নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: মৃত্তিকা ও বহ্নি

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৩২

মৃত্তিকা ও বহ্নি, আমার দুই কন্যার হাত দু’হাতে ধরে প্রতিদিন সকালে স্কুলে পৌঁছে দিতে হয়। মেয়েদের স্বনামধন্য স্কুলটি পায়ে হাঁটা দূরত্বে হলেও সেই দূরত্বটা নেহায়েত কম নয়। সরকারি চাকুরির সূত্রে শহরের একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করি বলে আমার সামাজিক অবস্থান খানিকটা উপরের দিকে। তবে কেউ যদি আরেকটু এগিয়ে আর্থিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে যান, তাহলেই বেরিয়ে পড়ে আসল চেহারা। গাড়ি কেনাটা আমার জন্যে বিলাসিতা নয় প্রয়োজন, কিন্তু এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বাহনটি কায়ক্লেশে কেনা সম্ভব হলেও বাহনের চালক ও জ্বালানির নিয়মিত চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। নগরীর যানবাহন চলাচল নির্বিঘœ করতে সম্প্রতি আমাদের এই পথে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা করা হয়েছে। অতএব জন্মসূত্রে প্রাপ্ত চরণ যুগলের উপরে ভরসা করা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যান্তর নেই। খুব ভোরে উঠে কন্যাদ্বয়ের মা যখন সকালের নাস্তা, স্কুলের টিফিন ইত্যাকার নিত্যকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সেই সময় মেয়েদের ঘুম থেকে জাগিয়ে স্কুলে যাবার মতো করে তৈরি করিয়ে, কিছুক্ষণ নাস্তা খাওয়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত দু’জনের কাঁধে দুটি বিদ্যার বোঝা চাপিয়ে স্কুলের পথে হাঁটতে শুরু করি।



প্রতিদিন একই পথে যাওয়া আসার ফলে রাস্তার দুপাশের দোকান-পাট, দেয়াল ও ফুটপাথ এবং ইট পাথরের আগ্রাসনের মধ্যে টিকে থাকা গাছপালা-ঝোপঝাড়সহ প্রায় সব কিছুই আমার পরিচিত। পথের প্রতিটি বাঁক এবং খানাখন্দ আমি নির্ভুল বলে দিতে পারি। এমন কি কোথায় কোন সাইনবোর্ডে ভুল বানানে কি লেখা আছে তাও আমার অজানা নেই। আমার মনে হয় জেব্রাক্রসিং না থাকলেও কোথায় রাস্তা পার হতে হবে সে কথা এখন মৃত্তিকা এবং বহ্নিও ঠিক ঠিক জানে।



জমজ সন্তানদের আচার আচরণ এবং কথা বার্তায় অদ্ভূত সাদৃশ্য থাকলেও মৃত্তিকা এবং বহ্নির ক্ষেত্রে এই প্রচলিত ধারণা একেবারেই খাটে না। দুজনের চেহারা একই রকম, ফলে ঘনিষ্টজনেরাও অনেক সময় মৃত্তিকা ও বহ্নিকে তাদের সঠিক নাম দিয়ে চিহ্নিত করতে পারেন না। তবে ওদের স্বভাব চরিত্র আলাদা, চিন্তা ভাবনা ভিন্ন এবং দুজনের প্রকাশ ভঙ্গীতেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মৃত্তিকা বয়সে সামান্য সময়ের বড়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ভাব গম্ভীর, বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে পৌঁছাবার পথটুকুতে সে প্রায় কোনো কথা বলে না বললেই চলে। অন্যদিকে বহ্নি স্বভাবে চঞ্চল, সারাক্ষণ ছটফট করতেই থাকে। স্কুলে যাবার রাস্তা জুড়ে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে সে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকে। তার কৌতুহলের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। পরিচিত পথ, চেনা দোকান অথবা পুরোনো সাইনবোর্ড নিয়ে সে অনায়াসে বের করে ফেলে নতুন নতুন জিজ্ঞাসার বিষয়।



