নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৭)

০৮ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:৫৩

পেছনের পর্বগুলো-

বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৬)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব৭)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৮)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৯)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১০)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৬)



বিস্তীর্ন সুবিশাল বদর প্রান্তর

মদিনা মুনাওওয়ারায় যে ক'টা দিন ছিলাম সাধ্যমত চেষ্টা করেছি প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থানগুলো সচক্ষে দেখে দেখে হৃদয় মন জুড়িয়ে নিতে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ জাল্লা শানুহূর দরবারে সিজদাবনত শুকরিয়া, অধম বান্দাকে তিনি মনের ইচ্ছাগুলো পূরনের অভাবিত তাওফিক ইনায়েত করেছেন। সুস্থতার নেআমত দিয়ে ধন্য করেছেন। যেখানে যাওয়ার প্রত্যাশা করেছি, তিনি অকল্পনীয়ভাবে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁর কুদরত বুঝে, সাধ্য কার? তাঁর সীমাহীন দয়ার সাগরে যেন হাবুডুবু খেয়ে কেটে গেছে প্রিয় সেই সময়গুলো। প্রিয়তমের রওজা মোবারকের পাশে, সবুজ গম্বুজের নীচে দুই সাথীকে নিয়ে শুয়ে থাকা জগতের শ্রেষ্ঠতম মহামানবের শিয়রের কাছে যখনই সময় পেয়েছি, ছুটে গেছি। সে এক অবর্ননীয় পরিতৃপ্তি! রওজা শরীফের চৌকাঠ ধরে দাড়ালে, ওখানের মায়াময় স্নিগ্ধতায় ডুব দিলে মন প্রান সিক্ত শীতল প্রশান্ত হয়! আহ, কিশোর বেলায় কি অসীম দরদ নিয়ে গাইতাম হৃদয়ছোঁয়া না'ত আর গজল! প্রানে কি অদ্ভূত টান ছিল তখন! কি অদেখা বন্ধন মদিনার সাথে মনপ্রানকে বেধে রাখতো সারাক্ষন! মদিনাওয়ালার পরশ পেতে, তাঁর সুরভী সৌরভ সুবাসে বিমোহিত হতে মন কি পাগলপারা হত! আহ, ছোট বেলার গাওয়া গজলের সেই কলিগুলো কতই না প্রিয় ছিল! আজও গুনগুনিয়ে যখনই গেয়ে উঠি মনের অজান্তে হৃদয় আপ্লুত হয়! অন্তর মন আবেগে ভিজে ওঠে! চোখের কোন্ বেয়ে অশ্রুরা ছুটে আসে অবলীলায়-

মন যে আমার টেকে না কো এদেশেতে হায় রে।
প্রিয় নবী লওগো ডাকি সোনার মদিনায় রে, সোনার মদিনায়।

যাইতে যদি পারতাম হেথা,
জুড়াইতো মনের ব্যাথা,
পাক মদিনার মাটি পেলে মাখতাম সারা গায়রে, মাখতাম সারা গায়। ঐ

রওজা পাকের চৌকাঠ ধরি,
চুমু খেয়ে থাকতাম পরি,
বলতাম যদি না দাও দেখা মরিব হেথায় রে, মরিব হেথায়। ঐ

বলতাম আরও বিনয় করে,
সেই ভয়ানক রোজ হাশরে,
উম্মত বলে কদমে ঠাঁই দিওগো আমায় রে, দিওগো আমায়। ঐ

ইতিপূর্বে মদিনাতুল মুনাওওয়ারাহর উপকন্ঠের উহুদ প্রান্তর নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছিলাম। আজ চলুন, ঘুরে আসি ঐতিহাসিক বদরের ময়দান থেকে। যে প্রিয় ময়দান সম্পূর্ন অচেনা-অজানা, অখ্যাত-অবিদিত ইসলাম এবং মুসলমানদের পরিচিতি মেলে ধরেছিল আরবে-আজমে-সমগ্র বিশ্বময়। নতুন একটি জাতির উঠে আসার প্রভাত বেলাতেই - যাত্রার প্রাক্কালেই - তাদের অপরিমেয় শৌর্য্য-বীর্য্য আর তেজে দেদীপ্যমান সোনালী দিনের ভিত্তি রচনা করে দিয়েছিল পৃথিবীর বুকে প্রিয় এই বদর।

মদিনা থেকে বদর

মক্কাতুল মুকাররমাহ থেকে বদর প্রান্তরের দূরত্ব প্রায় ৩২৪.২ কি: মি:। পক্ষান্তরে মদীনাতুল মুনাওওয়ারাহ থেকে বদর মাত্র ১২০ কি: মি: দূরে অবস্থিত। যারা বলেন, মুসলমানরা যুদ্ধংদেহী জাতি তাদের জন্য এই দূরত্বটা খুবই গুরুত্ববহ। তাদের জেগে ঘুমানোর কারনে তারা বাস্তবতাকে দূরে সরিয়ে রেখে ঢালাও দোষারোপ মুসলমানদের করতে চাইলেও প্রকৃতপক্ষে হামলাকারী বা আক্রমনকারী যে মুসলমানগন কোনো একটি যুদ্ধেও ছিলেন না, তার প্রমানে ইতিহাস সমৃদ্ধ। বদরের যুদ্ধের আলোচনাতেও সে কথাটি আরেকবার প্রমান হয়ে যায়।

