নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেলতেপড়তেদেখতেশুনতেগুনতে ভালোবাসি

নাছির84

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র

নাছির84 › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটপাখি এবং কালোমানিক এর গল্প

০১ লা জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৭



বড় বড় কূটনীতিবিদরা দু’বছর চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধের রক্তপাত বেড়ে চলছিল। তখন ১৯৬৭ সাল। স্থানীয় একটি দলের সঙ্গে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলতে লাগোস বিমানবন্দরে অবতরণ করে সান্তোষ। হঠাৎ করেই গোটা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার জন্য থেমে যায় নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ। রাজনীতিবিদরা হাজার চেষ্টা করেও যা করতে পারেননি, সেদিন তা-ই ঘটেছিল মাত্র একটি শব্দের সম্মোহনী শক্তিতে- পেলে!

১ হাজার ২৩১ গোল। ৯০টিরও বেশি হ্যাটট্রিক। তিনটি বিশ্বকাপ জয়। কিংবদন্তি তো বটেই, পেলেকে সর্বকালের সেরা বলে মেনে নেয়ার সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু, একটা অদ্ভুত রকমের বিপত্তি আছে। পেলের নিজ দেশেই পাঁচ যুগ ধরে একটি প্রবাদ প্রচলিত- ‘পেলে ওয়াজ গ্রেটেষ্ট, বাট গারিঞ্চা ওয়াজ বেটার!’

শরীরে ক্রীতদাসের রক্ত নিয়ে জন্মেছিলেন। তার ভেতর ঢুকে পড়ে পোলিও! মেরুদ-টা তাই আর কখনোই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ডান পা-টা ভেতরের দিকে কিঞ্চিৎ বাঁকানো। সমস্যা বাঁ পায়েও। সেটা আবার ডান পায়ের চেয়ে ছয় সেন্টিমিটার ছোট এবং বাইরের দিকে বাঁকানো। তাই প্রথম সাক্ষাতে সবাই ভেবে নিত, লোকটা হাঁটতে পারে না। কিন্তু একটা ফুটবল পেলে মাত্র ৫ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি উচ্চতার সেই শারীরিক কাঠামোটাই পরিণত হতো জন কিটসের সেই অমর লাইনে ‘এ থিং অব বিউটি ইজ জয় ফরএভার।’

পিতৃপ্রদত্ত নাম ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো দস সান্তোস। জন্মস্থান ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা পাও গ্রান্দে। একদিন কোত্থেকে একটি ছোট পাখি ধরে নিয়ে আসেন ম্যানুয়েল। তার বড় বোন বলে, দেখো, পাখিটা ঠিক তোমারই মতো। উড়তে পারলেও অপদার্থ। কোন কাজের নয়। এর নাম তো গারিঞ্চা!

বাবার দেয়া নামটি এরপরই হারিয়ে যায়। ম্যানুয়েল হয়ে ওঠেন গারিঞ্চা। নামটার অর্থ ছোট্ট ডানাওয়ালা পাখি, যে খুব সুন্দর করে গান গাইতে পারে! গারিঞ্চা ঠিক সেই অর্থে গায়ক নন। তার হয়ে গানের সুর ধরত বাঁকানো অমুল্য দুটি পা। উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানি একবার বলেছিলেন, ‘ফুটবলের ইতিহাসে আর কেউই গারিঞ্চার মতো এতটা আনন্দ দিতে পারেনি।’

গারিঞ্চার মতো এত সচ্ছন্দ ড্রিবলার ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া ভার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন অস্ত্র হিসেবে। পেশাদারি ক্যারিয়ার শুরুর ঘটনাটা এরকম- ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা লেফটব্যাক হিসেবে বিবেচিত নিল্টন স্যান্টোসের কাছে ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন গারিঞ্চা। প্রথম টাচেই বলটা সোজা চালান করে দেন স্যান্টোসের দুই পায়ের মাঝখানে! সবাই ভেবেছিল, এত পুঁচকে ছেলেটার ডেঁপোমি সহ্য করবেন না স্যান্টোস। কিন্তু বোটাফেগোর কর্মকর্তাদের ডেকে স্যান্টোস বলেছিলেন, ‘ওই ছেলেটা (গারিঞ্চা) সাধারণ নয়। ওকে নিয়ে নাও। ওর বিপক্ষে খেলার চেয়ে এক দলে থাকাই ভালো।’

পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে গারিঞ্চা একেবারে বোটাফোগোর মুল দলে এবং অভিষেকেই হ্যাটট্রিক!

’৫৮ বিশ্বকাপে গারিঞ্চার অভিষেক ঘটেছিল দুই ম্যাচ সাসপেনশনে ভোগার পর!



