নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনেক কিছুরই সাধ আছে কিন্তু সাধ্য যে নাই..........

মিঠুন_বিশ্বাস_রানা

সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই.............

মিঠুন_বিশ্বাস_রানা › বিস্তারিত পোস্টঃ

CCU BED-009

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:১১



CCU BED-009

সময়টা, ২০১৭ সা‌লের ঈদুল আযাহা এর আ‌গের দিন।ঢাকা মে‌ডি‌কেল বিশ্ব‌বিদ্যালয় এর CCU তে (Cardiac/Coronary Care Unit ) আজ আমার দ্বিতীয়‌দিন !

CCU !

এর সা‌থে আ‌গে কোন প‌রিচয় ছিল না ‌কোনকা‌লেই। তাই বিশাল সংশয় ও ভয় ছিল ম‌নে! ত‌বে আর দশটা হাসপাতা‌লের ম‌তো নয় অবশ্য এই ঢা‌মেক এর CCU!

তা প্রথম দুই‌দি‌নে বেশ টের পেলাম।

এখা‌নে রুগীর সা‌থে এ‌টেন‌ডেন্ট থাক‌তে পা‌রে! অবা‌ধে যে‌কোন সময় ভিত‌রে যাওয়া আসা করা যায়! রুগীর পা‌শে ব‌সে খাওয়া দাওয়া ফো‌নে কথা বলা, সবই করা যায় আর কি ! ত‌বে একটা বিষয় কিন্তু বেশ , তা হ‌লো সর্বদাই ডাক্তার ও নার্স রা একদম সাম‌নেই থা‌কে ব‌সে। বল‌তে গে‌লে ২৪ ঘন্টাই তারা থা‌কে পা‌শে, এখা‌নেই হয়ত এই CCU এর সার্থকতা।

নারী পুরুষ সব এক যায়গায় একই কাতা‌রে ‌থে‌কে চি‌কিৎসা সেবা নি‌চ্ছে। ১৮ টি বেড সব গু‌লো প‌রিপূর্ন, চারপা‌শে এতগু‌লো অসুস্থ মানুষ নি‌য়ে মাঝখা‌নে ব‌সে থা‌কে সর্বদা দুজন ডাক্তার! তা‌দের মু‌খে থা‌কে না কোন হা‌সি !

অসুস্থ মানুষ দেখ‌তে দেখ‌তে হয়ত ত‌ারাও জীব‌নের স্বাদ ভু‌লে গে‌ছে হয়ত !

আমার "মা" অ‌নেক ধর‌নের ব্যা‌ধি‌তে আক্রান্ত হ‌য়ে, ঈ‌দের আগ মুহু‌র্তে ঠাঁই নি‌য়ে‌ছে এই CCU তে । ঈ‌দের আগ মুহূ‌র্তে ফাঁকা হ‌য়ে যাওয়া এই ঢাকা শহ‌রে এর থে‌কে ভা‌লো কোন অপশন ছিল না হা‌তে। প্রথ‌মে BED-013 এ থাক‌লে ও নি‌জেদের সু‌বির্ধা‌থে বেড চেঞ্জ ক‌রে BED-010 স্থায়ী হলাম।

পা‌শের বেড‌টি 009 !

প‌রের দিন ঈদ তাই হয়ত , আ‌স্তে আ‌স্তে কিছু বেড ফাঁকা হ‌লো । সেই সূ‌ত্রে 009 ও ফাঁকা হ‌য়ে গেল রাত আটটার ম‌ধ্যে। "মা" কে দেখা শুনার জন্য র‌য়ে গেলাম আ‌মি। রাত বাড়ার সা‌থে সা‌থে রা‌তের খাবার খাওয়ালাম, ঔষুধ দিলাম সব কিছু কর‌তে রাত নয়টা। এটেন্ট‌ডেন্ট হিসা‌বে ‌যে‌হেতু আ‌ছি, আমার জন্য বরাদ্দ শুধু মাত্র একটা প্লা‌স্টিক টুল !

টুল‌টিতে ব‌সে, একরাশ চিন্তা গ্রাস করল আমা‌কে ক্ষ‌ণিক মুহু‌র্তে। সেই সা‌থে নিরব ওই CCU তে সর্বদা ১৮ টি বেড এর অসুস্থ মানুষ গু‌লো এখন আ‌ছে যে আমা‌দের সা‌থে তার সং‌কেত দি‌য়ে যা‌চ্ছে, বেড এর পা‌শে লা‌গো‌নো ম‌নিটর গু‌লো থে‌কে আসাঃ-

‌বিপ ! বিপ! বিপ!

