নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

*----------একজন সাধারণ মানুয----------*

মোহামমদ ইকবাল হোসেন

শূন্য হাতে এলাম আমি/শূন্যে বসবাস/জলের মাঝে জন্ম আমার/জলে সর্বনাশ।

মোহামমদ ইকবাল হোসেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিশুতোষ/শিশুসাহিত্য/শিশুতোষ গল্প: টোকাই (বইমেলা-২০১৫তে প্রকাশিত)

২৩ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ২:২২



টোকাই
মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন


সোয়াব চতুর্থ শ্রেণীর একজন মেধাবী ছাত্র। সে খুব শান্ত এবং বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে । বাবা মামুনুর রাহমান সরকারি চাকরি করেন। ওর মায়ের নাম সুফিয়া রহমান। সোয়াব এর একটা ছোট বোনও আছে, ওর নাম লিয়া। ও সবে মাত্র বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছে। সোয়াব তার বোনকে খুব আদর করে। খুব মমতায় তাকে সে লিও বলে ডাকে।
সকাল বেলা সোয়াব ঘুম থেকে উঠেছে। আজ স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছেনা তার। আরো একটু ঘুমাতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সে স্কুলে নিয়মিত যায়। তাই কষ্ট হলেও উঠে তৈরি হয়ে নিল । মা এক গ্লাস দুধ গরম করে দিলেন। স্কুলে যাবার সব কিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে টিফিনের বক্সটি ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। তৈরি হয়ে একটানে দুধের গ্লাস খালি করল সোয়াব। বাইরে বেল বাজতেই সোয়াব ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেল। সে প্রতিদিন স্কুল ভ্যানে যাওয়া আসা করে।
স্কুলে যখন তৃতীয় ক্লাসটি চলছে তখন সোয়াব জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। স্যার এটা লক্ষ্য করলেন এবং ভারি গলায় বললেন, সোয়াব উঠে দাঁড়াও, ওদিকে কি দেখছ? বলতো আমি কোন বিষয়ে পড়াচ্ছিলাম? সোয়াব বলতে পারলনা, মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
স্যার একটু ধমক দিয়ে সোয়াবকে বললেন, পড়ানোর সময় অন্য দিকে মন দিবেনা। তারপর বললেন, বসো।
সোয়াব বসে আবার বাঁকা চোখে একবার তাকিয়ে দেখল। এখনো আছে ছেলেটি। ছিঁড়া ফাটা একটা জামা পরা। এক হাতে ধরা কাঁধের উপর বড় একটা ব্যাগ। আর অন্য হাতে কি যেন খুঁজছে সে। তারপর দেখলো স্কুলের ছেলে মেয়েদের খাবারের উচ্ছিষ্ট গুলো খুঁজে খুঁজে খাচ্ছে ও।
আমাদের দেশে এমন ছেলে মেয়েদের টোকাই বলা হয়। এরা বস্তা কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। ময়লা লেগে থাকে সারা শরীরে। বস্তিতে অথবা ফুটপাতের ধারে এরা বসবাস করে। এদের বাড়িঘর বলতে ওটাই। পড়া লেখা তো দূরের কথা এরা ভরপেট খেতেও পায়না। আমাদের মৌলিক চাহিদা গুলোর বেশিরভাগই ওদের অপূর্ণ থেকে যায়।
সোয়াব স্যারের পড়ানোর দিকে মন দিয়েছে। এই ক্লাসটি শেষ হতেই নাস্তা খাবার জন্য বিশ মিনিটের নিয়মিত বিরতি দেয়া হয়। সবাই নাস্তা করতে ক্যান্টিনে চলে গেল। সোয়াব উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে ডাক দিল- এই ছেলে, এদিকে এসো, এদিকে এসো।
ছেলেটি কিছুটা অবাক দৃষ্টি নিয়ে আস্তে আস্তে সোয়াবের কাছে এল।
সোয়াবঃ তুমি যে ওখান থেকে মানুষের ফেলে দেয়া খাবার খাও-ওতে তোমার অসুখ করবে, তুমি জান না?
