন হয়, লোক হায়ার দ্রূত করতে যে যে প্রস্তুতি কোম্পানীর থাকতে হবে, তার কিছুই তাকে দিলেন না, তাতে সেই বেচারার পারফরম্যান্স ডাউন হলে তার কী দোষ? ব্যাপারটা হাত পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিয়ে তাকে সাতরাতে বলার মতো নয়?
সাত;
কর্মীকে তার পারফরম্যান্স লেভেল ও ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট জানানো ও তার সাথে সেটা নিয়ে ডিসকাস করা (পারলে বিচারের আগে) উচিৎ।
কর্মী যদি না ই জানে, কোম্পানীর কাছে তার অবস্থান কী আর কোথায় তার ডেফিশিয়েন্সী, কোথায় তার গ্লোরী, তবে সে নিজেকে নিজে শুধরাবে কী করে?
আট;
পারফরম্যান্স ও নন-পারফরম্যান্স এর মধ্যে রিটার্নের পার্থক্য থাকতে হবে।
সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে, হাই পারফরমার ও পুওর পারফরমার যেন একই মূল্য না পান। পুওর হলে সাজা আর হাই হলে রিওয়ার্ড নিশ্চিত থাকতে হবে। তা না হলে হাতি লাগিয়েও কোম্পানীর ইফিশিয়েন্সী বাড়ানো যাবে না।
নয়;
কর্মীদের পারফরম্যান্স যদি নিশ্চিত করতে হয়, তবে সবার আগে তার ডিপার্টমেন্টের ট্যানজিবল ও ইনট্যানজিবল; ভিজিবল ও এ্যাবসট্রাক্ট-সবরকম এ্যানুয়াল গোল নির্ধারন করতে হবে।
তারও আগে ঠিক করতে হবে ওই কোম্পানীর ট্যানজিবল ও এ্যাবসট্রাক্ট এ্যানুয়াল গোল। তারপর বানাতে হবে ওই গোল এ্যাচিভ করতে হলে কী কী করতে হবে,
কীভাবে করতে হবে, কী কী লাগবে।
তারপর কর্মীদেরকে ওই গোল এ্যাচিভ করার জন্য র‌্যাংক, বিভাগ, চাকরীর বয়স, যোগ্যতা অনুযায়ী দায়িত্ব দিতে হবে। তাহলেই কর্মীদের প্রতি সুবিচার হবে। কর্মী যদি না ই জানে, এই বছর তাকে কতটুকু দিতে হবে বা কোম্পানী তাকে কতটুকু দেয়ার জন্য আশা করে, তবে সে কী পারফরম করবে?
রাইট ম্যান ইন দ্যা রাইট পজিশন ফর রাইট জব-এটাও পারফর্ম্যান্স বিচারের আগে ঠিক করাটা জরুরী। কার কাছ হতে কোন গিভেন কন্ডিশনে কোন আউটকাম কাম্য-সেটাই তো প্রতিষ্ঠানগুলো ভুল মেজার করে।
দশ;
জানেন কিনা? যেকোনো কাজকে আজকাল গননাযোগ্য (ট্যানজিবল) কাজে রূপান্তর করা যায়?
কেপিআই এর কথা শুনেছেন নিশ্চই? মানে হল, যেকোনো বিভাগের যেকোনো কাজকে বা দায়ীত্বকে গোনা যায় এমন এককে রূপান্তর করা ও বছর শেষে কতটা টার্গেট রীচ করল তা মাপা যায়। শুধু একজন অপারেটরই না, একজন মেডিক্যাল অফিসারের কাজকেও গননাযোগ্য এককে রূপান্তর করা সম্ভব।
পারফরম্যান্সকে কে কী রকম চোখে দেখেন, সেটার ওপর পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট ও ইভ্যালুয়েশন কতটা নির্ভর করে, তার একটি সহজ উদাহরন হল নিচের গল্পটি।

