নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের ব্রতপার্বণ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৩২

বাংলাদেশের মানুষ আমোদ ও উৎসবপ্রিয়। দুঃখ দারিদ্র্য ভুলে মানুষ নানা উৎসবে মিলিত হয়। সারা বছর কোন না কোন উপলক্ষে বাংলাদেশের মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। সে জন্যই বলা হয়, এই দেশে বারো মাসে তেরো পার্বণ। এর মধ্যেই বাংলাদেশের মানুষের প্রচণ্ড প্রাণ শক্তির পরিচয় নিহিত। নৃতাত্ত্বিকগণ বলছেন, বাঙ্গালী একটি শঙ্কর জাতি। এ জাতির মধ্যে নানা জাতি গোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটায় বাংলাদেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে, বিশেষ করে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে। অঞ্জলভেদে এমনকি জেলায় জেলায়ও নানা পার্থক্য চোখে পড়ে। ব্রতপার্বণ প্রধানতঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত। তবে বাংলাদেশে কিছু এলাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও কিছু ব্রতপার্বণ প্রচলিত আছে।

ব্রতের সংজ্ঞা ও প্রকার ভেদ

ব্রত হচ্ছে মানুষের কামনার অনুষ্ঠান। কামনা ছাড়া মানুষ নেই, মানুষ ছাড়া কামনা নেই। বনবাসী সন্ন্যাসীও ঐশী শক্তিলাভ আর ঈশ্বর দর্শন কামনা করে ব্রত পালন করেন। তাঁর সাধনা ও সাধন পদ্ধতিই তাঁর ব্রত। ’বৃ’ধাতু †থকে ব্রত শব্দের উৎপত্তি (√বৃ+অত [অতক্] =ব্রত)। ব্রত শব্দের সাধারণ অর্থ নিয়ম বা সংযম। তাই ব্রত হচ্ছে নিয়ম,সংযমের ভিতর দিয়ে কামনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পূণ্য কর্মের অনুষ্ঠান। ব্রতসমূহ কামনার প্রতীক বলে প্রত্যেক ব্রতে ব্রতীর কামনা সক্রিয় থাকে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, 'কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে আসছে তাকেই বলি ব্রত’। ড.নীহাররঞ্জন রায় অনুমান করেন, ব্রতধর্ম পালন করেন বলেই অনার্যরা ব্রাত্য বা পতিত বলে অভিহিত হতেন। ড.রায়ের মতে,'ঋগ্বদেীয় আর্যরা ছিলেন যজ্ঞধর্মী; যজ্ঞধর্মী আর্যদের বাহিরে যাঁহারা ব্রতধর্ম পালন করিতেন, ব্রতের গুহ্য যাদুশক্তি বা ম্যাজিকে বিশ্বাস করিতেন তাঁহারাই হয়তো ছিলেন ব্রাত্য’। তাঁর মতে, অনার্য অধ্যুষিত প্রাচ্য এলাকা তথা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম এলাকাতেই ব্রতের প্রসার বেশি। ব্রতের উৎস সম্পর্কে সুহৃদ কুমার ভৌমিক আদিবাসী ঐতিহ্যের কথা বলেছেন। তাঁর মতে ব্রতকথা তৈরির যে কাঠামো তা বাঙালি ও আদিবাসীদের (বিশেষতঃ সাঁওতাল) মধ্যে প্রায় এক। অবন ঠাকুরেরও মত হচ্ছে, ব্রত আদিম ধারণাজাত। ব্রতের স্বরূপ প্রসঙ্গে গুরুবন্ধু ভট্টাচার্য বলেছেন,’স্মরণাতীত কাল হইতে বঙ্গের প্রতি পল্লীতে, প্রতি হিন্দু-গৃহে বিভিন্ন ব্রতের অনুষ্ঠান চলিয়া আসিতেছে। এই সকল নিত্যানুষ্ঠিত পুণ্য কর্ম্মের যবনিকার অন্তরালে সুন্দর সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। ব্রতের ”কথা”গুলি অতীত যুগে দেশের সুখ-সমৃদ্ধির অলিখিত ইতিহাস।’

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রতসমূহের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। তাঁর মতে ব্রত দুই প্রকার- মেয়েলি ব্রত ও শাস্ত্রীয় ব্রত। মেয়েলি ব্রত আবার দুই প্রকার-কুমারী ব্রত ও নারী ব্রত। ড.শীলা বসাক আরো বিস্তৃত পরিসরে ব্রতের শ্রেনিবিভাগ করেছেন। তাঁর মতে প্রধানতঃ ব্রত দুই প্রকার- শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক ব্রত ও অশাস্ত্রীয় বা লৌকিক ব্রত। অশাস্ত্রীয় ব্রত তিন প্রকার-নারী ব্রত, পুরুষ ব্রত ও নারী-পুরুষ যৌথ ব্রত। নারী ব্রত আবার চার প্রকার-কুমারী ব্রত, সধবা ব্রত, বিধবা ব্রত ও যৌথ ব্রত (কুমারী-সধবা-বিধবা)।

ব্রতের উদ্দেশ্য, কামনা-বাসনা

ব্রত মূলতঃ সমবেতভাবে পালিত পার্বণ। ব্রতসমূহ লোকদেবতাবৃন্দের গুণ বর্ণনার পাশাপাশি সকলের মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্য নিয়ে পালিত হয়। ব্রতপার্বণ নারীনির্ভর হলেও তার প্রধান লক্ষ থাকে সকলের মঙ্গল কামনার ভেতর দিয়ে নারীর নিজের মঙ্গললাভ। ব্রত পালনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কাশীরাম দাস উল্লেখ করেছেনঃ
শুদ্ধচিত্তে ব্রত যেই করে আচরণ
সর্ব্ব দুঃখে তরে সেই পাপ বিমোচন।। - মহাভারত (শান্তিপর্ব)
ব্রতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কামনা জানিয়ে আল্পনায় আঁকা প্রতিকৃতিতে ফুলধরা এবং ব্রতকথা শোনা। এর মূল প্রেরণা সংসারে সুখ ও শান্তি কামনা। তবে ব্রত পালনের ত্রুটি হলে ব্রতীর অমঙ্গলও যে হতে পারে। তার নমুনা মেলে নারায়নদেবের পদ্মপুরাণ কাব্যে-