টোকাইঃ আমগো অসুখ করেনা। তোমরা খাইলে করব। আমরা তো এগুলান খাইয়া বড় হই। আর কিছু কইবা?
সোয়াবঃ তোমার নাম কি?
টোকাইঃ আমার নাম মুন্না।
সোয়াবঃ তোমরা কয় ভাই-বোন?
টোকাই (মুন্না) : আমরা তিন ভাই বইন। আমার বড় একটা বইন, ছোড একটা বইন, আর আমি মাইঝ খানে ।
সোয়াবঃ তোমার বাবা, মা নেই?
মুন্নাঃ বাবা নাই, মা আছে। আইচ্ছা আমি এহন যাই। তোমার ক্লাস শুরু হইব।
ছেলেটি ওর ক্লাস বিরতির কথা জানে এটা ভেবে সোয়াব একটু অবাক হল। কি যেন কি ভেবে নিয়ে সোয়াব তার ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করে মুন্নাকে দিয়ে দিল। মুন্না হাত বাড়িয়ে নিয়েই একটু জলদি করে বক্সটা খুলে দ্যাখে বক্সের ভিতর রুটি আর ভাজা ডিম। খেতে যেয়ে খেলোনা সে। বক্সটি আবার বন্ধ করে দিল। সোয়াব জিজ্ঞাস করল, খাবেনা?
মুন্নাঃ না, আমার বইনের জন্য নিয়া জামু। তোমার বক্সটা কাইলকা দিয়া জামুনে।
সোয়াবঃ না ওটা তুমি নিয়ে যাও। তোমায় দিয়ে দিলাম ওটা।
একটা মুচকি হাসি দিয়ে মুন্না এক দৌড়ে চলে গেল। সোয়াবের ক্লাস শুরু হল আবার।
দুপুরে সোয়াবের স্কুল ছুটি হলে ভ্যানে করে বাড়ি ফিরল সে। খুদায় পেট চোঁ চোঁ করছে। প্যান্টটা মনে হয় খুলে পড়েই যাবে নিচের দিকে। বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞাস করলেন, কি হয়েছে বাবা? নাস্তা করনি তুমি? শরীর খারাপ করেছে?
সোয়াব কিছু না বলে চুপ করে রইল। সোয়াবের মা প্রথমে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন সোয়াবের শরীর গরম কিনা। তারপর ছেলের কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে টিফিন বক্সটা খুঁজলেন। না পেয়ে আবার জিজ্ঞাস করলেন তোমার টিফিন বক্স কোথায়?
সোয়াব ছোট করে বলল, মা ওটা ফেলে দিয়েছি। খাবার নস্ট হয়ে গিয়েছে তাই।
সোয়াবের মা সুফিয়া রহমান তাকে আর কিছু বলেননি। কিন্তু তার মনে হচ্ছে সোয়াব মিথ্যা বলছে। সব মায়েরা তাঁদের ছেলে-মেয়ের আচরণ সহজেই বুঝে নিতে পারেন। তারপর সোয়াবকে জলদি করে গোসল করে নিতে বললেন। লিয়া স্কুল থেকে এসে খেয়ে তারপর ঘুমিয়েছে। সোয়াব তার ঘুমন্ত বোনের তুলতুলে গালে একটা আদর দিয়ে দিল। লিয়া কে জাপ্টে ধরে অথবা ঘুমের মধ্যে আদর করতে ওর ভাল লাগে।
সোয়াব খেয়ে নিল মায়ের সাথে। তারপর বিছানায় গিয়ে লিয়ার পাশে শুয়ে পড়ল। সোয়াবের বাবা বিকেলে বাসায় ফিরেন। ওদের বাসাটা সরকারি কলনিতে। লম্বা বারান্দা দেয়া বাসার দোতলায় থাকে ওরা। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলতে যায় সোয়াব । ওদের বাসার সামনে ছোট্ট একটা খেলার মাঠ আছে। ওখানেই ওরা প্রতিদিন বিকেলে ক্রিকেট খেলে।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। সোয়াব বাসায় এলো। রাতের বেলায় লিয়াকে আর সোয়াবকে ওর মা পড়াতে বসলেন। ওদের বাবা এবং মা দু'জনেই শিক্ষিত। তাই ওদের মা বেশিরভাগ সময় ওদের পড়ান । আবার ওদের বাবাও কখনো কখনো পড়ান।
সোয়াব পড়তে বসে মাঝে মাঝে কি যেন ভাবছে। মা জিজ্ঞাস করলেন, সোয়াব পড়া রেখে কি ভাবছ তুমি? মন দিয়ে পড়ো বাবা, বাড়ির কাজ গুলো শেষ করে নাও, তারপর টিভি দেখো। তার পর ঘুউউউম।
লিয়া কুট করে হেসে দিল। তার মায়ের এমন আদুরে কথা তাদের খুব মজা লাগে।
সোয়াবঃ মা, রাস্তায় অথবা ‘ডাস্টবিনে’ পড়ে থাকা খাবার খেলে কি হয়?
