নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমাজ বদলাতে হবে। অনবরত কথা বলা ছাড়া এ বদ্ধ সমাজ বদলাবে না। প্রগতিশীল সকল মানুষ যদি একসাথ কথা বলতো তবে দ্রুতই সমাজ বদলে যেতো। আমি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনবরত বলতে চ

মুজিব রহমান

মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ

মুজিব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

হুমায়ুন নামা: বাংলাদেশের সাতজন হুমায়ুন

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:০৩

বাংলাদেশে আমরা সাত জন বিশিষ্ট হুমায়ূনকে পেয়েছিলাম। এরা হলেন, শিক্ষামন্ত্রী ও লেখক হুমায়ুন কবির, লেখক ও সর্বহারা নেতা হুমায়ুন কবির, রাজনীতিবীদ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, দৈনিক বাংলার সম্পাদক-প্রাবন্ধিক আহমেদ হুমায়ূন, ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী এবং জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ। দুই হুমায়ুন কবীর প্রয়াত হয়েছেন আগেই। এক হুমায়ুন কবির বাংলা ভাষার একজন প্রগতিশীল কবি ছিলেন। তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭২ সালে সর্বহারা পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত হন। সিরাজ সিকদারের সাথে তার পার্টির কর্মসূচির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তাঁর জন্ম ১৯৪৮ সালে। তাঁর বন্ধুরে মধ্যে ছিলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, আহম্মদ ছফা, ফরহাদ মহজার, মুনতাসীর মামুন, হেলাল হাফিজ আরো অনেক তবে কোন হুমায়ুনের সাথেই তার ঘণিষ্ঠতার তথ্য পাওয়া যায় না। আরেকজন হুমায়ুন কবির ছিলেন। তিনিও লেখক ছিলেন। তিনি অবশ্য অনেক সিনিয়র। তাঁর জন্ম ১৯০৬ সালে এবং ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের কোমরপুর গ্রামে গিয়েছিলেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত নন। তবে তিনি দুই দফায় ভারতের শিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন। তিনি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ছাড়াও লেখ ও দার্শনিক হিসাবেও খ্যাতিমান ছিলেন। তিনিও খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সেক্রেটারী নির্বাচিত হয়েছিলেন আবার অক্সফোর্ড থেকেই দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অকিার করেছিলেন। ড. হুমায়ুন আজাদেরও নাম ছিল হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুন কবীর ১৯৭২ সালে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই কবি খ্যাতি পেয়েছিলেন। আগের হুমায়ুন কবির আরো আগে থেকেই খ্যাতিমান। হুমায়ুন আজাদ তাই নিজের নাম বদলে ফেলেন এফিডেফিট করে। একসাথে জীবিত বাকী ৫ হুমায়ূনকে নিয়ে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী লিখতে চেয়েছিলেন ‘পঞ্চ হুমায়ূন’ নামে একটি ফিচার। তিনি হুমায়ূন আহমেদের শহীদুল্লাহ হলের বাসায় উপসি'ত হয়ে আগ্রহের কথা বললেন। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। তবে এখন নয়। আরও কিছুদিন যাক।’ সময় যেতে লাগল আর হুমায়ূনরা ঝরে পড়তে লাগলেন। প্রথম প্রয়াত হলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, একে একে আহমেদ হুমায়ূন, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন ফরিদী এবং সবশেষে হুমায়ূন আহমেদ। তাদের একসাথে করার সুযোগ হল না।
এই পাঁচ জনের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কও ছিল। হুমায়ুন ফরিদী ও হুমায়ূন আহমেদ পরস্পরকে মিতা বলতেন। তাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকলেও ঘণিষ্ঠতা থাকার নমুনা দেখা যায়নি। এই হুমায়ূনদের মধ্যে সবচেয়ে ঘণিষ্ঠতা ছিল হুমায়ূন আহমেদ ও হুমায়ুন আজাদের মধ্যে। আবার সবচেয়ে শত্রুতাও ছিল তাদের দুজনের মধ্যেই। এক আড্ডাতে হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান ও সালেহ চৌধুরীর আদুল গায়ের ছবিও দেখেছি। তাদের আড্ডায় আরেকজন থাকতেন। তিনি হলেন ইমদাদুল হক মিলন। সবার চেয়ে কণিষ্ঠও তিনি। হুমায়ূন আজাদ ও হুমায়ূন আহমেদের