নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পেশাদারিত্ব

০৩ রা মে, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৬

আজকাল আমাদের দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, বিত্তবান শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা প্রায় সবাই চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। জটিল ও কঠিন কোনো রোগ যদি দেশে নিরাময়যোগ্য না হয় তবে সামর্থ্য থাকলে উন্নততর চিকিৎসার জন্য যে কেউ বিদেশে যেতেই পারেন। কিন্তু সম্প্রতি ভিআইপি রোগীদের বিদেশের হাসপাতালে পরলোকগমনের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সংগত কারণেই কয়েকটি বিষয় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত. স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময়ে আমাদের সরকার তথা রাজনীতিবিদরা যে চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, তার ওপর তাঁদের নিজেদেরই কোনো আস্থা নেই।



দ্বিতীয়ত. আমাদের চিকিৎসকরা ক্ষমতাধর ও নামিদামি রোগী, বিশেষ করে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন ও সমর্থক-সাঙ্গাতদের সম্ভাব্য হামলা-মামলা, নিদেনপক্ষে চোখ রাঙানি এড়িয়ে চলতে চান এবং সে কারণেই এসব বিশেষ সামাজিক অবস্থানের রোগীদের দ্রুত বিদেশে পাঠিয়ে নিজেরা নিরাপদ থাকার চেষ্টা করেন। তৃতীয়ত. অর্থবিত্তের প্রাচুর্যের সঙ্গে বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারটি সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে প্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ফলে বিত্তবানরা তাঁদের সাধারণ হাঁচি-কাশি থেকে শুরু করে নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপের জন্য বিদেশের কোনো নামকরা হাসপাতালকেই বেছে নেন। সে জন্যই ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও চেন্নাইয়ের কয়েকটি হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগী নিয়ে রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে।



ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বিছানায় শুয়ে উল্লিখিত কারণগুলোর পাশাপাশি একটি মানসম্পন্ন হাসপাতালের পরিবেশ বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে, দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থাসম্পন্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠলেও প্রয়োজনীয় পেশাদারির অভাব পুরো আয়োজনকেই ব্যর্থ করে দিচ্ছে। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, পেশাদারির এই অভাব বা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ও দুর্বলতা হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট থেকে শুরু করে চিকিৎসক, নার্স, হিসাবরক্ষক, ওয়ার্ডবয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত সম্প্রসারিত। প্রথমবারের মতো হাসপাতালে প্রবেশের পর এর কাজের পদ্ধতি, পেশেন্ট আইডেন্টিফিকেশন কার্ড ও টয়লেট-বাথরুমসহ সামগ্রিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখে চমৎকৃত হতে হয়। এমনকি একটি ব্যস্ত সড়কের ওপর দিয়ে হাসপাতালের বর্ধিত অংশের সংযোগ সেতুটিও সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। অতএব অনুমান করা যায়, হাসপাতালটি একটু ব্যয়বহুল। তাতেও আপত্তি ছিল না, কিন্তু হাসপাতালের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের একটি বড় অংশের অমনোযোগিতা ও প্রকারান্তরে কর্তব্য সম্পর্কে অসচেতনতা এই বিশাল উদ্যোগকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে।



আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ও পেশাদারি



রিসেপশন বা অভ্যর্থনার দায়িত্বে নিয়োজিত একাধিকজন যখন কোনো একটি বিশেষ জিজ্ঞাসা যেমন 'সিরিয়াল কিভাবে নিতে হবে?' অথবা 'এই বিশেষ পরীক্ষার টাকা কোথায় জমা দিতে হবে?'-এর উত্তরে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দেন, তখন বোঝা যায়, তাঁরা নিজেরাই বিষয়টি ভালো করে জানেন না। টাকা জমা নেওয়ার কাউন্টারের স্মার্ট তরুণ কর্মী সম্পূর্ণ সঠিক সময়ে তাঁর কম্পিউটার অন করে বসে কাজ শুরু করলেও তিনি যখন কাউন্টারের লাইনে রোগী অথবা তাঁর অ্যাটেনডেন্টকে দাঁড় করিয়ে রেখে মোবাইল ফোনে শ্যালিকার বিবাহ সম্পর্কিত আলোচনা করেন, তখন তাঁর পেশাদারি নিয়ে প্রশ্ন না উঠেই পারে না। পরিচ্ছন্নতাকর্মী মেয়েটি তাঁর কাজ যথেষ্ট দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করার পরও যখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে উচ্চ স্বরে কথা বলেন, তখন বোঝা যায়, হাসপাতালের চাকরি সম্পর্কিত কোনো প্রশিক্ষণ তাঁকে দেওয়া হয়নি। তবে নার্সদের অদক্ষতা ও সিরিয়ালের অব্যবস্থা সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। একজন নার্স ক্যানুলা সংযোগ স্থাপনের জন্য দুই হাতের চার জায়গায় নিডল দিয়ে খোঁচাখুঁচি করার পর চতুর্থবারে শিরায় সুই প্রবেশ করিয়ে যখন সামান্যতম 'সরি' বলারও প্রয়োজন বোধ করেন না, তখন আবার সেই প্রফেশনালিজমের প্রশ্নটিই সামনে এসে দাঁড়ায়। তখনই মনে হয়, দূরের ফিলিপিনো ও নিকটের কেরালার নার্সদের জগৎজোড়া সুখ্যাতি এমনিতেই আসেনি।



নিয়মভঙ্গ করে সুবিধা নেওয়া বা পূর্বনির্ধারিত সিরিয়াল অনুসরণ না করার ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনের আর সব ক্ষেত্রের মতো আমাদের রোগীরাও কোনো অংশে কম যান না। গ্যাস্ট্রো-ইন্টেস্টাইন বিভাগে বিশেষ দিনটিতে অ্যান্ডোস্কোপি-কোলোনস্কোপি পরীক্ষার রোগী হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট একজন অভিনেত্রীর বাবা, যিনি একই সঙ্গে প্রয়াত একজন জনপ্রিয় লেখকের শ্বশুর ও একজন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্যের স্বামী। স্বাভাবিকভাবেই তিনি সিরিয়াল না মানার অধিকার সংরক্ষণ করেন! এ ছাড়া একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন রিপোর্টারের মা তাঁর সুযোগ্য সাংবাদিক পুত্রের কল্যাণে সিরিয়াল ভঙ্গের সুযোগ পেয়েছেন। আরো অন্তত তিনজন কিভাবে তাঁদের সিরিয়ালের বাইরে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছেন, তা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে আমার মতো নাম-পরিচয়হীন দু-তিনজনকে ইচ্ছাকৃতভাবে সিরিয়ালের শেষে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সেটা বেশ বোঝা যায়।



বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও তাঁদের চিকিৎসাসেবা বিবেচনায় না এনে শুধু সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থানের অভিজ্ঞতার আলোকে অনুমান করা যায়, বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির সমাবেশ ও অবকাঠামোগত চমৎকারিত্ব সত্ত্বেও আমাদের হাসপাতালগুলো পেশাদার চিকিৎসাসেবায় বিদেশের যেকোনো সাধারণ হাসপাতালের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। অতএব সুদৃশ্য একটি হাসপাতালে পুত্র, কন্যা ও নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে মৃত্যুবরণ না করে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর পরলোকগমনের জন্য কেন বিদেশে প্রায় সমমানের একটি হাসপাতাল বেছে নিয়েছিলেন, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।



লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.