নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

*----------একজন সাধারণ মানুয----------*

মোহামমদ ইকবাল হোসেন

শূন্য হাতে এলাম আমি/শূন্যে বসবাস/জলের মাঝে জন্ম আমার/জলে সর্বনাশ।

মোহামমদ ইকবাল হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্প: "একদা গভীর রাতে"

০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ২:০০

আমি একজন লেখক। রাতের নিস্তব্ধতায় গল্প লেখা আমার কাছে নেশার মত। প্রতিটি গভীর রাত আমার জন্য নতুন কোন গল্প অথবা চরিত্র সৃষ্টির রাত।

বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলিমা নীল ছড়াচ্ছেনা, মানে আমার ছোট বোন নীলিমাও ঘুমিয়ে গেছে। আমি একখানা নতুন গল্প লিখছি। শুরু করলাম, হয়তো শেষ হওয়া পর্যন্ত লিখে যাব। ভোরের আলো বেড়ার ফাঁকে উকি দেয়ার আগেই আমাকে সব গুছিয়ে উঠে যেতে হয়। ফজরের আজান দিলেই মা ঘুম থেকে উঠে যান। তাঁর আগেই আমি উঠে যেতে অভ্যস্ত, নইলে বকা খেতে হয়।

আমাদের ঘরটা বেশ বড়। নিচের অর্ধেকটা টিন আর উপরের অর্ধেক বাঁশের বেড়া আর কাঠ দিয়ে বাঁধানো। আমার ঘরটা এক কোণে। মাঝে মধ্যে কিছু প্রয়োজন হলে মাকে অথবা নীলিমাকে খুব জোরে , অনেকটা চিৎকার দিয়ে ডাকতে হয়। আমাদের বাড়িতে আমরা একাই, তাই বেশ নিরিবিলি। গ্রামের মধ্যে একলা বাড়ি গুলো এমনই হয়। বাবা সরকারি চাকুরি করেন। অবসর নেয়ার সময় বেশ কিছু টাকা পাবেন। তাই দিয়ে ঘরটাকে পাকা বাড়ি করার খুব ইচ্ছে বাবার।

‘হঠাৎ বাহিরে খুট-খাট শব্দ হচ্ছিল। আমি প্রথমে একটু ভয় পেলাম, কান দু’টোকে আরো একটু খাঁড়া করে নিলাম। হ্যা, সত্যিই কিছু একটা হচ্ছে। আমি একটু গলা সাধলাম, শব্দ থামেনি। বললাম,কে ওখানে? প্রশ্নবোধক উচ্চারনটা আবার করলাম, শব্দ নাই। আমি উঠতে বেশি সাহস করলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কে ওখানে?’

উত্তর এল, ‘আমি চোর’ প্রশ্ন বোধক থেকে আশ্চর্য বোধক হলাম। এই প্রথম কোন চোর তাকে চোর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে উত্তর দিতে শুনলাম। মনের ভেতর ভিন্ন রকম একটা অনুভূতির টের পেলাম।মজা করে, চোর কে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাস করলাম।



-আপনি চোর মানে? এখানে কি করেন?



‘আমি আইজ কয়েকদিন ধইরা আপনের এইখানে আসি। কিন্তু কিছু নিতে পারিনা আপনার লেইগ্যা। আপনে এত রাইত পর্যন্ত কি করেন? কিছু নিতে না পারলে আমার চলব কেমনে?’



কিছুটা বিদ্রোহী হয়ে কথা গুলো বলছিল চোর ব্যক্তিটি। আমি শান্ত হয়ে কথা গুলো শুনছিলাম। প্রথমে হতাশই ছিলাম।

ভেবেছিলাম এতটা সাহস নিয়ে কথাগুলো বলল, হয়তো একজনের বেশি আছে, হয়তো ডাকাতের দল। কিন্তু অন্য কারো কথা শুনতে পাইনি বলে ধরে নিলাম এক জনই আছে ওখানে।তারপর তাকে সহযোগিতার ভঙ্গিতে আমার মনের কৌতূহল মেটাতে চাইলাম।এই মুহূর্তে তাকে ধরিয়ে দেয়া অথবা তাড়িয়ে না দিয়ে তার সাথে কিছু বাক্য বিনিময় করাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। আমি তাই করলাম।



-আচ্ছা চোর ভাই, আপনি কতদিন ধরে চুরি করেন?

