নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একটি মানবিক পাখি, প্রকৃতি ও প্রেমিক কর্তৃক আহূত হয়ে হঠাৎ হঠাৎ আছড়ে পড়ি ভূ-পৃষ্ঠে তবুও মানুষের জীবনে ফিরে আসার সাধ নাই আর।

চন্দ্রনিবাস

খসে পড়া নক্ষত্রের দেহে পুনঃসংযুক্ত হইবার আশায় চন্দ্রপথে একাকি খুঁজিতেছি অতীত।

চন্দ্রনিবাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাওড় ভ্রমণকথা ০২

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৩



গতরাতের ঝড়োবাতাসে দারুণ ঘুম হলো। ঘুমিয়ে যাবার আগে প্লান করেছিলাম আজ হাওড়ের উপরে ভাসতে থাকা গ্রামগুলো ঘুরে দেখবো। আজকের দিনটি আরো রোমাঞ্জকর ছিলো আমার জন্য। প্রথম কারণ, হাওড়্গুলো যে এত বিস্তৃত সেটা আগে জানা ছিলো না। মালবাহী বড় জাহাজগুলোকে সারিবদ্ধভাবে একটার পর আরেকটাকে যেতে দেখবো হাওড়ে ভাবিনি। ক্ষুদ্র ট্রলারের পাশে বিশাল জাহাজগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিলো, এতো আর কিছু নয় রে বাবা, সমুদ্রেই আছি। আর এই মহাসমুদ্রে আমরা ভাসছি কেবলমাত্র একটা ছোট্ট ট্রলারে। দ্বিতীয়ত, ভাসতে ভাসতে অন্তত ৬০ কিলোমিটার অতিক্রম করার পর আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সিলেটে। ভৌগলিক জ্ঞানশূণ্য আমার মতো মানুষের জন্য এই অভিজ্ঞতা এক কথায় অভূতপূর্ব। আজকের দিনটি আমার জন্য মনে রাখার মতো একটি দিন। সেটি আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

সকাল সকাল ঘুম ভাংলো। জলসিড়িতে খিচুড়ি খেয়ে একটা ট্রলার ভাড়া নিলাম কয়েকটা দ্বীপগ্রাম ঘুরবো। ভাড়া আসা যাওয়া ৮০০ টাকা। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আমিরগঞ্জ, আনন্দবাজার, আজমিরিগঞ্জ, সময় পেলে আরো কিছু। পুরো ট্রলারে আমরা দুইজন। শুরুর দিকে শান্ত সকালের শান্ত হাওড়ে ভেসে ভেসে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ইটনা পার হবার পরপর যা দেখলাম, তাতে ঘাবড়ে না যাবার উপক্রম নেই। বিশেষ করে যারা সাঁতার জানে না, আবার উপভোগ না করে হাওড় ছেড়ে দূরেও থাকতে পারেনা। যতদূর চোখ যায় জল আর জল। ঢেউ বাড়তে লাগলো। ঢেউয়ের তোপে ট্রলার উপরে উঠছে আবার ধপাস করে পড়ছে কখনো ডানে, কখনো বায়ে ৯০ ডিগ্রি কোণ করে দুইপাশ থেকে জল সরিয়ে দুলতে দুলতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাচ্ছে। শরীরটাকে ট্রলারের দুলুনির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ সময় লাগলো। একটা সময় বুঝলাম যতক্ষণ যেতে হবে এমন করেই দুলতে দুলতে যেতে হবে। ততক্ষণে ইটনা থেকে বহুদূরে সরে এসেছি। শংকাও কিছুটা কমে এসেছে। শরীরটাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে জলস্রোতের সাথে ট্রলারের এই ধাক্কাধাক্কির সাথে। অনুভব করছিলাম, প্রকৃতির ভালবাসায় মানুষ হয়ে জন্মেছি। প্রকৃতি আর আমার এই পারস্পরিক সম্পর্কে কেবল ভালবাসাই বন্ধন। ঢেউগুলো ট্রলারের উপর আছড়ে পড়ে বারবার এই ভালবাসায় আমার চোখে মুখে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছিলো, জলের ছিটা হয়ে ভালবাসা ঝরে পড়ছিলো। ভাসতে ভাসতে অনুধাবন হলো, আমরা একটা গোল বৃত্তে আছি। বৃত্তের কেন্দ্রে একটা ট্রলার, ট্রলারে মাঝিসহ আমরা তিনজন। আর পুরো বৃত্তাকার হাওড়টাকে ঘিরে রেখেছে বৃত্তাকার আকাশ। এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য কেবল চোখে দ্যাখা যায়, অনুভব করা যায়।