আমার সরকারি আবাস থেকে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে রাস্তায় চলতে শুরু করলেই হাতের ডানে অযতেœ বেড়ে ওঠা ঝোপ জঙ্গলে পূর্ণ একটা ডোবা মতো জায়গা। শহরের অত্যন্ত মূল্যবান আবাসিক এলাকায় কাঁটাতারে ঘেরা এই অপ্রয়োজনীয় জলাশয়টি এখনো ভূমিদস্যুদের নজর এড়িয়ে টিকে আছে কি করে তা এক বিস্ময়। গত কয়েক বছরে এই এলাকার অনেক পুরোনো বাড়ি ভেঙে বহুতল ভবন উঠে গেছে, খেলার মাঠ রূপান্তরিত হয়েছে বিপনী কেন্দ্রে, বন জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত জমিতে নির্মিত হয়েছে সুদৃশ্য এ্যাপার্টমেন্ট। বিষয়টি আমার মতো বহ্নিরও চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই কিন্তু এতো দিন কোনো প্রশ্ন করেনি কেন সেটাই ভাবছিলাম। এই সময় আকস্মিকভাবেই সে বহুদিনের কাক্সিক্ষত প্রশ্নটি করে বসে, ‘এখানে এই পুকুরটা ভরাট করে বাড়ি বানাচ্ছে না কেন বাবা?’

বললাম, ‘যাদের জায়গা তাদের হয়তো আরও অনেক বাড়ি আছে, নতুন কোনো বাড়ি দরকার নেই অথবা তারা দেশেই থাকে না।’

‘তাদের যদি দরকার না থাকে তাহলে যাদের বাড়ি দরকার তাদের দিয়ে দিলেই তো পারে।’ কন্যার সরল মন্তব্য।

‘মানুষ তো কেউ কারও জিনিস এমনিতে দিয়ে দেয় ন, টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয়।’

‘ও আচ্ছা!’ টাকা যে একটা মহা মূল্যবান বস্তু এটা সে এই বয়সেও বুঝতে শিখেছে। তবুও কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পরে সে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের টাকা থাকলে আমরাও এই পুকুরটা কিনে বাড়ি বানাতে পারি, তাই না বাবা?’

‘তা হয়তো পারি, তবে প্রথম কথা হলো এই জায়গাটা কিনতে হলে অনেক টাকা দরকার, সেই টাকা আমি কখনোই জোগাড় করতে পারবো না। তাছাড়া জায়গার মালিক যদি পুকুরটা বিক্রি করতে না চান তাহলে টাকা থাকলেও কেনা সম্ভব নয়।’

‘এখানে বাড়ি হলে আমরা একা একাই স্কুলে যেতে পারতাম।’ নিজের মনে কথটা বলে সে দিনের মতো নতুন কোনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকে বহ্নি। অল্প কিছুক্ষণ পরে দুজনকে স্কুলের গেটে ছেড়ে দিয়ে উল্টো পথে হেঁটে যাই আমি।



মেয়েদের প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয় না। কাজেই ফেরার পথে বহ্নির কোনো প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞাসার উত্তর তার মাকেই খুঁজে বের করেতে হয়। তবে যতদূর মনে হয় ফেরার পথে ক্ষুধা এবং ক্লান্তিতে প্রশ্ন করার কোনো উৎসাহ তার থাকে না। তাছাড়া বাবার কাছে প্রশ্ন করে যতো সহজে উত্তর পাওয়া যায়, মাকে প্রশ্ন করে সেই সুখ নেই। কোনো বিষয়ে যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গের বাইরে কথা বললেই বকুনি খেতে হবে। অতএব সে বুঝে ফেলেছে চুপচাপ হেঁটে বাড়ি ফেরাই ভাল। শিশুরা যে যুক্তির বেড়া জালে আটকে থাকতে নারাজ এবং প্রয়োজনের বাইরে কথা বলাতেই যে তাদের আনন্দ এ কথা যুক্তি দিয়ে তাদের মাকে বোঝাতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।



