নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভুলে যাও বিশ্বের সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের সকল ভেদা ভেদ! কেবল নিজের লক্ষ্য ও গন্তব্য ঠিক করে নাও!

দুঃখী জাহিদ

কবি এবং কবিতার জন্য মগ্ন এ মন।

দুঃখী জাহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওআ সাল্লামার শিক্ষা:সমকালীন বিশ্বে এর বাস্তবতা।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৮



প্রারম্ভিকা:
পূর্ণতা তাঁর পৌছেছিল সর্বোচ্চ শিখর
রূপের আভায় তাঁর,
দূর হলো অন্ধকার,
সুষমা মন্ডিত তাঁর চরিত্র সুন্দর !
সালাত তাঁকে ও তাঁর পরিজন পর ।


বর্তমান বিশ্বে সাম্প্রদায়িকা এক কালো সাপের মত মানুষের আত্মার সাথে বিস্তার লাভ করেছে। যার অনেক শাখা প্রশাখা রয়েছে, প্রতিটি অনাকাঙ্খিত শাখা প্রশাখায় রয়েছে অপসংস্কৃতির ছোঁয়া, যার ফলে মানুষ আজ প্রতিটি ধাপে ধাপে অশান্তির জ্বরে আক্রান্ত । প্রত্যেক মানুষ শান্তি চায়,সুখ চায়, চায় উন্নতি। কেউ অশান্তি ও কষ্টের নৈরাজ্য চায় না। কোন মানুষ দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞ হিসেবে সমাজে বসবাস করতে চায় না। যদি আমরা তৎকালীন আরব সমাজকে দেখি তাহলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়নের দৃষ্যপট । যেখানে মানুষের কোন অধিকার ছিলো না। রাহুগ্রাসে ছিল প্রতিটি মানুষ বর্বরতায় লিপ্ত। আর সেই পথহারা মানুষদেরকে আলোর পথ,শান্তির পথ দেখানোর জন্যে এই নশ্বর পৃথিবীতে ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে আগমন করেছিলেন শান্তির দূত নবী মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । তিনি শিখিয়ে ছিলেন মানুষের মানবীয় অধিকার। তিনি শিখিয়েছিলেন দুখীর সাথে সুখীর বসবাস,গরিবের সাথে ধনীর মিলামেশা । দেখিয়েছিলেন সত্য সুন্দর পথের আলো । শুনিয়েছিলেন রাব্বে কালাম থেকে মহাসত্যের বাণী । জাগিয়েছিলেন সুপ্ত চেতনাকে,মানবতাকে,ভালবাসাকে । যার পরশে সমগ্র আরবময় শান্তির বসন্ত ফুটে উঠেছিলো ।

