নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

Never lose hope...., Never Stop Expedition....

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

ঘুরে বেড়ানো আমার একটা ভয়ংকর মাত্রার নেশা। আর আমার এই নেশার যোগানদাতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব দুঃসাহসিক অভিযাত্রিকেরা। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রাইলস তাদের লিডার। এই মানুষটার জন্যই আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘোরার নেশা আমাকে গ্রাস করে বসেছে। একা পথচলা আমার খুব পছন্দ। একা চলায় কষ্ট আছে সত্য, কিন্তু তা আনন্দের কাছে চাপা পড়ে যায়।The one who follows the crowd will usually get no further than the crowd. The one who walks alone is likely to find himself in places no one has ever been.

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিঃ গহীন অন্ধকারে..... (শেষ পর্ব)

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:২৬





হোক আমাদের ছোট বিভাগ, কিন্তু মন তো আর ছোট নয়; হই আমরা ‘পড়ুয়া’ পাবলিক, কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া দিতে তো আর পিছপা নই। স্মরণকালের এক ভয়াবহ দুর্যোগের বিভীষিকার বিপরীতে অন্য সবার মতো আমাদের প্রিয় বিভাগও দাঁড়িয়েছিল সাহসিকতার সাথে। অদূর অতীতের সেই দুঃখজনক ঘটনা ও তার মোকাবেলার ধারাবাহিক স্মৃতিচারণের এটি এক আনাড়ি উপস্থাপন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জিবপ্রযুক্তি বিভাগের একজন গর্বিত ছাত্র।

-----------------------------------------------------------------------

গাড়ী থেকে নামলাম। এ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন ধ্বংসনগরীর এক ছোট্ট প্রতিচ্ছবি। চারিদিকে মানুষের ছোটাছুটি আর চিৎকার-চেঁচামেচি। কেউ কাউকে চেনে না, কিন্তু সবার মাঝে মানবতার সুমহান টান এক ঐকতানে বহমান। আত্মস্বার্থ চরিতার্থকে মাটিচাপা দিয়ে চাপা পড়া মানুষগুলোকে বাঁচানোর নিরন্তর চেষ্টায় সবাই অবিরত, অবিশ্রান্ত। আমার ঠিক গজদশেক দূরেই বিধ্বস্ত রানা প্লাজা। নয়তলার ‘সুউচ্চ’ ইমারতখানা ভেঙে এখন তিনতলার প্যানকেকে রূপান্তরিত। আগেই বলেছিলাম যে আমরা মোটমাট আটজন ছাত্র গিয়েছিলাম আমাদের বিভাগ (জিন প্রকৌশল ও জিবপ্রযুক্তি) থেকে। তার মধ্যে চারজন কেবল অস্থায়ী নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলাম। আর পেরেছিলাম কেবল পিকআপে থাকার কারণে। আমার সাথে ছিল বিশাল, নাদভী আর শাদলী। আমরা যা যা এনেছিলাম তার প্রায় সবই রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ীভাবে বানানো ক্যাম্পে জড়ো করতে লাগলাম; কেবল অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ব্যাগে রেখে দিলাম। যখনই উপর থেকে কেউ চাচ্ছিলো তখনই বের করে দিচ্ছিলাম। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটা দেশ যখন বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয় তখন একদম শুরুর দিকে সাধারণ্যের যে অবস্থা হয় আমি ঠিক সেরকম উদ্‌ভ্রম হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো যেন একটু আগের বিমান হামলায় বিধ্বস্ত এক বিল্ডিঙের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। মধ্যগগনের চোখ রাঙানো সূর্যের দাবদাহে রীতিমত ঘামছিলাম আমি এবং আমরা সবাই।



