নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

মোঃ ইয়াসির ইরফান

পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালোবাসতেন অথবা সব কবি যদি রাজনীতিবিদ হতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। -জন এফ কেনেডী

মোঃ ইয়াসির ইরফান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্রিকেট-স্মৃতিকথা (পর্ব-এক)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৫৫


সালটা সম্ভবত ১৯৯৮ !
দুটি অবোধ বালক শিশুতোষ আনন্দে দেখছে ‘ক্রিকেট’ নামক বল পেটানোর এক খেলা । স্টেডিয়ামের দর্শকদের মতো করে, সাদা কাগজে বড় বড় করে লিখেছে ৪ ও ৬ । চার মারলে দেখায় চার, ছয় মারলে ঠিক দর্শকদের মতো করেই লাফিয়ে লাফিয়ে টিভির সামনে ছয় দেখায় । যে দলটা খুব চার আর ছয় মারছিল, বালক দুটি সেই দলকেই সাপোর্ট করতে শুরু করল ।


চট্টগ্রামের বাদির টেক এলাকার মোড়ে, রাস্তার পাশেই সটান দাঁড়িয়ে, ত্বি-তল হলুদ রঙা (এখন অবশ্য ছাই রঙা হয়ে গেছে) বিল্ডিং । বিল্ডিংয়ের নাম, দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং । বিল্ডিংটার বাসাগুলা কলোনী সিষ্টেমের, একেক তলায় দশটা করে ফ্যামিলি বাসা । তিন রুমের বাসা, সোজাসোজি একই সাইজের তিনটা রুম । প্রথম রুমটাকে সামনের রুম বা ড্রয়িং রুম বলা হয় । দ্বিতীয় রুমটাকে মাঝের রুম বা বেড রুম আর তৃতীয় রুমটাকে রান্নাঘর বলা হয় । দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিংয়ের পেছনের ভবনের, তিন তলায় বালক দুটির বাসা । বাসার সামনে আছে লম্বা বারান্দা । যেখানে প্রায় বালক দুটি খেলা করত, অন্যান্য বালক-সঙ্গীদের সাথে ।
এবার মনে হয় বালক দুটির পরিচয় দেয়ার সময় এসেছে । দুই বালকের একজন, আমি নরাধম নিজেই । আর অন্যজনের পরিচয় যথাসময়ে দেয়া হবে ।


পাঠক, নিশ্চয় প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছেন । ক্রিকেট বাদ দিয়ে কি সব ফালতু গল্প ফেঁদে বসেছি । একটু ধৈর্য্য ধরুন পাঠক । আর বিরক্ত করব না । এবার সরাসরি ক্রিকেটেই চলে যাব ।
সেই শিশুতোষ আনন্দ নিয়ে খেলা দেখছিলাম । আব্বু দুপুরের দিকে অফিস থেকে এলেন । জিজ্ঞেস করলাম, কোন দলকে সাপোর্ট করেন ?
আব্বু জবাব দিলেন, জয়সুরিয়া থাকলে শ্রীলংকাকে সাপোর্ট করতাম । এখন কোন দলকেই করি না । জয়সুরিয়া কি, থাকলে কি হয়... কিছুই বুঝি না । তবু আমি মহা উৎসাহে বললাম, আমি তো ভারতের পক্ষে । ভারতের প্লেয়ারগুলা কি মারটাই না দিচ্ছিল ! সাপোর্টার না হয়ে উপায় আছে ?
যদ্দূর মনে পড়ে আগ্রহভরে প্রথম খেলা দেখার ঘটনা ছিল, এটাই ।


তারপর থেকে তো যেন ক্রিকেটেই মজে গেলাম । শুভ্র দেব-শাকিলা জাফরের ‘ক্রিকেট ক্রিকেট, ভালবাসি ক্রিকেট” গানটায় মেতে উঠা, টিভিতে আবুল হায়াত-ঈষিতার ‘নট আউট’ নাটকটা দেখার জন্য ঢুলু ঢুলু চোখে জেগে থাকা... কি সব পাগলামী !
তখন বাংলা ধারাভাষ্য দেয়া হতো । ‘সৌভাগ্য সুজনের, সৌভাগ্য বাংলাদেশের’ কিংবা ‘দূর্ভাগ্য পাইলটের, দূর্ভাগ্য বাংলাদেশের’ এই ধরণের কথাগুলো বেশ পরিচিত ছিল তখন । আমি আর আমার বন্ধু যখন খেলতাম, সেখানেও এই বাংলা ধারাভাষ্য চালিয়ে যেতাম ।
ক্রিকেট কে আমার মনে হয়, আফিম বা নেশার মতো । কখনো মনে হয় ছোঁয়াচে রোগের মতো । আব্বুর ক্রিকেট-নেশা টা যেমন ছোঁয়াচে রোগের মতো আমার মধ্যে ছড়িয়ে গেল, তেমনি আমার থেকে আমার বন্ধু তারেকের মধ্যেও । হ্যাঁ, আমার সেই বন্ধুটির নাম ছিল তারেক মাহমুদ ।
আমরা দুজনই তখন ক্রিকেটের নেশায় বুঁদ । আমাদের খেলার বিষয় বস্তুও ছিল ক্রিকেট । নাহ, ব্যাট-বলের ক্রিকেট না, একটু অন্যরকম ক্রিকেট ।
পরিত্যাক্ত বোতল-টিন দিয়ে গড়া হতো একটা স্ট্যাম্প । তারপর সেই স্ট্যাম্প ঘিরে চলত আমাদের খেলা । সে বল করত, আমি উইকেটের পেছনে দাঁড়াতাম । এভাবেই চলত... আমাদের ছেলেমানুষী সব খেলা । কথা নাকি হারিয়ে যায় না, জমা থাকে । তাহলে আমাদের কত ধারাভাষ্য জমা হয়ে আছে, সেই তিন তলার লাল বারান্দাটাই !
বাসায় তখন রাখা হতো ইনকিলাব । আমাদের আরেকটা খেলা ছিল, পুরনো সব পত্রিকা বের করে তা থেকে স্কোর কার্ড দেখা । কি অদ্ভুত খেলা, তাই না !
আহা, কত পুরনো কথা ! কি জানি, তাঁর সব মনে আছে কি না !