মহানবীর আবির্ভাবকালে বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিঃ


এখানে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই, একথার বলার প্রয়োজন নেই যে, মহানবী (সা.) এর পূর্বে আরবে সভ্যতা বলতে কিছুই ছিলনা, সবই ছিল হানা-হানি ও রাহাজানি। অসংখ্য নবী-রাসূল বিশ্বের বিভিন্ন দিগন্তে মানুষে মানুষে সাম্য ও সম্প্রীতির শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কিন্তু মহানবী (সা.) এর আবির্ভাবকালে কেবল আরবজাহান নয় বরং সারা জাহান হতে মানুষে মানুষে ভালবাসা ও জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতি ভূলুন্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। মিশর, ভারত. ব্যাবিলন, গ্রীস ও চীনে মানব সভ্যতা সম্পূর্নরুপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। রোম ও পারস্য আজকের ইউরোপ আমেরিকার মত সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী ছিল। কিন্তু বা¯তবতা বলতে কিছুই ছিলনা। সন্ত্রাস নির্মূল ও বিশ্বশান্তির নামে পাশ্চাত্য জগত আজ যেমন সারা বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। রোমক ও ইরানীগণ তখন নিজেদের মাঝে হানা-হানিতে কেবল সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং গোত্রে গোত্রে হানা-হানি ও সাম্প্রদায়িকতা সভ্যতার আড়ালে ছড়িয়ে দিত। রোমান ও পারস্য সম্রাটগণ শুধু অবতার হওয়ার দাবী করতনা বরং তারা খোদা হয়ে মানব সমাজে জেঁকে বসেছিল। তাদের সাথে আতাঁত করে সাধারন জনগনের উপর প্রভুত্ব চালাত ভূমিপুত্র ও ধর্মযাজকগণ। তাদের শোষন নিষ্পেষনে মানুষ শ্বাসরুদ্ব হয়ে মরতে বসেছিল। কর্তৃত্বশীল শ্রেনীর ভোগ-বিলাস তাদের নৈতিক সত্তাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ক্ষমতার পালাবদল হত লড়াই সংঘর্ষের মাধ্যমে। নিত্যনতুন শাসক ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার পর জনগন ভাবত আগেরটির চেয়ে এটি আরও ভয়ানক শোষক। সারাবিশ্ব স্বজনপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। মানুষের সামনে ক্ষীণতম আশার আলো জ্বালানের মত কোন মতবাদ ছিলনা। তারা আর্তনাদ করত কিন্তু তাতে সাড়া দেয়ার কেউ ছিলনা। নবীদের শিক্ষা বিকৃতি ও অপব্যাবহারের ফলে দুনিয়া থেকে উঠে গিয়েছিল। গ্রীক দর্শন, কনফুসিয়াস, মনুসংহিতা, বেদ বেদান্ত, বৌদ্ধ ধর্ম ও জাষ্টিনিন ও সোলুওনর আইন সবই হয়ে পড়েছিল নিষ্প্রাণ ও নিষ্ক্রীয়। কোন দিক হতে কোন আশার আলো দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলনা। বিশ্বজুড়ে যখন ইতিহাসের ভয়াবহতম বীভৎসতা ছড়িয়ে পড়লো, অরাজকতার ঘুট ঘুটে অন্ধকারে মানবতা ঢাকা পড়লো, তখন আকস্মিকভাবে সম্প্রীতির প্রদীপ নিয়ে প্রেরিত হলেন মানবতার শ্রেষ্টতম বন্ধু মহানবী (সাঃ) ।

মহান আল্লাহ্ ভাষায় এরূপে ইরশাদ হয়েছেঃ

তোমাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহকে স্মরণ করঃ তোমরা ছিলে পরপর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। (আলে-ইমরান-১০৩)

উল্লেখ্য যে,জাহিলিয়া যুগে আউস ও খাজরায পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি সম্প্রদায় ছিল। এদের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও পরস্পর হানা-হানি এত চরমে পৌছে ছিল যে, শুরু হওয়ার পর আর তা শেষ হয়না। মহানবী সা. সম্প্রীতির অমীয় বাণী নিয়ে এধরাতে আবির্ভুত হলে তারা তা বুকে ধারন করে। ফলে তাদের মধ্যকার চিরাচরিত হানা-হানি কেবল বন্ধই হয়নি বরং তারা সম্প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনে আপন ভাইয়ের মত হয়ে গিয়েছিল। আল-কুরআনে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে (ইবন কাসীর, মুখতাসারু তাফসীরে ইবন কাসীর ১খ ৩০৫(