রানা প্লাজার যেদিকটায় আমরা এসে নেমেছিলাম সেটা ছিল তার সামনের অংশ। পাশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক যা বর্তমানে উদ্ধারকাজের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ। পুরো প্রক্রিয়া কেমন যেন এলোমেলো লাগছিলো। কেউ নাকে মাস্ক উঠিয়ে (কাজের বিরতিতে) জুস খাচ্ছে, অন্যদিকে ডেব্রিস সরাচ্ছিল যারা তাদের অনেকের মুখে কিছু নেই। কেউ হেলমেট পরে রোদের হাত থেকে মাথা বাঁচাচ্ছে, অন্যদিকে বিধ্বস্ত ভবনের ভিতরে অনেকেই খালি মাথায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। কেউ জুতা পায়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, অন্যদিকে খালি পায়ে কিছু লোক জং ধরা লোহার স্তূপ পরিষ্কার করছে। এই শেষের ব্যক্তিটি ছিলাম আমি। এডিডাসের জুতা পায়ে দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আসলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো আমাকে। কারণ আমি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না এখন আমার ঠিক কি কাজ করা উচিৎ। এমন সময় উপর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলো, “অঅঅক্সিজেএএএন, অঅঅক্সিজেএএএন, কেউ একজন একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার উপরে পাঠান।”



নীচে তাকিয়ে দেখলাম আমার পায়ের কাছে কয়েকটা অক্সিজেন সিলিন্ডার পড়ে আছে। সবকটা অক্সিজেনপূর্ণ। ব্যস, শুরু হয়ে গেলো কাজ। একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে রওয়ানা দিলাম উপরের দিকে। ডেব্রিসের স্তূপ দিয়ে একটা বড়সড় ঢিবি তৈরি হয়েছে। সেটা মাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। দুপুরের রোদের তাপে লোহার সিলিন্ডারগুলো বেশ গরম হয়ে গিয়েছিলো। আমার ঘাড় প্রায় পুড়ে যাচ্ছিলো। কারণ, যতই উপরে উঠছি ততই মানুষের ভিড় বাড়ছিলো যারা কোন না কোন কাজে ব্যস্ত; তবে সবাই আমার কাঁধে অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখে পথ করে দিচ্ছিল। কিন্তু এতে কি আর একেবারে ভিড়হীন, ফাঁকা পথ পাওয়া যায়? কয়েক জায়গায় আবার চোরা গর্তের মতো ছিল। পাড়া দেওয়ামাত্র গর্তে পা পড়ে যাচ্ছিলো। আমার কয়েকবার এরকম গর্তে পা চলে গিয়েছিলো। কোনরকমে সামলে সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হলাম রানা প্লাজার ঠিক সামনে। কাঁধ থেকে সিলিন্ডারটা নামালাম। নামিয়েই যে জিনিসটা দেখলাম তা আমি আমার জীবনে দেখিনি। এক মহিলার লাশ দুইটা স্ল্যাবের নীচে চাঁপা পড়ে আছে। বিষয়টা আপনাদের কিভাবে যে বোঝাই। জাস্ট বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি, আমাকে উল্টো বুঝবেন না। স্যান্ডউইচ দেখেছেন? মহিলার শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে রড ঢুকে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিলো। এখন তাকে কেটে কেটে বের করা ছাড়া নাকি আর কোন উপায় নেই। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ ভিতরে জীবিতের সন্ধান পাওয়া যায়। আর তার জন্যই অক্সিজেন সিলিন্ডার চাওয়া, আর সেই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আমার উপরে যাওয়া। আত্মা যার খাঁচার ভিতরে তাকেই তো আগে দেখতে হবে, তাই না? যার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে তাকে নিয়ে এখন না ভাবলেও হবে। তাই আপাতত কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে হতভাগিনীকে।