তুমি হেন অভাগিনী নাহি খিতি তলে।
অকালেতে রাড়ি হইল খণ্ডব্রত ফলে।।
কত খণ্ড ব্রত তুমি কৈলা গুরুতর।
সেহি দোষে ছাড়ি তোরে যায় লক্ষ্মিন্দর।।
উদ্দেশ্য ও প্রকৃতিভেদে ব্রতকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমত, বিশেষভাবে ব্যক্তিগঠনের জন্য পরিকল্পিত ও পালিত ব্রত। দ্বিতীয়ত, শান্তিময় পারিবারিক জীবন গঠনের জন্য পালিত ব্রত। তৃতীয়ত, গভীর আশ্বাস ও অভয় পাওয়ার জন্য পালিত ব্রত। চতুর্থত, প্রলোভন, স্বার্থবুদ্ধি ও ভোগ-আকাঙ্খাকে উপেক্ষা করে ত্যাগ ও সংযম শিক্ষার লক্ষ্যে পালিত ব্রত। পঞ্চমত, সামাজিক ও জাতীয় কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে নৈতিক প্রেরণা সঞ্চার করে এমন ব্রত। বাংলাদেশে বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষে পালিত কিছু ব্রতের উল্লেখ করা হলো-
১.সন্তানের মঙ্গলকামনা বিষয়ক - রূপসী ব্রত (সিলেট অঞ্জলে)
২.সঙ্কট বা বিপদমুক্তি বিষয়ক - আসনবিবি ব্রত, উদ্ধারবিবি ব্রত
৩.রোগমুক্তি বিষয়ক - ঝোলাবিবির শিরনি
৪.ধনসম্পদ বিষয়ক - লক্ষ্মী ব্রত
৫.বৃষ্টি-কামনা বিষয়ক - মেঘরাণীর ব্রত
৬.বন্যা,অতিবৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য পালিত - উদয়মঙ্গল ব্রত
৭.নৌকাডুবির হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের কামনায় পালিত - খোয়াজখিজির বা বেরাভাসান ব্রত
৮. জলচর পশুর আক্রমন হতে বাঁচার জন্য - কুমীরপূজা
৯. বাঘের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্য পালিত - দক্ষিণরায় বা কুলাই ঠাকুরের ব্রত
১০. বাস্তুভিটা ও বাস্তুভিটায় বসবাসকারী সকলের মঙ্গলের জন্য পালিত - বাস্তুবিবি ব্রত
১১. ঝড়-তুফান বা জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য - নৌকাপূজা ব্রত
১২. অগ্নি প্রতিরোধের জন্য - কোমাই ব্রত
১৩. ফল,শস্য ইত্যাদি নষ্ট না করার জন্য - কাউয়া মাগন ব্রত
১৪. শুভকাজ করার কামনায় - বরকরার ব্রত
১৫. ভৌতিক ভীতি দূরীবূত হওয়ার কামনায় পালিত - গাছের গুঁড়ি ব্রত

ব্রতের উপকরণ

ব্রত পালন করতে কিছু জিনিসের প্রয়োজন হয়। সেগুলোকে বলে ব্রতের উপকরণ বা উপচার। এসব উপকরণে নানা বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। ব্রত পালনের অপরিহার্য উপকরণের মধ্যে রয়েছেঃ ঘট, আম্রপল্লব, ফুল, দুর্বা, ধান্য, প্রদীপ, তুলসী, বেলপাতা, সিদ্ধি, হরিতকি, তিল, দধি, মধু, চিনি, ঘৃত, সশীষ ডাব, পঞ্চশস্য, পান, সুপারি, চাল, চালের গুড়া, ধানের শীষ বা ছড়া, কুলা, সিঁদুর, পিটুলি (আল্পনার জন্য), পাকাকলা, বস্ত্র (ধুতি বা শাড়ি), গামছা, ধূপ-ধূনা, ঘটি, সরা, থালা, মধুপর্কের বাটি, তামার টাট, গঙ্গাজল, আসন, পিঁড়ি, পুষ্পমালা, চাঁদমালা, ফলমূলের নৈবেদ্য, যজ্ঞকাঠ, পাটকাঠি, চন্দনকাঠ, বালি, দক্ষিণা ইত্যাদি।

ব্রতের নিয়মবিধি

ব্রত পালনকালে ব্রতীকে বেশ কিছু নিয়ম/ আচার পালন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রাতঃস্নান, শুচিবস্ত্র পরিধান, ব্রতাচার পালন, উপবাসী থাকা, আলপনা দেওয়া, ছড়া বলা, ব্রতকথা বলা বা শোনা। ব্রত পালনের পূর্বদিন নিরামিষ আহার গ্রহণ, সংযম পালন, উপবাসী থাকা, ফল-মিস্টান্ন, হরিষ্যান্ন, আংশিক আহার গ্রহণ ব্রতের অপরিহার্য নিয়ম। ব্রতবিশেষে এর কিছু ব্যতিক্রমও আছে।
ব্রতপালন শেষে ব্রতকথা শুনতে হয়। সাধারণত বর্ষীয়সী মহিলাগণ ব্রতকথা বলে থাকেন। ব্রতী বা ব্রতিনী দুর্বা, ফুল ইত্যাদি হাতে নিয়ে একাগ্রচিত্তে পবিত্র মনে ব্রতকথা শোনেন। ব্রতকথা শেষে বাঞ্ছিত বর কামনা করে ভক্তিভরে ব্রতের দেবতার উদ্দেশ্যে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেন।
শিবরাত্রি ছাড়া অন্যান্য ব্রত শুক্লপক্ষেই পালন করতে হয়। দিনানুগ ব্রতগুলির মধ্যে সংক্রান্তিনির্ভর ব্রতগুলি সৌরপঞ্জিকার ভিত্তিতে পালন করা হয়।

