নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ফাহমিদা বারী

আমার ব্লগ মানে গল্প। গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই :)

ফাহমিদা বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফলোয়ার

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৫৮



(কাউকে বলতে পারি না, আমার লেখা পড়ুন। কারণ আমি নিজেই সামুতে আর সময় দিতে পারি না। ফেসবুকে একটা পেজ চালাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। তবু মনে আশা, আপনারা হয়ত এখনো আমাকে ভুলে যাননি :)


সাজ্জাদের ইদানিং মাটিতে পা পড়ছে না।
অন্তত বন্ধুমহলে সেরকমই ধারণা। আর এই পা না পড়ার কারণ হচ্ছে সাজ্জাদের বিয়ে এবং তা থেকে পাওয়া মারাত্মক রকমের গুণবতী একখানা বউ। এত গুণবতী বউ যার বাসায় আছে, তার পা মাটি থেকে তিনহাত ওপরে থাকলেও কিছু বলার নাই।
বিয়ের পর অফিসে যেতেই কলিগরা ধরে বসলো, খাওয়াতে হবে। বেশিরভাগই তার বন্ধুশ্রেণীয়। সাজ্জাদ সাথে সাথেই রাজি। এ আর এমন কী! অফিসের পাশেই ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার রকম রেস্টুরেন্ট। তাতে দেশী, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান, জাপানিজ, ইটালিয়ান...সব ধরনের খাবারই মেলে। কাজেই বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে সাজ্জাদ বললো,
‘বেশ তো চল। কী খাবে? চাইনিজ নাকি ইটালিয়ান?’
কলিগরা সমস্বরে জোটবাঁধা গলায় বলে উঠলো,
‘উঁহু ওসব কিচ্ছু খাবো না। আমরা তোমার দেশি বউয়ের হাতের দেশি রান্না খাবো।’
সাজ্জাদ বুঝলো আগে থেকেই সবাই পরিকল্পনা করেই রেখেছে। কাজেই এদের ঠেকানো মুশকিল। সে একটু চিন্তায় পড়লো। সদ্য বিয়ে করা বউ। সাতদিনও হয়নি এখনো। সাজ্জাদ ওর বাবা-মা’র সাথে থাকে। রান্নাবান্না এখন পর্যন্ত ওর মা’ই করে। বউকে এখনো রান্নাঘরে ঢুকতে হয়নি। এতদিন অব্দি রান্নাঘরটা মায়ের একচেটিয়া দখলে ছিল। মেয়েদের সেটা বড় শখের ধন। কাজেই সেই রান্নাঘরে অন্য রাঁধুনির অনুপ্রবেশ মা কতটুকু মেনে নিবে বলা মুশকিল। তাই সাজ্জাদই বউকে বলে দিয়েছিল,
‘মা রাঁধছে রাঁধুক। তুমি এটা ওটা এগিয়ে দিও। মা কিছু না বললে রাঁধতে যাওয়ার দরকার নেই। ততদিনে শিখেও নাও কিভাবে রান্নাবান্না করতে হয়। পরে কাজে লাগবে।’
সাজ্জাদের বউ তনিমা কী বুঝেছিল কে জানে! ঘাড় নেড়ে লক্ষ্ণী মেয়ের মতো সম্মতি জানিয়েছিল। সাজ্জাদ বুঝতে পেরেছিল, রান্নাবান্নার ঝক্কি থেকে মুক্তি পাওয়াতে বউ ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছে। এই যুগের মেয়ে। এরা রাঁধার চেয়ে চুল বাঁধার পেছনেই বেশি সময় দেয়। এখন কলিগদের এই উজবুক আবদারে সমস্যাই হয়ে গেল। বউ কেমন রাঁধে, আদৌ জীবনে রান্নাবান্না করেছে কী না কে জানে! শেষমেষ একটা কেলেঙ্কারি না হয়! আর বন্ধুবান্ধবরা যে রকম ঠোঁটকাটা! খারাপ কিছু হলে হয়ত বাকী জীবন এই খোঁচাই হজম করে যেতে হবে।
চটজলদি সাতপাঁচ ভেবে নিয়ে সাজ্জাদ স্মার্টলি বললো,
‘আচ্ছা বেশ তাই হবে। দু’দিন সময় দাও। আয়োজন তো করি!’

