নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

Never lose hope...., Never Stop Expedition....

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

ঘুরে বেড়ানো আমার একটা ভয়ংকর মাত্রার নেশা। আর আমার এই নেশার যোগানদাতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব দুঃসাহসিক অভিযাত্রিকেরা। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রাইলস তাদের লিডার। এই মানুষটার জন্যই আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘোরার নেশা আমাকে গ্রাস করে বসেছে। একা পথচলা আমার খুব পছন্দ। একা চলায় কষ্ট আছে সত্য, কিন্তু তা আনন্দের কাছে চাপা পড়ে যায়।The one who follows the crowd will usually get no further than the crowd. The one who walks alone is likely to find himself in places no one has ever been.

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিঃ মৃত্যুঞ্জয় মানবতা (প্রথম পর্ব)

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:২৮





হোক আমাদের ছোট বিভাগ, কিন্তু মন তো আর ছোট নয়; হই আমরা ‘পড়ুয়া’ পাবলিক, কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া দিতে তো আর পিছপা নই। স্মরণকালের এক ভয়াবহ দুর্যোগের বিভীষিকার বিপরীতে অন্য সবার মতো আমাদের প্রিয় বিভাগও দাঁড়িয়েছিল সাহসিকতার সাথে। অদূর অতীতের সেই দুঃখজনক ঘটনা ও তার মোকাবেলার ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের এটি এক আনাড়ি উপস্থাপন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জিবপ্রযুক্তি বিভাগের একজন গর্বিত ছাত্র।

-----------------------------------------------------------------------

১১ বৈশাখের যথারীতি সকাল। সবাই যার যার কর্মস্থলে রুদ্ধশ্বাসে ধাবমান। ছুটে চলা এক ব্যস্ত শহর। তবে আমার ক্ষেত্রে কথাটা একটু ভিন্নভাবে সত্য। আমাকেও ছুটে চলতে হয়। তবে তা কর্মস্থলে না, শিক্ষাস্থলে। এমনই এক মরার রুটিন দিছে আমার ইয়ারে যে সপ্তাহের নিয়মিত ছয়দিনের মধ্যে পাঁচদিনই সকাল আটটায় ক্লাস ধরতে হয়। এ তো গেলো গোদের কথা; তার উপর বিষফোঁড়া হিসেবে আছে শুক্রবারে ক্লাস। বিরক্তিকর, চরম মাত্রায় বিরক্তিকর। সকাল সাতটা থেকে নিতে হয় ইচ্ছাবিরুদ্ধ প্রস্তুতি। আর তাই বৈশাখের সেদিনের শুরুটা কেমন ছিল আমার ঠিক খেয়াল নাই। থাকবে কেমন করে! এদিনও সকাল আটটায় ক্লাস। হলের ক্যান্টিন থেকে কোনরকমে খেয়ে দে দৌড়। তবে আমার সেদিনের প্রভাতটা রক্তরাঙা ছিল কিনা তা ভালোভাবে দেখে রাখা উচিত ছিল। তুলে রাখা উচিত ছিল আমার ব্যাগে সবসময়ের জন্য রাখা ক্যামেরার স্মৃতিতে। কারণ ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ যা বাংলায় ১১ বৈশাখ ছিল এক রক্তমাখা দিন। ঢাকার অকুস্থলে সাভারে ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস যার কারণ। স্বাধীনতার পরে এটাই হয়তো প্রথম ঘটনা যেখানে এতো মানুষ একবারে এক ঘটনায় মারা যায়। শুধু তাই নয়, ভবন ধসে এতো মানুষের মৃত্যু অধুনা বিশ্ব আগে কখনোই দেখেনি। পৃথিবীর বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়া, বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দেওয়া সেই ঘটনায় সবার মতো আমরাও বিজড়িত ছিলাম। শুনুন তাহলে সেই কাহিনী...