কচুরিপানার মতো জলের দেহে দেহ মিশিয়ে ভাসতে ভাসতে আমরা এসেছি আমিরগঞ্জ। চা খেতে খেতে জানলাম, কিশোরগঞ্জে ঠিক কতগুলো দ্বীপগ্রাম আছে গুণে বলা যাবে না। অষ্টগ্রাম, মিঠামাইন, হাজারিকান্দি, ইটনা, আনন্দবাজার, আলমপাশা, আনন্দবাজার, সিমনা, আড়ালিয়া, বড়শিপুরা, শয়লা, আহুলা, ধনপুর- এরকম অজস্র দ্বীপগ্রাম আছে। সবগুলো দ্বীপগ্রামের চেহারা একই। সবগুলো দ্বীপগ্রামে আমরা যাবার যথেষ্ট সময় পাইনি। তবে আশ-পাশ দিয়ে গিয়েছি। দ্বীপগ্রামগুলো হয়তো পনেরো বিশটি পরিবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে জলের বেস্টনি। কয়েকটি দ্বীপগ্রাম কেবল একটি পরিবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা আছি আমিরগঞ্জে। এখান থেকে চিংড়ি মাছ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যায়। চিংড়ি বিক্রেতার নম্বর নিয়ে এসেছি। ফোন করে দিলে রামপুরা, ঢাকা থেকে তাঁদের গাড়ি থেকে চিংড়ি নেয়া যাবে। আমিরগঞ্জ থেকে পাশের আজমিরিগঞ্জ গ্রামে যেতে হলে পার হতে হবে কালনী নদী। এ নদীর এক পাশে মেঘনা, আরেক পাশে কুশিয়ারা নদী। ছোট্ট একটা নৌকা করে কালনী নদী পার হয়ে আমরা পৌছালাম আজমিরিগঞ্জ। আজমিরিগঞ্জের মিয়াধন মিয়া কলেজের পাশে আজমিরি বাবার দরবার শরীফ। হয়তো কোনো এক সময় এই এলাকায় প্রথম আসে বাবা আজমিরি। তার নামে এই এলাকার নাম হয়। দরবার শরীফের সামনে পুকুরে বিশাল বিশাল গজার মাছ। গজার মাছকে খেতে দিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ঘুরে দেখতে লাগলাম আজমিরিগঞ্জ। আজমিরিগঞ্জ এসে দোকানের সাইনবোর্ডে লিখা দেখলাম আজমিরিগঞ্জ, হবিগঞ্জ। হাওড়ে ঘুরতে ঘুরতে যে হবিগঞ্জে চলে এসেছি তা আমার জানা ছিলো না। অদ্ভূত লাগলো। যথেষ্ট ভৌগলিক জ্ঞান না থাকলেও জানা হয়ে গেলো যে, হবিগঞ্জের একেবারে শেষ মাথায় এই আজমিরিগঞ্জ।

এবার ফেরার পালা। আসার সময় যে সামান্য ভয় ছিলো, যাকে বলেছিলাম ভয়ংকর ও সুন্দর। ফিরতি যাত্রায় তা কেবলি সুন্দর। যত বড় ঢেউ তত বেশি আনন্দ। ট্রলারের সামনে বসে বসে ঢেউয়ের সাথে সাথে ভাসতে ভাসতে নীরব হাওড়ের রুপ দেখতে দেখতে কখনো ট্রলারের ছাদে, কখনো ভিতরে শুয়ে শুয়ে, কখনো ট্রলারের সামনে বসে, ট্রলারের সামনে শুয়ে শুয়ে, গান গাইতে গাইতে আশে পাশের গ্রামগুলোকে দেখতে দেখতে, হাওড়ের বিস্তৃত জলের মাঝে শব্দহীন, দূষণহীন এক জীবনের, সৌন্দর্যের রুপ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেছি ইটনা। আমাদের সাথে ছিলো মাঝি, আশিষ। আশিষ বেশ দক্ষ মাঝি। প্রকৃতির প্রতি ভালবাসায় তৈরি বিশ্বাস আর মাঝির উপর ভরসা রেখেই হাওড়ের এত বিশাল বিস্তৃত জলরাশির মাঝেও ছিলাম নির্লিপ্ত কচুরিপানার মতন, কেবল ভেসে চলেছি, দেহহীন।

কিছু বিষয় জানা থাকা জরুরি যে, চামটা থেকে ইটনা অবধি পাবলিক ট্রলারে যেতে হয়। এই ট্রলারগুলো মোটামুটি বেশ বড়। আর হাওড়ে ঘুরার জন্য অপেক্ষাকৃত মাঝারি আকারের ট্রলার নিয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ ইটনা থেকে আজমিরিগঞ্জ বা অন্যান্য দ্বীপগ্রামে ঘুরে বেড়াতে যে পরিমাণ ঢেউয়ের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে হয়, তাতে ছোট আকারের ইঞ্জিলচালিত নৌকা যেগুলো পাবলিক ট্রলারের চেয়ে সামান্য ছোট সেগুলো নেয়াই ভালো। ডিঙ্গি নৌকা বা ইঞ্জিনহীন নৌকা বা ছোট নৌকা নিয়ে না যাওয়াই ভালো। এখানকার মাঝিরাই এমন পরামর্শ দিবে। ছোট নৌকা এত বড় ঢেউ সামলাতে গিয়ে উলটে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমন বেশ কিছু ঘটনাও শুনা গেলো এলাকার জনগণের কাছে। ইটনা ঘাটে এসেই দেখি যে ট্রলারে করে এসেছিলাম, একই ট্রলার দাঁড়িয়ে আছে। দেরি না করে উঠে পড়লাম।

