নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

মোঃ ইয়াসির ইরফান

পৃথিবীর সব রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালোবাসতেন অথবা সব কবি যদি রাজনীতিবিদ হতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারত। -জন এফ কেনেডী

মোঃ ইয়াসির ইরফান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাবা দিবসের একদিন...

১৮ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১:৩২

'‘ফজর হয়ে গেছে, আব্বা। আপনার কি ঘুম ভাঙছে?’ জানালাগুলো খুলতে খুলতে বলে আদনান। আকমল সাহেবের ঘুম ভেঙেছে আযানের সময়ই। লাইট জ্বালিয়ে দেয় আদনান। চোখ পিট পিট করে তাকান আকমল সাহেব। ছেলেটাকে নিয়ে বড় বিপদে আছেন। বাড়াবাড়ি পর্যায়ের বিরক্ত করে ছেলেটা।
আদনান কাছে এসে আকমল সাহেবকে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে তুলে বসায়। আকমল সাহেব কথা বলতে পারেন না। স্ট্রোকে হারিয়েছেন কথা বলার শক্তি। কথা বলার শক্তি থাকলে তিনি এই ছেলেকে ঠিক শায়েস্তা করে ছাড়তেন।

ছেলের সাথে আস্তে আস্তে তিনি মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকেন। খুব জোরে হাঁটতে পারেন না। পা-ও যেন ঠিকমতো বসে না। তবে আদনান শরীরের ভর অনেকটাই নিয়ে নিয়েছে। তবুও মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁর হাঁপ ধরে যায়। আকমল সাহেবকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এই মানুষটির ভয়ে একসময় পরিবার তো বটেই তটস্থ থাকত সমাজ, থরথর করে কাঁপত বিশাল এক এলাকা। এলাকার মানুষ এখনও আকমল সাহেবকে বেশ শ্রদ্ধা করে, দেখলেই সালাম দিয়ে সামনে থেকে সরে যায়।

নামাযের পরে আকমল সাহেব দেখেন, তাঁর ছেলে আদনান মসজিদের বারান্দায় কাদের সাথে যেন কথা বলছে। কি সব সমস্যার সমাধান করছে। আকমল সাহেবের জায়গাটা এখন আদনান নিয়েছে। এই সমাজের সমাজপতি এখন আদনান।
ছেলের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আকমল সাহেব। কেমন সবগুলো দাঁত বের করে হাসছে আদনান। ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড়ে হারামজাদার সবগুলো দাঁত ফেলে দেন। খুব পিতৃভক্তি দেখানো হচ্ছে, না? ব্যাটা বদের হাড্ডি। তোকে আমি চিনি না। আমার জায়গায় বসে, এখন খুব ভাব নেয়া হচ্ছে? বাকশক্তিটা ফিরে আসুক, তারপর তোকে দেখে নেব। ভাবেন আকমল সাহেব।
ছেলের উপর রাগ আরো বেড়ে যায় তাঁর, কি সব ছোটলোকের সাথে তাঁর ছেলে কাঁধে কাঁধ মেলাচ্ছে, হাত মেলাচ্ছে। এইসব ছোটলোকেরা সবসময় তাঁর থেকে পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলত। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আকমল সাহেব, সেখানে ছেলের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর প্রচন্ড ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার।

‘আব্বা, চলেন বাড়ি যাই।’ আদনান ধরে ধরে দাঁড় করায় আকমল সাহেবকে। ‘আপনি কি হাঁটতে পারবেন নাকি পিঠে তুলে নেব?’ জিজ্ঞেস করে আদনান। ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকেন আকমল সাহেব। মনে মনে বলেন, ব্যাটা ধড়িবাজ! জুতিয়ে তোর মুখের সাইজ বদলে দেব, হারামজাদা। মানুষের কাছে মহান হওয়ার ধান্দা সব। আমি বুঝি না মনে করেছিস?
তাঁর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে খুব। একটু পর আদনান তাঁকে পিঠে তুলে নেয়। ছেলেটা কিভাবে যেন তাঁর কখন কি দরকার ঠিক বুঝে নেয়। তিনি বুঝতে পারেন না, এই রোগা-পটকা ছেলেটা কিভাবে তাঁকে হুটহাট কোলে তুলে নেয়। খেয়ে খেয়ে বন্য মোষের মতো শক্তি করছে বোধহয়।