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারী মুসলমানদের মক্কায় রেখে যাওয়া সহায় সম্পদ, জমি জমা, ব্যবসা বানিজ্য সকলকিছু পাইকারীভাবে মক্কাবাসী অবিশ্বাসীগন কর্তৃক তছরুফ ও লুটপাটের কারনে মদিনায় আগত মুসলমান নিতান্ত কষ্টে শিষ্টে তাদের জীবনধারন করে চলছিলেন। এমতাবস্থায় তাদের যুদ্ধ করার আদৌ কোনো চিন্তা নয়, একমাত্র টার্গেট ছিল মক্কার বানিজ্য কাফেলাকে আক্রমন করে তাদের মাল সামান ছিনিয়ে নেয়া। কিন্তু দাম্ভিক কুরাইশগন অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের পোষাকে, যুদ্ধের সরঞ্জামাদির সর্বোচ্চ ব্যবহারে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে ৩২৪.২ কি: মি: পথ পাড়ি দিয়ে মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য যখন বলতে গেলে মদিনার নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। এমনকি মাত্র ১২০ কি: মি: দূরবর্তী মদিনা এবং মদিনার মুসলমানগনকে আক্রমন করতে উদ্ধতভাবে এগিয়ে আসে, তখন স্বভাবতই মদিনাবাসী মুসলমানদের দায়িত্ব হয়ে যায়, তাদের শহর ও তার অধিবাসীদের রক্ষা করার জন্য অস্ত্র হাতে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া। তারা শুধু সেই দায়িত্বটুকুই পালন করেছিলেন বদরের মাঠে। আর সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঈমানী বলে বলিয়ান মুসলমানগন যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা কর্তৃক প্রেরিত মালাইক দলের প্রত্যক্ষ মদদ লাভ করে বিজয়ীর ঝান্ডা হাতে ধারন করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন, আর তাদের এই প্রত্যাবর্তন দেখে যাদের গাত্রদাহ হয়, তারা আর যা ই হোন, ন্যায়বিচারের প্রশ্নে তাদের দুর্বলতা ঢাকতে পারেন না কোনো কালে, কোনোভাবেই।

বদর যুদ্ধ

ইসলামের স্মরণীয় যুদ্ধগুলোর মধ্যে বদর অন্যতম। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা মুসলমানদের কাছে পরবর্তীকালে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিলেন। এ কারণেই যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সাক্ষী উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পক্ষগুলো নিজ নিজ দাবির যথার্থতা বুঝাতে কতজন বদরী সাহাবী তাদের সঙ্গে রয়েছেন তার উল্লেখ পর্যন্ত করতেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জীবনীতে বদরে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ‘ বদরী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

বদর অভিযান : মুহাজিরদের ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা

দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ মদিনা মুনাওয়ারা থেকে ৮০ মাইল বা ১২০ কি: মি: দূরে ঐতিহাসিক বদর নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের প্রথম সমর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল মুসলিম বাহিনীর আনসার ও মুহাজিরদের জন্য ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় অর্জন করা ছিল অন্যান্য সব যুদ্ধের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের প্রথম সশস্ত্র অভিযান ছিল এই বদর যুদ্ধ। মূলত: মদিনার নতুন রাষ্ট্র ও ইসলামকে হেফাজত করার মানসে কুরাইশদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়েই এ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

এ অভিযানে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন স্বয়ং প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর চাচা হজরত হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, হযরত আবু বকর এবং হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমগনসহ অনেক বিখ্যাত সাহাবী ছিলেন এ যুদ্ধের অগ্রসেনানী।



বদরের মাঠের দৃশ্য

আর কুরাইশদের মুশরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় আবু জাহল (আমর ইবনে হিশাম) এবং আবু সুফিয়ান।

নব গঠিত মদীনা রাষ্ট্রের জন্য বদর যুদ্ধে জয়লাভের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অনেক বেশি। কারণ, নতুন রাষ্ট্র মদীনার জনবল, যুদ্ধের সরঞ্জাম তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে।

এ যুদ্ধে সল্পসংখ্যক; নিরস্ত্র, দুর্বল মাত্র ৩১৩ জন রোজাদার মুসলমান মক্কার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত ১ হাজার অবিশ্বাসী যোদ্ধার মোকাবেলায় অভূতপূর্ব এবং অভাবনীয় বিজয় অর্জন করে। আল্লাহ তাআলা এ যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে বলেন-

قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُم مِّثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَن يَشَاء إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لَّأُوْلِي الأَبْصَارِ

‘নিশ্চয়ই দু’টি দলের মোকাবিলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে। আর অপর দল ছিল কাফেরদের। এরা স্বচক্ষে তাদেরকে দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ যাকে নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। এরই মধ্যে শিক্ষনীয় রয়েছে দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য।'' (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৩)

বদর যুদ্ধ সদ্য মুসলিম হওয়া মুহাজিরদের জন্য ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা ছিল। কারণ, সদ্য ছেড়ে আসা তাদের আপন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে ছিল এ যুদ্ধ।

রক্তের বন্ধনও তাদেরকে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে বাধা দিতে পারেনি। আল্লাহ তাআ'লার সাহায্য লাভের মাধ্যমে অবিশ্বাসী পরাশক্তির মোকাবেলায় তাঁরা জয় লাভ করেছিলেন।

এ সকল মুহাজির নিজের আত্মীয়-স্বজনদের পরিহার করে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকেই বেশি ভালোবেসেছিলেন। যার প্রমাণও তারা দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে অনুষ্ঠিত ‍যুদ্ধের ময়দানে।

হিজরি দ্বিতীয় সালের রমজানের মাসের রোজাদার মুজাহিদদেরকে ইসলামের প্রথম যুদ্ধে আল্লাহ তাআ'লা বিজয় দান করেন।

যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার শুরুতেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবাসী আক্রমনকারীদের উদ্দেশ্য করে ‘শাহাতিল ওঝুহ’ বলে তাদের দিকে বালু নিক্ষেপ করেন। বদর যুদ্ধের বিজয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَـكِنَّ اللّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللّهَ رَمَى وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلاء حَسَناً إِنَّ اللّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

''সুতরাং তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর আপনি মাটির মুষ্ঠি নিক্ষেপ করনি, যখন তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ; যেন ঈমানদারদের প্রতি ইহসান করতে পারেন যথার্থভাবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী; পরিজ্ঞাত।'' (সুরা আনফাল : আয়াত ১৭)

