নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমাজ বদলাতে হবে। অনবরত কথা বলা ছাড়া এ বদ্ধ সমাজ বদলাবে না। প্রগতিশীল সকল মানুষ যদি একসাথ কথা বলতো তবে দ্রুতই সমাজ বদলে যেতো। আমি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনবরত বলতে চ

মুজিব রহমান

মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ

মুজিব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গুরুশিষ্য রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দ

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৮:৫৫

লেখাটি জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিকল্প নবজাগরণ’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। তাই তাঁর সম্পর্কে কিছু বলে নেই।
জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন বিক্রমপুরের অনন্য কৃতিসন্তান। তিনিও অতীশ দিপঙ্করের মতো বজ্রযোগিনী গ্রামের সন্তান। দিল্লির বিদেশমন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারী থাকাকালীন শিক্ষকতা পেশার টানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে নিউইংর্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো এবং ওয়াশিংটনের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজৃঅতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর বহুসংখ্যক গ্রন' ও গবেষণাপত্র দেশেবিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
উনিশ শতকের ধর্মসংস্কার প্রবাহ পরিণতি লাভ করেছিলো রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দুধর্মের নব বৈদান্তিক ভাষ্য নির্মাণ ও প্রচারে। রাম উপাসক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পিতামাতার সন্তান রামকৃষ্ণ চট্টপাধ্যায় পৈতৃক নাম গদাধর বাগদাই) ১৭ বছর বয়সে জমিদার রাণী রাসমণির দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের পুরোহিত হন। তার দাদাও একই কাজ করতেন। ক্রমশ রামকৃষ্ণ রাসমণির কালীমন্দিরের একমাত্র পপুরোহিত হয়ে ওঠেন এবং কালী সাধক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। রাসমণি ও তার জামাতা তাকে পরমহংস এবং ঈশ্বরের অবতার বলে ঘোষণা করেন। তিনি তার বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে কখনো সহবাস করেননি এবং তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। এসময় নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামের এক বেকার গ্রাজুয়েট যুবক দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করে তার অনুগামী এবং শিষ্যে পরিণত হন। ইনিই পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে খ্যাত হন।
রামকৃষ্ণ বলেছিলেন যে, অদ্বৈতবাদের সঙ্গে মূর্তিপূজার কোনও বিরোধ নেই। ব্যক্তি মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাকার ব্রহ্ম বা একেশ্বরকেও সাকার মূর্তি হিসেবে পূজো করা যেতে পারে। এতে মূর্তিপূজো বিরোধী ধর্মসংস্কার আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রূপে হিন্দু সমাজের কাছে বেদান্ত প্রকাশিত হলো। ফলে বেদ ও পুরাণের ঐতিহ্যে অধিষ্ঠিত হিন্দুধর্মের সব রকম যাগযজ্ঞ, পূজোপার্বণ, ব্রত-উপাচারই রামকৃষ্ণের বেদান্ত ভাষ্যের সমর্থনে পুষ্ট হলো। অদ্বৈতবাদী চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা হিন্দু মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের পক্ষে সহজ হয়েছিলো। রামকৃষ্ণ শঙ্করাচার্যের কামিনীকাঞ্চন ও কর্মত্যাগের সন্ন্যাসবাদকেই অদ্বৈত বেদান্তের আদর্শ রূপে তুলে ধরলেও জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনোভাবে বিত্ত অর্জনের বিরোধিতা করেননি। হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরে বৈষ্ণব ও শাক্তদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসছিল, রামকৃষ্ণ তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক স্তরে তা দূর করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘যতমত তত পথ’- রামকৃষ্ণের এই বিখ্যাত উক্তি শুধু যে সব শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের হিন্দুদের এক করবার মন্ত্র ছিলো তাই নয়। এর ফলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মোকাবেলা করাও সহজ হয়েছিল। একইজল জলকে হিন্দুরা বলে জল, মুসলমানরা বলে পানি আর খিস্টানরা বলে ওয়াটার। তেমনি ভাবে ঈশ্বরকেই যথাক্রমে ভগবান, আল্লা এবং গড বলা হয়। এসব বলে মধ্যবিত্তর সমাদর পেলেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে দেখা করেও তাকে প্রভাবিত করতে পারেন নি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথ দেখা হলে তিনি বঙ্কিমকে মানব জীবনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করেন এবং বঙ্কিম অবজ্ঞা ভরে উত্তর দেন আহার, নিদ্রা, মৈথুন। রামকৃষ্ণ এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
রামকৃষ্ণের ধর্মমতের যে বিশেষ দুর্বলতাগুলি নবজাগরণের পরিপন'ী ছিলো, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য তার যুক্তিবাদ বা জ্ঞানবিচারের বিরোধিতা। যে বিচারবুদ্ধি বা জ্ঞানবিচার নবজাগরণের প্রাথমিক পরিচয়, রামকৃষ্ণ তার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার প্রিয় রামপ্রসাদী শ্যামাসঙ্গীত ছিলো, ‘কাজ নেই মোর জ্ঞান বিচারে, আমায় দে মা পাগল করে’। জ্ঞানবিচার ত্যাগ করে ভক্তিরসে পাগল হওয়া ভক্তিমার্গের পরাকাষ্ঠা হতে পারে, কিন' এ পথে পৃথিবীর মানুষের বৌদ্ধিক এবং জাগতিক বিকাশ কদাপি সম্ভব নয়। এমনকি সংসারে এক হাত আর ঈশ্বরের পায়ে আরেক হাত রেখে এ পথে জমিদারি বা ব্যবসা সামলানোরও সম্ভব নয়। কঠিন বিদ্যাচর্চা এবং বিচারবুদ্ধির পথেই চিরকাল মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে। ভক্তিরস বা জীবাত্মার পরমাত্মায় লয়ের মাধ্যমে নয়।রামকৃষ্ণে এই নবজাগরণ বিরোধী দৃষ্টিকোণ সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ থাকে না যখন তিনি তার বিচারবুদ্ধিতে বজ্রাঘাত করবার জন্য কালীর কাছে প্রার্থনা করেন।
দ্বিতীয়ত, রামকৃষ্ণে অদ্বৈত দর্শনে অধিজাগতিক স্তরে সব মানুষই পরম ব্রহ্মের প্রকাশ স্বরূপ গণ্য হলেও জাগতিক জীবনে ধনী ও দরিদ্র, জমিদার ও প্রজা, আর্য ও শূদ্র পার্থক্য সম্বন্ধে তিনি উদাসীন ছিলেন। বাস্তব ক্ষেত্রে ধনী, জমিদার ও আর্যদের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ছিল বেশি। অর্থাৎ যে মানবতা ভিত্তিক সাম্যতত্ত্ব প্রকৃত নবজাগরণের আরেকটি পরিচয়, তাও রামকৃষ্ণ মতে অনুপসি'ত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যে বর্ণবেদ-জাতিভেদ প্রথা ছিলো উচ্চনীচ আর্থ সামাজিক অসাম্য ও ভেদাভেদের সর্বপ্রধান ধর্মীয় উপকরণ, সে সম্বন্ধেও রামকৃষ্ণের মনোভাব ছিলো কার্যত ইতিবাচক। রাণী রাসমণি নীচু কৈবর্ত জাতির মানুষ হিসেবে শূদ্র শ্রেণির সদস্য ছিলেন। রামকৃষ্ণ নিজে দক্ষিণেশ্বরে পৌরোহিত্য করবার আগেই তার দাদা রামকুমারকে সেখানে এ কারণে পৌরোহিত্য ত্যাগ করতে বলেছিলেন যে কৈবর্তের মন্দিরে ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য ধর্মবিরোধী কাজ। উত্তরে রামকুমার প্রথমে বলেছিলেন যে এই কৈবর্তরা অত্যন্ত ধনী মানুষ, এদের আশ্রয়ে থাকলে তাদের আর অন্নচিন্তা এবং সাংসারিক সমস্যা থাকবে না। রামকৃষ্ণ তথাপি অনড় থাকলে রামকুমার আরও বলেন যে, রাণী রাসমণি কৈবর্ত হলেও তার ব্রাহ্মণ গুরুর নামে মন্দির উৎসর্গ করে দিয়েছেন, অতএব সেখানে ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য ধর্মবিরুদ্ধ হনয়। স্বয়ং রামকৃষ্ণও পরে রাসমণির পৌরোহিত্য করতে জাতপাতের কারণে প্রথমে অস্বীকার করেছিলেন। কিন' ধর্মপত্রের সাহায্যে দাদার সঙ্গে লটারিতে হেরে যাবার পর রাজি হয়েছিলেন। তথাপি কৈবর্তের ভাত খেতে হচ্ছে বলে সারা জীবন তিনি আক্ষেপ করেছেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে প্রথম দিকে তিনি রাসমণির দেওয়া রান্নার কাঁচা উপকরণ নিয়ে সেগুলি নিজে গঙ্গাজলে রান্না করে খেতেন। কিন' পরে তার খাবার চিরদিনই কোনও