নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমাজ, স্বাধীনতা ও আত্মশক্তি

১৮ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:৫৫



সমাজ, স্বাধীনতা ও আত্মশক্তি
ফকির ইলিয়াস
====================================
একজন মানুষকে আত্মশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হলে তার স্বাধীনতা থাকতে হয়। সেই স্বাধীনতা হতে হয় ন্যায়ের, সেই স্বাধীনতা হতে হয় সামাজিক কল্যাণের। অতিসম্প্রতি দুটি সংবাদ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত হচ্ছে। কর্মস্থলে স্কার্ফ নিষিদ্ধের পক্ষে রায় দিয়েছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আদালত। নিয়োগকর্তারা চাইলে কর্মস্থলে কর্মচারীদের মাথার স্কার্ফ বা এমন কোনো রকম ধর্মীয়, রাজনৈতিক কিংবা দার্শনিক প্রতীক পরায় বাধা দিতে পারবেন বলে রায় দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ আদালত।

ইউরোপজুড়ে রাজনৈতিকভাবে বহুল আলোচিত হচ্ছে এ বিষয়টি। ঠিক এই সময়েই প্রথম ইউরোপীয় কোর্ট অব জাস্টিস (ইসিজে) এমন আদেশটি দিয়েছে। তবে আদালত রায়ে এও বলেছে যে, কর্মদাতা প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মচারীদের নিরপেক্ষভাবে পোশাক পরার অভ্যন্তরীণ নীতির ভিত্তিতেই এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। কোনো কাস্টমারের ইচ্ছার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।

বেলজিয়ামের একটি ফার্ম ২০০৬ সালে মাথায় স্কার্ফ পরার কারণে একজন রিসিপশনিস্টকে বরখাস্ত করে। এরপরই কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন দাবি করে চাকরিচ্যুত সামিরা আচবিতা আদালতের শরণাপন্ন হন। পরে বেলজিয়াম আদালত বিষয়টির আরো পরিষ্কার ব্যাখ্যার জন্য ইউরোপের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি হস্তান্তর করে। ‘ওপেন সোসাইটি জাস্টিক ইনিশিয়েটিভ’ এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইইউ বৈষম্যহীনতা আইনে সমঅধিকারের নিশ্চয়তার বিষয়টি এ রায়ে দুর্বল হয়ে পড়বে।’

আরেকটি সংবাদ খুবই চিন্তিত করেছে বিশ্ববাসীকে। নারীদের স্বাধীনতা দেয়ার ব্যাপারে সৌদি আরবে নারী কাউন্সিল চালু করা হয়েছে। কিন্তু শংকার কথা হচ্ছে, কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো নারী ছিলেন না। ১৩ জন পুরুষের বৈঠকের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে কাউন্সিল। আল-কাশিম প্রদেশের প্রথম এ নারী পরিষদকে বলা হচ্ছে ‘কাশিম গার্লস কাউন্সিল’। বিবিসি তাদের সংবাদে বলেছে, খুব সম্ভবত নারীরা অন্য একটি কক্ষে ছিলেন এবং ভিডিওকলের মাধ্যমে বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।

আল-কাশিম প্রদেশের গভর্নর প্রিন্স ফয়সাল বিন মিশাল বিন সৌদ গার্লস কাউন্সিলের উদ্বোধনী বৈঠকের নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি সম্মেলন নিয়ে তিনি গর্বিত এবং সৌদি আরবে এ ধরনের উদ্যোগ এটিই প্রথম। তিনি বলেছেন, ‘কাশিম প্রদেশে আমরা নারীদের পুরুষদের বোন হিসেবে দেখি। আমরা নারীদের প্রতি আরো উদারতা দেখানো এবং তাদের আরো সুযোগ দেয়া যা নারী ও মেয়ে শিশুদের কাজে লাগবে সেটিকে আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি।’