শব্দ !

রাত দশটার সময় ডাক্তার দের ডিউ‌টির পালা বদল হ‌লো । দুজন তরুন ডাক্তার আস‌লো , তার ম‌ধ্যে একজন বেশ নজর কাড়‌লো ! কারন ডাক্তার হিসা‌বে তা‌কে মানায় না । ম‌ডেল হ‌লে বেশ হত আর কি । লম্বা বেশ ! সাদা ধপদ‌পে শার্ট এর সা‌থে ব্লু জিনস্ । কি‌শোরী মে‌য়ে‌দের স্বপ্ন দেখার জন্য কিন্তুঃ-

বেশ বেশ !

‌কিন্তু ওই যে, মুখটি তার আর সবার ম‌তো রাশভারী!

আ‌রে ! আ‌রে আ‌মি এই সব কি বল‌ছি ! আস‌লে টু‌লে ব‌সে কিছুটা ক্লান্ত বোধ কর‌ছিলাম, তাই হয়ত আ‌শেপা‌শের সব কিছু খু‌টি‌য়ে খু‌টি‌য়ে দেখ‌ছি আর কি। সময় আর কা‌টে না, ঘ‌ড়ির কাঁটা ও মোবাইল এর ডি‌জিট দু‌টো ই জানান দি‌চ্ছে রাত এখন ১২ টা !

এ‌দি‌কে দীর্ঘ দিন ধ‌রে ক্লান্ত শরীর যেন আর মান‌ছে না। নানা অ‌নিয়ম এর ম‌ধ্যে তাই পা‌শের খা‌লি বেড একটু হেলান দি‌য়ে গা এলা‌নোর লোভ যেন কোন বাঁধাই মান‌ছে না নিয়ম এর বেড়াজাল ।

তাই একটু খা‌নি হেলান দিলাম BED-009 ।

এর মা‌ঝে ২০ থে‌কে ৩০ মি‌নিট পরপর "মা" কে পাশ ফি‌রি‌য়ে দি‌তে হয়। এভা‌বে রাত ২:২০ ম‌তো বাজ‌লো, হঠাৎ এই ম‌ধ্যে রা‌তে উপ‌স্থিত তিনজন মানুষ। ‌ডিউ‌টি রত ডাক্তার তা‌দের কথা শু‌নে ও রি‌র্পোট দে‌খে ভ‌র্তি ক‌রে নি‌লো সা‌থে সা‌থেই ।

BED-009 আর খা‌লি রইল না।

BED-009 এ বে‌ডে ভ‌র্তি হওয়া মানুষ‌টির বয়স ৫৮ বছর । মু‌খে মে‌হেদী দেওয়া এক রাশ লাল‌চে দাঁড়ি। কেমন যেন শান্ত শান্ত এক‌টি চেহারা । নি‌জেই হেঁ‌টে হেঁ‌টে এস BED-009 নাম্বা‌রে শু‌য়ে পড়ল। তার সা‌থে এ‌সে‌ছে তার ছোট ছে‌লে, ও তার মাঝ বয়সী বোন, দুজনই বেশচি‌ন্তিত!

তারা বেশ কথা বল‌ছে অসুস্থ মানুষটার সা‌থে, যতটুকু বুঝলাম, মানুষ‌টির আ‌রোও দু‌টো বড় ছে‌লে আ‌ছে। তারা তা‌দের বাবা কে অতটা দেখা শুনা ক‌রে না। দুপু‌রে বু‌কে ব্যাথা কর‌লে ও তারা কেউ তা‌দের বাবা কে নি‌য়ে আসে নাই হাসপাতা‌লে । ছোট ছে‌লে ও তার মাঝ বয়সী বো‌নের কত আফ‌সোস করছে এই নি‌য়ে । অসুস্থ মানুষ‌টি ও সেই সা‌থে সা‌থে বেশ তাল মিলা‌ছে ।

এর মা‌ঝে নার্স এস ই‌সি‌জি করল , কয়টা ঔষুধ দিল। লোক‌টি বেশ নিজ হা‌তে ঔষুধ ও পা‌নি নি‌য়ে তা সুন্দর ভা‌বে সেবন করল। সেই সা‌থে অবর্জা‌ভেশন ম‌নিটর এর সং‌যোগ ক্যাবল গু‌লো তার শরী‌রে লা‌গি‌য়ে দেওয়ার পর নিজেই নেড়ে চেড়ে দেখলো।‌ দি‌ব্যি সে সুস্থ সবল ভা‌বে বিছানা শু‌য়ে এপাশ ওপাশ কর‌ছে ।

আ‌মি পা‌শে ব‌সেই, দেখ‌ছি সব কিছু খু‌টি‌য়ে খু‌টি‌য়ে।অ‌নেকটা নেই কাজ তো খই ভাজ এর ম‌তো আর কি।এত কিছু ঘট‌ছে মাত্র ১৫ মি‌নি‌টের সম‌য়ের ব্যাবধা‌নে ।

হঠাৎ !

