নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

মোঃ ইয়াসির ইরফান

পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালোবাসতেন অথবা সব কবি যদি রাজনীতিবিদ হতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। -জন এফ কেনেডী

মোঃ ইয়াসির ইরফান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাফল্যে মোড়ানো একটি বছর

১৯ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:১৫

এই লেখাটা লেখা হয়েছিল গত বছরের শেষান্তে । বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক বছরের সাফল্য যাত্রাকে শব্দবন্দী করার প্রচেষ্টায় । একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছিল তখন ।
বহুদিন বাংলাদেশের খেলা নেই । প্রায় অর্ধ বছর পেরিয়ে গেল, সেই কবে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছিল বাংলাদেশ !
অনেকটা স্মৃতি রোমন্থনের মতো, এই লেখাটাকে আজ এখানে নিয়ে আসা ।




বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণালী এক অধ্যায়ের সুবর্ণকাল যেন চলছে । গত এক বছরে বিশ্বের চার-চারটি ক্রিকেট পরাশক্তিকে ভূপাতিত করেছে বাংলাদেশ । নাক উঁচু ব্রিটিশদের বিদায় করে ছেড়েছে বিশ্বমঞ্চ থেকে । দক্ষিন আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানকে দেশের মাটিতে তুলোধূনো করে সিরিজ জয়ও হয়েছে । পাঠক, আসুন না একটু ফিরে দেখি গত এক বছরের পথচলা !


আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা প্রায় তিন দশক কিংবা আড়াই যুগ ধরে । সময়টা অন্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর তুলনায় খুব একটা বেশী না হলেও, একদম কমও নয় । এই তিন দশকে আমাদেরর উন্নতিটা এসেছে ধাপে ধাপে, সংগ্রামের কঠিন-দুঃসহ পথ পাড়ি দিয়ে ।
একটা সময় ছিল, যখন বলা হতো- ‘আমরা পঞ্চাশ ওভার খেলিব’ । যেটা পরবর্তীতে রুপান্তরিত হয়ে ‘আমরা লড়াই করিব’ তে পরিণত হয়েছিল । তারও পরে হয়েছে, ‘আমরা হারার আগে হারব না’ । আর বিবর্তনের ধারা বেয়ে এখন বলা হয়, ‘আমরা জয়ের জন্য খেলব’ । কি অবাক হচ্ছেন ! দম্ভোক্তি মনে হচ্ছে ! অবিশ্বাস্য লাগছে ! না পাঠক, বিশ্বাস রাখতে পারেন । তার চেয়েও বড় কথা, এই বাক্য এখন কেবলমাত্র বলার জন্য বলা তে আটকে নেই । বরং সামর্থ্য ও শক্তিমত্তা বিবেচনায় কঠিন সত্য বলেই মেনে নিতে হয় ।
সাফল্যে মোড়ানো একটি ওভার, একটি ইনিংস, একটি ম্যাচ, একটি সিরিজ কিংবা একটি মাসের সময়গুলো পেরিয়ে, বাংলাদেশ আগাগোড়া সাফল্য দিয়ে মুড়িয়ে ফেলেছে গোটা একটি বছরকেই । এই ২০১৫ টা তাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বাঁধাই করে রাখার মতো একটি বছরে পরিণত হয়েছে ।
তা কেমন ছিল এই ২০১৫, পুরো একটি বছরের পথচলা ! প্রিয় পাঠক, আসুন না সাফল্যের সেই অসাধারণ-অমুছনীয় স্মৃতিগুলো আরেকটু রোমন্থন করি । সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে তো ভাললাগারই কথা ।


বিশ্বমঞ্চে বছর শুরু :