বয়সও কাছাকাছি। আহমেদ ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন আর আজাদ ২৮ এপ্রিল১৯৪৭ সালে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। আজাদ দেড় বছরের বড়। দুজনের কয়েকটি চমৎকার মিল আছে। দুজনেই জন্মগ্রহণ করেছেন নানা বাড়িতে। দুইজনেই নিজের নাম নিজেই বদলেছেন। হুমায়ূন আজাদের নাম ছিল হুমায়ুন কবীর। একই নামে আগেই জন্মেছিলেন আরেক লেখক। হুমায়ূন আহমেদ এর নাম ছিল শামসুর রহমান। আগেভাগে বদলিয়ে ভালই করেছিলেন। একই সময়ের প্রধান কবি ছিলেন শামসুর রাহমান- প্রায় একই নাম হয়ে যেত। দুজনেই এসএসসিতে স্ট্যান্ড করেছিলেন। মেধাবী ছাত্র। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দুজনেই ঠাঁই নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুজনেই প্রগতিশীল এবং লেখক। তাই ঘণিষ্ঠতা হওয়া স্বাভাবিকই ছিল। কিন' তাদের মধ্যে ঘণিষ্ঠতা ছাপিয়ে দ্বন্দ্বই দৃশ্যমান ছিল আমৃত্যু।
একসময় এই দুই হুমায়ূনেরমধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। পরবর্তীতে তাদের বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে। হুমায়ুন আজাদ এক লেখায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ এবং তার বেশি বেশি লেখার পরপ্রেক্ষিতে ‘ইতর প্রাণী প্রসব করে বেশি’ ধরনের মতামত প্রকাশিত হলে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা যোগাযোগই থাকে না। তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে উঠেন। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজ বাসভবনেই আড্ডার আয়োজন করতেন। সেখানে হুমায়ুন আজাদ বিষয়ক গল্প করতেন। এই গল্পটি বহুবার বলেছেন, ‘আজাদ সাহেব আমাকে প্রায়ই বলতেন তোমার লেখা ভাল, কিন' গভীরতা নাই। একবার গভীরতা আনার জন্য আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের একটি গল্প নিজ হাতে কপি করে নিয়ে গেলাম। শুধু চরিত্রের নামগুলোকে মুসলমান করলাম, পরিবর্তন শুধু এটুকুই। হুমায়ুন আজাদ এই গল্প পড়ে বললেন- হুম, সবই ঠিক আছে, গভীরতা একটু কম।’ তার বাসভবনের এই আড্ডায় অন্য লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়েও নানা রকম কৌতুক করতেন। বিশেষ করে যেসব লেখক তাকে তুলোধুনো করতেন- তাদের গল্প বেশি করতেন। হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনকে একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। বইটির নাম ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। দুইজনেই মনে করলেন, এখানে ঔপন্যাসিক হিসাবে তারা দুজনই নষ্ট এমন সূক্ষ্ম ইংগিত রয়েছে। মিলন প্রতিশোধের বাসনায় হুমায়ুন আজাদকে একটি বই উৎসর্গ করলেন। বইটির নাম ‘বনমানুষ’। আজাদ এই ঘটনায় যথেষ্টই বিরক্ত হয়েছিলেন এবং আহমেদ যথেষ্টই মজা পেয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের একটি বিষয় হল তিনি নিজে আক্রমনাত্মক ছিলেন না, আক্রান্ত হলেও সহ্য করতেন। তিনি আহমদ ছফাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। স্বাধীনতার পরে যখন দুষ্কৃতকারীরা হুমায়ূন পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে তখন ছফা এর প্রতিবাদে কেরোসিনের টিন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। উচ্ছেদ বন্ধ না হলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিবেন। উচ্ছেদ বন্ধ হয়েছিল। হুমায়ূনের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই আহমদ ছফাই যখন হুমায়ূন আহমেদকে নিমাই ভট্টাচার্যের সমমানের লেখক হিসাবে উল্লেখ করলেন তখনও হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চুপ ছিলেন। ছফার প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য দূরে থাকুক বিরক্তও প্রকাশ করেননি। বাড়ির আড্ডার বাইরে অন্য লেখকদের নিয়ে প্রকাশ্যে নিশ্চুপ থাকতে দেখেছি। শুধু হুমায়ুন আজাদের বিষয়ে তার বিরক্তিটা তিনি প্রকাশ করেছেন। অবশ্য তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার উপরও যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন।