সুইডেন বিশ্বকাপের একমাস আগে বোটাফোগোর হয়ে তিনি খেলতে গিয়েছিলেন ইতালিতে। ফিওরেন্তিনার বিপক্ষে প্রতিপক্ষের চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোলটি করেছিলেন গারিঞ্চা। পরে আরও একটি গোল করেছিলেন। বিপত্তি সেটা নিয়েই। তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গারিঞ্চা দাঁড়িয়ে ছিলেন একেবারে ফাঁকা গোলপোষ্টের সামনে। টোকা দিলেই গোল। কিন্তু তা না করে গারিঞ্চা অপেক্ষা করলেন পড়িমরি করে ছুটে আসা ডিফেন্ডার রোবোত্তির জন্য! রোবোত্তি এলেন। বাধা দিলেন। কিন্তু আবারও বোকা বনলেন। গোল!

গারিঞ্চার এমন আচরণ ভালোভাবে নেননি সে সময়ের ব্রাজিল কোচ। শাস্তি হিসেবে তাকে বিশ্বকাপের প্রথম দুটি ম্যাচে বসিয়ে রাখা হয়। তৃতীয় ম্যাচেই চলে আসে সুযোগ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে সেদিন ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ইতিহাসের দুই শ্রেষ্ঠ সন্তানের অভিষেক ঘটেছিল। দীর্ঘ ১২ বছর তারা একসঙ্গে খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে। এ সময়ের মধ্যে ব্রাজিল কোনো ম্যাচেই হারেনি ! একজন গারিঞ্চা, আরেকজন তার থেকেও বয়সে সাত বছরের ছোট, পেলে।

অভিষেকের প্রথম মিনিটেই গারিঞ্চা তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে যে শটটি নেন তা গোলপোষ্টে লেগে ফিরে আসে। মুহহৃর্তখানেক পর তার বাড়িয়ে দেওয়া বল থেকে পেলের নেওয়া শটও ল্যক্ষভ্রষ্ঠ হয় ক্রসবারে লেগে! মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে একের পর এক আক্রমণে সোভিয়েত উইংকে গারিঞ্চা-পেলে জুটি এতটাই ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল যে, ফুটবল ইতিহাসে ওই তিন মিনিটকে বলা হয়, ‘দ্য গ্রেটেষ্ট থ্রি মিনিটস ইন ফুটবল হিষ্ট্রি।’ কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর ওয়েলস ফুলব্যাক মেল হপকিন্স গ্যারিঞ্চাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘দ্য অ্যাঞ্জেল উইথ বেন্ট লেগস’ অর্থাৎ ‘বাঁকানো পায়ের ঈশ্বর’।

গারিঞ্চা শুধু ড্রিবলিংটাই পারতেন। খেলতেনও নিজেকে উজাড় করে। কিন্তু খেলাটির নিয়মকানুন জানার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। ’৫৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ‘মারাকানার ভূত’ তাড়ানোর পর মাঠেই উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন দিদি-ভাভারা। কিন্তু গারিঞ্চার মুখ শুকনো! তিনি ভেবেছিলেন, প্রতিটি দলের সঙ্গে আরও একটি করে ম্যাচ খেলতে হবে! যত ম্যাচ তত ড্রিবলিং, তত বেশি মজা' ফুটবলকে ঠিক এভাবেই দেখতেন তিনি।

নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন ’৬২ চিলি বিশ্বকাপের জন্য। চোট পাওয়ায় প্রথম দুই ম্যাচ পরই আসর থেকে ছিটকে পড়েন পেলে। দায়িত্ব বর্তায় গারিঞ্চার কাঁধে। অধুনা প্রজন্ম মনে করে, একা বিশ্বকাপ জেতানোর কৃতিত্বটা শুধুই দিয়েগো ম্যারাডোনার। ফুটবলের সঙ্গে কথাটা বেমানান হলেও একাই দেশকে শিরোপা জেতানোর কীর্তিটা কিন্তু গারিঞ্চাই প্রথম গড়েছিলেন। এখন মেসি-রোনালদো অবিশ্বাস্য খেললে আমরা তকমা দেই ‘ভিনগ্রহের ফুটবলার।’ ৬২ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে চিলির বিপক্ষে ২০ গজি ভলি থেকে গারিঞ্চার করা সে গোলটির পরদিন চিলির দৈনিক ‘এল মারকুরিও’ শিরোনাম করেছিল ‘সে (গারিঞ্চা) কোন গ্রহের ফুটবলার?’

’৬৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ৩-১ গোলে হারে ব্রাজিল। ওই ম্যাচে পেলে খেলেননি। পরের ম্যাচে ব্রাজিল মাঠে না নামায় ওটাই হয়ে যায় গারিঞ্চার জীবনের শেষ আর্ন্তজাতিক ম্যাচ। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে খেলেছিলেন মোট ৫০ ম্যাচ। হেরেছিলেন শুধু ওই এক ম্যাচে !