আমাদের যাত্রা পথে বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য এ্যাপার্টমেন্ট, একটি বহুতল ভবন, কিছু খুচরা দোকান পাট ও একটি শপিং মল ছাড়াও উঁচু দেয়াল ও পাহারা চৌকিসহ লোহার গেট এবং গাছ পালায় ঘেরা একটি বসত বাড়ি শুরু থেকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এ বাড়ির প্রবেশ পথের বাইরে লোহার গেটের দুপাশে দুটি রক্ত করবির গাছ, গাছের নিচে বন্দুকধারী দুজন পুলিশ। তারা কখনও হাঁটাহাঁটি করে আবার কখনও বন্দুক কাঁধে ফেলে অলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কোনো দিন পুলিশ দুজনের চেহারা দেখা যায় না। সেন্ট্রিপোস্টের ফোকর দিয়ে বন্দুকের নল বের করে তারা লুকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে লোহার ফটকের ওপার থেকে কুকুরের ডাক শোনা যায় এবং এই কুকুর যে বাংলা ভাষায় ঘেউ ঘেউ করে না তা আমার কন্যাদ্বয়ও বুঝতে পারে। সে কারণেই শুধু বহ্নি নয়, মৃত্তিকাও তার স্বভাব বিরুদ্ধভাবে দুএকদিন এই বাড়িটি নিয়ে দু একটি কথা বলেছে। আমার নিজেরও কিছুটা কৌতুহল ছিল বলেই খোঁজ নিয়ে জেনেছি সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এই বাড়িতে বসবাস করেন।



মেয়েদের স্কুল জীবনের প্রথম দিকে কাঁটাতারের বাড়তি নিরাপত্তা ঘেরা উঁচু দেয়াল ঘেঁষে উত্তর দক্ষিণের ফুটপাথ ধরে চলাচল করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও মৃত্তিকা বহ্নিকে একটু সামনে এগিয়ে দিয়ে তাদের পেছন পেছন হাঁটছিলাম আমি। রক্ত করবি গাছের নিচে যেখানে ফুটপাথ ঢালু হয়ে রাস্তায় মিশে গেছে মেয়েরা সেখানে পৌঁছতেই বন্দুকধারী শান্ত্রীদের একজন তাদের পথ আগলে দাঁড়ায়।

‘এই পথ দিয়া যাওয়া যাবে না, ওপারের রাস্তায় যান।’

‘কেন যাওয়া যাবে না? আমরা তো প্রতিদিনই যাই!’ পুলিশি প্রতিরোধের উত্তরে বহ্নির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।

‘প্রতিদিন যান ঠিক আছে, কিন্তু আজ এক্ষণ যাওয়া নিষেধ! মন্ত্রী মহোদয় বাইরে বের হবেন।’



রোবোট যেমন রিমোট কন্ট্রোলে চলে তেমনি পোষাকধারী প্রত্যেকেই চলে হুকুমে। পৃথিবী উল্টে গেলেও হুকুমের নড়চড় হবার জো নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে কন্যাদ্বয়ের হাত ধরে রাস্তা পেরিয়ে ওপারের ফুটপাথে উঠলাম। রাস্তায় তখন অফিস এবং স্কুলমুখি প্রভাতী যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। কাজেই রাস্তা পার হওয়াটা খুব সহজ হলো না। ওপারের ফুটপাথে উঠে বহ্নির প্রথম প্রশ্ন, ‘মন্ত্রী মহোদয় কী বাবা?’

‘মন্ত্রী অর্থ হলো যারা মন্ত্রণা দেনÑ মানে দেশ কীভাবে চলবে, কী করলে দেশের ভাল হবে এ সব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন।’

‘আর মহোদয়? মহোদয় মানে কী?’

