নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

উৎসবের অর্থনীতি ও প্রজন্মের আগ্রহ

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৩৫



উৎসবের অর্থনীতি ও প্রজন্মের আগ্রহ
ফকির ইলিয়াস
======================================
বাঙালি জাতি আরেকটি বাংলা নববর্ষকে আমন্ত্রণ জানালো। উদযাপন করলো নতুনের আবাহন। দেশে বিদেশে বাংলা নববর্ষ বরণ দিনে দিনে নবরূপ পাচ্ছে। বিষয়টি খুবই আশাব্যঞ্জক। আমার কাছে মনে হয়েছে, বাঙালি নিজ সংস্কৃতির দিকে ফিরছে। শিকড়ের সন্ধানে এগিয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম।
খবর বেরিয়েছে, পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে সিরাজগঞ্জে বৈশাখের শাড়ি তৈরির ধুম লেগেছিল। হাজার-হাজার তাঁতি এখন নানা রংয়ের শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দিনরাত খটখট আওয়াজে মুখরিত ছিল জেলার এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কাজিপুর ও সয়দাবাদের তাঁতপল্লিগুলো।
ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী, বৈশাখী শাড়ির নকশা না থাকলেই নয়। তাই ছোট-বড় সবার মন ভরাতে তৈরি করা হয়েছে ডুগডুগি, তবলা, হাতপাখা ও ঘুড়ির আলপনাসহ নানান প্রতীক সম্বলিত নকশার শাড়ি। বাহারি ডিজাইন ও উন্নত সুতার কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সিরাজগঞ্জের শাড়ির ছিল ব্যাপক চাহিদা। এখানে প্রতিদিনই এসব শাড়ি কিনতে তাঁতিবাড়িতে ভিড় করেছেন ব্যাপারীরা। বৈশাখ উপলক্ষে সিরাজগঞ্জে অন্তত ১০ কোটি টাকার শাড়ি বেচাকেনা হবে বলে ধারণা ছিল তাঁতিদের।
এবারের বৈশাখ বরণ উপলক্ষে উৎসব বাণিজ্যও ছিল অনেক জমজমাট। পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ক্রেতারা ব্যস্ত ছিলেন বৈশাখী কেনাকাটায়। বৈশাখ বরণে ঢাকায় ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। ব্যবসায়ীরা এবার বিচিত্রিতা এনেছেন তাদের কালেকশনেও। এবারের নববর্ষ উপলক্ষে আড়ং-এ গরমে পরার জন্য আরামদায়ক সুতি কাপড়ের সালোয়ার কামিজ ও পাঞ্জাবি আনা হয়েছে। পোশাকে লাল-সাদার পাশাপাশি উজ্জ্বল রং যেমন হলুদ, কমলা, মেরুন ও নীল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া স্লিম ফিটের সুতির পাঞ্জাবিতে এপ্লিকের কাজ, এ্যামব্রয়ডারি, মাল্টি কালার প্রিন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। আর শাড়িতে এ্যামব্রয়ডারি, টাই ডাই এপ্লিকের কাজ রয়েছে। শাড়িগুলোর আঁচলে ঝুল ও বিভিন্ন আলপনা প্রিন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। ছিল রঙিন জামদানি ও হাফ সিল্কের চেক শাড়িও। মেয়েদের কামিজে এ্যামব্রয়ডারি ও টাই ডাই, ফুলেল প্রিন্টের কাজ করা হয়েছে। বৈশাখের সাজের সঙ্গে শাড়ি ও সালোয়ার কামিজের সঙ্গে মিলিয়ে পরার জন্য আড়ংয়ে আরো আনা হয়েছিল বিভিন্ন নকশার ব্যাগ, গহনা ও ঘর সাজানোর সামগ্রী।
বিষয়গুলো সমাজের জন্য খুবই দরকারি। কারণ বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি বেশ একটা কঠিন সময় পার করছে আমাদের সামাজিক বিবর্তনের প্রয়োজনে। খুবই আনন্দের কথা, বিদেশেও বৈশাখ বরণ উৎসবটি অত্যন্ত মর্যাদা পেয়েছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। নিউ ইয়র্কে তিনদিনব্যাপী বৈশাখ বরণ উৎসব পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
