নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

মোঃ ইয়াসির ইরফান

পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালোবাসতেন অথবা সব কবি যদি রাজনীতিবিদ হতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। -জন এফ কেনেডী

মোঃ ইয়াসির ইরফান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ সে রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা

০৯ ই মে, ২০১৭ রাত ১০:১৯

হলের ব্যালকনি দিয়ে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে আছে শফিউল। পড়ার টেবিলে খোলা পড়ে আছে ল্যাব শীট, অর্ধেক লেখা ল্যাব রিপোর্ট আর দুটি বই। বি, পি লাথির কমিউনিকেশন বইয়ের পাশেই রয়েছে নাগপালের পাওয়ার প্লান্ট বইটা। ল্যাব রিপোর্ট জমা দেয়ার সাথে সাথে কালকে দুইটা ক্লাস টেস্টও দিতে হবে ওর।
মাথায় ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছে শফিউলের। একসাথে চারটা রিপোর্ট লিখতে বসেছিল সে, আড়াইটা লেখা হয়েছে। আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অসহ্য ব্যথায় কাঁদছে ভেতরটা, পৃথিবীকে বড় নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কি যে কষ্ট এই পড়ালেখা!
রেললাইনটাকে এখান থেকে স্পষ্ট দেখছে পাচ্ছে শফিউল। কিছুক্ষণ পরই একটা ট্রেন আসবে বোধহয়। আচ্ছা, রেললাইনে মাথা পেতে দিলে কেমন হয়? হঠাৎ নচিকেতার একটা গান মনে পড়ে যায় শফিউলের, ‘রেললাইলে বডি দেব মাথা দেব না।’ তাহলে কি ও শুধু বডি দেবে?
মাথার ভেতরে যেন হাতির নাচন চলছে। দপদপ করে ব্যথা করছে, সহ্যসীমা পার হয়েছে অনেক আগেই। কি যে করবে ভেবে পায় না, শফিউল। মায়ের কথা মনে পড়ে তার। বাড়িতে থাকলে মাথাটা মায়ের কোলে এলিয়ে দিয়ে বলতে পারত, একটু হাত বুলিয়ে দিতে। শফিউল আগেও দেখেছে, মা একটু হাত বুলালেই অনেকটা প্রশান্তি পায় সে। বড় ভালো লাগে তখন! মরার এই হোস্টেলে সে সুযোগ কোথায়!

***

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শফিউল। রুমমেটদের একজন নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে। আরেকজন মুভি দেখায় ব্যস্ত। অন্যজন কোথায়, কে জানে! রুমে নেই এখন।
সে আস্তে করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকে রেললাইনটাকে আরো স্পষ্ট লাগছে। ল্যাব ক্লাসে স্যার আজকে ইচ্ছেমতো ঝেড়েছেন, সে অসহায় হয়ে শুনেছে সব। জুনিয়রদের সামনে কত কথা শুনতে হয়েছে তার! তখনি মনে হয়েছিল, হাতের কাছে কোন হাতুড়ি থাকলে, নির্ঘাত সে নিজেকে মেরে দিত ওটা দিয়ে। লজ্জায়, ক্ষোভে, রাগে, অপমানে রীতিমতো কাঁপছিল সে। ভাগ্যিস স্যার থেমে গিয়েছিলেন, নইলে ওখান থেকে ছুটে বের হয়ে যে লাফ-টাফ দিয়ে দিত না, তা কে বলতে পারে!
ব্যালকনি দিয়েও লাফ দেয়ার একটা বাসনা এইমাত্র উঁকি দিয়ে, আবার লুকিয়ে গেল। তিনতলা থেকে লাফ দিলে সে মরবে না নিশ্চয়? তাহলে শুধু শুধু হাত-পা ভেঙে আর লাভ কি? এক্কেবারে কর্ম সাবাড় হলেই না শান্তি!
একবার ভাবে, সিঁড়ি বেয়ে ছয় তলার ছাদে চলে গেলে কেমন হয়? অত উপর থেকে ঝাঁপ দিলে নিশ্চয় মরবে। আচ্ছা, আশেপাশে তো পাহাড়ও আছে। পাহাড়ে উঠে কি একটা চেষ্টা করবে? নাকি পুকুরে বা খালে একটা চেষ্টা চালাবে? সে তো সাঁতার জানে না, তাহলে নিশ্চয় ডুবে মরবে।