লক্ষ-কোটি আবেগী জনতার বিশাল প্রত্যশাকে সঙ্গী করে মাশরাফিরা গেলেন, তাসমান পাড়ের দেশ অস্ট্রলিয়া-নিউজিল্যান্ডে, বিশ্বকাপের একাদশ আসরে অংশ নিতে । প্রাথমিক লক্ষ্য, ভালো খেলা । তারপরের লক্ষ্য ‘সেরা অষ্টক’ এ নিজেদের অবস্থান করে নেয়া ।
বিশ্বকাপ-পূর্ব আন-অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে, ক্লাব পর্যায়ের দলের কাছে বাংলাদেশের পরাজয়, সমর্থকদের আশার ফানুসে বিশাল ফুটো সৃষ্টি করলেও, তাতে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন বিবর্ণ হয়নি একটুও । অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচেও দলের পরাজয়ের ধারা অব্যহত থাকলে, কিছুটা ভড়কে যায় দেশের ক্রিকেট পাগল জনতা । তবে তা ওই ‘ভড়কে’ যাওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল । আশার পালে বড় ধরণের কোন আঘাত দিতে পারেনি ।
সমর্থকদের প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে একটুও দেরী করেননি মাশরাফিরা । প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে ব্যাটে-বলে উড়িয়ে দিয়ে শুভ সূচনা করতে সমর্থ হয়, লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা । দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভালবাসার জবাব দিতে, আফগানিস্তান-বধের পর ক্যানবারের মানুকা ওভাল মাঠে ‘ল্যাপ অব অনার’ দেয়, মুশফিক-সাকিবরা । বিশ্বকাপ-স্বপ্নের রঙ উজ্জলতর হয়ে ধরা দেয়, আমাদের কাছে ।
বাংলাদেশ নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয়, দ্বীপ দেশ শ্রীলংকার । এই ম্যাচে বাংলাদেশের জঘন্য পারফর্ম্যান্স, আহত করে এই অঞ্চলের ক্রিকেট-আসক্ত জনগোষ্ঠীকে । ছন্নছাড়া বোলিং, দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং আর চূড়ান্ত মাত্রার বাজে ফিল্ডিং, ভীষণ আশাহত করে তোলে বাংলাদেশের সমর্থকদের ।

ঘূর্ণিঝড় বাঁধায় পন্ড হয় বাংলাদেশ-অস্ট্রলিয়া ম্যাচ । পরিত্যক্ত ম্যাচের এক পয়েন্ট প্রাপ্তি থেকেও মাশরাফিদের জন্য বেশী আক্ষেপের ছিল, ব্রিসবেনের গ্যাবার সবুজ চত্ত্বরে খেলার আজন্ম-লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যু ! তিন ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট অর্জন করে, বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামে । সেই ম্যাচে তিন শতাধিক রান তাড়ার ইতিহাস রচনা করে, কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার লক্ষ্যের দিকে অনেকটাই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহা গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে, মার্চের নয় তারিখ এডিলেইড ওভালে, বাংলাদেশ খেলতে নামে ‘ক্রিকেটের জনক’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে । প্রথমে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশকে শুরুতেই ভড়কে দেন ইংল্যান্ডের দ্রুতগতির বোলাররা । শুরুর ধাক্কা সামলে, বাংলাদেশকে একটা লড়াকু সংগ্রহে পৌছে দিতে, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ তাঁর ব্যাটটাকে ‘চওড়া’ করে তুলেন, দৃঢ় সংকল্প চোখে এঁকে । প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে, বিশ্বকাপে মাহমুদুল্লাহ শতক পেলে, বাংলাদেশ পেয়ে যায় পৌনে তিনশ রানের দারুণ সংগ্রহ ।
পরে দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের সাথে দুরন্ত বোলিংয়ের যুগলবন্দী ঘটলে, এক সময়ের ‘ঔপনিবেশিক’ ইংরেজরা আটকে যায়, বাংলাদেশের রান থেকে ‘পনের’ দৌড় দূরে । শেষ দিকে রুবেলের অবিশ্বাস্য সেই ইয়র্কার, অনবদ্য দুটি বল, হয়তো আজও চোখে ভাসে অনেকের । অনেকের কানেই হয়তো আজও বেজে উঠে, ব্রিটিশ ধারাভাষ্যকারের সেই অভুলনীয় ধারা বিবরণী- “বাংলাদেশ টাইগার্স হ্যাভ নকড দ্যা ইংলিশ লায়ন্স আউট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড কাপ” । তারপরই এডিলেইড ওভালের গ্যালারী হয়ে যায় যেন একখন্ড ‘মিরপুর কিংবা সাগরিকা’ । আবেগী বাংলাদেশীরা সুযোগ পায়, আবেগটাকে আরো একবার উর্ধ্বে তুলে ধরার ! বাংলাদেশ দলের ‘ক্যাপ্টেন কিং’ মাশরাফি বিন মর্তুজা সেই আবেগী জনতার মধ্যে, প্রথম সারির একজনই ছিলেন । ইংল্যান্ড-বিজয়ের পর তাঁর মাঠেই শুয়ে পড়া, এবং তাঁর উপর গোটা বাংলাদেশ দলটার ঝাঁপিয়ে পড়া, ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়েছে আবেগের অনন্য-অসাধারণ এক ছবি ।
নাক উঁচু ব্রিটিশদের পরাজিত করার মধ্য দিয়েই, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো উঠে যায় স্বপ্নের কোয়ার্টার ফাইনালে ।