১৯৯৯ বিশ্বকাপের জোয়ারে ভাসছে দেশ । বাংলাদেশ খেলছে, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ । আব্বু-মামাদের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি, নান্নুকে না-নেয়াই বেশ বড়সড় বিতর্কের ঝড় উঠেছে । পরে নান্নু ফিরেছিলেন । টানা তিন ম্যাচ ভালও খেলেছিলেন । সম্ভবত অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষেও তাঁর একটা ভাল ইনিংস ছিল । স্কটল্যান্ডের সাথে মর্যাদার লড়াইয়েও ভাল খেলেছিলেন । স্কটল্যান্ডের সাথে জয়ের পর সে কী উচ্ছাস ! যা ছিল অভাবনীয়, অবর্ণনীয় ।
পাকিস্তানকে হারিয়ে তো মহাকাব্য রচনা করল বাংলাদেশ । আমাদের মধ্যে তখন একটা আলোচনা বেশ সাড়া ফেলেছিল, ‘পাকিস্তান ইচ্ছা করে হেরেছে’ । কেউ কেউ বলছিলেন, ‘পাকিস্তান টাকা খেয়েছে’ ।
পরদিন পত্রিকায় ওয়াসিম আকরামের সেই বিখ্যাত উক্তি, আমাদেরকে প্রভাবিতও করেছিল । ‘আমাদের ভাই থেকে আমরা হেরেছি’ ।
পরে বয়সকালে এসে ঠিকই বুঝেছিলাম, আকরাম-নান্নুদের কীর্তিগাঁথা, ! বীরত্বপূর্ণ সেই জয় নিয়ে তাই আজকাল কেউ প্রশ্ন তুললেই বলে উঠি, ‘আমার অত কিছু দেখার দরকার নাই, আমরা জিতছি ব্যাস ! পাকিস্তানকে হারিয়েছি । ওয়াসিম আকরাম, সাঈদ আনোয়ার, সাকি, ইনজি সমৃদ্ধ পাকিস্তানকে হারিয়েছি । ’৯৯ এর রানার্স আপ দলকে হারিয়েছি’ । যদ্দূর মনে পড়ে ঐ ওয়ার্ল্ড কাপে দুর্দান্ত একটা দল নিয়ে গিয়েছিল, ওয়াসিম আকরাম । যারা মোটে দুই কি তিনটা ম্যাচ হেরেছিল । তার মধ্যে, আমাদের সাথে একটা । ভারতের সাথে একটা । ফাইনালে একটা । আর হেরেছিল কি না, ঠিক মনে পড়ছে না ।


আমাদের ফ্লোরে দশটা বাসার পাঁচটা ছিল সিঁড়ির এপাশে, আর পাঁচটা ওপাশে । সেবার ’৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তান-ওয়েষ্ট ইন্ডিজ খেলা চলছিল । আমাদের পাশটাতে কারেন্ট চলে গেল । ওপাশে আছে । ‘আদনানের আব্বু’ আংকেল টা তাদের টিভি বারান্দায় নিয়ে আসলেন । সবাই মহা আনন্দে বারান্দায় বসে খেলা দেখছিল । পাকিস্তান সম্ভবত ২২৮ করেছিল সেদিন ।
আমাদের সেই খেলা দেখতে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো । কেন, জানি না ! বড়রা দেখলেন । আমরা ঘুমালাম । সকালে উঠে শুনি, উইন্ডিজ হেরেছে । ২০৮ কি ২১০ করেছিল । আব্বু বললেন, ‘পাকিস্তান যদি দুইশ করত, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ১৮০তেই ব্লক হতো’ ! আব্বুকে তখন দেখেছিলাম, পাকিস্তানের বোলিং আর শ্রীলংকার ব্যাটিং নিয়ে একটা উঁচু ধারণা রাখতেন । কালু-জয়সুর ব্যাটিংয়ের মুগ্ধ দর্শক ছিলেন, আব্বু ।
সেই সময় অস্ট্রলিয়া দলে একটা ফার্ষ্ট বোলার ছিল । পল রাইফেল । তখন আমার বড় আন্টির বাসা ছিল রাইফেল ক্লাব । বেশ অন্যরকম লাগত, জিনিসটা !