দুদিন সময় পাওয়া গেল। আয়োজন আর কী! বউয়ের কাঁচা হাতের রান্না তো আর কলিগদের খাওয়ানো যাবে না। সাজ্জাদ ভেবে ভেবে একটা উপায় বের করলো। বাজার ঘাট করে এসে মায়ের হাতে সব তুলে দিবে। মা রান্নাবান্না করে শুধু ক্রেডিটটা তার বউ তনিমাকে দিয়ে দিবে। বাসায় গিয়ে নিজের আইডিয়ার কথাটা শেয়ারও করলো সবার সাথে। একটু ভয় ভয় করছিল। মা আবার এটা মেনে নিবে কী না! কিন্তু সাজ্জাদের সেই ভয় দূর হলো। তার মা রীতিমত স্পোর্টিংলি নিলেন বিষয়টাকে। হাসতে হাসতে বললেন,
‘আচ্ছা যা একদিনের জন্য তোর বউয়ের কাছে নিজের রান্নার স্বত্ব ছেড়ে দিলাম।’
সাজ্জাদ মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হলো। অন্য শাশুড়ি হলে এমনটা করতো কী না সন্দেহ আছে। মা মনমানসিকতায় আধুনিক, এটা অন্তত প্রমাণিত হলো। কিন্তু ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেঁকে বসলো স্বয়ং সাজ্জাদের বউ তনিমা। সে মুখ নীচু করে ফিনফিনে গলায় বললো,
‘কিন্তু তোমার বন্ধুরা তো আমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে। এবারের মতো আমিই রান্না করি। উনাদের মিথ্যে কথা বলে ঠকানোটা কি ঠিক হবে?’

সবাই অবাক। তনিমার শাশুড়ি আম্মা আমতা আমতা করে বললেন,
‘তুমি রাঁধতে পারো? ওর কলিগরা এই প্রথম খাবে আমাদের বাসায়। যদি রান্না তেমন...’
তনিমা শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বললো,
‘মা, আমি চেষ্টা করবো ভালো করে রান্না করার।’
এরপরে আর কথা চলে না। রাঁধুনি নিজেই যখন রাজি, তখন অন্যদের কি আর সাজে গলাবাজি? তবুও সাজ্জাদ আরেকবার শেষ চেষ্টা করে বলে,
‘দেখ...যদি কনফিডেন্স পাও! এখনো তো দু’দিন সময় আছে। আগামীকাল মা’র কাছ থেকে একবার ট্রেনিং নিয়ে নিতে পারো।’
তনিমা বাধ্য মেয়ের মতো মাথাটাকে একপাশে হেলিয়ে দেয়।

পরেরদিন শুক্রবার। রান্নাঘরে বেশ ছাত্রী শিক্ষিকা অধিবেশন চলল। সাজ্জাদ মাঝে মাঝে এসে ঢুঁ মেরে গেল। তার মাকে খুব উদ্যোগী মনে হচ্ছে। কড়াই খুন্তি ধরা থেকে শুরু করে পেঁয়াজ কাটাও স্টেপ বাই স্টেপ দেখিয়ে দিচ্ছেন। তনিমার এক্সপ্রেশন নৈবৃত্তিক। সে চুপচাপ মাথা নীচু করে সবকিছু দেখে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে দু’একটা প্রশ্ন করছে। তাতে এই অধ্যয়ন পর্বটা বেশ সচল থাকলো। শাশুড়ি আম্মা এতে বিশেষ উৎসাহিত হলেন। চুলায় কড়াই বসানোর কতক্ষণ পরে তেল দিতে হবে সেটা মিনিট সেকেন্ডের হিসাব ধরে বুঝিয়ে দিলেন। সাজ্জাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক, যেভাবে হাতে কলমে শিক্ষা চলছে তাতে রান্নাটা মনে হচ্ছে একেবারে যাচ্ছেতাই হবে না।
দাওয়াতের দিন সকাল থেকেই যজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। মাছ মাংশ কাজের লোকদের সহায়তায় কেটে বেছে পরিষ্কার করা হলো। এবারে আসল কাজ। তনিমা যতই আত্মবিশ্বাস দেখাক না কেন, সাজ্জাদের মা প্রথম থেকেই খুব একটা ভরসা পাননি। তাই ছেলের বউ চুলায় ননস্টিকের কড়াই বসানোমাত্র তিনি ফাঁকতালে পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। যে যাই বলুক, তার ছেলের সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। শেষে মুখে চুনকালি পড়লে তো তার ছেলেরই পড়বে! ছেলের বউ তো আড়ালেই থাকবে! তার আর তেমন কি আসবে যাবে?