হাজারে আসওয়াদ প্রতিস্থাপনে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতার নিরসন :
কা’বা ঘর ও হাজারে আসওয়াদ ছিল ধর্ম বর্ণ নিবিশেষে সকল গোত্রের কাছে সম্মানিত। সেই আদম (আঃ) হতে তা সকল শ্রেনীর মানুষের প্রিয় স্থান বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। হযরত মুহাম্মাদ সা. তখনও নুবুওয়াত লাভে ধন্য হননি। তাঁর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কা’বা গৃহ মেরামত করার প্রয়োজন পড়ে। সকলে মিলে মিশে কা’বার নির্মান কাজকরতে লাগলেন। মক্কার কোন গোত্রই যেন এবরকতময় কাজ হতে বঞ্চিত না হন, সেজন্য ঘরের প্রতিটি অংশকে এক এক গোত্রের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। সম্মিলিত ভাবে কা‘বার কাজ চলছিল। হাজারে আসওয়াদ যেই স্থানে সংস্থাপন করার কথা সেখানে আসার পর কর্মরত গোত্র গুলোর মাঝে মতভিন্নতা সৃষ্টি হলো। কোন গোত্রের লোকজন পাথরটিকে যথাস্থানে স্থাপন করবেন তা নিয়ে মহা বিভ্রাট সৃষ্টি হলো। কারন এর সাথে সামাজিক মর্যাদার বিষয় জড়ানো ছিল। প্রতিটি গোত্র এমর্যাদায় ছাড় দিতে নারাজ। এর ফলে দ্বন্ধ চরম আকার ধারন করল। গোটা শহর হাঙ্গামার ভয়ে আতংকিত হয়ে ওঠল। চারদিন পর্যন্ত থম থমে ভাব বিরাজ করছিল। এরই মাঝে রণ প্রস্তুতি চলছিল। কোন কোন গোত্র তৎকালীন আরবের প্রথা অনুযায়ী রক্তে হাত ডুবিয়ে মরণের প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত করে ফেলল। যুদ্ধ বন্ধে বয়োজ্যেষ্ঠ আবু উমাইয়া (মতান্তরে তার ভাই ওয়ালীদ) বিবদমান দলগুলোকে যুদ্ধ বন্ধে একটি প্রস্তাব পেশ করলেন। তিনি বললেন, বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য আমি প্রস্তাব করছি যে, আগামী দিন বনু শায়বা নামক গেইট দিয়ে যিনি সর্বাগ্রে প্রবেশ করবেন তার হাতে এ ঝগড়ার মীমাংসার ভার দেয়া হোক। এপ্রস্তাবকে মীমাংসার সুন্দরতম পন্থা বলে সকলে মেনে নিলেন। তবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে উদ্বেগের কারন ছিল সেই গেইট দিয়ে কে প্রবেশ করে তার কৌতুহল নিয়ে। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হল সেই গেইট দিয়ে হযরত মুহাম্মাদ সা. এর প্রবেশের মাধ্যমে । তাকে দেখে সবাই বলে উঠল, সে তো ‘আল-আমীন’ আমরা তাঁর উপর সন্তুষ্ট। তাঁকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলা হল, তিনি বললেন যে সকল সম্প্রদায় হাজারে আসওয়াদ যথা স্থানে স্থাপনের অধিকারী বলে দাবীদার, তারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করুন। তিনি একখানা চাদর বিছিয়ে দিয়ে তাতে হাজারে আসওয়াদ কে এর মাঝ খানে রেখে প্রতিনিধি গণকে চাদরের এক প্রান্তে ধরে তা উঠাতে বললেন ফলে সম্মিলিত ভাবে তারা তা যথা স্থানে স্থাপনের সুযোগ লাভ করল। অতঃপর তিনি নিজ হাতে চাদর হতে পাথরটিকে যথা স্থানে রেখে দিলেন। এতে সকলেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। এভাবে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গার একসম্ভাবনা তিরোহিত হয়েগেল। (আয-যারকানী, শারহু মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়া, মিসর তা,বি ১খ ২০৩; আলী ইবন বুরহানুদ্দীন, আস-সীরাতুল হালাবিয়া, মিসর ১৯৬ খ্রি:, ১খ ১৬০(
হিলফুল ফযূল গঠন :
পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যের অঙ্গীকারমূলক একটি সংঘের নাম ছিল হিলফুল ফযূল। মুহাম্মাদ সা. সবে মাত্র কিশোর, বয়স ১৪ বছর, ফিজারের ৪র্থ যুদ্ধ তখন সংঘটিত হয় বিবদমান দু’টি দলের মাঝে প্রধানত কুরাইশ ও হাওয়াযিন গোত্র ছিল। কুরাইশদের হয়ে তিনি চাচাদের সঙ্গে যুদ্ধে উদ্ভাসিত ছিলেন। কুরাইশগন ছিল এতে আত্ম রক্ষার ভুমিকায়। তারা ছিল সম্পূর্ন নির্দোষ। একারণেই হযরত মুহাম্মাদ সা. তাতে অংশ গ্রহণ করেন। তবে তিনি কোন অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। যুদ্ধভীষন আকার ধারন করেছিল (ফুয়াদ হামযা, কালবু জাযীরাতিল আরব, মিসর ১৩৫২ হি. ২৬০)
রনাঙ্গনে উপস্থিত থাকায় যুদ্ধের বিভীষিকা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। গোত্রে গোত্রে এরূপ তান্ডব লীলা তাঁকে প্রচন্ড ভাবে আহত করে। আরবদের মাঝে এরূপ নির্মমতা চিরকাল হতে চলে আসছে। কোন দিনেই তাদের পাষাণ হৃদয়ে সহমর্মিতার উদ্রেক হয়নি। এবারই ব্যতিক্রম, কতিপয় যুবকের অন্তরে যুদ্ধ বন্ধ ও মানব সমাজে সম্প্রীতির ভাবনা তৈরী হয়। কারন বিশ্ব মানবতার ত্রানকর্তা, করুনারছবি ও ইনসানিয়্যাতের রবির আলোকচ্ছটা পড়েছে সেই যুবসমাজের অন্তরে। ফিজার যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর বনু হাশেম গোত্রের পতাকা উড্ডয়ন কারী যুবায়ের একটি শান্তি সংঘ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করলেন। তিনি ছিলেন মুহাম্মাদ সা. এর চাচা । তার অন্তরেই হযরত মুহাম্মাদ সা. এর অন্তরের প্রতিচ্ছায়া সম্যক রূপে প্রতিফলিত হয়েছিল। সমাজে সম্প্রীতি সৃষ্টির ভাবনা তাঁর হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়েছিল। উপস্থিত যুবকগণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে তাতে সাড়া দিল। আপন গোত্রের কেউ কোন অন্যায় করলে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন করা, তার মান ইজ্জত রক্ষার্থে অকাতরে ধন-প্রাণ বিলিয়ে দেয়া ছিল আরবে সাধারন নিয়ম। এপ্রথাকে বিসর্জন দিয়ে যুবকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞায় ঐক্যমত পোষন করায় বালক মুহাম্মাদ সা. মনেপ্রাণে খুশি হয়েছিলেন। (আস-সুহায়লী, আর-রাওদুল উনুফ, মিসর ১৯১৪ ২খ ৭১(