সকালের নাস্তাটা আদনান নিজেই তৈরী করে দেয়। আকমল সাহেবের স্ত্রী সুফিয়া যখন বেঁচে ছিলেন তখন তিনিই করতেন। সুফিয়ার মৃত্যুর পর বেশ কয়েকদিন খাওয়া দাওয়া করতে পারেননি আকমল সাহেব। কারণ, তাঁর মুখে কোন খাবারই রোচত না। তখনও আকমল সাহেব বেশ সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন। নানান জায়গার খাবার আনিয়ে খেয়ে দেখেছেন, খেতে পারেননি। পরে আদনান নিজেই খাবার তৈরী করে দেয়। সেটাই মুখে তুলতে পারেন আকমল সাহেব। সেদিনই পিতা-পুত্র প্রথম বুঝতে পারে, আদনান সুফিয়ার রান্নার হাত পেয়েছে।

সুফিয়ার সাথে নির্ঝঞাট সংসার ছিল আকমল সাহেবের। তিনি বাইরের পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সংসার নিয়ে তাঁকে কখনোই ভাবতে দেননি সুফিয়া। নিজের মতো চালিয়ে নিতেন তিনি। ছেলেটাকেও বোধহয় নিজের মতো করেই মানুষ করেছে সুফিয়া। নইলে তাঁর ছেলে কেন অমন ভেড়া টাইপ হবে? আর দশজন সাধারণের মতো হবে?
সুফিয়ার প্রতি তাঁর কোন রাগ ছিল না। রাগ করার মতো মানুষই ছিলেন না সুফিয়া। কিন্তু একবার এমন এক কান্ড করলেন যে, আকমল সাহেবের ইচ্ছে করেছিল সুফিয়াকে গলা টিপে মেরে ফেলতে।

রাহেলা ছিলেন তাদের গৃহপরিচারিকা। সুফিয়া হঠাৎ একদিন এসে বললেন, ‘রাহেলা তো মা হচ্ছে।’
‘তো?’
‘ওর আসলে বিয়ে হয়নি। তো কিভাবে কি করা যায় একটু জানতে চাচ্ছিলাম।’ নির্বিকার ভাবে খাটের পায়া মুছতে মুছতে বলেছিলেন সুফিয়া।
শুনে এমন রাগ উঠল আকমল সাহেবের। পারলে তখনই জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন সুফিয়াকে, রাহেলাকেও হয়তো। ‘যার বিয়ে হয়নি, তার বাচ্চা মানে বুঝতে পারছ না তুমি? বের করে দাও, হারামজাদীকে। বলে দিও, আমার ঘরে ওসব পাপাচার আমি সহ্য করব না।’ বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন আকমল সাহেব। তিনি ভেবেছিলেন ঝামেলা সেখানেই শেষ। কিন্তু ক’দিন পর তাঁর কানে এলো, সুফিয়া নাকি রাহেলাকে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাঁর বাচ্চার যেন কোনো সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছে।
তিনি সরাসরি সুফিয়াকে বলে বসলেন, ‘বজ্জাত মেয়েটাকে নিয়ে কোন আক্কেলে এত আদিখ্যেতা করছ?’
সুফিয়া চুপ করে থাকেন। কিছু বলেন না। উত্তর না পেয়ে রাগ আরো বেড়ে যায় তাঁর। তিনি আবার বলে উঠেন, ‘আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি। হতচ্ছাড়ীকে কিভাবে এলাকা ছাড়া করতে হয় আমার জানা আছে।’
‘তাহলে আমি আর বাবুও ঘর ছেড়ে চলে যাব।’ যেন আগে থেকে ঠিক করে রাখা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন, এমন ভঙিতে কথাটা বলেই চলে যান সুফিয়া। সুফিয়া যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর সব যন্ত্রণা সহ্য করলেও, সুফিয়ার মৃত্যুর পরপরই তিনি রাহেলাকে তাড়িয়ে দেন এলাকা থেকে। সমাজে নষ্ট মেয়ে ছেলে থাকলে, সমাজও নষ্ট হয়ে যায়।