তনিমা আড়চোখে শাশুড়ির উপস্থিতি দেখে নিয়েছে। পাশ থেকে অবশ্য তার ধারাভাষ্যও শুরু হলো সমান তালে।
‘কড়াই গরম হয়েছে? হুম...এখন তেল দাও। সাবধান তেল যেন খুব বেশি গরম না হয়ে যায়। তাহলে পেঁয়াজ দেওয়া মাত্রই পুড়ে যাবে। হ্যাঁ...এইটুকু ঠিক আছে। এখন পেঁয়াজ দাও। আরে আরে কী করছো? আস্তে আস্তে দাও!’
তনিমা মৃদু স্বরে বললো,
‘মা চিন্তা করবেন না। আমি পারবো।’
সাজ্জাদের মা এবারে একটু আহত হলেন। বউ কি তাকে অবহেলা করতে চাইছে? ঘোড়াকে ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে চাচ্ছে! অন্যসময় হলে দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতেন। কিন্তু এখন তো ভিন্ন পরিস্থিতি। একা একা মাতব্বরী করতে গিয়ে একটা ভজঘট না পাকিয়ে ফেলে!
তবু নিজের সম্মান বাঁচাতেই শেষমেষ রণে ভঙ্গ দিলেন। গালটাকে বেশ একটু ফুলিয়েই সরে এলেন রান্নাঘর থেকে। এদিকে ঘণ্টার পরে ঘন্টা কেটে গেল। রান্নাঘর থেকে কোন সাহায্যের আবেদন ভেসে এলো না। একটার পরে একটা আইটেম এসে জড়ো হতে লাগলো ডাইনিং টেবিলে। অপ্রসন্ন মুখে তনিমার শাশুড়ি প্রতিটি আইটেমের বাটির ঢাকনা খুলে খুলে দেখতে লাগলেন। তরকারীর রঙ চং দেখে অবশ্য আপত্তি করার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। মন চাইতে লাগলো, একটু চামচ দিয়ে চেখে দেখার। স্বাদ কতটা বলিহারী হয়েছে তা না দেখে তিনি কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সত্যি সত্যিই হাতে একটা চামচ নিয়ে মাংসের বাটি থেকে একটু ঝোল আর এক টুকরো ছোট মাংস তুলে নিলেন তনিমার শাশুড়ি। ঠিক সেই সময়েই হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকলো সাজ্জাদ। সে এতক্ষণ নিজের ঘরে টিভি দেখায় ব্যস্ত ছিল। সারি সারি খাবারের বাটি সাজানো দেখে অবাক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ওহ মা! রেঁধে ফেলেছো এর মধ্যেই! ওয়াও!’
তনিমার শাশুড়ি সাথে সাথে মাংস আর ঝোল আবার বাটিতে ঢেলে রাখলেন। মুখটা কালো করে বললেন,
‘তনিমা রাঁধছে। আমাকে তো দেখতেই দিলো না। কী জানি কেমন হলো!’
সাজ্জাদের মুখ পুরো হাঁ হয়ে গেল। এতগুলো রান্না তার আনাড়ি বউ একাই রেঁধে ফেলেছে! বলে কী!

রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বিস্ময়ের সীমা রইলো না সাজ্জাদের। তনিমা দশভূজা হয়ে একাই সবকিছু করছে। কাজের মেয়েটা চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দুই চুলায় রান্না বসিয়ে তনিমা চপিং বোর্ডে কী যেন কাটছে। মেয়েটা সাজ্জাদকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে একবার কৈফিয়তের সুরে বললো,
‘মামী...আমারে দ্যান। আমি বটিতে ঘচ কইরা কাইটা দেই!’
তনিমা নির্বিকার গলায় বললো,
‘নাহ্‌ যেভাবে কাটতে চাচ্ছি বলে বলে না দিলে কাটতে পারবি না। আমিই কাটি! তুই যা গিয়ে অন্য কাজ কর।’
তারপরে সাজ্জাদের দিকে চোখ পড়তেই বললো,
‘এই তো... প্রায় হয়ে গেছে। তোমার বন্ধুদের আসার আগেই সব হয়ে যাবে।’
বিস্ময়ের ধাক্কায় সাজ্জাদের মুখে কথাই সরলো না। ডাইনিং রুমে এসে দেখে তার মায়ের অবস্থাও একই রকম। ইতিমধ্যে তিনি প্রতিটি আইটেমই চেখে দেখেছেন। বিশ্বাস করতে পারছেন না... দু’দিন ধরে যাকে পই পই করে সবকিছু শেখালেন, সে নিজেই এতকিছু রান্না করে ফেলেছে! আর শুধু যে করেছে তাই নয়, প্রতিটি আইটেমই অসাধারণ হয়েছে।

খাবার টেবিলে বসে সাজ্জাদের কলিগরাও ভূয়ষী প্রশংসা করলো। খাওয়া দাওয়া শেষে গল্পের এক পর্যায়ে কেউ কেউ পিঠ চাপড়িয়ে তাকে অভিনন্দনও জানালো।
‘বউয়ের রান্না খেয়েই তো ওজন বাড়ায়ে ফেলবা এখন! মাঝে মাঝে আমাদেরকেও একটু চেখে দেখার সুযোগ দিও।’
দু’একজন আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলতেও ছাড়লো না।
‘এ যুগের মেয়েরা এত ভালো রান্নাবান্না জানে তাই তো জানতাম না। আমাদের বউদেরও তোমার বউয়ের কাছে তালিম দেওয়াতে হবে!’
তনিমার সামনেও প্রশংসার নহর ছুটলো। সে লাজুক হেসে বললো,
‘রান্না করতেই বেশি ভালোবাসতাম আমি। পড়া ফাঁকি দিয়ে ইউটিউবে রান্না শিখেছি।’
সাজ্জাদ যে স্ত্রীগর্বে কয়েক হাত ফুলে গেল, তা বলাই বাহুল্য। তনিমার রান্নার হাত যে এত অসাধারণ এই সত্যিটাই এতদিনে আবিষ্কৃত হলো! যাক, মায়ের একজন ভালো সহকর্মী জুটে গেল।

কিন্তু ঘটনা যে পথে এগুনোর কথা ছিল, সে পথে মোটেও এগুলো না। ইদানীং অফিস ফেরত সাজ্জাদ বউয়ের কাছে প্রায়ই এটা সেটা আবদার জুড়ে দেয়। যে আবদারগুলো আগে সবসময় সে মায়ের কাছেই জুড়তো। মায়ের রান্না তার সবসময়েরই প্রিয় ছিল। কিন্তু তনিমার রান্নাগুলো একেবারেই অন্যরকম। মায়ের হাতের পটলের দোলমা সাজ্জাদ অসংখ্যবার খেয়েছে। কিন্তু পটলের খোসা দিয়েও যে এত মজার খাবার রান্না করা যায়, এটা সে কোনদিনই জানতো না।
লোকে যেসব জিনিস ফেলে দেয়, সেগুলো দিয়েই কেমন মজার মজার খাবার বানিয়ে ফেলে তনিমা। সারাজীবন ঝিঙে সব্জিটা দু’চোখে দেখতে পারতো না সাজ্জাদ। যেভাবেই ঝিঙে রান্না করা হোক না কেন, সে এই সব্জিটাকে এড়িয়েই চলেছে এতদিন। কিন্তু সেদিন তনিমার হাতের ঝিঙে বাটা দিয়েই সাজ্জাদ এক থালা ভাত সাবাড় করে ফেলেছে। তার বাবার অবস্থাও একইরকম। কিছু একটা খেয়ে মুখে ধরলেই বউমাকে দুদিন পরেই আবার ফরমায়েশ করে বলেন,
‘সেদিনের ঐ রান্নাটা আবার কর না বৌমা!’
সাজ্জাদের মা ঠান্ডা চোখে পরিস্থিতি দেখে যেতে লাগলেন। ভালোমন্দ কিছুই বললেন না।