২৬ এপ্রিল, শুক্রবার। ক্লাস আছে। আজকে হবে বুধবারের ক্লাসগুলি। শুরু সকাল আটটা থেকে। তবে আজ আমি আর বিরক্ত না। কারণ কিছু একটা করার সুযোগ এনে দিয়েছে আজকের শুক্রবারের এই ‘অনাহূত’ ক্লাসরুটিন। গতকাল রাতেই আমাদের ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে (কিছু করার) একটা মৌন লক্ষণ বোঝা যাচ্ছিল। অনেকেই সাভারের রানা প্লাজায় আটকে পড়া মানুষদের সাহায্য করতে উন্মুখ হয়ে ছিল। তাই আজ আর দেরি না করে অনেক তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিলাম বিভাগ পানে। একটা কিছু করতেই হবে। হোক আমাদের ছোট বিভাগ, কিন্তু মন তো আর ছোট নয়; হই আমরা ‘পড়ুয়া’ পাবলিক, কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া দিতে তো আর পিছপা নই। তাই ডিপার্টমেন্টে গিয়ে অন্যান্য ব্যাচদের বললাম, সাথে আমার নিজের ব্যাচমেটদেরও। প্রাথমিক কাজ- টাকা তোলা। যতটুকু সম্ভব, যতো বেশী সম্ভব।



আমি আর আমাদের যারা যারা গতকাল রাতে বিভাগের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলাম তারা ছোটোখাটো একটা অলসতার কারণে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। অনেক দেরি করে আমরা পোস্টগুলো দিয়েছিলাম। ফলে রাত বেশী হয়ে যাওয়াতে অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায় পোস্টগুলো। তারপরও আমরা অনেক টাকা তুলতে পারি এবং টাকাগুলো ওঠে চোখের পলকে। এক্ষেত্রে আমাদের বিভাগের ২য় বর্ষের (১২তম ব্যাচ) শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখে। আমরা টাকা তুলে ওদের কাছে দিই। ওহ! একটা গুরুত্বপূর্ণ কথাই তো বলা হয়নি। কথাটাকে এভাবে বলা যায়- আমরা ভেবেছিলাম, বিভাগের সবার কাছ থেকে টাকা তুলে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আমাদের কয়েকজন সাভার যাবে জিনিসগুলো পৌঁছে দিতে। আমাদের ভয় ছিল- আমাদের এই ভাবনা স্যারদের সাথে মিল খাবে কিনা। চেয়ারম্যান স্যার হয়তো বলেই বসবেন- ক্লাস মিস দিয়ে কোন কাজ নয়!!! পড়াশোনা তো কর না, খালি আছো ক্যামনে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া যায় সেই চিন্তায়। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে কোন স্যারই কিছু বললেন না। উল্টো চেয়ারম্যান স্যারকে বলতেই উনি বললেন, “তোমরা তো অনেক দেরি করে ফেলছ! এতো দেরি করলে কেন! যাও, যারা যাবে তারা তাড়াতাড়ি যাও!” আমাদের সবচেয়ে বেশী অবাক করে দিয়েছিলেন রফিক স্যার। প্রথম অবাক হই যখন ওনাকে ফোন করে সেদিন ওনার ক্লাসটা না নেওয়ার অনুরোধ করি। স্যার বললেন, “তোমরা থাকো যতক্ষণ না আমি বিভাগে আসছি।” আমরা তো ভাবলাম, এই সারছে, স্যার আবার রেগে গেলেন কিনা। কিন্তু উনি রেগে তো গেলেনই না। উল্টো আমাদের অপেক্ষা করতে বলার যে কারণ ছিল সেই কারণটায় সবাইকে হতবাক করে দিলেন। মানবতার টানে সাড়াদান একজন মানুষের এতোটা থাকতে পারে আমাদের জানা ছিল না।



বিভাগের সবাই দেখলাম এক মুহূর্তে কেমন যেন সচকিত হয়ে উঠলো। নাম বলবো না, তবে এমনও অনেক ব্যাচকে দেখেছি যারা আগের রাতের পোস্ট না দেখার কারণে সেদিন বেশী টাকা আনতে পারেনি; কিন্তু যার কাছে যা ছিল সব দিয়ে দিয়েছে। আমার অলস স্মৃতিতে যতটুকু মনে হয়- আমাদের উত্তোলিত টাকায় কিছু দুই টাকার নোটও ছিল! অর্থাৎ সর্বস্ব ত্যাগিয়া মানবতার লাগিয়া সম্প্রদান। কে কত টাকা দিয়েছিলেন সেটা আলোচনা করবো না। দানের মহত্ত্ব আমার এই লেখনীতে কমবে বৈ যৎকিঞ্চিত বাড়বে না। শুধু এটুকু বলি- একবার চোখ বুজে আবার খুলতে যে সময় আমার কাছে মনে হয়েছিল সেই সময়ের ব্যাবধিতেই উঠে যায় সর্বমোট ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। টাকার পরিমাণ দেখে কেউ হাসবেন না, প্লিজ। আমি আগেই বলেছি আমার প্রিয় বিভাগ (জিন প্রকৌশল ও জিবপ্রযুক্তি) এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট বিভাগ। এই বিভাগের জন্মক্ষণ (সেই ২০০১) থেকে আজ (৩ আগস্ট, ২০১৩) অবধি ২০০ ছাত্রও হবে না। টেনেটুনে দেড়শ হতে পারে। আর সেদিন (২৬ এপ্রিল) উপস্থিত ছিল সব মিলায় চলতি ব্যাচগুলোর ৫০ কি ৬০ জন।



