নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেলতেপড়তেদেখতেশুনতেগুনতে ভালোবাসি

নাছির84

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র

নাছির84 › বিস্তারিত পোস্টঃ

আয়নালের একদিন

২৩ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৮:৫৩

ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া বেঞ্চিটায় শুয়ে আয়নাল ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাইরে চৈত্রের পোড়া দাবদাহ । পার্কটা সে তুলনায় বেশ ঠান্ডা। মাথার ওপর নাগালিঙ্গমের বীথি। খালি পেটে ঘুমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক।

দুপুর পেরিয়ে ঘুম ভাঙ্গলো আয়নালের। ততক্ষনে নাগালিঙ্গম বীথির চেহারাও পাল্টে গেছে। জাফরি আলপনা কাটা পাতার ফাঁক গলে সুর্যের সোনালী আলো চুঁইয়ে পড়ছে। মায়ের ফেরার অপেক্ষায় ছিল আয়নাল। যাওয়ার সময় মা বলেছিল-খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। আয়নালেরও হাত খালি। তাই পার্কের বেঞ্চিটায় শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু মা তো এখনো ফিরলো না ? ইতিউতি তাকিয়ে আয়নাল দেখতে পেল,একটু দুরেই জারুল তলায় তার বয়সি অনেক ছেলে-মেলে বাহারী পোশাকে হৈচৈ করছে। কেউ দাড়িয়াবান্ধা খেলছে,কেউবা সুলতানা বিবিয়ানা। মাইকও আছে ! আয়নালের খুব ইচ্ছে হলো,সেখানে যাওয়ার। কিন্তু কেমন ভয় ভয় লাগে। মা সঙ্গে থাকলে এমন ঘটতো না-আয়নাল ভাবে।

মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া শেষে আয়নাল হাঁটা ধরে। সাহসের ওপর ভর দিয়ে সে এগিয়ে যায় কচিকাঁচার মেলায়। কিছুদুর এগিয়েই আয়নাল থতমত খেয়ে যায়। ইস ! ছেলে-মেয়েগুলো কি বাহারী সাজই না সেজেছে ! কেউ জলদস্যূ,কেউ মেম সাহেব,কেউ আবার যোদ্ধা সেজেছে। মাজায় পিস্তল ! আয়নালের মনটা মায়ের জন্য হু হু করে ওঠে। তার মা এখানে থাকলে, এতক্ষনে ওই ছেলে-মেয়েগুলোর মতোও সে ছোটাছুটি করতে পারতো।

আহ ! সাজার বাহার দেখরে ! তীর-ধনুক নিয়ে একজন শিকারি সেজেছে। আয়নালের খুব মজা লাগে। সে আরো এগিয়ে যায়। সামনের টেবিলেই থরে-বিথরে সাজানো কেক,বিষ্কিট,ফল-ফলাদি। আরো কত কি! আয়নালের জিভটা সুড়ুৎ করে জল ছেড়ে দেয়। ছেলে-মেয়েগুলোর সঙ্গে তাদের মা-বাবারাও আছে। আয়নাল বুঝতে পারে,সাজানোর কাজটা তারাই করেছে। মায়ের ওপর তার খুব রাগ হয়। এভাবে কেউ ফেলে রেখে চলে যায় !

হাঁটতে হাঁটতে আয়নাল কখন যে হৈ-চৈ'য়ের মাঝখানে এসে পড়েছে,তা বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ খেয়াল করলো এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে-'কী চমৎকার সেজেছে।' আয়নালের ইচ্ছে হলো,এক দৌড়ে পার্কটা থেকে বেরিয়ে যায়। মনের ভেতর কেমন যেন অসস্তি লাগে তার। কিন্তু ভয় পায়না। চীনাদের সাজ নেয়া একটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। আয়নাল মুচকি হাসিতে জবাব দেয়। কিন্তু কয়জনের হাসির জবাব দেবে ? সবাই তো তাকে দেখে হাসছে। কেমন যেন চমকে যাওয়া হাসি। বড়দের চোখ পড়ে সেদিকে। কাজ ফেলে ছুটে আসেন তারা। মিসেস নেলী বলে ওঠেন,‌'হাউ স্পেলবাইন্ডিং।' তারপর ঘৃণা-অবহেলা মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,‌'কার ছেলে ? সাজটা একেবারে নির্ভূল।'