ব্রাহ্মণ ঠাকুর কিংবা তার নিজের স্ত্রী রান্না করে দিতেন। তিনি বলতেন যে সাধনপথে এক সময় বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যাযর-তার হাতে খেয়েছেন, কিন' পরে সে অবস'া কেটে গেছে। শেষ বয়সেও তিনি বলেছেন যে, ব্রাহ্মণের হাতের রান্না ছাড়া তিনি খেতে পারেন না। তিনি আজীবন উপবীত ধারণ করেছেন এবং যারা অদ্বৈতবাদের প্রেক্ষাপটে জাতিভেদের প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের এ বিষয়ে সক্রিয় হতে বার করেছেন। এ সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিলো যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে মানুষের ভেদাভেদ জ্ঞান সুপুরি গাছের পাকা ডালের মতো নিজে থেকে ঝরে যাবে। অর্থ এই দাঁড়ায় যে সব মানুষের ব্রহ্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত জাতিবর্ণভেদ যেমন আছে তেমনই থাকবে।
তৃতীয়ত, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাস্তবে রামকৃষ্ণের প্রবাব নেতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো্‌ বেদান্তের অদ্বৈত ব্রহ্ম ও আত্মা-পরমাত্মার ঐক্যের তত্ত্ব শঙ্করাচার্য থেকে রামমোহন হয়ে রামকৃষ্ণ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনে এবং হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আত্মশ্লাঘা বাড়ালেও তা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মূল ধর্মীয় বিশ্বাসগুলির বিপরীত মেরতে অবসি'ত ছিলো। আর আরব দেশে যে মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইসলাম ধর্মের জন্ম হয়েছিলো এবং এদেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের অন্যতম প্রধান কারণ ছলো, রামকৃষ্ণের ধর্মমতে তা আরও ব্যাপক এবং হিনআদুদের কাছে স্পর্ধায় গ্রহণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জাতিবর্ণভেদ প্রথা হিন্দু সমাজের আর্থসামাজিক কাঠামোর মূল ভিত্তি এবং ইসলামের সামাজিক সাম্যবাদের পরিপন্থী, রামকৃষ্ণের ধর্শপ্রচারে তাতেও কোন পরিবর্তনের আভাস মেনেনি। বাস্তব ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণের নয়া বেদান্ত ভাষ্যের ফলে একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব ধর্মই সত্য- যত মত তত পথ - এই ধর্মীয় দর্শন একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীকেও রামকৃষ্ণের ধর্মমতের দিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। কারণ তারা উপলব্ধি করেছিলো যে রামকৃষ্ণের বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদ হিন্দুধর্মের সঞ্জীবিত নবরূপ মাত্র।
স্বামী বিবেকানন্দ একবার ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়বার ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত প্রধানত আমেরিকায় এবং কিছুটা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে হিন্দুধর্ম ও বেদান্ত প্রচার করেন। ১৯৮৭ সনে প্রথমবার ভারতে ফেরার পর তিনি কলম্বো থেকে আলমোড়া এবং কলকাতাসহ দেশের অনেক জায়গায় জমিদারদের দেয়া সংবর্ধনা সভায় যোগ দেন এবং বহুসংখ্যক ভাষণ দেন। ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তার পাশ্চাত্য অনুগামীদের অর্থানুকূল্যে বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করে সে বছরেই জুুন মাসে আবার আমেরিকা যান, আর এক বৎসর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। সকলেই জানেন যে প্রথমবার ১৮৯৩ সনে তিনি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকা গিয়েছিলেন এবং সেখানে হিন্দু ধর্মের সপক্ষে সংক্ষিপ্ত অথচ সাড়াজাগানো ভাষণ দিয়েছিলেন। তারপরেও তিনি হিন্দু সন্ন্যাসী বা মঙ্ক হিসেবেই আমেরিকা ও ইউরোপে বক্তৃতা করেছিলেন এবং তাকে সর্বত্র হিন্দুধর্মের প্রচারক সুবক্তা সন্ন্যাসী রূপেই সমাদর করা হয়েছিলো। এ ঘটনা ঐতিহাসিক সত্য এবং এটিকে বিস্মৃত হলে ভারতে উনিশ শতকের বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে স্বামী বিবেকানন্দের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