এ যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৭০ জন সেনা নিহত হয় এবং সমান সংখ্যক লোক বন্দি হয়। আর মুসলমানদের পক্ষে মাত্র ৬ জন আনসার এবং ৮ জন মুহাজিরসহ ১৪ জন শাহাদাত বরণ করেন।

যুদ্ধের পটভূমি:

দ্বিতীয় হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি মদীনায় খবর পৌঁছায় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কা থেকে সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা যাত্রা করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাফেলাকে ধরার জন্য জাতুল উশাইরা পর্যন্ত গমন করেন ও পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেন। কিন্তু ঐ কাফেলার সন্ধান পান নি। কাফেলাটি প্রত্যাবর্তনের সময় শরতের প্রথম দিক নির্দিষ্ট ছিল। কারণ সাধারণত এ সময়েই সিরিয়া থেকে মক্কায় কাফেলাসমূহ ফিরে আসে। যে কোন যুদ্ধে তথ্য হলো জয়ের প্রথম পদক্ষেপ। যদি যুদ্ধের সেনাপতি শত্রুর ক্ষমতা, অবস্থান ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানে তবে যুদ্ধের প্রথমেই পরাস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

ইসলামের নবীর যুদ্ধকৌশলের প্রশংসিত ও লক্ষণীয় একটি দিক হলো- যার প্রমাণ প্রতিটি যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ থেকে আমরা পাই- শত্রুর অবস্থান ও প্রস্তুতি সম্পর্কে অগ্রিম তথ্য সংগ্রহ। তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি বৃহৎ ও ক্ষুদ্র সকল যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লামা মাজলিসীর৪৫১ বর্ণনা মতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদী নামের এক সাহাবীকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন।‘হায়াতে মুহাম্মদ’ এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ অনুযায়ী মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ কাফেলার যাত্রাপথ, প্রহরীর সংখ্যা ও আনীত পণ্যের ধরন সম্পর্কে জানার জন্য তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ ও সাঈদ ইবনে যাইদকে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁদের সংগৃহীত তথ্য নিম্নরূপ ছিল :

১. কাফেলাটি বেশ বড় এবং মক্কার সব গোত্রের লোকই তাতে রয়েছে।
২. কাফেলার নেতৃত্বে রয়েছে আবু সুফিয়ান এবং ৪০ জন প্রহরী ও রক্ষী তাদের সঙ্গে রয়েছে।
৩. এক হাজার উট মাল বহন করে নিয়ে আসছে যার মূল্য পঞ্চাশ হাজার দিনারের সমপরিমাণ।

যেহেতু মদীনার মুহাজির মুসলমানদের বিপুল সম্পদ মক্কার কুরাইশদের হাতে অবরুদ্ধ (ক্রোক) হয়েছিল সেহেতু মুসলমানদের জন্য কুরাইশদের বাণিজ্য পণ্য অবরোধের প্রয়োজন ছিল বটে। যদি কুরাইশরা মুসলমানদের সম্পদ অবরোধ অব্যাহত রাখে তবে মুসলমানরাও স্বাভাবিকভাবে কুরাইশদের বাণিজ্য পণ্য অবরোধ করে গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে। এ লক্ষ্য নিয়েই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

هذا غير قريش فيها أموالهم فاخرجوا إليها لعل الله يغنمكموها

“ হে লোকসকল! কুরাইশ কাফেলা নিকটেই। তাদের সম্পদ হাতে পেতে মদীনা থেকে বেরিয়ে যাও। এতে তোমাদের অর্থনৈতিক অসুবিধা দূর হবে।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনার মসজিদে ইমামতির এবং আবু লাবাবাকে মদীনার সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করে দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসের ৮ তারিখে তিনশ’ তের জন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে কুরাইশদের সম্পদ আটক করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হলেন।

যাফরান নামক স্থানের দিকে মহানবীর যাত্রা

সংবাদদাতাদের প্রেরিত বার্তা পেয়ে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরী বর্ষের দ্বিতীয় সালের রমজান মাসের আট তারিখ সোমবার মদীনা থেকে বেরিয়ে কুরাইশ কাফেলার উদ্দেশ্যে যাফরানের দিকে যাত্রা করেন। তিনি আলী ইবনে আবি তালিব ও মুসআবের হাতে পৃথক দু’ টি পতাকা প্রদান করেন। প্রেরিত সেনাদলে বিরাশি জন মুহাজির, খাজরাজ গোত্রের একশ’ সতের জন এবং একষট্টি জন আওস গোত্রের লোক ছিলেন। সেনাদলে মাত্র তিনটি ঘোড়া ও সত্তরটি উট ছিল।

ইসলামের সে যুগে মুসলিম সমাজে আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা এতটা তীব্র ছিল যে, অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকও সে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিল; কিন্তু প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে মদীনায় ফিরিয়ে দেন।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কথা হতে আগেই বোঝা গিয়েছিল, এ অভিযান মুসলমানদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুযোগ এনে দেবে। কুরাইশরা যেসব সম্পদ মক্কায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল তা-ই মুসলমানদের আশার উপকরণ ছিল। মুসলমানরা তা কব্জা করার উদ্দেশ্যেই মদীনা থেকে বের হয়েছিল।

গুরুত্বপূর্ন একটি প্রশ্নের উত্তর:

এ কাজের বৈধতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কুরাইশরা মক্কায় মুসলমানদের সমগ্র সম্পদ ক্রোক করেছিল এবং তাদের মক্কায় যাতায়াতের পথ রুদ্ধ করেছিল। ফলে তারা তাদের জীবন নির্বাহের উপকরণ হতে বঞ্চিত ছিল। একথা অতিব স্পষ্ট যে, যে কোন জ্ঞানসম্পন্ন মানুষই বলবেন শত্রুর সঙ্গে সেরূপ আচরণই করা উচিত যেরূপ আচরণ সে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে করেছে।

