নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কালাম আজাদ

কালাম আজাদ কক্সবাজার

মানবধর্ম ও সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী

কালাম আজাদ কক্সবাজার › বিস্তারিত পোস্টঃ

নুরপাড়ার দেলোয়ার এবং জাল ভোট

০২ রা জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:২৪



বাঁকখালী নদীর উপর দেয়া ভেড়ি বাঁধের দক্ষিণ প্রান্তের নুরপাড়ায় ভোটের ক্যাম্প পড়েছে। কোন পার্টির সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা একটা চমক। না খেয়ে থাকা মানুষগুলো একটু নতুনত্বের স্বাদ পাচ্ছে-ভোটের গান গুনছে। পোস্টার লাইটিং, মাইকিং, হৈ-হুল্লোড়। বিশেষ করে ছেলে পিলেদের আনন্দের সীমা নেই। সারাদিন ঘুরঘুর ঘুরঘুর করে ক্যাম্পটির আশে পাশে। এই পিচ্চি সিগ্রেট আন! ঐ পিচ্চি পানি আন! ঐ ছেমড়া চা লইয়া আয়!

ফুট ফরমান খাটার মধ্যে আনন্দ। ভাগ্য ভাল থাকলে ভোটের কাগজ (লিফলেট) বিলি করার দায়িত্বও পেয়ে যায় পিচ্চিগুলো মাঝে মধ্যে। অথবা চিকা মারে বস্তি-বস্তির ঘরে ঘরে। সেলিমের দিনমান কাটে ভোটের ক্যাম্পে। গত পরশু দিন চড় খেয়েছিল আমিন ভাইয়ের হাতে। ভেবেছিল আর আসবে না কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চোখটা মুছে আবার বান্দা হাজির। ভোটের গানগুলো ওর মুখস্ত ঠোঁটস্থ। সারাদিন বিড়বিড় করে গেয়ে যায়। মাঝে মাঝে ভাষণ দেয়-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম গরীবরে মারি হাইবার সংগ্রাম...

আর এই দিকে ওর বোনগুলো ডেকে ডেকে সারা হয়।

ও সেলিম গুসুল ন গরিবি। তাড়াতাড়ি আয়-মা বকিব।

আধ খাওয়া সেলিম একটু করে বন রুটি পেয়ে গিয়েছিল। ময়লা দাঁত বের করে হাত উচিয়ে বোনকে দেখাল রুটিটা। রিমিও হাসল। ভাগ্যবান তার ভাইটা। ভাইকে নেবার ছলে ক্যাম্পের খুঁটি ধরে দাঁড়ায় সে। পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত ওকে চিমটি দিচ্ছে রুমি।

রিমি উইক্কা চা-তরেইক্কা চাই থাইক্কে!

রিমি চোখ বড় বড় করে তাকায় ওদিকে। ক্যাসেট প্লেয়ারের সামনে বসে যে ছেলেটা ক্যাসেট উল্টে পাল্টে দিচ্ছিল সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে রিমিকে। বয়স তের পেরোয়নি মেয়ের কিন্তু কমতি নেই। আধ পেট খেয়ে যে দিন কাটায় দেখে বোঝা যায় না। তার ঐ তাকানোটা ভাল লাগছে। ভিতরে ভিতরে শিহরিত হচ্ছে রিমি। ভেনচি কেটে সে মুখ ফেরাল। ভাইকে ডাকতে গিয়ে অযথা হৈ চৈ করে উঠল।



-এ্যাই ছেঁড়া তাড়াতাড়ি আয়, কতক্কন ধইরি তিয়াই তাক্কি খবর নাই।



হাতে একগাদা ভোটের কাগজ নিয়ে সেলিম বোনের কাছে এল। মুখখানা ওর ভরে গেছে হাসিতে। অনেকগুলো মার্কা তার কালেকশানে। নৌকা, ধানের শীষ, দাঁড়িপাল্লা, জাহাজ, আনারস, মাছ, গোলাপফুল, খেজুরগাছ-বিভিন্ন রকম বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন রংয়ের। আব আবার এই এতগুলো। মামুন্যারে টেক্কা দেবে এই বার। সন্ধ্যায় নামল ঝুম বৃষ্টি। বাঁধের ওপর মাটির পথ। কাদায় একসার চারিদিক। ছেলেরা বস্তিতে ঢুকছে ভোট চাইতে। ঘরে ঘরে ঢুকে মা, বোনদের তোয়াজ করছে। ওদের দুর্গন্ধ বিছানায় বসছে, নোংরা, গু-মুত মেশানো কাদায় দিব্যি আসা যাওয়া করছে।



আবছা অন্ধকারে মুখোমুখি হয়ে গেল রিমির সেই ক্যাসেট ওয়াল ছেলেটির সাথে। ছেলেটি হাসিমুখ করে বলল-কি রে ভোট দিবি?