আদনান সকালের নাস্তা নিয়ে আসে। হাতে বানানো রুটি আর ঘন করে রান্না করা মশুরের ডাল। হাতে তেমন জোর নেই বলে, পাশে বসে আদনানই খাবার খাইয়ে দেয় আকমল সাহেবকে। ‘আব্বা, চিবোতে পারছেন তো? রুটি শক্ত হয়নি তো বেশী?’
আদিখ্যেতা! রাগে গা জ্বলে যায় আকমল সাহেবের। তিনি চুপচাপ খেতে থাকেন। রুটি পর্ব শেষ করে ওষুধ নিয়ে আসে আদনান। ওষুধ খাইয়ে চা আনতে চলে যায় সে।

আকমল সাহেবের স্ট্রোকের সময়টা স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বসার ঘরে বসেছিলেন। আদনান ঢুকতেই হুংকার দিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘তুই রাহেলাকে এই বাড়িতে এনে তুলেছিস কেন?’
আদনান মাথা নীচু করে বলেছিল, ‘আসলে আব্বা, আম্মাও নেই। তাই ভাবলাম ঘর-টর দেখাশোনার জন্য একটা পুরনো মানুষ দরকার...’
কথা থামিয়ে দিয়ে আকমল সাহেব চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘এখানে কি মানুষের অভাব হয়েছে?’
‘না, তা হয়নি। তবে উনি থাকলেও তো কোনো সমস্যা...’
‘আছে। সমস্যা আছে। আমার ঘরে কোনো ধরণের পাপ আমি ঢুকতে দেব না। বের করে দেয় ওকে।’
আদনান তেমনই ঠান্ডা স্বরে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘তা আর হয় না, আব্বা। আমাদের উত্তরাধিকার বেড়ে উঠছে তাঁর কোলে। সুতরাং...’
‘চুপ কর হারামজাদা। তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে, কুত্তাকে দিয়ে খাওয়াব আমি।’ তিনি রাগে রীতিমতো কাঁপছিলেন তখন।
তেমনই নির্লিপ্ত স্বরে জানিয়ে দিয়েছিল আদনান, ‘আমি আম্মাকে কথা দিয়েছি আব্বা। আমাকে মাফ করবেন।’
‘তোর মাফ আমি তোর পেছন দিয়ে...’
‘তাহলে আমার যে ঘর ছাড়তে হয় আব্বা।’
‘তুই আমাকে আব্বা ডাকিস কোন মুখে? বদমাইশ কোথাকার, হারামজাদা, বজ্জাত...’ বলতে বলতেই তিনি কখন যে স্ট্রোক করে বসেন, প্রথমে আদনান বুঝতেই পারেনি।

আকমল সাহেব চা খেতে খেতে দেখেন তাঁর সামনে ফুটফুটে এক বাচ্চা এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে আদনান। ‘বাবু ওই দেখো, ওটা কে? বলো, আব্বা...’
‘আব...বাবাহ’ আবার চেষ্টা করে আদনান। আবার ‘আব...বাবাহ’। আবার চেষ্টা করে। এখনও তার জিহ্বা তাকে ‘আব্বা’ ডাকতে সায় দিচ্ছে না বোধহয়।
আদনান বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। আকমল সাহেবের কাছে গিয়ে বলে, ‘আব্বা, আজকে নাকি বাবা দিবস। তাই ও এসেছে। আপনাকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে।’
বাচ্চাটার দিকে স্থির তাকিয়ে তাকেন আকমল সাহেব। তাঁর ভাবলেশহীন চোখ থেকে তপ্ত নোনা জল গড়িয়ে নামে।

আদনান কাছে এসে বসে। ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, আব্বা? অনেক হয়েছে আর না। এবার থেকে ঠিকঠাক আপনার চিকিৎসা করাব। আপনাকে বিদেশ নিয়ে যাব। আপনি আবার সুস্থ হবেন, কথা বলবেন। অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে, আর না। আমাকে মাফ করে দেন, আব্বা। মাফ করে দেন।’ আকমল সাহেবের পা ধরে কাঁদতে থাকে আদনান। কাঁদেন আকমল সাহেবও। দূর্বল হাতটি বহু কষ্টে আদনানের মাথায় রাখার চেষ্টা করেন।
বহুদিন পর ছেলের দিকে তাকাতে তাঁর একটুও রাগ হচ্ছে না। একটুও না।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.