বিগত দুই-তিন দশকে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন। হুমায়ূন আজাদ তাদের উপন্যাসকে অপন্যাস বলে মনে করতেন। তারা পাঠককে বইমুখী করেছে কিনা জানতে চাইলে একটি মাসিক পত্রিকাকে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, এ-ধারণাটি বেরিয়েছে মগজহীন বুদ্ধিজীবীদের মাথা থেকে, যারা অনেকটা মানসিক প্রতিবন্ধী। তারা কিছু ঠিক মতো ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে পারে না, প্রতিবন্ধীদের পক্ষে তা সম্ভব নয়; তাই এ- ধরনের হাস্যকর কথা বলে। তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরকিশোরীদেরই মনে করে সাহিত্যের বিচারক; ক্লাশ নাইনের মেয়েটি ওই বইয়ের জন্যে পাগল ব‘লে ওই বইট ভালো! হুমায়ূন-মিলন তরুণদের বইমুখি করেনি, বরং প্রকৃত সাহিত্যবিমুখ করেছে, প্রকৃত বই থেকে সরিয়ে নিয়েছে। ওদের বই একশোটি পড়লেও কোনো উপকার নেই, একটিও না পড়লে কোনো ক্ষতি নেই। ওদের বই সাহিত্য বা শিল্পসৃস্টি নয়; ওগুলো শস্তা বিনোদন, যার জন্যে মগজের দরকার পড়ে না। হুমায়ূন-মিলন তো শুদ্ধ বাঙলাও লিখতে পারে না। ওদের বই পড়ে সাধারণত পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর কিশোরকিশোরী তরুণ তরুণীরা। তারা সাহিত্য উপভোগ করতে চায় না, মজা পেতে চায়, শস্তা প্রেমের গল্প পড়তে চায়। ওরা শিশুসাহিত্যকেও নষ্ট করেছে ওরা বই লেখে অস্টম শ্রেণীর ছাত্রদের ভাষায়। ওরা ওদের কিশোরকিশোরী পাঠকপাঠিকাদের মানসিক প্রতিবন্ধীতে পরিণত করে, ওদের বই পড়ে তারা বারো-তেরো বছর বয়সেই আটকে থাকে; তাদের মনের বয়স বাড়ে না। ওদের বই যারা পড়ে, তারা কোনো উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়তে পারে না; উৎকৃষ্ট সাহিত্য তাদের কাছে কঠিন লাগে। কেননা তারা সাধারণত মানসিকভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক হয় না। তারা কখনো রবীন্দ্রনাথ বা সুধীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে পারবে না। একটু বড়ো হয়ে তারা আর বই পড়ে না। অবশ্য কেউ কেউ ওদের বইয়ের স্তর থেকে উঠে আসে; অনেক তরণতরুণী আমার কাছে এসে বলে যে ওই সমস্ত বাজে বই পড়ে তারা সময় নষ্ট করেছে, এখন তারা লজ্জাবোধ করে; আর অধিকাংশই বড়ো হয়ে ওদের বইয়ে কোনো মজা পায় না, আবার উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়তে গিয়েও বিপন্ন বোধ করে। আমাদের অধ্যাপক থেকে সাংবাদিক থেকে বুদ্ধিজীবী থেকে মন্ত্রীরাও সাহিত্যের ব্যাপার মানসিকভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাই ওদের নিয়ে মাতামাতি করে। এর পেছনে অবশ্য একটু ব্যবসাও আছে। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের জটিলতা ওদের পাঠকেরা বুঝতে পারে না। তাই ওরা পাঠক সৃষ্টি না করে পাঠক ধ্বংস করেছে, যারা পাঠক হতে পারতো তারা কখনো পাঠক হবে না। নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শংকর, নিমাই ভট্টাচার্য, আকবর হোসেনের বইও এক সময় জনপ্রিয় ছিলো; কিন' তারা কোনো লেখক নন। এ-দুজনও তাই। ওরা টিকে আছে টেলিভিশনের সিরিয়াল নির্ভর করে। অজস্র চ্যানেলে অজস্র সিরিযাল চলে, ওগুলোর লেখকদের নাম কেউ জানে? আমাদের নিম্নসংস্কৃতির দেশেই সিরিয়ালঅলাদের লেখক বলা হয়। ক্রিস্টি, চেজ, হ্যারণ্ড রবিন্স ও আরো শতো শতো লেখকের বই মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে ও হচ্ছে কিন' ইংরেজি সাহিত্যে তাদের কোনো স্থান আছে? এখন হ্যারি পটার লিখে যে-মহিলা বিলিয়নঅলী হয়েছেন, আরো হবেন, তাঁর কোন স্থান আছে ইংরেজি সাহিত্যে? হুমায়ূন আমার সঙ্গে প্রথম দেখা করেছিলো এক বোঝা বই কাঁধে করে নিয়ে এসে। হুমায়ূন সুবিধা ও নাম ও টাকার জন্যে সব কিছু করতে পারে, আবুল ফজলের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র আনতে পারে, আবার নাজমুল হুদার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারে অনুদানের জন্যে। এক সময় এদের সঙ্গে আমার বেশ সম্পর্ক ছিলো, আমার বাসায় প্রায়ই পানের (মদ্যপানের) আড্ডা বসতো। ওরা দুজন কয়েক বছর ধরে চেয়েছিলো, ওদের প্রশংসা করে কিছু লিখি; দুটো বইও তারা আমার নামে উৎসর্গ করেছিলো। আমি উৎসর্গ করেছিলাম দুজনকে একটি বই। এতে অনেকে ক্ষুন্ন হয় যে আমি ওদের নামে বই উৎসর্গ করেছি। ওদের মতে এতো নিম্নমানের লেখকদের আমি বই উৎসর্গ করতে পারি না। হুমায়ূন-মিলন সিরিয়াল-প্যাকেজ নাটক-অ্যাড-ডকুমেন্টারির ব্যবসায়ী, এতে কোটি কোটি টাকা আসে। তাই ক্ষমতায় যে দলই আসে, সে-দলের কাছেই বিনীত থাকে; হাসিনা এলে ওরা মুজিবের জয়গান গায়, খালেদা এলে জিয়ার জয়গান গায়। হুমায়ূন-মিলন উৎকৃষ্ট সাহিত্য লিখবে কী, তারা উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়েও নি কখনো।