‘মহোদয়রা সব মহান লোক, অনেক বড় মাপের মানুষÑ তারা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। অর্থাৎ যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন তাদেরকেই বলা যায় মহোদয়। আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা দেশ পরিচালনার ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দেন।’

এবারে অনিবার্যভাবেই বহ্নি প্রশ্ন করে, ‘সরকার কে বাবা?’

সরকার যে কে অথবা সরকার জিনিসটা আসলে কী তা আমি নিজেও খুব ভাল করে জানি না। তারপরেও মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তো উপায় নেই। আমি আমার নিজস্ব চিন্তা থেকে সরকার সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করি।

‘পাঁচ বছর পর পর দেশের মানুষ ভোট দিয়ে তিন শ জন লোক নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায়Ñ সেখানে তারা একটা সরকার গঠন করে। সংসদ ভবন দেখেছো না?’

‘দেখেছিÑ ঝন্টু মামার সাথে আমরা একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। সংসদে তো সবাই বেড়াতে যায়।’

‘সংসদের বাইরে অনেকে বেড়াতে যায় আর ভেতরে জনপ্রতিনিধিরা বসে সরকার পরিচালনার নিয়ম নীতি ঠিক করেন, আইন তৈরি করেন। মন্ত্রী মহোদয়রা জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নের উত্তর দেন...’

‘সরকারও কি সংসদ ভবনে থাকেন?’ আমাকে শেষ করতে না দিয়ে বহ্নি আবার প্রশ্ন করে।

‘সরকার তো কোনো মানুষ নয়Ñ সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিব এইসব মিলিয়েই সরকার আর কী!’

উত্তরটা দিয়েই আমার মনে হলো, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। এখনি প্রশ্ন আসবেÑ ‘সচিব কী বাবা?’ কিন্তু ভাগ্য ভাল, কথা বলতে বলতে আমরা স্কুলের গেটে পৌঁছে গেছি। অতএব নতুন কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে দুই বোন হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলে আমি ফিরতি পথে হাঁটতে শুরু করি। বাড়ি ফেরার সময় পুরোটা রাস্তা জুড়ে আমার মাথায় সরকার সম্পর্কিত ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে।



প্রায় বছর দশেক সরকারি চাকরি করেও আমি জানি না সরকার আসলে কে অথবা কি! সরকারের সিদ্ধান্তগুলো প্রকৃতপক্ষে কার সিদ্ধান্ত?



অভ্যাসবশত আমি হাতের বাঁ দিকের ফুটপাথ অর্থাৎ মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম।

মন্ত্রী মহোদয়েরা কি স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, নাকি তাদের উপর অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে নির্দেশ আসে? পরামর্শক কিংবা অন্যকোনো তাহলে মন্ত্রী মহোদয়েরা কি ঠুঁটো জগন্নাথ?



সকালে স্কুলে যাবার পথের ঘটনাটা মনে হবার সাথে সাথে চলমান গাড়ি এবং রিকশার মাঝ দিয়ে বেশ ঝুঁকি নিয়ে দ্রুত পার হয়ে অপর পারের ফুটপাথে উঠলাম।

সরকারের ভেতরে সরকার বলে একটা জটিল মানসাঙ্ক প্রায়ই আমাদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়Ñ সেই জটিলতা নিরসনের কোনো উদ্যোগ প্রকৃত সরকার নেয় না কেন? সরকারের কাজে ও কথায় মিল থাকে না কেন?



পথের জেব্রাক্রসিং থেকে ডোরাকাটা দাগ পুরোপুরি উধাও হয়ে যাবার অনেকদিন পরে জেব্রার গায়ে নতুন করে সাদা রঙের প্রলেপ দেয়া হয়েছে। তারপরেও রাস্তা পার হবার সময় একটা গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যাল এবং পথে বিছানো জেব্রাকে উপেক্ষা করে হার্ডব্রেক কষে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।

সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কারা বাধা দেয়? তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে না কেন?