ইংল্যান্ড-বধ এর ধারা অব্যহত রেখে, গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে, নিউজিল্যান্ডের সাথেও বাংলাদেশ উপহার দেয় নান্দনিক ক্রিকেট । শেষ আট আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায়, লাগামছাড়া ক্রিকেট-সৌন্দর্য্যে মেতে উঠে মাশরাফির অনুপস্থিতিতে সাকিবের নেতৃত্বে মাঠে নামা বাংলাদেশ । মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ করেন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরী । অপ্রতিরোধ্য কিউইদের কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়, ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা লাল-সবুজ জার্সিধারীরা । শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হারলেও, বাংলাদেশ জিতে নেয় কোটি ক্রিকেট-রসিকদের মনোজগত ।

কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয়, দেশাত্নবোধের আবেগে কাঁপতে থাকা বাংলাদেশ । সেই ম্যাচে বাংলাদেশ অতটা ভালো না-খেললেও, ক্রিকেট-বিশ্ব চাক্ষুষ করে পক্ষপাতের নির্লজ্জ এক খেলা । খেলাটার চিরন্তন সৌন্দর্য্যকে চূড়ান্ত মাত্রায় অপদস্থ করে, মেলবোর্নে মঞ্চস্থ হয় জঘণ্য প্রতারণা ও প্রবঞ্চণার ঘৃণ্য উদাহারণ । বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেটাসক্ত জনতার আবেগের সাথে, কৃত অন্যায় বাংলাদেশ তো মেনে নেয়-ই নি । বিশ্ব ক্রিকেট পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে । বিশ্বের অনেক রথী-মহারথীর সাথে সুর মিলিয়ে ভারতের অনেক ক্রিকেট-বোদ্ধাও মেতে উঠেন, বাংলাদেশের সাথে অন্যায্য আচরণের বলিষ্ঠ প্রতিবাদে ।
বলা হয়, সেই ম্যাচে কমপক্ষে তিন-তিনটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গিয়েছে... ।
রুবেলের ফুলটস বলে রোহিত শর্মা আউট হলে ‘নো বল’ কল করা !
মাশরাফির বলে সুরেশ রায়নাকে সরাসরি এলবি না দেয়া !
ইনফর্ম মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ হুক করলে বাউন্ডারিতে ধাওয়ান ক্যাচ ধরে, তখন প্রশ্ন উঠে তাঁর পা সীমানা-দড়িতে লেগেছিল কি না !