যা‌ন্ত্রিক শব্দ অশ‌নি সং‌কেত দি‌তে শুরু করল। যা‌ন্ত্রিক শব্দ প‌রিবর্তন এর সা‌থে সা‌থে উপ‌স্থিত ডাক্তার ও নার্স দের ম‌ধ্যে বেশ তৎপরতা শুরু হলো। সুদর্শন সেই ডাক্তার ও নার্স এক সাথে দৌড়ে এলো BED-009 এর কাছে। চিকিৎসক দ্রুত কিছু নির্দেশনা দিল নার্স কে । নার্স দ্রুত সেটা পালন করা শূরু করল। এদিকে মাঝবয়সী সাথে আসা নারীটি এই মধ্যরাতে তার ভাইয়ের অবস্থা দেখে, যান্ত্রিক শব্দ কে হার মানিয়ে রাতের এই CCU এর নিরবতাকে খান খান করে চিৎকার করে কান্না শুরু করলো ।

তার এই কান্নার শব্দে আর কিছু না হক বাকি উপস্থিত রোগী ও তাদের এটেনডেন্ট রে মনে যথেস্ট ভীতি ও বিরক্তির কারন হয়ে উঠলো মুহুর্তে। সবাই আসলে যার যার রোগীর অবস্থা নিয়ে চিন্তিত। আমি ও ভীত হয়ে পড়লাম কারন পাশের বেডটিতে আছে আমার “মা” !

সে না জেগে যেয়ে আতকিংত হয়ে পড়ে, কিন্তু তার অসুস্থার ঘোর এতই বেশি যে সে ঘুমেই আছে । এদিকে টুলে বসে আর থাকতে পারলাম না । দুই বেড এর মাঝ খানে দাড়ালাম , যদি “মা” উঠে ও যায় তাও যেন পাশের রোগীটাকে দেখতে না পারে ।

এদিকে তরুন সেই চিকিৎসক শুরু করছে তার আপ্রান প্রচেস্টা । নার্স এর মাঝে চিকিৎসক এর কথা মতো হাতের লাগোনো ক্যানোলা দিয়ে মেডিসিন ইনজেক্ট করা শুরু করেছে । সেই সাথে রোগীর স্বজনদের ঔষুধ ক্রয় এর জন্য নিচে পাঠিয়েছিল , সেই অপেক্ষা না থেকে নিজেদের স্টক থেকেই মেডিসিন ইনজেক্ট করছিল ।

প্রতিটি বেড এর জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে BED-009 এর দিকে । আমার চোখ একবার মনিটর এর দিকে আরেকবার রোগীর দিকে । মনিটর পর্দা হয়ে উঠলো আমার কাছে ক্রিক্রেট খেলার স্কোর বোর্ড এর মতো । অত কিছু বুঝি না , তবে বিপি রেট এর বড় বড় ডিজিট এই কয়দিনে ভালই বুঝেছি। উপরে ও নিচের স্কোর টি যখনই একটু করে বাড়ে ও মনে মনে ভাবি এই যাত্রায় মনে হয় রক্ষা হলো । আবার পরক্ষনেই স্কোরটি পড়ে যায়, তখন অজানা ভয় কামড়ে ধরে ।

এদিকে তরুন চিকিৎসক হাত দিয়ে বুকে পাঞ্চ করে যাচ্ছে বিরতিহীন ভাবে । মনে মনে ভাবছি এর নামই হয়ত জীবন রক্ষাকারী সেবা! টানা 10 মিনিট এর মতো সে একাই বুকে পাঞ্চ করে গেলো । আমি ও পাশেই দাঁড়িয়ে দেখছি । আর মনে মনে অজানা অদৃস্ট কে বলছি এ যাত্রা যেন রক্ষা করো মানুষটিকে।

অবশেষে পাঞ্চ করতে করতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে, ডাক্তার কি একটা মেশিন আনতে বলল। পরে মেশিন টার নাম জোনা না থাকলেও দেখে বুঝলাম এটা অটো পাঞ্চ করার মেশিন, তা এনে লাগানো হলো । এদিকে আমার “মা” হঠাৎ জেগে উঠলো ! আমি ব্যাস্ত হয়ে তাকে অন্য দিকে ফিরালাম যাতে সে এদিকে কি হচ্ছে দেথতে না পায় ।

মেশিন পাঞ্চ করে চলছে ...