আব্দুল্লাহ ইবন জুদ’আনের গৃহে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে হিলফুল ফযূলের কার্যক্রম শুরু হয়। হযরত মুহাম্মাদ সা. এসম্মেলনে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। অন্যতম সদস্য হিসেবে তিনি শপথ গ্রহন করেন। নুবুওয়াত লাভের পর তিনি বলতেন, আব্দুল্লাহ ইবন জুদ’আনের গৃহে শপথ করে যে প্রতিজ্ঞা করে ছিলাম তার বিনিময়ে আমাকে লাল লাল উট দান করলেও আমি সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে সম্মত নই। আজও যদি কোন নিপীড়িত ব্যক্তি হে হিলফুল ফযূলের সদস্যগণ! বলে আহ্বান করে তবে আমি তার সে ডাকে সাড়া দেব। কারন ইসলাম ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং নির্যাতিতের সাহায্যের জন্যই এসেছে ।
(আল-হাকীম নিশাপুরী,আল-মুসতাদরাক, হায়দ্রাবাদ, ১৩৪৫হি, ২খ ২২০(

মুহাজির ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃতের বন্ধন :

রাসূলুল্লাহ সা. মাদীনায় হিজরতের পর দেশ ত্যাগী সাহাবায়ে কেরাম ও আশ্রয় দাতা আনসার গণের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে সম্প্রীতির এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দু‘টি অঞ্চলের মানুষ, যারা পেশা ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় অভ্যস্থ, তাদেরকে এক সুতোয় গাঁথার জন্য যেই কর্ম কৌশল অবলম্বন করার প্রয়োজন ছিল, তাহল, তাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ পয়দা করা। রাসূলুল্লাহ সা. তা-ই করে গোটা উম্মাহকে সোনালী সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ইরশাদ হচ্ছে : আনাস রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় আমার গৃহে কুরাইশ ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করছিলেন, তার থেকে বর্ণিত অন্য রেওয়ায়াতে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. আবূ উবায়দা ইবনুল র্জারাহ ও আবূ তালহার মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে দিয়েছিলেন। (ইমাম মুসলিম, আস-সাহীহ, ২খ ৩০৮
এই ভ্রাতৃত্ব এমন ভাবে সুদৃঢ় করে দেয়া হয়ে ছিল যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে এর দ¦ারা পরস্পর উত্তরাধিকারও হওয়া যেত। পরবর্তীকালে আল-কুরআনে উত্তরাধিকার আইন স্পষ্ট ভাবে নাযিল হলে এর কার্যকারিতা রহিত হয়ে যায় (ইমাম নাওয়ায়ী, (পাদটীকা সাহীহ মুসলিম, প্রাগুক্ত)
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং মহানবীর জীবনের ঘটনা :
শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী (সা.)-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রজ্ব¡ল দৃষ্টান্ত। এক অমুসলিম বৃদ্ধার ঘটনা ইতিহাসে আমরা জেনেছি। যে বৃদ্ধা প্রতিদিন মহানবী (সা.)-এর চলার পথে কাঁটা দিত। একদিন রাসূল (সা.) দেখলেন, পথে কাঁটা নেই, তখন তিনি ভাবলেন, হয়তো ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়েছে বা কোন বিপদে আছে, তার খোঁজ নেয়া দরকার। এরপর দয়ার নবী (সা.) ওই বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দেখেন ঠিকই সে অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। এতে বৃদ্ধা অভিভূত হয়ে গেল যে, আমি যাকে কষ্ট দেয়ার জন্য পথে কাঁটা পুঁতে রাখতাম, সে-ই আজ আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে? ইনিই তো সত্যিকার অর্থে শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত। মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে লোকজন নিরাপদ থাকে, সেই মুসলমান এবং যার নির্যাতন থেকে মানুষ নিরাপদ; তাকে মুমিন বলে।’

