নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেলতেপড়তেদেখতেশুনতেগুনতে ভালোবাসি

নাছির84

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র

নাছির84 › বিস্তারিত পোস্টঃ

মারাকানাজ্জো

০২ রা জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৬



মাঝেমধ্যে বেঁচে থাকাও বাকিদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ! সেটা

দু-একজন হলে ভিন্ন কথা, কিন্তু গোটা জাতির শাপ-শাপান্তের কারণ হয়ে বেঁচে থাকাটা তো এক অর্থে মৃত্যুরই সমান!

সেদিনের পর থেকে জীবনের বাকি ৫০ বছর ঠিক এভাবেই বেঁচে ছিলেন মোয়াকরি বারবোসা নাসিমেন্তো। দেহত্যাগের পরদিন ব্রাজিলের এক দৈনিক শিরোনাম করেছিল‘বারবোসার দ্বিতীয় মৃত্যু !’ আত্নীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব মিলিয়ে তার শেষকৃত্যে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ জন ! পার্থক্যটা হলো, বারবোসার ‘প্রথম মৃত্যু’ দেখেছিল ১ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ। আন-অফিসিয়ালি সংখ্যাটা ২ লাখেরও বেশি! এখন পর্যন্ত যা সর্বোচ্চ দর্শক উপস্থিতির রেকর্ড। ইতিহাসে দিনটি ১৯৫০ বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ‘মারাকানাজ্জো’।

উরুগুয়ে তখন আটবার কোপা আমেরিকা এবং একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তার পরও স্বাগতিকরাই ফেভারিট ! ড্র করলেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন। শিরোপার এতটা কাছে থাকায় চারদিকে তাই সাজসাজ রব পড়ে যায়। ম্যাচের দিন-তারিখ নির্ধারিত হয় ১৬ জুলাই।

ব্রাজিলের সংবাদপত্রগুলো বসে থাকেনি। দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক ‌'ও মুন্ডো' জাতীয় দলের বিশাল এক ছবিসহ ক্যাপশনে ‘এরাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ লিখে ম্যাচ শুরুর আগেই একটা সংষ্করন প্রকাশ করে। এর বেশ কিছু কপি কিনে আনেন উরুগুয়ের অধিনায়ক ওবদুলো ভ্যারেলা। পড়ার জন্য নয়,জলবিয়োগের পর সংস্করনগুলোকে তারা ব্যবহার করেছিলেন ন্যাপকিন হিসেবে! ব্রাজিলিয়ানদের তাতে থোড়াই কেয়ার। জাতীয় দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের নামাঙ্কিত স্মারক মুদ্রা পর্যন্ত বাজারে ছেড়েছিল তারা! একদল মিউজিশিয়ানও প্রস্তুত রাখা হয়। ম্যাচ শেষে তাদের দায়িত্ব ছিল জয়ী দলের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো। ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীত এবং ১১ জন খেলোয়াড়কে নিবেদন করে ‘ব্রাজিল ক্যাম্পিও’ নামে বিশেষ একটি গানের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন বাদকরা। কিন্তু উরুগুয়ের জাতীয় সঙ্গীতকে প্রস্তুতির তালিকায় রাখা হয়নি । আয়োজকরা প্রয়োজন মনে করেননি!

ব্রাজিলিয়ানদের প্রস্তুতির বহর দেখে উরুগুয়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ভড়কে যান। ম্যাচ শুরুর আগে দূতাবাস থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা উরুগুয়ের ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভ্যারেলাকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘হারের ব্যবধানটা যেন কোনোমতেই ছয় না হয়। চার পর্যন্ত আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে সন্তুষ্ট !’