-'আমাদের যেমন খুশি তেমন সাজো'তে খুব মানাবে'-সায় দেয় একজন।

মিসেস ললিতা আবার বাড়িয়ে বলতে ভালবাসেন। 'ওই ছেলেটাই প্রথম হবে বলে মনে হচ্ছে। ইস,আমার টুকুন সাঁওতাল সেজেও ওর সঙ্গে পারবে না। ঢাকা-ব্যংকক বিমান টিকিটা হাতছাড়াই হয়ে গেল তাহলে'-একরাশ হতাশা নিয়ে বলেন ললিতা। আরেকজন বলে উঠলো-'দেখেন না আপা,সাজটা কি নিঁখুত। মুখে কি চমৎকার পাউডার মেখেছে। ঠিক ধূলোর মতো। ভিখিরি ছেলেরা কাঁদলে তাদের চোখের পানির যে শুকনো দাগ থাকে,সেটাও আছে ! এই ছেলে ফার্ষ্ট না হয়ে যায় না।

কিন্তু ললিতার সহ্য হয়না-'আপনি যাই বলেন ভাবী,ছোট ছেলে-মেয়েদের এভাবে ভিখিরি সাজাতে নেই। এতে তাদের কচি মনের ওপর প্রভাব পড়ে।'

সবাই সায় দিয়ে ওঠে।

কেউ কেউ আয়নালের ছবি তুলতে শুরু করে। তাদের থামিয়ে দেন মিসেস জুবাইদা। উপস্থিত মায়েদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বয়সি।

কিছুটা প্রভাবশালী।

সন্দেহবাদী।

মাতব্বরনি।

জুবাইদা জিজ্ঞেস করেন,‌‌'একটা ছেলেকে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে ? পুরুষ্কারও তো দিতে হবে,নাকি ? তা ছেলেটা কার ?

-তা জানিনা আপা। মনে হয় মিসেস রওশনআরার ছেলে।

নেলি বেগম ছুটে গিয়ে বাচ্চাদের তালিকা নিয়ে আসেন। সবার স্বাক্ষর দেখে তিনি নিশ্চিন্ত হন,মিসেস রওশনআরার ছেলেই শুধু উপস্থিত নেই। তিনি ভেবে নেন,ছেলেকে এভাবে পাঠিয়ে ভাবী হয়তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। তবু নিশ্চিন্ত হতে তিনি আয়নালকে ডাক দেন-'এই খোকা একটু শুনবে ?' আয়নাল ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায়।

-তোমার বাবার নাম কি ?

আয়নাল নিশ্চুপ। ঠিক তখনই জুবাইদা আগ বাড়িয়ে নেলীকে বাধা দেন-'আহ,এত্তটুকুন ছেলেটাকেও জেরা করার লোভ সামলাতে পারলে না। ছাড়ো তো ওকে। যাও,খোকা টেবিলে খাবার আছে। খাওগে।'

আয়নাল যেন হাতে চাঁদ পেল। একছুটে সে টেবিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো্ এবং গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো।

মিসেস নেলী ও জুবাইদা দুজনেই বেশ চমকে যান। হঠাৎ পরিচিত একটি গাড়ীর হর্নের শব্দ। জুবাইদা তাকিয়ে দেখেন,মিসেস রওশনআরার গাড়ী। তার আগেই অনেকেই ছুটে যায় রওশন আরা কাছে। একজন বলে-'আপা,এমন রসিকতার কোন দরকার ছিল। ছেলে প্রথম হবে জানতেন বলেই কি এত দেরী করে এলেন ?

-আমার ছেলে ? মানে কি ?

-থাক আর বিনয় দেখাবেন না আপা। আমরা তো আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম। মায়ের সামনে পুরষ্কার নিতে আপনার ছেলের ভালই লাগবে।

রওশন আরা এবার রেগে যান। তিনি খেঁকিয়ে ওঠেন-জাহানারা,তোমায় না বলেছি ছেলেকে আমি কোন ফাংশনে পাঠাই না। কথাটা তখন তোমার কানে ঢোকেনি ?

জাহানারা নিশ্চুপ। কিন্তু নেলি হাল ছাড়লো না। টেবিলে গোগ্রাসরত আয়নালের দিকে উদ্দেশ্য করে সে বললো-'ওই ছেলে আপনার নয় ?'

রওশন আরা বেগম আয়নালের দিকে তাকিয়ে বিরক্তস্বরে বলেন-'না। তোমরা ভেবেছ কি,যেমন খুশি তেমন সাজার পোগ্রাম বলেই কি,আমি আমার ছেলেকে ভিখিরি সাজিয়ে পাঠাবো ? আমার টাকা-পয়সা নেই ?

-কিছু মনে করবেন না আপা। আমরা ভেবেছিলাম'.....এই বলেই লিস্ট হাতে নিয়ে মিসেস নেলি ছুটে যান আয়নালের কাছে। সবাই তাকে অনুসরন করে। নেলি বলেন-'এই তোমার বাবার নাম কি ?

