নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবনাহীন ভাবনাগুলো

মাহের ইসলাম

মাহের ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাহাড়িদের সরলতা ; সুযোগসন্ধানীর ব্যক্তিস্বার্থ ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩৯

আল জাজিরায় একটা ভিডিও দেখেছিলাম গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। যেখানে দেখানো হয়, অত্যন্ত সহজ ৪ টি স্টেপে, যে কারো পক্ষেই ফেসবুকে ফেইক নিউজ তৈরি করা যায় এবং অতি দ্রুত তা ছড়িয়ে দেয়া যায়। আধা ঘন্টার মধ্যে একটা ফেইক নিউজ প্রায় ৫০০০ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে একজনকে মাত্র ৫৪ ডলার খরচ করতে হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি মাত্র এক টাকায় একজনের কাছে একটি মিথ্যে সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছেন, ফেসবুকের কল্যানে!

সাথে আরেকটু তথ্য না দিলে, বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; তা হলো এই যে, বাংলাদেশের তরুণদের মতে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এক্ষেত্রে, ফেসবুক এদেশের তরুণদের প্রায় সকলেরই প্রথম পছন্দ। সরকারী হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ ফেসবুক ইউজার আছে। (প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০১৭)। এর মধ্যে কতজন তরুণ আমি জানি না, তবে এর অর্ধেকও যদি তরুণ হয়, তাহলেও প্রায় এক কোটির বেশি বাংলাদেশি তরুণ ফেসবুককে তথ্যপ্রাপ্তির সবচেয়ে কার্যকর উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। অর্থাৎ, দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী তথ্যপ্রাপ্তির জন্য ফেসবুকের তথ্যের উপর নির্ভর করছেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, “ তরুণেরা মনে করে, বৈচিত্রপূর্ণ সংবাদ ও তথ্যপ্রাপ্তির জন্য জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সামাজিক যোগাযোগ” এবং জরিপের ৯৬ % অংশগ্রহণকারী বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই মনে করেন। অর্থাৎ, দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ফেসবুকে প্রাপ্ত সংবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হবেন না, বা সন্দিহান না হওয়ারই কথা।

এই সহজলভ্য এবং জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ প্রাপ্তির উপকারিতা নিয়ে কিছু বলার পরিবর্তে এর অন্য দিকটি নিয়ে কিছু বলা জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই উৎসের যদি অপব্যবহার করা হয়, তাহলে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে, তা বোঝার জন্যে বেশি দূরে যেতে হবে না। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে। যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে, আমাদের দেশেরে কিছু মানুষ সব সময়ই প্রকৃত ঘটনা জানতে পারছে না। বরং বাস করছে, ভিন্ন বাস্তবতায়। যে ভয়টির কথা গত ২৮ ডিসেম্বরের প্রথম আলোয় বারাক ওবামার সাক্ষাৎকারে ঊজ্জল্ভাবে উঠে এসেছে এভাবে, “ইন্টারনেটের একটা ঝুকি হচ্ছে, মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বসবাস করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য মানুষের পক্ষপাতমূলক ধারনাগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে।“

লংগদুর কথা ভেবে দেখুন। ফেসবুকের কল্যাণে ঘটনাটি অতি দ্রুত লংগদুর বাইরে ছড়িয়ে দেয়া হয়, দেশে এবং বিদেশে; তবে একটু ভিন্ন ভাবে। জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক, এই ভয়াবহ সংবাদটি কয়েকটি দেশি এবং বিদেশী পত্রিকাতেও খানিকটা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।


যে তিনটি ছবিকে লংগদুর অগিকান্ডের ছবি বলে চালানো হলো, দেশবাসি এবং বিশ্ববাসীর সমবেদনা প্রাপ্তি এবং বাঙ্গালীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেগুলো আসলে এদেশেই ঘটে যাওয়া টঙ্গীতে বয়লার বিস্ফোরণ (১০/৯/১৬), গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লি (৭/২/১৭) এবং বরিশালে বিস্কুটের গোডাউন (৪/২/১৭) এর আগুনের ছবি।

