নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একটি মানবিক পাখি, প্রকৃতি ও প্রেমিক কর্তৃক আহূত হয়ে হঠাৎ হঠাৎ আছড়ে পড়ি ভূ-পৃষ্ঠে তবুও মানুষের জীবনে ফিরে আসার সাধ নাই আর।

চন্দ্রনিবাস

খসে পড়া নক্ষত্রের দেহে পুনঃসংযুক্ত হইবার আশায় চন্দ্রপথে একাকি খুঁজিতেছি অতীত।

চন্দ্রনিবাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

সবুজ তাপস: এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যভ্রমণ- বুক রিভিউ

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৮


এক।
আমার ব্লগটি প্রথম পাতায় প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়েছে তাই আমি চাইছি আমার পোস্টখানি আপনাদের সামনে আবারো তুলে ধরি। পোস্টখানি যদিও বড়। কারণ অনেক সময় নিয়ে লিখতে হয়েছিলো। তবে কবিতা যাদের ভালোলাগে, তাদের জন্য একজন নতুন লেখককে পরিচয় করিয়ে দিতে আমার এই প্রয়াস। চলুন আবিষ্কার করি নতুন কিছু। আশা করছি ভালো লাগবে।

কবিতা কখন সার্থক হয়ে উঠে এ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হয়তো একটি অমীমাংসিত ও চলমান প্রক্রিয়া। কবিতার দশক বা কাল নিয়েও চলে একরকম দলাদলী, টানাটানি। কবিতা কেন? এ প্রশ্নের উত্তরেও দেখা যায় ব্যক্তি সাপেক্ষে বিভিন্নতা। কারো কারো কাছে কবিতা কেবল সুন্দরের। কারো কারো কাছে পাঠকের হাহাকারের সমান হয়ে উঠে কবিতা। কারো কারো কাছে কবিতা জীবনের সমান। আমার মনোপটেও কবিতার একটি নিজস্ব আখ্যা তৈরি হয়েছে। কবিতা জীবনের বা সময়ের ভেতরে থেকেও জীবন ও সময়ের উর্ধ্বে আকাঙ্খিত ও অনুভূত এক জীবন-সময়ের কথা বলে। আমার কাছে তাই সার্থক কবিতা হলো, যে কবিতার আমার বোধে যাতায়াতের সামর্থ্য আছে, ছুঁতে পারে আমার সীমাবদ্ধতাকে, হাহাকারকে, সুন্দরকে। যে কবিতা আমার অনুভূতি ধরে টানে, সুন্দরকে আরো সুন্দর এক দৃশ্যপটে চোখের সামনে আনে, হাহাকারকে শারীরিক বাস্তবতায় শূণ্যতার সৃষ্টি করে; এমন। আমার কাছে তাই কবিতা মাত্রই স্থান ও কালোর্ধ্ব একটি শ্বাশত সুন্দর দৃশ্যপট, যার যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতা আছে মানুষের মনোজগতের সাথে বাইরের দৃশ্যত বা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য অনুভূত জগতের।

পাঠক হিসেবে আমি সৌন্দর্যভ্রমণপ্রিয়। সৌন্দর্যভ্রমণে মানসিক শান্তি ও চিত্তানন্দ আসে। লেখকের বোধের পথে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা জ্ঞানার্জনও হয় অবশ্য। বই-পত্তর পড়ি অল্প বিস্তর। তবে সচেতন পাঠক নই যে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ইচ্ছে জাগবে। এটি আমার মতন লঘু পাঠকের জন্য দুঃসাহসিক কর্মও বটে। তবুও গত ছ’মাসে যতবারই বিশ্লেষণী বা রিভিউটাইপ কিছু লিখার ইচ্ছা জেগেছে, প্রতিবারই ইচ্ছে ছিলো আমার বন্ধুমহলের সবার সাথে নতুন কিন্তু পরিণত লেখক সবুজ তাপসের ‘সবুজ তাপস’ কাব্যগ্রন্থটিকে তুলে ধরি। সবুজ তাপসের কবিতা আমার ভালো লাগার অন্যতম কারণ, সবুজ তাপস আমাকে আমার মাথার ভেতর চালিয়ে দিয়েছে। অনেকগুলো বইয়ের কপি বয়ে বেড়ানো এক অনুজ, কাব্যপ্রেমিক হিসেবে বইখানি আমার হাতে তুলে দিলে নতুন লেখকের সম্মানার্থে ১৫০ টাকা মূল্য চুকিয়ে সেলফের এক কোণায় ফেলে রেখেছিলাম অনেকদিন। লেখকের নামেই কাব্যগ্রন্থের নাম, যা বাংলা সাহিত্যঙ্গনে এখন অবধি একমাত্র সংযোজন আমার জানামতে- এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে নেহায়েত অনাগ্রহ নিয়ে বইখানি উল্টাতে থাকি।