In the eyes of a CFO:
সকাল ৯ টায় ঢুকবে। বিকাল ৫ টায় বের হবে। মাঝখানে ১ ঘন্টা লাঞ্চ বাদে মোট ১০ জন কর্মী কোনোদিকে না তাকিয়ে ঘাড় গুঁজে কাজ করল। সামান্য টয়লেটেও যায়নি। পানি খায়নি। কফির আড্ডা দেয়নি। পাশের ডেস্কের সুন্দরী কলিগের সাথে গল্প করেনি কেউ।
তাহলে মোট ৮ ঘন্টা X ১০ জন = ৮০ ম্যান আওয়ার কাজ আদায় হল। ওয়াও! টার্গেট রিচড।
In the eyes of a CEO:

সকাল ৮:৫০ হতে ৯:১৫ তে সবাই ঢুকেছে। বিকাল ৪:৩০ টা হতে ৬ টার মধ্যে সবাই বের হয়ে গেছে। গড়ে সেই ঘন্টা আস্টেক কাজ সবাই করেছে। তার মানে ৮০ ম্যান আওয়ার। মাঝে লাঞ্চ ছাড়াও ১০ জন কর্মী কফি ব্রেকে গেছে দু’বার করে, গড়ে ১০ মিনিট করে ২০ মিনিট X ১০ জন = ২০০ মিনিট কাটিয়েছে। তারপর গোটা টীম দলবেঁধে লাঞ্চ করেছে।
লাঞ্চে বস একটা জোক বলে সবাইকে হাসিয়েছে। লাঞ্চের পরে সিগারেট অফার করায় ৫ জন স্মোক করে ৫ মিনিট করে ২৫ মিনিট খরচ করেছে। ২ জন বসের সাথে বা কলিগের সাথে গল্প করেছে ৭.৫ মিনিট করে ১৫ মিনিট। ১ জন ৩০ মিনিট আগে বের হয়েছে। তবে সে সেজন্য লাঞ্চ হতে আধাঘন্টা বাঁচিয়েছে।

১ জন কাল ১ ঘন্টা দেরীতে আসবে বলে আজ দ্বিগুন বেগে হাত চালিয়ে তার ২ ঘন্টার প্রোডাকশন বেশি করে ফেলেছে। দিনশেষে সিইও হিসেব করে দেখেন: ১০ জন মানুষ মোট কাজ করেছে ৮ ঘন্টা করে ৮০ ঘন্টা। ১০ জনের মোট অকাজে (আসলে রিফ্রেশিংয়ে) কেটেছে ২৪০ মিনিট মানে সো কলড অপচয়। ১ জনের সরাসরি অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে সরাসরি ২ ঘন্টা মানে ১২০ মিনিট যার থেকে কাল কম করবে ৬০ মিনিট, বাড়তি তবু ৬০ মিনিট।

আর ওভারঅল মটিভেটেড ও চমৎকার কর্মপরিবেশের কারনে ১০ জনের সবাই মিলে বাড়তি প্রোডাকশন দিয়েছে মোট ৬ ঘন্টার, মানে ৩৬০ মিনিট। তাহলে কী দাড়ালো?

দিনে শেষে CEO'র টীম এত এত ফাঁকি দিয়েও বাড়তি উৎপাদন ১৮০ মিনিটসহ মোট উৎপাদন ৮০+৩ ঘন্টা= ৮৩ ম্যান আওয়ার।

পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কথা বলার সময়, আমি প্রায়শই মজা করে এই গল্পটি প্রায়ই বলি।

গ্রামের মাঠে ওয়াজ হচ্ছে। ওয়াজিন সাহেব মধুর কন্ঠে বেহেশতের বর্ননা দিচ্ছেন। সেখানে এই থাকবে, ওই থাকবে, ওই সুখ, এই আরাম ইত্যাদি। সেখানে প্রত্যেক নেকবান পুরুষ হুরদের পাবেন।
এ কথা শুনে উপস্থিত এক নারী জিজ্ঞেস করলেন,
আচ্ছা, পুরুষরাতো হুর পাবেন, আমরা নারীরা কী পাবো?
ওয়াজিন বললেন, “প্রত্যেক নারী তাদের স্বামীদের পাবেন।”
“কন কি হুজুর! আবার সেই করীমের বাপে?”
আরেকটা গল্প বলে আসল কথা বলি:
সম্ভবত পেলের উক্তি এটি-”ফুটবল এমন একটি খেলা যেখানে ২২ জন খেলোয়াড় ৩৬০ বাই ১৬০ ফিট মাঠে ৯০ মিনিটব্যাপী দৌড়াদৌড়ি করে গলদঘর্ম হয় এবং অবশেষে ব্রাজিল জেতে।”