বিভিন্ন বিষয়ে তাদের চিন্তা ও আচরণে বিপরীত অবস্থাও দেখা যায়। হুমায়ুন আজাদ অধ্যাপক ইউনুছকে বলেছেন, ‘কাবুলিওয়ালা মাত্র’। তিনি মনে করতেন এই গ্রামীণ ব্যাংকের সাহায্যে দেশের কোন উন্নতি হয়নি। ইউনুছ সাহেব দেশে দেশে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের স'প পাঠায় আর পুরষ্কার অর্জন করে। হুমায়ূন আহমেদ ভিন্ন অবস্থানে। তিনি বলেছেন, অধ্যাপক ইউনুছ যখন নোবেল পান তখন আমি নাটকের একটা ছোট্ট দল নিয়ে কাঠমুন্ডুর হোটেল এভারেস্টে থাকি। হোটেল লবিতে বসে চা খাচ্ছি। হঠাৎ আমার ইউনিটের একজন চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল। সে বলছে, স্যার, আমরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। স্যার আমরা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছি। সে বলেনি, অধ্যাপক ইউনুছ নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। সে বলেছে আমরা পেয়েছি। অধ্যাপক ইউনুছের অর্জন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের অর্জন। এই আনন্দ সংবাদ শোনার পর শুটিং বাতিল করে উৎসবের আয়োজন করি। সেই উৎসবের শিখা বুকে জ্বালিয়ে রেখেছি। দেশের বাইরে যখন সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে যাই তখন আগের মতো হীনমন্যতায় ভুগি না। কারণ এই সবুজ পাসপোর্ট অধ্যাপক ইউনুছও ব্যবহার করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই তার পেছনে থাকবো।
হুমায়ুন আজাদ আরো বলেছেন, হুমায়ূন-মিলন একসময় আমার বাসায় প্রায়ই আসতো, হুমায়ূন তখন ধনী হয় নি, আমার থেকে ৫০০ টাকাও ধার নিতো। টিভি সিরিয়াল তার ধনের খাল খুলে দেয়। টাকা হলে মানুষ কতো কী করে- গাধার জন্যে প্রাসাদ বানায়, সমুদ্রে বাড়ি বানায়, লোকেরা ওই বাড়িকে বলে পাগলের বাড়ি। হুমায়ূন এসে ধরলো তার পিতার নামে গ্রামে পাঠাগার করবে, ওই অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হবে- সঙ্গে নির্মলেন্দু ও মিলন। হুমায়ূনের স্ত্রী, কন্যা, মা, ও অন্যরা তো ছিলোই। অমন বিরক্তিকর পরিস্তিতিতে আমি কখনো পড়ি নি। কিশোরগঞ্জ না কোথাকার এক পাটক্ষেতের ধারে সন্ধ্যার পর আমরা নামলাম, খেতের আলে হাঁটু পানি, ওই পানিতে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে, অন্ধকারের মধ্যে কোথায় গিয়ে যে উঠলাম, কেমনে উঠলাম তা আমি বুঝতে পারলাম না। একটি সমস্যা হলো ওদের ওখানে কোনো পায়খানা নেই, পাটখেতে বা অন্য কোনো খেতে যেত হয়, ওা প্রকৃতির ডাক শুনে দৌঁড়ায়। এক ইস্কুলের বিএ পাশ, বেশ সুন্দরী, এক শিক্ষয়িত্রী এক বদনা পানি নিয়ে চললো আমার সঙ্গে, আমি বিব্রত বোধ করতে থাকলে; সে বললো, স্যার, আপনি করেন, আমি আছি। আরেকটি সমস্যা হলো- যে বাড়িতেই যাই নির্মলেন্দু, হুমায়ূন, মিলন বুড়োবুড়ীদের পা ছুঁয়ে প্রণামে/সালামে মেতে উঠতে থাকে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। শহর থেকে লেখকেরা গেছি প্রণাম/সালাম করতে? এটা আমার জন্যে একটি সমস্যা হলো। এ নিযে আমার ওই পদধূলিপবিত্র তিনজনের সঙ্গে বেশ তর্ক হয়ে গেলো। ওই ভ্রমণটা ছিলো আমর জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ ভ্রমণ। পা ওরা এখনো ছুঁয়ে চলছে, কখনো হাসিনার কখনো খালেদার, আরো অনেকের। হাসিনা-খালেদার মতো অতো ওপরে যেতে হবে না, দরকার হলে ওরা সহকারি সচিবেরও পাও ছুঁতে পারে। ওরা কাঁচা বই লিখলেও মানুষ হিশেবে পাকা।