কইত ন পারি। মা কইয়ে আর ভুটের বয়স অয় নাই।



-ভোটের আবার বয়স লাগে না কি? যাবি আর দিয়েনে আই যাবি গৈ।



রিমি ঠাট্টা করে বলল-



ন-পাইজ্যম। ভুট দিয়া আ’র কি কাম?



তর কি নাম? হইদ্দে।”



ছেলেটা আচমকা খামচে ধরল ওর কাঁধ। রিমি রেগে কাঁদ ছাড়ল এবং বলল-



-লুচ্চা হদিয়ার- এই বলে রিমি তার বাসায় চলে আসে। নুরপাড়ার মালিক্যার সন্ত্রাসী পুত্র দেলোয়ার ভবিষ্যতে দেখে নেবে বলে ঐ স্থান ত্যাগ করে। দেলোয়ারের কাজ হচ্ছে মানুষ মারা আর চাঁদা দাবী করা। আর দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়া। সে নাকি মহেশখালীর একটি গ্রুপের সদস্য এবং কুখ্যাত সোনার পাড়ার সন্তান। সে নুরপাড়ায় আসে তার বাবার কর্মসূত্রে। আসার পর থেকে সে এ অপরাধ করে আসছে। এদিন তাকে মারে, এই দিন অমুখের দাঁত ভাঙে। আর এদিকে আমিন্যা চোরা তাদের প্রশ্রয় দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুপে নেয়।



সেলিমেরা নতুন কাজ পেয়েছে। আশেপাশে অন্য পার্টির পোস্টার পড়া মাত্র ছিঁড়ে ফেলা। এজন্য চড় থাপ্পর খেতে হয়েছে প্রচুর এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে। ক্যাম্পের ছেলেরা বলে দিয়েছে, কোন আ’লায় মারে দেইখ্যা রাখবি। রাইতের আন্ধারে ফিনিশ করি দিয়ুম’



সন্ত্রাসীদের পোলা পোয়ানের এই উদ্বত্যপূর্ণ কথায় সাহস পেয়ে পাড়ার গরীবের ছেলেরা পোস্টার ছেঁড়ে মনের আনন্দে। সন্ধ্যা নামলেই মিছিল শ্লোগান। মারামারি, ঢিলাঢিলি। আজ এর মাথা পাটে, কাল ওর। সেলিমেরা চকলেট পায়, বিস্কুট পায়, ঢিল খেলে একশ টাকা পায়। এটুকুনই লাভ। ভোটের আগের রাতে ভোটার দিতে আসে ছেলেগুলো। বড় ছোট প্রত্যেককে ধরিয়ে দেয় একটা করে। “ এই মার্কায় সীল মারবা-এ ই নাম বলবা-বয়স এত ভুল যে না হয়। লেকচার দিতে দিতে রগফুলে যায় ওদের। সেই ক্যাসেটগুলো ছেলেটা মানে দেলোয়ার খুঁজে বের করল রিমিকে।



-এ্যাই ছেমড়ী নে ধর। তর নাম কুট্টি বিবি। বয়স কুড়ি। খবরদার ভুল যেন না হয়।



-ছেমড়া ছেমড়া গরেন ক্যান? ভুট দিতাম ন যাইয়ুম।’



রিমির মান-সম্মানে লেগেছে খুব। রিমির এই অবস্থা দেখে দেলোয়ার হাসল-বলল



-আচ্ছা আচ্ছা, ছেমড়া ছেমড়া ন কইয়ুম, বিবি সাব কইয়ুম। ভোট না পাইলে কিন্তু খবর অইব। তুরার হোন অসুবিধা নাই। সকালে নাস্তা পাবি দু’রে বিরানী আর যদি টিপ খাডাইয়া বেশী ভোট দিতে পারস তইলে একশ টাকা বেশী পাবি, খাওন-আসন আবার।



একশ টাকা! ছুকড়ীগুলোর চোখ মাথায় ওঠে। একদিনের আয় একশ টাকা! ছুড়ি, ফিতা, ক্লিপ, জর্জেটের ওড়না কত কি পাওয়া যায় একশ টাকায়।



রিমি নাসরিনেরা ছোটাছুটি করে সারাদিন। এ কেন্দ্র থেকে ও কেন্দ্রে। ভোটার ীপ নেয় আর জাল ভোট দেয়। দুপুরে খায় ভরপেট বিরানী। একটু পর পর কেক, বিস্কুট। রিমির ঝোলা ভরে আর ভরে। সন্ধ্যায় ফিরতি পথে ওরা উকি দেয়া ক্যাম্পে। জাল ভুট দিয়া আসছি। ট্যাকা দেন অহন”



দলবেঁধে দাবী জানায়। ওদের গা থেকে ছুটে আসে পাউডারের গন্ধ, তেলের গন্ধ, সর্বোপরি উৎকট গন্ধ। পেট মোটা এক লোক বসে বসে কি যেন হিসাব নিকাশ করছে। সে ঘাড় ফিরিয়ে বলল-



-কিয়ের টাকা?”