কাব্যগ্রন্থঃ সবুজ তাপস, প্রকাশকালঃ ২০১৫ ফেব্রিয়ারি, রচনাকালঃ ২০০১-২০১৪, কবিতার সংখ্যাঃ সত্তর, প্রচ্ছদঃ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, অঙ্কনঃ তিলোত্তমা তিতলী ও গোঁসাই পাহলভী, প্রকাশকঃ প্রত্যালীঢ়, মূল্যঃ ১৫০ টাকা। রচনাকালের (২০০১- ২০১৪) দিকে দৃষ্টি পড়লে আটকে যাই। লেখকের চাইতে সাধকই আমার বেশি প্রিয় বলে, পনেরো বছর ধরে সবুজ তাপসের সাধনার ফল ‘সবুজ তাপস’ নিয়ে আগ্রহটা কিছুটা গতিবেগ পেলো যেন। সুন্দর সবুজ প্রচ্ছদের পরে মধ্যাঙ্গুলীর সাথে জিহবার সংযোগের মধ্য দিয়ে সবুজ তাপসে চলতে থাকি। লেখক যখন তার প্রচারবিমুখ কবিতায় কহিলেন,

তোমার চুলে আমার হাজার হাজার কবিতা…তুমি চুলগুলো বেঁধে ফেলো। এত সহজ সুন্দর একটা পংক্তির আদতে প্রকাশ পেলো, লেখকের প্রচারবিমুখতা। যেখানে সমসাময়িক লেখকেরা প্রচার পরিচিতির আশায় যেখানেই সুযোগ পাবেন, সেখানেই দু-এক লাইন আবৃত্তি করে দিয়ে তাদের কবিত্বকে জাহির করবেন, সেখানে সবুজ তাপস শুরুতেই ব্যতিক্রমী। একটা কবিতা আমার কাছে তাই হয়ে উঠলো, কবি-অকবির পার্থক্যের সমান, প্রচার-প্রসারপ্রেমী মানুষ ও প্রচারবিমুখ আত্মকেন্দ্রিক সাধকের পার্থক্যের সমান। কবিতাটির সহজ-সাবলীল কথনেরও প্রেমে পড়ে যাই।

দুই।
যদিও প্রথম ও নতুন প্রকাশিত হওয়া একজন লেখকের লেখক হয়ে উঠা নিয়েই যতো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! সে পথে না হেটে তাই কবিতার আনন্দভ্রমণে সবুজ তাপসকে কেন সমসাময়িক অন্য লেখকদের চেয়ে আমি বেশি নম্বর দিতে আগ্রহী সে ব্যাপারে আমার মতামতের পক্ষে সবুজ তাপসের কবিতার পংক্তি উল্লেখপূর্বক আমি আমার যৌক্তিক কৈফিয়ত দিয়ে এই লিখার কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বইটির কৈফিয়তে সবুজ তাপস বলেছেন ‘আমাকে আমি আবিষ্কার করি ২০০১ সালের দিকে।‘ নিজেকে আবিষ্কারের নেশা থেকেই সবুজ তাপস নিরন্তর নিজের গভীরে প্রবেশ করেছেন, ইতিহাসের পথে প্রান্তরে হেটেছেন, হেঁটেছেন উৎসমুখী। ‘কাব্যের উৎসর্গঃ সবুজ মিয়া, যার ভেতরের দুনিয়ায় আমি হতে পেরেছি সবুজ টিয়া'। (সবুজ তাপসের প্রকৃত নাম সবুজ মিয়া) সবুজ তাপস কী উৎসর্গে সেই মানুষটাকে স্মরণ করেছেন যার ভেতরে তাপস হয়ে উঠেছেন সবুজ তাপস! প্রচ্ছদেও রয়েছে একখণ্ড সবুজ, এতে কাব্যগ্রন্থটি হয়ে উঠেছে আরো দর্শনীয়। কবি ময়ুখ চৌধুরী বইটি হাতে নিয়ে বহুকালের আক্ষেপের সমাপ্তি টেনে বলেছেন, ‘বহুদিন প্রচ্ছদে সবুজ দেখিনা…’।