‘বাংলা নববর্ষ ১৪২৪’কে বরণের সবচেয়ে বড় উৎসবটি হয়েছে নিউ ইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে বেলাজিনো পার্কিং লটসহ সুপরিসর মিলনায়তনে। এ উপলক্ষে ১৪ এপ্রিল তথা পহেলা বৈশাখ জ্যাকসন হাইটসে বৈশাখী সাজে সজ্জিত হয়ে বাঙালি নারী-পুরুষ এবং শিশুদের ঢল নেমেছিল। আর উচ্ছল জনতার এই সরব উপস্থিতির স্পষ্ট ঘটে ডাইভার্সিটি প্লাজা থেকে বৈশাখী র‌্যালির মধ্য দিয়ে। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানে র‌্যালি এগিয়ে যায় বেলাজিনো পার্কে। এক পর্যায়ে পার্কসহ পুরো মিলনায়তন বাঙালির প্রাণে প্রাণে ভরে উঠে। এরপরই মূল মঞ্চে বেলুন উড়িয়ে দিনব্যাপী এই ‘বৈশাখী উৎসব’র উদ্বোধন ঘোষণা করে হোস্ট সংগঠন ‘বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউ ইয়র্ক'’।
ড্রামা সার্কেল নামক একটি সংগঠনের উদ্যোগে বৈশাখ বরণের বর্ণাঢ্য উৎসব হয় কুইন্স প্যালেসে। এখানে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, কন্সাল জেনারেল শামীম আহসান। গত দেড় দশকের মতো এই সংগঠনের বৈশাখ বরণ অনুষ্ঠানে এবারও পান্তা ইলিশ পরিবেশিত হয়। সঙ্গীতে অংশ নেন প্রবাসের বিশিষ্ট শিল্পীরা। এ সময় প্রদত্ত বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত প্রবাসের কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও বাঙালি সংস্কৃতি সমুন্নত রাখতে প্রবাসীদের নিরন্তর প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে এই নিউ ইয়র্কেও বড় ধরনের মঙ্গল শোভাযাত্রা হতে পারে।’ ‘গেলো বছরের গ্লানি মুছে, সকল অশুভ শক্তি পর্যুদস্ত করে মঙ্গলের পথে সকলে এগিয়ে যাই- এই হউক নতুন বছরের প্রত্যাশা’; বলেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মান্নান।
শুধু বাঙালি প্রজন্মই নয়- প্রচুর বিদেশিও বৈশাখী পোশাক পরে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন র‌্যালি-সমাবেশে। বিদেশিদের মাঝে আমাদের পাঞ্জাবি-শাড়ির যে চাহিদা বাড়ছে, তাও ছিল চোখে পড়ার মতো। নিউ ইয়র্কের ভারতীয়-বাংলাদেশি কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। দোকানিরা ভালো ব্যবসা করেছেন, জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী।
সাধারণত আমি বাংলাদেশের জাতীয় কিছু ছুটি ও উৎসবের সময় লম্বা ভ্যাকেশন কাটাই। বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ, দুই ঈদ উৎসব আমি পরিবারকে সাথে নিয়েই কাটাই। এবারের পয়লা বৈশাখেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু এবার আমার নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হলো। তা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
বৈশাখ বরণের একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে দুপুরের আড্ডায় গিয়েছিলাম। দেখলাম সেখানেও দুটি পক্ষ। একজন বলেই ফেললেন- ‘দেখুন, বৈশাখ বরণ আমাদের ঈদের চেয়েও বেশি ঘটা করে পালিত হচ্ছে।’ আমি পাল্টা জবাব দিলাম। বললাম, ঈদ একটি গোষ্ঠীর উৎসব। কিন্তু বাংলা নববর্ষ সকলের। সকল ধর্মের মানুষের, বাংলাদেশের। শুরু হয়ে গেল সেই পুরোনো কাসুন্দি। ‘মুসলামান’ আগে না ‘মানুষ’ আগে। আমি সাধারণত এসব বিষয়ে দীর্ঘ তর্ক করি না। কিন্তু সেদিন আর মুখ চেপে রাখতে পারলাম না। বেশ উচ্চস্বরেই কথা বললাম। কিন্তু মৌলাবাদ যাদের মগজ ধোলাই করে ছেড়ে দেয় তাদের বোঝানো বড় কঠিন কাজ। উত্তর আমেরিকায়ও এই মৌলবাদী শক্তিটি কম তৎপর নয়। তারা ঢুকে পড়েছে মসজিদে মসজিদে। বৈশাখ উৎসব আমাদের নয়, মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের এমন অনেক কথা তারা বলে বেড়াচ্ছে। ‘মঙ্গল’ শব্দটিই কি তবে তারা নাজায়েজ ঘোষণা করবে?
