নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিটিভির ৫০ বছর ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠান

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:১১



বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কোন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়নি। জাতীয় জীবনের এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ শোকাবহ দিনে জাতীয় গণমাধ্যমে অন্তত একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়া উচিত_ এই চিন্তা থেকে ১৯৮৮ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তাব যখন জেনারেল ম্যানেজার মোস্তফা কামাল সৈয়দের কাছে উপস্থাপন করা হলো, তখন তিনি একটু বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, 'এই অনুষ্ঠানটা কি তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুষ্ঠানের তালিকায় আছে?'



সাহস করে বললাম, 'মন্ত্রণালয়ের তালিকাটা দেখিনি, তবে বাংলা একাডেমিসহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিবসটা পালন করা হয়। তাছাড়া দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক আর সংবাদসহ সবগুলো জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবিসহ লিড নিউজ এবং কোন কোন পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করা হয়।'



'ওইদিন আসলে কী হয়েছিল বলেন তো? ১৪ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল?'



'তারিখটা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, তবে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা সঠিক জানা না গেলেও সারাদেশে অন্তত দুই থেকে আড়াইশ জনকে হত্যা করা হয়েছিল।'



বেশ কিছুটা সময় নীরবে ফাইলে স্বাক্ষর শেষ করে জেনারেল ম্যানেজার বললেন, 'স্বাধীনতার এতদিন পর এসব কথা আর কে মনে রেখেছে বলেন! তারপরও পলিসিগত প্রবলেম না থাকলে ২৫ মিনিটের একটা অনুষ্ঠানের চিন্তা করতে পারেন।



তখন পরিস্থিতিটাই এমন করে রাখা হয়েছিল যে স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলাটাও যেন সহজ স্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র ১৭ বছরের মধ্যেই স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যে আমরা ভুলে যাইনি এবং কখনোই ভুলে যাওয়া যায় না এ কথা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমি কোন বিতর্কে জড়াতে চাইনি।



আমাদের চিন্তা আসলে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদ পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পথ খুঁজে পেতে সেই শীতের সকালে আমাদের ঘাম ঝরে গিয়েছিল। তারপরও স্থানীয় খেলাঘর কর্মীদের সহযোগিতায় অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পৌঁছে বেশ বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সাকল্যে অর্ধশত মানুষকেও সেদিন সেখানে উপস্থিত হতে দেখিনি। শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার ও খেলাঘরের বেশ কয়েকজন কর্মী ছাড়াও একটু দেরি করে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন 'দৈনিক সংবাদ'-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান। যতদূর মনে পড়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়েই তিনি বলেছিলেন, 'শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস পালনের জন্য লোকের অভাব হবে না। কিন্তু আর কেউ না মনে না রাখলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা অন্তত আমরা যেন কখনোই ভুলে না যাই। দিনটা যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার দায় আমরা কোনভাবেই এড়াতে পারি না।' ভাইয়া বজলুর রহমানের সেদিনের সেই আবগপূর্ণ বক্তব্য আমাদের মনে একটি স্থায়ী ছাপ ফেলে গিয়েছিল।



অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর আবার এলাম জেনারেল ম্যানেজারের দফতরে। জিজ্ঞেস করলেন, 'অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করবেন কে?'



বললাম, 'বাংলা একাডেমির রশীদ হায়দার। শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থের সম্পাদক।' এরপর আর কোন আপত্তির কথা শোনা গেল না। জেনারেল ম্যানেজার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, 'কম্পিকেসি অ্যাভোয়েড করে সিম্পল টাইপের একটা অনুষ্ঠান করে ছেড়ে দেন।'



অনুষ্ঠানটির আয়োজন আমরা সত্যিই খুব সাদামাটাভাবে করেছিলাম। স্টুডিওতে ঢাকার প্রথিতযশা কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নিকটজন তাদের বাবা, ভাই, বা স্বামীর স্মৃতিচারণ করেছেন আর বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের স্বপ্নের কথা। অনুষ্ঠানে আমরা একটা গান ব্যবহার করেছিলাম। কবি শামসুর রাহমানের লেখা 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় তেমন যোগ্য সমাধি কই...' গানের সুরকার 'মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও গান' গ্রন্থের সম্পাদক, সংগীত পরিচালক সেলিম রেজা নিজেই রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তার অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন আর গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সুবীর নন্দী। রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় অগণিত শহীদ বুদ্ধিজীবীর হাত-পা বাঁধা, কারো চোখ বাঁধা মৃতদেহ এবং অনেক ক্ষেত্রেই শনাক্ত করা অসম্ভব অসংখ্য লাশের যে দৃশ্য বিটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক প্রয়াত হুমায়ূন চৌধুরী ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৬ মিলিমিটার সাদাকালো ফিল্মে ধারণ করে এনেছিলেন সেই দৃশ্যের নেপথ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল এই গান।