অক্সিজেন দিয়ে নীচে নেমে আসছি এমন সময় দেখলাম নীচে কয়েকজন বেলচা দিয়ে ডেব্রিস পরিষ্কার করছে আর অন্যরা ফালি ফালি কাপড় পেতে দাঁড়িয়ে আছে। বেলচা দিয়ে উঠানো ডেব্রিস ঐ কাপড়গুলোর উপর ফেলা হচ্ছে। প্রত্যেকটা কাপড়ের চারিধারে চারজন করে দাঁড়িয়ে আছে। কাপড়টি মোটামুটি ভরে গেলে সেটা নিয়ে অদূরে রাখা ট্রাকে ফেলে আসছে। মোটামুটি নীচে নেমে এসেছি এমন সময় দেখলাম সবচেয়ে কাছের একটা কাপড়ে ডেব্রিস ফেলা হবে; কিন্তু একজন শর্ট। তো কি আর করা। আমি হয়ে গেলাম সেই শেষজন। আমি কাপড়ে হাত দিতে না দিতেই তার উপর ঝপাঝপ ডেব্রিস ফেলা আরম্ভ হল। ধুলা উড়ানো তপ্ত দুপুরে এই হল সেই অভিশপ্ত রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষ যার নীচে বলি হতে হয়েছে হাজারেরও উপরে নিরীহ প্রাণের। আর আমি যে কাপড়ের প্রান্তভাগ ধরে রেখেছি তা এই রানা প্লাজায় অবস্থিত গার্মেন্টসগুলোরই পিস পিস করে কাটা থান কাপড়। শত প্রাণের ঘামে ভেজা কপালে ক্লান্ত দেহের কর পড়া করতলের নিপুণ ছোঁয়ায় যে নিরেট থান কাপড়গুলো আকর্ষণীয় রূপে সারা বিশ্বময় ঘুরে বেড়ায়, আজ ধ্বংসলীলার মাঝে তার অপ্রত্যাশিত ‘ভগ্নদশা’ বড় বেমানানই দেখায়। দেখতে দেখতে কাপড়টি ভরে গেলো। আমরা চারজন রওয়ানা দিলাম ট্রাকের দিকে। অন্য পার্টি এখন আমাদের জায়গা নেওয়ার জন্য সামনে এগোল। ডেব্রিস ফেলে আসতে না আসতেই আবার ডাক পড়লো, ছুটে গেলাম আবার উপরে। দেখলাম একটু আগে যে লোকটা বেলচা দিয়ে ডেব্রিস পরিষ্কার করছিলো সে সেখানে নেই। বেলচা পড়ে আছে। হাতে তুলে নিলাম বেলচা। এক সময়ের সুরম্য অট্টালিকার ইট, সুরকি, পাথর, ভাঙাচোরা রড, কাঠ সব উঠে আসতে লাগলো আমার বেলচায়। হঠাৎ একটা রডে ঘ্যাচাং করে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বেঁধে গেলো। সাথে সাথে এক ফালি চামড়া উঠে আসলো। বেলচা ফেলে যে নীচে নেমে আসবো তারও কোন উপায় নেই। নীচে বড় বড় তিনটা কাপড় হাতে নিয়ে তিন চারে বারোজন দাঁড়িয়ে আছে। তার উপর এগুলো যতো দ্রুত পরিষ্কার করা সম্ভব ততো মঙ্গল। ভিতরে যেখানে হাত কেটে, পা কেটে আমার ভাইবোনদের বের করা হচ্ছে সেখানে আমার এইটুকু চামড়া ছিলে যাওয়া কিছুই না। একেবারেই কিছুই না। কিন্তু একসময় আমার হাত থেকে একজন বেলচা নিয়ে নিলো।

“ভাই, আমাকে দেন। আপনি অনেকক্ষণ ধরে করছেন। একটু বিশ্রাম নিন। এখন আমি ধরছি।” কথা শুনে বুঝলাম পালা করে করা একটা কাজের অংশ ছিলাম আমি। আমার জন্যে অঘোষিত সময়সীমা শেষ, আমাকে এখন এই কাজে ক্ষান্ত দিতেই হবে।