আমরা এতদিন জেনে এসেছি- বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান কোনো ধর্ম বা বর্ণের বিশেষ অনুষ্ঠান নয়। আবহমান কাল ধরে এটি বাঙালি সর্বজনীন জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হচ্ছে। বাঙালির চিরকল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুল ভ্রান্তি ও ব্যর্থতার গøানি ভুলে গিয়ে বাঙালি নতুন বছরের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় পালন করে থাকে নববর্ষ। উৎসবের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ। সেদিন সে সব মানুষের সঙ্গে একত্র হয়ে বৃহৎ সেদিন সেসব মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করে মহৎ’।
রবীন্দ্রনাথ ১৩০৯ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম বাংলা নববর্ষের উৎসব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথের বর্ষবরণের উদ্যোগ বাঙালির মানসপটে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে তার শেকড়ের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বাঙালির মনোজগতে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। বাঙালি সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বিশাল স্থান জুড়ে রয়েছে নববর্ষের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। এসব আচার-অনুষ্ঠান বাঙালির হৃদয়ে আনন্দ ধারা সৃষ্টি করে।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, একটি শ্রেণি এই রবীন্দ্রনাথকেই বিতর্কিত করতে চেয়েছে শুধু তার ধর্মীয় পরিচয়কে হাতিয়ার করে। ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকেই মনেপ্রাণে ও আচার আচরণে একটি শ্রেণি কখনোই বাঙালি হতে পারেনি। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে কোনো উৎসব বলে মনে করেন না। এরা একুশের অহঙ্কারকে অস্বীকার করে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকারের সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এরাই তো রাজাকারের, বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করেছে। আমরা ভুলে যাইনি, এই মৌলবাদী সা¤প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছে। এরা বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় কায়দায় অন্ধকারের অচলায়তনে আবদ্ধ করতে চায়। দেশে-বিদেশে এদের চ্যালা চামুণ্ডারাই বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে অস্বীকারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এবারে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যাবে না- এমন হুমকি বাংলাদেশে কেউ কেউ দিয়েছিল। তারা তা ঠেকাতে পারেনি। কারণ বাঙালি জাতি, এই প্রজন্ম তার শিকড়ের সন্ধানেই ফিরছে। প্রত্যেকটি উৎসবের পেছনে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক সাপোর্ট খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে এই কাজটি হচ্ছে। যা খুবই আশাজাগানিয়া। আমরা পাশ্চাত্যের দিকে তাকালে দেখবো, ভ্যালেন্টাইনস ডে, ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে, ইস্টার ডে, গুড ফ্রাইডে, এমনকি ক্রিসমাসেও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। আর ব্যবসার আমেজই হয়ে উঠে উৎসবের প্রাণ। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, দুর্গাপূজাও বাঙালির ‘অর্থনীতির উৎসবে’ পরিণত হয়েছে অনেক আদিকাল থেকে। বৈশাখ বরণ আগে তেমনটি ছিল না। গেলো ১৫ বছরে তা নবরূপে এসেছে। রমনার বটমূলের মূর্ছনা এখন ছড়িয়ে পড়েছে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টরোন্টো, টোকিও, মস্কো, সিডনি, প্যারিস, রোম, দুবাই, জেদ্দা, প্রভৃতি শহরে। এই সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ বাড়তেই থাকবে। তা কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। বাংলা সাহিত্য সভ্যতার ইতিহাস হাজার বছরের। যারা বিদেশে ইংরেজিতে কথা বলে, সেই প্রজন্মও বাংলা নববর্ষকে বরণে র‌্যালিতে নামছে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় বিজয় আর কী হতে পারে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক খোলাকাগজ ॥ ঢাকা ॥ ২৩ এপ্রিল ২০১৭ রোববার

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.