প্রায় একই পদ্ধতি অনুসরন করা হয়, রামগড়ের একটি ঘটনাতে। ৩০ জুন ২০১৭ , চাকমা সম্প্রদায়ের তাজধারী এক নারী ও সমাজের এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মধ্যরাতে ফেসবুকে পোস্ট দিলেন যে, শতশত বাঙ্গালী সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা করছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীও এতে অংশ নিচ্ছে। আর, প্রানভয়ে পাহাড়িরা পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আবার প্রতিরোধেরও আহবান জানালেন, এই বলে যে, শুধু চোখের পানি ফেললে চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই, এই পোস্টটি শেয়ার হতে দেরি হল না। আরেকটি লংগদুর পুনরাবৃত্তির আশংকায় অনেকই আশঙ্কিত হয়ে তাদের মতামত, বাঙ্গালীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এমনকি প্রতিশোধের পন্থা পর্যন্ত উচ্চারণ করে ফেললেন। অথচ, প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। কয়েকজন সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী রামগড়ের কালাডেবাতে (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) এসে কয়েকজন বাঙালীর কাছে চাঁদা দাবী করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, কালাডেবার অন্য বাঙালীরা এবং পার্শ্ববর্তী লামকোপাড়ার (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) বাঙালীরা একত্রিত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে। সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে করতে তারা সোনাইয়াগা ( ত্রিপুরা এবং মারমা অধ্যুষিত) এর মধ্যে দিয়ে বড় চন্দ্র কারবারিপাড়া (ত্রিপুরা অধ্যুষিত) পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু কাউকে ধরতে ব্যর্থ হয়। ইত্যবসরে, বাঙালীদের কাছ থেকে সশস্ত্র চাঁদাবাজদের সংবাদ পেয়ে বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত হয়। তারা উত্তেজিত সকলকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত রাখে। ফলে, ঘটনা অন্য কোন দিকে মোড় নেয়নি। রাত প্রায় ১২ টার দিকে, পুরো এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করে।

এই মিথ্যে চর্চার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ সৃস্টি হয়েছে, বিলাইছড়ির ঘটনা নিয়ে। কিছু ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট দিয়ে, তাদের স্ববিরোধী ও উস্কানিমূলক বক্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আমার বক্তব্য বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই, বরং এই পোস্ট গুলোর বক্তব্য খেয়াল করলেই হবে।

ফেসবুকে পোস্টে দাবী করা হয় যে, “৫-৬ জন বাঙ্গালী মারমা পরিবারটির বাড়িতে ঢুকে কিশোরী দুইবোনকে ধর্ষণ করে’। এ রকম একটা পোষ্টের পরের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না, কারণ আপনারা সবাই তা জানেন। কিন্তু ফেসবুকের একই পেইজে, দ্বিতীয় পোষ্টের ভিডিও তে মেয়ে দুইজনের ছোট ভাই বলছে, ঘরে “একজন” ঢুকেছিল। তাহলে প্রথম পোষ্টের দাবী কি সত্যি? প্রথম পোষ্টের মিথ্যা দাবীর ভিত্তিতে যারা মিছিল, মানব বন্ধন, প্রেস ব্রিফিং করলেন এবং ফেসবুকে কমেন্ট করে ফেনা তুলে ফেল্লেন, তাদের কে দায়ী করা উচিত ? নাকি সরল বিশ্বাসী কিছু মানুষের ইমোশন কে কাজে লাগালেন, সেই সকল সুযোগসন্ধানীদের দায়ী করবো ?


