নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সংযুক্ত সম্পাদক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

মণীশ রায় চৌধুরী

সংযুক্ত সম্পাদক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

মণীশ রায় চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রসঙ্গঃ গোমাতা (উগ্র হিন্দুত্ববাদিদের কিছু প্রশ্নের জবাব)

০৩ রা জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:৫৪

আমরা নাস্তিক, যুক্তিবাদীরা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের “গোমাতা” মার্কা রাজনীতির তীব্র বিরোধিতা করে থাকি।
তাতে কিছু হিন্দু মনোভাবাপন্ন বন্ধু প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ।
এখানকার মানুষের কাছে গরু একটি মূল্যবান সম্পদ বলেই বিবেচিত হয়।
এদেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ দুধের উপর নির্ভরশীল, তারও অন্যতম উৎস সেই গরু।
তাহলে আমরা কোন যুক্তিতে এরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীটিকে অপমান করে থাকি?
এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির জবাব দিতে বিষয়টির গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।

সত্যি কথা, আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ান এই অবলা জীবটির গুরুত্ব অপরিসীম।
বেঁচে থাকতে প্রতিমুহূর্তে নিঃশব্দে এরা আমাদের শুধু দিয়েই যায়।
এমনকি মারা যাওয়ার পরেও নিজের দেহের প্রায় প্রতিটি অংশ দিয়েই আমাদের সেবা করে থাকে।
তাহলে, কোন যুক্তিতে আমরা এরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীটিকে অপমান করি?
আসলে, আমরা কোনদিনই এই উপকারি প্রাণীটিকে অপমান করিনা।
“গোমাতার সন্তান” কথাটির মাধ্যমে আমরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী যুক্তিহীন নোংরা রাজনীতিটারই বিরোধিতা করে থাকি।


২০১২ সালের তথ্য অনুসারে সারা পৃথিবীতে বাৎসরিক প্রায় ৭১০ মিলিয়ন টন দুধ উৎপাদিত হয়।
ভারত বিশ্বের অন্যতম সেরা দুধ উৎপাদক দেশ। ভারতে বাৎসরিক প্রায় ৫৯,২১০,০০০ টন প্রায় দুধ উৎপাদিত হয়।

ভারতে দুধের অন্যতম যোগানদার প্রাণী দুটি হল গরু এবং মোষ।
এছাড়াও ছাগল, ভেড়া, উট প্রভৃতি প্রাণীদের দুধও ব্যবহৃত হয়।
খাদ্যগুণ অনুসারে গরু এবং মোষের দুধে খুব বেশি অন্তর নেই।
ফ্যাট কম থাকায় শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যে গরুর দুধ উপকারি বলে গণ্য হয়।
অপরপক্ষে, ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকায় জোয়ানদের জন্যে মোষের দুধকেই বেশি লাভজনক মনে করা হয়।
এই দুটি প্রাণীর দুধের খাদ্যগুণের তুলনামূলক আলোচনা নিচের টেবিলে দেওয়া হল।

Composition of milk.
Nutrient Cow Buffalo
Water, g 88.0 84.0
Energy, kcal 61.0 97.0
Protein, g 3.2 3.7
Fat, g 3.4 6.9
Lactose, g 4.7 5.2
Minerals, g 0.72 0.79


বন্ধুরা, ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন মানুষের বয়স ও তার শারীরিক অবস্থার তারতম্য
অনুসারে কোনক্ষেত্রে গরুর দুধ আবার কখনো মোষের দুধ উপকারি বলেই বিবেচিত হয়।
এদের দুধ থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের গুণমানেরও বিশেষ কোন অন্তর নেই।

তা সত্ত্বেও কিছু মানুষের কাছে গরু “মাতা” বলে পূজিত হয়।
অথচ, পূজাতে নির্বিচারে মোষ, ছাগল, ভেড়া বলি দিতে আমরা বিন্দুমাত্র বিবেচনা করিনা।
কোন কোন সময়তো “গোমাতার” প্রতি আমাদের ভক্তি এতটাই উথলে ওঠে যে গোমাংস রাখার গুজবে
কোন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও আমাদের হাত এতটুকু কাঁপেনা।
এই নোংরা রাজনীতির নামই হল গোবলয়ের ধর্মীয় রাজনীতি যা মানুষকে মানুষ থাকতে দেয়না।
আমরা এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই বিরোধিতা করে থাকি।