পারফর্ম্যান্স ম্যানেজমেন্টের প্রাথমিক পাঠ ২টি:-পারফম্যান্স কী-সেটা ডিফাইন থাকা। পারফর্ম্যান্স ও কোয়ালিফিকেশনকে আলাদা করা।

আর দ্বিতীয়টি হল, পারফর্ম্যান্সের রিওয়ার্ড কী হবে-সেটা আগেই ঠিক করা। যদি এমন হয় বেষ্ট পারফর্মার ও লীষ্ট পারফর্মার একইরকম মূল্য পাচ্ছেন, তাহলে কেপিআই, ৩৬০, হ্যান ত্যান-নানারকম গালভরা হাই প্রোফাইল পারফর্ম্যান্স ইভ্যালুয়েশনের জন্য সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

একটা ছক্কা লুডু কিনে ছক্কা ছুড়ে দেন। যে নাম্বার উঠবে ওই পরিমান টাকা দিয়ে দিন। ব্যাস।

সবচেয়ে জরুরী হল, বার্ষিক পারফরম্যান্স মূল্যায়নকে টপ প্রায়োরিটির একটি কাজ বলে গন্য করুন। শুধু বার্ষিক বেতন বাড়ানোর অনুষ্ঠান যেন সেটি না হয়। একটি উপযুক্ত পারফরম্যান্স মূল্যায়ন প্রোগ্রাম কোম্পানীকে দারুনভাবে উপকৃত ও সমৃদ্ধ করবে। আর মানহীন গতানুগতিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠানকে অধঃপতনে নিয়ে যাবে।

ভাল একটি পারফরম্যান্স মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের দায়ীত্ব সমান।
পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। কীভাবে আপনার টীমকে সর্বোচ্চ এফিশিয়েন্সীর সাথে কাজ করানো সম্ভব আর কীভাবে টীমের প্রত্যেকের কর্মস্পৃহা ও কর্মনৈপূণ্যের মূল্যায়ন করা যায়-তা নিয়ে অনেক কাজ করবার সুযোগ থাকে।

বছরের পর বছর একই কাজ করতে করতে আমরা টাইপড হয়ে যাই। নিত্যদিনের অভ্যস্ততায় অনেক ডেভেলপমেন্ট স্কোপই চোখ এড়িয়ে যায়। তাই মাঝে মধ্যে অডিট করুন। রি-ইভ্যালুয়েট করুন। প্রয়োজনে বাইরের কারো সাহায্য নিন। এইচআর তো আছেই আপনাদের জনশক্তিকে সর্বোচ্চ দক্ষতায় কাজে লাগানোর যেকোনো রকম প্রচেষ্টা নিয়ে সাহায্য করতে।

টীম সদস্যদের পারফরম্যান্স মেজার করা ও তা ইভ্যালুয়েট করার দক্ষতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করা জরুরী। উপযুক্ত মেজারমেন্ট হলে যথোপযুক্ত রিওয়ারডিং সহজ হয়। পারফরম্যান্স মেজারমেন্ট সারা বছরব্যাপী চলমান একটি কাজ। টীমের সিনিয়র ও সুপেরিয়রদের কাজ হল, যার যার টীমের ইনডিভিজুয়াল সদস্যদের সারা বছরব্যাপী কাজ, অবদান, এ্যাচিভমেন্ট, ফল্ট-সব কিছু নজরে রাখা আর রেকর্ড রাখা। বিষয়টা বছর শেষে PEF ফরম পেলে সেটা পূরন করে দেয়া নয়।

টীম প্রধানদেরকে সারা বছরব্যাপী এই রেকর্ড কাগজে কলমে মেইনটেইন করতে হবে। আর বছর শেষে যখন PEF ফরম যাবে, তখন সেখানে তার রিফ্লেকশন থাকতে হবে। রেকর্ড রাখার সাথে সাথে যেকোনো কর্মীর লাগাতার ডাউন পারফরম্যান্স হতে থাকলে সেটা এইচআরের সাথে আলোচনা করুন। পরামর্শ দিন, পরামর্শ নিন। ওই কর্মীকে কাউন্সেল করার পাশাপাশি এই ডাউনফল ও কাউন্সেলিংয়ের তথ্য যার যার ফাইলে যাবে।