সুফিয়া রহমানঃ অসুখ করে, কেন? কেউ কি খেয়েছে?
সোয়াবঃ হ্যা মা। একটা ছেলে, নাম মুন্না। ওকে আমি ওখান থেকে খাবার খেতে দেখেছি। আমি জিজ্ঞাস করলাম তোমার অসুখ করবেনা, ও বলল ওদের নাকি অসুখ করেনা।
সুফিয়াঃ হ্যা,ওদের তেমন অসুবিধা হয়না। আর হলেও বা কি, ওরা তো খাবার পায়না তাই ওগুলো খায়। ওদের খাবার এবং থাকার জায়গা গুলোও পরিচ্ছন্ন নয়। এমন করে খেতে খেতে হয়ত ওদের সয়ে গেছে। আবার কখনো কখনো অনেক অসুখ হয় ওদের। তুমি কি আজ তোমার খাবার টা মুন্নাকেই দিয়ে দিয়েছিলে?
সোয়াবঃ হ্যা, বলে দুপুরে মিথ্যা বলার অপরাধে চুপ করে রইল। মা তার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিলেন। সোয়াব স্বাভাবিক হল মায়ের আদর পেয়ে। লিয়া, মা আর ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের ছড়া পড়ায় মনোযোগ দিল।
‘আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া
ওরে বুবু সরে দাঁড়া,
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া......।।‘
রাত নয়টার দিকে সোয়াব আর লিয়ার পড়া শেষ হল। দু’জনে উঠে বাবার কাছে গেল। লিয়া দৌড়ে বাবার কোলে গিয়ে বসল। তারপর বলল, বাবা টম দাও। মানে তারা ‘টম এন্ড জেরি’র কার্টুন দেখবে। বাবা কার্টুন চ্যানেল এনে দিলেন। সোয়াবেরও এটা ভাল লাগে। দু’জনের খুব হাসি পায় যখন টমকে জেরি বোকা বানায়। লিয়া হাসে হি! হি! হি! আর সোয়াব হাসে হা! হা! হা! ওদের বাবাও হাসছেন ওদের সাথে।
বাবা বললেন হাসার পালা শেষ, এখন সবাই খেতে চলো। সবাই একসাথে খেতে বসল। খাবারের টেবিলে সোয়াব বাবাকে জিজ্ঞাস করল, বাবা টোকাইরা বস্তিতে থাকে কেন?
বাবাঃ ওদের ঘর নেই বলে। সোয়াব? তাহলে আমাদেরওতো ঘর নেই। এটাতো সরকারের ঘর। ওদেরকে ও সরকার ঘর দেয়না কেন?
বাবাঃ ওদের কেউ সরকারের কাজ করেনা তাই সরকার ওদের ঘর দেয়নি। এখন খাও, খাবার সময় বেশি কথা বলতে হয়না বাবা। লিয়া ছোট্ট করে করে বলল, বাবা আমি বেশি কথা বলিনা, তাইনা?
