নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

Never lose hope...., Never Stop Expedition....

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

ঘুরে বেড়ানো আমার একটা ভয়ংকর মাত্রার নেশা। আর আমার এই নেশার যোগানদাতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব দুঃসাহসিক অভিযাত্রিকেরা। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রাইলস তাদের লিডার। এই মানুষটার জন্যই আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘোরার নেশা আমাকে গ্রাস করে বসেছে। একা পথচলা আমার খুব পছন্দ। একা চলায় কষ্ট আছে সত্য, কিন্তু তা আনন্দের কাছে চাপা পড়ে যায়।The one who follows the crowd will usually get no further than the crowd. The one who walks alone is likely to find himself in places no one has ever been.

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

সে থাকে শত দেশ দূরে, কত নদীর পরে, বহুদূর সেই দূর সাগর পাড়ে

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫০

ছোটকালে দেখতাম আপাকে আম্মা তেমন একটা দূরে ঘুরতে পাঠাতেন না। পারলে নিজে নিয়ে যেতেন, তা না হলে মামাদের কাউকে গার্ডিয়ান করে পাঠাতেন। আর আব্বার কথা নাই বললাম। তার ইঞ্জিনিয়ারিঙের কাজ ছাড়া সে আর কিছু বুঝতো কিনা আল্লাহ্‌ মালুম। আমাদের ভাইবোনদের ক্লাসে কার রোল কত সেটার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা কে কোন ক্লাসে পড়তাম তাই আব্বা অনেক সময় জানতেন না। এটাকে আমি মোটেও ভালো কিছু বলবো না। যাই হোক, আজ আব্বার ব্যাপারে কিছু বলবো না। সে আমার নিকটে বর্তমান। যার কথা খুব মনে পড়ছে সে আমার বড় বোন। যার থেকে আমার দূরত্ব এখন যোজন যোজন দূরে। সে থাকে শত দেশ দূরে, কত নদীর পরে, বহুদূর সেই দূর সাগর পাড়ে। কোন কারণ ছাড়াই মাঝে মাঝে আমার আপার কথা মনে পড়ে- এই কথাটা মিথ্যা।কারণ তো আছেই......



আমরা চার ভাইবোন। এখন তিন- এক বোন আর দুই ভাই। আমার দুই বোনই আমার বড়। আমার 'জুনিয়র' বড় বোন আমার সাথে দেখা না করেই ঐ না ফেরার দেশে চলে গেছে বহুদিন আগে। এখন যে আপা আছেন তিনি আমাদের সবার বড়। আমার থেকে ৮ বছরের বড় তিনি। আমি আপাকে সেই ছোটকাল থেকে "তুই" করে ডাকি। আমি যখন আপাকে "এই আপু, শোন।" বলে ডাকতাম তখন আশেপাশের অনেকেই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো। অনেকে অনেক উপদেশ দিতো। কিন্তু আমি আপাকে আপনি বা তুমি বলতে পারতাম না। আমার দেখাদেখি আমার তিন বছরের ছোটটাও আপাকে "তুই" বলেই ডাকতো। আমাদের এই রকম সম্বোধনে আপা কিছু মনে করতেন না। যা মনে করতো সব ঐ পান চাবানো মুরুব্বীরা। X( X( X(



আপা অনেক কিছু করতে পারতেন। ছবি আঁকা, কবিতা লিখা, কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ওরিগামী বানানো, মাসুদ রানার বই পড়া, দুই বছরের ছোট্ট এই 'আমি'র সাথে খেলার সময় কমে যাবে এই শঙ্কায় দুই ঘণ্টার পরীক্ষা ২৫ মিনিটে দিয়ে বাসায় এসে আম্মার সেই মাইর খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে আপা অনেক কিছু পারতেন, এখনও পারেন। আমরা ছোট দুই ভাই শুধু বদের হাড্ডি ছিলাম না, ঐ হাড্ডিতে কিছু গোশতও লাগানো ছিল। :D ;) :P আমরা পালা করে আপাকে জ্বালাতন করতাম। আমি ছিলাম এই ক্ষেত্রে শৈল্পিক গুণের অধিকারী। মাইরও খাইতাম সেইরকম। মাইর খেয়েই আবার ক্ষ্যাপাতাম। :P :P আমার পরীক্ষার সময় আপাই আমাকে পড়াতেন। অবশ্য আম্মার কারণে (বা ভয়ে) মাঝে মাঝে আব্বা এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে আমার শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুলে নিতেন। তখন আমারে দেখে কে। আব্বারে তো আর সেইভাবে জ্বালাতন করা যায় না। মূলত আব্বারে আমরা কেউই ঘাঁটাতাম না। আমি আল্লাহ্‌ তায়ালার রহমতে ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হতাম। সবাই আমাকে বাহবা দিতো। কিন্তু আমি জানতাম এই বাহবা আমার প্রাপ্য না। এই বাহবার যোগ্য প্রাপক আম্মা আর আমার আপা। আমি না।