সৌদি আরব বলছে, তারা মডারেট হচ্ছে। অথচ সৌদি আরবে নারীদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আছে। এমনকি সেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতিও দেয়া হয় না। কিন্তু তারা বলছে, ‘ভিশন-২০৩০ প্রোগ্রাম’-এর অংশ হিসেবে দেশটির সরকার নারীদের ওপর ওই সব বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করতে পারে। ওই প্রকল্পের অধীনে কর্মক্ষেত্রে ২২ থেকে ৩০ শতাংশ নারী কর্মী থাকার লক্ষ্যমাত্রাও ধার্য করা হয়েছে। গোটা বিশ্বেই একটা বৃহৎ অংশ নারী। চলমান পুঁজিবাদের আওতায় এটা ধরেই নেয়া হয় যে, নারীরা গৃহভিত্তিক নানা কাজ ও অন্যান্য বিষয়ে শ্রমদান করবেন। গৃহের কাজ কর্মসম্পাদন, শিশুদের লালনপালন ও বড় করে তোলাসহ নানা প্রকৃতির কার্যক্রম বিনা পারিশ্রমিকে করার জন্য নারীদের প্রচলিত সমাজ দয়িত্ব প্রদান করে রেখেছে। ফলে তাদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করাকে সমাজে ও অর্থনীতিতে অবমূল্যায়ন করে আসছে। একটু ভিন্নভাবে বিষয়টিকে দেখলে আমরা দেখতে পাব যে, মুনাফা লাভের জন্য শ্রমিকের বেতন কমানোর সূত্র থেকেই এর উৎপত্তি হয়েছে। মহামহিম লেনিন প্রাভদা নং ১০২-এ লিখেছিলেন- ‘বর্তমানে সমাজে বহু প্রকার দারিদ্র্য ও নিপীড়নকে আড়াল করে রেখেছে যা প্রাথমিকভাবে চোখে পড়ে না। কর্ম সময়ে, কর্মস্থল ও পরিবার উভয়কে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে দরিদ্র ও শহুরে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলো, শিল্পী, শ্রমিক, কর্মকর্তা এবং ছোট ছোট অফিস কর্মচারীরা তাদের জীবনে অবিশ্বাস্য রকম অসুবিধায় বসবাস করছে। মিলিয়ন মিলিয়ন নারী এরূপ পারিবারিক জীবনে গৃহদাসী হিসেবে দিনাতিপাত করে আসছে। পরিবারের সামর্থানুসারে তাদের খাদ্য, কাপড় ও অন্যান্য বিষয়ে অর্থ খরচ করেই সম্পাদন করা হয়, শুধু তারা নিজেদের পারিশ্রমিকটিই পান না। পুঁজিপতিরা তাদের প্রয়োজনে নারীদের নিয়োগ দান করে খুবই অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তারাও নিয়োজিত হয় ভাত-কাপড় ও নিজেদের কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য।’ শুধু প্রাচ্যে কেন, পাশ্চাত্যে এই চিত্র এখনো চোখে পড়ার মতো। আর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে জেন্ডার ইস্যুগুলোই প্রকৃত সমাধান করতে পারবে না এবং তা সত্যিকার কৌশলও নয়। নারী মুক্তির জন্য সর্বাগ্রে বুঝতে হবে নারী নিপীড়নের গভীরতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো যা জেন্ডারভিত্তিক শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জেন্ডার ইস্যু ও শ্রেণির প্রশ্নের আন্তঃসম্পর্কের মীমাংসাই আমাদের নারী স্বাধীনতার সংগ্রামে সফলতা এনে দিতে পারে। বিষয়গুলো আমি এ জন্য বলছি, আমাদের সামাজিক স্বাধীনতার যে বলয়- তার অন্যতম খুঁটি হচ্ছেন নারী সমাজ। সে নারীদের ভূমিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে লিখেছেন- ‘য়ুরোপের যেখানে বল আমাদের সেখানে বল নহে। য়ুরোপ আত্মরক্ষার জন্য যেখানে উদ্যম প্রয়োগ করে আমাদের আত্মরক্ষার জন্য সেখানে উদ্যম প্রয়োগ বৃথা। য়ুরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার। সেই স্টেট দেশের সমস্ত হিতকর কর্মের ভার গ্রহণ করিয়াছে- স্টেটই ভিক্ষাদান করে, স্টেটই বিদ্যাদান করে, ধর্মরক্ষার ভারও স্টেটের ওপর। অতএব এই স্টেটের শাসনকে সর্বপ্রকারে সবল কর্মিষ্ঠ ও সচেতন করিয়া রাখা, ইহাকে অভ্যন্তরিক বিকলতা ও বাহিরের আক্রমণ হইতে বাঁচানোই য়ুরোপীয় সভ্যতার প্রাণরক্ষার উপায়।’

আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে। তাহা ধর্মরূপে আমাদের সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া আছে। সেই জন্যই এতকাল ধর্মকে সমাজকে বাঁচানোই ভারতবর্ষ একমাত্র আত্মরক্ষার উপায় বলিয়া জানিয়া আসিয়াছে। রাজত্বের দিকে তাকায় নাই, সমাজের দিকেই দৃষ্টি রাখিয়াছে। এই জন্য সমাজের স্বাধীনতাই যথার্থভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। কারণ, মঙ্গল করিবার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা, ধর্মরক্ষার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা।

এতকাল নানা দুর্বিপাকেও এই স্বাধীনতা অক্ষুণœ ছিল। কিন্তু এখন ইহা আমরা অচেতনভাবে, মূঢ়ভাবে পরের হাতে প্রতিদিন তুলিয়া দিতেছি। ইংরেজ আমাদের রাজত্ব চাহিয়াছিল, রাজত্ব পাইয়াছে, সমাজটাকে নিতান্ত উপরি-পাওনার মতো লইতেছে- ফাও বলিয়া ইহা আমরা তাহার হাতে বিনামূল্যে তুলিয়া দিতেছি।

তাহার একটা প্রমাণ দেখো। ইংরেজের আইন আমাদের সমাজরক্ষার ভার লইয়াছে। হয়তো যথার্থভাবে রক্ষা করিতেছে, কিন্তু তাই বুঝিয়া খুশি থাকিলে চলিবে না। পূর্বকালে সমাজবিদ্রোহী সমাজের কাছে দণ্ড পাইয়া অবশেষে সমাজের সঙ্গে রফা করিত। সেই রফা অনুসারে আপসে নিষ্পত্তি হইয়া যাইত। তাহার ফল হইত এই, সামাজিক কোনো প্রথার ব্যত্যয় যাহারা করিত তাহারা স্বতন্ত্র সম্প্রদায়রূপে সমাজের বিশেষ একটা স্থানে আশ্রয় লইত। এ কথা কেহই বলিবেন না, হিন্দুসমাজে আচারবিচারে কোনো পার্থক্য নাই; পার্থক্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু সেই পার্থক্য সামাজিক ব্যবহারগুণে গণ্ডিবদ্ধ হইয়া, পরস্পরকে আঘাত করে না। ‘কবিগুরুর কথাগুলো আজও আমাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য। সমাজ প্রযুতির দিকে এগোচ্ছে। এগোচ্ছে মানবিক স্বাধীনতার দিকে। এই সত্যকে মানতে হবে। মননে, মনীষায় মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল, তা হলো মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতা। ধর্ম-বর্ণের স্বাধীনতা। এই সত্যটি যদি আমরা অনুধাবন করতে না পারি, তবে শান্তি বারবারই পরাহত হবে আমাদের সমাজে।
-------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ১৮ মার্চ ২০১৭

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.