নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেলতেপড়তেদেখতেশুনতেগুনতে ভালোবাসি

নাছির84

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র

নাছির84 › বিস্তারিত পোস্টঃ

‌'নগ্ন যুবতী'দের দেশে ফুটবলের হাসি-কান্না

০৩ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ৯:৫৮

অস্কার ওয়াইল্ড ছিলেন নান্দনিকতার পূজারী। তাই বলেছিলেন, ‘জীবনের কেন্দ্রে শিল্প নয়, বরং শিল্পের কেন্দ্রেই জীবন।’

ভিক্টোরিয়ান যুগের এ কিংবদন্তি আইরিশ লেখকটি তার জীবদ্দশায় কখনও ব্রাজিলে যাননি। গিয়ে থাকলে বলতেন ‘এখানে শিল্প নয়, জীবনের কেন্দ্রে থাকে ফুটবল !’



আগেই বলেছিলাম, ব্রাজিলে বল কখনোই থামে না। তুলতুলে ঘাসের গালিচা থেকে অমসৃণ রাস্তা, এমনকি বালুকাময় কোপাকাবানা সুমদ্রসৈকতেও চোখে পড়বে ফুটবল খেলার মেলা । গ্রিক এবং রোমানদের মস্তিস্ক প্রসূত এ খেলাটিকে ব্রাজিলিয়ানদের মতো প্রতিদিনের আটপৌরে জীবনের রোজনামচায় অপরিহার্য জায়গা করে দিতে পারেনি পৃথিবীর আর কোনো দেশই। ফুটবলরসিকরা তাই কৌতুক করে বলে থাকেন ‘এজন্য সব দোষ চার্লস মিলারের।’

জাতিতে স্কটিশ মিলারের জন্ম সাও পাওলোতে। ১৮৮৪ সালে লেখাপড়ার জন্য মিলারকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন তার বাবা-মা। দশ বছর সেখানে থাকার পর ব্রাজিলে ফেরার সময় শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাকেই সঙ্গে করে আনেননি, কয়েকটি ফুটবল এবং খেলাটির কিছু নিয়মকানুনও টুকে এনেছিলেন সাও পাওলো রেলওয়ে কোম্পানির এ ইঞ্জিনিয়ার। বাকিটা ইতিহাস।

আমের আঁটি ভেঙে শাঁস খাওয়ার মতোই এক ফুটবলেরই কয়েক পদ সৃষ্টি করেছে ব্রাজিলিয়ানরা। রসিকতার কথা হলো, ব্রাজিলের ‘ফ্যাভেলা’গুলোর (বস্তি) গলি-ঘুপচি থেকে রিও ডি জেনিরোর পাঁচতারা হোটেলের সামনের রাস্তা পর্যন্ত বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলাটা অতটা চোখে পড়বে না, যতটা নজর কাড়বে ‘পেলাডা’!

ব্রাজিলিয়ানদের কাছে শব্দটার আভিধানিক অর্থ ‘নগ্ন যুবতী’। সামান্য এক টুকরো জায়গায় সেটা আবার খাঁচা দিয়েও ঘেরা থাকতে পারে, তার মধ্যে কয়েকজন মিলে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠার নামই পেলাডা। সময়ের গাছ-পাথর নেই, সাক্ষাৎ রাত্রি দ্বিপ্রহর কিংবা খাঁ খাঁ দুপুরেও জমে ওঠে খেলাটি। যে দল আগে গোল করবে তারাই জয়ী। তৃণমুল ব্রাজিলিয়ানদের কাছে পেলাডার আবেদন কতখানি নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ফ্লামেঙ্গোর এক দারোয়ান অগাস্তো কুইন্তেল দ্য লিমা, ‘বেঁচে থাকার জন্য ব্রাজিলিয়ানদের প্রয়োজন শুধু পেলাডা এবং নারী।’