বাবাঃ হ্যা মা, আমার লক্ষ্মি মামুনি।
খাবার শেষ করে সবাই শুয়ে পড়ল।
সকাল বেলা পুব আকাশে সূর্য্যি মামা উঁকি মারছে। পাখিদের কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হেমন্তের সকাল। আকাশটা বেশ পরিষ্কার।
সোয়াব স্কুলে এসে পৌঁছালো, ওর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে।
আজ নাস্তার বিরতিতে ছেলেটি নিজেই জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সোয়াব তখন টিফিন বক্স খুলে খাওয়া শুরু করেছে মাত্র। মুন্নাকে দেখে জিজ্ঞাস করল,খাবা আমার সাথে? মুন্না মাথা নেঁড়ে সম্মতি জানালো। সোয়াব জানালার ফাঁকে বক্সটি ধরল আর মুন্না ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করল। দু’জনে একসাথে খাওয়া শেষ করল। ক্লাস শুরু হতে এখনো ১০ মিনিট বাকি তাই দু’জনের গল্প শুরু হল।
মুন্নাঃ আচ্ছা তোমার বাবা আছে?
সোয়াবঃ হ্যা,আছে।
মুন্নাঃ ভাই,বইন?
সোয়াবঃ হ্যা, লিয়া নামে আমার একটি ছোট্ট বোন আছে। ও আমার দুই বছরের ছোট। আমি ওকে খুব আদর করি। আমরা চারজন, বাবা, মা, আমি আর লিয়া।
মুন্নাঃ হেসে বলল,আমার ছোড বইনটাও আমার দুই বছরের ছোড- মায় বলছে। আমিও তারে আদর করি। বাইরে ভাল কিছু পাইলে তার জন্য লইয়া যাই। ও কুট কুট কইরা খায়। দেখতে আমার খুব ভালা লাগে।
সোয়াবঃ তোমার বোন কি পড়ে?
মুন্নাঃ না, আমার বইন পড়েনা। আমরা কেউ পড়িনা। আমার বাবায় মরবার পর আমার মা বুয়ার কাজ করে। বইন বাড়িতে একলা থাকে । মা বেশি সময় অসুখেই পইরা থাকে। তাই কাজ কইরা যে কয়ডা টাকা পায় তা দিয়া আমাগো হয়না। হেইজন্যেই আমি টোকাই হইছি।
সোয়াবঃ তুমি কি পড়ালেখা করেছ?
মুন্নাঃ হ, আমি ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ছিলাম। আমার এখনও পড়তে অনেক ইচ্ছা করে। তাই স্যার যখন তোমগো পড়ায়, আমি জানলার পিছনে আইসা বইসা থাকি। আমি পড়া শুনি,আমার অনেক ভাল লাগে ।
সোয়াবঃ ও, এ জন্যই তো তুমি আমাদের ক্লাস সম্পর্কে জান।
মুন্নাঃ হুম, আমি তোমাদের অনেক পড়াই পারি। ধরবা আমারে? আমারে একটা পড়া ধর আমি বইলা দিমু।
সোয়াবঃ আচ্ছা বলোতো দেখি...... এমন সময় বিরতি শেষ হতেই সহপাঠিরা ক্যান্টিন থেকে ক্লাসে এসে ঢুকতেই মুন্না সরে গেল। সোয়াবও আগে ক্যান্টিনে গিয়ে খেতো। মুন্নার সাথে পরিচয় হবার পর থেকে আর যায়না। ওকে খাওয়াবে বলে জানালার পাশে বসে খায়। মুন্না আর সোয়াবের এমন সম্পর্কের কথা এখনো কেউ জানেনা। স্কুল ছুটি হলে সোয়াব বাড়ি ফিরে এল।
এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। ঈদের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। আজ স্কুলে যাবার আগে সোয়াব তার এবং লিয়ার একটি করে জামা ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নিল ওর মায়ের অজান্তে।