একেবারে শেষ মুহূর্তে এইচআরকে জানিয়ে শাস্তি আরোপের চেয়ে আগে হতে তাকে আপগ্রেড করার চেষ্টাটা বেটার। এভাবেই নিবিড় কার্যক্রমের ভিতর দিয়ে চলতে থাকে পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট। শুধু দরকার কালেকটিভ ম্যানেজমেন্ট এবং ওপেন ডিসকাশন। ওপেন হোন, ইন্টার‌্যাকটিভ হোন।
পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের আলোচনায় আরেকটি জরুরী কথা যোগ করব। সেটি হল, এইচআরের সকল কাজের শুরু হয় শুরুর কাজটি দিয়ে। কিন্তু, পারফরম্যানস ইভ্যালুয়েশনের ক্ষেত্রে সেটি হবে উল্টো। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবে শেষের কাজটি দিয়ে।

সেটি হল রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ, পারফর্ম করলে কর্মী কী পাবেন, আর না করলে তার পরিণতি কী হবে, তা বছরের শুরুতেই নির্ধারন করে কর্মীর সামনে এনে দিতে হবে, প্রমোট করতে হবে এই রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে। তাহলে, কর্মী বছরের শুরু হতে সারাবছরই একটি লক্ষ্য ও ভয়কে সামনে রেখে কাজ করবেন। মূলা ও ডুলা সামনে না থাকলে মানুষ কাজ কেন করবে?

তবে, তারও আগে যেটা করতে হবে, তার নাম এমপ্লয়ার ব্র্যান্ডিং। আপনার নিজের কর্মী ও বাইরে থাকা পোটেনশিয়াল বা ফিজিবল কর্মী তথা জব এ্যাপ্লিক্যান্ট বা জব সিকারদের কাছে আপনার প্রতিষ্ঠানকে একটি বড় ও স্বীকৃত এমপ্লয়ার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচীত করতে হবে। অন্যথায়, আপনার কর্মীরা ভাল পারফর্ম করার উৎসাহ না হয় রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট হতে পাবেন, কিন্তু, পারফর্ম না হলে শাস্তি পাবার বা চাকরি হারাবার ভয় ও পরোয়া যদি না থাকে, অর্থাৎ এই চাকরিতে বহাল থাকাকে যদি তার কাছে লাগসই করে প্রতিভাত না করা হয়, তাহলে সে পারফর্ম করবার তাগিদ দেন অনুভব করবে? সে তো বলব, “আরেহ, এই চাকরী গেলেই কী, থাকলেই কী?”

সুতরাং, সবার আগে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং, তারপরে রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট ও স্ট্রাকচার, তার পরে KRA ও KPI ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স বা প্যারামিটার নির্ধারন ও পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন পদ্ধতি নির্ধারন, তার ভিত্তিতে পারফরম্যান্স রেটিং আর তারপরে রিওয়ার্ড প্রদান। প্রথমে ঠিক করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের সুনির্ধারিত ও যথোপযুক্ত Goal, যার সাথে কানেকটেড ও এলাইনড থাকবে প্রতিষ্ঠানের মিশন, ভিশন, ভ্যালুজ। তার পরে সেই গোল অর্জনের জন্য স্ট্রাটেজি নির্ধারন এবং সেট অব এ্যাকশন, যাকে আমরা প্রতিষ্ঠানের KPI বলতে পারি। সেই KPI এর আলোকে বিভিন্ন বিভাগের কাঙ্খিত কনট্রিবিউশন তথা KPI ঠিক করতে হবে। সেই বিভাগীয় বা টীম KPI এর আলোকে আবার টীমের অরগানোগ্রাম ও অনুমোদিত ম্যানপাওয়ার বাজেটের ওপর ভিত্তি করে পুরো টীমের প্রতিটি পজিশন ও ব্যক্তির KPI সেট করা হবে। এই প্রক্রিয়া অনুসরন করার ফলে, ব্যক্তির পারফরম্যান্স তখন সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠানের কাঙ্খিত পারফরম্যান্স হিসেবে প্রতিফলিত হবে। আবার, উল্টোদিকে, প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্সে ব্যক্তি কর্মীর অংশ এবং স্বভাবতই তার প্রযোজ্য রিটার্ন নির্ধারন তখন সহজ ও ন্যায্য হবে।