একই ভাবে, ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ফেসবুকে দাবী করা হয় যে, ‘জলপায়ী দানব বাংলার দা মাল ছেলে সেনাবাহিনীরা চাচ্ছে তাদের কর্তৃক ধর্ষিতা ও শারিরিকভাবে লাঞ্ছিত দুই মারমা তরুণীকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে’। অথচ, একই পেইজে রাত দশটার পরে দাবী করা হয় যে, চিকিৎসা শেষে দুই কিশোরীকে ছেড়ে দিতে হাঁসপাতাল ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ অভাবনীয় টালবাহানা করছে। আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি এই যে, একই পেইজে পরবর্তীতে পোস্টে দেখা যায় স্থানীয় পাহাড়ি কিছু নেতা-নেত্রী কিশোরী দুইজনকে তাদের জিম্মায় নেয়ার জন্যে প্রানান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কোনটা সত্যি আর কোনটা নয়, সেটা বুঝা সত্যিই দায়!


উপরের পোস্ট দেখে আপনারাই বলুন, প্রথম পোস্টের দাবী বিশ্বাস করার কোন উপায় আছে? কারা হাঁসপাতাল থেকে মেয়ে দুটোকে নিজেদের জিম্মায় নেয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে? আর, কাদেরকে এই দোষে দোষী করা হচ্ছে?



উপরের পোস্টের তারিখ খেয়াল করুন, হ্যা, ঠিক ধরেছেন, ২৭ জানুয়ারি। অথচ, ২৫ জানুয়ারিতে ডয়চে ভেলে প্রকাশিত সংবাদে দাবী করা হয়, “রাঙামাটির বিলাইছড়িতে ধর্ষণের ঘটনাটি ‘আর্মির পোশাক পরা' লোকজন ঘটিয়েছে বলে ঘটনার শিকারদের উদ্ধৃত করে অভিযোগ করেছেন চাকমা রানি ইয়েন ইয়েন৷ সেনাবাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে, আটক হয়েছে আনসারের এক সদস্য৷” এমনকি, আনসার ব্যাটেলিয়নের কমান্ডিং অফিসার কে উদ্ধৃত করে একই সংবাদে প্রকাশ করা হয় যে, “(এক) আনসার সদস্য ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলেন আর একজন সেনাসদস্য বাইরে গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ সার্চ করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না৷ আমরা আনসার সদস্যকে ক্লোজড করেছি”। তাহলে, পাঠককুলই বিচার করুক, বিশ্বাস করা কতটা কঠিন যে, ২৭ তারিখের ঐ পোস্টের দাবী কি না জেনেশুনেই করা হয়েছিলো।

এবার আসি, সর্বশেষ পরিবেশনায়। নিচের পোস্টটি খেয়াল করুন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারিতে পোস্ট টি দেয়া হয়।


ফেসবুকে যেহেতু এসেছে, তাই এটাও বিশ্বাস করতে হবে! অথচ, প্রকৃত সত্য এই যে, “রাঙামাটির বিলাইছড়িতে নির্যাতিত দুই মারমা কিশোরীকে তাদের অভিভাবক নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এইচ এম জাহাঙ্গীর।বৃহস্পতিবার (১৫ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিভাবকরা তাদের কিশোরীদের নিজ জিম্মায় নেন।এ বিষয়ে রাঙামাটির ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: নীহার রঞ্জন নন্দী জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই দুই কিশোরীর অভিভাবক ছাড়পত্রে স্বাক্ষর করে তাদের নিজ জিম্মায় নিয়ে নেন।” যারা উপরের পোষ্টটি করেছেন, তারা এই সত্যটি না জেনেই এমনটি করেছেন – সেটা আমি ভাবতে পারছি না। কারণ, মেয়ে দুজনের পাশে অনেক ভলান্টিয়ার ছিলেন, অনেকেই মেয়ে দুজনকে নিজেদের জিম্মায় নেয়ার আপ্রান চেষ্টা করছিলেন। তাদের কুটকৌশল ব্যর্থ হওয়াতেই কি এমন পোস্টের অবতারণা, নাকি নিজেদের অপকর্ম ধরা পরে যাবে বলেই নিজে নিজে আড়ালে চলে গিয়ে, অন্য কোন ইস্যু সৃস্টির অপচেস্টা হচ্ছে – সেটা সত্য সময়ই সামনে নিয়ে আসবে।