ব্রতের ছড়া

ব্রতের অন্যতম অঙ্গ হলো ছড়া। ব্রতের ছড়াগুলোতে নারীমনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। মেয়েলি ব্রতের ছড়া প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন,'ইহাদের মধ্য দিয়া বাংলা ছড়ার আর একটি বৈচিত্র্য প্রকাশ পাইয়াছে। যদিও অলৌকিক বিশ্বাস হইতেই ব্রতের ছড়াগুলির উৎপত্তি হইয়াছিল, তথাপি এইকথা সত্য যে ব্রতিনীদিগের কোন অলৌকিক লক্ষ্য ইহাদিগের মধ্য দিয়া দৃষ্টিগোচর হয় না।’ এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,'ব্রতের ছড়াগুলি যেখানে ছোটো-ছোটো যাত্রার পালার মতো গাঁথা হয়েছে, সেখানে নাট্য নৃত্য ও গীত-কলার যথেষ্ট অবসর রয়েছে দেখি।’
নারীদের লৌকিক ব্রতগুলিতে নারীরাই সকল ভূমিকা পালন করেন, সেখানে পুরহিতদের কোন স্থান নেই। সেই ব্রতগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছড়া। এই সব ছড়াই নারীর নিজস্ব ব্রত অনুষ্ঠানের মন্ত্রস্বরূপ। বাংলাদেশে প্রচলিত কিছু ছড়া এখানে তুলে ধরা হলোঃ
১.সুবচনী ব্রতঃ
দেওয়ায় করে মেঘ মেঘালি
তলাত্ পূবাল বাও।
ভর্ আঙিনাত পূজা করে,
সুবচনীর মাও।
যে কোন শুভকাজ করার আগে যে কোন সময় এই ব্রত পালিত হয়।
২. গাড়শী ব্রতঃ
পোকা মাকড় দূরে যায়,
লক্ষ্মী ঠাকুরানী ঘরে আয়।
এটি অলক্ষ্মী বিদায়ের ব্রত। আশ্বিন মাসে পালিত হয়।
৩. থুয়া ব্রতঃ
থুয়া থোয়ান্তি
ঘরে দাও সোয়ান্তি।
কড়া কড়া ভাতে
গরপড়া বেয়ন্নে কাল পুতে।
অগ্রহায়ণ মাসে ধন-ঐশ্বর্য ও সুখের কামনায় এই ব্রত পালন করা হয়।
৪. মাঘমণ্ডল ব্রতঃ
উঠ উঠ সূর্য ঠাকুর ঝিকি মিকি দিয়া,
তোমাকে পূজি আমি জবা ফুল দিয়া,
তোমাকে পূজি আমি দনাই মনাই দিয়া। ..
সুপতি লাভ, পিতা-ভ্রাতা ও সাংসারিক মঙ্গলকামনায় মাঘ মাসে ব্রতটি পালন করা হয়।
৫. ফাগুনকুণা ব্রতঃ
ফাগুণকুণা গুণফাগুণা
গুণনিধি ছৈল (ছোল) গুয়া (সুপারি) লইল পান,
উঠানে ফাগুণকুণা
খাটালে (পিছন দরজা) খাট। ...
পিতা, শ্বশুর ও নিজের সংসারের মঙ্গলকামনায় ফাল্গুন মাসে এই ব্রতটি পালিত হয়।

লোককথা, ব্রতকথা

লোককথা লোকসাহিত্যের এক সমৃদ্ধ অঙ্গ। মুখে মুখে প্রচলিত বিভিন্ন ধরণের গল্প শ্রুতি-পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে। একই গল্প একটু ভিন্নতা নিয়ে নানা দেশে প্রচলিত হতে পারে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ গল্পের এ ধরণের রূপান্তর নিয়ে কৌতুহলোদ্দীপক প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি এবং ড.সৈয়দ মুজতবা আলী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রচলিত লোকসাহিত্য গুণেমানে বিশ্বের সর্বোত্তম সাহিত্যকৃতির অন্তর্গত। লোককথাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ রূপকথা, পশুকথা, পরীকথা, কিংবদন্তী, ব্রতকথা, লোকপুরাণ, গীতি কাহিনী। এসব লোককথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অন্যায়ের, পাপের অনিবার্য পরিণতি ভোগ করতেই হবে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামাল দিয়ে শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের জয় হবেই।
ব্রতকথার গল্পের সাথে বিশ্বাস ও সংস্কারের যোগ অতিনিবিড়। কিছু কিছু ব্রতকথায় দেবমহিমা বর্ণিত হয়। এতে থাকে মানুষের কামনা এবং কামনাপূরণের আশায় কৃচ্ছ্রসাধন। ব্রতকথার শেষাংশে থাকে নায়ক বা নায়িকার বিপদমুক্তি ও দৈবকৃপালাভের বর্ণনা। ব্রতকথা আমাদের লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ ও একান্ত নিজস্ব সম্পদ। ব্রতকথায় নারীদের ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কার মিলেমিশে আছে। এগুলো ব্রতের অপরিহার্য অঙ্গ। ব্রতকথার কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায। যেমনঃ ক. দেবমহিমার প্রচার ও দেবমহিমার প্রাধান্য, খ. অপরিবর্তনশীলতা, গ. নারীজাতির সহ্যশক্তি, ঘ. সেবাপরায়নতার প্রকাশ, ঙ. নারীজাতির কথকতাশক্তির প্রকাশ, চ. গদ্যছন্দের প্রকাশ, ছ. জননীর বাৎসল্যরসের প্রকাশ, জ. ব্রতের মাহাত্ম্য প্রচারে নারীজাতির ভূমিকা পালন ইত্যাদি। ব্রতকথায় কতগুলি সাধারণ অভিপ্রায় লক্ষ করা যায়। ব্রতকথায় দেবতার দয়া বা নিগ্রহ বর্ণিত হয়। ব্রতী বা ব্রতিনী ব্রত পালন করে দেবতার কৃপায় সুখশান্তি লাভ করেন, ব্রত পালনের অবহেলা হলে দেবতার হাতে নিগৃহীত হয়ে চরম দুঃখদুর্দশায় পতিত হতে হয়।