প্রকৃতপক্ষে কুরাইশদের কাফেলাগুলোর ওপর মুসলমানদের আক্রমণের কারণ মুসলমানদের প্রতি তাদের নির্যাতনমূলক আচরণ, যা কুরআনুল কারীমেও উল্লেখিত হয়েছে এবং মুসলমানদের এ আক্রমণের অনুমতিও প্রদান করা হয়েছে তাতে। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন :

أذن للّذين يُقاتلون بأنّهم ظُلموا و أنّ الله على نصرهم لقدير

“ যাদের প্রতি আক্রমণ করা হয়েছে তাদের প্রতিরোধের অনুমতি দেয়া হলো। কারণ তারা নির্যাতিত হয়েছে এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান।” সূরাহ আল হাজ্জ্ব, আয়াত-৩৯



বদরের মাঠের বর্তমান দৃশ্য

মক্কায় যুদ্ধের বার্তা

আবু সুফিয়ান সিরিয়ার দিকে যাত্রার পূর্বেই জেনেছিল যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাফেলাকে পশ্চাদ্ধাবন করতে পারেন। এ কারণেই সে প্রত্যাবর্তনের পথে সতর্কতা অবলম্বনের লক্ষ্যে যে কাফেলারই মুখোমুখি হতো প্রশ্ন করত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেলার পথ রুদ্ধ করে রেখেছেন কি না? যখন তার কাছে বার্তা পৌঁছল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে মদীনা হতে বেরিয়ে এসেছেন ও কুরাইশ কাফেলার পশ্চাদ্ধাবনের মনোবৃত্তিতে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী যাফরানে ছাউনী ফেলেছেন তখন সে কাফেলা নিয়ে অগ্রসর হতে নিবৃত্ত হয়ে কুরাইশদের এ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করাকে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করল। সে দামদাম (জামজাম) ইবনে আমর গিফারী নামক এক দ্রুতগামী উটচালককে ভাড়া করে নির্দেশ দিল মক্কায় পৌঁছে মক্কার সাহসী কুরাইশ বীরদের ও কাফেলার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক রয়েছে তাদের জানাও তারা যেন মুসলমানদের হাত থেকে কুরাইশ কাফেলাকে বাঁচাতে মক্কা থেকে এখানে এসে পৌঁছায়।

মক্কাবাসীদের যুদ্ধযাত্রা

দামদাম দ্রুত মক্কায় পৌঁছে আবু সুফিয়ানের নির্দেশ অনুযায়ী নিজ উষ্ট্রের কান কেটে ও নাক ছিদ্র করে, তার পিঠে বসবার স্থানটি বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে অগ্র ও পশ্চাৎ ছিন্ন করে বলল,“ হে মক্কার অধিবাসিগণ! তোমাদের বাণিজ্য পণ্য বহনকারী উটগুলো আক্রান্ত হয়েছে। মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা তোমাদের পণ্য লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। তোমাদের পণ্য তোমাদের হাতে পৌঁছবে বলে মনে হয় না, দ্রুত কুরাইশ কাফেলার সাহায্যে এগিয়ে এস।”

উষ্ট্রের কান ও নাক হতে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। উটের এ করুণ অবস্থাদৃষ্টে এবং দামদামের মর্মস্পর্শী বক্তব্য ও সাহায্যের আহ্বানে মক্কার অধিবাসীদের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠল। সকল যোদ্ধা ও সাহসী পুরুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মক্কা থেকে বের হলো। মক্কার প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু আবু লাহাব এ দলটির সঙ্গে আসেনি, তবে সে আস ইবনে হিশাম নামে এক ব্যক্তিকে তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য চার হাজার দিরহাম দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রাজী করায়।

উমাইয়্যা ইবনে খালাফকে যুদ্ধে যেতে বিশেষ কৌশল

কুরাইশ গোত্রপতিদের মধ্যে উমাইয়্যা ইবনে খালাফ বিশেষ কারণে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছিল না। কারণ সে শুনেছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সে মুসলমানদের হাতে নিহত হবে। কুরাইশ গোত্রপ্রধানরা দেখলো, এরূপ ব্যক্তিত্ব যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তবে নিশ্চিতভাবে তাতে কুরাইশদের ক্ষতি ও মর্যাদাহানি হবে। উমাইয়্যা ইবনে খালাফকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কুরাইশরা দু’ ব্যক্তিকে (যারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বের হচ্ছিল) উমাইয়্যার কাছে পাঠায়। সে যখন কুরাইশদের কাছে বসেছিল তখন এ দু’ ব্যক্তি একটি ট্রেতে সুরমাদানি নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলে,“ হে উমাইয়্যা! যখন তুমি নিজ গোত্র ও ভূমির সম্ভ্রম রক্ষা ও বাণিজ্য পণ্য উদ্ধারের কাজ হতে বিরত থেকে নারীদের মত ঘরের কোণে বসে যুদ্ধ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছ তখন নারীদের মত এ সুরমা চোখে দিয়ে তাদের সঙ্গেই বসে থাক, কুরাইশ বীর যোদ্ধাদের তালিকা হতে নিজের নাম উঠিয়ে নাও।”

এরূপ আক্রমণাত্মক কথা উমাইয়্যাকে এতটা উত্তেজিত করল যে, সে অবচেতনভাবেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে বাণিজ্য পণ্য উদ্ধারের লক্ষ্যে রওয়ানা হলো।

কুরাইশগন যে সমস্যার মুখোমুখি হলো

যাত্রার সময় নির্ধারিত হলো। কুরাইশ গোত্রপ্রধানরা বুঝতে পারল, যাত্রাপথে মুসলমানদের সাথে সাক্ষাতের পূর্বেই বনি বকর গোত্রের মতো কঠিন শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদেরএবং পশ্চাৎ দিক থেকে তারা আক্রমণের শিকার হতে পারেন। কারণ বনি বকরের সঙ্গে কুরাইশদের রক্তের শত্রুতা ছিল। এ ঘটনাটি ইবনে হিশাম তাঁর সিরাত গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বনি বকর গোত্রের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি সুরাকা ইবনে মালিক এ সময় তাদের কাছে এসে নিশ্চয়তা দান করল যে, এমন কিছু ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই এবং কুরাইশরা নিশ্চিত মনে মক্কা হতে বেরিয়ে যেতে পারবে।



