নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\"সমস্ত পেরেশানি \"একীন\" ঠিক না হওয়ার কারণে পয়দা হয়!\" টিএম.নীরব\"

টিএম.নীরব

بسم الله الرحمن الرحيم

টিএম.নীরব › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ ‎আহমেদ ইয়াসিন (রহঃ) এর সংগ্রামী জীবন ইতিহাস

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:০৮

এক.

ফিলিস্তীন তখন ব্রিটিশদের অত্যাচার চলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্বের পর ওসমানীয় খেলাফতের সমাপ্তি ঘটে এবং ফিলিস্তীনসহ আরবের বিরাট অংশ চলে যায় ব্রিটিশদের আন্ডারে। ১৯৩৭ এর কোন একদিন বর্তমান ইজরাইলের দখলকৃত আশকেলন শহরেরর এক গরীব মহল্লায় জন্ম নেন এক নবজাতক। পরবর্তীতে সন্ত্রাসী ইজরাইলের গলায় কাটার মত বিঁধে যান যিনি, যাকে নিয়ে বহু রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মোসাদের দূর্ধর্ষ এজেন্ট আর অপারেটররা এবং যার উত্তরসূরীরাই মূলত তেলআবিবের মাথাব্যাথার প্রধান কারণ এখন


জন্মের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় পিতাকে হারান, বাড়ির পাশের এক স্কুলে পড়েন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। ১৯৪৮, ফিলিস্তিনী নকবা বা বিপর্যয়ের বছর। বনি ইসরাইলের অবাধ্য সন্তানেরা উড়ে এসে জুড়ে বসে গোটা আলকুদসের আশপাশে। একের পর এক শহর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে, নিজ বাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে মুসলমানেরা। সে ধারাবাহিকতায় আহমেদ ইয়াসিনের পরিবার বাড়িঘর তালা মেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলে যান গাজায় এক রিফিউজি ক্যাম্পে। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে একটা অসহায় পরিবার, কিছুদূর যেয়ে ফিরে ফিরে চাচ্ছে এক বালক সে পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের সামনে বুলডোজার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো তার শৈশবের ভালবাসার উঠোন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে বালক, মুঠো শক্ত হয়ে গেছে ১০ বছরের আহমেদ ইয়াসিনের। তখন ইজরাইলের কেউ যদি এ বালকের মনের আগুনের আঁচ টের পেত তবে বাড়িঘর বাদ দিয়ে তার উপরেই বুলডোজার চালিয়ে দিত।
ফিলিস্তিনসহ গোটা আরবের মুসলমানদের উপর এ অত্যাচার দেখে বসে বসে কাঁদেনি এ কিশোর। চোখে তার জ্বলে ওঠে আগুন। এ আগুন প্রতিরোধের, এ আগুন প্রতিশোধের।

সে আগুনেই পরবর্ততে বহুবার জ্বলেছে ইজরাইল। দীপ্ত কণ্ঠে বলেছেন তিনি, ‘ফিলিস্তিনের সমস্যা আমাদের, আমাদেরকেই এর সমাধান করতে হবে। অস্ত্র ধরে প্রতিরোধে নামতে হবে। আমাদেরকে আরবের কোন দেশ বা আন্তর্জাতিক কেউ সাহায্য করতে আসবেনা।’

সত্যিই তাই, হামাসের প্রতিষ্ঠার পর তা অক্ষরে অক্ষরে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

গাজায় একদিন বন্ধুর সাথে কুস্তি খেলতে যেয়ে আঘাত পান মেরুদন্ডে। ৪৮ দিন প্লাস্টার নিয়ে পড়ে রইলেন বিছানায়। এরপরও বহুদিন চলল চিকিৎসা। কিন্তু শেষমেশ ডাক্তার জানিয়ে দিল পিচ্চি এ বালককে কুস্তি খেলার শাস্তি সারাজীবন ভোগ করতে হবে।

কিন্তু ডাক্তার জানতনা, যে পিচ্চির মনে ইজরাইলের সাথে কুস্তি লড়ার শখ সে কি এত সহজেই দমে যাবে ! বিছানা আর হুইল চেয়ারে বসে বসেই ইজরাইলেী সন্ত্রাসীদের সাথে লড়াই এর নকশা আঁকে সে বালক। হোক না পংগু, তাতে কি ! আল্লাহ চাইলে তো সবই সম্ভব।

দুই.

পুরো ফিলিস্তিন জুড়েই তখন চলছে অনাহারী মজলুমের আর্তনাদ। ১৯৫২ তে মেরুদন্ডে আঘাত পাবার আগের দিন পর্যন্তও আহমেদ ইয়াসিন নামের এই কিশোর ছুটে বেড়াতো পরিবারের অন্য মুখগুলোর জন্য অন্নের সন্ধানে। একটা রেস্টুরেন্টেও কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল সে। মাঝে মাঝে গাজা-মিশর সীমান্তেও ঘুরে বেড়াত সে। মিশরীয় সৈন্যদের ফেলে যাওয়া খাবার বা পোষাক যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু অসুস্থ হয়ে যাবার পর সে জানল হুইল চেয়ার তার পরবর্তী জীবনের সংগী।