বিদেশে থাকাকালে বক্তৃতা সভার উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী স্বামী বিবেকানন্দকে হিন্দুধর্ম ও দর্শন ছাড়া অন্যান্য অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ে বলতে হয়েছে। কিন' বিদেশে তার প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বেদান্তের অদ্বৈতবাদী দর্শনকে হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্ব হিসেবে প্রচার করা, আর সর্বধর্মের প্রতি হিন্দুধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। এই মূল লক্ষ্যকে ঘিরেই আমেরিকা ও ইউরোপে তার সমস্ত কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছিলো। বিশেষত জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ এবং রাজযোগ বিষয়ক বক্তৃতামালা আমেরিকায় আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলো অদ্বৈত বেদান্তকে কিভাবে জগতের ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডে প্রয়োগ করা যায় সে বিষয়েও তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন' জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা, ভারতে নারী জাতির অবস্থা প্রভৃতি সমকালীন ভারতের সমস্যাগুলি সম্বন্ধে তিনি সর্বদাই অতিরঞ্জিত ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছেন এবং হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেগুলিকে সমর্থন করেছেন। হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে তার আরও একটি বক্তব্য ছিলো এই যে একমাত্র বেদান্তোর অদ্বৈতবাদের মাধ্যমেই পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে একটি মাত্র উদার বিশ্বধর্ম গড়ে ওঠা সম্ভব। পরাধীন, অপমানিত এবং পদদলিত ভারতের ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে পাশ্চাত্য দেশে এভাবে এভাবে সগর্বে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে তিনি এদেশের হিন্দুদের কাছে এক পরিত্রাতা মহাপুরুষ রূপেই প্রতিভাত হয়েছিলেন। আর এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে দেশে ফেরার পরেও তিনি মূলত বেদান্তভিত্তিক হিন্দুধর্মই প্রচার করতে থাকেন, যদিও গুরু রামকৃষ্ণের মতোই তিনি কালীপূজোসহ অন্যান্য মূর্তিপূজোতেও অভ্যস্ত ছিলেন। একথা সর্বজন স্বীকৃত এভাবে স্বামী বিবেকানন্দ উনিশ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে রামহোন এবং ব্রাহ্মসমাজের চেয়েও এগিয়ে গিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রূপ দিয়েছিলেন। আর এভাবে বিশ শতকের প্রথমে এদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দুধর্মের প্রভাব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিলো। কিন' ভারতের প্রকৃত নবজাগরণে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান কতোখাতি তা নিয়ে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে।
তিনি প্রথম থেকেই যুক্তিবাদ, জ্ঞানবিচার ও বিজ্ঞানমনষ্কতার চেয়ে ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মীয় আবেগের দিকেই তার বেশি প্রবণতা ছিলো। রামকৃষ্ণে সঙ্গে পরিচয় হবার আগেই তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন এবং তার কণ্ঠে ব্রহ্মসঙ্গীত শুনেই রামকৃষ্ণ তার প্রতি সর্বপ্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরবর্তী সন্ন্যাস জীবনে স্বভাবতই তার এই ধর্মভাব আরও প্রবল হয়েছিলো। ভারতের যুক্তিবাদী ও বস'বাদী দর্শনগুলোর প্রতিও তিনি কোন আকর্ষণ অনুভব করেননি। ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার পর জাতীয় রাজনীতি সর্বভারতীয় রূপ ধারণ করতে আরম্ভ করেছিলো। কিন' বিবেকানন্দ এসব থেকে অনেক দূরে থেকেছেন। শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকে ফেরার পরও তিনি তার অনুগামীদের জাতীয় আন্দোলনের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দের মূল বক্তব্য ছিল যে, সর্বপপ্রথম হিন্দুধর্মের প্রচার ও পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে, তারপর রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব আপনি ঠিক হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, হিন্দুধর্মের সাহায্যে ভারতের সব সমস্যার সমাধানের এই তত্ত্ব হিন্দু জাতীয়তাবাদে ইন্ধন জোগালেও জ্ঞানবিচারের নিরিখে পশ্চাৎমুখী এবং প্রকৃত নবজাগরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিলো।