নবী (সা.) নিজেকে তিনটি বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন :
১. ঝগড়া-বিবাদ, ২. বেশি কথা বলা, ৩. অনর্থক বিষয়াদি হতে। অনুরূপ তিনটি বিষয় হইতে
অন্যকেও বাঁচিয়ে রেখেছিলেন : ১. কারো নিন্দা করতেন না, ২. কাউকে লজ্জা দিতেন না, ৩. কারো দোষ তালাশ করতেন না।
রাসূলে কারীম (সা.)-এর ঘরে এক ইহুদি মেহমান হয়ে আসল। রাসূল (সা.) তাকে যথাযথ মেহমানদারী করলেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। ইহুদি মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে। রাসূল (সা.) তাকে কিছু বলবেন এই ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসূল (সা.) এ মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে, হায়! আমি ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি; হয়তো সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর মহামানব মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানা পরিষ্কার করলেন এবং ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন, ভাই আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে। আমি আপনার কোন যতাযত করতে পারিনি। এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ! অতঃপর রাসূল (স.)-এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে।
একজন বেদুঈন এসে মসজিদের ভেতরে পেশাব করতে লাগল। এতে উপস্থিত সাহাবীগণ তাকে ধমক দিলে রাসূল (সা.) বললেন, তাকে পেশাব করা থেকে বাধা প্রদান করো না। তাকে সুযোগ দাও; যাতে সে পেশাবের প্রয়োজন সেরে নিতে পারে, কারণ মধ্যখানে বন্ধ করলে ক্ষতি হবে। সে বেদুঈনের পেশাব করা শেষ হলে নবী কারীম (স.) তাকে ডেকে বললেন যে, এটা পেশাবের স্থান নয়; বরং এটা আমাদের ইবাদতখানা, পবিত্রস্থান। এ বলে তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন এবং এক সাহাবীকে পানি নিয়ে আসতে বললেন। অতঃপর মহানবী (সা.) নিজেই সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মসজিদ থেকে উক্ত পেশাব ধুয়ে দিলেন।” এরূপ উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মদীনা সনদ:
মহানবী (স.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেন তা ইসলাম তথা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। মদীনায় বসবাসরত বিভিন্ন গোত্র, উপগোত্র, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী, দল ও উপদলের সহাবস্থান, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাসূল (সা.) একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে ‘মদীনা সনদ’ নামে খ্যাত।
এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা রয়েছে। অতুলনীয় চরিত্র মাধুর্য, অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ, আমল ও আখলাক দ্বারা তিনি মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মদীনায় মুসলমান, ইহুদী এবং আওস ও খাযরায গোত্রসহ ১২টি উপগোত্রের বসবাস ছিল।
চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে সকল গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করা যায় মহানবী (সা.) মদীনাকে তার একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী (সা.) ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। যেমন- সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। বহু ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মদীনার সনদ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মদীনার সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন সমাজের গোত্রসমূহের আন্তঃকলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশক’টি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুহাম্মদ (সা.) তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর সন্ধিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সাথে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.)কে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখ। এতে হযরত আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূল (সা.) নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন।
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (স.) বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী (সা.) বিজিত শত্রুদের প্রতি কোন ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, ‘আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। অতঃপর রাসূল (স.) বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।’ ইসলামে জাতি, শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্য নেই। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের
একমাত্রভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া বা পরহেজগারি। নারীদের বিষয়ে বিদায় হজের ভাষণে বলা হয়েছে ‘তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের উপর তাদেরও অধিকার রয়েছে’।
একজন বেদুঈন এসে মসজিদের ভেতরে পেশাব করতে লাগল। এতে উপস্থিত সাহাবীগণ তাকে ধমক দিলে রাসূল (সা.) বললেন, তাকে পেশাব করা থেকে বাধা প্রদান করো না। তাকে সুযোগ দাও; যাতে সে পেশাবের প্রয়োজন সেরে নিতে পারে, কারণ মধ্যখানে বন্ধ করলে ক্ষতি হবে। সে বেদুঈনের পেশাব করা শেষ হলে নবী কারীম (স.) তাকে ডেকে বললেন যে, এটা পেশাবের স্থান নয়; বরং এটা আমাদের ইবাদতখানা, পবিত্রস্থান। এ বলে তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন এবং এক সাহাবীকে পানি নিয়ে আসতে বললেন। অতঃপর মহানবী (সা.) নিজেই সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মসজিদ থেকে উক্ত পেশাব ধুয়ে দিলেন।” ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে নবী করীম (সা.) ও সাহাবাগণ কোন রকম জোর-জবরদস্তি করেননি। নায়েবে রাসূল (সা.), ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া, পীর-মাশায়েখ, অলি-আউলিয়া, হাক্কানী আলেম-ওলামা যুগ যুগ ধরে দুনিয়ার বুকে দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিরলসভাবে মেহনত করে চলছেন। যুগে যুগে যারা মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তারা অসাধারণ মানবপ্রেম, অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য, অতুলনীয় মানবিক মূল্যবোধ, দৃষ্টান্তমূলক সৎকর্ম, নিষ্ঠাপূর্ণ আমল ও পরিশুদ্ধ মননশীলতা দ্বারা বিশাল জনগোষ্ঠীকে ইসলাম গ্রহণে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার যে, রাসূল (স.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে জায়েজ নেই। সহিংসতা তো দূরের কথা অন্য ধর্মের প্রতি সামান্য কটূক্তিও না করার জন্য কুরআনে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে।” (আনআম-১০৮)। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস থেকে পরিত্রাণের জন্য পবিত্র কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা এবং নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস বিরোধী আয়াত ও ইসলামের মানবতাবাদী শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ):
ইসলাম পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতির ধর্ম। ইসলাম ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। একই দেশের নাগরিকদের মেজরিটি ও মাইনরিটি বিবেচনায় বিভাজনের অবকাশ ইসলামে নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধর্ম ইসলাম। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম-অমুসলিম সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সবার অধিকার সমান। ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত সব ধর্মের নাগরিক স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালনসহ সব ধরনের মানবাধিকার লাভ করে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো ধরনের অন্যায়-অবিচারের বৈধতা ইসলামে নেই। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের ন্যায়বিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার করবে। ইনসাফ করবে। এটাই তাকওয়ার নিকটতর। (মায়িদা-৮)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, দীন-ধর্ম সম্পর্কে কোনো জোরজবরদস্তি নেই। (বাকারা-২৫৬)। অর্থাৎ কোনো অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের জন্য জোরজবরদস্তি করা যাবে না। ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে শেখায়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিখিয়েছেন। সব মানুষই আদম (আ.)-এর সন্তান। আর আদম মাটি দ্বারা তৈরি। সুতরাং মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই।

