নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস

এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

ফকির ইলিয়াস › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাজী আরিফ : আমাদের সময়ের অগ্রপথিক

০৬ ই মে, ২০১৭ সকাল ৮:৩৯





কাজী আরিফ : আমাদের সময়ের অগ্রপথিক
ফকির ইলিয়াস
=========================================
হ্যাঁ, তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের অগ্রপথিক। কোথায় ছিলেন না তিনি! শিল্পে, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে। সমাজে, মননে, মনীষায়। তিনি জানিয়ে যেতেন, আমরা দাঁড়াতে চাই। দাঁড়াতে চাই কবিতায়। দাঁড়াতে চাই, একটি অগ্রসরমান প্রজন্মের হাত ধরে। কাজী অরিফের অনেক পরিচয় ছিল। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অস্ত্র হাতে।

পেশায় তিনি স্থপতি ছিলেন। আর নেশায়, আপাদমস্তক কাব্যপ্রেমিক। তিনি কবিতার মাঠে বিচরণ করতেন চব্বিশ ঘণ্টা। কাজী আরিফ আমাদের কৈশোরের নায়ক ছিলেন। রেডিও কিংবা টিভিতে তাঁর কণ্ঠ শুনলে আমরা চমকে উঠতাম। কী ভরাট উচ্চারণ! কী বর্ণিল তাঁর উপস্থাপনা।

সেই কাজী আরিফের সঙ্গে আমার ঢাকায় দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। প্রথম দেখা হয়েছিল নিউইয়র্কে। ১৯৮৯ সালে। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত আজকের ‘সাপ্তাহিক পরিচয়’ পত্রিকা তখন মাসিক হিসেবে বের হওয়া শুরু করেছে। এর সম্পাদক নাজমুল আহসান। আমি সেই কাগজের প্রধান প্রতিবেদক। নাজমুল ভাই-ই আমাকে কাজী আরিফের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন। সেই দিন থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় আরিফ ভাই।

আমি এই ‘পরিচয়’ পত্রিকাতেই তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রচ্ছদে তা ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কাজী আরিফ, আবৃত্তি শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

কাজী আরিফ ছিলেন একজন প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি হু হু করে হেসে কথা বলতেন। তিনিই জানিয়েছিলেন তার এই শিল্পবোধ সম্পন্ন শুরুর দিনগুলোর কথা। বলেছিলেন- ‘শুরুটা হয়েছিল এক মজার ঘটনা দিয়ে। ১৯৬৮ সালের দিকের কথা। একটা অনুষ্ঠানে উপস্থাপক আসেনি তাই আমাকে তুলে দেয়া হলো উপস্থাপনা করতে। আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতাম বলে তাদের ধারণা জন্মেছিল আমি উপস্থাপনা করতে পারব। হলোও তাই। তখন অনেকেই বলেছিল আমার কণ্ঠ আবৃত্তির কণ্ঠের মতো। কিন্তু ঠিক তখনই শুরু হলো না আবৃত্তিটা।

স্মৃতি আউড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সেই ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। আমি তখন ছাত্রলীগের রাজনীতি করি। এরপর যোগ দিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে আবার এসে ক্লাস শুরু করলাম বুয়েটে। মূলত তখনই প্রবলভাবে শুরু হয় আবৃত্তিটা।

১৯৭২ সালে আমি যখন বুয়েট হলে এসে উঠি তখন হল প্রায় ফাঁকা। অনেক কম ছাত্র ছিল। মারাত্মক নিঃসঙ্গতায় ভুগতাম আমি। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য শুরু করলাম বইপড়া। প্রচুর পড়তাম। ওই বছরেই অংশ নিলাম বুয়েটের এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। চ্যাম্পিয়ন হলাম নজরুল, আধুনিক ও রবীন্দ্রনাথ তিন বিভাগের আবৃত্তিতেই। এরপর থেকে যেখানেই প্রতিযোগিতা হতো সেখানেই অংশ নিতাম শুধুমাত্র পুরস্কার হিসেবে বই পাব বলে। এভাবেই আসলে আবৃত্তি শুরু।’