বাড়ির কাছাকাছি এসে আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত প্রবেশ পথ খুঁজে বের করতে একটু সমস্যা হলো।

সরকারের চেহারা আসলে কেমন, হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে যারা নিজেদের মুখচ্ছবি দ্রুত পাল্টে ফেলে ক্ষমতার স্রোতে মিশে যেতে পারে, সেইসব গিরগিটিরাই সরকারের মূল চালিকা শক্তি। একদল গিরগিটি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে...



ভীষণভাবে ঘামতে ঘামতে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আমার অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার, এতো ঘামছো কেন? প্রেসার বেড়েছে বোধ হয়।’



রক্তচাপ মেপে দেখার সময় এবং সুযোগ কোনোটাই ছিল না। অতএব ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরে অফিসে যাবার প্রস্তুতি হিসাবে গোসলখানায় ঢুকে গেলাম।



মন্ত্রী মহোদয়ের শান্ত্রীদের এড়াবার জন্যে পরদিন থেকে আমরা সকালে স্কুলে যাবার পথে বাঁ দিকের এবং ফেরার পথে ডান দিকের ফুটপাথ ব্যবহার করি। সপ্তাহ দুয়েক এ ভাবেই চলছিল। দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির পর হঠাৎ এক রবিবার সকালে দেখা গেল বাঁ দিকের ফুটপাথ জুড়ে দীর্ঘ এক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। হয়তো পানি অথবা গ্যাসের পাইপ লাইন নতুন করে বসানো হচ্ছে বা পরিবর্তন করা হচ্ছে। অথবা বিদ্যুৎ কিংবা টেলিফোনের তার বসানোর কাজ চলছে। ব্যাপারটা যাই হোক সাইন বোর্ডে লেখা হয়েছে, ‘উন্নয়ন কাজ চলিতেছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিতÑ কর্তৃপক্ষ।’ এই কর্তৃপক্ষ যে কে বা কারাÑ আল্লা মালুম!



নিতান্ত বাধ্য হয়েই দুই কন্যার হাত ধরে আবার মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ির সামনের ফুটপাথ ধরতে হলো। বাড়ির সামনে রক্ত করবি গাছের তলায় একজন সেপাই বন্দুক কাঁধে অলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। বন্দুকধারী শান্ত্রীর কাছাকাছি এসে বহ্নি উপরের দিকে তাকিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘রক্ত করবি ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে কেন বাবা?’

গত কয়েকদিনে একেবারেই নজরে পড়েনি। কিন্তু বহ্নির সাথে সাথে আমিও তাকিয়ে দেখলাম, রক্ত করবির ফুল তো বটেই বেশ কিছু ডালপাতাও শুকিয়ে গেছে। গাছটা বোধহয় বাঁচবে না। একটা ফুল বা ফল গাছের মরে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকে। কিন্তু বহ্নির জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর কী হতে পারে! বললাম,‘বন্দুকের নলের নিচে কোন গাছই শেষপর্যন্ত বাঁচে না। বারুদের গন্ধে ফুল পাতা সব শুকিয়ে যায়।’

‘বন্দুক হাতে নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়কে পাহারা দেয় কেন বাবা?’

‘যে কোনো মানুষ যেনো হঠাৎ করে মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়িতে ঢুকে পড়তে না পারে, কিংবা অকারণে তাকে বিরক্ত করতে না পারে, সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা।’

‘তার মানে মন্ত্রী মহোদয় লোকজন মোটেও পছন্দ করেন না,’ একটু থেমেই আবার প্রশ্ন করে, ‘বাড়িতে ঢুকতে গেলে মন্ত্রী মহোদয় কি সবাইকে তাড়িয়ে দেন?’



গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার কন্যার মনে অতি অল্প বয়সেই একটা বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হোক তা কোনক্রমেই কাম্য হতে পারে না। তাই তাড়াহুড়ো করে বললাম, ‘তা হবে কেন! জনগণকে নিয়ে, জনগণের সেবা করাই মন্ত্রী মহোদয়দের কাজ। তবে সবাইকে খুশি করা তো কারও পক্ষে সম্ভব নয়, সে কারণে তাদের শত্রুরও কোনো অভাব নেই। কেউ তার উপর হামলা করে গুলিও চালিয়ে দিতে পারে, তাই তার নিরাপত্তার জন্যে এই পুলিশ পাহারা।’

আমার উত্তর শুনে বহ্নি তাৎক্ষণিকভাবে নতুন কোনো প্রশ্ন করে না। একটু সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে বলে, ‘এতো ঝামেলা করে মন্ত্রী মহোদয় হবার দরকার কী!’



দিন কয়েক পরে অভিভাবক দিবস উপলক্ষে এক শনিবার বেলা দশটার দিকে দুই কন্যা এবং তাদের বাবা মাÑ অর্থাৎ আমাদের চারজনের পুরো পরিবার স্কুলের পথে রওনা হয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে ডান এবং পরে বাঁ দিকে ঘুরে ফুটপাথে উঠবার পরে দূর থেকেই বুঝতে পারলাম কোথাও কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। আরও একটু এগিয়ে কাছে যাবার পরে দেখা গেল, মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ির বাইরে ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যারিকেডের এ পাশে কয়েক শ উত্তেজিত মানুষ জড়ো হয়ে ঘনঘন শ্লোগান দিচ্ছে আর ও পাশে প্রায় সমান সংখ্যক পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ি ঘিরে রেখেছে। গাড়ি এবং রিকশা চলাচল বন্ধ থাকলেও উল্টো দিকের ফুটপাথ দিয়ে পথচারিদের চলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক। কিন্তু আমার স্ত্রী কিছুতেই এই হাঙ্গামা পেরিয়ে স্কুলে যেতে রাজি হলেন না।



আমরা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়েও উত্তেজিত জনতার শ্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম।

‘চোর চোট্টার গদিতেÑ আগুন জ্বালো একসাথে!’

ঘটনার অভিনবত্ব এবং আকস্মিকতায় বহ্নি এতোক্ষণ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল। এবারে সে একই সঙ্গে প্রশ্ন এবং উত্তর বলে দেয়, ‘চোর চোট্টা কাকে বলছে বাবাÑ মনে হয় মন্ত্রী মহোদয়কে!’

‘সম্ভবত!’ আমি অতি কষ্টে উত্তর দেবার চেষ্টা করি। সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার প্রশ্ন করে, ‘গদিতে আগুন দিতে বলে কেন বাবা? গদি মানে কী?’

‘গদি মানে হলো, মন্ত্রী মহোদয় যেখানে বসেনÑ অর্থাৎ তার আসন, চেয়ার-টেবিল, অফিস, এমন কি বাড়িও হতে পারে।’



সব সময় চুপচাপ থেকে যাওয়া মৃত্তিকা গম্ভীরভাবে মন্তব্য করে, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের গদিতে আগুন দেয়াটা ঠিক হবে না, তাহলে আশেপাশে আরও অনেক বাড়ি পুড়ে যেতে পারে।’

‘তাহলে কী করা যায়?’ বহ্নি এমনভাবে জিজ্ঞেস করে যেনো প্রশ্নের উত্তর পেলেই দুই বোনে মিলে তা কার্যকর করে ফেলবে।

‘চোর চোট্টাদের মাটিতে পুঁতে ফেলাই ভাল।’



মৃত্তিকা তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।





মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৩৯

টাইটান ১ বলেছেন: লেখাটি ভালো হয়েছে।

২| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫৮

ফারজানা শিরিন বলেছেন: সব সময় চুপচাপ থেকে যাওয়া মৃত্তিকা গম্ভীরভাবে মন্তব্য করে, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের গদিতে আগুন দেয়াটা ঠিক হবে না, তাহলে আশেপাশে আরও অনেক বাড়ি পুড়ে যেতে পারে।’
‘তাহলে কী করা যায়?’ বহ্নি এমনভাবে জিজ্ঞেস করে যেনো প্রশ্নের উত্তর পেলেই দুই বোনে মিলে তা কার্যকর করে ফেলবে।
‘চোর চোট্টাদের মাটিতে পুঁতে ফেলাই ভাল।’

একমত ।

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:৪৮

ফরিদুর রহমান বলেছেন: আপনার মতো আরও অনেকে একমত হলে কাজটা সহজ হয়ে যায়! আপনাকে ধন্যবাদ।

৩| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৩

আখাউরা পূলা বলেছেন: চরমকার লাগল!