ঐতিহাসিক বদর প্রান্তর

গ্লানিকর পশ্চাদপসরন নয়: সিদ্ধান্ত হলো, সর্বশক্তি দিয়ে মুসলমান লড়েই যাবে

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাকে অবরোধ করার লক্ষ্যে মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন এবং যাফরান নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাণিজ্য কাফেলার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে নতুন খবর এসে পৌঁছাল যা ইসলামের সৈনিকদের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাল এবং তাদের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। মহানবীর কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, মক্কাবাসীরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হয়েছে এবং আশেপাশেই অবস্থান গ্রহণ করেছে। মক্কার সব গোত্রই এ সৈন্যদলে অংশগ্রহণ করেছে। মুসলমানদের মহান নেতা দু’পথের মাঝে নিজেকে লক্ষ্য করলেন। একদিকে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা বাণিজ্যপণ্য অবরোধের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন এবং এ কারণে মক্কা থেকে আগত বড় একটি সেনাদলের মুখোমুখি হওয়ার উপযুক্ত প্রস্তুতি তাঁদের ছিল না; লোকবল এবং যুদ্ধাস্ত্র উভয় ক্ষেত্রেই তাঁদের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। অন্যদিকে যে পথে তাঁরা মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন সে পথেই যদি পুনরায় মদীনায় ফিরে যেতেন তবে এতদিন পরিচালিত বিভিন্ন সামরিক মহড়াগুলোর ফলে অর্জিত মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতো। হয়তো এর ফলে শত্রুরা দুঃসাহস দেখিয়ে আরো অগ্রসর হয়ে ইসলামের কেন্দ্র মদীনাতেও আক্রমণ করে বসত। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পশ্চাদপসরণকে উপযুক্ত মনে করলেন না, বরং যেটুকু শক্তি রয়েছে তা নিয়েই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরোধ করাই সমীচীন মনে করলেন।

কোন পথে যাবেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম?

অন্য যে বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় ছিল তা হলো মদীনা থেকে আগত সেনাদলের অধিকাংশই ছিলেন আনসার যুবক। তাঁদের মধ্যে শুধু ৭৪ জন মুহাজির ছিলেন। তদুপরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকাবায় আনসারদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন তা ছিল প্রতিরক্ষামূলক- আক্রমণাত্মক নয়। তাই তাঁরা মদীনার বাইরে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন এমন কোন প্রতিশ্রুতি সেখানে ছিল না। এমন চরম একটি নাজুক মুহূর্তে মুসলিম সেনাদলের সর্বাধিনায়ক কী করলেন? তিনি সামরিক পরামর্শ সভার আহবান ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পেলেন না। আর এভাবেই তিনি সকলের মতামত গ্রহন করে, পরামর্শের ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের চিন্তা করলেন।

সামরিক পরামর্শ সভা

তিনি দাঁড়িয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন,“ এ বিষয়ে তোমাদের মত কি?”

সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু দাঁড়িয়ে উত্তম কথা বললেন। এরপর হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুও দাঁড়িয়ে উত্তম কথা বললেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়কে পর্যায়ক্রমে বসার নির্দেশ দিলেন।

তখন হযরত মিকদাদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন,“ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অন্তর আপনার সঙ্গে। আল্লাহ্ তাআ'লা আপনাকে যা নির্দেশ দিয়েছেন আপনি তারই অনুসরণ করুন। মহান আল্লাহর শপথ! কখনই আমরা আপনাকে সেরূপ কথা বলব না, যেরূপ কথা বনি ইসরাইল হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে বলেছিলেন। যখন হযরত মূসা আলাইহিসসালাম বনি ইসরাইলকে জিহাদের আহবান জানিয়েছিলেন, তখন তারা হযরত মূসাকে বলেছিল : হে মূসা! তুমি ও তোমার প্রভু তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর এবং আমরা এখানেই বসে থাকব। কিন্তু আমরা এর বিপরীতে আপনাকে বলব : আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহের ছায়ায় জিহাদ করুন এবং আমরাও আপনার অনুগত হয়ে আপনার অধীনে যুদ্ধ করব।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথায় অত্যন্ত খুশী হলেন এবং তাঁদের জন্য মহান আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে দোয়া করলেন।

ইবনে হিশাম, মাকরিযী এবং তাবারী তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থসমূহে মহানবীর সামরিক পরামর্শ সভার ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।

তাবারী হযরত আবদুল্লহ্ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, “ বদরের দিন আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল মিকদাদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর অবস্থানে যদি আমি অবস্থান নিতে পারতাম। কারণ, তিনি বিরূপ এক পরিবেশে বলেছিলেন : আমরা কখনই বনি ইসরাইল জাতির মতো আপনাকে (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে) বলব না যে, আপনি ও আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন এবং আমরা এখানে বসে রইলাম। যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর চেহারা ক্রোধে রক্তিম হয়ে গিয়েছিল তখন হযরত মিকদাদ এমন কথা বলেছিলেন যাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল। তাই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল ঐ ইপ্সিত অবস্থানটি যদি আমি অর্জন করতে পারতাম!”

পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত ও আনসার দলপতির মত

যে মতগুলো এতক্ষণ উপস্থাপিত হয়েছে তা ব্যক্তিগত মত হিসাবেই প্রণিধানযোগ্য। মূলত পরামর্শ সভার লক্ষ্য ছিল আনসারদের মত জানা। যতক্ষণ আনসাররা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিবে ততক্ষণ ছোট কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণও কঠিন ছিল বৈকি! এতক্ষণ মতামত দানকারী ব্যক্তিবর্গের সকলেই ছিলেন মুহাজির। এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের মত নেয়ার জন্য তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, “তোমরা তোমাদের মত প্রদান কর।”

সা’দ বিন মায়ায আনসারী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি কি আমাদের মত চাচ্ছেন?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “ হ্যাঁ।”

সা’দ বিন মায়ায রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বললেন, “ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি। আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি আপনার আনীত ধর্ম সত্য। এ বিষয়ে আমরা আপনার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও হয়েছি। তাই আপনি যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, আমরা তারই অনুসরণ করব। সেই আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যদি আপনি সমুদ্রেও প্রবেশ করেন (লোহিত সাগরের দিকে ইশারা করে) তবে আমরাও আপনার পশ্চাতে তাতে প্রবেশ করব। আমাদের এক ব্যক্তিও আপনার অবাধ্য হবে না। আমরা শত্রুর মুখোমুখি হতে কুণ্ঠিত নই। আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে আমরা এমনটা প্রমাণ করব যে, এতে আপনার চক্ষু উজ্জ্বল হবে। আপনি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের যেখানেই যেতে বলবেন, আমরা যেতে প্রস্তুত।”

সা’দ বিন মায়ায রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর এ বক্তব্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর অন্তরে প্রফুল্লতা বয়ে আনে এবং প্রিয় সহচরের সত্যভাষন ও লক্ষ্যের পথে দৃঢ়তা এবং জীবনসঞ্চারক আশার বাণী হতাশা ও শঙ্কার কালো ছায়াকে দূরীভূত করল।

সত্যের এ সাহসী সৈনিকের বক্তব্য এতটা উদ্দীপক ছিল যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথে যাত্রার নির্দেশ দিয়ে বললেন,

“যাত্রা শুরু কর। তোমাদের জন্য সুসংবাদ, হয় তোমরা কাফেলার মুখোমুখি হবে ও তাদের সম্পদ ক্রোক করবে, নতুবা কাফেলার সাহায্যে এগিয়ে আসা দলের মুখোমুখি হয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমি কুরাইশদের নিহত হওয়ার স্থানটি দেখতে পাচ্ছি, তাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।”

মুসলিম সেনাদল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পশ্চাতে যাত্রা শুরু করলেন এবং বদরের প্রান্তরে পানির আধারের কাছে ছাউনী ফেললেন।

শত্রুর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ

যদিও বর্তমানে সামরিক নীতি ও যুদ্ধকৌশলের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ও পূর্ববর্তী সময় থেকে তার পার্থক্য স্পষ্ট; তদুপরি এখনও শত্রুর অবস্থা, যুদ্ধকৌশল, সামরিক শক্তি ও অন্যান্য গোপন তথ্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা পূর্বের মতোই সম্যক গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এ সকল তথ্য এখনও মৌলিক বলে বিবেচিত। অবশ্য বর্তমানে তথ্য সংগ্রহের এ জ্ঞানটি সামরিক শিক্ষাদানের অন্যতম পাঠ্যের রূপ নিয়েছে এবং গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য বিশেষ ক্লাস ও পাঠ্যসূচী পর্যন্ত প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্লকের দেশগুলোর সামরিক অবস্থান তাদের গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল মনে করে। কারণ গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমেই তারা শত্রুর সম্ভাব্য শক্তি ও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে পূর্বে অবহিত হয়ে তাদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করে।

এ কারণেই মুসলিম সেনাবাহিনী এমন এক স্থানে অবস্থান নেয় যাতে করে এ মৌলনীতি সংরক্ষিত হয় এবং কোনরূপেই যেন গোপন তথ্যসমূহ প্রকাশিত না হয়। অন্যদিকে একদল সংবাদ বাহককে কুরাইশ সেনাদল ও বাণিজ্য কাফেলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিয়োগ করা হয়। প্রেরিত সংবাদ বাহকগন নিম্নরূপ পদ্ধতিতে তথ্যসমূহ হস্তগত করেছিলেন :

১. প্রথম দলে স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন। তিনি একজন সেনাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু পথ অগ্রসর হয়ে একজন গোত্রপ্রধানের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তাকে প্রশ্ন করলেন, “ কুরাইশ এবং মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে আপনি কোন তথ্য জানেন কি?”

সে বলল, “ আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা থেকে বের হয়েছে। যদি এ খবরটি সত্য হয়, তবে তারা অমুক স্থানে অবস্থান নিয়েছে (সে এমন স্থানের নাম বলল রাসূল ও তাঁর সঙ্গীরা ঠিক সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন)।

পক্ষান্তরে কুরাইশরাও অমুক দিন মক্কা থেকে যাত্রা করেছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। যদি এ খবরটিও সঠিক হয় তবে কুরাইশগন অমুক স্থানে অবস্থান নিয়েছে (এ ক্ষেত্রে সে কুরাইশদের অবস্থান নেয়া স্থানের নামই উল্লেখ করল।)

২. যুবাইর ইবনে আওয়াম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ও আরো কিছু সঙ্গী হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু -এর নেতৃত্বে বদরের কূপের কাছাকাছি স্থানে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। এ স্থানটি তথ্য সংগ্রহের জন্য আনাগোনার স্থান হিসেবে সংবাদ বাহকদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রেরিত দলটি কূপের কাছে কুরাইশদের দু’জন দাসের সাক্ষাৎ লাভ করল। তাঁরা তাদের বন্দী করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর কাছে আনেন। এ দুই দাস কুরাইশের দু’গোত্র বনি হাজ্জাজ ও বনি আ’সের পক্ষ থেকে কুরাইশদের জন্য পানি নেয়ার উদ্দেশ্যে কূপের কাছে এসেছিল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে কুরাইশদের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, পর্বতের পশ্চাতের সমতল ভূমিতে তারা অবস্থান নিয়েছে। তাদের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে তারা অবগত নয় বলে জানায়।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্ন করলেন, “ প্রতিদিন তারা খাদ্যের জন্য কতটি উট জবাই করে?”