তিন।
চারখণ্ডে সাজানো ‘সবুজ তাপস’- খণ্ড-বিখণ্ড ভূখণ্ড, বাঁচনভঙ্গি, সালফিউরিক আবেগ ও সবশেষে, পাতার গান। ৭০ টি কবিতায় আছে বাংলার ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতি, জৈবনিক জটিলতা, শৈশব, কৈশোর, স্বদেশপ্রেম, প্রকৃতি, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, কাম, প্রেম, সর্বোপরি জীবন। দৃষ্টান্তবাদ নামক লোকায়ত দর্শনের জনক সবুজ তাপসের বেশিরভাগ কবিতার ঢং- দৃষ্টান্তবাদী। সবুজ তাপসের কবিতাজুড়ে আত্মধ্যানমগ্নতার প্রকাশ। তার স্বপ্নাদ্য সিরিজের কবিতাগুলো পরাবাস্তববাদী। তাপসের কবিতা একটা নিজস্ব ধরনে ছোট ছোট শব্দচয়নে-ছন্দে এগিয়ে যেতে থাকে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের কবিতা হওয়ায় তার কবিতা পড়ার জন্যে পংক্তি ধরে ধরে অনেকটা পথ হেটে যেতে যেতে ক্লান্তি আসে না। অল্প কথায় গভীর তত্ত্বের প্রকাশের প্রতি তাপসের ঝোঁক রয়েছে। শব্দের জন্যে তাপস অনেকক্ষেত্রে অভিধানের বাইরে এসে নিজেই শব্দে-শব্দে বিয়ে পড়িয়েছেন, নতুন শব্দ রচনা করেছেন। শঙ্খবাস (সংখ্যা ২, ২০১০) নামক লিটল ম্যাগাজিনে তাপসের প্রকাশিত গদ্য দৃষ্টান্তবাদী দৃষ্টিতে কবিতার সৌন্দর্যোপভোগযাত্রা-এ তিনি নতুন শব্দ তৈরির ব্যাপারে তার আগ্রহের পক্ষে এভাবে যুক্তি তুলে ধরেছেন, “যিনি কবি, একজন স্রষ্টা, যুক্তিধর্মরাকারী শব্দনির্মাণকাজ তার সৃষ্টিশীল চরিত্রের পরিচায়ক।“

চার।
আত্মমগ্ন সবুজ তাপস পনেরো বছর ধরে রচনা করেছেন, ‘সবুজ তাপস’। পনেরো বছর ধরে নিজেকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ভেঙ্গেছেন যতটা গড়তে চেয়েছেন তার চেয়ে বেশি। সমসাময়িক অনেক লেখকই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ পরিচিতি লাভ করলেও সবুজ তাপস থেকেছেন আড়ালে। সময়ে সময়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশিত হলেও নিজেকে আড়ালে রেখে প্রচারবিমুখ থেকে করেছেন সবুজের তপস্যা-

‘প্যাঁচার মতোন অন্ধকারে থাকি, অন্তরালে ডাকি-
নিজের কাব্যরসিক কেবল নিজেই হতে চাই,……
যদি আমার হও, তুমি চুলগুলো বেঁধে ফেলো,”
(প্রচারবিমুখ, সবুজ তাপস)