এবার যাবার পালা। কিন্তু যাবে কারা কারা? আমি তো যাবোই। আমার সঙ্গী হল আরো সাতজন-বিশাল, নাদভী, শাদলী, নোমান, রিয়াদ, রাব্বি আর শাহিদুল। এদের ভিতর বিশাল বাদে বাকি সবাই ২য় বর্ষের। বিশাল মাস্টার্সে। লিফটের বাঁটন চাপলাম নিচে নামার জন্য। সবার মুখে কোন উচ্ছ্বাস নেই, পরিবর্তে আছে দায়িত্ববোধ আর উৎকণ্ঠা। কোথা থেকে কি শুরু করবো সেই দুশ্চিন্তা তো ছিলই। কিন্তু লিফট দিয়ে ছয়তলা থেকে নামতে নামতেই মোটামুটি ঠিক করে ফেলি পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত। প্রথমেই যেতে হবে ফার্মেসীতে। প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছিলাম কলাবাগানের লাজ ফার্মাতে যাবো। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টাই। হাতের কাছে তোপখানা রোডের বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন) থাকতে এতদূর যাবার রিস্ক নেওয়ার দরকার নাই। সবাই মিলে ঠিক করলাম- যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য কিছু নিয়ে যাবো। গতকাল থেকেই অনলাইনে বিভিন্ন জায়গায় দেখলাম অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগবে। বিধ্বস্ত ভবনে যারা আটকা পড়ে বা চাঁপা পড়ে আছে তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে অক্সিজেন স্বল্পতার জন্য। একটা মাঝারী মানের অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম এমনি সময়ে নাকি ১,০০০ টাকা। আর এখন সাভারের কথা বললে লাজ ফার্মা ৮০০তেই ছেড়ে দিচ্ছে। সেই হিসাবে আমরা ঠিক করলাম অন্তত ১৫টা সিলিন্ডার নিবো আমরা। যেকোনো যাত্রায় মানুষ বেশী থাকলে বিভিন্নমুখী সিদ্ধান্তের তোড়ে আসল কাজে অহেতুক বিলম্ব হয়। হতে যাচ্ছিলোও। আমাদের সাথে স্বপ্নচারী নামের আরেকটি সংগঠনের কিছু সদস্যের যাওয়ার কথা ছিল। আগেরদিন রাতে ওদের সাথে আমার কথা হয়। কিন্তু কোন একটা কারণে তাদের আসতে দেরি হচ্ছিল। মুহূর্তকাল দেরি না করে আমরা আমাদের কাজে রওয়ানা দিলাম। প্রথম গন্তব্য তোপখানা রোডের বিএমএ। তবে একটা কথা ঠিক- স্বপ্নচারীর একজন সদস্যের সাথে আমি আর বিশাল সবসময় যোগাযোগ রাখছিলাম। ওরা অনেক বড় বাজেট নিয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু আমরা ফিল্ডে নামি আগে। তাই ওদের কি কি কিনলে ভালো হবে, কোনটা কিনলে আদতে কাজে লাগবে এই ব্যাপারে ঠিকমতো বলতে পারছিলাম। আর ওরাও অনেক অমায়িক, সাহায্যপ্রবণ আর বন্ধুবৎসল ছিল। শুধু ওরাই নয়, সেদিনের রৌদ্রদগ্ধ পথে নেমে যার কাছেই গিয়েছিলাম তার থেকেই পেয়েছি হৃদয় নিংড়ানো সাহায্য করার মানসিকতা, অনন্যোপায় হেতু সাহায্য করতে না পারার সলজ্জ কাতরতা; সর্বোপরি কান্তিমান মৃত্যুঞ্জয় মানবতা



চলবে.........

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.