হাতের যে অবস্থা তাতে ফার্স্ট এইড না নিলে পরে ঝামেলা হতে পারে। তবে তার আগে দেখলাম হাতে লোহা বিঁধছে কিনা। মরিচা ধরা লোহায় টিটেনাস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আমি কাছের মেডিক্যাল ক্যাম্পে গিয়ে ফার্স্ট এইডের সন্ধান করলাম। দুর্ভাগ্য আমার, সেখানে তা ছিল না; শেষ হয়ে গেছে। এক ডাক্তার তরুণী বললেন, “ভাইয়া, এই নিন পানি। কাটা জায়গা ভালো করে ধুয়ে নিন।” এই বলে সে একটা মিনারেল ওয়াটার বাড়িয়ে ধরল। হাত ধুয়ে ফিরে আসার সময় বিশাল আর নাদভীর সাথে দেখা। ওরা আমার খোঁজ করছিলো। আসলে এতক্ষণের ঘটনা বর্ণনায় পরোক্ষভাবে ওদের সাথে আমার সাময়িক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার বিষয়টা বোঝা যায়। কিন্তু এই বিচ্চিন্নতা অনাকাঙ্ক্ষিত। চিন্তা করে দেখুন, কোন্ অবস্থায় আমি ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। অক্সিজেন সিলিন্ডার। আমার জায়গায় আজ যদি ওরা কেউ থাকতো তো ওরাও তাই করতো। বিশাল মারফত যা জানতে পারলাম তাতে আমাদের আরো এক ব্যাগ সিলিন্ডার রয়ে গেছে যা কিনা নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থাকা আমাদের বাকি চারজনের কাছে। ওহ শিট, ঠিক এই বাক্যটা লিখার সময় খেয়াল হল যে আমরা পিকআপে চারজন না, বরং তিনজন ছিলাম। আর বাইরে ছিল পাঁচজন, চারজন না। দুঃখিত সবার কাছে, বিষয়টা প্রথমে আমি খেয়াল করতে পারিনি। যাইহোক, ঐ ব্যাগটা আনতে গেলাম আমি। এইবার মনে পড়েছে। আমি নিরাপত্তা বেষ্টনীর দিকে যেতে যেতে শাদলীকে ফোন দিলাম তারা কোথায় আছে তা জানার জন্য। কিন্তু নরক গুলজার করার মতো চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে না শুনছিলাম আমি ওর কথা, না শুনতে পাচ্ছিলো ও আমাকে। পুলিশ আর বিডিআর (আমি ওদের এখনো এই ঐতিহ্যবাহী নামেই ডাকি এবং ডেকে যাবো) নিরাপত্তা ঘেরাটোপের দায়িত্বে ছিল। ওরা আমাদের বাইরের পাঁচজনের মধ্যে কেবল শাদলীরে ঢুকতে দিলো। শাদলী অবশিষ্ট অক্সিজেন (মিনি) সিলিন্ডারগুলো নিয়ে প্রবেশ করলো মৃত্যুপুরীর আঙিনায়।



বাকি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো নিয়ে আমরা বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়লাম। একসময় আমাদের ১২ হাজার টাকায় কেনা বিশটা সিলিন্ডার শেষ হয়ে গেলো। এইসব সিলিন্ডারের ব্যাপারে একটু জ্ঞানদান না করলেই নয়। এগুলো দেখতে এয়ার ফ্রেশনার বা এরোসেল স্প্রের মতো। ভিতরে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকে তা দিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মিনিট স্প্রে করা যায় আর তা ক্ষেত্রভেদে দশ থেকে পনের মিনিট পরিবেশে অক্সিজেন হিসেবে থাকে। আবদ্ধ জায়গায় বিপন্ন প্রাণের মুহুর্মুহু টানে মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় সেইসব অক্সিজেন। রানা প্লাজার ভিতরে এমন কিছু জায়গা ছিল যেখানে বাইরের অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারছিলো না, উল্টো কার্বন-ডাই অক্সাইড জমছিলো। তখন আটকে পড়াদের জন্য এই স্প্রে ছড়ানো হতো। যাদের হাত বা পা কিংবা দুটোই কোন ভারী কিছুর নীচে চাপা পড়ে ছিল, যাদের উদ্ধার করতে আরো সময় লাগবে মূলত তাদের আটকে পড়া এরিয়াতেই এইসব স্প্রে করা হতো বেশী। যখন আমাদের হাত থেকে শেষ সিলিন্ডারটি (এগুলোকে আসলে অক্সিজেন স্প্রেয়ার বলা উচিৎ) চলে গেলো তখন আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, আমরা কত অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই মাঝে মাঝে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এই বিনামূল্যের অক্সিজেন আমরা অবলীলায় টেনে নিচ্ছি আর অবহেলায় ছেড়ে দিচ্ছি। অথচ একটুও ভেবে দেখছি না এটা আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ আর যে স্রষ্টা এটা আমাদের ক্রমাগত দিয়ে যাচ্ছেন তিনি কত অনুগ্রহশীল। ৪২ মিনিটের সামান্য অক্সিজেনের মূল্য বার হাজার টাকা! এটা সেই অক্সিজেনই কিন্তু যা আমরা সতত সর্বদা নিচ্ছি। এমনকি এই লিখাটা পড়ার সময়ও.........