কিছুটা সুস্থ হলে স্কুলে যাওয়া শুরু হলো তবে হুইল চেয়ারে করে। ১৯৫৮ তে হাই স্কুল পাশ করে গেল হুইল চেয়ারে বসে সংগ্রামরত এ যুবক। পাশ করার পর একটা ছোট্ট চাকরীও যোগাড় করে ফেলল সে শারীরিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, একটা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার কাজ।

মাত্র কদিন যেতে না যেতেই বই-পুস্তক তাকে আবার টানতে লাগল। হাই স্কুল পেরুনো এ যুবকের মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর ক্যাম্পাস ভাসছে ।

১৯৫৯ তিনি চলে গেলেন মিশরে। আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করলেন। অনেক কিছু শিখলেন এখানে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা ঘটলো তার মগজে ইমাম হাসান আল বান্নার থিওরি ঢুকে গেল। পরিচিত হলেন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে। মিশলেন তাদের সাথে, তার হৃদয়জুড়ে যে কষ্টের হাহাকার আর চোখজুড়ে যে আগুন জ্বলছিল তা প্রশমিত হবার পথ পেল। তখন হাজার হাজার পথ হারা যুবক অশান্তির আগুন থেকে বাঁচতে দলে দলে যোগ দিচ্ছিল ১৯২৮ সালে হাসান আর বান্নার প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনে। মিশরের জালেম শাসক দিশেহারা ইখওয়ানের চিন্তায়।

এরই মধ্যে কলেজ ডিপ্লোমার সার্টিফিকেট পেয়ে গেলেন। কিন্তু মিশরে তখন চলছে আরেক ফেরাউনের শাসন। সে ফেরাউনের নাম জামাল আব্দুন নাসের। মিশর কর্তৃপক্ষ বহুদিন ধরেই নজর রাখছিল বেশ কিছু ফিলিস্তিনী ছাত্রের উপরে। ইখওয়ানের উপরে ক্রমাগত ক্র্যাকডাউনের অংশ হিসেবেই গ্রেপ্তার হলেন আহমেদ ইয়াসিন। অভিযোগ আনা হলো তিনি মিশরের সরকার বিরোধী কার্যকালাপে জড়িত। জেল খাটলেন অল্প কদিন। কোর্টে তার উকিলের কঠিন যুক্তির মুখে ছাড়া পেলেন। জীবনের প্রথম জেল জীবনেই অনিয়ম-অনাচার আর অবিচারের প্রতি ঘৃণার সবচেয়ে বড় বীজ বপন করলেন তিনি। এভাবে চলতে দেয়া যায়না। আল্লাহর জমিনে মুসলমানরা কাফের-মুনাফিক উভয়ের হাতে অবিচার-জুলুমের শিকার হবে, এটা চেয়ে চেয়ে দেখার কোন রাস্তা নাই। নামতে হবে প্রতিরোধে । এ জুলুমের শেকড় উপড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

হুইল চেয়ারে করে আবার রওনা হলেন প্রিয় জন্মভূমির দিকে । এবার আর ছন্নছাড়া কাজ না, গোছানো কাজে হাত দিতে হবে। মাথারভর্তি বহু চিন্তা, প্ল্যান। কোন কোন সূত্রে জানা যায়, মিশর থেকেই তাকে গাজায় মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিন শাখার স্থানীয় কোন দায়িত্ব দেয়া হয় এবং সে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি ফিরে আসেন গাজায়।



আহমেদ ইয়াসিন যখন যুবক ছিলেন, মিশর এবং ফিলিস্তিনে তোলা ছবিঃ



তিন.

মিশরে একটা জিনিশ তিনি স্পষ্ট বুঝে গেলেন, আরবদের সমস্যার সমাধান সম্ভব একমাত্র ইসলামী গণজাগরণেই। সেক্যুলার আরব শাসক আর আমেরিকা-ইজরাইলের চরিত্রে তিনি কোন ফারাক খুজে পেলেননা যখন দেখলেন পশ্চিমের অংগুলি নির্দেশে ইখওয়ানের উপর পাইকাড়ী হত্যা-গ্রেপ্তার চালানো হচ্ছে।

আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল তার এবং ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে তা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে ফিলিস্তীনী এই পংগু যুবকের জন্য। অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ডিপ্লোমা নিয়েই গাজায় ফিরলেন আহমেদ ইয়াসিন যা আগের পর্বে এসেছে। ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেন তারই আত্মীয় হালিমা ইয়াসিনকে ১৯৬০ সালে। ততদিনে তার মন-মগজে ঢুকে গেছে মানুষকে সত্যের দিকে দাওয়াতের বিভিন্ন পন্থা।

গাজায় নিজ বাড়িতে ফিরে বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জনে প্রচুর সময় ব্যায় করতে থাকলেন। রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন এবং ইসলামী ফিকহসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় স্বাধীন বিচরণ করতে থাকলেন। এদিকে ইখওয়ানের ফিলিস্তীন শাখার প্রোগ্রামেও নিয়মিত দেখা যেত তাকে। গাজার আল-আব্বাসী মসজিদে জুমুআর নামাজে নিয়মিত খুতবা দিতে শুরু করলেন তিনি। তার গভীর জ্ঞান এবং মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার হৃদয়গ্রাহী পন্থা মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করল। গাজার ওই মসজিদে তার বক্তব্য শুনতে প্রায়ই শখানেক যুবক ছেলেপুলে হাজির হতো, আর এরাই পরবর্তীতে হয়েছিল হামাসের নিউক্লিয়াস। পাশাপাশি তিনি একটা স্কুলে আরবি সাহিত্য এবং ইসলাম ধর্ম বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা তার এ ক্লাসের সময় মুগ্ধ নয়নে কান খাড়া করে সব শুনতো, একজন পংগু মানুষ যে কিনা হুইল চেয়ারে ঘোরাফেরা করে সে কিভাবে এত জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে সে বিস্ময়ে হতবাক হতো অনেকেই। গাজার সে স্কুলের শত শত ছেলে মেয়ের কাছে প্রিয় শিক্ষকে পরিণত হলেন সদা হাস্যজ্জ্বল আহমেদ ইয়াসিন।