মনে রাখতে হবে, গতানুগতিক যে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট আমরা দিই, সেটি কিন্তু পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের সবটা নয়। আমরা এই লেখায় মূলত পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন নিয়েই বেশি বলেছি। পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের আরও দিক রয়েছে। যাহোক, বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট হল ওভারঅল পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের একটি ছোট অংশ। বেশিরভাগ সময়ই সেই ইনক্রিমেন্ট আসলে পরিণত হয় এ্যাডজান্টমেন্ট টু ইনফ্লেশন। তাই ওখান হতে ওটাকে বের করতে হবে। শুধু ইনকাম এ্যাডজাস্ট করলে হবে না, মানুষকে আয় বাড়িয়ে দিতে হবে তো।

আর তার পরে, যোগ করতে হবে, আরো পুরস্কার ও ইনসেনটিভ। সেই পুরষ্কারে থাকবে আর্থিক ও অনার্থিক-সবরকমই।
পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট, ইভ্যালুয়েশন এবং রিওয়ার্ড নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে ঠিক কতটা পরিমাণে ক্ষোভ ও অনুযোগ জমা থাকে, তার কিছু কিছু নমুনা আমি দিতে পারব। তবে কলেবর বিশাল হয়ে যাওয়ায় থামলাম। মোটের ওপরে, শুধু বলব, বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী এবং এখানে ন্যায্যতা প্রায়শই মানা হয় না।

একটি বিল্ডিং গড়তে ফাউন্ডেশনে যে ইট, বালু, সিমেন্ট থাকে তাদের কেউ দেখে না। দেখে তাদের আত্মদানের ওপর দাড়িয়ে মাটির ওপরে থাকা ডেকোরেটিভ টাইলের সৌন্দর্য। টাইলসের প্রশংসার শেষ নেই। প্রায় সবখানেই দেখবেন, কিছু লোক থাকে, যারা কাজের সময় থাকে দূরে। ঘুর ঘুর করে, এর ওর কাজের খবরদারি করে, পান সিগারেট খায়। কাজ শেষ হয়ে ফিতা কাটার সময় হলে, বা কর্তার আসার সময় হলে, হাতা গুটিয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। খুব ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায়, শ্বাস ঘন করে ফেলে। মূল কাজে তাদের অবদান শূন্য হলেও ফিতা কাটার আর ছবি তোলার সময় কাজের লোকদের কনুইর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে যায়গা করে নেয় ক্যামেরার ফোকাসে।

কর্তার আশেপাশে থেকে ছবিতে মুখখানা উজ্জ্বলভাবে ধরে রাখে। দুঃখের বিষয়, সমাজে তারাই বেশি ট্রিটমেন্ট পায়।
দিনশেষে কর্তার দেয়া ট্রফিখানা তারাই বাগায় ওই ঘাম আর ঘনশ্বাসের বদৌলতে। নিরবে যারা কাজ করে যায় তারা ক্লান্তিতে আর সংকোচে থাকেন পিছনে। লোকচক্ষুর আড়ালেই সাধারনত থেকে যায় তাদের অবদান। ওই ফাউন্ডেশনের ইটের মতো। প্রকৃত পারফর্মার ও কাজের মানুষদের চিনে নেয়াটা জরুরী। সত্যিকারের পারফর্মার কে বা কারা-সেটাকে বের করে আনতে হয়।

ইতিহাস বলে, পারফর্মাররা নিভৃতচারী হন। তারা সামনে আসেন না, তাদের সামনে বের করে আনতে হয়।
রূপকথার কাজলরেখা সূচ কুমারের গল্প পড়েছেন কেউ?
এক রাজা তার রাজকন্যাকে কোনো এক রহস্যময় অজানা কারনে একবার জঙ্গলের মধ্যে বনবাসে রেখে আসতে বাধ্য হলেন। কন্যার নাম কাজলরেখা। তো কাজল রেখা জঙ্গলে তার কূটিরে থাকে। জঙ্গলের ফলমূল খায়। একা একা ইশ্বরকে ডাকে।