ইতিমধ্যেই সাজ্জাদের কলিগের বউরা সত্যি সত্যিই তনিমার সাথে যোগাযোগ করেছে। কেউ ফোনে, কেউবা ফেসবুকের মেসেঞ্জারে।
‘হ্যালো ভাবী, সেদিন আমার জামাইকে কী খাইয়েছেন বলুন দেখি। এখন তো আমার হাতের রান্না তার আর মুখেই রুচে না!’
এই ভাবীদের সাথে তনিমা’র এখন দু’একদিন পরে পরেই কথাবার্তা হয়। তাদেরই একজন তনিমাকে পরামর্শ দিল,
‘আচ্ছা ভাবী, আপনি এত দারুণ রান্না জানেন। ইউটিউবে সুন্দর কিছু রান্নার ভিডিও করে আপলোড করলেই তো পারেন!’
এটা অবশ্য তনিমার মাথায় আসেনি আগে। আইডিয়াটা মন্দ নয়। তার রান্নায় বৈচিত্র আছে। একধরনের রান্না দেখলে সে সেটা থেকেই অন্যরকম কিছু বের করে ফেলতে পারে। রান্নার ভিডিও আপলোড করে দেখা যেতে পারে। কেউ না দেখলে থেমে গেলেই চলবে।

সাজ্জাদের সহায়তায় এক ছুটির দিনে ভিডিও তৈরি হলো। শাশুড়ি আড়াল থেকে সবকিছুই দেখলেন। একবার কাছে এসে জিজ্ঞেসও করলেন,
‘কীসের ভিডিও করছো তোমরা? রান্নার ভিডিও করে কী হবে?’
ভিডিও করার কারণ বলতেই তার মুখ অন্ধকার হলো। ছেলের বউয়ের ভিডিও ইউটিউবে চলবে। দশজন পুরুষ মানুষ দেখবে। এটা একটা কথা হলো নাকি? কথাটা সাজ্জাদকে ডেকে আড়ালে বলেও ফেললেন। সাজ্জাদ মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকালো। কিছুদিন আগেও সাজ্জাদের মনে হয়েছিল, তার মা উদার মনের একজন মানুষ। নিজের রান্নার স্বত্ব ছেলের বউকে দিয়ে দিতেও তার কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না। অথচ আজকেই এ কীরকম বিপরীত কথাবার্তা!
সাজ্জাদ দু’নৌকায় সাবধানে পা রেখে বললো,
‘একটু শখ হয়েছে আর কী! আর তাছাড়া এখন তো অনেকেই এরকম ক্রিয়েটিভ কিছু জানলে সেটার ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে দিয়ে দেয়। লোকজন দেখে মতামত জানায়। উপকারী কিছু হলে তাদের কাজে লাগায়। কেউ কেউ লাইক দেয়। চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে। ফলোয়ার হয়। খারাপ কিছু তো না! আর ঠিক আছে... তোমার কাছে যদি ভালো না লাগে, এই ভিডিও আপলোড করার পরে আর করতে নিষেধ করবো।’
সাজ্জাদের মায়ের মুখের অমাবস্যা গাঢ় হলো। স্বগতোক্তির মতো করে বললেন,
‘তাই কর! বাড়ির বউ ফলোয়ার বানায়ে বেড়াবে এটা একটা কথা হলো নাকি?’