স্কুলে এসে সোয়াব জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মুন্নাকে খুঁজছে। মুন্না এখনও আসেনি। একটু পরেই স্যার চলে আসবে। সোয়াবের মন এবং চোখ, দুটোই জানালার বাইরে। এমন সময় বাইরে মুন্নাকে দেখতে পেয়েই ডাকল, এই মুন্না। মুন্না ছুটে এল। এতদিনে সোয়াব আর মুন্নার সম্পর্কের কথা ক্লাসের বাকিরাও জেনে গেছে। মুন্না যে বাইরে বসে স্যারের পড়া শুনে এটাও সবার জানা হয়ে গেছে। সোয়াব ব্যাগ থেকে জামাগুলো তাড়াতাড়ি বের করে দিয়ে বলল, একটা তোমার আর একটা তোমার বোনের জন্য। জামাগুলো দেখে মুন্না অতি আনন্দে হেঁসে উঠলো। ওর হাসি দেখে সোয়াবের মন ভরে গেল। জামা দু’টো পেয়ে মুন্না বাড়ির দিকে দৌড় দিল।
বাড়ি গিয়ে এক বোল পানি নিয়ে বোনকে গোসল করাল। এর পর সরিষার তেল মেখে তার বাবার মত আদর করে জামাটি পরিয়ে দিল। এক দৃষ্টিতে বোনের দিকে চেয়ে রইল। বোনটাকে তার লাল পরীর মত লাগছে। দৌড়ে গিয়ে চুলোয় রাখা পাতিলের নিচ থেকে আঙ্গুলে করে কালি নিয়ে বোনের কানের নিচে লাগিয়ে দিল। বোনকে দেখে কারো যেন নজর না লাগে। ওর মা এসব বলতে ও শুনেছে। মুন্নার বাবা মারা যাবার আগে ওদের অবস্থা মোটামুটি ভাল ছিল। বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে ওদের কোথাও যাবার উপায় ছিলনা। তাই রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে ওরা ঠাঁই করে নিয়েছে।
মুন্না এবার নিজে গোসল করে নিজের জামাটি পরে দেখছে। ঠিকঠাক ভাবে ওর গায়ে লাগল জামাটি । ও বয়সে সোয়াবের মতই হবে। বড় বোনের আয়নায় নিজেকে দেখল আর লজ্জা পেয়ে হেঁসে দিল। জামাগুলো নতুনের মতই। মুন্নার চোখে মুখে আনন্দ, নয়ন দুটো অশ্রু টলমল। অতি আনন্দে ও নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। খুশিতে লাফাতে লাফাতে বোনের কাছে গেল। বোন ও অনেক খুশি ভাই তার জন্য নতুন জামা এনেছে। একটু পরে ওদের বড় বোন মিতা বাইরে থেকে এল। ওদের দেখে অবাক হয়ে গেল সে। মুন্নাকে জিজ্ঞাস করল, কোথায় পাইছস এগুলা? চুরি করস নাইতো?
মুন্নাঃ না, আমি চুরি করিনাই, চুরি করুম কেন? আমি কি চোর? এটা আমার বন্ধু দিছে।
মিতাঃ তোর বন্ধু আবার কেডায়?
মুন্নাঃ আপা আমি হাচা কইতাছি, আমার একটা বন্ধু আছে। ও দিছে। আমি চুরি করিনাই। বিশ্বাস হয়না? আচ্ছা অরে একদিন নিয়া আসুমনে। মুন্নার বোন এবার বিশ্বাস করল কথাটা। জামা গুলো খুব সুন্দর রে মুন্না।
মুন্নাঃ হ.. বলে ছুটে বের হয়ে গেল তার বন্ধুকে দেখানোর জন্য। এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে।
সোয়াব দেখে মুচকি হাসি দিয়ে চোখে ইশারা করল একটু পরে আসতে।
কিছুক্ষন পর বিরতিতে সবাই বের হয়ে যেতেই মুন্নাকে ডাক দিল সোয়াব। মুন্না হাসি হাসি মুখে সামনে এলো। দু’জনে একসাথে টিফিন খেয়ে কিছু সময় গল্প করল । তারপর সোয়াবকে মুন্না বলল, তোমারে একদিন আমার বাড়ি যাইতে হইব। আমার আপা তোমারে যাইতে কইছে।
সোয়াবঃ আচ্ছা, কিন্তু আমিতো স্কুল ভ্যানে যাওয়া আসা করি। কিভাবে যাব তোমাদের বাড়ি?
