নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাভার হত্যাকাণ্ড ও আমাদের মুখে একটি কিশোরীর পদাঘাত

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৮:৫৫

সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপের ভেতরে চাপা পড়া একটি কিশোরী মেয়ে তার নূপুর পরা পায়ে সারা বাংলাদেশের দিকে একটি লাথি ছুঁড়ে মেরেছে। ফেসবুকে, বিভিন্ন ব্লগে এবং পত্রিকার পাতায় যারা ছবিটি দেখেছেন তারা সহজেই অনুমান করতে পারেন- এই মেয়েটির জীবনের প্রতি অসামান্য ভালবাসা ছিল, নিজেকে সে নান্দনিক সৌন্দর্যে পৃথিবীর কাছে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল এবং সর্বোপরি সে ছিল প্রতিদিনের বাঁচার লড়াইয়ে একজন সংগ্রামী নারী। কিন্তু তার প্রাণহীন দেহ এখন শুধু আমাদের মুনাফা শিকারি পোশাক শিল্পের মালিকদের প্রতিই নয়, দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখানো ক্ষমতাধরদের প্রতি এবং কখনও অসহায় ও কখনও কূট কৌশলী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি একটি স্থায়ী পদাঘাত হেনেছে। মেয়েটির প্রাণহীন পায়ের এই লাথি কি ‘সবকুছ ঠিক হ্যায়’ নীতিতে বিশ্বাসী আমাদের সরকার এবং দীর্ঘ সূত্রিতায় ভরা আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে এতোটুকু হলেও স্পর্শ করেনি?



আমরা প্রত্যেকেই জানি, আলোচিত এই কিশোরীটিসহ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আড়াইশতাধিক মানুষের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। সুস্পষ্টভাবে এটি মানুষের সৃষ্ট হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের নায়কেরা ঘটনার অন্তত ২৪ ঘণ্টা পূর্বে ভবনে মারাত্মক ফাটলের কথা জানাতেন এবং যে কোনো মুহূর্তে এটি ধ্বসে পড়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে তাও জানতেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন রাজনীতির আশ্রয়ে লালিত মাস্তান ভবন মালিক এবং অর্থলিপ্সু গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মুনাফাখোররা শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুতির ভয় ভীতি দেখিয়ে তাদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছে। ঘটনার আগের দিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে ভবন মালিক সোহেল রানা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘সামান্য প্লাস্টার খসে গেছে, এটি কোনো ফাটল নয়।’ (একুশে টেলিভিশন, সাভার প্রতিনিধি গৃহীত সাক্ষাৎকার) লক্ষণীয়, স্থানীয় প্রশাসনের সতর্কতার ফলে একই ভবনের নিচ তলায় অবস্থিত একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বা কর্মচারিদের একজনও এই ‘দুর্ঘটনা’য় ক্ষতিগ্রস্ত হননি।



ঘটনাটি ঘটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার ব্রিগেড, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ স্থানীয় জনসাধারণ যেভাবে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তা প্রশংসাযোগ্য। এদের পাশাপাশি নিকটবর্তী গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক কর্মচারি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক এবং বিশেষকরে এনাম মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন। নেহায়েত জীবিত না পারলেও স্বজনদের কাছে প্রিয়জনের প্রাণহীন দেহ ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন।



যে কোনো মানবিক বিপর্যয়ে সরকার তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং এটি সরকারের কাছে জনগণের কোনো অযৌক্তিক দাবী বা বাড়তি প্রত্যাশা নয়। কিন্তু সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন এ ধরনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কার্য কারণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উদ্ভট ‘স্তম্ভ নাড়াচাড়া তত্ত্ব’ হাজির করে নিজেকে দেশের মানুষ ও বিদেশের গণমাধ্যমের কাছে হাস্যরসের খোরাক হিসাবে উপস্থাপন করেন, তখন এই সকল কর্তা ব্যক্তির দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। এ কথা সত্য, সাভারের রানা প্লাজার এই হত্যাকা-ের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যথাযথ গুরুত্ব এবং দ্রুততার সাথে উদ্ধার তৎপরতা, চিকিৎসা সেবা ও তাৎক্ষণিক অর্থ সাহায্য প্রদানের কাজ শুরু করেছে। তবে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা স্বত্ত্বেও ‘সীমিত সাধ্য’ সরকারের এই উদ্ধার তৎপরতা তথা সামগ্রিক বিপর্যয় মোকাবেলাকেই বাধাগ্রস্ত করেছে।



এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, অগ্নিকাণ্ড বা ভবন ধ্বসের মতো বছর দুর্যোগের মুখোমুখি হবার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর সরকারের সাধ্য সীমিতই থেকে যায় কেন? কেন একটি ভেঙে পড়া ভবনের ভেতরে আটকে পড়া জীবিত মানুষদের যথাসাধ্য অক্ষত অবস্থায় বের করে নিয়ে আসার জন্যে স্ল্যাব ফুটা করার ড্রিল মেশিন, কাপড়, রড কাটার ব্লেডসহ যন্ত্রপাতি ঘটনাস্থলে পাঠাবার জন্যে আকুল আবেদন জানাতে হয়? কেন সরকার দ্রুততার সাথে হেভি ডিউটি জেনারেটর, ক্রেন বা ক্রাশার মেশিন ঘটনাস্থলে পাঠাতে পারে না? কেন একশ শয্যার একটি ফিল্ড হাসপাতাল তাৎক্ষণিকভাবে স্থাপন করার বিষয়টি সরকারের সাধ্যে কুলায় না? কেন মারণাস্ত্র ও যুদ্ধ বিমানসহ অপ্রয়োজনীয় অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে অথচ সংকটাপন্ন মানুষের জীবন বাঁচাবার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা হয় না কেন? আমরা কি জানতে পারি ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টেসের ভবন ধ্বসে ৬৪ জন মানুষের মৃত্যুর পরে উদ্ধার তৎপরতার আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ কি আদৌ নেয়া হয়েছে?