কিন্তু ভ্যারেলা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কোচ হুয়ান লোপেজ পর্যন্ত রক্ষনাত্নক ফুটবল খেলার নির্দেশ দেওয়ায় উরুগুয়ে ফুটবলের ‘ব্লাক চিফ’ নামে খ্যাত এ সেন্টারব্যাক তার সতীর্থদের বলেছিলেন, ‘হুয়ান খুব ভালো মানুষ। কিন্তু আজ তার সিদ্ধান্ত ভুল। আমরা যদি রক্ষনাত্নক খেলি, তাহলে সুইডেন এবং স্পেনের মতো পিষ্ট হতে হবে। এসব কথার কোনো মুল্যই থাকবে না, যদি আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। তাই হারের জন্য মাঠে নামার প্রশ্নই ওঠে না। চার গোলের ব্যবধানে তো নয়ই।’

ম্যাচ শুরুর আট ঘণ্টা আগে থেকেই মারাকানায় দর্শকের ভিড়ে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। স্টেডিয়ামটির নির্মাণকাজ তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রায় ১ লাখ ৯৯ হাজার জনের মধ্যে উরুগুয়ের সমর্থক ছিল একশ’রও কম! টানেল দিয়ে ভ্যারেলা তার দল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করতেই বজ্রনিনাদে ফেটে পড়ে সমর্থকরা। অধিনায়ক তার সেনানীদের ভরসা দিয়ে বলেন, ‘ভেবো না, গ্যালারির কেউ খেলবে না।’

বাঁধভাঙা আবেগ আর আয়োজনের পসরায় ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া ম্যাচটি শুরু হয় কাঁটায় কাঁটায় বিকেল ৩টায়।



দুর্দান্ত খেলেও প্রথমার্ধ গোলশূন্য ছিল ব্রাজিল। কিন্তু বিরতির পর ফ্রিয়াকার গোলে আগাম উৎসবের কাজটা সেরে ফেলে তারা। এরপর শিফিয়ানো গোল করে সমতায় ফেরান উরুগুয়েকে। খেলা শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে ডান দিকে বল পেয়ে যান উরুগুয়ের উইঙ্গার আলদাইস ঘিগিয়া। ব্রাজিলের লেফটব্যাক বিগোদাকে কাটালেন। সবাই ভেবেছিল, ঘিগিয়া পাস দেবেন। আন্দাজ করতে পেরে পজিশন থেকে একটু সরে যান ব্রাজিল গোলরক মোয়াকরি বারবোসা। এই ভুলটাই তার বাকি জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফাঁকা জায়গা পেয়ে শট নেন ঘিগিয়া। গোল!

সবাই বলে, নৈঃশব্দের কোনো আওয়াজ নেই। ঘিগিয়া শুনেছিলেন তার উল্টোটা ! মুখর মারাকানা একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছিল। ঘিঘিয়ার ভাষায়, ‘অসাধারণ,শ্বাসরুদ্ধকর, নীরবতা।’জাল থেকে বল কুড়িয়ে নিয়ে বারবোসা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আকাশে। হয়তো ভাবছিলেন, ‘ঈশ্বর কেন এত নিষ্ঠুর?’ তখন ঘুর্ণাক্ষরেও জানতেন না, জীবনের বাকি দিনগুলো শুধু এ প্রশ্নটাই তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে।

শেষ বাঁশি বাজার পর হার সহ্য করতে না পেরে অনেকেই লাফিয়ে পড়েছিল মারকানার ছাদ থেকে। কেউ কেউ আত্নহত্যাও করে বসে! সব প্রতিকূলতার বিপক্ষে উরুগুয়ের এ জয়টা ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে জ্বলছে চিরস্থায়ী চুল্লির মতো, যার আরেক নাম ‘মারাকানাজ্জো’।

(মোয়াকির বারবোসা) (আলদাইস ঘিঘিয়া)

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উৎসব পালন করতে পরদিন সরকারি ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গুমোট, এক অসহ্য নীরবতায় ঢাকা পড়ে গোটা ব্রাজিল। মারাকানা স্টেডিয়াম যার নামে প্রস্তুত, সাংবাদিক মারিও ফিলহো (পেশায় সাংবাদিক) তার কলামে লিখেছিলেন, ‘শহরের প্রতিটি ঘরের জানালা বন্ধ ছিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। মনে হচ্ছিল, প্রত্যেক ব্রাজিলিয়ান তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে হারিয়েছে। সব সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নির্মম বেদনা কেউই সইতে পারেনি। অনেকেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ফুটবলের ইতিহাসে ১৬ জুলাই যেন আর কখনোই ফিরে না আসে।’