তারা বলল,“ কোন দিন দশটি, কোন দিন নয়টি।”

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধারণা করলেন, তাদের সংখ্যা নয়শ’ থেকে এক হাজার। এরপর তাদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসেছে প্রশ্ন করলে জানায়, উতবা ইবনে রাবীয়া, শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, আবু জাহল ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হাজাম, উমাইয়্যা ইবনে খালাফ প্রমুখ তাদের মধ্যে রয়েছে। এ সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন,

هذه مكّة قد القت اليكم افلاذ كبدها

“ মক্কা শহর তার কলিজার টুকরোগুলোকে বের করে দিয়েছে।”

এরপর তিনি এ দু’ ব্যক্তিকে বন্দী করে রাখার নির্দেশ দিয়ে তথ্য সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিলেন।

৩. দু’ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হলো বদর প্রান্তে গিয়ে কুরাইশ কাফেলা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার। তাঁরা একটি কূপের কাছাকাছি স্থানে অবতরণ করে পানি পানের উদ্দেশ্যে এসেছেন এমন ভান করে কূপের কাছে পৌঁছলেন। সেখানে দু’নারীর সাক্ষাৎ লাভ করলেন যারা পরস্পর কথা বলছিল। তাদের একজন আরেক জনকে বলছিল, “আমার প্রয়োজন আছে জেনেও কেন আমার ধার পরিশোধ করছ না?”

অন্যজন বলল, “ কাল অথবা পরশু বাণিজ্য কাফেলা এসে পৌঁছবে। আমি কাফেলার জন্য শ্রম দিয়ে তোমার অর্থ পরিশোধ করব।”

মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তি এ দু’নারীর নিকট দাঁড়িয়েছিল। সেও ঋণগ্রস্ত মহিলার কথাকে সমর্থন করে বলল, “ কাফেলা দু’এক দিনের মধ্যেই এসে পৌঁছবে।”

সংবাদ বাহক দু’ ব্যক্তি এ কথা শুনে আনন্দিত হলেন, তবে সাবধানতা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে ফিরে এলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তথ্যটি অবহিত করলেন। যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদের অবস্থান ও বাণিজ্যিক কাফেলার আগমন সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পেলেন এবং তখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।



বদর প্রান্তর

আবু সুফিয়ানের পলায়ন

কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলা প্রধান আবু সুফিয়ান কাফেলা নিয়ে সিরিয়া গমনের সময় একদল মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল। তাই সে ভালোভাবে জানত যে, ফিরে আসার সময় অবশ্যই মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হবে। এ কারণেই সে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন এলাকায় প্রবেশের পরপরই তার কাফেলাকে এক স্থানে বিশ্রাম নিতে বলে স্বয়ং তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বদর এলাকায় প্রবেশ করে। সেখানে সে মাজদি ইবনে আমরের সাক্ষাৎ পেল। তাকে সে প্রশ্ন করল, “ অত্র এলাকায় সন্দেহভাজন কোন ব্যক্তিকে দেখেছ কি?”

সে বলল, “ সন্দেহ হতে পারে এমন কিছু দেখিনি দুই উষ্ট্রারোহীকে কূপের নিকট অবতরণ করে পানি পান করে চলে যেতে দেখেছি।”

আবু সুফিয়ান কূপের নিকট এসে উষ্ট্রের বসার স্থানটিতে উষ্ট্রের মল পড়ে থাকতে দেখল। সে মলগুলোকে আঘাত করে ভেঙে দেখল তাতে খেজুরের বীজ রয়েছে। সে বুঝতে পারল উটগুলো মদীনা থেকে এসেছে। সে দ্রুত কাফেলার নিকট ফিরে এসে কাফেলাকে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন এলাকা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিল এবং কাফেলার পথকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। অতঃপর সে কুরাইশদের কাছে বার্তা পাঠাল যে, কাফেলা মুসলমানদের অধীন এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে এবং কুরাইশ সেনাদল যেন যে পথে এসেছে সে পথে মক্কায় ফিরে যায়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপযুক্ত শিক্ষাদানের দায়িত্বটি যেন আরবদের ওপর ছেড়ে দেয়।

কুরাইশ কাফেলার পরিত্রাণ লাভের ঘটনা সম্পর্কে মুসলমানদের তথ্য লাভ

কুরাইশ কাফেলার পলায়নের খবরটি মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে যেসব ব্যক্তি বাণিজ্য পণ্য লাভের নেশায় বুঁদ হয়েছিল তারা বেশ অসন্তুষ্ট হলো। তখন মহান আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

و إذا يعدكم الله إحدى الطائفتين أنّها لكم و توّدون أنّ غير ذات الشوكة تكون لكم و يريد الله أن يحقّ الحقّ بكلماته و يقطع دابر الكافرين

“স্মরণ কর ঐ মুহূর্তকে যখন আল্লাহ্ দু’টি দলের একটিকে মুখোমুখি হওয়ার সুসংবাদ তোমাদের দিলেন এবং তোমরা অমর্যাদার দলটির (বাণিজ্য কাফেলা) মুখোমুখি হওয়ার আশা করছিলে; অন্যদিকে আল্লাহ্ চেয়েছেন সত্যকে পৃথিবীর ওপর সুদৃঢ় করতে এবং কাফির দলের মূলোৎপাটন করতে।”