পাঁচ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের প্রাক্তন ছাত্র সবুজ তাপসের কবিতা দার্শনিকতাপূর্ণ। কোনো কোনো কবিতা দর্শন হয়ে উঠতে চাইলেও তিনি জ্ঞাতসারেই তাকে কবিতা হয়ে উঠতে বাধ্য করেছেন বলে মনে হয়েছে। সবুজ তাপসের কবিতা সহজপাঠ্য নয়। অন্তত আমার জন্য। তার সব কবিতার শরীরে আমি বেশ কয়েকবার বিচরণ করার সাহস দেখালেও, তাদের দেহের বোধে গমন সম্ভব হয়নি। তবুও সুখপাঠ্য বলেই মনে হয়েছে। তত্ত্বজ্ঞানে ভরপুর তার বাক্যশৈলী পাঠকের মনে চিন্তার খোরাক জোগাতে বাধ্য করবে। এমন কিছু পংক্তিমালা পাঠকের সামনে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না।

‘বঙ্গবন্ধুই শেখ মুজিবের প্রকৃত হত্যাকারী’ (মাঝারি, সবুজ তাপস),
“আমি নার্সিসাস নই, নিমগ্ন ঋত্বিক” (প্রশ্নের পিনাক, সবুজ তাপস),
‘নিজেকে ভাবতে হয় পৃথবীর শ্রেষ্ঠ অবতার’ (প্রবোধ, সবুজ তাপস),
‘সক্রেটিস প্রথম নিহত বুদ্ধিজীবী, মানো;’ (তুই এবং তুমি, সবুজ তাপস),
‘কবি হয়ে বলতে পারিনি- ‘রবিগুরু কবিন্দ্রনাথ’’ (ক্ষমতা, সবুজ তাপস),
‘আমার পূর্বপুরুষ পণ্ডিতবহার বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছেন চর্যাপদ রচনা’ (কবিযশোপ্রার্থী, সবুজ তাপস)

ছয়।
ছোট ছোট ছন্দবদ্ধ বাক্যের সাথে গভীর ভাব মিলে সবুজ তাপসের কবিতা একটি ভিন্ন ধারায় প্রকাশ পেয়েছে যেনো। পাঠক নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠবেন সবুজ তাপসের ভেতরের দুনিয়ায় আনমনে বিচরণ করে ইতিহাস, দর্শন, প্রকৃতিবিজ্ঞানের পাঠ নিতে। এ ধ্যানের জন্য তাকে গুহায় যেতে হয়নি। কবিতা নির্মাণে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন জীবনের- প্রকৃতির- সমাজের নানান প্লটের। মাঝির কাছে শিখেছেন বাতাসের বেদ। কবিযশোপ্রার্থী নন সবুজ তাপস। তার চারপাশের জীবনপ্রকৃতিকেই তিনি তার সবুজ তাপস হবার কৃতিত্ব দিতে চান। এমনটাই তিনি তার কবিতায় ঘোষণা করেছেন,

“এই কর্ণফুলিরাই কবি, আমার
চোখ ধরে টানে, পা-দুটো দখলে রাখে নিজস্ব নির্মাণে,
আমার হাত দিয়ে আকড়ে ধরে কবিতার কোমর,
আমি কোনো কবি নই।“ (বাঁচনভঙ্গি, সবুজ তাপস)