উৎসবের মুখরতা থেকে ব্রাজিলিয়ানদের আশ্চর্য পতন ছুঁয়ে যায় ভ্যারেলাকেও। ফাইনালের পর সারা রাত এক পানশালায় কাটিয়ে দেন উরুগুয়ের অধিনায়ক। খুন হয়ে যেতে পারেন, এই ভয়ে তার কোনো সতীর্থই রাস্তায় বের হননি। দেশে ফেরার পর পুরষ্কার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বড়জোর একটা এঁটো ‘ফোর্ড৩১’ মডেলের গাড়ি কিনতে পেরেছিলেন ভ্যারেলা। কিন্তু উরুগুয়ে ফুটবলের কেষ্ট-বিষ্টুরা নিজেদের অলংকৃত করেছিলেন সোনার পদক আর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের প্রাচুর্যে। অথচ শেষ জীবনে ভ্যারেলাকে ভুগতে হয়েছে চরম দারিদ্রে। বেঁচে থাকতে তার দায়িত্ব কেউ না নিলেও শেষকৃত্যের খরচটা ঠিকই দিয়েছিল উরুগুয়ে সরকার।

বারবোসাকে ভোগ করতে হয়েছে এর থেকেও কঠিন সাজা !

পানশালায় তাকে দেখে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠত। কেউ কথা বলত না। কানে যা উড়ে আসত তা এরকম ‘দেখো, দেখো ওই লোকটাই আমাদের কাঁদিয়েছিল।’ ১৯৯৩ সালে এক টিভি সাাৎকারে বারবোসা বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলে সর্বোচ্চ অপরাধের শাস্তি ৩০ বছর। আমার ক্ষেত্রে ১৩ বছর বেশি হয়ে গেছে। সবাই আমার প্রতি যে আচরণ করে নিজেকে সংযত রাখতে না পারলে, এতদিনে আমার ঠিকানা হতো জেল কিংবা সমাধিক্ষেত্র।’

ব্রাজিলিয়ান লেখক নেলসন রদ্রিগুয়েজের ভাষায়, ‘ব্রাজিলিয়ানরা হলুদ জ্বর, বাধ্যতামূলক টিকা, পিনেইরো মাচেদো হত্যা ভুলে গেছে, কিন্তু বারবোসার ভুলটা চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে তাদের হৃদয়ে।’

ওই ম্যাচের পর ব্রাজিল আর কখনোই সাদা জার্সি পড়ে মাঠে নামেনি। আর, মৃত্যুর সাত বছর আগে ঈশ্বর একবারই সদয় হয়েছিলেন বারবোসার প্রতি। ১৯৯৩ সালে ব্রাজিল জাতীয় দলের ক্যাম্পে শুভেচ্ছাসূচক বক্তব্য প্রদানের জন্য বারবোসাকে ডেকে আনেন তৎকালীন সহকারী কোচ মারিও জাগালো। অভিশপ্ত হওয়ায় রোমারিওদের কাছ থেকে অতটা সমাদর পাননি ঠিকই; কিন্তু পরের বছর ওই দলটাই তো জিতে নিল বিশ্বকাপ !





(লেখাটা বেশ আগে ব্লগে দিয়েছিলাম। কিন্তু দৈনিক সমকাল এর বিশেষ সংখ্যা ‌'গোল' এ প্রকাশ হওয়ায় কিছুদিনের লেখাটা জন্য ড্রাফটে নিতে হয়। অতঃপর তা ফিরে গেল নিজের জায়গায়...)



(ছবি ঃ ইন্টারনেট)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ৩:৪৪

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


এমন একটা পোস্ট এতদিন লুকিয়ে রেখে কাজটা ঠিক করেন নি।

০৩ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৪

নাছির84 বলেছেন: দুঃখিত ভাই। সবার আগে ব্লগেই পোষ্ট করেছিলাম। কিন্তু সমকালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত পো্ষ্টটা তুলে নিতে বাধ্য হই। ওখানে প্রকাশ হওয়ার পর যেখানকার জিনিষ সেখানে ফেরৎ দিয়ে দিলাম :P
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।

২| ০৩ রা জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৪৬

সুমন কর বলেছেন: গ্রেট পোস্ট। অনেক কিছু জানতে পারলাম।

০৩ রা জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৫

নাছির84 বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.