নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান

ফরিদুর রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

টেলিভিশনের শক্তি ও সাংস্কৃতিক ঘোড়ারোগ

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২৭



গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে যাঁরা খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করবেন সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিস্তার বা আগ্রাসনকে অনিবার্য করে তুলতে টেলিভিশনের কোনো বিকল্প নেই। শুরুতেই এই শক্তিশালী মাধ্যমের শক্তি সম্পর্কে দুটি উদাহরণ দিতে চাই। একটি অতি সম্প্রতি অর্জন করা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অন্যটির উৎস বিদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র সংবাদ।



অল্প কিছুদিন আগে এক বন্ধু কন্যার বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল! বিবাহ পরবর্তী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল অত্যন্ত অভিজাত এলাকায় একটি ব্যয়বহুল পার্টি সেন্টারে। অনুষ্ঠানের মিলনায়তনে প্রবেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখে পড়লো বিশাল পর্দায় উদ্দাম নৃত্য-গীতের একটি দৃশ্য। সম্ভবত অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের মানুষ হিসাবে প্রথমে এই দৃশ্যটিই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আমি একটু বিস্মিত হয়ে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা বিয়ের অনুষ্ঠানে হিন্দি ছবির ভিডিও চালাচ্ছে কেন?’ তিনি আমার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘তুমি হিন্দি ছবি কোথায় পেলে, এটা তো ওদের হলুদের অনুষ্ঠান!’ পর্দার ছবিতে ভাল করে চোখ রাখার পরে দু একটি পরিচিত চেহারা ছাড়া পোশাক পরিচ্ছদ, পরিবেশিত নাচ গান এবং অঙ্গভঙ্গির কোথাও পরিচিত কিছু খুঁজে পেলাম না। বন্ধুদের দু একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বিয়ের আগে গায়ে হলুদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ ধরনের পরিবেশনা এখন আমাদের দেশের প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, গায়ে গলুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকায় ভুরিভোজের সাথে মুফতে হিন্দি ছবির দৃশ্য রেকর্ডিং-এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে হলো।



ভাষা সংস্কৃতির বিকৃতি ও বিনাশের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত বিত্ত বা ধণিক শ্রেণীর ‘কৃতিত্ব’ সবচেয়ে বেশি। তবে শিক্ষিত, বিশেষত উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা সব সময়েই উচ্চতর শ্রেণীতে একীভূত হবার নিরলস প্রচেষ্টায় নিয়োজিত, এ ক্ষেত্রে তাঁদের ‘অবদান’ও কম নয়। এই দুই শ্রেণীর মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জল নিচের দিকে গড়িয়ে নামার ফলে নিম্নবিত্ত বা নেহায়েত গরিব মানুষের মধ্যেও এ সব সামাজিক ঘোড়ারোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।



দ্বিতীয় দৃশ্যটির ঘটনাস্থল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ-এর রাজপথ। কিছুদিন আগে সেখানে একদল প্রতিবাদী মানুষ ব্যানার-ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে রুশ মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের হাতের প্লাকার্ডে লেখা ’’Russian Media Incites Split of Ukraine!’ !সংবাদে প্রকাশিত বিবরণ থেকে ধারণা করা যায় রাশিয়ার একাধিক স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ইউক্রেনের সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে উস্কে দিচ্ছে। বিশেষ করে রুশ ভাষাভাষি অধ্যুষিত ক্রিমিয়ার জনগণের মধ্যে এ সব স্যাটেলাইট চ্যানেলের যে জনপ্রিয়তা তা কাজে লাগিয়ে প্রবল শক্তিধর প্রতিবেশীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইউক্রেনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।



উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশ্বব্যপী তাদের নিজস্ব তথ্য এবং সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি ভিনদেশী দর্শকদের জন্যে যথেষ্ট আনন্দ বিনোদনেরও ব্যবস্থা রেখেছে। ফলে নাটক সিনেমা, সঙ্গীত, খেলাধুলা, ভ্রমণ, চিকিৎসা এমন কি রান্নাবান্নার মশলাপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে টেলিভিশনের লোকজন আমাদের ড্রইংরুম কিংবা শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে। এর ফলে এ সব টেলিভিশন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জীবনাচরণ ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সাংস্কৃতিক প্রভাব বলয়ের এই লাগমহীন বিস্তার বা আগ্রাসন যাই বলি না কেন,আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার প্রভাব কতটা পড়েছে অথবা আদৌ পড়েছে কিনা তা হিসাব করে বলা কঠিন। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রপ্তানি বাণিজ্যসহ অর্থ উপার্জনের অন্য সকল খাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নির্ধারণে আমরা যেমন পিছিয়ে আছি এক্ষেত্রটিও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।



ভারতীয় হিন্দি এবং বাংলাসহ সকল বিদেশী চ্যানেল প্রচারের ক্ষেত্রে সম্পর্কটি হওয়া উচিত ‌‌'রেসিপ্রকাল' বা পারস্পরিক বিনিমেয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেল প্রচারের কোনো নীতিমালা আছে কি না এবং থাকলেও তার কোনো কার্যকরিতা নেই বলেই মনে হয়। ফলে ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে দূরে থাক, বাংলা ভাষাভাষি পশ্চিমবঙ্গেও বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তার সুযোগে বিদেশী চ্যানেলগুলো ইচ্ছেমতো বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ এবং প্রচার করে চলেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এ সব বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কিভাবে সংশ্লিষ্ট বিদেশী টেলিভিশনে প্রেরণ করা হয় এবং চ্যানেলগুলো এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে কোনো ট্যাক্স বা ভ্যাট পরিশোধ করে কিনা সে সম্পর্কেও সঠিক কোনো তথ্য নেই।