যে জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে ভারতে অসাম্য, অবিচার আর শ্রেণিশোষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, যা ভারতের তিন-চতুর্থাংশ মানুষকে অবমানিক স্তরে নির্বাসন দিয়েছিলো, আর ভারতবর্ষকে বারংবার বিদেশি আগ্রাসনের সহজ শিকারে পরিণত করেছিলো, সে কুপ্রথাকে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা থাকাকালে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমর্থন করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ ১৮৯৩ ৭ অক্টোবরের একটি ভাষণে তিনি বলেন যে, পৃথিবীর অন্য সব প্রাচীন সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও ভারতীয় সভ্যতা জাতিভেদের কারণেই প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত একইভাবে বেঁচে থাকতে সমর্থ হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ১৪ মে আরেকটি ভাষণে তিনি বলেন: ‘আমাদের দৃষ্টিতে সদগুণ এবং সৎকুলে জন্মই জাতি নির্ধারণ করে, টাকা নয়। ভারতে টাকা দিয়ে সম্মান কেনা যায় না। জাতিপ্রথায় উচ্চতা অর্থের দ্বারা নিরুপিত হয় না। জাতির দিক দিয়া অতি দরিদ্র এবং অত্যন্ত ধনীর একই মর্যাদা। জাতি প্রথার ইহা একটি চমৎকার দিক। --- ধনলিপ্স হতেই জন্মায় হিংসা, ঘৃণা, লোভ এবং চলে প্রচণ্ড কর্মোন্মত্ততা, ছুটাছুটি, কলরব। জাতিপ্রথা মানুষকে এই সকল হতেই নিষ্কৃতি দেয়। উহা তাকে অল্প টাকায় জীবন যাবন করতে সক্ষম করে এবং সকলকেই কাজ দেয়। জাতিপ্রথায় মানুষ আত্মার চিন্তা করবার সময় পায়, আর ভারতের সমাজে ইহাই তো আমরা চাই। দেশে ফিরেও তিনি চাতর্বর্ণ্য ব্যবস্থাকে নির্ধিধায় বারবার সমর্থন করেছেন। শুধু তাই নয়, পুরাণের ধর্মীয় ঐতিহ্যে চার যুগের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে যুগধর্ম অনুসারে চার বর্ণের উত্থান-পতনের যেকাল্পনিক তত্ত্ব আছে, তাকেই অনুসরণ করে তিনি অতীত যুগে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের উত্থান-পতনের পরে সমকালে বৈশ্য বর্ণের উত্থান এবং ভবিষ্যতে শূদ্র বর্ণের উত্থানের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। কিন' চার বর্ণের এই চক্রাকারে উত্থান-পতন তার বিচারে ছিলো সনাতন ধর্মচক্রেরই বাহ্যিক প্রকাশ। তাত্ত্বিক দিক থেকে এতে মানুষের কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিলো না। উনিশ শতকের শেষে পুনরুজ্জীবিত হিন্দুধর্মের উদগাতা হিসেবে এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান অনস্বীকার্য হলেও বৌদ্ধিক বা জ্ঞানবিচারি নবজাগরণের দৃষ্টিতে সে অবদানকে মূলত নেতিবাচক বলেই গণ্য করতে হবে। রামমোহনের অদ্বৈতের মতোই বিবেকানন্দের আরও শক্তিশালী বিশ্বজয়ী অদ্বৈতবাদ জমিদার ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির শ্রেণিস্বার্থের অনুকূল ছিলো।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:০০

শ্রাবণধারা বলেছেন: কৌতুহল-উদ্দীপক আলোচনা । বেশ ভালো লাগলো । লেখকের পয়েন্ট অব ভিউটা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই কমবেশি প্রযোজ্য । জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-অর্থনৈতিক-সামাজিক উপযোগগুলো সৃষ্টির উৎস সন্দেহবাদ। ধর্ম সেদিকে নিয়ে যায়না , তার যাত্রাপথ ভিন্ন, পরিভাষা লৌকিক নয় ।

শুভকামনা ।

২| ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৭

রাজীব নুর বলেছেন: আমার বাড়িও বিক্রমপুর।

লেখা ভালো লেগেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.