-ওইসব বইলা রাইত শেষ করতে আমি এখানে আসিনাই । রাইত শেষ হওনের আগেই আমারে অন্য ঘরে যাইতে হইব।

-আমি যদি আপনাকে কিছু টাকা দেই, তাহলে কি আপনি সময় দিতে পারবেন?

-না, আইচ্ছা বলেন কি জানতে চান?”

-আপনি এই পেশায় কবে থেকে, কিভাবে এলেন?

(আমরা দুজন অনেকটা ফিস ফিস করে কথা বলতে লাগলাম)

-বলতে পারুমনা কতদিন। তবে অনেকদিন হইব। ডায়রিয়া হইয়া আমার বাপ মারা গেছে।আমরা অনেক গরিব।ছোড বইন আর আমি খুব ছোড আছিলাম, তাই বাপের চিকিৎসা করাইতে পারিনাই। আমি যদিও বইনের বড় কিন্তু কিছুই করার বয়স তহনো হয়নাই। আমার বাপ কামলা খাটতো, আর মা এই বাড়ি ওই বাড়ি কাম করতো। গরিবের মৃত্যু বইলা বাবার অসুখের সময় কেউই আগায় আসেনাই। বিছানায় পইরা থাইক্যা আমার বাবার মৃত্যু হয়। আপনে কি করেন?

-আমি একজন লেখক, রাত জেগে গল্প লিখি। আচ্ছা চোর ভাই আপনি তো গায়ে খেটে কোন কাজ করে সংসার চালাতে পারতেন, কি পারতেন না?

-পারতাম,করছিও। বাবার মরনের কয়েকদিন পর মা ও মইরা গেল। বইনটা এক বাসায় কাম করত। ওর বয়স আছিল বার/তের বছর। একদিন হঠাৎ বইনটা হারায় গেল। আইজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাইনাই। পরে এমন কইরা হারায় যাওয়া কিছু মাইয়াগো খবর শুনছিলাম, তাগো নাকি ইন্ডিয়ার বর্ডার পার কইরা বেইচ্চা দিছে। কিন্তু সত্যটা কি আইজও জানিনা। আমি কাম কইরা নিজে চলতে থাকি। এক সময় বিয়া করি। সংসার বড় হইতে থাকে। কিন্তু সংসারের চাহিদা মতোন কাম পাইনা।

কিছুদিন পর একটা ঘুস খোরের বাসায় কাম পাই। সে আমারে পোষায় দিব বইলা অনেক খাটাইত।আমিও পেটের দায়ে কাম করতাম। একদিন আমার বড় মাইয়াটার অনেক অসুখ হয়। আমি তার কাছে সাহায্য চাই। আমারে ধমক দিয়া সে বলে, টাকা কি আমি গাছ থেকে পাইরা দিব? তর মতো লোক হাজার আছে। যা দেই এটা নিয়াই থাক আর না থাকলে বিদায় হ। আমি আমার পাওনাটা চাই। সে আমারে যা দিল তা আমার কামের বিনিময়েও হয়না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেলাম। যা পাইছি তা দিয়াই কোন মতে মেয়ের চিকিৎসা করাইলাম। আমার মেয়ে কোনরকম সুস্থ হইল। এইখানে কাম করতে করতে অন্য জায়গায় ও কাম খুঁজতে থাকি। একদিন ওই লোকের বউয়ের একটা গয়নার সেট চুরি গেছিল। তারা আমারে সন্দেহ করে অনেক কিছু জিগাইল। আমি তাগোরে অনেক বললাম আমি এমন কাম করিনাই। আমি সৎ ভাবে গায়ে খাইট্টা কাম করি। বউটাও তার খারাপ আছিল। সে তার স্বামী রে বলল, পিডানি দিলে সব স্বীকার করবো। লোকটা তখন এলাকার বখাটে পোলা ডাইকা আইনা আমারে অনেক মারলো। হের পরেও আমি একই কথা বললাম। ওরা আমার বাড়িত গেলো, সব জায়গায় খোজলো কিন্তু কিছু পাইলনা। শেষ চেষ্টা হিসাবে আমারে আমাগো বাজারে স্বর্ণের দোকানে নিয়া গিয়া জিজ্ঞেস করে আমি এমন কিছু বেচছি নাকি। আমার মনে পরে আমার বাপ-মায় মরনের সময় আমি অনেক কানছিলাম কিন্তু এমন কইরা কষ্ট অনুভব করিনাই। আমি চোরের অপবাদ নিয়া বেকার হইয়া গেলাম। আগে শুধু গরীব ছিলাম এখন চোরও হইলাম। তাই আমারে কেউ কাম দিতে চাইতোনা। কিছু লোক আমারে সাহায্য করতে চাইলেও ক্ষমতার জোরে সবাই ভয়ে পিছায়া গেলো। আমার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ছিল। “দুটি সন্তানের বেশি নয়” বইলা সরকার টেলিভিশনে যেই কথা প্রচার করে। সরকারের সেই কথা আমি রাখছিলাম। কিন্তু আমাগো মত লোকের কথা সরকার রাখতে পারেনা। কারন সরকারের আরো অনেক বড় বড় কাজ করতে হয়। সংসার নিয়ে হতাশায় পড়ে গেলাম। এমন সময় গ্রামের একজন নেতা আমারে কিছু টাকা দিল। বলল, যা বাচ্চাগুলারে ভাত খাওয়াইয়া বাঁচা। ওরা তো মইরা যাইব। আমি তারে ফেরেশতা ভাবলাম। বাজারে তখন রেশনের চাইল কিনা যাইত। দুই কেজি চাইল কিনা যে টাকা থাকল তা দিয়া আরো দরকারি কিছু জিনিস নিয়া বাড়িত গেলাম।