ব্রতের সংখ্যা

ফোকলোর গবেষক মোহাম্মদ সাইদুর ব্রতের সাথে ব্যবহৃত সংখ্যার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেন। ব্রতী বা ব্রতিনীর কাছে কোন সংখ্যা কী অর্থ বহন করে তিনি তার একটি তালিকা প্রণয়র করেছেন-
১ সংখ্যা- ব্রক্ষ্ম বা পরমাত্মা। ব্রক্ষ্ম বা পরমাত্মার কোন ক্ষরণ নেই, তিনি অদ্বিতীয়। এ কারণে তিনি ১ সংখ্যার প্রতীক বিবেচিত হয়েছেন। পৃথিবীও ১ সংখ্যার বোধক।
২ সংখ্যা-চোখ (দু’টি)
৩ সংখ্যা-অগ্নি (উৎপত্তি বা গুণভেদে অগ্নি ৩ সংখ্যা নির্দেশ করে) এবং ত্রিনাথ (ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর)
৫ সংখ্যা-পঞ্চকন্যা বা সতী (অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দোদরী এই পাঁচ জন পঞ্চকন্যা নামে পরিচিতা), পঞ্চপা-ব (যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব), পাঁচ আঙুল।
৭ সংখ্যা-সমুদ্র

প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্যে ব্রতের উল্লেখ

প্রাচীন যুগ থেকেই যে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে ব্রত পালনের রীতি চলে আসছে তার প্রমান মেলে প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানা কাব্যে। মঙ্গলকাব্যসহ অন্যান্য কাব্যে বিভিন্ন ব্রতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রত পালনের রীতি, ব্রত ভঙ্গ করার ফল, প্রজাদের ব্রত পালনের জন্য রাজা বা জমিদার কর্তৃক বল প্রয়োগ ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে কাব্যগুলোতে। ড. দীনেশচন্দ্র সেন কর্তৃক সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন পালায় মনসা ব্রতের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ
১. শায়ন মাসেতে লোকে পূজে মনসা। - মলুয়ার পালা।
২. কিসের ঢাক কিসের ঢোল কিসের বাদ্য বাজে।
শায়ানা সংক্রান্তে রাজা মনসারে পূজে।। - কমলা পালা
৩.শায়ন মাসেতে দূতি পূজিলা মনসা।
সেইতে না পূরিল গো আমার মনের আশা।। - দেওয়ানভাবনা পালা।
ড. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত পূর্ববঙ্গ গীতিকায়ও মনসা ব্রতের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে ব্রত পালনের বিস্তারিত বিবরণও পাওয়া যায়ঃ
শাওন বাওন মাস আখাল পাখাল পানি।
মনসা পূজিতে কন্যা হইল উৎযোগিনী।।
কান্দিয়া বসাইল ঘট আপনার গিরে।
প্রাণপতি ঘরে আইসে মনসার বরে।।
চাচার চিক্কণ কেশে গিরটি মাঞ্জিল।
নূতন পিটালি দিয়া আলিপনা দিল।।
পঞ্চনাগ আঁকে কন্যা শিরের উপরে।
মনসা দেবীরে আঁকে অতি ভক্তি ভরে।।
শির নোয়াইয়া করে শতেক প্রণতি।
বর দাও মনসা গো ঘরে আইওক পতি।। - বাগুলার বারমাসি।
লক্ষ্মী হচ্ছেন ঐশ্বর্যের দেবী। শাস্ত্রীয় বচন অনুসারে ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্র মাসে শক্লপক্ষে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজা করলে অভীষ্ট ফল লাভ হয়। অন্য দিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পৌষ মাসে নারীরা লক্ষ্মী ব্রত পালন করেন। লক্ষ্মী ব্রতে আলপনা অঙ্কনে এ দেশের নারীদের দক্ষতা সুবিদিত। ড. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত পূর্ববঙ্গ গীতিকায় লক্ষ্মী ব্রতের আলপনা আঁকার কৌশল তুলে ধরা হয়েছেঃ
উত্তম সাইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া।
ধুইয়া মুছিয়া কন্যা লইল বাটিয়া।।
পিটালি করিয়া কন্যা পরথমে আঁকিল।
বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল।।
জোরা টাইল আঁকে কন্যা আর ধানছড়া।
মাঝে মাঝে আঁকে কন্যা গিরলক্ষ্মীর পারা।।
শিব-দূর্গা আঁকে কন্যা কৈলাসভবন।
পদ্মপত্রে আঁকে কন্যা লক্ষ্মীনারায়ন।।
-----------------------------------
আলিপনা আঁকিয়া কন্যা জ্বালে ঘিরতের বাতি।
ভূমিতে লুটাইয়া কন্যা করিল প্রণতি।। - কাজলরেখা পালা
মৈমনসিংহ গীতিকায় সন্তান কামনায় কার্তিক মাসে কার্তিক ব্রত পালনের কথা উল্লেখ করা হয়েছেঃ
ক. কার্তিক মাসে কার্তিক বরত পুত্রের লাগিয়া। -মহুয়া পালা
খ. কার্তিক মাসেতে †দখ কার্তিকের পূজা।
পরদিমের ঘট আকি বাতির করে সাজা।।
সারারাত্রি হুলামেলা গীত বাদ্যি বাজে।
কুলের কামিনী যত অবতরঙ্গে সাজে।। - কমলা পালা