মুন্নাঃ ব্যাপার না ,আমি তোমারে দিয়া আসুমনে। স্কুল ছুটি হইলে আমার সাতে যাইবা, আজকে?
সোয়াবঃ আচ্ছা, ঠিক আছে।
বিরতি শেষ হলে সবাই ধীরে ধীরে এসে যার যার জায়গায় বসল। আবার ক্লাস শুরু হয়ে গেল। মুন্না জানালার বাইরে বসে রইল। ক্লাস শেষ হলে বন্ধুকে তাদের বস্তিতে নিয়ে যাবে।
স্কুল ছুটি হয়ে গেলে সোয়াব মুন্নার সাথে ওদের বস্তিতে গেল। সেখানে মুন্নার মা সোয়াবকে অনেক আদর করল। খুশি হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। সোয়াব চোখ দু'টো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের থাকার অবস্থান টি দেখতে লাগল।
লিয়া স্কুল থেকে ফিরে এলে সুফিয়া রহমান মেয়ের স্কুলের জামা কাপড় খুলে গোসল করাতে নিয়ে গেলেন। আজ লিয়াকে লাল জামাটি পরাবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু আলমারিতে জামাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। লিয়াও বায়না ধরেছে এই জামাটি ছাড়া অন্য জামা পরবেনা আজ। লিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। একটু পর সোয়াবের স্কুল ভ্যান আসার কথা কিন্তু সে এখনো এলোনা। ছেলের জন্য চিন্তা খুব হচ্ছে সুফিয়ার, আবার এদিকে লিয়ার জামাটি হারিয়ে গেল । কোথাও পাওয়া যায়নি জামাটি। তাই সুফিয়া রহমানের মন খুব খারাপ।
এক ঘন্টা পরে সোয়াব বাসায় এলো । মা অস্থির হয়ে দেরি হবার কারণ জানতে চাইলে সোয়াব চুপ করে থেকে লিয়ার জন্য আনা চকলেটে বের করে দিল। মন খারাপ বলে লিয়া আজ ঘুমায়নি। কাঁদো কাঁদো গলায় ভাইকে বলল, ভাইয়া আমার লাল জামাটি কে যেন নিয়ে গেছে।
সোয়াবঃ তোমার মন খারাপ হয়েছে?
লিয়া মাথা নাড়ল, ওর মন খুব বেশি খারাপ হয়েছে।
সোয়াবঃ মন খারাপ করোনা, ভাইয়া বড় হলে তোমাকে এত্তগুলা লাল জামা এনে দিব। দুই হাত প্রশারিত করে একটু অভিনয় করে লিয়াকে খুশি করার চেস্টা করল।
লিয়াঃ ভাইয়া শোন, আর একটা নীল জামাও এনে দিবা।
সোয়াবঃ আচ্ছা, বলে লিয়াকে একটা চুমু খেল। লিয়া চকলেট খাচ্ছে। মা আবার এসে বললেন। সোয়াব গোসল করে খেতে এসো।
সোয়াব খেয়ে ঘুমাতে গেল। কিন্তু ঘুম আসছেনা। ওর শুধু মুন্নাদের কথা মনে হচ্ছে। মুন্না পড়তে চায়। কিন্তু ওদের স্কুলেই। মুন্না বড় হয়ে খুব শিক্ষিত হতে চায়।
বিকেলে বাবা বাসায় এলে সোয়াব উঠে দরজা খুলে দিল। সোয়াবের মা আর লিয়া তখন ঘুমাচ্ছে। সোয়াব আজ খেলতে যায়নি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবছে কি করা যায়। ভাবছে মা-বাবাকে মুন্নার কথা বলবে কিনা। আর কয়দিন পর স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে অনেক দিনের জন্য। মুন্নার সাথে দেখা হবেনা এতদিন। ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে এলো ।
সবাই সন্ধ্যার নাস্তা করছে, তখন সোয়াব বাবার কাছে গিয়ে মুন্নাদের কথা বলল। ওর আর লিয়ার জামা নিয়ে মুন্নাকে দিয়েছে এটাও জানালো সে। সোয়াবের মা-বাবা তাদের ছেলের এমন দরদি এবং পরোপকারী মন, আর উদারতা দেখে খুব খুশি হলেন। তারপর বাবা বললেল, সোয়াব তুমি মন খারাপ করোনা। আমি কালকে স্যারদের বলে দেখি কি করা যায় মুন্নার জন্য। চল এবার একটু হাসো । সোয়াব দুপুর থেকে এপর্যন্ত আর হাসেনি। সুফিয়া রহমান এখন সব বুঝেছেন, ছেলে কেন দেরি করে ফিরেছিল আজ।
পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে সোয়াব মুন্নাকে বলল ওর দেয়া জামাটি পরে আসতে। আর এও বলল মুন্নাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য ওর বাবা আসবেন স্কুলে। স্যারদের সাথে কথা বলতে।
মুন্না তৈরী হয়ে এসেছে। টিফিনের সময় সোয়াবের বাবাও এল। প্রথমে মুন্নাকে ডেকে এনে ওর সাথে কথা বললেন, তারপর ওকে নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলেন। প্রধান শিক্ষক মুন্নার সব কথা শুনলেন এবং ওকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাস করলেন লেখা পড়া নিয়ে। পাশ থেকে আর একজন শিক্ষক জানতে চাইলেন তুমি কি ক্লাস টু পাশ করেছ?
মুন্নাঃ হাসি মুখে উত্তর দিল স্যার আমি ক্লাসে তিন নাম্বার হইছিলাম।
স্যারঃ খুব ভাল। আচ্ছা বলত, আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি এর ইংরেজী কি হবে?
মুন্নাঃ আই রিড ইন ক্লাস টু। হইছেনা স্যার?
স্যারঃ ভেরি গুড।

মুন্নার ব্যবহার আর পড়া লেখার আগ্রহ দেখে সবাই খুব খুশি হলেন। ওকে বিনে পয়সায় পড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত জানালেন প্রধান শিক্ষক। মুন্নাকে বললেন কালকে তোমার মাকে নিয়ে আসবে। আমরা যদি তোমাকে এখন তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করতে পারি তাহলে তো ভাল। আর না হলে তুমি এখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে ক্লাস করবে আগামী বছর তুমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তে পারবে।
মুন্না আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেঁদে দিল। সোয়াবের বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখের পানিও মুছে দিলেন। স্যারদের বললেন, মুন্নার বই-খাতা আর পড়ার জন্য বাকি যা লাগে তার খরচ আমি দিব।
সবাই মিলে টোকাই মুন্নার পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। মুন্না দৌড়ে গিয়ে সোয়াবকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার জন্যই সব হল। তুমি আমার ভাই। আমি এখন যাই, মাকে সব কিছু বলি। কালকে দেখা হইব।
জানালার এপাশ-ওপাশ থেকে শুরু হওয়া সম্পর্ক মুন্নার মত একজন টোকাইকে তার স্বপ্নের পৃথিবীতে পৌঁছে দিয়েছে। সোয়াবের মত এমন সুন্দর মনের বাচ্চা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। শিক্ষকরা সবাই এবার বার্ষিক ক্রিড়া অনুষ্ঠানের পুরষ্কার বিতরণীতে মহৎ উদ্যোগের জন্য সোয়াবকে পুরষ্কার দিবেন বলে ঠিক করলেন। সোয়াব এসব কিছুই জানেনা। সে শুধু জানে তার বন্ধুর জন্য কিছু করার চেস্টা করেছে ও।
ছুটির পর সোয়াব বাড়ি ফিরে এল। আজ সে ভীষণ খুশি। কারো জন্য কিছু করতে পারার আনন্দে ওর বুক ভরে গেছে। প্রতিদিনের মত গোসল করে খেয়ে ঘুমাতে বিছানায় এল সোয়াব। বোনের ঘুমিয়ে থাকা মায়াবি মুখে একটা চুমু খেয়ে নিজেও একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ২:২৮

মো;জহিরুল ইসলাম রাসেল বলেছেন: খুব মজা পেলুম

২৩ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:৫৯

মোহামমদ ইকবাল হোসেন বলেছেন: জেনে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ জানুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.