সেদিন আমার বাচ্চাগুলার ভাত খাওয়ার সেই আনন্দ আপনে না দেখলে বুঝবেন না স্যার।

-কেঁদে দিল সে। কান্নায় জড়ানো তার গলা। কথা বলতে পারছিলোনা সে। আমি বললাম, তো ওই লোকটা আপনাকে কোন কাজ দিলনা?

-হ স্যার, তবে কাজ নয়, সে আমারে ব্যবহার করতো বিনিময়ে টাকা দিতো। আমি সততায় বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আমার কাছে যিনি ফেরেশতা রূপে আইছিলেন আমি জানতাম না যে উনি ই অনেক মানুষের ক্ষতির কারন ও আছিলেন। ওইটা আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি। রাজনীতি মানে গরিব মানুষের হক নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। অথবা মিথ্যা কে সত্য আর সত্য কে মিথ্যা বানায় মানুষের চোখে ধুলা দেওয়া না। কিন্তু আমার চোখে মানুষ রুপি ফেরেশতা সেই নেতা ওই কাম টাই করতেন। আমি সহ্য করি আর উপায় খুঁজি, কি করা যায়। বেশিদিন আমি এইখানে থাকতে পারুম না।আমারে এইটা ছাড়তেই হইবো। কিন্তু এই সত্য মিথ্যার খেলার মাঝে আমার সংসার ভাল ভাবেই চলতে থাকে। বড় মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করায় দিলাম। একদিন নেতা আমারে কইলেন, আমার বাড়িতে বিভিন্ন লোকজন আসে। কাজের লোক দরকার বাড়িতে। তুমি তোমার বউ টারে তো কাজে দিতে পারো। অন্য কাজ না থাকলে আমার বাড়িতে আসতে বল। তোমার সংসার আরো ভাল ভাবে চলবে। আমিও রাজি হইয়া গেলাম ভাবলাম আয় রোজগার বাড়লে খারাপ কি।

কিন্তু কয়দিন পর ঘটলো তার উলটা ঘটনা। আমি হতভাগা কিন্তু মিথ্যাবাদী না। আমি গরিব হতে পারি আমার আত্মসম্মান বোধ আছে। ওই লোকটার আমার বউয়ের দিকে খারাপ নজর দিতেও বাধেনাই। আমি আমার সম্বল টুকু নিয়ে কাজ ছাইড়া বাড়ি ফেরত গেলাম।

-কথা গুলো একবারে বলে একটা বড় শ্বাস নিল সে। আমি তার কথায় এতটাই মগ্ন ছিলাম যে, আমার হারিকেনের তেল শেষ হয়ে তা নিভু নিভু করছে খেয়াল না করে চোরের কথায় আরো মনোযোগী হলাম। আমি বললাম, তারপর?