আপা আজ প্রায় দশ বছর হয় ভাইয়া আর দুইটা বাবুকে (আমি অবশ্য এই দুইটাকে ব্যারল বলি অর্থাৎ বিড়ালের আদুরে, গদগদ রূপান্তর) নিয়ে আমেরিকা থাকেন। ভাইয়ার চাকরীর সুবাদে ঐখানে আপার বসবাস। একটা অফ টপিক- আমি আবার আপার জামাইদের দুলাভাই ডাকতে পারি না, দুলাভাই কথাটায় কেমন জানি একটা মাখন মাখন ভাব থাকে। :P ঠিক তেমনি আমি আমার ভাইয়াদের ওনাদের কখনো ভাবী ডাকি না, স্রেফ আপু বা আপা ডাকি। ভাবী কথাটায় কেমন যেন একটা 'ভাবমারানো' ভাব থাকে। :P আর সবচেয়ে বড় কথা, এগুলা সম্বোধনের পুরাতন এনালগ ভার্সন। আমি ডিজিটালে বিশ্বাসী। :) যাই হোক, আসল কথায় ফিরে আসি। আল্লাহ্‌ তায়ালার রহমতে আপাদের ওখানে ভালোই সেটেলমেন্ট হয়ে গেছে। দুইতলা বাড়ীর পাশে ছোট্ট একটা বাগান। সেখানে ঋতুভেদে বিভিন্ন শাক-সবজির চাষ করেন আপা। বাড়ীর পাশে একটা ছোট্ট নদী। নিরুপদ্রব এক জীবন সেখানে। আম্রিকা বলে কথা। কিন্তু আপার ওখানে নাকি একটুও ভালো লাগে না। /:) /:) /:)



আপারা মাঝে মাঝেই বাংলাদেশে আসেন। শেষ এসেছিলেন আম্মাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। ডাক্তার বলে দিয়েছিলো আম্মার সম্ভাব্য আয়ুষ্কালের কথা। আমার এখনো মনে আছে আপার সেই কান্নাভেজা চোখদুটোর কথা। আম্মার চুল ছাড়া মাথায় বাচ্চাদের মতো আদর করার সময় আমি দেখেছিলাম আপার কান্নার দমকা বেগ সামাল দেওয়ার অপার ক্ষমতা। কিন্তু হাসপাতালের বারান্দায় আপা আমার ভুল ভেঙে দিয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে দিলেন। ঠিক এমনভাবে আমি কেঁদেছিলাম আপার বিয়ের সময় তার বিদায়বেলায় মামার কাঁধে মুখ লুকিয়ে। তবে আপার সেই কান্নার ভেদ্যতা ছিল অভেদ্য। আজ যেই বাবুটাকে সুস্থ (কিছুটা হলেও) দেখে যাচ্ছি, এরপরেরবার এসে তাঁকে আর কোনদিনই দেখবো না। এই মা, এই কথা বলতে পারা মা, এই ক্যান্সারের অসহ্য যন্ত্রণায়ও সদা হাস্যমুখী মা, এই চোখের কোণে চিকচিকে অশ্রু নিয়ে সন্তানকে বিদায় দেওয়া মাকে যে আর কখনোই দেখবে না আপা এটা তার থেকেও বেশী নাড়া দিয়েছিল আমাকে। ওহ! একটা কথা বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম, আমরা আমাদের আম্মাকে যতো না আম্মা, মা, আম্মু ডাকতাম তারচেয়ে কোন অংশে কম ডাকতাম না 'বাবু' বলে। আম্মা আমাদের তিন ভাইবোনের কাছে অলটাইম বাবু ছিল। এখনও আছে, কাছে নেই তো কি হয়েছে।