যুবকদের মধ্যে জ্ঞান এবং জিহাদের অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দেবার জন্য অদ্ভূত অদ্ভূত কৌশল ব্যবহার করতে থাকলেন। মসজিদে ২ মিনিটের সমাবেশ বা অমুক এলাকায় ৩ মিনিটের বক্তব্য এ ধরনের পন্থাতে গাজার নতুন প্রজন্মের মগজে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা করছিলেন তিনি। পাশাপাশি ফিলিস্তীনী শহীদ-বাস্তুহারা পরিবারগুলোর লিস্ট করে তাদের জন্য সাহায্য কালেকশন এবং বিতরনের মত বিরাট উদ্যোগও নেন তিনি।

১৯৬৭ তে আরব-ইজরাইল যুদ্ধের সময় গাজাসহ পুরো ফিলিস্তীন দখল করে ফেলে ইজরাইল। পঙ্গু আহমেদ ইয়াসিনের নাম ছড়িয়ে গেছে গাজার আনাচে-কানাচে। ঘুমন্ত আরব সিংহদেরকে জাগানোর গান গেয়ে যাচ্ছেন তিনি, জাগরণ কিন্তু শুরুও হয়ে গেছে ততদিনে।

প্রতিরোধ-প্রতিশোধ এবং আল আকসার পুনরুদ্ধারের জন্য জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন নিয়মিত। দলে দলে যুবকেরা যোগ দিতে থাকল তার এসব সমাবেশে, তাদের বুকভর্তি আশা আর চোখভর্তি আগুন। সে আগুনে পুড়িয়ে দিতে চায় সন্ত্রাসী দখলদারদেরকে। চোখের সামনে নিজ প্রিয়জনকে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যার প্রতিশোধ নেবার একটা পথ বাৎলে দিবে কেউ তাদের এমনটাই তাদের চাওয়া। গোটা ফিলিস্তীন ঢুকে যাচ্ছে এক বিরাট অজগরের মুখে, তাকে রুখতে হবে। লড়তে হবে।

১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন Al-Mujama Al-Islami নামের একটি সংগঠন যার নামের ইংলিশ অর্থ দাঁড়ায় the Islamic Charitable League। এই সংগঠন ব্যাপকভাবে জনসেবা এবং সামাজিক কাজ করতে লাগল যেমন ফ্রি ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা, ফ্রি স্কুলিং, মসজিদ এবং লাইব্রেরী নির্মান। ইজরাইল চাচ্ছিল তখনকার একমাত্র প্রতিরোধ আন্দোলন ফাতাহকে দূর্বল করার জন্য বিপরীতে কোন একটা সংগঠন তৈরী হোক আপাতত। আর পঙ্গু একজন মানুষের নেতৃত্বে দখলদারিত্বের মধ্যে অনর্থক এসব স্কুল-মসজিদ করার আন্দোলন ইজরাইলের জন্য খুব একটা ক্ষতির কারন হবেনা হয়ত এমনটাই ভাবত ইজরাইলের তখনকার নেতারা, তাই তারা সেভাবে বাঁধা দেয়নি আহমেদ ইয়াসিনকে প্রাথমিক দিকে ।

বীজ বোনা শেষ এবার ফসলের ক্ষেতে নামার পালা।

বেশকিছু বছর পেরিয়ে গেছে এরই মধ্যে। ১৯৮০ সালে Al-Mujama Al-Islami group পরিবর্তিত হল Al-Majahadoun Al-Philastiniyun নামক সংগঠনে।

‘মাজদ’ এই সাংকেতিক নামে ছোট খাটো অপারেশন শুরু করল শাইখ আহমেদ ইয়াসিনের শিষ্যরা ১৯৮২ সালে। এ সকল অপারেশনের আর্থিক এবং অস্ত্র সাহায্য আসত ইখওয়ানের জর্ডান শাখার বেশ কিছু নেতার মাধ্যমে। সফলতাও আসতে থাকলো ‘মাজদ’ এর ছোট ছোট কাজগুলোর দ্বারা। ইজরাইল এই প্রথম টের পেল কেউ একজন তাদের পেছনে লাশের স্তুপ থেকে উঠে দাড়িয়ে অস্ত্র তাক করেছে তাদের দিকে।

আরবদের ঘাড়ে সাপের মত উঠে বসা ভয়ংকর ইজরাইলের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল ভবিষ্যতের বিপদের কথা চিন্তা করে।

মোসাদ সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করল এই গ্রুপের মাথা বের করার জন্য।

খুব অল্প কষ্টেই তারা গাজার বিখ্যাত আলেম এবং জনপ্রিয় নেতা শাইখ আহমেদ ইয়াসিনকে ‘মাজদ’ এর মূল হোতা হিসেবে বের চিহ্নিত করলো।

১৯৮৪ তে গ্রেপ্তার হলেন শাইখ আহমেদ ইয়াসিন।

ইজরাইলের পবিত্র প্রমিজড ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার এবং উস্কানীর অভিযোগে তাকে ১৩ বছরের জেল দিল অবৈধ ইজরাইলের অবৈধ আদালত।


চার.