যারা খোঁজ খবর রাখেন, তারা নিশ্চয় এমন অনেক পোস্ট নিয়মিতই দেখছেন। তাহলে কি, উস্কানিমূলক মিথ্যা দিয়ে মানুষকে কি ধোঁকা দেয়া হচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ? এখানে কি ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত না অন্য কিছু? নাকি, এটি শুধু একটি নিকৃষ্টতম নিচু মানসিকতাপ্রসুত ঘৃন্য মিথ্যেই নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং দলমত নির্বিশেষে সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিরুদ্ধে এক সুদুরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের প্রয়াসের অংশবিশেষ। সেটি ভেবে দেখার উপযুক্ত সময় এখনই।

একের পর একে স্ববিরোধী মিথ্যাচার করার পরেও কি এই সব ষড়যন্ত্রকারীরা অন্তত এটুকু খেয়াল করবেন না যে, তারা এমন মিথ্যেকে সত্য বলে চালানোর চেস্টা করছেন যে, তাদের মিথ্যাচার অবলীলায় ধরা পরে যাচ্ছে ? পাহাড়িদের সরলতা নিশ্চয় গুটিকয়েকজনের ক্রীড়নক নয়। পাহাড়িরা সরল বলেই আমি জানি। কিন্তু, তারা কি এতই বোকা যে, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে আসা ঘৃন্য কয়েকজণের চিরাচরিত ব্যক্তিস্বার্থের সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্ত মিথ্যে মেনে নিবে?


আল জাজিরায় একটা ভিডিও দেখেছিলাম গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। যেখানে দেখানো হয়, অত্যন্ত সহজ ৪ টি স্টেপে, যে কারো পক্ষেই ফেসবুকে ফেইক নিউজ তৈরি করা যায় এবং অতি দ্রুত তা ছড়িয়ে দেয়া যায়। আধা ঘন্টার মধ্যে একটা ফেইক নিউজ প্রায় ৫০০০ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে একজনকে মাত্র ৫৪ ডলার খরচ করতে হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি মাত্র এক টাকায় একজনের কাছে একটি মিথ্যে সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছেন, ফেসবুকের কল্যানে!

সাথে আরেকটু তথ্য না দিলে, বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; তা হলো এই যে, বাংলাদেশের তরুণদের মতে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এক্ষেত্রে, ফেসবুক এদেশের তরুণদের প্রায় সকলেরই প্রথম পছন্দ। সরকারী হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ ফেসবুক ইউজার আছে। (প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০১৭)। এর মধ্যে কতজন তরুণ আমি জানি না, তবে এর অর্ধেকও যদি তরুণ হয়, তাহলেও প্রায় এক কোটির বেশি বাংলাদেশি তরুণ ফেসবুককে তথ্যপ্রাপ্তির সবচেয়ে কার্যকর উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। অর্থাৎ, দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী তথ্যপ্রাপ্তির জন্য ফেসবুকের তথ্যের উপর নির্ভর করছেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, “ তরুণেরা মনে করে, বৈচিত্রপূর্ণ সংবাদ ও তথ্যপ্রাপ্তির জন্য জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সামাজিক যোগাযোগ” এবং জরিপের ৯৬ % অংশগ্রহণকারী বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই মনে করেন। অর্থাৎ, দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ফেসবুকে প্রাপ্ত সংবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হবেন না, বা সন্দিহান না হওয়ারই কথা।