সবশেষে আসা যাক ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন তথা শিল্প কারখানায় যে কোনো দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি করার প্রশ্নটি। সাভারের রানাপ্লাজা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ভবনের সকল গার্মেন্টস মালিকের শাস্তির দাবীটি বেশ জোরেশোরেই উত্থাপিত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি যথারীতি গঠন করা হয়েছে এবং সাতদিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে অধিকাংশ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সময়ের ঘুর্ণাবর্তে হারিয়ে যায়। আর কালেভদ্রে কোনো রিপোর্ট উপস্থাপিত বা প্রকাশিত হলেও দীর্ঘ শীতনিদ্রার পরে বিচারিক কর্মকা- শুরু হবার আগেই এ ধরনের দুর্ঘটনা বা হত্যাকাণ্ডের সাথে দায়ী ব্যক্তিরা তাদের আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে সামাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরও মুনাফার জন্যে লালায়িত এবং আরও হত্যাকাণ্ডের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন।



যদি ইতিপূর্বে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডেরও যথাযথ বিচার সম্পন্ন করে ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি এবং হতভাগ্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো তাহলে এই মৃত্যুর মিছিল কখনোই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতো না। গত শতাব্দীর ১৯৯০ সালে সারিকা গার্মেন্টেসে ৩২ জন, ১৯৯৭ সালে রহমান এ্যান্ড রহমান এ্যাপারেল-এ ২২ জন এবং তামান্না গার্মেন্টেস-এ ২৭ জন এবং ২০০০ সালে চৌধুরি নিটঅয়্যারে ৫৩ জনের মৃত্যুর কথা আমাদের মনে থাকার কথা নয়। ২০০১ সালে মাইকো সোয়েটাররে ২৪ জন, ২০০২ সালে গ্লোবাল নিটিং-এ ১২ জন, ২০০৫ সালে গোদনাইলের সান নিটিং-এ ২৩ জন এবং একই বছর সাভারে স্পেক্ট্রাম গার্মেন্টস-এ ৬৪ জনের মৃত্যুর কথাও নিশ্চয়ই ভুক্তভোগীদের পরিবারের লোকজন ছাড়া আর সকলেই বিস্মৃত হয়েছেন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে কেটিএস গার্মেন্টস-এ ৬৭ জন এবং একই বছর ফিনিক্স টেক্সটাইলে নিহত হয়েছিলেন ২২ জন। ২০১০ সালে হামীম গ্রুপের একাধিক কারখানায় তিনটি পৃথক ‘দুর্ঘটনায়’ মৃত্যুবরণ করেছিলেন মোট ৭১ জন নারী পুরুষ। পুরোনো দিনের কথা ভুলে গেলেও অতি সম্প্রতি ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাজরীন ফ্যাসানের আগুনে পুড়ে যে ১১৪ জন অসহায় মানব সন্তান অঙ্গারে রূপান্তরিত হয়েছিলেন তাদের স্বজনেরা কি ন্যায় বিচার পেয়েছেন? তাজরীন ফ্যাসানের মালিক অথবা তাদের সাহযোগীরা কি কোনো শাস্তি পেয়েছে? আর কিছু না হোক, তাদের কি গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে? এই সবগুলো প্রশ্নের একমাত্র উত্তর ‘না’।



অতীতের এতোগুলো হত্যাকাণ্ডের যদি বিচার না হয়ে থাকে, তাহলে সাভারের রানাপ্লাজা হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হবে না তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর যদি কোনো কারণে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং তাদের সত্যিই শাস্তির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে নূপুর পরা পায়ের স্বপ্ন দেখা মেয়েটিকে বলতে পারবো, ‘বোন, তোমার সান্ত্বনাহীন মৃত্যুর মধ্যদিয়ে আমরা প্রথমবারের মতো একজন অর্থলোলুপ মুনাফাখোরকে শাস্তি দিতে পেরেছি।’





মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:৩৮

পদ্ম (কমল দাস) বলেছেন: সুন্দর বিশ্লেশণধর্মী একটি পোস্ট। অথচ মতামত জানানোর কেউ নেই।
ধন্যবাদ লেখককে।

২| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:৫৬

ওবায়দুল হক মাহমুদ বলেছেন: অনেক কষ্টের দিনলিপি তে ছোট্ট দুটি সুখবর
(১) আমাদের বয়ষ্ক বুয়া রাশেদের মা'র নাতি কে ৩৬ ঘন্টা পর জীবিত উদ্ধার ।
(২) বাসার পিছে থাকা কিশোরী মেয়েটিকেও সুস্থ ও জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ।
Click This Link

৩| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:২১

এল এইচ, জুয়েল বলেছেন: সুন্দর বিশ্লেশণধর্মী একটি পোস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.