নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেলতেপড়তেদেখতেশুনতেগুনতে ভালোবাসি

নাছির84

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র

নাছির84 › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমি এবং কিছু বনেদী মানুষ

১২ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৪৪

আমাদের একতলা বাড়িটি ছিল ইটকাঠের সহবাসে তৈরি।ইস্পাতের গ্রীলে বারান্দা ও বর্হিজগতের সীমান্ত টেনে দেয়া । ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠে আমার প্রথম কাজ ছিল,রঁসুই ঘর থেকে ‌'খুচানী' চুরি করে তাকে বেত বানিয়ে ছাত্রদের পড়ানো। কেমন পড়াতাম সেটা তো বলাই বাহুল্য। আমার ক্ষীনতনু ছাত্রগুলোও কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারতো না। ইস্পাতের বোবা শিকগুলোর কাছ থেকে শিক্ষক আমি আর কিইবা আশা করতে পারি !

ছোট বেলায় কিন্তু তা বুঝতাম না। আমার কি দোষ,স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো বোঝেননি ! উনার ছেলেবেলা খুঁড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম,তিনিও আমার মতো বারান্দার রেলিংগুলিকে ছাত্র বানিয়ে শিক্ষকতার অবশ্যকর্মটি সম্পাদন করতেন। তবে সেটি যে ক্রমাগত বেত্রাঘাত,তা আর বলতে !

বেত্রাঘাত। আহ ! একটা শব্দ বটে। গোটা শৈশবজুড়েই চার অক্ষরের এই শব্দটির রাজত্ব অনস্বীকার্য। প্রায় প্রতিদিন মারধর হতো বলে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে মনে করতাম প্রাইমারি স্কুল । সে যে কত রকমের প্রয়োগবিধি তা ভাবলে অবাক হতে হয়-হাতের তালুতে বেত্রাঘাত,হাঁটুর নিচে বরইয়ের বিচি রেখে নীল-ডাউন,দুই আঙ্গুলের ফাঁকে কলম রেখে নাট টাইট দেয়ার মতো ঘুরানো,আর কত কি । মাষ্টারমশাইদের বেতন ছিল সামান্য। হয়তো সে কারণেই তাদের বেতগুলো হয়ে উঠেছিল অসামান্য।

নিয়মিত প্রহার আহার করার পাশাপাশি আরও কিছু অভ্যাসও রপ্ত করেছিলাম। এককথায় তার নাম হতে পারে শিক্ষক সেবা । মাথার পাকা চুল তুলে দেয়া,গা-হাত পা টিপে দেয়া,কানের ময়লা পরিষ্কার করা,পিঠ চুলকে দেয়া সহ আরও নানান কিসিমের সেবামঞ্জুরী। তখন চেয়ার-টেবিল বেঞ্চের বালাই ছিল না। অধিকাংশই চট,দুই একজন বনেদীর বগলে অবশ্য আসন ঝুলে থাকতো। মাষ্টার মশাইয়ের বসার আসন ছিল শতরঞ্চি। স্কুলের প্রতিবেশিী বাড়িগুলো সুপ্রসন্ন থাকলে মাঝেমধ্যে তিন পায়ের চেয়ারও জুটে যেত !

কড়ে গুনে শিক্ষক ছিলেন চারজন। হেডপন্ডিত,সেকেন্ডপন্ডিত,থার্ডপন্ডিত এবং আপাপন্ডিত। শেষের জনের চারণভূমি ছোটওয়ান+বড়ওয়ান হলেও থার্ডপন্ডিতের দখলে ছিল জনাকয়েক পায়খানার মিস্ত্রি ! আসলে ক্লাস থ্রী। সেকেন্ডস্যারের মুঠোবন্দি ছিল হেডস্যারের জুতো চোর। আরে না ! ক্লাস ফোর। আর হেডস্যারের হাতে শাণিত হতো এক দঙ্গল কলের পাইপ। বুঝতেই পারছেন, ক্লাস ফাইভ।

বাংলা-অংক-বিজ্ঞান-সমাজ ও পাঁতিহাস,থুক্কু ইতিহাস-এর সবগুলো শাখা-প্রশাখাতে মাত্র একজন স্যার সুপারম্যান হয়ে বিচরণ করতেন,আর আমরা নিয়ম করে অনিয়মের মাধ্যমে তাকে খসাবার চেষ্টা করতাম।

রুপসা স্যান্ডেল,রাবারের কোমরবন্ধনী যুক্ত হাফপ্যান্ট আর উর্দ্ধঙ্গে যেমন খুশি তেমন সাজোর সেই দিনগুলিতে একমাত্র আপদ ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। উফ ! সে এক মুর্তিমান গলগ্রহ। সব থেকে বেশি আতঙ্কে ভুগতেন হেডস্যার। কারণ,ওই বড়কর্তার রিপোর্টেল ওপর ভিত্তি করতো তার সংসার। তাই পরিদর্শক যেদিন তার লক্কড়-ঝক্কর ফিফটি হোন্ডায় মেদভূড়ি চাপিয়ে গোঁফে তা দিতে দিতে স্কুলে আসতেন,সেদিন হেডস্যারের ভালই খসতো। মিষ্টি-সিঙ্গারা ? মুখে রোচে না ? কোন সমস্যা নেই,মধ্যাহেৃর ভূরিভোজ তো আছেই। পরিদর্শকের জন্য পেশ করা থাল থাল পোলাও-মাংসের পানে তাকিয়ে ঈশ্বরকে কতদিন বলেছি-ফিঙ্গে পাখির বিষ্টা ফেলতে,কিন্তু ছোট ছিলাম,গলায় পরিদর্শকের মতো জোর ছিল না,তাই হয়তো আমার দরখাস্ত কখনো সা্ত-আসমান পর্যন্ত পৌঁছাতো না। তবে পরিদর্শককে নাকাল করার পরিকল্পনাটা আমরা ভালই জানতাম। সেখানে নিজেদের গুণপণার ছাপটা ছিল যথেষ্ট !

