নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেলতেপড়তেদেখতেশুনতেগুনতে ভালোবাসি

নাছির84

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র

নাছির84 › বিস্তারিত পোস্টঃ

রুটির ভেলা

২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৩:০৩

হাতে-পায়ে বেড়ে ওঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনকে দিন কমছে খোয়াবের সংখ্যা। ছোটবেলায় অনেক স্বপ্ন দেখতাম। তার কেন্দ্রিয় চরিত্র ছিল এক পাউরুটিওয়ালা। সাইকলে পাউরুটির বোঝা সাজিয়ে সে দরজায় টোকা মারত ভোরবেলায়। দ্বার খুলতেই গরম পাঁউরুটি সমর্পন করে খাঁটি ইংরেজ কায়দায় ‘নড’ করে সে বলতো 'গুড মর্নিং, স্যার' ! স্বপ্নটা এমনই তাড়া করেছিল যে শেষে পাড়ার চায়ের দোকানে রুটি-বিস্কুট যোগান দেয়া ময়দা মুন্সীকে তলব করতে বাধ্য হন বাবা। তারপর থেকে ফি দিন সকাল ছটায় গরম না হলেও নরম পাউরুটি হাজির হতে শুরু করল বটে,কিন্তু শত চেষ্টা করেও ময়দা মুন্সীর হাসিমুখ থেকে সাত সকালে 'গুড মর্ণিং' সম্ভাষন শোনা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো। মাসখানেক লেগে থাকার পর শেষ পর্যন্ত মুন্সীর বিদ্যের কাছে হার মেনেছিলাম। আমার স্বপ্নসন্ধানী মনের যতিও পড়ে সে যাত্রায়।



প্রায় নিরক্ষর কোনও পাউরুটিওয়ালাকে নিয়ে আর কেউ এমন উচ্চাশা পোষণ করেছেন কিনা তা জানা নেই। কিন্তু ঢাকায় ‌‌‌‌ফ্লাট-বিশিষ্ট্য বাঙালির প্রাতরাশের পাতে গাঢ় বাদামি বর্ডারওয়ালা সহস্র্ ছিদ্র বিশিষ্ট চতুষ্কোনের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। ঠিক কোন বয়সে আমার জীবনে তার অনুপ্রবেশ, তা হলফ করে বলতে পারব না। তবে স্মৃতির সিন্দুক খুঁড়ে বের হলো রংচটা এক শৈশব চিত্র। তখনও ফুলপ্যান্টের মাপ দেইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঝে-মধ্যে ব্রাশ করতে ভুল হতো,কিন্তু দুধ-পাঁউরুটি গলাঃধকরন করতে ভুল হতো না। আসলে হওয়ার উপায় ছিল না ! চোখ বুজে এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই,স্টেইনলেস স্টিলের জামবাটি উপুছুপু দুধসাগরে ভিজে ঢোল হয়ে যাওয়া অগুনতি রুটির ভেলা। টেবিলের উল্টো দিকে বসে রাজগোঁফে তা দিতে দিতে বাঘা নজরে আমাকে পর্যবেক্ষন করতেন বাবা। আধঘণ্টার ওই সময়টাকে মনে হতো যেন এক যুগ। অশ্রুসজল সেই পর্ব অতিক্রম করতে স্বয়ং আলেকজ্যান্ডারও হয়তো দু'বার ভাবতেন।



অবশ্য পাউরুটি দিয়ে শিকারের টোপ বানাতে আমি কখনোই দু'বার ভাবিনি। চোখ মুদলে এখনো পরিষ্কার দেখতে পাই,হাঁটার তালে তালে মাজায় টুংটাং পেতলের ঘন্টার ছন্দ তুলে হপার মুদি দোকান অভিমূখে এগিয়ে যাচ্ছে একটি ছেলে। কোমরে কায়দা করে বসা গাবের আঠার ছাপচিত্র যুক্ত রাবারের প্যান্টের ভাঁজে গোঁজা শতচ্ছিন্ন দুইটাকা। কিছুক্ষন আগেও যার আবাস ছিল মায়ের আঁচল তলে । কিন্ত শাস্ত্রে আছে- প্রয়োজন আইন মানেনা। তাই নিজ ঘরে হাত সাফাই করতে ভয় ছিলনা। তেমনি হপার দোকানে গিয়েও ইপ্সিত বস্তুটি চাইতে হতো না। ছাগলা দাড়িতে তেলচিটচিটে আঙ্গুল চালিয়ে হপা হাঁক ছাড়তো-‌'মিয়্যার ব্যাটা আইছে,রুটি দে।' ডান হাতে দুই টাকার প্রদান ও বাঁ হাতে রুটির আদান করে আমি ত্রস্ত পায়ে কানাপুকুরের দিকে এগিয়ে যেতাম। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষায় থাকতো আমার স্যাঙাত ‌'রপকুল'(রফিকুল)। দীঘির কালো জলে রুটি ভেজালে কেমন মিইয়ে যেত। তারপর ইচ্ছেমতো ‌'ময়দা ছেনা'। অতঃপর সেই ময়দার কাইয়ে ‌ মেশাও ‌'একআনি।' দারুন সুগন্ধযুক্ত ওই বস্তুটার যোগান দিত জগদুল চাচার ক্ষেত। আমরা তা সংগ্রহ করতাম 'প্রয়োজন আইন মানেনা' প্রবাদটি মনে ধারন করে !