আর্সেন ওয়েঙ্গার একবার বলেছিলেন, ‘ফুটবল হলো সুন্দরী রমণীর মতো। মনে করিয়ে না দিলে সে নিজের সৌন্দর্য ভুলে যায়।’ পেলে ছিলেন সম্পুর্ণ ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক। তার জীবনের খেরোখাতা পরিসংখ্যানসহ প্রায় সবারই মুখস্থ। তা ফের জাবর না কাটাই ভালো। গারিঞ্চার জীবনচিত্র ছিল ‘কালোমানিক’-এর ঠিক উল্টো। নারীসঙ্গ ভীষণ পছন্দ করতেন। ৫ বউয়ের কোলে উপহার দিয়েছিলেন মোট ১৪টি সন্তান! বাবার মতো মদ গিলতেন। কথিত আছে, সারারাত মদ খেয়ে পরদিন মাঠে খেলতে নামতেন ! ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে আবারও মদ খেতেন। বাবার পথ অনুসরণ করেই লিভারটা পচিয়ে ১৯৮৩ সালে গারিঞ্চা ফিরে যান না ফেরার দেশে।



ব্রাজিলিয়ানদের কাছে গারিঞ্চার আবেদন আসলে কতখানি ছিল, সে ব্যাপারে তার মৃত্যুর পরদিন এক কলামে লিখেছিলেন দেশটির প্রখ্যাত কবি, কার্লোস দ্রুমান ডি আন্দ্রে, ‘ঈশ্বর ফুটবলকে লালন করে থাকলে, সে খুবই চতুর। আর গারিঞ্চা তারই পাঠানো প্রতিনিধি যে কি-না স্টেডিয়ামে সবার চিত্তবিনোদনের খোরাক জোগাত। কিন্তু ঈশ্বর একইসঙ্গে নিষ্ঠুরও। ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার পর গারিঞ্চার জীবন আর জীবন থাকেনি। একটা মানুষ প্রায় একাই গোটা দেশের দুঃখ (মারাকানা ট্র্যাজেডি) ভুলিয়ে দিল। অথচ দুর্ভাগ্য সেই দুঃখটা আবারও ফিরে এসেছে, কিন্তু গারিঞ্চাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কখনোই না।’

চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেও রিও ডি জেনিরোর সমাধিক্ষেত্রে না থেকেও আছেন গারিঞ্চা। তার সমাধিফলকে খোদাই করা দুটি বাক্য এখনো ভক্তদের মনের কথা, ‘here rests in peace the one,who was joy of people-Mane garrincha’ এবং ‘thank you garrincha, for having lived’.







(লেখাটা বেশ আগে ব্লগে দিয়েছিলাম। কিন্তু দৈনিক সমকাল এর বিশেষ সংখ্যা ‌'গোল' এ প্রকাশ হওয়ায় কিছুদিনের লেখাটা জন্য ড্রাফটে নিতে হয়। অতঃপর তা ফিরে গেল নিজের জায়গায়...)



(ছবিগুলোর কিছু গারিঞ্চা সংশ্লিষ্ট। বাদবাকি স্রেফ ভাল লাগা থেকে দেয়া।)



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৬

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: দারুন!

অনেক অজান জানা হলো!

আসলেই পেলে মানে পেলেই। তার কোন তুলনা হয় না্।

++++

০১ লা জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪

নাছির84 বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।

২| ০১ লা জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৯

রিফাত হোসেন বলেছেন: + তবে মারাদোনা তো মারাদোনাই ! :) ব্রাজিল কে চির শত্রু মনে হয় । পেলেও অসাধারণ খেলেন । :)

মারাদোনার জাদুতে এখনও আর্জেন্টিনাকে ভালবাসি । তবে চোখ খোলা রেখে বললে ব্রাজিল শৈল্পিক দিক দিয়ে এগিয়ে । কিন্তু মন আমার ঐ আর্জেন্টিনা ...

০১ লা জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:১৩

নাছির84 বলেছেন: মন যা বলে তাই শোনা উচিত। কারণ আনন্দ যোগায় মন, মস্তিস্ক নয়। কথাটা আপনার চিরশত্রু দলের এক সমর্থকের। মানলে ভাল, না মানলে আরো ভাল !
শুভ কামনা। ভাল থাকবেন।

৩| ০১ লা জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:৪২

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: বরাবরের মতই অসাধারণ একটা ফিচার। উপভোগ করলাম।

০২ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:০৬

নাছির84 বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ প্রফেসর। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।

৪| ০২ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:০০

rakibmbstu বলেছেন: +++++++++++++

০২ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:০৬

নাছির84 বলেছেন: ধন্যবাদ।

৫| ০২ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:০৩

বিজন শররমা বলেছেন: xxx

০২ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:১২

নাছির84 বলেছেন: ???

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.