আইসিসি, মোড়ল-সর্দার ভারত ও আম্পায়ারদের তুমুল সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে পুরো ক্রিকেটাঙ্গন । বিশ্বকাপ জুড়ে সেই সমালোচনার ঝড় তো ছিলই, এখনো মাঝে মধ্যেই আসর গরম হয়ে উঠে ১৯শে মার্চের সেই ঘৃণ্য আচরণের নিন্দা-আলোচনায় ।

বীরদর্পে স্বদেশে ফিরে আসে মাশরাফি ও তাঁর দল । নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম বিশ্বকাপ শেষ করে, স্বাধীনতার মাসে স্বদেশের মানুষদের এক অন্যরকম ক্রিকেট উন্মাদনায় উদ্বেলিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ।

বিশ্বমঞ্চে অসাধারণ সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শুরু করে স্বর্ণালী অধ্যায়ের প্রথম ধাপ । তখন কে জানতো, সারা বছরই এমন অসাধারণ সাফল্যের মধ্য দিয়েই যাবে এই বাংলাদেশ !

পাকিস্তান এলো, ষোল বছরের ফাঁড়া কাটলো :
নিয়তির এ এক অদ্ভুত খেল ! টেস্ট মর্যাদা-লাভের পর কত দেশকেই তো ভূপাতিত করল, বাংলাদেশ । অথচ টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের ভিত গড়ে দেয়া সেই ঐতিহাসিক পাকিস্তান-বধ এর পর, পাকিস্তানকে কি না আর হারানোই গেল না, দেড় দশক ধরে ! চোখ কপালে উঠার মতোই ব্যাপার ।
অবশেষে সেই পাকিস্তানকেও হারালো বাংলাদেশ । প্রায় ষোল বছর পর । তাও আবার এক-দুই ম্যাচ নয়, টানা চার চারটি ম্যাচ । তিনটি ওডিয়াই ও একটি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে স্রেফ উড়ে গেল যেন পাকিস্তান ।
মাহমুদুল্লাহর বিশ্বকাপ-ফর্ম কিভাবে যেন হাত বদল হয়ে তামিমের কাছে চলে আসে । আর সেই উত্তুঙ্গ ফর্ম দিয়ে, তামিম পাকিস্তানি বোলারদের গুড়িয়ে দেন টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফর্মেটেই । ওয়ানডে সিরিজে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরীর সাথে তৃতীয় ম্যাচেও ফিফটি তুলে নেন তামিম ইকবাল । আর টেস্টে তো ইমরুল কায়েসের সাথে গড়েন রেকর্ড ৩১২ । নিজেও ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বি-শতক তুলে নেন ।
ওয়ানডে সিরিজে ধবল ধোলাইয়ের পর এক ম্যাচের টি-টুয়েন্টিতে পাকিস্তানকে গুড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ । দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ১-০ তে হারলেও দারুণ লড়াই করে মুশফিকের দল ।
বিশ্বকাপের চমৎকার সাফল্যের ধারা বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়েও অব্যহত রাখে বাংলাদেশ ।

এবার সময় প্রতিশোধের :
এক টেস্ট ও তিন ওয়ানডের সংক্ষিপ্ত এক সফরে বাংলাদেশে আসে, প্রতিবেশী দেশ ভারত । বিশ্বকাপ-জ্বালা তখনও জ্বলজ্বল করছে, প্রতিটি বাংলাদেশীর বুকে । চারদিক থেকে রব উঠে, ‘প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ’ । জোচ্চুরির প্রতিশোধ, অন্যায়ের প্রতিশোধ, নির্লজ্জ-পক্ষপাতের প্রতিশোধ ।
খেলোয়াড়রাও সেই প্রতিশোধ-অনলে পুড়ছিলেন কি না, কে জানে ! তবে প্রথম ম্যাচে সৌম্য-তামিম যেভাবে ছিঁড়ে-খুড়ে শেষ করে দিতে চাইলেন ভারতীয় বোলারদের, তাতে তাদের জ্বুলুনিটা বেশ বোঝা গেল । আগ্রাসী ক্রিকেটের অনন্য প্রদর্শনে বাংলাদেশ ভারতকে প্রথম ম্যাচেই গুড়িয়ে দেয়, ব্যাটে-বলে সমানতালে । মুস্তাফিজুর রহমান নামের এক বিস্ময় বালকের অফ কাটারে কাটা পড়তে থাকে একের পর এক বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যান ।
টানা দুই ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে সিরিজ নিজেদের গড়ে নেয়, মাশরাফি বিন মর্তুজার বাংলাদেশ । সিরিজের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে গেলে, ধবল ধোলাই থেকে কোনমতে রক্ষা পায় ধোনীর মহাভারত ।
ফিয়ারলেস ক্রিকেটের ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর বলা হতে থাকে, এই অসাধারণ-অপরাজেয় বাংলাদেশকে ।
সিরিজের একমাত্র টেস্টের বেশীর ভাগ সময় বৃষ্টি মাঠে থাকায়, নিস্প্রাণ ড্রতেই পরিসমাপ্তি ঘটে টেস্টটির ।