হজরত মুহাম্মদ (আ.) আরও বলেন, সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। যে আল্লাহর পরিবারকে ভালোবাসে সে-ই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন কোনো শিক্ষা ইসলামে নেই। আর এ জন্যই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। রাষ্ট্রধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্র থাকে প্রকৃত নিরপেক্ষ। কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামের বিধান অনুসৃত হলে সব ধর্মের নাগরিকের জীবন সুখময় হবে। মদিনার আদর্শ রাষ্ট্রে বাস্তবে যা হয়েছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনার বহুজাতীয় নাগরিকদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও সব ধর্মাবলম্বীর নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্বারোপ করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো জিম্মির প্রতি অবিচার করবে, মানহানি করবে, তাকে তার সামর্থ্যের অধিক কাজে বাধ্য করবে। অথবা তার সন্তুষ্টি ছাড়াই তার কোনো কিছু ছিনিয়ে নিবে কেয়ামত দিবসে আমি তার প্রতিপক্ষ হব। (আবু দাউদ শরিফ)। আরেকটি হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো জিম্মিকে কষ্ট দেয় সে যেন আমাকেই কষ্ট দেয়। অন্য এক হাদিসে তিনি বলেন, জিম্মিদের রক্ত আমাদের রক্তের ন্যায়।