টোষ্টাও কিন্তু নারীকে এড়িয়ে গেছেন। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল হিসেবে বিবেচিত ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ‘সেলেকাও’দের এ সদস্য মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফুটবল আমাদের সমাজকে প্রতিফলিত করে। তবে ব্রাজিলে এ খেলাটির রং ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে।’

গ্রেটরা স্বাভাবিকভাবেই দূরদর্শী হয়ে থাকেন। ব্রাজিলে প্রতি বছর খুনের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের পর থেকে ফুটবল সর্ম্পকিত খুনের সংখ্যা বছরে গড়ে আড়াইশ’রও বেশি ! এজন্য আঞ্চলিক বৈষম্য অনেকাংশে দায়ী। ব্র্রাজিলের দক্ষিনাঞ্চলের মানুষদের বলা হয় ‘সুল’ অথবা ‘সুদেস্তে’। উত্তরে বসবাসকারীদের নাম ‘নর্দে’ কিংবা ‘নর্দেস্তে’। এ দুটি অঞ্চলের মধ্যে দক্ষিণের বিত্তবৈভব এবং দাপট বেশি হওয়ায় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ব্রাজিলিয়ান লীগ জিততে পারেনি উত্তরের কোনো দলই!



কিন্তু ভেতরের চিত্রটা যাই হোক না কেন, বাইরের দুনিয়ায় ফুটবল মানেই ব্রাজিল সবসময় কিছু প্রমাণ করতে চায়। ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪, ২০০২-এ সালগুলোই তার প্রমাণ। ওই সব আসরে ফুটবলকে একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে সেলেকাওরা। ঠিক যেভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের ভাবকে প্রকাশ করে থাকেন কবি-সাহিত্যিকরা। আর তাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে ‘ব্যক্তিদক্ষতার’র প্রভাব অনেক বেশি। ইউরোপের ছকে বাঁধা ফুটবলের ঠিক উল্টোটা। লাতিন এবং ইউরোপিয়ান এ দ্বন্দের ব্যাখ্যা করেছেন ব্রাজিলিয়ান লেখক লিওনেল ক্যাজ, ‘...শুধু ফুটবলেই ব্রাজিলিয়ানরা বাকি বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছে, তারাই খেলাটির সত্যিকারের পূজারী। এটাই একমাত্র আর্ন্তজাতিক যুদ্ধ, যেখানে অংশগ্রহণের পর থেকে তারা কখনও হারেনি।’

দেশের সীমানার ভেতর সাদা-কালোর বৈষম্য নিপাতের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে ফুটবল। ব্রাজিলের প্রথম সুপারষ্টার কৃঞ্চাঙ্গ ফুটবলার ছিলেন আর্থার ফ্রেডেনরিখ, তারপর এলেন ডমিনোস দ্য গুইয়া এবং সবশেষে এডসন অরান্তেস দো নাসিমেন্তো ওরফে ‘পেলে’। ২০০৮ সালে ব্রাজিলের ফুটবল জাদুঘর উদ্ধোধনের সময় দেশটির খ্যাতনামা সাংবাদিক হোসে রবার্তো মারিনহো এই তিন ‘কালোমানিকে’র অবদানকে স্বীকার করে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয়ানক বর্ণবৈষম্যের মধ্যেও ফ্রেডেনরিখ, ডমিনোস দ্য গুইয়া এবং পেলের মতো জাতীয় বীরেরা খেলাটিকে এমন এক উচ্চতায় স্থাপন করেছে যেখানে ফুটবল শুধু সাদা চামড়া, ব্রিটিশ কিংবা অভিজাতদের একান্ত সম্পত্তি নয়; বরং সবার আবেগ প্রকাশের পীঠস্থান।’

ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবলপ্রীতির নেপথ্যে রয়েছে তৃণমহৃল পর্যায়ের চরম দারিদ্রতা। টোষ্টাও একবার বলেছিলেন, ‘দারিদ্র্যতা থেকে ব্রাজিল কখনোই মুক্তি পায়নি। তাই হাজারো শিশু ভালো স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে বেছে নেয় ফুটবলকে। কারণ গরিবদের জন্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্যকিছু হওয়ার চেয়ে ভালো ফুটবলার হওয়া অনেক সহজ। যদিও বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাদের অনেকেই ঝড়ে পড়ে। এ তাড়নাটাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের দক্ষতাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। সে কারণে রোমারিও, রোনালদো কিংবা নেইমারদের উঠে আসা স্রেফ অনিবার্য ব্যাপার।’

অনেকে বলে থাকেন, ফুটবলই ভিত গড়ে দিয়েছে আধুনিক ব্রাজিলের। রেসিফের পেরনাম্বুচো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির প্রফেসর সিলভিও ফেরেইরার মতে, ‘ক্রীতদাস প্রথা সাংবিধানিকভাবে বিলোপের পর পরই ফুটবলের আবির্ভাব ঘটে ব্রাজিলে। তখন সামাজিক সংস্কার সম্ভব হয়েছে শুধু এ খেলাটির মাধ্যমে। বাঙ্গু, সান্তাক্রুজ, ভাস্কো দা গামার মতো ক্লাবে সুযোগ ঘটে অসংখ্য কৃঞ্চাঙ্গ ফুটবলারের। আসলে আধুনিক ব্রাজিলের সৃষ্টিই এ ফুটবলে। কারণ তখন জাতিগত এবং সামাজিক বৈষম্যকে ভুলিয়ে শুধু এ খেলাটিই পেরেছে সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষকে একসুত্রে গেঁথে রাখতে।’

কিন্তু সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে ফুটবলের প্রতি ব্রাজিলিয়ানদের আবেগও পাল্টেছে। দেশটির অনেক কিশোর ফুটবলারই এখন তাদের ডাকনাম রাখে ইউরোপিয়ান ষ্টাইলে। বিশ্বায়ন তাঁবু গেঁড়ে বসার পর থেকেই ব্রাজিলিয়ানদের ‘জোগো বনিতো’ (সুন্দর ফুটবল) তার খোলস পাল্টে ফেলেছে। এখন ওয়ান টাচ ফুটবলের বদলে জোনাল মার্কিংই কোচদের প্রিয় রেসিপি। গ্লোবো স্পোর্তে প্রকাশিত এক কলামে টোষ্টাও ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘বিশ্বায়ন এবং ক্রীড়া বিজ্ঞানে অবাধ উন্নতি সাধিত হওয়ায় ব্রাজিলিয়ানরা এখন উভয় সংকটে পড়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছে না, কোনটা গ্রহণ করা উচিত ইউরোপের ছক নাকি ব্যক্তিদক্ষতা কেন্দ্রিক উদ্ভাবনী ফুটবল।’

টোষ্টাওয়ের মন্তব্যটি বিগত এক যুগ ধরে ব্রাজিলের জাতীয় দলের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু ‘পেলাডা’ তো এখনও টিকে আছে ব্রাজিলের রাস্তাঘাট থেকে আলিশান বাড়ির উঠোনে ? আর গত বছরও ইউরোপের মোট ৪৭৮টি লীগে মোট ৫১৫ জন ফুটবলার রফতানি করেছে ব্রাজিল। তাই সময় যে পথই বেছে নিক না কেন, ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবলপ্রীতি এখনো দিনের আলোর মতোই সত্য!











(লেখাটা বেশ আগে ব্লগে দিয়েছিলাম। কিন্তু দৈনিক সমকাল এর বিশেষ সংখ্যা ‌'গোল' এ প্রকাশ হওয়ায় কিছুদিনের লেখাটা জন্য ড্রাফটে নিতে হয়। অতঃপর তা ফিরে গেল নিজের জায়গায়...)



(ছবি ঃ ইন্টারনেট)










মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.