এভাবেই চূড়ান্ত আক্রমণ করে হুমায়ুন আজাদ তৃপ্তি পেতেন। তিনি হুমায়ুন আহমেদ ছাড়াও আহমেদ ছফা, তছলিমা নাসরিন, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক লেখকের সাথেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। আক্রান্তও হয়েছেন। আহমেদ ছফা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, শুকরের বাচ্চার যখন নতুন দাঁত গজায় তখন বাপের পাছায় কামড় দিয়ে পরীক্ষা করে দাঁত শক্ত হয়েছে কিনা। হুমায়ূন আহমেদও আজাদের কিশোরগঞ্জ কাহিনী নিয়ে মন্তব্য করেছেন খুবই সামান্য- ‘যথেষ্ট বিরক্ত করেছেন’। অবশ্য সৈয়দ হকের সাথে হুমায়ূন আহমেদও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ে বা পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তা না হলে হুমায়ূন আহমেদের দুইবার দুইজন বালিকাকে বিয়ে করা নিয়ে চটুল কোন মন্তব্য হয়তো আমরা পেতাম। হুমায়ুন আজাদ এক্ষেত্রে তার সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছেন। যখন তার সহপাঠিনী মাস্টার্স শেষ করেছেন। হুমায়ূন আজাদ বিতর্ক সৃষ্টি করতেন; হুমায়ূন আহমেদ সযত্নে বিতর্ক পরিহার করতেন। হুমায়ূন আজাদ ছিলেন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী আর হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঈশ্বরে সন্দেহবাদী মানুষ। হুমায়ুন আজাদ আক্রমন করতেন প্রায় সবাইকেই। তিনি প্রথাবিরোধী ছিলেন বলে দাবী করতেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করেছেন তীব্র ভাষায়। জামায়াত, কমুনিস্ট, বিএনপি, আওয়ামীলীগ সবাইকে। পার্থক্য অবশ্য আছে। জামায়াতকে তিনি সবচেয়ে বেশি আক্রমন করতেন। বহুমানুষকে তিনি আক্রমণ করেছেন। অনেকেই ভীত থাকতো, কখন থলের বিড়ালটি হুমায়ূন আজাদ বের করে দেন। হুমায়ূন আহমেদ এক্ষেত্রে নির্বিকার। তিনি পারতপক্ষে কাউকেই আক্রমন করতেন না। তার বই পড়ে ধর্মান্ধরা বুঝতে পারতো না তিনি ধর্মের বা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে না পক্ষে। তিনি একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন না। উগ্র মৌলবাদীদের বিরুদ্ধেও সেভাবে কিছু বলতেন না। অর্থাৎ তিনি উটকো ঝামেলায় জড়াতে চাননি। হুমায়ুন আজাদ লিখতেন, ভাষাবিজ্ঞান, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদি। নিজেকে বহুমার্ত্রিক লেখক বলতেন। তিনি লিখেও আক্রমন করতেন, আবার মুখেও আক্রমন করতেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেও কারো জবাব দিতেন না, মুখেও আক্রমন করতেন না। লিখতেন প্রধানত উপন্যাস। এছাড়া নাটক-সিনেমা বানাতেন। দুজনের পাঠকও ভিন্ন। হুমায়ূন আজাদ সাক্ষাৎকার দিতে পছন্দ করতেন। অনেক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। চারজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেনও। এসব নিয়ে কয়েকটি বইও রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার সেভাবে জনপ্রিয় ছিল না। একেবারে শেষে প্রকৃতি আরেকটি বিষয়ে তাদের মিলিয়ে দিলেন। দুজনেরই মৃত্যু হল বিদেশের মাটিতে। দুজনেরই লাশ আসলো দেশে। অগণিত ভক্ত-আত্মীয়-স্বজন অশ্রুসজল চোখে তাদের লাশ সমাহিত করেছে প্রকৃতির মধ্যে- হুমায়ুন আজাদকে বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে, হুমায়ূন আহমেদকে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে।
দুজন লেখকের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। বাংলা বা বিশ্বসাহিত্যে এটা অস্বাভাবিক নয়, এধরনের ঘটনা হরদমই ঘটেছে। তাদের মধ্যে যত দ্বন্দ্বই থাকুক, তারা দুজনই বাংলাদেশের ভিন্নধারার গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী সেই সব সুবিধাভোগী ভাগ্যবানদের একজন যারা স্বৈরশাসক আবার গণতান্ত্রিক সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি হতে পারেন। তিনি এরশাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন আর মৃত্যুবরণ করেন আওয়ামী লীগ শাসনামলে স্পীকার থাকা অবস'ায়। ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের মতোই তাঁরও পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাঁর পিতা আব্দুর রশিদ চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় বিধান সভার সদস্য এবং মা সিরাজুন নেছা চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। এরকম বহুদলের সুবিধাবাদী লোকদের সুবিধা এতে আরো বেড়ে যায়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক তার উপরের পর্যায়ে লোকজন থেকেই যায়। তাঁর আওয়ামী লীগে যোগ দেযার পরেই শোনা গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে তিনি ইউরোপে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ফলে তার সুযোগ বেড়ে গেল এবং খুব দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলেও স্পীকারের চেয়ারে বসলে সেটা ভরে যেতো, বর্তমান রাষ্ট্রপতি সে তুলনায় স্পীকার থাকাকালীনও অনেক ক্ষীণকায় ছিলেন। তিনি হুমায়ুন কবীরের মতোই ইউরোপে অধ্যয়ন করেন এবং ছাত্রদের নেতৃত্ব দেন। এরশাদের আমলে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একটি অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এরশাদের দুটি জবরদখল নির্বাচন ৮৬ ও ৮৮ তে তিনি বিজয়ে হন। বঙ্গবন্ধুর আমলে তিনি জার্মানির রাষ্ট্রদূত ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের শাসকরাও তাঁর উপর আস'া রেখেছিল, সে সবারই বিশ্বস্ত মানুষ ছিলেন। এরপরেও তিনি সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালে, মৃত্যবরণ করেন ২০০১ সালে। হুমায়ুন কবীর তাঁর চেয়ে ২২ বছরের সিনিয়র ছিলেন। ভারতীয় কংগ্রেস তাকে শিক্ষামন্ত্রী করেছিল। অনেক বড় বিষয়, নেহেরু মন্ত্রীপরিষদের শিক্ষামন্ত্রী হওয়া।
হুমায়ুন কবীর নামটি আলোচিত হয় পাঠ্যপুস্তকে তাঁর ‘মেঘনার ঢল’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ায়। আমিনা নামের মেয়েটিকে তাঁর মা মেঘনার তীরে গরু আনতে পাঠিয়েছিল কিন' সে মেঘনার ঢলে ভেসে যায়। এটি মৌলিক কবিতা নয়, অনুবাদ কবিতা। তারপরেও এ কবিতাটি তাকে আলোচিত করে। মূলত সেই টানেই খুঁতে গিয়েছিলাম তাঁর পৈতৃকবাড়ি ফরিদপুরের কোমরপুরে। কোমারপুর যাওয়া সহজই। সাথে ছিল আমার গার্লফ্রেন্ড। এলাকার শিক্ষিত কয়েক তরুণ হুমায়ূন আহমেদ এর নাম জানেন। ওরা বলে, তার বাড়িতো ফরিদপুরে নয়। তবুও বুঝাই আহমেদ নয়, কবীর। বিখ্যাত মানুষ, মেঘনার ঢল কবিতার লেখক, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। কেউ চিনে না। তবু হুমায়ুন কবীরের খোঁজ করতে গিয়ে প্রথম পেলাম এক চাষিকে নাম হুমায়ুন ঢালী, আরেকজন ব্যবসায়ী হুমায়ুন মিয়া, আরেকজন কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। সেই বাড়িতে বসতেই টের পেলাম ১০/১২ জন স্থানীয় মাস্তান ঘিরে ধরেছে আমাদের। ওদের মতিগতি ভাল নয়। আমাদের ঘিরে ধরে ১০ হাজার টাকা চাঁদা চাইলেন। বিয়ে করিয়ে দিবেন ঠিকঠাক মতো, নইলে যেতে পারবো না। আমার খুবই রাগ হল। আমিও ওদের ফরিদপুর শহরের কয়েকজন মাস্তান ছাত্রনেতার নাম বললাম। বললাম, ওরা আমার বন্ধু, ওদের সাথে রাজনীতি করি। এসব বলতে বলতে, কোথা থেকে একটি রিক্সা চলে আসলো, আমরাও লাফিয়ে উঠে পড়লাম। ওরা একটু ভয় পাওয়াতে মুক্তি পেলাম। কিন' হুমায়ুন কবীরের খোঁজ ছাড়াই ফেরত আসলাম। পরে আমার এক কমরেড বন্ধু বলল, মেঘনার ঢল কবিতাটি অন্য হুমায়ুন কবীরের। সে সর্বহারা পার্টি করতো, সিরাজ সিকদারের সাথে দ্বন্দ্বে খুন হয়ে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এই কমরেড হুমায়ুন কবীরের দুটি কাব্যগ্রন' তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তবে কাব্যদুটিতে বামপন্থী চেতনার প্রকাশ ছিল। ইঁদুর গল্পের লেখক সোমেন চন্দের মতো অনেক সম্ভাবনা তাঁরও ছিল, নিজেরাই যদি নিজেদের শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনাকে খুন করে তবে তারা কি আগাতে পারে? ‘মেঘনার ঢল’ কবিতাটি ফরিদপুরের কোমরপুরের হুমায়ুন কবীরেরই অনুবাদ করা কবিতা।