জিম্বাবুয়ের একটা প্লেয়ার ছিল, নেইল জনসন । সে নাকি দক্ষিন আফ্রিকান । দেশান্তরী হয়েছিল, স্বদেশের ক্রিকেট নির্বাচকদের উপেক্ষার জবাব দিতে । দিয়েছিলও, ভালই । তাঁর একটা ক্যাচ এখনো চোখে লেগে আছে আমার । ’৯৯ বিশ্বকাপে, কোন দলের বিপক্ষে ঠিক মনে নাই । তবে পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল । বলটাকে এক হাতে উপরে ঠেলে দিয়ে, নিজে পড়ে যাওয়ার সময় বলটাকে আরো একবার উপরে তুলে দিয়েছিল, এবং তৃতীয়বারে মাটিতে শুয়ে ক্যাচটা লুফে নিয়েছিল । অসাধারণ একটা ক্যাচ !
ক্যাচের কথা আসায় মনে পড়ল, গিবসের কথা । অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে তাঁর সেই বিখ্যাত ক্যাচ মিস ! স্টিভ ওয়াহ যেই ক্যাচ ড্রপকে বলেছিলেন, ‘ট্রফি ড্রপ’ ! সেই ক্যাচ মিস লাইভ দেখেছিলাম । আমাদের ধারণায় তখন সেটা মিস ছিল না । আমরা বলাবলি করছিলাম, সে ক্যাচটা ধরেছে ঠিকই । কিন্তু উপরে না-ছুঁড়ে, নীচে ফেলেছে !
আর আফ্রিকানদের তখন ডাকা হতো ‘জ্বিন’ নামে ! সিরিয়াসলি বলছি, ‘জ্বিন’ ডাকত তাদের । কারণ তাদের প্লেয়ারদের নাকি দেখা যায় না । কোত্থেকে এসে কি সব অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং করত, চোখ কপালে উঠে যাওয়ার অবস্থা হতো আমাদের ! গিবস, জন্টি তো অতিমানবের কাতারে ছিল তখন ।
আর একটা প্লেয়ার ছিল ক্লুজনার ! লোকটার জন্য আফসোস লাগে, এখনও ।


২০০০ এর দিকে এসে খেলাটার প্রতি নেশাটা যেন আরো বেড়ে গিয়েছিল । আব্বু কেবলমাত্র খেলা দেখার জন্য, সেবার ক্যাবলের সংযোগ দিলেন । দুটি মাত্র খেলার চ্যানেল । ইএসপিএন, স্টার স্পোর্টস ।
বাসায় তখন আমার এক ভাইয়া থাকতেন । চুয়েটে পড়তেন । প্রায়ই বাসায় আসতেন, থাকতেন তখন । উনিও ছিলেন ক্রিকেট-নেশায় আসক্ত । ভাইয়ার সাথে খেলা দেখতাম, অনেক কিছু জানতে পারতাম । সবচেয়ে মজা হতো যখন আব্বু, আমি ও ভাইয়া একসাথে খেলা দেখতাম । সে এক অভুলনীয় স্মৃতি !
মাঝে মধ্যে তারেকও আমাদের সাথে যোগ দিত । চার মারলে সে বলে উঠত, ‘ফুর ফুর ফুর’ । তা নিয়ে আমাদের সে কী হাসাহাসি !
অস্ট্রলিয়ায় খেলা হলে অন্য এক ধরণের আনন্দ লাগত । সাদা সাদা কবুতরদের উড়ে যাওয়া, ঘন সবুজ মাঠ, ফজরের নামাযের পর খেলা দেখা... কেমন যেন ছিল সেই অনুভূতিগুলো !

আহা, কি সব স্মৃতি ! কি সব অনুভূতি ! শৈশবের ক্রিকেট বলে কথা ।

_________

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: আমি অস্ত্রেলিয়ার সাপর্টার। ওদের খেলা দেখার জন্য কী করিনি।
একদিন গিলির খেলা দেখতে গিয়ে মায়ের পিটানি খেয়েছিলাম

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৩৭

মোঃ ইয়াসির ইরফান বলেছেন: হা হা হা

২| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৩৫

মহা সমন্বয় বলেছেন: এই ক্রিকেটের জন্যই আমার বাবার সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে.. সেই যে নষ্ট হয়ে গেছে আর কোন দিন জোড়া লাগে নাই। :((

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৪১

মোঃ ইয়াসির ইরফান বলেছেন: এইবার আন্তরিক সমবেদনাই জানাচ্ছি । আহারে ! :(

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.