এই সহজলভ্য এবং জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদ প্রাপ্তির উপকারিতা নিয়ে কিছু বলার পরিবর্তে এর অন্য দিকটি নিয়ে কিছু বলা জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই উৎসের যদি অপব্যবহার করা হয়, তাহলে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে, তা বোঝার জন্যে বেশি দূরে যেতে হবে না। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে। যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে, আমাদের দেশেরে কিছু মানুষ সব সময়ই প্রকৃত ঘটনা জানতে পারছে না। বরং বাস করছে, ভিন্ন বাস্তবতায়। যে ভয়টির কথা গত ২৮ ডিসেম্বরের প্রথম আলোয় বারাক ওবামার সাক্ষাৎকারে ঊজ্জল্ভাবে উঠে এসেছে এভাবে, “ইন্টারনেটের একটা ঝুকি হচ্ছে, মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বসবাস করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য মানুষের পক্ষপাতমূলক ধারনাগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে।“

লংগদুর কথা ভেবে দেখুন। ফেসবুকের কল্যাণে ঘটনাটি অতি দ্রুত লংগদুর বাইরে ছড়িয়ে দেয়া হয়, দেশে এবং বিদেশে; তবে একটু ভিন্ন ভাবে। জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক, এই ভয়াবহ সংবাদটি কয়েকটি দেশি এবং বিদেশী পত্রিকাতেও খানিকটা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।


যে তিনটি ছবিকে লংগদুর অগিকান্ডের ছবি বলে চালানো হলো, দেশবাসি এবং বিশ্ববাসীর সমবেদনা প্রাপ্তি এবং বাঙ্গালীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেগুলো আসলে এদেশেই ঘটে যাওয়া টঙ্গীতে বয়লার বিস্ফোরণ (১০/৯/১৬), গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লি (৭/২/১৭) এবং বরিশালে বিস্কুটের গোডাউন (৪/২/১৭) এর আগুনের ছবি।

প্রায় একই পদ্ধতি অনুসরন করা হয়, রামগড়ের একটি ঘটনাতে। ৩০ জুন ২০১৭ , চাকমা সম্প্রদায়ের তাজধারী এক নারী ও সমাজের এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মধ্যরাতে ফেসবুকে পোস্ট দিলেন যে, শতশত বাঙ্গালী সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা করছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীও এতে অংশ নিচ্ছে। আর, প্রানভয়ে পাহাড়িরা পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আবার প্রতিরোধেরও আহবান জানালেন, এই বলে যে, শুধু চোখের পানি ফেললে চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই, এই পোস্টটি শেয়ার হতে দেরি হল না। আরেকটি লংগদুর পুনরাবৃত্তির আশংকায় অনেকই আশঙ্কিত হয়ে তাদের মতামত, বাঙ্গালীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এমনকি প্রতিশোধের পন্থা পর্যন্ত উচ্চারণ করে ফেললেন। অথচ, প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। কয়েকজন সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী রামগড়ের কালাডেবাতে (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) এসে কয়েকজন বাঙালীর কাছে চাঁদা দাবী করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, কালাডেবার অন্য বাঙালীরা এবং পার্শ্ববর্তী লামকোপাড়ার (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) বাঙালীরা একত্রিত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে। সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে করতে তারা সোনাইয়াগা ( ত্রিপুরা এবং মারমা অধ্যুষিত) এর মধ্যে দিয়ে বড় চন্দ্র কারবারিপাড়া (ত্রিপুরা অধ্যুষিত) পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু কাউকে ধরতে ব্যর্থ হয়। ইত্যবসরে, বাঙালীদের কাছ থেকে সশস্ত্র চাঁদাবাজদের সংবাদ পেয়ে বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত হয়। তারা উত্তেজিত সকলকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত রাখে। ফলে, ঘটনা অন্য কোন দিকে মোড় নেয়নি। রাত প্রায় ১২ টার দিকে, পুরো এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করে।

এই মিথ্যে চর্চার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ সৃস্টি হয়েছে, বিলাইছড়ির ঘটনা নিয়ে। কিছু ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট দিয়ে, তাদের স্ববিরোধী ও উস্কানিমূলক বক্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আমার বক্তব্য বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই, বরং এই পোস্ট গুলোর বক্তব্য খেয়াল করলেই হবে।