বাংলাদেশে প্রচলিত ব্রতসমূহ

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ব্রতের মধ্যে আঞ্চলিক বা জেলাভিত্তিক পার্থক্য বিদ্যমান। একই ব্রত বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নামেও প্রচলিত আছে। কিছু ব্রত আছে নির্দিষ্ট মাসে নির্দিষ্ট তিথিতে পালিত হয়, কিছু ব্রত আছে কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। নানা উপলক্ষে পালিত ব্রতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ-
১. ছয় ষষ্ঠী ব্রত - আঁতুড়ঘরে ৬ দিন দিবাগত রাতে পালনীয়।
২. সুমতি ব্রত - বছরের যে কোনো সময় সোম বা শুক্রবারে পালিত হয়।
৩. কল্কিনারায়ণ ব্রত - যে কোনো শনি বা মঙ্গলবার পালন করা হয়।
৪. সন্তোষী মাতার ব্রত - মানসিক করে ১৬টি শুক্রবারে পালন করা হয়।
৫. জ্বরাজ্বরি ব্রত - জ্বরের হাত থেকে সুস্থ্য হওয়ার কামনায় ব্রতটি পালন করা হয়।
৬. মঙ্গলচণ্ডী ব্রত - সংসারের সর্বমঙ্গলকামনায় যে কোনো মঙ্গলবার পালিত হয়।
৭. বিপদনাশিনী বা তারিণী ব্রত - শনি বা মঙ্গলবারে পালন করা হয়।
৮. সত্যনারায়ণ ব্রত - শনিবার কৃষ্ণপক্ষে অথবা পঞ্জিকামতে বৈশাখ, আষাঢ ও মাঘ মাসে পালিত হয়।
৯. শনি ব্রত - শনিবার কৃষ্ণপক্ষে অথবা পঞ্জিকামতে বৈশাখ, আষাঢ় ও মাঘ মাসে পালিত হয়।
১০. বনদূর্গা/গাছের গোড়ার ব্রত - অশৌচ ওঠাতে বা বিয়ে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি শুভকাজের পূর্বে পালন করা হয়।
১২. মহালয়া ব্রত - নিমগাছের নিচে পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তিকামনায় পালিত হয়।
১৩. সুবচনী ব্রত - শনি বা মঙ্গলবারে পালিত হয়।
১৪. কামাক্ষা ব্রত - শনি বা মঙ্গলবারে পালিত হয়।
১৫. বরকুমার ব্রত বা বরকরার ব্রত - যে কোনো শুভকাজের পূর্বে পালন করা হয়।
১৬. ঘাটকালী ব্রত - শনি বা মঙ্গলবারে বিপদমুক্তির কামনায় পালিত হয়।
১৭. বৈদ্যনাথ ব্রত - সোমবারে পালিত হয়।
১৮. সঙ্কটতারিণী ব্রত - মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার, শনিবার এবং রবিবার পালিত হয়।
১৯. রূপসী ব্রত - সন্তানের মঙ্গলকামনায় পালন করা হয়।
২০.মাদার বাঁশের জারী ব্রত - অগ্নির হাত থেকে রক্ষার পাবার জন্য পালন করা হয়।
২১. কাক ব্রত বা কাউয়া ব্রত - কোন পাখি বা জীব কর্তৃক ফসল নষ্ট করা থেকে রক্ষা পাবার জন্য পালন করা হয়।
২২. বসন্ত ব্রত - বসন্ত রোগ থেকে রক্ষা পাবার জন্য পালন করা হয়।
২৩. ইয়াতলি ব্রত - খোস-পাঁচড়া অর্থাৎ চর্মরোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য পালন করা হয়।
২৪. ঝলকা ব্রত - ওলাওঠার হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের কামনায় পালিত হয়।
২৫. মাঘমণ্ডল ব্রত - সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে পালিত ব্রত।
২৬. বাঘাই ব্রত - বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য পালিত ব্রত।
উপর্যুক্ত ব্রতগুলি ছাড়াও বিভিন্ন মাসের বিভিন্ন তারিখ বা তিথিতে কিছু ব্রত পালিত হয়। মাস অনুসারে বাংলাদেশে পালিত ব্রতগুলো হচ্ছেঃ-
বৈশাখ মাস
১.বিষ্ণুপূজা ও হালখাতা - বাংলা নববর্ষে পালনীয়।
২.অক্ষয়তৃতীয়া ব্রত - শুক্লা তৃতীয়াতে পালিত হয়।
৩. হরিষমঙ্গলচণ্ডী - মঙ্গলবারে পালিত হয়।
৪. সঙ্কটা ব্রত - শুক্রবারে পালিত হয়।
জ্যৈষ্ঠ মাস
১.জামাইষষ্ঠী / অরণ্যষষ্ঠী - যাদের জামাতা আছে তেমন নারীরা শুক্লা ষষ্ঠীতে এই ব্রত পালন করেন।
২.করমাদি / কর্মপুরুষের ব্রত - জ্যৈষ্ঠের সংক্রান্তি দিনে পুরুষরা এই ব্রত পালন করেন।
৩.সাবিত্রী ব্রত - কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি †থকে শুরু করে অমাবস্যা পর্যন্ত পালন করা হয়।
আষাঢ় মাস
১.রথ ব্রত বা রথাইচণ্ডী - আষাঢ় মাসে রথ যাত্রার দিন পালিত হয়।
২.অম্বুবাচী ব্রত - আষাঢ় মাসের ৭ তারিখে শুরু করে তিনদিন অম্বুবাচী ব্রত পালিত হয়।
শ্রাবণ মাস
১.শ্রাবণী ব্রত (মনসা ও নাগপূজা) - শ্রাবণের সংক্রান্তি দিনে পালিত হয়।
২.নাগপঞ্চমী ব্রত - কৃষ্ণা পঞ্চমীতে পালিত হয় নাগপঞ্চমী ব্রত।
৩.বিষহরি ব্রত - শ্রাবণসংক্রান্তিতে সিলেট অঞ্চলে পালিত হয় বিষহরি ব্রত।
৪.সঙ্কটা ব্রত - শুক্রবারে এই ব্রত পালিত হয়।
ভাদ্র মাস
১.জন্মাষ্টমী ব্রত - ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমীতে এই ব্রত পালন করা হয়।