কাজী আরিফ ছিলেন, কাজী সব্যসাচীর সরাসরি ছাত্র। কিভাবে দীক্ষা পেলেন গুরুর থেকে? জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন- ‘সে অনেক কথা। আমি আসলে ওনাকে খুঁজতে থাকি ১৯৭২ সাল থেকেই, পাই ১৯৭৩ সালে। অনেক কষ্টে অনুমতি পাই কথা বলার। ওনাকে আবৃত্তি করে শোনালাম। ব্যস, সে থেকেই শুরু হৃদয়ের সেতুবন্ধন। তারপর তিনি নিজেই মাঝে মাঝে যেতে বলতেন আমাকে। আমি নিয়ম করে চলে যেতাম নজরুল ভবনে। গুরুর সামনে আবৃত্তি করতাম কবিতা। ভুল হলে তিনি শুধরে দিতেন। এভাবেই শেখা ওনার থেকে।’

কাজী আরিফ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি পেয়েছিলেন সেই ‘কাজী সব্যসাচী পুরস্কার’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠপুত্র আবৃত্তিশিল্পী প্রয়াত কাজী সব্যসাচী। বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম পথপ্রদর্শক, প্রবাদপ্রতিম এ শিল্পীর ৩৭তম প্রয়াণ বার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমবারের মতো ‘কাজী সব্যসাচী স্মৃতি পুরস্কার-২০১৬’ প্রবর্তন করে কাজী সব্যসাচী পরিবার। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যে এ পুরস্কার প্রদান করা হয় বাংলা ভাষার দুই খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শিল্পী কাজী আরিফকে। মনে পড়ছে, এই পুরস্কারটি পেয়েই তিনি নিউইয়র্কে ছুটে এসেছিলেন চিকিৎসার প্রয়োজনে। তারপর ফোনে আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর আনন্দের কথা। বলেছিলেন- ‘এটা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি ইলিয়াস। কারণ আমি সরাসরি সব্যসাচীর ছাত্র। পুলকিত হয়েছিলাম আমরা সবাই।

নিউইয়র্কের ‘বহুবচন’ নামে একটি সাহিত্যআড্ডার আয়োজন করেন নাট্যজন মুজিব বিন হক ও কবি শামস আল মমীন। সেই আয়োজনের সবগুলোতেই উপস্থিত থাকতেন তিনি, উত্তর আমেরিকায় এলেই। আমার পরম সৌভাগ্য, ‘বহুবচন’-এর অনুষ্ঠানে তিনি আমার লেখা কবিতা আবৃত্তি করে আমাকে চমকে দিয়েছিলেন। চিরকৃতজ্ঞ করে রেখেছিলেন আমাকে। তাঁর সঙ্গে আবৃত্তিশিল্প নিয়ে প্রায়ই আমার কথা হতো। হতাশা ব্যক্ত করতেন। বলতেন- ‘আবৃত্তির ভবিষ্যৎ দৃশ্যত অন্ধকার। কারণ, যে বা যারা আবৃত্তি করছে তাদেরটা ঠিকঠাক আবৃত্তি হয়ে উঠছে না। তাই, শ্রোতাপ্রিয়তা হারাচ্ছে।’ তাঁর এই অনুযোগ আজকের আবৃত্তিশিল্পীদের বিবেচনায় নেয়া দরকারি বলেই মনে করি।

গত বছর নিউইয়র্কে সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘ঘুংঘুর’-এর সম্পাদক কবি হুমায়ুন কবিরের কবিতা নিয়ে একক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান করেছিলেন কাজী আরিফ। সেখানেই চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছিলাম। বলছিলাম- ‘আরিফ ভাই চলুন একটা গ্রুপ ছবি তুলি!’ তিনি খিল খিল করে হেসে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- ‘হঠাৎ ছবির এত গুরুত্ব কেন ইলিয়াস! কি তুমি আমাকে নিয়ে অবিচুয়ারি লিখবা?’ আমিও হেসে দিয়েছিলাম উচ্চৈঃস্বরে। বলেছিলাম- ‘উই নিড ইউ এনাদার হানপ্রেড ইয়ারস, ইয়াংম্যান! তিনি আবারো হেসে বলেছিলেন- কয় কি? আমারে একশ বছর বাঁচায়ে রাখতে চায়! এক বছরও তো যাবে না! হ্যাঁ সেটাই তো হয়ে গেল প্রিয় আরিফ ভাই! এক বছরও পার হলো না! এভাবে বলে কয়ে চলে গেলেন আপনি! চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে আসার পরও বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখক হত্যার প্রতিবাদে প্রবাসীদের মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে মৌলবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বারবার। আমাকে বলেছিলেন, আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটলেই মৌলবাদ নিপাত যাবে।