এই “গোমাতার সন্তান”রা প্রচার করে থাকে হিন্দুধর্মে গরুর শরীরেই সকল দেবতার অধিষ্ঠান।
তাই গোহত্যা বন্ধ করার জন্যে তারা ফতোয়া জারি করে থাকে।
এরা যদি সত্যি হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পড়ত, তাহলেই দেখতে পেত প্রাচীন আর্যদের যজ্ঞে গো-বলিদান অবশ্য কর্তব্য বলেই বিবেচিত হত। ঋগ্বেদ এবং সংহিতাগুলিতে অশ্বমেধ যজ্ঞের ন্যায় গোমেধ যজ্ঞের কথাও বলা আছে।
বাছুরের মাংস এবং সোমরসকেই দেবরাজ ইন্দ্রের প্রিয় খাদ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
অতিথি ও ব্রাহ্মণ সৎকারে গোমাংস অন্যতম উপকরণ ছিল বলেই অতিথিকে “গোঘ্ন” বলা হত।

কিন্তু, তৎকালীন কৃষিতে গরুর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তাই এই নির্বিচার গোহত্যার ফলে খাদ্য সমস্যার শুরু হয়।
তাই ক্রমশ ধর্মীয় অনুশাসনের মোড়কে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানও এক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু, হিন্দু ধর্মে গোহত্যা নিষিদ্ধ একথা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।

আবার, বর্তমানে ফেরা যাক।
এদেশে শুধু মুসলিমরাই গোমাংস খায় একথা সত্য নয়। এমনকি, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত বাবু
সমাজের যারা গরু খেয়ে থাকে তারাও শখ করে বা হুজুগে পড়েই খেয়ে থাকে।
তাদের সংখ্যাও খুবই কম।
কিন্তু, এই গরীব দেশে সস্তায় অ্যানিমাল প্রোটিন পাওয়ার জন্যে অসংখ্য আদিবাসী এবং প্রান্তিক মানুষদের এই
গোমাংসের উপরই নির্ভর করতে হয়।
তাদের কিন্তু সামর্থ্য নেই যে তারা আমাদের মত চিকেন-মাটন কিনে খাবে।
তাই ধর্মীয় গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে গোহত্যা নিষিদ্ধ করলে কয়েক কোটি ভারতবাসীর মুখের গ্রাসই কেড়ে নেওয়া হয়।
আপনারাই বলুন, নিরন্ন দেশবাসীর মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেওয়া কি দেশদ্রোহিতা নয়?

শুধু, মানুষ নয়। প্রতিদিন, ব্যাপক হারে দেশের চিড়িয়াখানাগুলিতে গরু ও মোষের মাংসের প্রয়োজন হয়।
এই বিপুল চাহিদা কিন্তু কোনভাবেই ছাগল আর মুরগি দিয়ে সামাল দেওয়া যাবেনা।

গোমাংসের বাণিজ্যিক চাহিদাও কিন্তু কম নয়।
গত আর্থিক বর্ষে ভারত ব্রাজিলকে টপকে ১ নং বিফ এক্সপোর্টকারী দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে।
এখানে বিফ বলতে গরু ও মোষ দুটি প্রাণীর মাংসের কথাই বলা হচ্ছে।
কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে এই অবস্থার আবার অবনতি ঘটছে।
The Economic Times এর ৬ এপ্রিল, ২০১৬ তে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৫-১৬ এর প্রথম ৩ টি
কোয়ার্টারের (৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার) তুলনায় এবছর এক্সপোর্ট প্রায় ১৬% কমে গিয়ে হয়েছে ৩.১৭ বিলিয়ন ডলার।
এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পুনরায় নিজের স্থান দখলে সক্রিয় হয়েছে ব্রাজিল।


গরুর দুধ আর মাংসের কথা তো হল। ভারতে কৃষিকাজেও গরুর ভূমিকা অপরিসীম।
অনেকেই প্রশ্ন করবেন, এক্সপোর্ট বাড়াতে গোহত্যা করলে কি কৃষিকাজে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বেনা?
তাদের কাছে, জানতে চাই স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন আমাদের দেশে সেই মান্ধাতার আমলের কৃষিব্যবস্থা প্রচলিত আছে?
সরকার পাল্টেছে, কিন্তু চাষির অবস্থা পাল্টায়নি। গরীব চাষিকে এখনো তার রুগ্ন গরু নিয়ে লাঙল চালাতে হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই, তাতে ফসল উৎপাদন কমছে।
খাদ্যস্বনির্ভরতা অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা এই অবৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবস্থা।
অথচ, ইজরায়েলের মত রুক্ষ মাটির দেশ শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সহায়তায় প্রতি হেক্টরে ভারতের থেকে অনেক
উন্নত গুণমানের ফসল ফলায়।