ফেসবুকে পোস্টে দাবী করা হয় যে, “৫-৬ জন বাঙ্গালী মারমা পরিবারটির বাড়িতে ঢুকে কিশোরী দুইবোনকে ধর্ষণ করে’। এ রকম একটা পোষ্টের পরের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি না, কারণ আপনারা সবাই তা জানেন। কিন্তু ফেসবুকের একই পেইজে, দ্বিতীয় পোষ্টের ভিডিও তে মেয়ে দুইজনের ছোট ভাই বলছে, ঘরে “একজন” ঢুকেছিল। তাহলে প্রথম পোষ্টের দাবী কি সত্যি? প্রথম পোষ্টের মিথ্যা দাবীর ভিত্তিতে যারা মিছিল, মানব বন্ধন, প্রেস ব্রিফিং করলেন এবং ফেসবুকে কমেন্ট করে ফেনা তুলে ফেল্লেন, তাদের কে দায়ী করা উচিত ? নাকি সরল বিশ্বাসী কিছু মানুষের ইমোশন কে কাজে লাগালেন, সেই সকল সুযোগসন্ধানীদের দায়ী করবো ?


একই ভাবে, ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ফেসবুকে দাবী করা হয় যে, ‘জলপায়ী দানব বাংলার দা মাল ছেলে সেনাবাহিনীরা চাচ্ছে তাদের কর্তৃক ধর্ষিতা ও শারিরিকভাবে লাঞ্ছিত দুই মারমা তরুণীকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে’। অথচ, একই পেইজে রাত দশটার পরে দাবী করা হয় যে, চিকিৎসা শেষে দুই কিশোরীকে ছেড়ে দিতে হাঁসপাতাল ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ অভাবনীয় টালবাহানা করছে। আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি এই যে, একই পেইজে পরবর্তীতে পোস্টে দেখা যায় স্থানীয় পাহাড়ি কিছু নেতা-নেত্রী কিশোরী দুইজনকে তাদের জিম্মায় নেয়ার জন্যে প্রানান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কোনটা সত্যি আর কোনটা নয়, সেটা বুঝা সত্যিই দায়!


উপরের পোস্ট দেখে আপনারাই বলুন, প্রথম পোস্টের দাবী বিশ্বাস করার কোন উপায় আছে? কারা হাঁসপাতাল থেকে মেয়ে দুটোকে নিজেদের জিম্মায় নেয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে? আর, কাদেরকে এই দোষে দোষী করা হচ্ছে?



উপরের পোস্টের তারিখ খেয়াল করুন, হ্যা, ঠিক ধরেছেন, ২৭ জানুয়ারি। অথচ, ২৫ জানুয়ারিতে ডয়চে ভেলে প্রকাশিত সংবাদে দাবী করা হয়, “রাঙামাটির বিলাইছড়িতে ধর্ষণের ঘটনাটি ‘আর্মির পোশাক পরা' লোকজন ঘটিয়েছে বলে ঘটনার শিকারদের উদ্ধৃত করে অভিযোগ করেছেন চাকমা রানি ইয়েন ইয়েন৷ সেনাবাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে, আটক হয়েছে আনসারের এক সদস্য৷” এমনকি, আনসার ব্যাটেলিয়নের কমান্ডিং অফিসার কে উদ্ধৃত করে একই সংবাদে প্রকাশ করা হয় যে, “(এক) আনসার সদস্য ঘরের ভিতরে ঢুকেছিলেন আর একজন সেনাসদস্য বাইরে গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ সার্চ করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না৷ আমরা আনসার সদস্যকে ক্লোজড করেছি”। তাহলে, পাঠককুলই বিচার করুক, বিশ্বাস করা কতটা কঠিন যে, ২৭ তারিখের ঐ পোস্টের দাবী কি না জেনেশুনেই করা হয়েছিলো।