-আমার বাচ্চাগো খাওনের কষ্ট আর সইতে পারলাম না। সাহায্য চাওনের ভঙ্গিতে ভিক্ষা করতে গেলাম। কিন্তু আমার পোড়া কপাল আমি যা ই বলি মানুষ বিশ্বাস করতে চায়না। পুরা সপ্তাহ ঘুইরাও একদিনের খাওন জুটত না। মাইয়াটা খালি পেটে স্কুলে যায়। অনেক রাস্তা হাটতে হইত। আস্তে আস্তে মাইয়াটা আমার দুর্বল হইয়া গেলো। আমি আমার মাইয়াটারে আদর কইরা ময়না বইলা ডাকতাম। কাম থেইকা আইসা ময়না বইলা ডাকলেই আমার কাছে ছুইটা আসতো আমার ময়না। বাবার কি লাগব না লাগব ময়না যেন সব বুঝতে পারতো। চাওয়ার আগেই দৌড়াইয়া সব আইনা দিত। আইজ আমার সেই ময়না কথা কয়না। জরে সারা শরীল পুইরা যাইতাছে। আমি তারে ওইখানের এক ডাক্তারের কাছে নিয়া গেলাম। ডাক্তার তারে হাসপাতালে নিয়া যাইতে বলে। হাতে টাকা নাই দেইখা আমি অপেক্ষা করতে থাকি, ভাবি আল্লাহ গরিবের দিকে মুখ উঠাইয়া চাইব। পরে এক হুজুরের থেইক্কা পানি পড়া আইনা খাওয়াই। স্যার গো, আমার ময়নাডা সব মায়া ছাইড়া মইরা গেলো। আমি আমার ময়না ডারে বাঁচাইতে পারলাম না। আমার তহন খালি ভিটা মাটি ছাড়া আর কিছুই নাই। আমি বিছানায় পইরা গেলাম। বউ এবাড়ি ওবাড়ি কাম কইরা কিছু আনত। একদিন একটা খারাপ স্বপ্ন দেখি, আমার মাইয়াডা আমারে বলতাছে বাবা খাইতে দাও, অনেক খিদা লাগছে। আমি তারে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে কই তোর মা রানতাছে। এইতো মা আর একটু পরেই খাবি। এখন ঘুমা। এই কথা বলে আমার মাইয়ারে ঘুম পারায় রাখলাম। সেই স্বপ্ন দেইখা আমি লাফায় উঠি। ঘুমাইতে পারিনাই ওই রাইতে। আমি আমার গণ্ডি থেইক্কা বাইর হইতে পারিনাই। সকালে ছেলের মুখের দিকে চাইয়া প্রতিজ্ঞা করি। আমার বাবা,মা,বইন সব গেলো। শেষ পর্যন্ত আমার মাইয়াডারেও হারাইলাম। আমার জীবন থাকতে আর কাউরে হারাইতে পারুম না। সারাদিন ভাবলাম কি করা যায়। এরপর থেকে আইজ পর্যন্ত আমি এই কাম করি। এইটাই এখন আমার নেশা, আমার পেশা। এই কামে কোন মিথ্যা নাই, কারো কাছে হাত পাতন লাগেনা। ধরা না খাইলে কারো কাছে ছোটো হইতে হয়না।’

আমি বললাম, “আপনি ধরা খাননি কখনো?”

-খাইছিলাম স্যার, প্রথম দিকের কথা। তহন আমি সিঁধ কাইটা চুরি করতাম। নিজেরে আর বস্তা বাইর করার মতো বড় কইরা কাটতাম। একদিন অন্য গ্রামের এক বিদেশ থেকে আসা লোকের বাড়ি যাই। অনেক জিনিস পত্তর দেইখা লোভ সামলাইতে পারিনাই। তাই বস্তাটা একটু বড় হইয়া গেলো। বাইর করার সময় তারা টের পাইয়া যায়। ইচ্ছা মতো পিটাইলো আমারে ওরা। এরপর অগো চেয়ারমেন আইসা আরেকদফা দিল। সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। চেয়ারম্যান এর পায়ে ধরে মাফ চাইতে চাইতে বললাম, স্যার আর কোনদিন চুরি করুম না আইজকা ছাইড়া দেন। চেয়ারম্যান নিজেও একটা চোর ছিল। কিন্তু তার আমার মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। সে চুরি কইরা ধরা খাইলে দুর্নীতি বলা হইত। আইন আদালত কইরা পার পাইয়া যাইত। আর আমি ধরা খাইলে পিটানি খাইতে হইত। যাইহোক, চেয়ারম্যানের একটু মায়া হল, সে আমারে ছাইড়া দিল। আমার বউ আগে ভাবতো আমি চুরি করি কিন্তু আইজ সে পরিষ্কার বুইঝা গেলো। আমার পিঠে জমে থাকা রক্ত আর বালু পরিষ্কার করছে আর তার চোখের পানি আমার কাঁটা গায়ে পরে জলে উঠলো। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। কাইন্দনা বউ। আমি আর এসব করুম না, ছাইড়া দিমু। সে আছিল আমার সহযোদ্ধা। জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে আইজ দুইজনেই ক্লান্ত।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর চুরিটা ছেড়ে দিলেন না কেন?’