২.আলেরী ব্রত - ভাদ্র মাসের যে কোনো শুক্রবার রাতে পালন করা হয়।
৩.সিদ্ধেশ্বরী ব্রত - ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের রবিবার বা বৃহস্পতিবার রাতে পালন করা হয়।
৪.কানুপীর / কানুভাইয়ের ব্রত - ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষে রবিবার কিংবা বৃহস্পতিবার বিপদমুক্তির জন্য এই সৌভাগ্যসূচক ব্রতটি পালন করা হয়।
৪.অনন্ত ব্রত ও কর্মাদিত্যের ব্রত - ভাদ্র মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে এই দু’টি ব্রত পালন করা হয়।
৫.দুর্বাষ্টমী ও রাধাষ্টমী ব্রত - ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে এই ব্রত দু’টি পালিত হয়।
৬.ভদ্রচণ্ডী ব্রত - ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে ভদ্রচণ্ডী ব্রত পালন করা হয়।
আশ্বিন মাস
১.গারসী / গাড়ই ব্রত - আশ্বিনের সংক্রান্তির দিনে ব্রতটি পালিত হয়।
২.নিয়মসেবা ব্রত - আশ্বিনের একাদশী তিথি থেকে কার্তিকের একাদশী তিথি পর্যন্ত, মতান্তরে পুরো কার্তিক মাস বৈষ্ণবরা এই ব্রত পালন করেন।
৩.বীরাষ্টমী ব্রত - দূর্গাপূজার অষ্টমীতে বীরাষ্টমী ব্রত পালন করা হয়।
৪.লক্ষ্মী ব্রত - কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমাতে এই ব্রতটি পালিত হয়।
৫.ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ব্রত - শুক্লা দ্বিতীয়াতে পালিত হয় এই ব্রত।
৬.আট আনাজ ব্রত - ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয় আট আনাজ ব্রত।
কার্তিক মাস
১.পাঁচকুমার ব্রত - কার্তিক মাসের ১ তারিখে ময়মনসিংহ এলাকায় এই ব্রত পালিত হয়।
২.নিয়মসেবা ব্রত - বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা আশ্বিনের একাদশী থেকে যে ব্রত পালন শুরু করেন তা কার্তিকের একাদশী মতান্তরে পুরো কার্তিক মাস জুড়ে এই ব্রত পালন করেন।
৩.কার্তিকপূজা ব্রত / কার্তিক ব্রত - কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে সন্তানের মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালিত হয়।
৪.গোষ্ঠাষ্টমী ব্রত - কার্তিক মাসের শুক্লা অষ্টমীতে এই ব্রত পালিত হয়।
৫.সঙ্কটা ব্রত - শুকবারে এই ব্রত পালন করা হয়।
অগ্রহায়ণ মাস
১.ক্ষেত্র ব্রত - অগ্রহায়ণে নতুন ধানের চাল দিয়ে এই ব্রত পালন করা হয়।
২.নবান্ন ব্রত (লক্ষ্মী ব্রত) - অগ্রহায়ণ মাসে, সাধারণত পূর্ণিমার দিন নতুন ধানের চাল দিয়ে পোকা না ধরার কামনায় এই ব্রত পালন করা হয়।
৩.সূর্য ব্রত - অগ্রহায়ণে নতুন ধানের চাল দিয়ে এই ব্রত পালিত হয়। এই ব্রতে ব্রতী কোন চালার নিচে যান না।
৪. কুলকর মঙ্গলচ-ী ব্রত - অগ্রহায়ণ মাসের যে কোনো মঙ্গলবার এই ব্রত পালন করা হয়।
পৌষ মাস
১.বাস্তুপূজা ব্রত - পৌষপার্বণে এই ব্রত পালন করা হয়।
২.হেঁচড়া ব্রত - পৌষ মাসের ১ তারিখে কুলগাছ পুঁতে ব্রতটি পালন করা হয়।
৩. পৌষ আগলানো / পৌষপার্বন ব্রত - পৌষ সংক্রান্তিতে পালিত হয় এই ব্রত।
মাঘ মাস
১.পুনাই ব্রত / মাঘীপূর্ণিমা ব্রত - মাঘ মাসে পূর্ণিমা তিথিতে সংসারে সুখ-শান্তি কামনায় সধবা নারীরা এই ব্রত পালন করেন।
২.মাঘ ব্রত - মাঘ মাসের যে কোনো সময় পালিত হয়।
৩.শীতলষষ্ঠী ব্রত - মাঘ মাসের শুক্লা অষ্টমীতে এই ব্রত পালিত হয়।
৪.শ্রীপঞ্চমী ব্রত - মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমীতে এই ব্রত পালিত হয়।
৫.সূর্য ব্রত / কালাঠাকুরের ব্রত - মাঘ মাসের যে কোনো রবিবারে এই ব্রত পালিত হয়।
৬.সঙ্কটা ব্রত - শুক্রবারে এই ব্রত পালিত হয়।
ফাল্গুন মাস
১.শিবরাত্রি ব্রত - ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে এই ব্রত পালিত হয়।
চৈত্র মাস
১.বসন্তা ব্রত - চৈত্র মাসের শনি / মঙ্গলবার সব মেয়ে এই ব্রত পালন করেন।
২.চৈত্র সংক্রান্তি ব্রত - চৈত্র মাসের শেষ দিনে পালিত হয় এই ব্রত।
৩.শিবরাত্রি ব্রত - চৈত্র মাসে এই ব্রত পালিত হয়।
৪.গো-ব্রত বা গোরক্ষনাথ সেবা - চৈত্র সংক্রান্তিতে পুরুষরা গবাদি পশুর মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন করেন।
৫.পাঁচকুমার ব্রত - চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয়।
৬.রামনবমী ব্রত - চৈত্র মাসের শুক্লা নবমীতে রামনবমী ব্রত পালিত হয়।
৬.শিব ব্রত - চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন সন্ন্যাসীরা এই ব্রত পালন করেন।