সাত।
সবুজ মিয়া তার কবিতায় দৃষ্টান্তসাপেক্ষে সত্য, এমন উপমা ব্যবহারের পক্ষে যে আন্দোলনের সূচনা করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে, সে কবিতাগুলোকে এক কথায় দৃষ্টান্তবাদী কবিতা বলা চলে। দৃষ্টান্তবাদে- ভ্রান্ত উপমা, চিন্ত্রকল্প বা দৃশ্যকল্প যেমন ‘জিয়ল মাছের মতো লাফাতে লাফাতে সূর্য উঠছে (সরকার আমিন)’ (যেহেতু সূর্য লাফাতে লাফাতে উঠে না) এমন উপমা ব্যবহারের চাইতে যা দৃষ্টান্তসাপেক্ষে সত্য তাই কবিতায় ব্যবহার করাকেই যৌক্তিকসাপেক্ষে সুন্দরকবিতা বলে মনে করা হয়। দৃষ্টান্তবাদী দৃষ্টিতে কবিতার সৌন্দর্যোপভোগযাত্রা, শঙ্খবাস প্রথম সংখ্যায় সবুজ তাপস বলেছেন, “দৃষ্টান্তবাদ একটি সার্থক-ভালো কবিতায় দুটি দিক আশা করে- প্রথমত যে বাক্যনিচয়কে কবিতা বলা হবে তার একটি যৌক্তিক দৃশ্য থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত দৃশ্যটি হাজির করা হবে কবিতার প্রয়োজনেই। অর্থাৎ দৃশ্য আছে, কবিতাত্ব নেই- এমন বাক্যসমষ্টিকে দৃষ্টান্তবাদ কবিতা বলার পক্ষপাতী নয়।“

“তারা শিল্প চায়, থাকতে চায় না উপোসি আটকচাতক” (শিল্পচর্চা, সবুজ তাপস)- এই পংক্তিতে উপোসি আটকচাতকের যে উপমা হাজির করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তবাদ সাপেক্ষে সত্য। চাতকপাখি, যে মেঘের জল ছাড়া অন্য জল পান করে না, এমন উপোসি চাতককে খাঁচায় আটকে রাখলে যেমন করে ছটপট করে, সবুজ তাপসও তেমনি তার আত্মধ্যানে বাধাপ্রাপ্ত হলে তড়পাতে থাকেন। বোধ করি, এই উপোসি আটকচাতকের মতোন অবস্থা হয় প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল মানুষের, যদি তাদেরকে সৃষ্টিশীলতার গতিকে থামিয়ে দেয়া হয়। যদি তাঁদের অন্যরকম করে বলার গলা বন্ধ করা হয়।

কবি ও তাত্ত্বিক হাফিজ রশিদ খান বলেছেনঃ “কবিতা নৈরাজ্যের এই সমসাময়িক দোনোমনো বাস্তবতায় সবুজ তাপস একটি ধ্যান উপস্থাপন করেছেন। তার ধ্যানটির অ্যাকাডেমিক শিরোনামঃ দৃষ্টান্তবাদী কবিতা…দৃষ্টান্তবাদিতা সঠিক কাব্য-উপলব্ধি, তার প্রচার-প্রসার ও উন্মোচনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালনে সংশপ্তক। এ লক্ষাভিসারে সবুজ তাপস সংখ্যালঘু হলেও তার আত্মা শুদ্ধ, অনুধাবন নান্দনিক এবং তা অনুকরণযোগ্য।“ (সবুজ তাপসঃ একজন দৃষ্টান্তবাদী কবিঃ রাজীব লালন, ভোরের কাগজ)।

আট।
সবুজ তাপস তাঁর চারপাশের প্রকৃতিজুড়ে সুন্দরের খোঁজ করেছেন, সুন্দরকে নিজের ভেতরে স্থাপন করতে চেয়েছেন। এ সমাজ কর্তৃক চাপিয়ে দিতে চাওয়া অসুন্দরের, শিল্পহীনতার হাহাকার রয়েছে তার কবিতায়। “তুমি অন্যরকম না বলায় শিল্প হয়নি কতদিন” (শিল্পচর্চা, সবুজ তাপস), একটি বাক্যই যথেষ্ট হয়ে উঠে তার হাহাকারকে প্রকাশ করতে। আত্মমগ্ন থাকলে সবুজ তাপসও জৈবনিক জটিলতায় পড়েন, দোটানায় নড়েন।

তিনচোখে যখনই দেখি
জৈবনিক জটিলতা, তড়পাই রাগে
ভাল্লাগে না ভবের হাটের বেচাকেনা-
আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগে।

আর যখনই দেখি কোন কপোতাক্ষ নারী
চড়ছে কোন নেকাবহীন রিকসায়, আহা মরি
ঢেউ খেলা করে শরীরের চৌদ্দভাগেঃ
কল্পকাল বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগে!
(দোটানা, সবুজ তাপস)