রসগোল্লাটার অর্ধেক কেবল কায়দা করে এনেছিল আয়নাল। এরমধ্যে বাঁজখাই কন্ঠ শুনে সে ঘুরে তাকায়। একসঙ্গে এতগুলো চোখ তাকে দেখছে, দেখে আয়নাল ঘাবড়ে যায়। কিন্তু জবাব দিতে দেরি করেনা-'আমার বাপ নাই।'

-কি হয়েছে ?

-ট্রাকের তলে পড়ছিল।

নেলি ততক্ষনে তুমি থেকে তুইয়ে-'তোর মা ?'

-সেও মরে গেছে।

-তবে,তুই কার ছেলে ?

-আজ সকালে একজনকে মা ডেকেছিলাম। সে নিয়ে যাবে বলেছিল। কিন্তু এখনো আসেনি।

উপস্থিত সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে। মিসেস ললিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কেউ একজন বলেন-কথার কি শ্রী !

নেলি মরিয়া-তোর নতুন মা কে ?

-ভিক্ষা করে।

নেলির মেজাজ ততক্ষনে সপ্তমে। তিনি আবারও প্রশ্নের তুবড়ি ছোটান-তুই কোথায় থাকিস ?

-যখন যেখানে খুশি।

-তুই তবে কে ?

-আমি ভিক্ষা করি।

ভিখিরি !?!?!?

আয়নালের কাছ থেকে সবাই কয়েকহাত পিছিয়ে গেল। কর্কশ আওয়াজে জুবাইদা আবারও জিজ্ঞেস করেন-সত্যি তুই ভিক্ষা করিস ?

-হ্যাঁ করি।

-তবে রে,কুত্তার বাচ্চা,এখানে যে ঢুকেছিস। কথা শেষ করার আগেই আয়নালের গালে জুবাইদার হাত বসে গেছে। শুরু হয় হৈ-চৈ। নেলি বলেন-ছিঃ ছিঃ তাই বলে রাস্তার ভিখিরি। অথচ আমরা ভেবেছিলাম...।বদমাইশটার গায়ে রাজ্যের আবর্জনা।

জুবাইদা,ললিতা,জাহানারাদের কেউই বসে নেই। সবারই হাত-পা চলছে সমানে। মা গো-শব্দে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল আয়নাল।

মিসেস নেলি চিৎকার করে চলছেন-লাঠি আন তাড়াতাড়ি,শয়তানটার হাড্ডিগুলো চুর করি।

আয়নালের তেজ আছে বলতে হবে ! মাটিতে ভূপাতিত অবস্থায় হাই হিলের ক্রমাগত লাথি খাওয়া স্বত্তেও সে উঠে দাঁড়ায়। চট করে ব্যূহ ভেদ করে সে প্রাণপণ দৌড় লাগায়। কয়েকটা হিলের গোড়ালি তখনও শূন্য থেকে আয়নালের শরীরে আছড়ে পড়ার অপেক্ষায়। কিন্তু নিচে শিকার নেই !

উর্দ্ধশ্বাস আয়নাল রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকে। সবুজের ওই ছায়াবীথি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তার মনে হলো,শতশত ডাইনি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে আসছে আর বলছে-লাঠি আন,শয়তানটার হাড্ডি চুর করি।









মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৯:৩২

খেয়া ঘাট বলেছেন: Boroi korun.
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
Ek guchcho Plus.

২৪ শে জুন, ২০১৩ ভোর ৬:৫৩

নাছির84 বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

২| ২৩ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৩০

মাক্স বলেছেন: লেখাটি ভাল লাগলো!

২৪ শে জুন, ২০১৩ ভোর ৬:৫৭

নাছির84 বলেছেন: তাই চমকে যেতে হবে ? শুভেচ্ছা রইল।

৩| ২৩ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ২:২৬

মনিরা সুলতানা বলেছেন: মর্মমূলে ধাক্কা দেয়া লেখা ...
চমৎকার ...।

খেয়া ঘাট এর মত এক গুচ্ছ +++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

২৪ শে জুন, ২০১৩ ভোর ৬:৫৭

নাছির84 বলেছেন: দুইজনের প্লাসই বুঝিয়া পাইলাম।

৪| ২৩ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:১৮

শূন্য পথিক বলেছেন: ভাল হইছে

২৪ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৭:০০

নাছির84 বলেছেন: ধন্যবাদ। ব্লগে স্বাগতম।

৫| ২৯ শে জুন, ২০১৩ রাত ৮:৫৯

নীল-দর্পণ বলেছেন: ৫নং ভাল লাগা

২৪ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:৫২

নাছির84 বলেছেন: ধন্যবাদ নীলদর্পন।

৬| ২৪ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:৪০

এক্সপেরিয়া বলেছেন: খুবই মায়াময় কষ্টকর.... এই গল্পটা অনেক ভাল লাগল....

২৪ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:৫৩

নাছির84 বলেছেন: ধন্যবাদ এক্সপেরিয়া। ব্লগে স্বাগতম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.