বিকেলের দিকে ঢেউ আরো বাড়তে লাগলো। সাথে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ করে হাওড়ের মাঝে থেমে গেলো ট্রলার। ট্রলারের যে পাখাটি দিয়ে জল কেটে কেটে আমরা ভাসছিলাম চামটার পথে, ঐ পাখাটিকে ভেঙ্গে দিয়েছে প্রচণ্ড জলস্রোত। ইঞ্জিন থেমে যাবার পর ট্রলারের দুলুনি বেড়ে গেছে অনেকখানি। দিঘীর পানিতে পাতা যেমন করে ভাসে, তেমন করে ভাসছিলো আমাদের ট্রলার। আশেপাশে জল আর জল, মাঝে ভাসছি দুলছি আমরা। ২০/২৫ মিনিট ভাসার পরে আবার যাত্রা শুরু হলো। এমন সময় দেখলাম মালবাহী বড় জাহাজ, একটা আসছে। একটা না দুইটা না। ছয়টা জাহাজ একের পর এক আমাদের এই ছোট ট্রলারের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সাইজের জাহাজকেও হাওড়ে ভাসতে দেখবো ভাবিনি। নিজেদেরকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো। আরো মনে হচ্ছিলো, যাকে আমরা হাওড় বলে ডাকি আদর করে, সেতো হাওড় নয় রে বাবা, এ এক সমুদ্র। আর এই সমুদ্রে আমরা কিনা ভাসছি একটা ট্রলারে!! ট্রলারের ইঞ্জিন আবারো সচল করা হলে আরো ২৫ মিনিট পরে চামটাঘাটে নামলাম।

চামটা এসে হাত মুখ ধুয়ে সিএনজি করে চলে এলাম একরামপুর। একরামপুর এসে খোঁজ নিলাম রেস্টুরেন্টের। ভালো রেস্টুরেন্টগুলোর একটা- ধানসিড়ি। ধানসিড়িতে চিংড়ি মাছ আর বাছামাছ দিয়ে ভরপুর খেয়ে বিড়ি টানতে টানতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ভিতর দিয়ে এসে পৌছালাম কিশোরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড। আবার সেই যাতায়াত বাসে চড়লাম। বাসে উঠেই চানাচুর বিক্রেতা ছেলেটা উঠেই ডাক ছাড়লো,

“চানাচুর, চানাচুর;
ঝাল টক চানাচুর,
লেবু দিয়া আদা দিয়া,
ঝাল টক চানাচুর”।

জীবনটা হয়তো এমনি। কারো কাছে বিবর্ণ, কারো আছে নিরর্থক। তবে কিছুটা লেবু আদা মিশিয়ে নিতে পারলে, জীবন বড়ই সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩

প্রামানিক বলেছেন: ভালো লাগল আপনাদের হাওড় ভ্রমণ কাহিনী।

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৪

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: প্রামানিকদা, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আবারো আমার ব্লগে ভ্রমণের জন্য।

২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:১৯

জুবায়ের ইব্রাহীম বলেছেন: সত্যি সুন্দর একটা হাওর।

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৬

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।

৩| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:২৪

মাকার মাহিতা বলেছেন: চমৎকার গল্প। বেশ ভাল লেগেছে...শুভকামনা রইল!

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৭

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।

ভালো লাগলো জেনে কৃতজ্ঞ।

শুভকামনা।

৪| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:০১

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:




অদ্ভূত < অদ্ভুত

অদ্ভুতের ভুত বাদে বাকি সব ভূত! হা হা হা!


খুব সুন্দর ভ্রমন কাহিনী! এসব জায়গায় ভ্রমন করলে মনে হয়, যদি এখানে একটা ঘর করা যেত, সাঁতার কাটা যেত, গা এলিয়ে একটা ঘুম দেওয়া যেত তবে কতই না মজা হত।


২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:১৪

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। শিখতে এসেছি ও শিখছি বেশ।

শুভকামনা।

৫| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৮

শায়মা বলেছেন: অনেক অনেক ভালো লাগা ভাইয়া!:)

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৩১

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপু। শুভ কামনা।

৬| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৪৫

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:



'জীবনটা হয়তো এমনি। কারো কাছে বিবর্ণ, কারো আছে নিরর্থক। তবে কিছুটা লেবু আদা মিশিয়ে নিতে পারলে, জীবন বড়ই সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর।'
- বাণীতে চন্দ্রনিবাস।

আপনার লেখা পড়া আনন্দদায়ক। যদিও পড়িনি এটা। পড়ে পড়বো। আজকে অনেক লেখা পড়ে ফেলেছি। :(

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:১০

চন্দ্রনিবাস বলেছেন: :)

এত সুন্দর একটা সত্য মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তবে আপনি কিন্তু সময় করে পড়ে নিবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.