শৈশবের সেই রপকুলের সঙ্গে পথভাগ হয় দাঁড়ি-গোঁফ ওঠার আগেই। তবে পাউরুটির সঙ্গে আমার শেষপর্যন্ত বন্ধুত্ব হয়েছিল ফ্রেঞ্চ টোষ্টের মহিমায়। সাদামাটা, সাত-চড়ে-রা-কাড়ে-না গোবেচারা ময়দার বর্গক্ষেত্র ডিমের গোলায় চুবিয়ে ডুবো তেলে ভাজলে যে এমন এক স্বাদু ব্যাপার হয়, তা ছেলেবেলায় আমায় না জানানোর অন্তরালে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। আসলে পেট খারাপ হতো কিনা তাই। কিন্তু জীবনযুদ্ধে ঢাকায় এসে মেস জীবনে হাঁসের ডিমের ফ্রেঞ্চ টোস্ট পাউরুটি সর্ম্পকে আমার ধারণাই পাল্টে দিয়েছিল।



তবে ফ্রেঞ্চ টোষ্ট বা স্যান্ডউইচের পাউরুটি কেবল নিমিত্ত মাত্র। কড়া টোষ্টের বুকে কমলার রস ঢেলে তার সঙ্গে কনডেন্সড মিল্ক অথবা উদার হাতে মাখন লাগিয়ে সবার শেষে চিনির দানা ছড়িয়ে কামড় দিলেই শীতের সকালে মুচমুচে স্বর্গসুখ। মাটির চুলোর নিভু আঁচে সেঁকা লালচে কুড়মুড়ে টোষ্টের পেলব অঙ্গে ডিমের কুসুমের উষ্ণ আদর জিভে লালার সুনামী পৌঁছে দেয় তুঙ্গে।



আমার এক বন্ধুর মা পাউরুটির পুডিং বানাতেন দুর্দান্ত। আর্শ্চয, মৃদু সুগন্ধী সেই তুলতুলে বিষ্ময় ক্ষনিকের জন্য হলেও মন থেকে দুধ-পাউরুটির ভয়াবহতা দুরে সরিয়ে দিত। আর পাঁউরুটি ঘিয়ে ভেজে তা চিনির রসে ফেললে স্রেফ অমৃত ! সঙ্গে যদি একটু ক্ষীর আর কিছু কিশমিশ দানা থাকে,তাহলে নবাবি মেজাজে সেটা শুধুই ‘শাহি টুকরা’।



চেনা পাউরুটির অচেনা পদ খাইয়েছিলেন আলিমউদ্দি নামে জয়পুরহাটের এক হোটেল বাবুর্চী । পাবনা অনুর্দ্ধ-১৯ ক্রিকেট দলের হয়ে ১১ বছর আগে ভরা বর্ষার কোন এক সন্ধ্যায় আমার পা পড়েছিল জয়পুরহাটে। হোটেল বুকিং-টুকিংয়ের বালাই ছিল না। কিন্তু নিরাশ করলেন না কেয়ারটেকার-কাম-বাবুর্চি-কাম-বেয়ারা আলিমউদ্দি। মাকড়সার দঙ্গলে ভরা ঘর খুলতেই নাকে ঘাই মারলো ভ্যাপসা গন্ধ। কিন্তু দিনভর ট্রেনে কুমড়ো-গড়াগড়ি দিয়ে পেটে দাবানল জ্বলছিল। খাবারের কথা তুলতেই ম্লান আলিমউদ্দির মুখ-'বেটাইমে আইছেন স্যার। হাট-বাজার কিছু করতে পারিনাই। তয় ঠোলে ডিম-পাউরুটি আছে। করে দেই?'