১৯৮৫, মানে গ্রেপ্তারের ১ বছরের মাথায় তিনি মুক্তি পেলেন একটি বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে। এই বিনিময় চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল Popular Front for the Liberation of Palestine General Command নামক একটি প্রতিরোধ সংগঠন এবং ইজরাইল সরকারের মধ্যে, ফিলিস্তিনের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আহমেদ জিবরিল। সম্ভবত দু-একজন ইজরাইলি সৈন্যের বিপরীতে কয়েকশ ফিলিস্তিনী মুক্তি পায় সে বার।

আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করলেন ১৯৮৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। আরবী ‘হামাস’ মানে ‘enthusiasm’ বা উদ্দীপনা, প্রবল আগ্রহ/উদ্যোম। শায়খ আহমেদ ইয়াসিনের সাথে এসময় ছিলেন গাজার একদল আলেম এবং ইসলামিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রধান সহযোগী হিসেবে ছিলেন ডা. আব্দুল আজিজ রানতিসি যিনি পরবর্তীতে আহমেদ ইয়াসিনের শাহাদাতের পর হামাসের প্রধান হয়েছিলেন এবং নিজেও শহীদ হয়েছিলেন ইজরাইলি বিমান হামলায়।

হামাসের জন্মের সাথে সাথে ফিলিস্তিনীরা নতুন উদ্যোমে প্রতিরোধ শুরু করল। বহু ফিলিস্তিনীর মধ্যে আশার সঞ্চার হল। হামাসের প্রতিষ্ঠার বছরেই শুরু প্রথম ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনীদের গণজাগরণ এবং প্রতিরোধ। মূলত প্রথম ইন্তিফাদার পেছনে হামাস নেতাদের ভূমিকাই ছিল মূখ্য এবং এই ইন্তিফাদা পরিচিত হয়েছিল ‘মসজিদের বিপ্লব’ হিসেবে কারন এ আন্দোলন উঠে এসেছিল মসজিদ থেকে। হামাস শুরু করল ইজরাইলি দখলদারদের উপরে হামলা। গাজা উপত্যকাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইজরাইলি সৈন্য নিহত হল প্রথম ইন্তিফাদাতে।

ইজরাইল আবারো শায়খ আহমেদ ইয়াসিনকে এসব হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী বলে অভিযুক্ত করে গাজাতে তার বাড়িতে সৈন্য পাঠিয়ে হামলা করে তছনছ করে দিল। শায়খকে শাসিয়ে দেয়া হল যে তাকে লেবাননে নির্বাসনে পাঠানো হবে যদি সে এসব কাজ অব্যাহত রাখে।

১৯৮৯ সাল, প্রথম ইন্তিফাদার দুবছর পর আবার গ্রেপ্তার হলেন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা। হুইলচেয়ারসহ তাঁকে তুলে নিয়ে গেল দখলদাররা, বিভিন্নরকম নির্যাতন চালিয়ে এবার ৪০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হল। প্রধান অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে ইজরাইলী সৈন্যদেরকে হত্যা, কিডন্যাপ এবং স্বশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেওয়া।

শায়খ আহমেদ ইয়াসিনের সাথে হামাসের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা শহীদ ডা. আব্দুল আজিজ রানতিসি


পাঁচ.

কারাগারে ক্রমাগত অত্যাচার আর ভয়াবহ নির্যাতনে তিনি ডান চোখের দৃষ্টি হারালেন, বাম চোখও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল। এমনিতেই অসুস্থ্য ছিলেন, এই দূর্বল শরীর একে একে আক্রান্ত হতে থাকল দূরারোগ্য সব রোগে। ফুসফুস, হার্ট, কান, পাকস্থলি, বৃহদান্ত্র কিছুই বাদ গেলনা ।

১৩ ই ডিসেম্বর ১৯৯২, হামাসের মিলিটারি উইং ইজ্জেদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেড একটি সফল অপারেশনে এক ইজরাইল সেনাকে আটক করে। তারা ইজরাইলকে এই সৈন্যের বিনিময়ে তাদের সম্মানিত নেতা আহমেদ ইয়াসিনসহ আরো বেশকিছু বৃদ্ধ ও অসুস্থ্য নেতাকে ছেড়ে দেবার আহ্বান জানায়।

কিন্তু ইজরাইল অস্ত্রেই সামধান ঠিক করল, কমান্ডো আক্রমণ চালানো হল সেই বাড়িতে যেখানে আটক ছিল ইজরাইলি সেনা। ভয়াবহ সংঘর্ষ হল কাসসামের যোদ্ধাদের সাথে। কাসসমামের তিনজন শহীদ হল, অন্যদিকে ইজরাইলের সেই আটক সেনাসহ নিহত হল মোট চারজন। এই চারজনের মধ্যে ইজরাইলি কমান্ডো ইউনিটের প্রধানও ছিল।