উপসংহার :
মানব সমাজ যখন অমানিশার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত, মানুষে মানুষে কলহ-বিবাদ, গোত্রে গোত্রে রক্তের হোলি খেলা, পাশবিকতা ও হিংস্রতার জয় জয়াকার, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বিগ্রহের যাতাকলে যখন মানবতা নিভু নিভু করছে তখন ধরাধামে সম্প্রীতির মশাল নিয়ে আগমন করলেন মানবতার পরম বন্ধু, মহানবী মুহাম্মাদ সা.। তিনি আবির্ভুত হন গোটা বিশ্ববাসীর উপহার স্বরূপ। শুধু মুমিন-মুসলিম নয় সমগ্র মানব জাতির ত্রাণকর্তা রূপে তিনি প্রেরিত, মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ আমি তোমাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সু-সংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। (সাবা-২৮)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেছেন— ‘অবশ্যই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমার ভাইয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর, যাতে তোমরা রহমত পেতে পার’ (হুজরাত-১০)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই। তিনি ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে বলেছেন— ‘তোমরা সবাই আদম সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। একমাত্র তাকওয়া ছাড়া অনারবদের ওপর আরবদের আর আরবদের ওপর অনারবদের কোনো প্রাধান্য নেই’ (বায়হাকী)। মহানবী (সা.)-এর এই আদর্শে গোত্রভিত্তিক সমাজের কৃত্রিম আভিজাত্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করে এবং সংকীর্ণ সে সমাজ নির্মূল হয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিভিত্তিক সমাজের উদ্ভব ঘটে।
নবী (সা.)-এর শিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল হল গোত্রভিত্তিক সমাজের আধিপত্য বিলোপ সাধন করে ইসলামী ভ্রাতৃত্বে অনুপ্রাণিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। তিনি কেবল আরববাসীদের মধ্যে কিংবা শুধু মুসলিম উম্মাহর মধ্যেই নয় বরং জাতি বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সমস্ত মানবের মধ্যে সম্প্রীতি, শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দুনিয়ায় এক অক্ষয় আদর্শের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর আদর্শের মূল ভিত্তি হল ধর্ম, জাতি, দেশ ভিন্ন হলেও সকল মানুষ মূলত একই পরিবারভুক্ত। মুসলিম-অমুসলিম সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন— অমুসলিমদের জান ও মাল এবং আমাদের জান ও মাল এক ও অভিন্ন।



মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: খুব মন দিয়ে আপনার লেখাটি পর-পর দুইবার পড়লাম।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩৮

দুঃখী জাহিদ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

২| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


লেখাটি আরবীতে ছাপিয়ে সিরিয়া ও ইরাকে বিতরণ করলে কাজ হবে! আপনি চেষ্টা করে দেখুন।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪০

দুঃখী জাহিদ বলেছেন: তা করতে পারলে ভালো হতো !কিন্তু

৩| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:২৬

মহামোহপাধ্যায় বলেছেন: ধন্যবাদ। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে লিখার জন্য।
আপনার জন্য শুভকামনা।

আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।
আমীন।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪০

দুঃখী জাহিদ বলেছেন: আমিন আমিন আমিন

৪| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩০

আবু তালেব শেখ বলেছেন: প্রিয়তে রাখলাম। পরে মন দিয়ে পড়বো

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩৯

দুঃখী জাহিদ বলেছেন: ভালবাসা আমারও রইলো

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.