একদিন জঙ্গলের খালে স্নান করতে গিয়ে দেখে একটা ভেলাতে এক রাজপূত্রের শব ভেসে যাচ্ছে। কাছে গেলে দেখল, রাজপূত্রই। তবে তার সারা শরীরে সূচ বিদ্ধ। প্রায় মৃত। সাথে একখানা পত্র। যাতে লেখা, “কোনো সতিসাধ্বি কুমারী যদি ১২ বছর বসে প্রতিদিন সকালে স্নান, প্রার্থনা শেষে পবিত্র দেহে মনে একটি করে সূচ তুলে তাকে একটি বিশেষ গাছের পাতার রস খাইয়ে যেতে থাকে, তবে সে ১২ বছর পরে সুস্থ্য হয়ে যাবে। কাজলরেখা রাজপূত্রকে কূটিরে নিয়ে এলো।

রোজ সকালে জঙলের খালে স্নান করে। উপাসনা করে। তারপর রাজপূত্রের গায়ের একটি সূচ তুলে ওই বিশেষ গাছের পাতা বেটে রাজপূত্রকে খাইয়ে দেয়। এভাবে করতে করতে গেল ১১ বছর ১১ মাস ২৮ দিন। কঠোর সাধনা ও শ্রম কাজলরেখার। আর একটা সূচ তোলা বাকি। পর দিন সে জঙ্গলে স্নানে যাবার পথে দেখে খাল দিয়ে নৌকা করে এক বৃদ্ধ তার মেয়েকে বিক্রি করতে হাটে নিয়ে যাচ্ছে। কাজলরেখা তাকে দাসী হিসেবে কিনতে চাইল। কিন্তু তার কাছে পয়সা না থাকায় হাতের সোনার কাঁকন খুলে দিল। কঙ্কণ দিয়ে কিনল বলে, সে দাসীর নাম দির কঙ্কণ দাসী। কঙ্কণ দাসীকে সে ঘরে নিয়ে গেল।

তাকে কাজ বুঝিয়ে দিল। রাজকুমারকে দেখে কঙ্কণ দাসী জানতে চায়। কাজলরেখা তাকে সব খুলে বলে। পরের দিন কাজল রেখা স্নানে যাবার আগে কঙ্কণদাসীকে বলে গেল, তুমি একটু গাছের পাতাটা বেটে রাখো। আমি স্নান করে এসে উপাসনা করে বাকি একটা সূচ তুলে ফেলে রাজকুমারকে ওই পাতার রস খাইয়ে দিলেই তিনি সুস্থ্য হয়ে যাবেন। কঙ্কনদাসী সায় দিল।

কাজলরেখা স্নান করে কূটিরে ফিরল। তার মনে অনেক আনন্দ। আজ তার সাধনা পূর্ণতা পাবে। রাজকুমার সুস্থ্য হবে।
কিন্তু এ কী?

কাজলরেখা ঘরে ঢুকতে ঘটে গেল অভাবনীয় এক ঘটনা। সে দেখল, কঙ্কণদাসী বসে আছে রাজকুমারের পাশে, খাটিয়াতে। রাজকুমার সুস্থ্য হয়ে গেছে। কাজলরেখাকে দেখেই কঙ্কণদাসী বলে উঠল, “রাজকুমার, আমি হলাম কাজলরেখা। আমি আপনাকে গত ১২ বছর ধরে সেবা করে সুস্থ্য করেছি। আর ও হল কঙ্কণদাসী। ওকে আমি আমার হাতের কঙ্কণ দিয়ে কিনেছি।” রাজকুমার সাবেক কঙ্কণদাসী ওরফে নতুন কাজলরেখাকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালো। তারপর তাকে সাথে করে নিজে দেশে নিয়ে গেল। বিয়ে করে তাকে রাজরানী বানালো।

আমাদের কাজলরেখার কী হল জানতে চান তো?