যে সিরিজ নিল অগ্নি-পরীক্ষা :
বিশ্বকাপ পারফর্ম্যান্স ও এরপর পাকিস্তান-ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত ক্রিকেট উপহার দেয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ উঠে যায় অনন্য উচ্চতায় । তাই দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের জন্য আক্ষরিক অর্থেই অগ্নি পরীক্ষার । শক্তিমত্তায় বহুগুণে এগিয়ে থাকা দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ কেমন করে, সেটা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব ক্রিকেট ।
দুই ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজে দক্ষিন আফ্রিকার কাছে পাত্তাই পেল না, বাংলাদেশ । প্রশ্ন উঠল, বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে । ক্রিকেটাররা নিজেরাই সন্দিহান হয়ে পড়লেন, নিজেদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে । সমর্থকরাও যেন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন, প্রিয় দলের অসহায় আত্নসমর্পণে ।
ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেও পুনরাবৃত্তি হলো, টি-টুয়েন্টি সিরিজের । কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই প্রবলভাবে ফিরে আসল বাংলাদেশ । দক্ষিন আফ্রিকার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে, নিতান্ত ক্লাব-দলের মতো করে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ । একই ধারায় তৃতীয় ম্যাচেও দাপুটে জয় তুলে নিয়ে ওডিয়াই সিরিজ নিজেদের করে নেয়, ফিয়ারলেস ক্রিকেটের ধারক-বাহকরা । সৌম্যর লাগামহীন আগ্রাসনে উত্তাল হলো মিরপুর থেকে সাগরিকার গ্যালারি ।
পাকিস্তান, ভারতের পর দক্ষিন আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তিও পরাজিত হলো, বাংলাদেশের কাছে । বিশ্ব যেন শুনতে পেল এক নতুন ক্রিকেট-পরাশক্তির আগমনী গান ।
দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের আট দিনই বৃষ্টি নিজের করায়ত্বে রেখে দিলে, আর কি করার থাকে ! অনুমিতভাবেই ড্র জুটে টেস্ট দুটির ভাগ্যে । মুশফিকরা হারায়, আমলা-প্লেসিসদের বিপক্ষে সত্যিকারের ‘টেস্ট’ এ অংশ নেয়ার সুযোগ ।

অপেক্ষা, হতাশা ও আক্ষেপ :
অক্টবরে অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ । স্মিথের ‘নবীন’ অস্ট্রলিয়ার বিপক্ষে মুশফিকের অপেক্ষাকৃত ‘প্রবীণ’ বাংলাদেশের লড়াইটা দেখার জন্য, অপেক্ষায় ছিল এই দেশের ক্রিকেট-বুভুক্ষু জনগোষ্ঠী ।
সব অপেক্ষায় যেন হঠাৎ জল ঢেলে দেয়া হলো । নিরাপত্তাজনিত-কারণ দেখিয়ে সফর স্থগিত করে বসল, ক্রিকেট অস্ট্রলিয়া । চারদিকে যেন হাহাকার ও হতাশার বান ডেকে গেল । দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সর্বোচ্চ-মাত্রার নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হলেও, সেই আশ্বাসকে পায়ে ঠেলে সফরে আসল না অস্ট্রলিয়া ।
আক্ষেপ ও হতাশায় মুষড়ে পড়ল, এই অঞ্চলের খেলা-পাগল জনতা ।
অবশ্য অস্ট্রলিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরবর্তী কোন এক সময়ে তাঁরা বাংলাদেশে আসবে । এবং নির্ধারিত সিরিজে অংশ নেবে ।