১৯৯৭,শায়খ আহমেদ ইয়াসিনের কারাজীবন অষ্টম বছরে তখন।

হামাসের পলিটিক্যাল ব্যুরোর চীফ খালেদ মাশালকে গুপ্তহত্যার মিশনে যেয়ে মোসাদের দুই স্পেশাল এজেন্ট হামাসের হাতে ধরা পড়ে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে । ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল সে ঘটনা। মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরে এলেন খালেদ মাশাল এবং অনেকগুলো বড় অর্জনের মধ্যে হামাস সবচেয়ে বড় যে জিনিশটা পেল সেটা হচ্ছে তাদের নেতা আহমেদ ইয়াসিনকে। তেলাবিব থেকে হেলিকপ্টারে করে অসুস্থ লিডারকে আম্মানে এনে হামাসের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হল ইজরাইল এবং বিনিময়ে তারা ফিরে পেল তাদের দু স্পেশাল এজেন্টকে। এছাড়া খালেদ মাশালকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা বিশেষ ধরনের বিষের এন্টিডোটও হামাসের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করা হয় ইজরাইলকে। এ ঘটনায় মধ্যস্থতা করেছিলেন জর্ডানের তৎকালীন বাদশা হুসাইন। অবশ্য এর পেছনে জর্ডানের নিজের স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ইজ্জ্বতও জড়িত ছিল।

মোসাদের ইতিহাসে এমন বিপর্যয় সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নাই।

এরপর জর্ডানের মিলিটারি হাসপাতালে সাময়িক চিকিৎসা শেষে তিনি আবার সরাসরি উড়াল দিলেন প্রিয় ভূমি গাজায়। গাজায় সেদিন লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানাতে। আহমেদ ইয়াসিনকে যখন জেরুজালেমের উপর দিয়ে নিয়ে আসছিল হেলিকপ্টার তখন তিনি বেড থেকে বারবার মাথা উচিয়ে প্রিয় বায়তুল মুকাদ্দাসকে এক নজর দেখার চেষ্টা করছিলেন অস্থিরভাবে, বারবার চেষ্টা করেও তাকে বিরত রাখা যাচ্ছিলনা।


ছয়.

হামাসের এই বিজয় এবং গাজায় তাদের নেতার প্রত্যাবর্তন স্বভাবতই বিরাট প্রভাব ফেলল সংগঠনটির উপরে। প্রভাব পড়ল পুরো ফিলিস্তিনে। আকুণ্ঠ দূর্নীতি এবং বেঈমানীতে ডুবে থাকা ফাতাহর নেতারা বুঝতে পারল তাদের সামান্তরালে দাড়িয়ে গেছে হামাস এবং ফিলিস্তিনী যুবকদেরকে দলে দলে হামাসে যোগ দিতে দেখে এও বুঝতে পারল যে তারা না চাইলেও ফিলিস্তিনের নেতৃত্বে খুব দ্রুতই পরবির্তন আসছে, এ পরিবর্তন ছিল অবধারিত। জনস্রোতকে আটকানোর ক্ষমতা মাহমুদ আব্বাসদের ছিলনা। তাছাড়া হামাসের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আহমেদ ইয়াসিন ক্রমেই ফিলিস্তিন নিপীড়িত মানুষের প্রধান নেতা হয়ে উঠেছিলেন, আরবসহ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে তাঁর একটা পাওয়ারফুল ইমেজ তৈরী হয়েছিল। গাজায় ফিরে এক ভাষণে তিনি ফিলিস্তিনীদের ঐক্যবদ্ধ আহ্বান জানান। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন PA বা প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটির সাথে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকার পরও তিনি PA এর সাথে সম্মিলিতভাবে সবখানে ফিলিস্তিনীদেরকে প্রতিরোধের জন্য তৈরী হতে বলেন।



কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল তারা?