কাজলরেখারা এভাবেই সারাজীবন খেটে যায়, শ্রম দেয়, নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক দিয়ে জান লড়িয়ে কাজ করে। আর দিনশেষে কঙ্কণদাসীরা চান্সে ছক্কা মেরে সেই ক্রেডিট ছিনতাই করে কাজলরেখা তথা হিরো বনে যায়।
গল্পের মাজেজা বহুমূখী। সে আরেকদিন হবে।

ওহ, সবকিছুতে ব্যক্তিগত গন্ধ খোঁজা ভাল নয়। পৃথিবী গোল।
অনেক সময়ই জুনিয়ররা আক্ষেপ করে থাকেন, সিনিয়ররা সব ক্রেডিট নিজেদের করে নেন।
ঘন্টার পর ঘন্টা খেটে, হোমওয়ার্ক ফিল্ডওয়ার্ক করে, নিজের আইডিয়া দিয়ে জুনিয়র কর্মীরা একটা প্রোজেক্ট, প্রোগ্রাম দাড়া করান আর সিনিয়ররা বা বসেরা সেটাকে বগলদাবা করে টপ ম্যানেজমেন্টকে দেখিয়ে পুরোটা ক্রেডিট নিজের বলে পুরষ্কারটা বাগিয়ে নেন।

অথচ যখনই কাজের কোনো ভুল হয়, তখনি নিজের কাঁধে দায়ীত্ব নেন না, সাথে সাথে জুনিয়রদের উপর দোষটা চাপিয়ে দেন।

অথচ হওয়া উচিৎ ছিল, বস বা লীডার সাফল্যের ক্রেডিট দেবেন পুরা টীমকে বিশেষত যে জুনিয়র বা সহকর্মীর জন্য সাফল্য এসেছে তাকে।

আর টীমের ভুলের দায় নেবেন নিজের কাঁধে।

জুনিয়রদের তাদের পারফর্মেন্স দেখানোর সুযোগ করে দিন। তাদের হাতে কাজ ছাড়ুন। তাদের এমপাওয়ারড করুন। জুনিয়রদেরকে সুযোগ করে দিন ম্যানেজমেন্টের সাথে ইন্টার‌্যাক্ট করার। তাদের কাজকে নিজে প্রেজেন্ট করার সুযোগ দিন।
টীম ক্লিক করলেই না আপনার ক্রেডিট।

একা একা বিশাল রাজ্যের রাজার মুকুট না পড়ে টীমকে নিয়ে ছোট একটা রাজ্যের রাখাল হওয়াও শ্রেয়।
পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের আলোচনায়, সবার শেষে একটি কথা যোগ করব। সেটি হল, এইচআরের সকল কাজের শুরু হয় শুরুর কাজটি দিয়ে। কিন্তু, পারফরম্যানস ইভ্যালুয়েশনের ক্ষেত্রে সেটি হবে উল্টো। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবে শেষের কাজটি দিয়ে।

সেটি হল রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ, পারফর্ম করলে কর্মী কী পাবেন, আর না করলে তার পরিণতি কী হবে, তা বছরের শুরুতেই নির্ধারন করে কর্মীর সামনে এনে দিতে হবে, প্রমোট করতে হবে এই রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে। তাহলে, কর্মী বছরের শুরু হতে সারাবছরই একটি লক্ষ্য ও ভয়কে সামনে রেখে কাজ করবেন।

মূলা ও ডুলা সামনে না থাকলে মানুষ কাজ কেন করবে?

তবে, তারও আগে যেটা করতে হবে, তার নাম এমপ্লয়ার ব্র্যান্ডিং। আপনার নিজের কর্মী ও বাইরে থাকা পোটেনশিয়াল বা ফিজিবল কর্মী তথা জব এ্যাপ্লিক্যান্ট বা জব সিকারদের কাছে আপনার প্রতিষ্ঠানকে একটি বড় ও স্বীকৃত এমপ্লয়ার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচীত করতে হবে। অন্যথায়, আপনার কর্মীরা ভাল পারফর্ম করার উৎসাহ না হয় রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট হতে পাবেন, কিন্তু, পারফর্ম না হলে শাস্তি পাবার বা চাকরি হারাবার ভয় ও পরোয়া যদি না থাকে, অর্থাৎ এই চাকরিতে বহাল থাকাকে যদি তার কাছে লাগসই করে প্রতিভাত না করা হয়, তাহলে সে পারফর্ম করবার তাগিদ দেন অনুভব করবে? সে তো বলব, “আরেহ, এই চাকরী গেলেই কী, থাকলেই কী?”