কয়েক মাস আগে ইউক্রেনের রেডিও টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং কাউন্সিল রাশিয়ার পাঁচটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষি অঞ্চলের দর্শকদের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাকেও সামান্য জ্ঞান করার কোনো কারণ নেই। ভাষা সংস্কৃতির সাথে যেহেতু ঐতিহ্য এবং আবেগের প্রশ্নটি জড়িত সে কারণেই বিপুল সংখ্যক দর্শক চ্যানেলগুলো বন্ধ করায় তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কাজেই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের দেশে ভারতীয় বাংলা বা হিন্দি চ্যানেলগুলোর প্রচার যদি কোনো কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে এ দেশের টেলিভিশন দর্শক তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে মোটেও বিলম্ব করবেন না। এ সব টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ও রিয়ালিটি শো ব্যাপক দর্শকের নিত্যদিনের জীবন যাপনের অংশ বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক দর্শকের ক্ষেত্রে এই অভ্যাস নেশায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং এর ফলে অনেকেই তাদের আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাত বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের সময় সূচী ঠিক করার আগে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখে অগ্রসর হন।



অতএব উন্মুক্ত আকাশের যুগে টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতো সমস্যার সমাধান খোঁজা দু হাতের দশ আঙুলে সূর্যালোককে বাধাগ্রস্ত করার মতোই অসম্ভব ব্যাপার। দর্শকদের মধ্যে আমাদের নিজস্ব চ্যানেলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে উত্তরণের কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। দুর্বল অনুকরণ, অন্ধ অনুসরণ এবং কথামালার জটাজাল বিস্তার করে আর যাই হোক দর্শক আকর্ষণ করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো ‘কন্টেন্ট’, ‘ফরম্যাট’ এবং ‘প্রেজেন্টেশন’ সকল দিক থেকেই বিদেশী স্যাটেলাইট টেলিভিশন থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।



মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০৩

অন্ধবিন্দু বলেছেন:
ফরিদুর,
আমাদের চ্যানেলগুলো চেষ্টা করছে। আশা করছি কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে। তবে সাংস্কৃতিক যে বিস্ফোরণ হয়ে গেছে তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে আর বাঁচা গেলো না ...

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৮

ফরিদুর রহমান বলেছেন: আশাবাদী হতে আপত্তি নেই, তবে ক্ষতি যা হবার সত্যিই হয়ে গেছে। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

২| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: এই যুগে হাজারবার চেষ্টা করেও বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ করা যাবে না, যদি আমরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এ দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে না তুলতে পারি। এ জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির জগতে যোগ্য মানুষের পদচারনা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরী।

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৯

ফরিদুর রহমান বলেছেন: আপনার মন্তব্যের সাথে একমত। ধন্যবাদ।

৩| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৪২

ওয়্যারউলফ বলেছেন: যে দেশে হিন্দি সিরিয়ালের মত অরুচিকর ,জঘন্য জিনিস দেখার দর্শকের অভাব নেই সে দেশে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন না বলে আমন্ত্রন বলাই ভাল।
আবু হেনা ভাই এর মন্তব্যে "লাইক" দিলাম।

৪| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩৬

আমিনুর রহমান বলেছেন:




ফরিদ ভাই আবারো আপনার আরো একটা সমসাময়িক সমস্যা ও সমাধান নিয়ে চমৎকার লিখা পড়লাম।


উন্মুক্ত আকাশের যুগে টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতো সমস্যার সমাধান খোঁজা দু হাতের দশ আঙুলে সূর্যালোককে বাধাগ্রস্ত করার মতোই অসম্ভব ব্যাপার। দর্শকদের মধ্যে আমাদের নিজস্ব চ্যানেলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে উত্তরণের কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। দুর্বল অনুকরণ, অন্ধ অনুসরণ এবং কথামালার জটাজাল বিস্তার করে আর যাই হোক দর্শক আকর্ষণ করা সম্ভব নয়।

সহমত ।

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৩০

ফরিদুর রহমান বলেছেন: মন্তব্য ও সহমতের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৫| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩০

আবু শাকিল বলেছেন:

কিছুদিন আগে শুনেছি দেশ থেকে স্টার জলসা বন্ধ করা হবে।এখনো করা হয়েছে কিনা জানি না।
ইন্টারনেট আমাদের অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে, যার যা দরকার সে ঠিক ই দেখে নিবে।
ভারতের মিডিয়া দক্ষিণ এশিয়া এবং মিডল ইষ্টে একক ভাবে প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছে।কোন ভাবেই বিরত রাখা যাচ্ছে না।
চ্যানেল বন্ধ করে সমস্যার সমাধান খোঁজা বোকামি।
আপনার সাথে সহমত পোষণ করে কথা গুলো বলে গেলাম।

চমৎকার লিখা -
" ভাষা সংস্কৃতির বিকৃতি ও বিনাশের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত বিত্ত বা ধণিক শ্রেণীর ‘কৃতিত্ব’ সবচেয়ে বেশি। "

" উন্মুক্ত আকাশের যুগে টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতো সমস্যার সমাধান খোঁজা দু হাতের দশ আঙুলে সূর্যালোককে বাধাগ্রস্ত করার মতোই অসম্ভব ব্যাপার। দর্শকদের মধ্যে আমাদের নিজস্ব চ্যানেলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে উত্তরণের কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই।"

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৩৪

ফরিদুর রহমান বলেছেন: আপনার মন্তব্য ও সহমতের জন্য ধন্যবাদ। সত্যি সত্যিই আমাদের নিজস্ব চ্যানেলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.