৪| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৭

নেক্সাস বলেছেন: ভালো লেগেছে লিখাটি

৫| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:০৪

তন্ময় ফেরদৌস বলেছেন: আপনার লেখার হাত বেশ ভালো।

৬| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:১১

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: আপনার পিচ্চি মেয়ে দুটোর জন্য অনেক আদর থাকল। দোয়া করি বড় হয়ে ওদের যেন এমন স্লোগান শুনতে না হয়।

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:৪৭

ফরিদুর রহমান বলেছেন: আপনার আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং আপনার জন্যে শুভ কামনা।

৭| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৮

শ্রাবণধারা বলেছেন: ‘আর মহোদয়? মহোদয় মানে কী?’ চোট্টা মহোদয়, মানে যারা মহৎ ভাবে চুরি করে। তাহারা চুড়ি করার সময় ফুলিশ বাহিনী বন্দুক নিয়ে পাহারা দেয়, আর প্রধান মহা মহা মহোদয় দেশফ্রেমিকের খেতাব দেয়..।
মৃত্তিকা ও বহ্নির জন্য শুভকামনা...

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:৪৪

ফরিদুর রহমান বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

৮| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৬

কালো ঘোড়ার আরোহী বলেছেন: ভাল লাগলো।

৯| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:৪২

ফরিদুর রহমান বলেছেন: যাঁরা গল্পটি পড়েছেন এবং পড়ে যাঁরা মন্তব্য করেছেন সকলকে ধন্যবাদ এবং সবার জন্যে শুভ কামনা। আমরা আমাদের সন্তানদের জন্যে একটি সুখি সুন্দর নিশ্চিত ভবিষ্যত চাই!

১০| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৬

আল মামুন মাহবুব আলম বলেছেন: গলপোটি খুব ধির লয়ে এগিয়ে নেয়া হয়েছে।ম্রিত্তিকা,বহ্নি ও তাদের বাবার কথোপকথনই বলে দেয় নেহায়েত ছা-পোষা চাকুরিজিবি তিনি নন।অত্যান্ত স্পষ্ট করেই বলে দিচ্ছে,গিরগিটিদের পরিচয়।এ ধরনের সরকারের কাছে মানুষ শুধু শুধু আশার স্বপ্নেই থাকতে পারবে,বাস্তবায়ন কখনোই ঘটবে না।

ধন্যবাদ ফরিদুর রহমানকে।তবে,আমি আশাকরি একটু দ্রুত তালে উপস্থাপন করলে,গল্পটা আরও প্রাণ পেত.।

১১| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৬

আল মামুন মাহবুব আলম বলেছেন: গলপোটি খুব ধির লয়ে এগিয়ে নেয়া হয়েছে।ম্রিত্তিকা,বহ্নি ও তাদের বাবার কথোপকথনই বলে দেয় নেহায়েত ছা-পোষা চাকুরিজিবি তিনি নন।অত্যান্ত স্পষ্ট করেই বলে দিচ্ছে,গিরগিটিদের পরিচয়।এ ধরনের সরকারের কাছে মানুষ শুধু শুধু আশার স্বপ্নেই থাকতে পারবে,বাস্তবায়ন কখনোই ঘটবে না।

ধন্যবাদ ফরিদুর রহমানকে।তবে,আমি আশাকরি একটু দ্রুত তালে উপস্থাপন করলে,গল্পটা আরও প্রাণ পেত.।

১২| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ৯:০০

ফরিদুর রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.