কুরাইশদের মতদ্বৈততা

যখন আবু সুফিয়ানের প্রেরিত ব্যক্তি কুরাইশ সেনাদলের কাছে তার বার্তা নিয়ে পৌঁছল তখন এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে ব্যাপক মতদ্বৈততা সৃষ্টি হলো। বনি যোহরা ও আখনাস ইবনে শারীক তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোকে নিয়ে প্রাঙ্গন ত্যাগ করল। কারণ তাদের ভাষ্য ছিল: আমরা বনি যোহরা গোত্রের বাণিজ্য পণ্যগুলো রক্ষার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলাম। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। হযরত আবু তালিবের পুত্র তালিব, যিনি বাধ্য হয়ে কুরাইশদের সঙ্গে এসেছিলেন তিনিও কুরাইশদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পর মক্কায় ফিরে গেলেন।

আবু জাহল আবু সুফিয়ানের মতের বিপরীতে নাছোড়বান্দা হয়ে বলল, “আমরা বদর প্রান্তরে তিন দিনের জন্য অবস্থান নেব। সেখানে উট জবাই করে, শরাব পান করে ও গায়িকাদের গান শুনে কাটাব। সে সাথে আমাদের শক্তির মহড়া প্রদর্শন করব যাতে করে সকল আরব আমাদের শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং চিরকাল তা স্মরণ রাখে।”

আবু জাহলের মনভোলানো কথায় প্ররোচিত হয়ে কুরাইশরা বদর প্রান্তরের দিকে ধাবিত হয়ে একটি উঁচু টিলার পশ্চাতে উঁচু সমতল ভূমিতে গিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অবশ্য সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় কুরাইশদের চলাচলই মুশকিল হয়ে পড়ল ও তারা আরো অগ্রসর হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঐ টিলা থেকে একটু দূরেই অবস্থান নিতে বাধ্য হলো।

বদরের শিক্ষা

দ্বিতীয় হিজরির পবিত্র রমজান মাসে রোজা রেখে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন মুহাজির এবং আনসার সাহাবীগন। ইসলামের ইতিহাসে এ অভিযান ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ইসলাম যে শিক্ষা মুসলমানদেরকে প্রতিনিয়ত দিয়ে আসছে। আর তা হলো- সব কাজে ‘তাওয়াক্কালতু আ’লাল্লাহ’ আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস এবং ভরসা। বিপদে-আপদে, কষ্টে-মুসিবতে সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহ পাকের ওপর পরিপূর্ন আস্থাশীল হওয়াই বদরের ঐতিহাসিক সুমহান শিক্ষা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বদর প্রান্তরের এ সুমহান শিক্ষাকে জীবনের প্রতিটি কাজে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।



বদর প্রান্তর; মুসলমানদের ঈমানের শক্তিতে আজো বলিয়ান করে যে ময়দান

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:০২

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: অনেক অনেক ভাল লাগা।

মুসলমানদের ঘুম ভাংবে কবে? কে জানে?
নবীজি সম-সাময়িক প্রচলিক সকল পদ্ধতিকেই ব্যবহার করেছেন সত্য প্রচারে।

আজ ২০১৮ সালেও আমরা দ্বিধান্বিত- সিনেমা বানানো জায়েজ না নাজায়েজ!

আপনার এই পোষ্ট এবং এর সত্য এত দীর্ঘ সময় নিয়ে না পড়ে একটা আধ ঘন্টার শর্টফিল্ম কি আরো বেশি
তথ্য এবং আবেদন প্রকাশ করতে সক্ষম নয়?
দা ম্যাসেজ ছবিটি বিশ্বব্যাপি যে জাগরন এবং পরিবর্তন আনতে পেরেছে দর্শকানুভবে
হাজারো প্রচলিত ওয়াজ মাহফিলেও তা সম্ভব নয় বলেই বোধকরি!

সময়ের সাথে চলমানতায় সর্বশ্রেষ্ঠ এবং উত্তম অবস্থান থাকার কথা মুসলমানদের
অথচ সবচে পশ্চাদপততায় তারা আজ সবচে পেছনে!

পুথিগত বিদ্যা আর আচার ধর্মী ধর্মানুভব আর জ্ঞানের বৃহত্তর চর্চার অভাবেই এ দুরবস্থা
উত্তরনে উদ্যোক্তা কই????

১০ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ৮:৫১

নতুন নকিব বলেছেন:



সুচিন্তিত অসাধারন একটি মন্তব্য রেখে গেলেন। অশেষ মোবারকবাদ। কৃতজ্ঞতা।

হ্যা, আপনার কথা ঠিক আছে, আধা ঘন্টার একটি মানসম্পন্ন শর্টফিল্ম ভাল প্রভাব রাখতে পারে, তবে, প্রত্যেকের অবস্থানে প্রত্যেকে সঠিক। শর্ট ফিল্ম লেখার অভাব পূরন করে না। আবার লেখাও শর্টফিল্ম এর প্রয়োজন মিটিয়ে দেয় না। সুতরাং, এই আপনারা যারা লেখালেখি করছেন, আপনাদের অবদান অনবদ্য। ইসলামের প্রচারের পথে এর আবশ্যকতা রয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ন কথাটি আপনি বলেছেন মন্তব্যের শেষাংশে-

সময়ের সাথে চলমানতায় সর্বশ্রেষ্ঠ এবং উত্তম অবস্থান থাকার কথা মুসলমানদের
অথচ সবচে পশ্চাদপততায় তারা আজ সবচে পেছনে!

পুথিগত বিদ্যা আর আচার ধর্মী ধর্মানুভব আর জ্ঞানের বৃহত্তর চর্চার অভাবেই এ দুরবস্থা
উত্তরনে উদ্যোক্তা কই????


বিনীতভাবে জানার ইচ্ছে ছিল, দ্যা ম্যাসেজ বিশ্বব্যাপী কি ধরনের জাগরন এবং পরিবর্তন এনেছে। যদি একটু জানাতেন।

২| ০৮ ই জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো পোষ্ট।

১০ ই জুলাই, ২০১৮ সকাল ৮:৫৫

নতুন নকিব বলেছেন:



মুগ্ধতা অশেষ। বিপদ কি কেটেছে পুরোপুরি?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.