১৯৭১ সালে ১ নম্বর সেক্টরে মেজর রফিকুল ইসলামের কমান্ডে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন কাজী আরিফ। এরপর যুদ্ধ শেষে বুয়েটে লেখাপড়া শুরু করেন আর সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে থাকে তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্পের অন্যতম রূপকার ছিলেন কাজী আরিফ। তিনি মুক্তকণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে।

কর্মজীবনেও তিনি ছিলেন বীর। তাঁর স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ডেক্সট্রাস কলসালটেন্স লিমিটেড থেকে করা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনাল, বিমান ভবন, ডেইলি স্টার ভবন, বিজিএমইএ ভবন, ইনডোর স্টেডিয়াম, গলফ ক্লাব, বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-লাইব্রেরি।

তাঁর শবদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ঢাকায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যারা আবৃত্তিকে জনপ্রিয় করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী আরিফ, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একটি প্রতিক‚ল সময়ে তিনি আবৃত্তিচর্চা শুরু করেছিলেন। নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে তিনি আবৃত্তিকে এক অন্য শিখরে তুলে দিয়ে গেলেন।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেছেন, সত্তর দশকের শেষ দিকে আরিফ আবৃত্তির সঙ্গে আর আমি নাটকের সঙ্গে যুক্ত হই। এভাবে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। আশির দশকে যখন আমরা আন্দোলন করি, তখন যে কবিতা প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে তা আমরা আরিফের কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারি। আশির দশকে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বনি-তরঙ্গে যে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ প্রকম্পিত করেছিলেন, সেই শহীদ মিনারেই রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধায় ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেষযাত্রায় চলে গেছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের এই অগ্রসেনা। দেশের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাওয়া কাজী আরিফকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পদক দেয়ার বিষয়টি ‘বিবেচনায়’ রাখবেন বলে জানিয়েছেন আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এমন ‘বিবেচনা’র আর কত জীবন অপেক্ষা করবেন আমাদের গুণীজন। না, কাজী আরিফ তাঁর জীবদ্দশায় সঠিক মূল্যায়ন পাননি। কেন পাননি? তা আমাদের ভাবতে হবে।

আমি প্রস্তাব করি, বাংলা একাডেমিতে কাজী আরিফের নামে একটি ভবনের নামকরণ করা হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আবৃত্তি বিষয়ে কোনো ইনস্টিটিউট যদি করা সম্ভব হয়, তাহলে তা যেন কাজী আরিফের নামে করার কথা সুবিবেচনায় রাখা হয়। আমরা আমাদের আলো হারাচ্ছি। আমরা মানুষগুলোকে হারাচ্ছি। হে রাষ্ট্র, তুমি তোমার যোগ্য সন্তানদের যথার্থ সম্মান আর কবে করতে শিখবে? আর কত অপেক্ষা করব আমরা? আরিফ ভাই, আপনার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।
-----------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৬ মে ২০১৭

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মে, ২০১৭ সকাল ৮:৪৭

চাঁদগাজী বলেছেন:


উনি যদি অগ্র পথিক হয়ে থাকেন, বাকীগুলোর অবস্হা কি?
বুয়েটের স্হপতি আমেরিকায় গাড়ী চালাতেন; অনেক বাংগালীকেই ড্রাইভ করতে হচ্ছে, তবে বুয়টের স্হপতি গাড়ী চালায়ে অগ্রপথিক হয়ে গেছেন? ভাবতে হয়, বাকীদের অবস্হা কি?এসব কথা কম বললে ভালো হতো!

১৩ ই মে, ২০১৭ সকাল ১১:০৯

ফকির ইলিয়াস বলেছেন: চাঁদগাজী,
ইউ আর জাস্ট এ আওলাদে রাজাকার।
দ্যাটস অল আই কেন সে...
নাথিং মোর দ্যান দেট

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.