বিশাল বলল, “ভাই, এখন আমাদের ফেরা দরকার। আমরা এখানে থেকে তেমন কিছু করতে পারবো না। চলেন, চলে যাই।” আমি দেখলাম কথাটা এক অর্থে ঠিক। আমাদের ফিরে যেতে মন চাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিলো আমরা আরো কিছু হয়তো করতে পারি বা পারতাম। কিন্তু সত্য বলতে এখানে আমাদের কর্মক্ষেত্র নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একটু এনাম মেডিক্যালে যাবো। যদি সেখানে কিছু করতে পারি। ন্যূনপক্ষে রক্ত তো দিতে পারবো আট ব্যাগ। নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে আসলাম। পথে যেতে যেতে দেখলাম রাস্তার ধারে কিছু লোক বিনামূল্যে শরবত বিতরণ করছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে ইনারা স্থানীয় জনগণ। নিজের গাঁটির টাকা খরচ করে মানুষকে খাওয়াচ্ছেন। যে যত গ্লাস পারে খেতে পারছে, কিন্তু কেউই ওদিকে যাচ্ছে না। বাঙালী মাগনা পেলে আলকাতরাও খায় এই থিউরি সেদিন সাভারের পথে পথে ভুল প্রমাণিত হচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় এনাম মেডিক্যালে পৌঁছলাম। মহাসড়ক থেকে একটু ভিতরে এই কলেজ কাম হাসপাতালটি। পথে অনেকের মুখে ‘অন্যরকম’ একটা নাম শুনছিলাম। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলাম না বিষয়টা কি। যাইহোক, এনাম মেডিক্যালের রিসিপশনে জিজ্ঞাসা করলাম রক্ত লাগবে কিনা। ওরা আমার ব্লাড গ্রুপ জানতে চাইলো। আমি কাঁচুমাচু করে আমার ব্লাড গ্রুপ বললাম। ওনারা ফোনে কথা বলে জানালো, ব্যাংকে প্রচুর ব্যাগ জমা আছে। আপাতত আর লাগবে না। তো আর কি করা, এখানেও আমাদের কোন কাজ নেই। বাইরে বেরিয়ে এসে আমরা কোথায় আর কখন লাঞ্চ করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। এমন সময় দূরের এক মাইকে কিছু নাম ঘোষণা করা হল, সাথে জানানো হল এদের লাশ অধরচন্দ্রের মাঠে রাখা আছে। এতক্ষণে সেই ‘অন্যরকম’ নামটা ভালোভাবে শুনতে পারলাম- অধরচন্দ্র। এই নামটাই আসার সময় অনেকের মুখে শুনেছিলাম। আমি ঠিক করলাম ওখানে যাবো। সবাইকে বললাম; কিন্তু কেউই রাজী হল না। বিশাল এখানে আর একটুও থাকতে চাচ্ছে না। জুনিয়র ছয়জনও চুপ থেকে মৌন সম্মতি জানালো। আমি বললাম, “ঠিক আছে, তোরা এখানে থাক। আমি একাই যাচ্ছি। আর তোরা যদি চলে যেতে চাস তো তাও পারিস। আমরা তো আর এখন ডিপার্টমেন্টে যাবো না, যার যার বাসায় চলে যাবো। তাই যে যার মতো চলে যেতে চাইলেও সমস্যা নেই।”