সুতরাং, সবার আগে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং, তারপরে রিওয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট ও স্ট্রাকচার, তার পরে KRA ও KPI ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স বা প্যারামিটার নির্ধারন ও পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন পদ্ধতি নির্ধারন, তার ভিত্তিতে পারফরম্যান্স রেটিং আর তারপরে রিওয়ার্ড প্রদান। মনে রাখতে হবে, গতানুগতিক যে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট আমরা দিই, সেটি কিন্তু পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের সবটা নয়। আমরা এই লেখায় মূলত পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন নিয়েই বেশি বলেছি। পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের আরও দিক রয়েছে। যাহোক, বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট হল ওভারঅল পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের একটি ছোট অংশ। বেশিরভাগ সময়ই সেই ইনক্রিমেন্ট আসলে পরিণত হয় এ্যাডজান্টমেন্ট টু ইনফ্লেশন। তাই ওখান হতে ওটাকে বের করতে হবে।

শুধু ইনকাম এ্যাডজাস্ট করলে হবে না, মানুষকে আয় বাড়িয়ে দিতে হবে তো। আর তার পরে, যোগ করতে হবে, আরো পুরস্কার ও ইনসেনটিভ। সেই পুরষ্কারে থাকবে আর্থিক ও অনার্থিক-সবরকমই।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:৫৯

শূন্য সারমর্ম বলেছেন:


বই লিখলেন ব্লগে?

২৪ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৪:০১

বেচারা বলেছেন: হা হা হা। ঠিক তা নয়। হ্যা, বপুখানা বিশাল।

২| ২৪ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:৩২

ঋণাত্মক শূণ্য বলেছেন: একটি পোষ্টে অনেক কিছু আলোচনা করে ফেলেছেন। প্রথম দিকে ভালো লেগেছে। পুরাটা পড়বার সময় পেলাম না। পরে পড়বো।

দেশে আসলেই পারফরমেন্স মেজারমেন্টে সমস্যা আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলি ঠিক ভাবে হিসাবই করে না।

লেখা চালিয়ে যান, এমন লেখা আমাদের দরকার। জব-ক্যারিয়ার-বিজনেস নিয়ে একটা ব্লগ করবার ইচ্ছা বহু বছরের, অর্থ এবং সময়ের অভাবে করা হয়ে উঠেনি।

২৪ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৪:০২

বেচারা বলেছেন: এখানে আসলে ডিটেল আলাপের সুযোগ থাকায় অনেক দিক নিয়ে বলেছি। আর, এখানে কপি করবার অন্যতম কারন, আমার নিজের সাইট নেই। বড় লেখা ইথারে রাখার জন্য সামহোয়্যার ছাড়া আর গতি নেই।

পড়ার জন্য কৃতজ্ঞ।

৩| ২৪ শে আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪২

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: কে পি আইয়ের নামে ভণ্ডামি করা হয় বাংলাদেশে। বসকে খুশি রাখা হোল নাম্বার ওয়ান কে পি আই বাংলাদেশে। এইটা ঠিক মত পারলে আর কিছুর দরকার নাই।

২৫ শে আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:২৪

বেচারা বলেছেন: কে।পি।আই এবং ও।কে।আর-উভয় মেথডই অটোমেটেড। বসের কিছুই করবার থাকে না।

আপনি যেটা বলছেন, সেটা হল, এসব মেথডকে ইগনোর করা হয়।

৪| ২৫ শে আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:৫৬

সাাজ্জাাদ বলেছেন: ভালো লিখেছেন. অনেক কিছু জানলাম. কাজে লাগবে.

৫| ২৫ শে আগস্ট, ২০২২ রাত ১০:১৯

ককচক বলেছেন: আসলেই যারা কাজ করে তারা তারা কাজলরেখার মতো বঞ্চিত হয়, আড়ালেই থেকেই যায়।

তথ্যবহুল পোস্ট। +

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.