***

দারুণ বাতাস আসছে, ফ্যানটাও ঘুরছে বনবন করে। তবুও ঘেমে যাচ্ছে শফিউল। কেন, কে জানে! ফ্যানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। আরে, এটা এতক্ষণ মাথায় আসেনি কেন? ফ্যানের সাথে ঝুলে গেলেই তো হয়! নাহ, রুমমেটরা কখন আবার দেখে-টেখে ফেলবে, একটা কেলেংকারী ঘটে যাবে। অত ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই, বাবা।
ভীষণ অস্থির বোধ করছে শফিউল। মাথাটা দপদপ করে জ্বলছে। চারপাশ অসহ্য লাগছে। কানে কে যেন বারবার বলে যাচ্ছে, বেঁচে থেকে কি লাভ? নাহ, বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। মরে যাবে সে। এত দুঃসহ যন্ত্রণা, অস্বস্তিকর অপমান নিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। কে যেন গেয়েছিলেন, ‘জীবন মানে যন্ত্রণা, নয় ফুলের বিছানা।’ ভুল বলেছিলেন। আসলে গাওয়া উচিৎ ছিল, জীবন মানে মহাযন্ত্রণা, বিষাক্ত কাঁটার বিছানা! বড় কষ্ট লাগছে শফিউলের, বড় যন্ত্রণা হচ্ছে তার।

***

চারদিকে মৃত্যুর, যন্ত্রণার, কষ্টের কত উপকরণ সাজানো গোছানো, কেবল বেঁচে থাকার কিছু নেই কোথাও।
শফিউলকে পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ডাকছে বিল্ডিংয়ের ছাদও। ফ্যান যেন প্রতি ঘূর্ণনেই বলছে, ‘ঝুলে পড়, ঝুলে পড়।’ ব্যালকনি দিয়ে নীচে তাকায় সে, মাটি যেন তাকে বুক পেতে, দু’হাত বাড়িয়ে বলছে, ‘আয়… আয়।’ হনহন করে ছুটে নেমে আসে শফিউল।
বেরোনোর সময় গার্ড চাচার সামনে পড়ে যায়। ঠোঁটটা একটু প্রসারিত করে সে। চাচা বোধহয় সেটাকে হাসি বলেই ধরে নিয়েছেন। শফিউল দেখতে পায়, গার্ড চাচা কেমন দন্ত বিকশিত করে বিশাল হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। দাঁড়িয়ে না থেকে রেললাইনের দিকে গটগট করে হাঁটতে থাকে শফিউল। সে ঠিক করে ফেলেছে, রেলের নীচেই মাথা দেবে সে। ঝাঁপ-টাপ দিলে মরার নিশ্চয়তা নেই। শেষে আবার পঙ্গু-টঙ্গু হয়ে আরেক যন্ত্রণায় পড়তে হবে। তার চেয়ে রেললাইনই ভালো। নিমিষেই কার্য শেষ।

***

রেললাইনটাকে কেমন যেন লাগছে! কি স্নিগ্ধ যে দেখাচ্ছে! পরিবেশটাকেও কেমন অন্য কোনো লোকের মনে হচ্ছে, যেন এখানে পার্থিব বলতে কিছু নেই।
হঠাৎ বুঝি এর কারণ টের পেয়ে যায় শফিউল। চট করে উপরের দিকে তাকিয়ে, আর চোখ ফেরাতে পারে না সে। ঠিক মাথার উপরে শ্বেত থালার মতো চাঁদটা যেন তার জন্যেই সবটুকু রুপ মেলে ধরে ঝকমকিয়ে হাসছে। কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শফিউল, তারপর আস্তে করে চোখ নামিয়ে চারপাশটা আরেকবার দেখে নেয়। কি এক নৈসর্গিক অবস্থা বিরাজ করছে এখানে! এতক্ষণ খেয়াল হয়নি কেন?
দূরে কোথাও হতে ভেসে আসে ট্রেনের আওয়াজ। শফিউল বুঝতে পারে ট্রেন আসছে। সে দাঁড়িয়ে থাকে, রেললাইনে। ট্রেন আসে, চলে যায়।
শফিউল মুগ্ধ হয়ে দেখে, জোছনাকে কেমন অঙ্গে মেখে নিয়ে চলে গেছে ট্রেনটা। এবার তার পালা। সেও মন ভরে গায়ে জোছনা মেখে নেয়। চারদিকে কেমন এক অপার্থিব, অলৌকিক সৌন্দর্য্যের ছড়াছড়ি।
শফিউলের মনে হয়, বেঁচে থাকাটা কতই না আনন্দদায়ক!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.