অনুষ্ঠানটি 'সিম্পল টাইপের' হলেও তা প্রচারিত হওয়ার পর দর্শক_ বিশেষ করে শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যে সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীকে হানাদার বাহিনী বলে উল্লেখ করা হতো এবং রাজাকার, আল বদর, আল শামস উচ্চারণ করা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল_ সে সময় রশীদ হায়দার তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে 'পাকিস্তানি সেনা বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর ঘৃণ্য ঘাতক রাজাকার আল বদর' শব্দগুলো এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কথা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।



পর পর তিন বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠান প্রচারের ফলে যে ধারাবাহিকতার সূচনা হয়েছিল তা দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির পাশাপাশি শহীদ পরিবারগুলোর জন্যে প্রতীক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রথম বছরেই আমরা অনুষ্ঠানের যে পরিকল্পনা করেছিলাম সেখানে কথা বলেছিলেন চারজন শহীদ জননী। সে বছর আমরা স্টুডিওর বাইরে ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হানের নিমতলীর সাপ মন্দির রোডে এবং শহীদ মুনীর চৌধুরীর সেন্ট্রাল রোডের বাসায়। পুত্রশোকে বাকরুদ্ধ এসব বৃদ্ধা মায়ের মর্মবেদনার কথা রেকর্ড করাও আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শহীদ মুনীর চৌধুরীর মা আফিয়া বেগম প্রায়ই তার কথার মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। তিনি তার প্রিয় পুত্রের শেষবার চলে যাবার দিনক্ষণ এবং সেই শেষদৃশ্যটিকে ঘুরে ফিরে বারবারই উল্লেখ করছিলেন। তাকে প্রশ্ন করে এবং খেই ধরিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে কিছু কথা বের করে আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তার কন্যা ফেরদৌসী মজুমদার। একইভাবে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার ও জহির রায়হানের মায়ের সঙ্গে কথোপকথনে সাহায্য করেছিলেন তার পুত্রবধূ পান্না কায়সার। খুব বেশি কথা তিনি বলেননি, কিন্তু তার শেষ কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার আগে বুক চাপড়ে দুবার বলেছিলেন, 'আমার কলিজা জ্বলি যায়... কলিজা জ্বলি যায়...।'



নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্বৈরাচারকে হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আমরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল এখন থেকে দেশে যেমন গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও তার প্রতিফল ঘটবে। পদে পদে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা যখন সামনে এগোতে চেষ্টা করছি, সেই সময় এলো ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাস। কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠিত সত্যের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাৎসরিক নিয়মিত অনুষ্ঠান হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। টিভি গাইডে অনেক আগেই ছাপা হয়ে গেছে অনুষ্ঠানের নাম ও প্রচার সময়। রশীদ ভাই শহীদ পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকারের দুই বছর পূর্ণ হতে তখনও দুই মাস বাকি। আমাদেরও তখন পর্যন্ত অনেক কিছু জানার এবং বোঝার বাকি ছিল। ১৯৯২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যে অনুষ্ঠানের সম্পাদনা শেষ করে উপস্থাপন বিভাগে ক্যাসেট জমা দিয়ে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে এসেছিলাম। রাত সাড়ে ১০টার ইংরেজি সংবাদের পর অনুষ্ঠান প্রচার হওয়ার কথা।



সন্ধ্যার ঠিক পরপরই আমার শান্তিবাগের বাসার সামনে টেলিভিশনের একটি মাইক্রোবাস এসে হাজির। বের হয়ে দেখলাম গাড়িতে বসে আছেন স্বয়ং অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ জিয়া আনসারী। তিনি জানালেন অনুষ্ঠানটি পুনঃসম্পাদনা না করে প্রচার করা যাবে না। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম সমস্যাটা কোথায়। নব্বই দশকের শেষতক তো বটেই, তারপরও অনেক বছর পর্যন্ত অর্থাৎ আমাদের প্রজন্মের প্রযোজকদের অনুষ্ঠান প্রচারের পূর্বে প্রায় কখনোই প্রিভিউ করা হতো না। প্রযোজকের নিজস্ব শিক্ষা ও মেধা, পেশাদারিত্ব এবং নিজস্ব বিবেচনা বোধই তাকে জানিয়ে দিতো একটি অনুষ্ঠানে কতটুকু প্রচার করা যাবে অথবা যাবে না। কর্তৃপক্ষের আস্থাও সেভাইে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা।



আমি জিয়া ভাইকে বললাম, 'গোলাম আযম কিংবা মতিউর রহমান নিজামির ছবি ব্যবহার করা যাবে না সেটা আমি নিজেও জানি। কিন্তু মাওলানা মান্নানের ছবি নিয়ে তো কোন সমস্যা থাকার কথা নয়।' 'খুনি মান্নানকে ধরিয়ে দিন' শিরোনামে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত মাওলানা মান্নানের ছবির একটি ঝকঝকে ফটোকপিটি দিয়েছিলেন শহীদ ডাক্তার আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। প্রাসঙ্গিক হলেও সেই ছবিটি এবং কিছু কথা অনুষ্ঠান থেকে সেদিন বাদ দিতে হয়েছিল।