হুমায়ুন ফরিদীর ‘দহন’ সিনেমাটির কথা এখনো মনে আছে। সেখানে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়, সুদর্শন নয় তবে আমাদের নিজেদের একজনই মনে হতো। শেষ দৃশ্যে সে সামনে এগিয়ে গেলে থাকে শুধু কাঁটাতারের বেড়া। হুমায়ুন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের শেষ দৃশ্যে সুবর্ণা মোস্তফাও এমন একটি দৃশ্যে অভিনয় করেন, সামনে অফুরন্ত জলরাশি- ‘কোথাও কেউ নেই’। তাদের দুজনের দুজনার হওয়ার কথা ছিল না, সুবর্ণা ফরিদীর বাহুডোরেই ধরা দিলেন। শেষ পর্যন্ত কেউ কারো থাকলেন না। আমরা জানতাম সুবর্ণার সাথে আফজাল হোসেনের হৃদয় ঘটিত সম্পর্ক রয়েছে। ওদিকে ফরিদীতো বিবাহিত। দাবার চাল উল্টে গেল। ফরিদীর সাথে সুবর্ণার বিয়েটাও সবাই স্বাগতই জানিয়েছে। সুবর্ণাকে ভালবাসা নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। একাবার নাকি দুজনের ঝগড়া হওয়াতে সুবর্ণা ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে খিল লাগিয়ে দেয় আর ফরিদী যে ঘরে ঝগড়া হয়েছিল সেই ঘরের দেয়াল জুড়ে লিখেন, সুবর্ণা আমি তোমায় ভালবাসী। সুবর্ণাকে সে ভালবাসতো। ভালবাসাতো একপাক্ষিক হয় না। সুবর্ণাতো শুরুতেও তাকে ভালবাসেনি, শেষেও তাকে ছেড়ে চলে যায়। অফুরন্ত প্রাণশক্তির মানুষ খয়ে গেলো, খসে গেলো। ফরিদী বলতেন, ‘বাঁচো আর বাঁচতে দাও। জীবনটা অনেক দামী, এটার যত্ন করো। পৃথিবী নামক গ্রহে তোমার কোন অবদান থাকবে না, এটা কিভাবে হয়? হ্যাঁ এই গ্রহে অনেক সমস্যা। সেটাই সব নয়, এ গ্রহে সবাই বুশ না, এই গ্রহে রবীন্দ্রনাথও আছেন’। তাহলে কি বলবো? সচেতন থাকলেই সব হয় না। নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, বিচ্ছেদেও। অভিনয়ে পারলেও বিচ্ছেদে পারেননি। সম্ভবত এই বিচ্ছেদটা ফরিদী সহ্য করতে পারেন নি। তাঁর জীবনের শেষটা তাই দ্রুতই এগিয়ে আসে। ষাট বছর বেশি বয়স নয়। সুবর্ণা ঠিকই পুকুর ফেলে ঘটির জলেই আকৃষ্ট হলেন। ফরিদীর একটি স্মরণীয় উক্তি- ‘সুখি হবার একটাই উপায়, কেউ কাউকে ঠকাবেন না, অবশ্যই সুখি হবেন’। কিন্তু যখন নিজে ঠকে যাবেন, তখন তা হয়তো জীবন দিয়েই শুধরাতে হয়।
মানুষ ফরিদীর অভিনয়কে যতটা পছন্দ করেছে, সেটা অতুলনীয়। বাংলাদেশে কারো অভিনয় মানুষের হৃদয়ে এতোটা দাগ আর কাটেনি। তাঁর অভিনয়ের বাঁক পরিবর্তন হয় শহিদুল্লাহ কায়সারের ‘সংসপ্তক’ নাটকে অভিনয় করে। কানকাটা রমজান চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। আমি ওই সময় উপন্যাসটি পড়ার সুযোগ পাই এবং পড়ে ফেলি। এর পরেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি ভিলেন হিসাবে আবিভূত হন। শুধু অভিনয়েই নয়, মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জৈব রসায়ন বিভাগে, পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে অর্থনীতিতে ভর্তি হন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেকানে অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। সেই মেধার স্ফূরণই দেখি অভিনয়ে। যারা তাঁর ভাঙ্গনের শব্দ শুনিতে বৃদ্ধ সেরাজ তালুকদারের অভিনয় দেখেছেন, যারা ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘বকুলপুর কত দূর’ ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চান মিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ’ দেখেছেন তারা তরুণ হুমায়ুন ফরিদির দুর্দান্ত অভিনয় দেখেছেন। হুমায়ুন ফরিদী হুমায়ুন আহমেদকে মিতা বলতেন, নামের মিলের কারণে। ফরিদীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। তিনি পত্রিকায় খুবই আবেগতাড়িত একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন। পরে তার বইতেও লেখাটি স্থান পায়। সম্পর্কে মিতা হলেও তাদের মধ্যে ঘণিষ্ঠতা ছিল না, তারা বন্ধুও ছিলেন না। দুজন দুজনকে পছন্দ করেছেন, কালেভদ্রে দেখা হতো। হুমায়ুন আহমেদ একটি দাবী করেছিলেন, হুমায়ুন ফরিদীকে একুশে পদক দেয়ার। ফরিদী অবশ্য চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্টার পেয়েছিলেন।
রমজানের সেই পিলে চমকানো হাসির কথা কি মানুষ ভুলতে পারবে? হাসি কতরকম ভাবে হাসা যায়- বিস্ময়কর। তাঁর অভিনিত অনেকগুলো বাংলা সিনেমাও দেখেছি- ভিলেন হিসাবে তাকে অতিক্রমের কোন চেষ্টাও বাংলা সিনেমায় দেখিনি। শুধু অভিনয়েই নয়, তিনি যখন জাহাঙ্গীর নগরে পড়তেন তখনও ছিলেন প্রাণচঞ্চল। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন, আবার দুষ্টুমিতেও তাঁর সমান কেউ ছিল না। ঈদের সময় স্যারের গুরু চুরি করে কোরবানী দিয়ে আবার স্যারকেই মাংশ ফেরত দেয়া কিংবা হলের নাম ফলক ভেঙ্গে গেলে সেটা প্রশাসন ঠিক না করায় ‘হুমায়ুন ফরিদী হল’ নামে নাম করণ করে দেয়া।