কিন্তু তনিমার আর ভিডিও আপলোডিং করা বন্ধ হলো না। তার পোস্টগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় হলো। হু হু করে ফলোয়ার বাড়তে লাগলো। এদিকে শাশুড়ি সারাদিন বাসাতে থাকে। তনিমা বুঝতে পারে, এসব ভিডিও তৈরি করাটা তার শাশুড়ি খুব একটা ভালো চোখে দেখছে না। এদিকে তার কাছে নিত্যনতুন আইটেমের রিকোয়েস্ট আসছে।
‘প্লিজ আপু... রুই মাছের এক্সেপশনাল একটা আইটেম দেখান প্লিজ।... ডিম দিয়ে কী কী আইটেম করা যায় আপু?... আমার বাচ্চা একদম সব্জি খেতে চায় না। সব্জির মজাদার কিছু দেখাতে পারেন আপি? বাচ্চারা পছন্দ করে এমন?’
প্রতিটি ভিডিওর কমেন্ট বক্স প্রশংসা আর অনুরোধে ভেসে যেতে থাকে। তনিমা চিন্তায় পড়ে যায়। সাজ্জাদও গাইগুঁই করতে থাকে।
‘বাদ দাও এখন এসব। মা যেহেতু ভালো চোখে দেখছে না... কী দরকার এসব করার?’

তনিমার হাত গুটিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। এতদিনে সে মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। নিজের ভালোলাগার জায়গাটা দিয়েই ঘরে বসে টাকা উপার্জন। এর চেয়ে ভালো কিছু আর কী হতে পারে?
কিন্তু সাহসেও কুলায় না। বর শাশুড়ি দুজনেই গররাজি। আগে সাজ্জাদই ভিডিও করে দিত। এখন তাকেও অনুরোধ করলে এড়িয়ে যেতে চায়। আর শাশুড়ি আম্মা তো সারাদিন বাসাতেই বসে থাকেন। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু করার জো নেই। তাই বেশ অনেকদিন সে কোন নতুন ভিডিও আপলোড করতে পারছে না।
একদিন দুপুরের পরে খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে একটু বিছানায় গা এলিয়েছে তনিমা। এমন সময়ে দরজায় টোকা। খুলে দিতেই দেখে তার শশুর দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একবাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা চিংড়ী। তনিমা জিজ্ঞাসু মুখে তাকাতেই বলেন,
‘চটপট রান্নাঘরে এসো বৌমা। তোমার শাশুড়িকে আজ জোর করে মার্কেটে পাঠিয়েছি। আমার একশো একটা ফরমায়েশ দিয়ে। সেদিন এই চিংড়ি মাছটা বাজার থেকে কিনে এনে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রেখেছিলাম। তোমার শাশুড়ির চোখ বাঁচিয়ে। শিগগির এসে একটা নতুন কোন আইটেম রান্না করে ফেল দেখি। কতদিন আর ফলোয়ারদের অপেক্ষাতে রাখবে?’

তনিমা অবাক গলায় বলে,
‘কিন্তু...বাবা...আপনি এসব...মানে আপনি কিভাবে জানলেন আমার ফলোয়াররা চিংড়ির আইটেম দেখতে চাচ্ছে?’
‘কিভাবে জানি মানে? আমিও তো তোমার একজন ফলোয়ার! মর্নিং ওয়াক শেষে পার্কে বসে বসেই তোমার সব ক’টি ভিডিও দেখেছি আমি! দারুণ সব রান্না। আজকের এই রান্নাটা আমি একাই চেখে দেখবো। ওরা মা-ছেলে রাতে এসে ডাঁটা চচ্চরি আর শিং মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে ভাত খাবে। তোমার শাশুড়ির যুগ যুগ পুরনো আইটেম!’
তনিমা কৃতজ্ঞ চোখে শশুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাড়াতাড়ি আয়োজন করে ঝটপট বানিয়ে ফেলে চিংড়ির মজাদার একটা চাইনিজ আইটেম। তার শশুরের দেখে আর তর সয় না। বাটিতে নিয়েই অর্ধেকটা সাবাড় করে ফেলেন।