আজ বহুদিন হয় কোন থমথমে মলিন মুখ দেখি না। সেই কবে দেখেছিলাম চিরস্থির এক নিথর প্রাণকে যে ছিল আমার মন, মনন আর চিন্তার বিরাট অংশ জুড়ে; যাকে কবরে নামিয়ে আর উঠতে ইচ্ছা করছিলো না আমার, জোর করে ধরে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। যাকে কেউ আমার সামনে কখনো অপমান করে পার পায়নি, সেই তাঁকেই সেদিন চারিদিকের মুঠো মুঠো মাটি দিয়ে সবাই ঢেকে দিচ্ছিল এই নিরুপায় ‘আমি’র সামনে-আজ কেন যেন সেইসব দিনের জোর করে ভুলে থাকা স্মৃতি হঠাৎ ফিরিয়ে আনতে মন চাইলো। যেই মানুষটার অসম্ভব যন্ত্রণার বিনিময়ে আমি এই দুনিয়ায় এসেছিলাম তাঁকেই যখন আমি অতি আদরে কবরে নামিয়েছি, নাকের রক্তমাখা তুলা সরিয়ে দিয়ে মলিন মুখটাকে কিবলামুখী করে দিয়েছি, শেষবারের মতো আমার কয়েক ফোঁটা চোখের পানি উপহার দিয়ে আজও একাকী বেঁচে আছি, সেখানে অধরচন্দ্রে যাই অপেক্ষা করে থাকুক না কেন সেটা আমার কিছু করতে পারবে না। আমি ঠিক রাখতে পারবো নিজেকে, স্থির রাখতে পারবো মন। হাঁটা শুরু করলাম। দুপুরের হেলে পড়া সূর্যের আলোয় পথ চলছি। পেছনে সঙ্গী কেবল আমার ছায়া। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ছায়ার সাথে আরো কতগুলো ছায়া এসে মিলল। পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা সাতজন আমার সাথে সাথে হাঁটছে। সবাই মিলে পথ চলতে লাগলাম। সত্য কথা বলতে কি, সেদিন আমরা কে সিনিয়র আর কে জুনিয়র সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। একসময় আমরা অধরচন্দ্রের গেইটে এসে পৌঁছলাম।



ভিতরে ঢুকে দেখলাম অনেক মানুষ। কারো অবস্থা স্বজনহারা, কারো হৃদয় স্বজনের খোঁজে পাগলপারা, কারো বা চোখে স্বজনসকাশে অশ্রুধারা। এখানের বাতাস অনেক ভারী; লাশের উৎকট গন্ধে ভারী, মানুষের ‘আরশ কাঁপানো’ হাহাকারে ভারী। অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাল সবুজ চত্বর মানুষের অবিরত আনাগোনায় ধূসর জমিন হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। দেখে বোঝার উপায় নেই ঠিক একশ’ বছর আগে প্রয়াত বাবু রাখাল চন্দ্র সাহা জামিনদার (অর্থাৎ জমিদার) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি এই বছরের জানুয়ারিতে শতবর্ষপূর্তির আনন্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব জায়গা তার শোকে মুহ্যমান। দোতলা স্কুল ভবনের নিচতলার বারান্দায় দূর থেকেই কয়েকটা সাদা কাপড়ে মোড়া লাশ চোখে পড়লো। যতই সেগুলোর কাছে যাচ্ছিলাম ততই লাশের গন্ধ নাকে এসে বিঁধছিল, কেমন যেন একটা ভোঁতা ভোঁতা গন্ধ। একসময় লাশ অবধি পৌঁছে গেলাম। কিন্তু যা দেখলাম তা আমাদের অচিন্ত্য ছিল। এ কেমন লাশ!!!! একটা মানুষ মারা যাওয়ার পর এমন হতে পারে!!!! দুই চোখ কোটর থেকে যেন বিস্ফোরিত হয়ে বের হয়ে এসেছে, সাদা হয়ে যাওয়া জিহ্বা মুখ থেকে বের হয়ে দুই পাটির দাঁতের মাঝে চাপা পড়ে আছে, কালোকেশী লম্বা চুলগুলো ফুলে যাওয়া মুখের উপর আলুথালুভাবে ছড়িয়ে আছে, সারা শরীর কয়লা কালো হয়ে আছে যেন মনে হচ্ছে এইমাত্র আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে লাশগুলো। আমরা যে কয়টা লাশ দেখেছি সব কোন না কোন হতভাগিনীর। মাছি ভনভন করছে চারপাশে। কয়েকজনকে দেখলাম একটা লাশ দেখে আরেকটা লাশের পানে দুরুদুরু বুকে, কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে আসতে। হাতে একটা ছবি ধরা। আমি বুঝি না এরা কি বোকা না অন্য কিছু! হাতে ধরা ছবির সাথে এইসব লাশের কোন মিল নেই, থাকতে পারে না, কিছুতেই পারে না, কোনমতেই পারে না, কখনোই পারে না। চিকন পাড়ের লাল শাড়ির যে মেয়েটা মাঝখানে সিঁথি করে পেছনে চুল বেণী করে রেখেছে, যার কাজল দেওয়া টানা চোখের সামনে কপাল থেকে বেয়ে আসা একগোছা চুল লুকোচুরি খেলছে, যার গোলাপি দুই ঠোঁটের মাঝে এক চিলতে হাসির আভা মিলিয়ে না যেতেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ উদ্ভাসিত হয়ে নিষ্প্রাণ ডিজিটাল সেন্সরে চিরকালের জন্য ধরে রেখেছে, সেই মায়ামাখা প্রিয় মুখটির সাথে এই কঠিন বাস্তবতার সাযুজ্য খোঁজা যে একেবারেই বেমানান সেটা কে কাকে বোঝাবে! বেশীক্ষণ আর থাকলাম না সেখানে। আমাদের সবাই কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে, কেউ কিছু বলছে না। নাদভী এক পর্যায়ে আমাকে ধরে কেঁদে ফেলল। আসলে আমরা সবাই তখন কাঁদছিলাম, কারোটা প্রকাশিত হয়ে পড়েছিলো নাদভীর মতো, কারোটা চাপা ছিল হৃদয়ের মাঝেই।