পাকস্থলীর প্রবল টানে আমি তখন চোখের সামনে দন্ডায়মান আলিমউদ্দিকে আস্ত মাংসের চাপ বলে ভাবতে শুরু করেছি। কোনমতে বললাম, 'একটা কিছু নিয়ে আসেন।'



নিখাদ ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আলিমউদ্দির ডাকে ভাগাড়ের মতো খাওয়ার টেবিলে হাজির হলাম। কাঁসার বাটিতে যা পরিবেশিত হলো, তার সঙ্গে ওই বারই আমার প্রথম ও শেষ পরিচয়। লন্ঠনের আলোয় ঠাহর করলাম, পাঁউরুটির ভাজা মিনিয়েচার টুকরোর সঙ্গে ডিম-কিশমিশের মিশেল। গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ চাগান দিচ্ছে ভুরভুর করে।খিদেয় আমি তখন বকরাক্ষস। বাটি শেষ করতে বড় জোর পাঁচ মিনিট।



জঠর শান্ত হতেই ফিরে এলো শহুরে সস্তা শিষ্টতা। ট্রাউজারের পকেট থেকে থেকে ১০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিতেই আলিমউদ্দি জিভে কামড় মারলো-'আমাবতীর রাইতে কুনও রকমে আপনাগো প্যাটে কিছু দিছি। এইডার আবার দাম কি। পরে দিয়েন।'



আটপৌরে ময়লা শরীরটির ঝলকানির সামনে আমার তামাম নাগরিক শিষ্টতা তখন বড়ই বয়োদব,বুঁজদিল, বদসুরত।

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৮/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৩:২২

s r jony বলেছেন:
ভাষার শৈলি ও গঠন চমৎকার হয়েছে ভাই, +++++++++++++++++
"পাউরুটি", এই সাধারন একটি বিষয়কে এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করে গল্পের রুপ দিয়েছেন, যেটা না পড়লে অনেক বড় কিছু মিস করতাম।



কমেন্ট নাই দেখে অবাক হলাম, ফেবু তে শেয়ার দেই, অন্যেদের পড়তে বলি।

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৯

নাছির84 বলেছেন: ধন্যবাদ। শেয়ার দেয়ার জন্য আবারও ধন্যবাদ। তবে এইসব সাধারন জিনিষগুলোর অসাধারন সব গল্প আমাদের সবার জীবনেই আছে। আমি হঠাৎ করেই কিভাবে যেন এই গল্পটা খুঁজে পেয়েছি।

২| ২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৩:৩১

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: চমৎকার। আপনার উপস্থাপন স্টাইলটি ভালো লেগেছে।

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫০

নাছির84 বলেছেন: কৃতজ্ঞতা রইলো।

৩| ২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৩

রাজন আল মাসুদ বলেছেন: এত সুন্দর করে লিখছেন যে নরম পাউরুটি খাওয়ার জন্য মন আকু-পাকু শুরু করছে।

+++++

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫২

নাছির84 বলেছেন: বেশি খাওয়ার দরকার নাই। নইলে ফার্মেসীতে যেতে হবে !

৪| ২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:০১

বোকামন বলেছেন:


খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে।
উপস্থাপন চমৎকার !
ভালো থাকবেন।

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৩

নাছির84 বলেছেন: আমার কৃতজ্ঞতা নেবেন ও ভাল থাকবেন।

৫| ২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৫:০২

ফারজানা শিরিন বলেছেন: যা বলার অন্যরা বলে দিয়েছেন । তাদের সাথে সহমত ।

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৪

নাছির84 বলেছেন: সবাই যেহেতু সহমতের ভেলায়...আমি কেন একলা মরি কূলের কাঁদায় ?

৬| ২৯ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৫:০৩

মনিরা সুলতানা বলেছেন: ভাল লাগ্ল আপনার পাউরুটি বিলাস ...।।

আটপৌরে ময়লা শরীরটির ঝলকানির সামনে আমার তামাম নাগরিক শিষ্টতা তখন বড়ই বয়োদব,বুঁজদিল, বদসুরত।

এই পরিস্থিতি তে আমিও জীবনে কয়েকবার পরেছিলাম...
নিজের লজ্জিত মুখচ্ছবি মনে পরে গেল :(

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৭

নাছির84 বলেছেন: নিজেকে তখন খুবই অসহায় লাগে।

৭| ২৯ শে মে, ২০১৩ রাত ৮:২৭

পলক শাহরিয়ার বলেছেন: দারুন মজা করে লিখেছেন। দেশে থাকতে খুবই অপছন্দের খাবার ছিলএই পাউরুটি ।পাঁকে পড়ে খেতে হচ্ছে।সয়ে যাচ্ছে।

৩০ শে মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৪

নাছির84 বলেছেন: ‌‌'যদ্যিপ দেশে যদ্যিপ সমাচার'।

৮| ৩০ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:১২

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: আপনার লেখায় একটা ছন্দ, ঝংকার আছে। খুব মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। ভালো লাগা রইল।

০৩ রা জুন, ২০১৩ রাত ১০:০৭

নাছির84 বলেছেন: ভাল লাগা রইলো যতনে..
গহন মনের অন্দরে..

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.