রাতে খেতে বসে সাজ্জাদ বিমর্ষ মুখে ভাত তরকারি মাখাতে থাকে। শিং মাছের এই ঝোলটা দিয়ে ভাত খেতে ওর অসহ্য লাগে। মনে হয় যেন রোগীর পথ্য। পাশে তাকিয়ে দেখে তার বউ আর বাবা দিব্যি খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু মা’ও ভাত নাড়াচাড়া করছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বন্ধ ঘরের মধ্যে তনিমার শাশুড়ি তার শশুরকে জিজ্ঞেস করেন,
‘চিংড়ি কই? সব একাই খেয়ে ফেলেছো?’
শশুর ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলেন,
‘কীসের চিংড়ি? চিংড়ি কই থেকে আসবে?’
‘কই থেকে আসবে মানে? তোমার আদরর বৌমা দেখলাম চিংড়ি মাছের রেসিপি আপলোড করেছে! তাকে চিংড়ি কে এনে দিয়েছে...সেটা কি আমি জানি না মনে করেছো?’
তনিমার শশুর তখন ঘরের মধ্যেই লক্ষ তারা দেখছেন। মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,
‘চিংড়ি মাছের ভিডিও’র কথা তুমি কিভাবে জানলে?’
‘না জানার কী আছে? তোমার বৌমার পেজ তো আমিও সাবস্ক্রাইব করে রেখেছি। মানে...আমিও একজন ফলোয়ার। ভাবছি সামনের শুক্রবার কই পাতুড়িটা নিজে রেঁধে তোমার ছেলেকে খাওয়াবো। আমার রান্না তো সে আর গ্রাহ্যই করে না! এখন বল দেখি...চিংড়ি কই গেল?’

এদিকে পাশের ঘরেও তখন একই নাটক চলছে। সাজ্জাদ ছদ্মরাগ দেখিয়ে বউকে বলছে,
‘সব চিংড়ি একাই খেয়ে ফেললে? আমার জন্য একটাও রাখলে না? এই তোমার পতিভক্তি!’


মন্তব্য ৯ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:১০

আমি সাজিদ বলেছেন: হাহা। মজা পেলাম।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:২৭

ফাহমিদা বারী বলেছেন: ধন্যবাদ গল্প পড়ার জন্য :)

২| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:২৩

রাজীব নুর বলেছেন: লেখা চালিয়ে যান।
মনে রাখবেন বাংলাদেশে নারী লেখকের সংখ্যা কম।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:২৭

ফাহমিদা বারী বলেছেন: নারী লেখকে তো দেখি ফেসবুক সয়লাব। আর আপনি কী বলেন?

এত এত নারী লেখকের মাঝে পুরুষ লেখকই চোখে পড়ে না!

৩| ০১ লা মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৫০

নাসরীন খান বলেছেন: বেশ ভালো লাগল।

৪| ০১ লা মার্চ, ২০২১ দুপুর ১:১৬

এম ডি মুসা বলেছেন: ভালো উপদেশ দিয়ে নিজেই পথ ভুলে গেছি, এখন কেউ সাহায্য তো দূরের কথা
কিভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াব সেটা কেউ বলেনা। এটার জন্য নিজের বড় দুঃখিত

৫| ০১ লা মার্চ, ২০২১ দুপুর ১:১৭

এম ডি মুসা বলেছেন: গল্প টা ভালো লেগেছে,

৬| ০১ লা মার্চ, ২০২১ বিকাল ৩:৪৮

করুণাধারা বলেছেন: চমৎকার গল্প!! টক মিষ্টি স্বাদের...

৭| ০৬ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১:১৮

ঢুকিচেপা বলেছেন: গল্পটা ভালো লেগেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.