সবুজ তাপস নিজের ভেতরে যেমন সুন্দরের খোঁজ করেছেন, তেমনি কখনো কখনো পরিভ্রমণ করেছেন বাস্তবতার জটিল জগতেও। এ ক্লান্তিকর জগতের অসুখে যখন তিনি পড়তেন, তখন তিনি মনে করতেন তার মায়ের কথা। আনমনে বলে উঠেছেন, ‘আমার মা সেরা চিকিৎসক, সেরা দার্শনিক’। পাখি হয়ে চলে যেতেন মায়ের কাছে, মায়ের মুখটি একবার দেখার আশায়। আবার কখনো নিজেই হয়ে যান ঋগ্বেদ ঋষি। ভ্রমণ করেন ইবনে বতুতার সঙ্গে। প্রথার বিপরীতে যেয়ে হয়ে যান ডায়োজিনিস। নাগরিক জীবনে থেকেও সবুজ হয়ে উঠতে চেয়েছেন বুদ্ধ কিংবা দর্শনের কালপুরুষ, বাহ্যিক রুপ বৈচিত্রকে তাচ্ছিল্য করেছেন এবং সবিনয়ে দর্পনের সামনের চোখকে বলেছেন,

“সাধুবাদ জানো নিজেকে দেখে আমারো পছন্দ হয়নি কোনো।“ (দর্পণপাঠ, সবুজ তাপস)

চাতক ও চকোর হয়ে মেঘ ও জোছনা পান করে বেঁচে থাকাতেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন চার্বাক, বুদ্ধ, পাণিনির মতো একই আনন্দের খোঁজ। সবুজ তাপস তার বোধের জগতে হেঁটেছেন, হাটছেন অনেক বছর ধরে। লিঙ্গ সচেতন হবার পর থেকেই তিনি হাঁটতে শুরু করেছেন, জানতে শুরু করেছেন, ভাঙ্গতে শুরু করেছেন কবিতা গড়ার জন্য। তাইতো নিজের ভেতরের যিশুকে নিজেই তাচ্ছিল্যেস্বরে বুঝিয়ে বলেন, কেন তার কবিতা লিখাই বড় প্রয়োজন হয়ে উঠলো। কারণ সবুজ তাপস মনে করেন কবিতা না লিখলে পৃথিবী হয়ে যেত কাষ্ঠ রাষ্ট্র। কবিতা না লিখলে তিনি হতে পারতেন মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গীও। লিঙ্গ সচেতন সবুজ তাপস তার মানুষ স্বত্তাকে অবুঝ স্বত্তা বলতে চেয়েছেন হয়তো তার কবিতায়,

“যখন অবুঝ ছিলাম, মানুষ ছিলাম না। যখন লিঙ্গ চিনলাম,
কবি, তখন থেকেই দোয়েলের দুনিয়ায়।“
(সবুজতাপসসড়ক, সবুজ তাপস)

নয়।
বাংলা সাহিত্যে পরাবাস্তববাদের বা সাইকোঅ্যানালাইসিসের ব্যবহার নতুন নয়। অনেক লেখকেরাই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। জীবনানন্দদাশ দাশ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সমীর রায় চৌধুরী, রবীন্দ্র গুহ থেকে শুরু বর্তমান সময়ের সবুজ তাপসও তার কবিতায় পরাবাস্তববাদিতার প্রকাশ করেছেন। যদিও দৃষ্টান্তবাদিরা পরাবাস্তববাদিতার অবচেতন মনের ধারণাকে গ্রহণ করেন না, এক্ষেত্রে সবুজ তাপস কি স্ববিরোধীতা টেনে নিয়ে আসলেন কিনা এটা আমার জানার আগ্রহে রইলো। সবুজ তাপস তার স্বপ্নাদ্য সিরিজের কবিতায় পরাবাস্তববাদিতার দারুণ কিছু পংক্তির অবতারণা করেছেন। তার মধ্যে একটি পংক্তি সুরিয়্যালিজমের উপর আমার জ্ঞানের দরজায় দারুণ টোকা মেরে বলেছে, আমিই সুরিয়্যালিস্ট।