সকল রাজনৈতিক দলের নেতারাই এই সত্য ভাল ভাবেই জানেন।
কিন্তু, নিজেদের স্বার্থেই তারা এই সমস্যার সমাধান করেননা। শুধু, ভোট এলে চাষির দুঃখে এদের প্রাণ কেঁদে ওঠে।
তখন তারা ইচ্ছাকৃতভাবে জিইয়ে রাখা ইস্যুটা নিয়ে রাজনীতি করে থাকেন।
আমরা অনেকেই জানিনা, চাষির এই দুর্দশার কথা গভীরভাবে ভেবেছিলেন কোন এক রবীন্দ্রনাথ।
সেজন্যেই, নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও জামাই নগেন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টারি না পড়িয়ে ‘কৃষিবিদ্যা’ পড়তে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন।
নিজে বিদেশ থেকে বইপত্র আনিয়ে হাতে কলমে শ্রীনিকেতনে বিকল্প উন্নত কৃষিব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন।
তারই অর্থে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘Agronomy’ অর্থাৎ ‘কৃষিবিদ্যা’ পড়ান শুরু হয়। দুঃখের কথা,
আমরা তাকেও ঘরে সাজিয়ে রেখেছি আর তার দেখান পথও ভুলতে বসেছি।


আবার “গোমাতার” কথায় ফেরা যাক।
আচ্ছা, আমরা তো এত ভক্তি গদ্গদ হয়ে “গোমাতার” পুজো করে থাকি। আমাদের দেশের গরুগুলোর চেহারা দেখেছেন কখনো?
দিনের পর দিন অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা হাড় জিরজিরে রুগ্ন জীবগুলিকে দেখলে সত্যি করুণা হয়।
সাম্প্রতিক কালে মহারাষ্ট্রের প্রচণ্ড ক্ষরাতে কত গরু অনাহারে মারা গেছে “গোমাতার” ভক্তরা সে খবর রাখেন কি?
এবার, সবাই DDLJ তে দেখা গলায় ঘণ্টা বাঁধা গরুটার চেহারা মনে করুন।
ওরা কিন্তু “গোমাতার” পুজো করেনা। ওরা গরু, মোষ, ভেড়া এসব গবাদিপশুকে পশু মনে করেই অনেক মানবিক ব্যবহার করে।
তাদের পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতিপালিত করে। তাই তাদের থেকে অনেক বেশি দুধ, মাংস, পশম সবই পেয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ভারতীয় গরু (বস ইন্ডিকাস) এবং জার্সি গরুর দুধে জরুরি A2 টাইপের বিটা কেসিন
প্রোটিন থাকে। কিন্তু, এদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কম।
অপরপক্ষে বিদেশী হলস্টাইন গরুর (বস টরাস) দুধে A1 টাইপের বিটা কেসিন প্রোটিন থাকে যা থেকে টাইপ-১ ডাইবেটিস,
অটিজমের মত মারাত্বক কিছু রোগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে।
কিন্তু, এই গরুগুলির দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ভারতীয় বা জার্সি গরুর ৩ গুণ।
সেজন্যেই নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইজরায়েলের মত উন্নত দেশগুলি গবেষণা শুরু করেছে যাতে ক্রস ব্রিডের মাধ্যমে
এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

আবার মনে করিয়ে দিতে চাই, ওরা গরুকে গরু মনে করে বলেই তার উন্নতির জন্যে এত কিছু করতে পারে।
আর আমরা গরুকে মালা পরিয়ে, বাসি রুটি খাইয়ে পুণ্য অর্জন করে ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষার প্রচেষ্টায় মেতে আছি।

আমরা যুক্তিবাদিরা, এই অবৈজ্ঞানিক, দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসকারী রাজনীতিরই বিরোধিতা করে থাকি
এবং ভবিষ্যতেও করতে থাকব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.