বছরান্তেও বহমান সাফল্যধারা :
অস্ট্রলিয়া সফর পেছানোয়, বিসিবি তড়িঘড়ি করে আমন্ত্রণ জানালো জিম্বাবুয়েকে । তিনটি ওয়ানডে ও দুটি টি-টুয়েন্টি ম্যাচের সংক্ষিপ্ত এক সফরে আসতে । জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড সেই আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহন করে এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল আসে সপ্তাহ-দেড়েকের এক ছোট্ট সফরে ।
বছরের শুরুতে বিশ্বকাপে যে সাফল্য ধারার সূচনা হয়েছিল, বছরের শেষ দিকেও সেই সাফল্যধারা চলতে থাকে আপনগতিতে ।
তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই বিশাল ব্যবধানে জিম্বাবুয়েকে পরাজিত করে সিরিজ সূচনা করে বাংলাদেশ । দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচেও দাপটের সাথে জয় তুলে নিলে, ধবল ধোলাইয়ের শিকার হয় জিম্বাবুয়ে । একেক সময় একেক জনের হাত ধরে জয়ের কক্ষপথে হেঁটেছে বাংলাদেশ । তামিম, কায়েস, মুশফিক, আল আমিন, সাকিব, মাশরাফি, মুস্তাফিজ... পুরোটাই যেন সম্মিলিত দলগত শক্তির ফসল ।
টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচও জিতে নেয় বাংলাদেশ । তবে দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়ালার-মেদজিবার ব্যাট, বাংলাদেশকে জয়ের ধারায় ভাসার সুযোগ দেয়নি । দ্বিতীয় টি-টুয়েন্ট ম্যাচ হেরে ১-১ এ সিরিজ শেষ করে, মাশরাফির দল ।



শেষটা হয়তো মনমতো হয়নি । তবে বছরজুড়ে যে অসাধারণ সাফল্য উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ, তা কিভাবে ভুলে যাবে সমর্থকরা ! উদ্দাম-আগ্রাসনের সাথে কূশলী ক্রিকেটের যে যুগলবন্দী, তা হয়তো চিরস্থায়ী ছাপ বসিয়ে দিয়েছে অনেকের মনে । বড় বড় ক্রিকেটবোদ্ধারা তো বাংলাদেশকে এমনি এমনি বলেননি, “ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর অব ফিয়ারলেস ক্রিকেট” ! আক্ষরিক অর্থেই ভয়ডরহীন ক্রিকেটের চমৎকার বিজ্ঞাপণ ছিল এই বাংলাদেশ ।
এই বাংলাদেশকে ভুলে যাওয়া কঠিন । ভীষণ কঠিন । বাংলাদেশকে স্বর্ণালী সময় উপহার দেয়া এই ২০১৫ সালটাকেও ভুলে যাওয়া হয়তো কঠিন ! অভুলনীয় কিছু সুখের সময় যে উপহার দিয়েছে এই বছর । সাফল্য আর সুখস্মৃতিতে ভরিয়ে দিয়েছে যে এই ২০১৫ ।


আগামী দিনেও চলতে থাকুক সাফল্যের এই ধারা । অনাগত বছরগুলো ছাড়িয়ে যাক, এই বছরটাকেও ।
দীর্ঘজীবি হোক, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যধারা । দীর্ঘজীবি হোক, এই ভয়ডরহীন ক্রিকেট । দীর্ঘজীবি হোক, এই লাগামছাড়া দৃষ্টিনন্দন আগ্রাসন ।

__________
__________

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.