অনেক উপন্যাস পড়তে গিয়ে, জটিল জটিল চরিত্রকে চলচ্চিত্র রূপে চিন্তা করতাম। দেখতাম যে কোন ধরনের চরিত্রেই মানিয়ে যেতো ফরিদীকে। এখন কি একটা জটিল চরিত্র সুচারো রূপে উপস্থাপন করার কেউ আছেন। আমরা এখন ভাড়ামোকেই অভিনয় মনে করছি। ফরিদীর জামানায় এটা দর্শকরা ভাবতো না কারণ তারা ফরিদীকে দেখতো চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে।
দৈনিক বাংলা পত্রিকাটি ক্ষয় হতে হতে এক সময় মরে যায়, সরকারি পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও। স্বৈরশাসকদের গুণগান পাঠকরা পয়সা দিয়ে কিনে পড়বে কেন? সরকারের চাপের মুখে সম্পাদকদের নতি স্বীকার করতেই হতো। দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান, সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবীব। আরো বহু বিখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক বাংলা এবং পূর্বনাম দৈনিক পাকিস্তানে সাংবাদিকতা করেছেন। এখান থেকে সাংবাদিকতা করে অন্যত্র সফল হয়েছেন আরো অনেকে। দৈনিক বাংলার একজন উজ্জ্বল সম্পাদক ছিলেন আহমেদ হুমায়ূন। তিনি একসময় অধ্যাপনা করতেন পদার্থবিদ্যা বিভাগে। পরে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসাবে নেন। তাঁর জানার পরিধি ছিল ব্যাপক। প্রগতিশীল মুক্তমনের মানুষ ছিলেন। পাকিস্তান আমলেও নিষিদ্ধ রবীন্দ্র চর্চা করেছেন। পত্রিকায় নিয়মিতই কলাম লিখতেন আবার প্রাবন্ধিক হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে তাঁর ব্যাপক পড়াশোনা ছিল। তিনি অনুবাদক ও ছড়াকারও ছিলেন। তাঁর হাত ধরে সাংবাদিকতা শিখেছেন অনেকে। সম্পাদক হিসাবে তিনি উচু মানের ছিলেন এসব কারণেই।
তাঁর একটি বাজে অভ্যাস ছিল, অফিসে বসেই খানিকটা পান করে নিতেন মানে মদ্যপান করতেন। এ অভিযোগ অবশ্য আরো সম্পাদকের বিরুদ্ধেও ছিল। একবার আমার বস তরিকুল গণি চেতন (সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পুত্র) আমাকে পাঠালেন বাংলার বাণীর সম্পাদকের কাছে। যাওয়ার পরেতো আর দেখা করতে পারি না। এপয়েন্টমেন্ট করা বললেও, তার পিএ কিছুতেই দেখা করতে দিলেন না। পরে একজন জানালো, ওনি বেহেড অবস্থায় আছেন। অবশ্য আমার ওই বস নিজেও অফিসে বসে সোমরস খেতে পছন্দ করতেন। একদিন আমাদের দুজন নারী সহকর্মী ওনার কক্ষ থেকে বের হয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন। স্যারকে বেহেড হতে আর কখনো শুনিনি বা দেখিনি। স্যারের পিতা যাদু মিয়ার বিরুদ্ধেও ব্যাপক মদ্যপানের অভিযোগ ছিল। একবার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তিনি বলছিলেন, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে- চাল, আটা, তেল, ডাল, পেয়াজ, রসুন, মরিচ .. তবে মদের দাম বেড়েছে কিনা সেটা আমি বলতে পারবো না, বলতে পারবে আমার যাইদু (যাদু মিয়া)। মঞ্চে যাদু মিয়া বসা ছিলেন। ভাসানী তাঁর দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছিলেন। যাদু মিয়া বলেছিলেন, ধুর হুজুর যে কি কন? মাইকে এসব কথা প্রচার হয়ে গেলে উপসি'ত জনতার মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। ভাসানী ন্যাপ করে আসা একজন বাম নেতার কাছ থেকেই শুনেছিলাম। হুমায়ুন আজাদ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে মদ্যপানের কথা উল্লেখ করেছেন।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৭

আজগুবী বলেছেন: পড়লাম!
অনেক অজানা কিছু জানতে পারলাম।
ধন্যবাদ!

২| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৩১

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: ভালো লাগলো পোস্টটা!

৩| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:১৪

আখেনাটেন বলেছেন: অনেক তথ্যের সমাহার। গোটাটায় পড়লাম।

ভালোলাগল।

হুমায়ুন কবীরের ভাতিজা অালতামাস কবীর কিছুদিন আগেও ভারতের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ৮:৫৩

মুজিব রহমান বলেছেন: সিগমা হুদাও ঐ পরিবারের মেয়ে অর্থাৎ হুমায়ুন কবীরের ভাইয়ের নাতনি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.