স্থানীয় এক রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম আমরা সবাই। এরই মধ্যে আমার এক কলেজ জীবনের বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হল। ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং এখানকার অধিবাসী অর্থাৎ সাভারবাসী। খাবার খেয়ে আমরা আবার এনাম মেডিক্যালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের একটা অ্যাম্বুলেন্সে গেট দিয়ে ঢুকছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার” নামক একটা সংগঠন কিছু মেডিক্যাল সংক্রান্ত জিনিস নিয়ে এসেছে। ঠিক হল এই অ্যাম্বুলেন্সে করেই আমরা সবাই ফিরে যাবো। বেলা চারটা। ঈষদুষ্ণ তাপ ছড়াতে ছড়াতে সূর্য তার বিদায়বার্তা জানিয়ে যাচ্ছে শুক্রবারের শেষবেলায়। সবাই অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসলো। এখন যাবার পালা। অ্যাম্বুলেন্সের কর্কশ সাইরেন বেজে উঠেছিলো কিনা আমার ঠিক খেয়াল নেই, কিন্তু সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি যখন একা সেই ধ্বংসনগরীর মাঝে থেকে গেলাম তখন একটু খারাপ লাগছিলো বৈকি; এতক্ষণ একসাথে ছিলাম আর এখন আলাদা হয়ে গেলাম। যদিও আমাদের ডিপার্টমেন্টে রোজ দেখা হয়, মাঝে মাঝে ফ্রেন্ডলি ‘মারামারি’ (যেটাকে খুনসুটি বলে) হয়, এর কোক ওর স্প্রাইট জোরপূর্বক টান দিয়ে নিয়ে গলা ভেজানো হয়, কম্পিউটার ল্যাবে ফেসবুকে বসা নিয়ে ছোটোখাটো ‘যুদ্ধ’ হয়, সেমিনারের গোল টেবিলে বসে হাসিঠাট্টা করা হয়; কিন্তু এভাবে এরকম পরিস্থিতিতে তো কখনো থাকিনি। যাইহোক, আমি কেন থেকে গেলাম সেটা বলি। একটু আগে আমার এক সাভারবাসী বন্ধুর কথা বলেছিলাম না? ঐ আমাকে থেকে যেতে বলল। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির অন্তরালের কিছু কাহিনী নাকি সে জানে। যে পথে আমার অনুজেরা (অ্যাম্বুলেন্সে করে) বাড়ি ফিরে গিয়েছে, সেই পথে একা একা হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে পুনরায় মহাসড়কে চলে আসলাম। সন্ধ্যার কিছু আগে বন্ধুর সাথে দেখা হল। অনেকদিন পর দেখা। পরস্পর নিষ্প্রাণ ভাব বিনিময় করলাম। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসলো। আঁধার ঘনিয়ে আসছে জীবনের পরতে পরতে। মৃত্যুপুরীতে আটকে থাকা বিপন্ন মানবতা যেন তলিয়ে যাচ্ছে বিভীষিকাময় রাতের গহীন অন্ধকারে......



(আপাতত শেষ)



রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিঃ মৃত্যুঞ্জয় মানবতা (প্রথম পর্ব)



রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিঃ টেক এন্ড রান (দ্বিতীয় পর্ব)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.