আমার বাসায় টেলিফোন সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পর প্রতি বছরই ১৪ ডিসেম্বর রাতে অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে পরিচিত অপরিচিত অনেক দর্শকই টেলিফোনে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহীদ পরিবারের স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং মুক্তিযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধাদের অনেকেই তাদের মতামত জানিয়ে উৎসাহিত করেছেন। তবে এর পাশাপাশি টেলিফোনে হুমকি-ধমকি এবং অকথ্য গালাগালও কম শুনতে হয়নি। টেলিফোনে হুমকি ছাড়াও দুবার সম্ভবত ১৯৯২ এবং ১৯৯৩ সালে পোস্ট কার্ডে লেখা দুটি চিঠি পেয়েছিলাম। এর একটিতে লেখা ছিল পরবর্তী ১৪ ডিসেম্বরের আগেই আমার এবং রশীদ হায়দারের নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় স্থান পাবে। চিঠিটা পড়ে শোনানোর পর রশীদ ভাই মজা করে বলেছিলেন, 'একাত্তরে তো বুদ্ধিজীবী হতে পারিনি_ এবারে নব্য রাজাকারদের হাতে খুন হয়ে যদি তালিকায় নাম ওঠে তাহলে মন্দ কি!'



আরও একটি ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। দাফতরিক প্রয়োজনে জেনারেল ম্যানেজারের কক্ষে ঢুকে দেখলাম 'বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ' ও বিটিভির ইসলামী অনুষ্ঠান 'জীবনের আলো'র নিয়মিত আলোচক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার এক তরুণ সাগরেদসহ বসে আছেন। আমি তাদের পাশের একটি আসনে বসতেই মাওলানা আজাদ আমার সঙ্গে তার তরুণ সাঙ্গাতের পরিচয় করে দিলেন। আমার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গেই সামান্য শ্মশ্রু চর্চিত তরুণটি বেশ আদবের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বললেন, 'আমি আপনাকে চিনি_ কয়েকদিন আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানটির প্রযোজক তো আপনিই ছিলেন! অনুষ্ঠানটি চমৎকার হয়েছে।' এই মৌলবাদী তরুণের কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল, খুশি হওয়ার পরিবর্তে আমার মেরুদ- দিয়ে একটা শীতল হিমপ্রবাহ যেনো নিচের দিকে নেমে গেল। সে দিনের এই মাওলানা আবুল কালাম আজাদই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত বিস্মৃত প্রায় বাচ্চু রাজাকার!



১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এক নাগাড়ে দশ বছর রশীদ ভাই এই অনুষ্ঠান উপস্থাপনার এবং উপস্থাপনার আমি প্রযোজনার দায়িত্ব পালন করেছি। অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেছেন শহীদ ডাক্তার আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেনের পুত্র জাহিদ রেজা নূর, শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের নাতনি এ্যারোমা দত্ত, শহীদ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহর পুত্র সাদি মোহাম্মদ তকিউল্লাহ, শহীদ মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যা শমী কায়সার, শহীদ রশীদুল হাসানের কন্যা রোকাইয়া হাসিনা নিলি, প্রজন্ম একাত্তরের সাঈদুর রহমান, শহীদ মামুন মাহমুদের কন্যা জেবা মাহমুদ, শহীদ কাজী আজিজুল ইসলামের কন্যা ফাহমিদা ইসলাম রুমা, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্র, শহীদ আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রী সহ আরও অনেকে। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক শহীদ শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও আইনজীবী পরিবারের স্বজনেরা আমাদের আমন্ত্রণে সাগ্রহে এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।



শহীদ পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এই অনুষ্ঠানে এসে দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের অনেকেই পাকিস্তানিদের_ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামীর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তবে সঙ্গত কারণেই অনুষ্ঠানে 'জামায়াতে ইসলামী' নামটি উচ্চারণ করা তখন সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৯৪ সালে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে বুদ্ধিজীবী হত্যার পটভূমি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, '১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় একটি কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল. তা হলো_ পূর্ব বাংলায় এই বিচ্ছিন্নতার মূলে কাজ করেছে এখানকার শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। এর ফলে তরুণদের মধ্যে পাকিস্তানের ঐক্যবোধের বদলে একটা বাঙালি স্বাতন্ত্র্য বোধ জেগেছিল এবং তার ফলেই এই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। ....এদের প্রতি যে ক্রোধ প্রকাশিত হয়েছিল সেদিন সেই ক্রোধ কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি ছিল না_ ছিল সমগ্র বাংলাদেশের সচেতন বুদ্ধিজীবীর প্রতি... এবং স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে মেরুদ- খাড়া করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চেষ্টাই সেদিন করা হয়েছিল।'



দীর্ঘকাল আগে এই অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও অনেক শহীদ পরিবারের পুত্র-কন্যার বুকভাঙা কান্না, স্ত্রীর দীর্ঘশ্বাস অথবা ভাই-বোনের ক্ষোভের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না।



[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন]

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০১

হাসান কালবৈশাখী বলেছেন: ভাল লাগলো

২| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৯

তিক্তভাষী বলেছেন: ধন্যবাদ বিটিভির পেছনের কথাগুলো জানানোর জন্যে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.