শাস্ত্রীয় ব্রত

শাস্ত্রীয় ব্রতে পুরোহিতের মধ্যস্থতায় সংস্কৃতে শ্লোক উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে প্রার্থনা শুরু করা হয়। শাস্ত্রীয় ব্রতে স্বস্তিবাচন, কর্মারম্ভ, সঙ্কল্প, ঘটস্থাপন, পঞ্চগব্য শোধন, শান্তিমন্ত্র ইত্যাদি উচ্চারণ ও স্থাপনকরা হয়। এরপরে ভুজ্জি (ভোজ্য) উৎসর্গ ও ব্রাক্ষ্মণকে দক্ষিণা দেওয়া হয়। শাস্ত্রীয় ব্রতে আর্য ঋষিরা যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিয়ে দেবতার স্তব ও প্রার্থনা করতেন-ধন, জ্ঞান, অন্ন, আয়ু, সুখ ও সমৃদ্ধির। শাস্ত্রীয় ব্রতের মধ্যে কয়েকটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-
ধর্মঘট ব্রতঃ প্রতিষ্ঠাকালে ব্রাক্ষ্মণকে সদক্ষিণা ভোজ্য দান। ব্রতের ফল-দীর্ঘায়ু, ঐশ্বর্য ও অচলা স্ত্রী লাভ, দেহাবসানে বিষ্ণুলোক প্রাপ্তি।
ফলসংক্রান্তি ব্রতঃ মাসে মাসে ব্রাক্ষ্মণকে ফল দান করলে বিভিন্ন ফললাভ হয়। শেষে ব্রাক্ষ্মণ ভোজন করিয়ে স্বর্ণ দান করতে হয়। ব্রতের ফল- দেহান্তে বিষ্ণুলোক লাভ।
তালনবমী ব্রতঃ এই ব্রতে তালফল দান করাই প্রধান কাজ। খর্জুর, নারিকেল, রম্ভা দাড়িম্ব দেওয়া উত্তম। তারপর ব্রাক্ষ্মণ ও স্বামীকে পিষ্টক ভোজন করিয়ে নিজে খেতে হয়। ব্রতের ফল-লক্ষ্মী অচলা থাকেন, কদাচ বৈধব্য হয় না, ধনধান্যপুত্রলাভে সুখ হয়, স্বর্গবাস সুনিশ্চিত।
ষোলকলা ব্রতঃ চৈত্রসংক্রান্তিতে এই ব্রত আরম্ভ করে পরে প্রতি মাসের সংক্রান্তিতে একজন ব্রাক্ষ্মণকে ষোলটি কলার একটি ছড়া দিতে হয়। শেষ অর্থাৎ দ্বাদশ সংক্রান্তিতে দ্বাদশজন ব্রাক্ষ্মণকে এই রকম কলার ছড়া দিয়ে, ভোজন করিয়ে দক্ষিণা দিতে হয়। ধনীরা সোনা বা রূপা দিয়ে কলার ছড়া গড়িয়ে দান করতে পারলে উত্তম। ব্রতের ফল-ধনৈশ্বর্য ব্রদ্ধির সীমা থাকবে না।
ব্রাক্ষ্মণ ব্রতঃ মহাবিষুব সংক্রান্তিতে ব্রত আরম্ভ করে সমস্ত বৈশাখ মাস প্রতিদিন একজন ব্রাক্ষ্মণকে পরিতোষরূপে ভোজন করিয়ে দক্ষিণা দিতে হয়। চার বছরে এই ব্রত শেষ হয়। যাঁকে দিয়ে ব্রত আরম্ভ করা হয় সেই ব্রাক্ষ্মণকে দিয়েই শেষ করতে হয়। সমাপন কালে ব্রাক্ষ্মণকে বস্ত্র, অলংকার, পাদুকা, ছাতা প্রভৃতি দান করে, পর্যাপ্ত ভোজন করিয়ে দক্ষিণা দিতে হয়।
কালিপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত ’ব্রতকথা’ এবং বীরেশ্বর কাব্যতীর্থ সম্পাদিত ’ব্রতমালাবিধান’ গ্রন্থদ্বয়ে উপরে বর্ণিত শাস্ত্রীয় ব্রতগুলিসহ আরো শাস্ত্রীয় ব্রতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য কিছু শাস্ত্রীয় ব্রতকে বলছেন,’ব্রাক্ষ্মণদের মনগড়া ব্রত’। এ ধরণের ব্রতের মধ্যে তিনি দধিসংক্রান্তি, কলাছড়া, গুপ্তধন, ঘৃতসংক্রান্তি, ধনগছানো প্রভৃতি ব্রতের উল্লেখ করেছেন। বিনয় ঘোষের মতে, ’বস্তুত শাস্ত্রীয় ব্রতের অধিকাংশই লৌকিক ব্রতের রূপান্তর বা গোত্রান্তর। অনেক শাস্ত্রীয় ব্রত অবশ্য লৌকিক ব্রতের অনুকরণে ব্রাক্ষ্মণদের নিজেদের উদ্ভাবিত। রূপান্তর ও উদ্ভাবন দুইই যে ব্রাক্ষ্মণশ্রেণী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই।’

মুসলিম ব্রত

সাধারণত মুসলমানদের মধ্যে ব্রত পালনের প্রচলন নেই। তবে ধর্মান্তরিত মুসলিমরা কিছু ব্রত পালন করেন। গবেষক ড. মোমেন চৌধুরীর মতে, প্রকৃতপক্ষে কোন মুসলিম ব্রত নেই। তবে উদ্দেশ্য একই হলে ব্রত পালন করে থাকে। ফোকলোর গবেষক মোহাম্মদ সাইদুরের মতে, প্রকৃত মুসলিম ব্রত হলো খোয়াজপীরের ব্রত। মুসলিমদের মধ্যে যারা কবিরাজ বা লোক-চিকিৎসক তাদের পরিবারের মধ্যে সেটা সীমাবদ্ধ। কোনো কোনো নিম্নশ্রেণির মুসলিম পরিবারে ব্রতের প্রচলন দেখা যায়।
কোনো এলাকায় হারানো জিনিস খুঁজে পাবার আশায় মুসলিম নারীরা হাজিরপীর ব্রত পালন করে থাকেন। এই ব্রতে উপকরণ হিসাবে পান, সুপারি ও বাতাসা ব্যবহৃত হয়। কিশোরগঞ্জ এলাকায় হিন্দু ও মুসলিমরা যৌথভাবে আসনপীরের ব্রত, কানুপীর ব্রত ও গাওয়াপীর ব্রত পালন করে থাকেন।