অসলো চুক্তির পর থেকেই ইয়াসির আরাফাত এবং তার দল ফাতাহর প্রতি সমর্থন কমতে থাকে ফিলিস্তিনীদের। শান্তির মুলো দেখে অস্ত্র ত্যাগ করে ইজরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন এক সময়কার সংগ্রামী নেতা ইয়াসির আরাফাত। কিন্তু প্রকৃত শান্তি কোনদিনই আসেনি ফিলিস্তিনীদের জীবনে, তারা যে অসলোতে বিরাটভাবে প্রতারিত হয়েছে এটা ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছিল তাদের কাছে। আরব শাসক এবং ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা কাড়ি কাড়ি টাকার সুফল সাধারণ ফিলিস্তিনীরা পেতনা, সে টাকা চলে যেত ফাতাহর নেতাদের একাউন্টে। শায়খ আহমেদ ইয়াসিন খুব স্পষ্ট করে সবসময়ই এই অসলো চুক্তিকে বলতেন ‘বিরাট প্রতারণা’ এবং ‘লজ্জ্বাকর আত্মসমর্পণ’। ফিলিস্তিনীদের জমি কেড়ে নেয়া থেমে থাকেনি এত কিছুর পরও। দখলকৃত ফিলিস্তিনের জমিতে ফিলিস্তিনীরাই হয়ে গেল দাসের মত তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় পরবর্তী জায়োনিস্ট সরকারগুলো কর্তৃক ব্যাপকহারে ইহুদী বসতি নির্মাণ এবং ক্রমাগত ফিলিস্তিনি জমি অধিগ্রহণ অনেক ফিলিস্তিনির জন্য শায়খের চিন্তাধারাকে সমর্থনের কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। ঘর-বাড়ি হারা মানুষদের কষ্ট আর এক বুক ব্যাথায় এগিয়ে আসে হামাস। অবৈধ ইজরাইলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে এবং তাদের আত্মরক্ষার কোন অধিকারই নাই স্বীকৃতি তো দূরের কথা, হামাস নেতাদের এমন কথাই আশান্বিত হত ফিলিস্তিনের তরুণরা। হামাসের ঝুলিতে ছিল ভিক্ষার টাকা, ফাতাহর নেতাদের মত কাড়ি কাড়ি টাকা তাদের জন্য আসতনা। সেই অল্প পরিমাণ টাকা খুব পরিকল্পিতভাবে তারা মানুষের জন্য ব্যায় করত। প্রায় সব ফিলিস্তিনীই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত যে তারা একদিন তাদের হারানো বাড়িঘর আবার ফিরে পাবে, হামাসেরও কথা ছিল এমনই। আজ হোক কাল হোক ফিলিস্তীন পুরোপুরী মুক্ত হবেই, হামাস নেতাদের এমন বক্তব্য শুধু যে ফাঁকা বুলি না তা তাদের কাজে টের পেয়েছিল জনগণ। এছাড়া বিভিন্ন দ্বন্দ্ব থাকার পরও ফাতাহর সাথে কখনও সংঘর্ষ বা ঝামেলাতে যেতে চায়নি হামাস। আহমেদ ইয়াসিন সবসময়ই ফিলিস্তিনীদের নিজেদের মধ্যকার সংঘর্ষ এড়ানোর পন্থা খুজতেন এবং বহুবার তিনি ইয়াসির আরাফাতের সাথেও বসেছেন এ নিয়ে আলোচনার জন্য। নিজেদের মধ্যে লড়াই প্রতিরোধকে দূর্বলই করবেনা বরং তা চূড়ান্ত বোকামী হবে এবং আদর্শগতসহ সকল মতপার্থক্য পাশে সরিয়ে রেখে প্রধান সমস্যা অর্থাৎ ইজরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে এক হতে হবে যে কোন মূল্যে গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকের সকল মানুষকে এই নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ফলে পুরো ফিলিস্তিনের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত নেতা ছিলেন তিনি, ছিলেন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের প্রতীক।


সাত.

ইয়াসিন গৃহযুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করলেন

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থান শুরুর পূর্বে ইয়াসিনকে গৃহবন্দি করা হয়। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ যা আমেরিকা এবং জায়োনিস্টদের প্রচণ্ড চাপের মুখে ছিল হামাস ও ইসলামিক জিহাদের লাগাম টেনে ধরার জন্য, ইয়াসিনের টেলিফোন যোগাযোগ কঠোরভাবে নজরদারি করছিল। হামাস নেতা সবসময় সতর্ক ছিলেন যাতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি না ঘটে যা গৃহযুদ্ধে মোড় নিতে পারে , যাকে তিনি দেখতেন ‘ফিলিস্তিনের চূড়ান্ত রেড লাইন’ হিসেবে। ইয়াসিন চেষ্টা করতেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং আরব বিশ্বের সরকারগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে; তার বিশ্বাস ছিল বিভক্ত নেতৃত্ব ফিলিস্তিনি স্বার্থকে দুর্বল করে ফেলবে।

হামাস নেতা শায়খ আহমেদ ইয়াসিন এবং PLO নেতা ইয়াসির আরাফাত

ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনের অধিকারের উপর জোর দিয়েছিলেন

আল আকসা ইন্তিফাদা অর্থাত ২য় ইন্তিফাদা চলাকালে শায়খ প্রতিরোধের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। তাঁর যুক্তি ছিল স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হয়, রৌপ্যের থালায় করে দেয়া হয়না আর জোরপূর্বক যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, তা কেবল শক্তি খাটিয়েই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তিনি জায়োনিস্টদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী বোমা হামলাকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে গেছেন। তার ব্যাখ্যা ছিল এটাই ফিলিস্তিনিদের একমাত্র অস্ত্র শক্তিশালী এক শত্রুর মুখে যে কিনা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও উৎখাতের ব্যাপারে নাছোড়বান্দা। সাধারণ ফিলিস্তিনি নাগরিক এবং ইউনিফর্মবিহীন জায়োনিস্টদের লক্ষ্য করে সকল প্রকার হামলা বন্ধে তিনি বারবার আহবান জানান। কিন্তু জায়োনিস্টরা সবসময় এ প্রচেষ্টাগুলোকে সফল হতে দিতে অস্বীকার করেছে। এছাড়া প্রথম ইন্তফাদার সময় ইজরাইলকে তিনি আহ্বান জানান ১৯৬৭’র সীমানায় ফিরে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে দখলদার সেনা প্রত্যাহার করে নেবার জন্য, বিনিময়ে ইন্তফাদার সমাপ্তি টানার আশ্বাস দেন তিনি। কিন্তু অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে যারা পছন্দ করে বেশী সেই ইজরাইল এ ধরনের প্রস্তাব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়।