ক্যা! জাল ভুট দিলে একশ টাকা করে দিবার কথা কই আসসিলা?”



অ-। পরে পাবি। অহন যা।



-পরে কুন সময়? মেয়েগুলো অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন তোলে।



-আইস কাইল এক সময়।



-অহন যা। ন দেখর কাম গরিদদে।” লোকটা বিরক্তির সাথে জবাব দিত,



মেয়েগুলো মেজাজ খারাপ করে ফিরে আসে। কি ক্লান্তি, শ্রান্তি, কি পরিশ্রমটা গেছে সারাদিন। যে যার ঘরে চলে যায়। রিমি ঘরে ঢুকে দেখল ঘুর ঘুট্টি অন্ধকার। কেউ নেই। মা কখন ফিরবে কে জানে। কোন কিছু না ভেবে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য বিছানায় এলিয়ে পড়ে। এলিয়ে পড়া মাত্রই চোখে ঘুম এসে যায় তার। পরে সেলিমের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে রিমির। কাঁচা ঘুম। ধরফর করে ওঠে বুক। চোখ মেলে চেয়ে দেখে তাদের ওপর লম্ফ জ্বলছে।



-মা কই?



-কি জানি। মনে হয় বিবিসাবগো বাড়ী।



-আরে কিইল্যাই ডাইকছস?



তোরে ট্যায়া নিতে যাইবারলাই কইয়ে।



ট্যাকার কথা শুনে লাফ দিয়ে ওঠে রিমি।



কে? ত হদে যাইবার লাই হয়ে



-হুই, ঐ দেলোয়ার। ক্যাম্ফে।



রিমি ওঠে ভাইয়ের হাত ধরে হাটা দেয়।



-ল-যাই



-না। তুরে একলা যাবারলাই কইয়ে। আরে মেলাডি বাদাম ভাজা দিয়ে। মা আইলে যাইয়ুম। অহন যা তাড়াতাড়ি বাড়ি আইস। রিমি দ্বিরুক্তি না করে পথে নামল। ঐ দিকে রাত কত বোঝা যাচ্ছে না। চারদিকে চিল্লাচিলি হৈ চৈই। ক্যাম্পের ভেতর টিভি চলছে। প্রচণ্ড ভীড় জমিয়ে লোকেরা দেখছে। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে উঠছে। দেলোয়ারই বা কে? রিমি মনে করতে পারল না। ক্যাম্পের কাছাকাছি আসতে ওপাশ থেকে কে ডাকল ওকে। রিমি এগিয়ে গেল। দেখল সেই ছেলেটা।



-আইছস টিইয়া নিতে?



-অনর নাম দেলোয়ার?



-হু চল আগে বাড়ী।



দেলোয়ার ওকে নিয়ে চলে গেল অনেকটা পথ। ভাঙ্গা-চোরা একটা ঝুপড়ির সামনে নিয়ে দাঁড়াল। রিমির এবার ভয় করতে থাকে। সে ভারী উদ্বিগ্ন, গলায় বলল,



-কই আনলেন আরে। টিইয়া দেন চইলা যাই গৈ।”



-টিইয়া নিবি? আয়।”



দেলোয়ার ওর হাত ধরে টেনে ঢোকায় ঘরে। ওর বুক টেনে ওড়না টেনে মুখ বাঁধে শক্ত করে। অনেক চেষ্টা করেও তার হাত থেকে মুক্ত হতে চায়। দেলোয়ার খুবই শক্তিশালী। আর আধ পেটে খাওয়া ওর সাথে। এটে রিমি বাধা দিতে পারে না। রিমি সব শক্তি নিঃশেষিত। কত সময় যায়-রাত কত গভীর হয় ও বুঝতে পারে না। দূর থেকে ও যেন শুনতে পায় ওর মা ডাকছে রিমি-ও রিমি!



সেলিমের কচি গলা ভাসে বাতাসে, বুজি!



রিমির চেতনা ফেরে। খরার রোদের তাপে। হন্ত-দন্ত হয়ে উঠে বসে ও। গা ভরা কষ্ট টের পায়। দেলোয়ার নেই। ওর পাশে পড়ে আছে একশ টাকার নোট। একটা নয়-দুটো। হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে রিমি। বিলাপ করে আপন মনে, এতো বড় সর্বনাশ গরলি আ’র। মারে কি কইয়ুম আই-বস্তিতে কেন গরি দেখাইয়ুম এই মুখ।



রিমির বিলাপ শোনার কেউ নাই এখানে। সবাই হৈ-হুল্লা করছে ঐ দূরে-ক্যাম্পের কাছে। টলোমলো পায়ে এগোয় সে। চারদিক কি উজ্জ্বল, ছেলেরা উল্লাস করছে, আনন্দে নাচছে। মিষ্টি বিলোচ্ছে দু’হাতে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.