বিপপপপ !!! বিপপপপ!!!

সে এক অন্যরকম এক অনুভূতি । মনিটরে রেখা গুলো কেমন যেন সরল হতে শুরু করছে । যার অনেকটা সিনেমা দেখে এসছি । এর নামই কি ?

মৃত্যু !!

এর নাম কি চলে যাওয়া !!

আমার চোখের সামনে একটা মানুষ যে একটু আগেও ছিল , সে চলে যাচ্ছে কি নিরবে ! আমি দেখছি , কিন্তু কোন কিছুই করার নাই । জীবনে এই প্রথম কাউকে চলে যেতে দেখছি চোখের সামনে । আস্তে আস্তে রেখা গুলো একদম সরল হয়ে গেলো ...

সুর্দশন ডাক্তার টি তার নিজ চেয়ারে ফিরে গেল পরাজিত সৈনিক এর মতো । নিরবে এক রাশ কস্ট তার ওই চেহারাটিতে । আমি আমার টুলে বসে তাকে দেখতে পাচ্ছি । মনে হলো, না সমাজে কসাই নামে এই মানুষ গুলোর একটা মন আছে, যেটা কাঁদে হয়ত নিভৃতে ।

এর মাঝে, লোকটির ছেলে ও বোন প্রচুর কান্নাকাটি শুরু করছে , যেটা এই পরিবেশ এর সাথে এক বিষময় অনুভূতি সৃষ্টি করেছে । কেউ কিছু বলছি না , কিন্তু সবাই সেলফিস এর মতো চাচ্ছি কেন চুপ করছে না! কারন আমাদের প্রিয় মানুষ গুলো যে এখন আছে এই খানে বেডে শূয়ে! কতটা বিবেগেহীন আমরা ।

সময় ৩:০৫ !!

মাত্র ৪৫ মিনিটের ব্যবধানে ! চলে গেছে লোকটি, না ফিরার দেশে। আমি সামনে বসে আছি, হাতের ক্যানোলা খুলে দেওয়া হলো, একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো । ১৮ টি বেডে শুয়ে আছে সব জীবিত মানুষ একজন বাদে।

ডাক্তার দুজনের এক জন ডেথ সাটিফিকেট লিখে ধরিয়ে দিল , ছেলেটির হাতে । ছেলেটি বার বার ফিরে আসছে সেই মানুষটির কাছে যে , তাকে অনেকটা বছর বুকে ধরে মানুষ করেছে । ছেলেটি নিজেকে পরাজিত মনে করছে বিধায় হয়ত, বার বার এসে সেই পিতা নামক মানুষ টার পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছে । তাকে ধরে রাখতে পারে নাই ।

সময় ৩:১৫ !!

স্ট্রেচার করে ছেলেটি তার বাবা নিয়ে যাচ্ছে ....

মাত্র এক ঘন্টার কম সময় এর ব্যবধানে , পৃথিবী নামক মায়ার জগত থেকে একটি অধ্যায় এর পরিসম্পাত্তি!!

আমি বসে আছি .... সামনে BED-009 আবার খালি । একটু আগে ও এখানে একটা মানুষ ছিল, একটা জীবন ছিল , একটা গল্প ছিল ! ডাক্তার টি এখন ও সেই চেয়ারে শুন্যতা নিয়ে বসে আছে , মাঝখানে একটি BED-009 তার এপাশে আমি একটি টুলে বসে আছি । আমার “মা” দিব্যি আছে সে এই চলে যাওয়া একটি গল্পের কোন কিছুই উপলব্দি করতে পারে নাই । এটাই এই এখন আমার শান্তি যে সে কিছুই টের পায় নাই । কিন্তু মনে মনে বলছি এই গল্পের চিত্রনাট্য যেন আমাকে কখন অভিনয় করতে যেন না হয়।

সময় ৪: ৩৭ !!

আবার CCU তে একজন আনুমানিক ৪০ বছরের লোক, স্ত্রী ও ১৬-১৭ বছরে এক সন্তান কে নিয়ে প্রবেশ। ডাক্তার সব দেখে শু‌নে তাকে ভর্তি করে নিলো সেই ....

BED-009 এ !!!

কিছুক্ষনের ব্যবধানে BED-009 আর খালি রইল না ........

‌মিঠুন_‌বিশ্বাস _রানা
২৬ শে সে‌প্টেম্বর ২০১৭
০৯ ই আ‌শ্বিন ১৪২৪

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.