“জানি, স্বপ্নের ভেতর পাড়াগাঁর জন্মান্ধ ফটিক কখনো আন্ধারও দেখেনি!”
(স্বপ্নাদ্য ২, সবুজ তাপস)

দৃষ্টান্তবাদ বা পরাবাস্তববাদের স্ববিরোধীতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। তবে এটাও সত্যি যে, দৃষ্টান্তবাদী সবুজ তাপস এমন কোনো দৃষ্টান্ত টেনে আনেন নি যা তার দৃষ্টান্তবাদকে অসমর্থন করে। পাশাপাশি কেবল কাব্যরসের আলোকে যদি বলতে হয়, তবে সত্যি আমার অবচেতন মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে জন্মান্ধ ফটিক কী স্বপ্ন দেখে! হ্যা স্বপ্ন দেখা কেবল দর্শনেন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে না। জন্মান্ধের স্বপ্নে কী কেবল অন্ধকারই আসে!

দশ।
শব্দ প্রয়োগে আর শব্দে শাব্দিক ছন্দময় কবিতা রচনায় সবুজ তাপস বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন বলেই মনে হয়েছে। যেমন বলেছিলাম, তিনি বেশ কিছু শব্দে-শব্দে সফলমিলন ঘটিয়েছেন। তার শব্দের দিকে তাকালে দেখতে পাই শব্দশ্যামের দারুণ সম্ভার- সবুজ তাপস। বনসাঁই, মার্বেলচোখ, কামনাসাম্পান, নজরনোঙ্গর, চেতনাচৈতন, সারসঙ্গ, বাঁচনভঙ্গি ইত্যাদি শব্দতীরে বিদ্ধ করেছেন বখতিয়ারের শরীর, ইঙ্গ-মার্কিন মানসে ছুড়েছেন পংক্তিবোমা। শব্দের জয় হবেই বলে তিনি মনে করেন।

“জানি শব্দ কিছুই না, তবু বোধে আছে, মানিও
মুজিবের মতো তারও আছে নিরঙ্কুশ বিজয়।“
(হুমায়ুন আজাদ, সবুজ তাপস)

এগারো।
সবুজ তাপস তার পনেরো বছর ধরে সাধনাজুড়ে তার আশ-পাশের জীবন-প্রকৃতি-বাস্তব ও পরাবাস্তব জগতের গভীরে যে ধ্যানের পরিভ্রমণ করে রচনা করেছেন, সবুজ তাপস। সে জগতে হয়তো মুক্তিকামী মানুষমাত্রই ভ্রমণ করতে আগ্রহী। তবুও সবাই পারেনা উড়তে, না পারে হাঁটতে! ‘কিছু একটা’ বাঁধা দেয়! সবুজ তাপস এই ‘কিছু একটা’র বাঁধা পেরিয়ে গেছেন বলেই বসবাস করেন দোয়েলের দুনিয়ায়। সবুজ তাপসের দোয়েলের দুনিয়ার ভ্রমণ করতে করতে এবার সময় হলো বিদায় নেবার। বিদায়কালে সবুজ তাপসের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে কিছু কথা বলছি। সবুজ তাপসের জন্ম ফেব্রুয়ারি ১৭, ১৯৭৭; ভবানীপুর, দাগনভূঁঞা, ফেনী। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে ২০০৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। পেশাজীবন শুরু করেছেন সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায়। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচিত ও সমালোচিত লোকায়ত দর্শনমত ‘দৃষ্টান্তবাদ’ এর জনক। তার সম্পাদিত সাহিত্যকাগজ- ‘ ঢেউ’। সবুজ তাপসের কাব্যের রিভিউ লিখতে আমি সাহায্য নিয়েছি আমার কাছে থাকা ‘সবুজ তাপস’ এর প্রিণ্টেড কপি, বাংলা অবিধান, গুগুল, সবুজ তাপস নিয়ে লেখা অন্যান্য লেখকের রিভিউ। ঢেউ, শঙ্খবাস, চেরাগী আড্ডা নামক কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন, অন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা তার আলোচনা-সমালোচনা, দৃষ্টান্তবাদ, পরাবাস্তববাদ ইত্যাদির ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়া লিংক।