শায়খকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা

সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে প্রথম তার জীবনের উপর জায়োনিস্টদের হামলার পর তার হাজারো সমর্থক তার দিকে তাকিয়ে রয়েছিল প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞার জন্য। এটাই ছিল বিশ্বব্যাপী লক্ষ-কোটি মুসলিমদের প্রতিচ্ছবি, যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল নতুন উদ্দীপণা এবং সমগ্র উম্মাহর মাঝে জিহাদের ডাক।

যাই হোক, হামাসের মত একটি আদর্শবাদী দলের ক্ষেত্রে, যেখানে নেতার চেয়ে আদর্শই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আহমাদ ইয়াসিনের মৃত্যুতে আন্দোলন স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে যাবার কোন কারণ ছিলোনা। প্রকৃতপক্ষে তার বয়স এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি কয়েক বছর পূর্বে থেকেই আন্দোলনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন।

শায়খ আহমাদ ইয়াসিন গাজার আল সাবরা এলাকায় তার সাধারণ বাড়িতে থাকতেন। সেপ্টেম্বর ৬, ২০০৩ এ গাজায় তার এক বন্ধুর সাথে সাক্ষাত করতে যাবার সময় তার জীবনের উপর ব্যর্থ হামলা চালায় জায়োনিস্ট দখলদারেরা। তিনি এ দফা বেঁচে গেলেও ডান হাতে সামান্য চোট পান। গুরুতর শারিরীক অক্ষমতা সত্ত্বেও তিনি তার মৃত্যু পর্যন্ত হামাস এবং ফিলিস্তিনের ইসলামী শিবিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।



আট.

শাহাদাত

২০০৩ এর ৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইজরাইল ৫৫০ পাউন্ড ওজনের বোমা নিক্ষেপ করে জঙ্গি বিমান থেকে, কিছুটা আহত হলেও বেঁচে যান তিনি। ১৯৮৮ সালে তিউনিশিয়াতে ফিলিস্তিনী কমান্ডে চীফ খলিল আল ওয়াজিরকে হত্যার পর এত বড় হাই প্রোফাইল নেতাকে হত্যার মিশনে তেল আবিব নেমেছে অনেকদিন পর, মিশনের ব্যাপারে হোয়াইট হাউস গ্রিন সিগন্যাল দিলে তা অনুমোদিত হয় ইজরাইলি মন্ত্রিসভাতে। তার উপর এই হামলার পর আল ক্বাসসাম ব্রিগেড এবং আল আক্বসা ব্রিগেড যৌথভাবে ইজরাইলীদের উপর আত্মঘাতি বোমা হামলা চালায় জেরুজালেমে। ইজরাইল আবার প্ল্যান করতে থাকে ইয়াসিনকে চিরতরে শেষ করে দেবার জন্য। পরের বছর ১৬ ই জানুয়ারি ইজরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষনা করেন শায়খ ইয়াসিন ‘মৃত্যুর জন্য চিহ্নিত’ হয়ে আছে। তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতাকে লক্ষ করে বলেন, ‘তার উচিৎ মাটির নিচে যেয়ে লুকানো যেখান থেকে সে দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারবেনা এবং আমরা তাকে টানেলের ভিতর পেলেও টানেল সহই তাকে শেষ করে দিব’।

কদিন পরেই ইয়াসিন উত্তরে বলেন, ‘আমাদেরকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নাই কারন আমাদের মুখে সবসময়ই থাকে শাহাদাতের বাণী, যে কোন সময় শহীদ হওয়ার সৌভাগ্যই আমরা কামনা করি’ !

২২ মার্চ, ২০০৪

ভোর সাড়ে চারটা

গাজার মসজিদগুলো থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। মধ্য গাজার আল-শাবরা এলাকা। শায়খ আহমেদ ইয়াসিন নামাজের জন্য যখন রওনা দিচ্ছেন পাশেই ইসলামিক এসোসিয়েশন মসজিদের উদ্দেশ্যে। তিনি নিয়মিত সেখানেই ফজরের নামাজ আদায় করেন।

অন্যদিকে ঠিক তখনই তেলআবিবে ইজরাইলি ডিফেন্স ফোর্সের কয়েকটি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান এবং একটি এপাচে হেলিকপ্টার গানশিপ রেডি হচ্ছে ইয়াসিন হত্যা মিশন শুরু করার জন্য। সে মিশন সরাসরি তত্বাবধান করছে ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন। আহমেদ ইয়াসিন নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হলেন। তাঁর সাথে সবসময়ই হামাসের কয়েকজন সশস্ত্র মেম্বার থাকেন। তারা মসজিদ থেকে বের হতে হতেই মাথার উপর দিয়ে ইজরাইলি ফাইটার জেট উড়ে যাবার শব্দ পেলেন। মসজিদের সামনে রাস্তায় রাখা গাড়ির দিকে এগুতে এগুতেই তাদের মাথার উপরে পৌছে গেল ইজরাইলি এপাচে। কোনরকম বিলম্ব ছাড়াই আহমেদ ইয়াসিনের হুইল চেয়ার লক্ষ করে আমেরিকার তৈরী ‘হেল ফায়ার’ মিসাইল নিক্ষেপ করা হল হেলিকপ্টার থেকে।

কিছুক্ষণ পরেই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হুইল চেয়ারের অংশগুলো কুড়িয়ে আনে স্থানীয়রা, কুড়িয়ে আনে প্রিয় নেতার ছ্ন্নি-ভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহের বিভিন্ন অংশ।