এবার আসি, সর্বশেষ পরিবেশনায়। নিচের পোস্টটি খেয়াল করুন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারিতে পোস্ট টি দেয়া হয়।


ফেসবুকে যেহেতু এসেছে, তাই এটাও বিশ্বাস করতে হবে! অথচ, প্রকৃত সত্য এই যে, “রাঙামাটির বিলাইছড়িতে নির্যাতিত দুই মারমা কিশোরীকে তাদের অভিভাবক নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এইচ এম জাহাঙ্গীর।বৃহস্পতিবার (১৫ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিভাবকরা তাদের কিশোরীদের নিজ জিম্মায় নেন।এ বিষয়ে রাঙামাটির ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: নীহার রঞ্জন নন্দী জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই দুই কিশোরীর অভিভাবক ছাড়পত্রে স্বাক্ষর করে তাদের নিজ জিম্মায় নিয়ে নেন।” যারা উপরের পোষ্টটি করেছেন, তারা এই সত্যটি না জেনেই এমনটি করেছেন – সেটা আমি ভাবতে পারছি না। কারণ, মেয়ে দুজনের পাশে অনেক ভলান্টিয়ার ছিলেন, অনেকেই মেয়ে দুজনকে নিজেদের জিম্মায় নেয়ার আপ্রান চেষ্টা করছিলেন। তাদের কুটকৌশল ব্যর্থ হওয়াতেই কি এমন পোস্টের অবতারণা, নাকি নিজেদের অপকর্ম ধরা পরে যাবে বলেই নিজে নিজে আড়ালে চলে গিয়ে, অন্য কোন ইস্যু সৃস্টির অপচেস্টা হচ্ছে – সেটা সত্য সময়ই সামনে নিয়ে আসবে।

যারা খোঁজ খবর রাখেন, তারা নিশ্চয় এমন অনেক পোস্ট নিয়মিতই দেখছেন। তাহলে কি, উস্কানিমূলক মিথ্যা দিয়ে মানুষকে কি ধোঁকা দেয়া হচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ? এখানে কি ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত না অন্য কিছু? নাকি, এটি শুধু একটি নিকৃষ্টতম নিচু মানসিকতাপ্রসুত ঘৃন্য মিথ্যেই নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং দলমত নির্বিশেষে সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিরুদ্ধে এক সুদুরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের প্রয়াসের অংশবিশেষ। সেটি ভেবে দেখার উপযুক্ত সময় এখনই।

একের পর একে স্ববিরোধী মিথ্যাচার করার পরেও কি এই সব ষড়যন্ত্রকারীরা অন্তত এটুকু খেয়াল করবেন না যে, তারা এমন মিথ্যেকে সত্য বলে চালানোর চেস্টা করছেন যে, তাদের মিথ্যাচার অবলীলায় ধরা পরে যাচ্ছে ? পাহাড়িদের সরলতা নিশ্চয় গুটিকয়েকজনের ক্রীড়নক নয়। পাহাড়িরা সরল বলেই আমি জানি। কিন্তু, তারা কি এতই বোকা যে, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে আসা ঘৃন্য কয়েকজণের চিরাচরিত ব্যক্তিস্বার্থের সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্ত মিথ্যে মেনে নিবে?

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:৫৮

খায়রুল আহসান বলেছেন: লেখাটি রিপীট হয়েছে, অর্থাৎ দুইবার এসেছে। পরেরটি সম্পাদনা করে মুছে ফেলতে পারেন।
পাহাড়ী জনগণ অত্যন্ত সহজ ও সরল। তাই তারা সহজেই নিজ সম্প্রদায়ের কিছু লেখাপড়া জানা কুচক্রীদের এবং স্বার্থান্বেষী মতলববাজদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে যায়। বিষয়টি এখানে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
পাহাড় নিয়ে ষড়যন্ত্র আজকের নয়, বহু দিনের পুরনো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.