ওয়েবসাইট লিংকঃ http://www.shobujtaposh.com (‘সবুজ তাপস’, সবুজ তাপস)
ফেইসবুক পেইজের লিংকঃ facebook.com/ShobujTaposh (‘সবুজ তাপস’, সবুজ তাপস)
উইকিপিডিয়া লিংকঃ en.wikipedia.org/wiki/ShobujTaposh (‘সবুজ তাপস’, সবুজ তাপস)

বারো।
সবুজ তাপসের কবিতায় পাঠক একটি ভিন্ন মাত্রার উপলব্ধির সাথে পরিচিত হবেন। তার দার্শনিকতাপূর্ণ কবিতার সীমাবদ্ধতা হয়তো একটাই তার কবিতার পাঠককে ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন সচেতন হতে হবে। আশাবাদী হতে হয় যখন দেখি, সবুজ তাপসের কবিতা আমার মতো অলস পাঠকের বোধের জগতকে আন্দোলনের মাধ্যমে তার গভীরে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর কবিতায় আনন্দ আছে, আছে জ্ঞানঅন্বেষণী আন্দোলনও। এখানেই হয়তো সমসাময়িক অন্য লেখকের চেয়ে তিনি ব্যতিক্রম হয়ে উঠতে পারেন। সবুজ তাপস বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের নতুন তাপস হলেও তিনি যে তার চেতনার মশালটি জ্বালিয়ে দিয়েছেন স্বমহিমায়, একথা আমার স্বীকার করে নিতে ইচ্ছে করে। পনেরো বছরের সাধনায় সবুজ তাপসের ভেতরের জগতে্র বদ্ধজীব মানুষটা তাই একদিন জুনিপন্ডিত হয়ে সাহসী উচ্চারণ করে বলেছেন,

“আমার কোনো লিঙ্গ নাই, কেবল মৃত্যুহীন”
(বায়োডাটা, সবুজ তাপস)


কবি অনেকেই হোন, কিন্তু প্রিয় কবি হোন কতজন! চেতনার আলো জ্বালাতে পারেনই বা কজন। জীবনানন্দ দাশের সুচেতনা কবিতাটির দুটি লাইন আমার মাথার ভেতর কে যেন! ক্রমাগত উচ্চারণ করে যাচ্ছে, “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে; সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ:” (সুচেতনা, জীবনানন্দ দাশ)। কাল বিবেচনায় সবুজ তাপস বাংলা সাহিত্যঙ্গনের কাব্যমনীষী হয়ে উঠেছেন কিনা বা হয়ে উঠবেন কিনা তা হয়তো সত্য ধ্যানকালেই জানা যাবে। জগতের সব সবুজ তাপসদের আন্তরিক অভিনন্দন। সবুজের তপস্যা হোক আমাদের ব্রত। জয়গুরু।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৬

বিজন রয় বলেছেন: চন্দ্রনিবাস

সুন্দর নিক।

ব্লগে স্বাগতম।

শুভকামনা, শুভব্লগিং।

৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৩১

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: বিজন ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার নিক দেখে জীবনানন্দের কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো-

"কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস- "

২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৭

বিজন রয় বলেছেন: লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।

অনেক বড় তাই পরে পড়ে নিব।

৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৩২

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: সময় করে পড়তে শুরু করেন। আশা করি সামনে যেতে ভালো লাগবে। যদি নতুনকে জানার আগ্রহ থাকে আপনার।

ধন্যবাদ।

৩| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:১৫

গেম চেঞ্জার বলেছেন: ১ম পোস্টেই বাজিমাত!! সুস্বাগতম ব্লগে!!

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:১৫

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: আপনার অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। চন্দ্রনিবাসের ব্লগে স্বাগতম। পাশে থাকবেন। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.