সমাপনী

ব্রত পালনকারী অন্যান্য দেশ বা প্রদেশের ন্যায় বাংলাদেশেও অঞ্চলভেদে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সে পার্থক্য হতে পারে নামের বা ব্রতাচারের। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কিশোরগঞ্জের বত্রিশ গ্রামে পালিত গাড়শী ব্রত অন্য অঞ্চলে যমপুকুর ব্রত নামে পরিচিত। এছাড়া বাংলাদেশে কেবল পুরুষরা পালন করেন কল্কিনারায়ণ ব্রত আর কর্মপুরুষের ব্রত; শুধু বিধবারা পালন করেন অম্বুচারী ব্রত; নারী ও পুরুষ উভয়ে পালন করেন শিবচতুর্দশী, একাদশী, জন্মাষ্টমী, বৈদ্যনাথ ও শনি ব্রত।
বাংলাদেশে প্রচলিত ব্রতগুলির মধ্যে কোনো কোনো ব্রতাচারে মেয়েরা গীত সহযোগে ধামাইল নাচ করে থাকেন। কিছু ব্রতের মধ্যে উর্বরতা সম্পর্কিত যাদুবিশ্বাস লক্ষ করা যায় (যেমন, সূর্য ব্রত)। কিছু ব্রতের মধ্যে আদিম সমাজের উপাসনারীতির প্রভাব দেখা যায় (মাঘমণ্ডল ব্রত)। কিছু ব্রতের মধ্যে বৃক্ষপূজার রীতি চোখে পড়ে (রূপসী ব্রত)।
লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ড.আশরাফ সিদ্দিকীর মতে, ব্রত প্রাক্-হিন্দু, প্রাক্-বৌদ্ধ যুগের আগে থেকেই চলে আসছে। প্রথমে আর্যশক্তি ও অনার্যশক্তির সংমিশ্রণ হয়েছে। অনার্যদের পরে বৌদ্ধদের সাথে সংমিশ্রণ ঘটেছে। লাউল হলেন বৌদ্ধদের সাহায্যকারী দেবতা এবং থুয়া হলেন বৌদ্ধদের দেবতা। এঁদের প্রভাব ব্রতের মধ্যে আছে। সন্তানের জন্মের সময় থেকেই মানুষের জীবনে প্রথম ব্রতের শুরু হয়। এর পর অন্নপ্রাশন, বিয়ে, সমুদ্রযাত্রা,যুদ্ধযাত্রাসহ সমগ্রজীবনে ব্রত আছে।
ড.ওয়াকিল আহমদের মতে, ব্রতগুলো ফোকলোরের একটি জীবন্ত ও প্রাচুর্যপূর্ণ উপাদান। ব্রতকথা, ব্রতছড়া বা গান, ব্রত-আলপনা, ব্রতাচার, ব্রতের দেব-দেবী ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত আছে। ব্রত মুখ্যত নারীসমাজের বিষয়। এর সাথে শাস্ত্রধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। প্রায় সবটাই লৌকিক ব্যাপার। ব্রতগুলো বেশ প্রাচীন; আংশিকভাবে অরণ্য ও পরিপূর্ণভাবে কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।
সবশেষে বলা যায়, আদিম সমাজ, কৃষি সমাজ এমনকি শিকার যুগের নানা উপকরণের মিশেলে ব্রতপার্বণ বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সোনালী স্মারক, লোক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ উপাদান। কালের করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করে, পাশ্চাত্য প্রভাবিত আধুনিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো টিকে আছে। টিকে থাকবে অনেকদিন।

দোহাই

বাংলার ব্রতপার্বণ-ড.শীলা বসাক
বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব-বিনয়ঘোষ
বাংলার ব্রত-অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)-ড.নীহাররঞ্জন রায়
বাঙালির সংস্কৃতি ও আদিবাসী ঐতিহ্য-সুহৃদ কুমার ভৌমিক
বাংলার লোকসাহিত্য-আশুতোষ ভট্টাচার্য
বাংলার লোকসংস্কৃতি-ড.ওয়াকিল আহমদ

সাহিত্য শিল্পের ত্রৈমাসিক 'প্রতিকথা'র বর্ষ ৬, সংখ্যা ৯, ফেব্রুয়ারি ২০১৯ - এ প্রকাশিত

মন্তব্য ১৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: এগুলো কি ব্রত না কুসংস্কার??

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২৩

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: ধর্মের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও এর সাথে ধর্মীয় আবেগ জড়িয়ে আছে। এগুলোকে লোকাচার বলতে পারেন। পৃথিবীর প্রায় সব প্রাচীন মানবগোষ্ঠীতে এ ধরণের লোকাচার পাবেন। একে আপনি বড়োজোার সংস্কার বলতে পারেন। পাঠের জন্য, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১৭

সোনালী ডানার চিল বলেছেন: আপনার অন্যান্য যেকোন লেখার মতোই, তথ্যবহুল, আলোচ্য-
অনেকদিন পর সবাইকে ব্লগে দেখে ভালো লাগছে!
শুভেচ্ছা রইল!

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪৩

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: আপনাকেও অনেকদিন পর পেয়ে ভালো লাগছে। ব্লগকে কেন্দ্র করে আমাদের মিলনমেলা আবার জমে উঠবে আশা করি। ভালো থাকবেন।

৩| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৫

পুকু বলেছেন: দারুণ এবং তথ্যবহুল!!!!

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪৫

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৪| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:১৬

সেলিম আনোয়ার বলেছেন: ব্রতের উপকরণের যে সুদীর্ঘ তালিকা আপনি দিলেন তাহাতে মাথা ঘুরিয়া গেল ।ওরে বাপরে । পরিশ্রমী পোস্ট দীর্ঘদিন পর। পোস্টে + ।

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৩৬

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: কি যে বলেন ! কেমন আছেন ? শুভেচ্ছা নিরন্তর।

৫| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:২১

জুল ভার্ন বলেছেন: অনেক তথ্যবহুল পরিশ্রমী লেখা ভালো লেগেছে।

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:২৪

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। অনেকদিন পর আপনার সাড়া পেলাম।

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫০

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: ভাইয়া আপনার নতুন ফোন নং দেবেন দয়া করে।

৬| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৩৩

সুনীল সমুদ্র বলেছেন: কি অসাধারণ দুর্দান্ত পরিশ্রমী এক লেখা ! গবেষণামূলক জার্নালে প্রকাশ করার মতো- কৌতুহল জাগানো অজানা সব তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে এই লেখায় !

এমন কষ্টসাধ্য পরিশ্রমী এক লেখার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:০৩

এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন সব সময়।
জবাব দিতে দেরি করার জন্য ক্ষমা করবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.