-‘স্যার, আপনে যেমন লেখেন। এই কামটা করতেও আপনের অনেক কষ্ট হয়। রাইত জাইগা থাকেন। কি হয়না? আপনে কি চাইলেই লেখা ছাইড়া দিতে পারবেন?’

আমি তখন ভেবে বললাম, ‘আমি তো আর খারাপ কিছু করছিনা। আমি গল্প লিখি। যদিও নিজ থেকে; কিন্তু এটা পরে মানুষের অনেক অভিজ্ঞতা হয়। অনেকের কাছে ভাল লাগে। কারো তো কোন ক্ষতি হয়না। তাছাড়া মাইর খাওয়ার ভয় নেই। যদিও গল্প বানিয়ে লিখি তবে পুরোটাও মিথ্যা নয়। কখনো কখনো এটা হয় সত্যের ছায়া। আর তুমি যেটা করছ ওটা ঠিক না। তাই বলছি এসব ছেড়ে দাও। আবার একটা ভাল জীবন শুরু করো। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।

-সে যাই হউক, আমি এটা ছাড়তে পারুম না। এখন সব সয়ে গেছে আমার। তাছাড়া এখন আর সিঁধ কাইটা চুরি করতে হয়না। সবাই কম বেশি টাকার মালিক হইতাহে। দালান কোঠা কইরা ফালাইতাছে। যুগের সাথে সাথে আমার চুরির পেশায় ও উন্নতি হইছে। এখন আমি বস্তা ভরেও জিনিস চুরি করিনা।

-তাহলে কি করতে হয়?

-আমি এখন মোবাইল, ল্যাপটপ অথবা হালকা ওজনের জিনিস চুরি করি। যেটা বেইচ্চা অনেক দাম পাই। প্রত্যেকদিন চুরি করন লাগেনা। তাছাড়া সিঁধ কাটনের ও ঝামেলা নাই। তয় মাঝে মইদ্ধে গিরিল কাটতে হয়। যেদিন যেই বাসায় কাম করি সেদিন কোন না কোন ভাবে ওই বাসায় আগে ঢুইকা যাই। তারপর নিজের পছন্দ মতো জিনিস লইয়া বাইর হইয়া যাই। স্বর্ণ কম পাই। কারন ওটা মানুষ পলায় রাখে। মানুষ এখন অনেক লোভী আর স্বার্থপর হইয়া গেছে। টাকা পয়সা হইলে আরাম আয়েশ করতে কৃপণতা করেনা। কৃপণতা শুধু গরীবরে দান করার বেলায়। আমারে যে টাকা গুলো দিবেন বলছিলেন সেগুলো কোন অসুস্থ রুগীরে দিয়েন। যার চিকিৎসা করার টাকা নাই অথবা কোন এক ক্ষুধার্তকে দিয়েন। যার খাওয়া জুটাতে কষ্ট হয় বলে না খেয়ে দিন কাটায়। আমি এখন খেয়ে পরে ভালই আছি। আমার পোলারে স্কুলে দিছি। ও বড় হইয়া ডাক্তার হইব। সব গরীব মাইনসেরে চিকিৎসা দিব।

সকাল হয়ে এল। আমি ভাবলাম জানালা খুলে ভোরের আলোয় লোকটাকে একটু দেখব। বেড়ার ফাঁকে অথবা জানালা খুলে। প্রথমে উকি দিলাম কেউ নেই, তারপর জানালা খুলে বুঝলাম কথাগুলো বলেই হয়তো সে পালিয়েছে। আমি কোন শব্দ শুনতে পাইনি, তাই এমন একজন লোক কে দেখা হলনা আমার।

একটু পর ফজরের আজান দিবে, আমি তাই নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। কিন্তু ভাবনায় এখনো চোর ব্যক্তিটির কষ্টের কথাগুলো ঘুরে ফিরে আসছে। সত্যিই লোকটার উপর অনেক জুলুম হয়েছে। তাই আজ সে এমন কর্ম বেছে নিয়েও নিজেকে অপরাধি ভাবছেনা। আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছেন যারা তার কৃত কর্মের ফল কি তা জানেন, অথবা মন্দ জেনেও সে কাজটা অনায়াসে করে যান। এই চোর ব্যক্তিটিও তাই করছেন। মন্দ কাজ সব সময়ই মন্দ বলে বিবেচিত, সে যেভাবেই হোক না কেন।



মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন

২রা মার্চ, ২০১৪

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.