আমাদের গ্রামটা ছিল সবুজে ঘেরা, কিন্তু অজ পাড়া গাঁ।বর্ষাকালে এঁটেল মাটির রাস্তায় গাড়ী চলা তো দুরের কথা হাঁটাই যেতনা। তাই বড়কর্তার আদেশ জারী না হলে পরিদর্শকও আসতেন না খুব একটা। একদিনকার কথা-পরিদর্শক এসেছেন। আমাদের ক্লাসে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন,বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কি ? গোটা ক্লাস নিশ্চুপ। পরিদর্শক হয়তো ভেবেছিলেন,গ্রামের যোগাযোগ বর্জিত স্কুল,তাই প্রশ্নটি বুঝতে পারেনি ছাত্ররা।একটু কৌশল খাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা ঢাকার নাম শুনেছ ? এবারও গোটা ক্লাস নিশ্চুপ। পরিদর্শক ধরলেন হেডস্যারকে-কী ব্যাপার স্যার ? ছাত্রদের কি পড়ান ? হেডস্যার হাত কচলাতে কচলাতে বললেন-ছাওয়াল পালের পড়ানোর একটা্ সিষ্টেম আছে,সেটা না খাটালে ওরা পারবে না। আপনি অনুমতি দিলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। পরিদর্শক অনুমতি দিলেন। হেডস্যার বললেন-বলোতো বাবারা,ঢাকা বাংলাদেশের কি ধানী ? আমরা একসুরে জবাব দিয়েছিলাম -রা-আ-জ-ধা-নী।

প্রশ্নোত্তরের এই পাঠপক্রিয়ায় মাঝে-মধ্যে কিছু অভিনব উত্তরও মেলে। যেমন,স্যার জিজ্ঞেস করলেন, 'গরু আমাদের কি দেয় ? জবাব আসলো-'গুঁতিয়ে দেয় স্যার।' যাহা অবশ্য হইবে-এককথায় প্রকাশ কি ? জবাব আসতো -'বিবাহ।'

নানান রংয়ের সেই দিনগুলিতে প্রাইভেট স্কুলের আবির্ভাব ঘটেনি। বাচ্চা-কাচ্চাদের পেটে কালির অক্ষর যোগান দিতে তাল-ছনে ছাওয়া ওই প্রাইমারী স্কুলগুলোই ছিল ভরসা। আমার স্কুলের নাম ছিল ৮২ নং সোনাতলা সরকারি বুনিয়াদী বিদ্যালয়। স্কুল ছাড়ার পর হেডস্যারকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম-স্যার,বুনিয়াদী কথাটির অর্থ কি ? জবাবটা আজও ভুলিনি। ‌'বনেদী বুঝিস? বুনিয়াদী মানে হলো বনেদী স্কুল। আর,আমরা সেখানকার বনেদী টিচার।'

এখন বুঝি স্যার অনেক দুঃখে কথাটি বলেছিলেন। শরৎচন্দ্রের সেই 'পন্ডিতমশাইয়ে'র মতো। পরিদর্শকের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হয় ৭৫ টাকা। অর্থাৎ এক ঠ্যাং পিছু ২৫ টাকা। পন্ডিতমশাই হিসেব কষে দেখলেন,পরিদর্শকের ওই কুকুরটার এক ঠ্যাং তার গোটা সংসারের চেয়েও দামী। গল্পটা আমার প্রয়াত হেডস্যারের খুব পছন্দের ছিল। আজ মনে হয় স্যার যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাকে গিয়ে বলতাম-'স্যার আপনি যথার্থই বলেছেন,বুনিয়াদী মানে হলো বনেদীপনা।' স্যারের বিশ্বাস না হলে,বঙ্কিমের 'ইন্দিরা' উপন্যাসটি বের করে বলতাম-'এই যে দেখুন স্যার,বঙ্কিমবাবু লিখেছেন আমার পিতা হরমোহন দত্ত বুনিয়াদী বড় মানুষ।'







মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৫৬

বোকামন বলেছেন:
সা ধা র ন - সা দা মা টা ......
নানান রংয়ের সেই দিনগুলিতে ফেরত গিয়েছিলুম শব্দের পিঠে চড়ে .....

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:৪৫

নাছির84 বলেছেন: ফের শব্দের পিঠে চড়িয়ে ফেরত আনতে পারলেই সার্থকতা। তা করতে পেরেছি কিনা জানিনা।

২| ১২ ই জুন, ২০১৩ রাত ১০:০৮

কালোপরী বলেছেন: :)

১৩ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১২

নাছির84 বলেছেন: তাই !!!!

৩| ১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:০৪

খেয়া ঘাট বলেছেন: এতো সুন্দর লিখার বুনন, গদ্যের এতো সুন্দর উপস্থাপন- পড়ে মুগ্ধ হলাম।
"জবাব আসলো-'গুঁতিয়ে দেয় স্যার।' যাহা অবশ্য হইবে-এককথায় প্রকাশ কি ? জবাব আসতো -'বিবাহ।'- নিখুঁত হাস্যরস।

অনেক ভালো লাগলো। অনেক , অনেক।
+++++

১৪ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:৫৯

নাছির84 বলেছেন: এত সুন্দর স্তুতির সঙ্গে দয়া করে ভুলগুলোও ধরিয়ে দেবেন। স্কুলব্যাগের মতো আরেকটি গল্পের অপেক্ষায়.........


আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.