সেদিন তিনজন বডিগার্ডসহ তিনি শহীদ হন, এছাড়া মসজিদ থেকে নামাজ শেষে বেরুনো মুসল্লিদের মধ্যে থেকে আরো ৫ জন শহীদ হন। গুরুতর আহত হয় প্রায় ১৭ জন যাদের মধ্যে শহীদ ইয়াসিনের দুই পুত্রও ছিল।


আহমেদ ইয়াসিনকে ইজরাইল হত্যা করলেও হত্যা করতে পারেনি তার রেখে যাওয়া প্রতিরোধ আন্দোলনের আগুনকে। বরং তা লাখগুন বেশী তেজে জ্বলে উঠেছে। ফিলিস্তিনসহ গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছে তিনি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক। সুবিচার-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংগ্রামরত কর্মীদের কাছে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। মজলুম গণমানুষের কাছে একজন স্বর্গীয়-স্বপ্নপুরুষ তিনি। অনেকে তাঁকে বলেন দ্বিতীয় নুরুদ্দিন জঙ্গি যার তৈরী করা পথে হয়ত আবার হাজার বছর পরে দ্বিতীয় কোন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দেখা পেতে যাচ্ছে জেরুজালেমের খেজুর বিথীকা । বিশ্বের পঞ্চম শক্তিশালী আর্মির সামনে দাঁড়িয়ে একজন পঙ্গু-অচল মানুষ যে প্রতিরোধের আগুন জ্বেলেছিলেন সে আগুন সামাল দিতে আজ হিমশিম খাচ্ছে সন্ত্রাসী ইজরাইল এবং তার দোসররা। আল্লাহ চাহেন তো তাঁর রেখে যাওয়া এই আগুনেই ছারখার হয়ে যাবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট-নিষ্ঠুুর এই সন্ত্রাসী অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র। মুক্ত হবে আমাদের প্রিয় নবী করিম (সা.) এর মিরাজসহ শত শত নবী-রাসূলগণের স্মৃতি বিজড়িত বায়তুল মুক্বাদ্দাস, আমাদের প্রথম ক্বিবলা। সবশেষে শহীদ শায়খ আহমেদ ইয়াসিনেরই একটা উক্তি দিয়ে ইতি টানছি, ‘আমি জানি আমাদের এই পথ অনেক কঠিন, রক্তপিচ্ছিল এবং বিপদসংকুল কিন্তু ভবিষ্যৎ আমাদেরই ইনশাআল্লাহ…’


তথ্যসূত্রঃ
Wikipedia
Ikhwanweb
Electronicintifada
Islamtimes
Occupiedpalestine
Foa

আম্মানে মোসাদ কর্তৃক খালেদ মাশালকে হত্যার ব্যর্থ মিশন এবং পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে আল-জাজিরার করা অসাধারণ দুই পর্বের ডকুমেন্টারি ‘কিল হিম সাইলেন্টলিঃ’
Youtube
Youtube

আমার ফেসবুক লিংক

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮

সাদিকনাফ বলেছেন: ইসরাইল আর ইন্ডিয়ান রা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে কাপুরুষ সেনাবাহিনী...

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:০৪

টিএম.নীরব বলেছেন: এরাই মুসলিমদের দুষমন

২| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: আহমেদ ইয়াসিনকে ইজরাইল হত্যা করলেও হত্যা করতে পারেনি তার রেখে যাওয়া প্রতিরোধ আন্দোলনের আগুনকে। বরং তা লাখগুন বেশী তেজে জ্বলে উঠেছে। ফিলিস্তিনসহ গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছে তিনি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক। সুবিচার-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সংগ্রামরত কর্মীদের কাছে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। মজলুম গণমানুষের কাছে একজন স্বর্গীয়-স্বপ্নপুরুষ তিনি। অনেকে তাঁকে বলেন দ্বিতীয় নুরুদ্দিন জঙ্গি যার তৈরী করা পথে হয়ত আবার হাজার বছর পরে দ্বিতীয় কোন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দেখা পেতে যাচ্ছে জেরুজালেমের খেজুর বিথীকা । বিশ্বের পঞ্চম শক্তিশালী আর্মির সামনে দাঁড়িয়ে একজন পঙ্গু-অচল মানুষ যে প্রতিরোধের আগুন জ্বেলেছিলেন সে আগুন সামাল দিতে আজ হিমশিম খাচ্ছে সন্ত্রাসী ইজরাইল এবং তার দোসররা। আল্লাহ চাহেন তো তাঁর রেখে যাওয়া এই আগুনেই ছারখার হয়ে যাবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট-নিষ্ঠুুর এই সন্ত্রাসী অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র। মুক্ত হবে আমাদের প্রিয় নবী করিম (সা.) এর মিরাজসহ শত শত নবী-রাসূলগণের স্মৃতি বিজড়িত বায়তুল মুক্বাদ্দাস, আমাদের প্রথম ক্বিবলা। সবশেষে শহীদ শায়খ আহমেদ ইয়াসিনেরই একটা উক্তি দিয়ে ইতি টানছি, ‘আমি জানি আমাদের এই পথ অনেক কঠিন, রক্তপিচ্ছিল এবং বিপদসংকুল কিন্তু ভবিষ্যৎ আমাদেরই ইনশাআল্লাহ…’

+++++++++++++++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.