আমাকে মাঝে মাঝেই আপা ফোন দেন। একবার ফোন দিলে টানা ৯০ মিনিট। আমার খারাপ লাগে না। সত্যিই খারাপ লাগে না। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে অন্যখানে। আমি আবার হলে থাকি। আপা সাধারণত আমাকে ফোন দেন রাত নয়টার পর। আমেরিকায় তখন সকাল। ভাইয়া বিড়াল দুইটাকে স্কুলে দিয়ে অফিস চলে গেলে আপার আর করার কিছুই থাকে না। তখনই আমাকে ফোন দেন। বাবু দুইটা কি করে, ওখানে ইন্টারনেট স্পীড কেমন, নায়াগ্রা ফলসের বাকি ছবিগুলা আপলোড করা হয়নি কেন, কবে আসবি- এইসব থাকে আমার প্রশ্ন। এগুলোর উত্তর ৫ মিনিটেই আপা দিয়ে দেন। তারপর শুরু করেন তার প্রশ্ন- তোর আর কয় বছর বাকি আছে (এর মানে হল, আমাকে আর কয় বছরের ভিতর বিয়ে দেওয়া যাবে), :P :P :P প্রেম-ট্রেম করি কিনা, তুই হলে কি খাইস, খাবারের নাম বলার পর এগুলো ভালো কিনা, তোর কণ্ঠস্বর এমন শোনাচ্ছে ক্যান, হলে রাজনীতি করি কিনা, আমার মার্শাল আর্ট প্র্যাকটিসের কি খবর, ছবি তোলার কি অবস্থা, ঘোরাঘুরির নেশা বাদ দিসি কিনা, এখনও বাদ না দিয়ে থাকলে কবে নাগাদ বাদ দিবো (কারণ আমাকে বিয়ে দিতে হবে যে) :D :D নামায ঠিকমতো পরতেসি কিনা- এইসব ব্যাপারে তার প্রশ্ন থাকে। আমাদের বেশিরভাগ কথোপকথন হয় আপার প্রশ্ন আর আমার তড়িৎ উত্তরদানের ভিত্তিতে। একটা উত্তর দিতে দেরি করলেই হইছে। আপা ধরেই নেন যে, আমি যেই উত্তরটা দিবো সেটা বানানো উত্তর; যেই কারণে আমি ভাবার জন্য একটু সময় নিচ্ছি। আপারে কিছুতেই বোঝানো যায় না যে, হলে ফোনে টানা ৯০ মিনিট একমাত্র রোমিও-জুলিয়েটরাই কথা বলে, তাও আবার রাতের বেলা। হলের ঐ বদগুলারে ক্যামনে বুঝাই আসল কথা। ওরা বুঝেও না বোঝার ভান করে দাঁত বের করে রাখে। ওদের দাঁতগুলো পুনরায় দুই ঠোঁটের আড়ালে নিতে আমার যে একটু সময় লাগতে পারে এটা তো আর ফোনের ভিতর দিয়ে আপারে বোঝানো যাবে না।



আপার আমেরিকা ভালো লাগে না একটুও। আমি জানি কেন লাগে না। তারপরও জিজ্ঞাসা করি, স্বপ্নের দেশ আমেরিকা ছেড়ে বসবাসের অযোগ্য এই দেশে......... আপার একটাই কথা আমার এখানে ভালো লাগে না। কিন্তু আমি জানি আপার কেন এতো কিছু থাকার পরও ওখানে ভালো লাগে না। ওখানে তো তার সেই ছোট দুইটা ভাই নেই, ওখানে তো আর আমাদের মায়ের কাঁচামাটির কবর নেই, ওখানে তো সারাজীবন ব্রিজ, ফ্লাইওভার, পোর্ট, মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিঙের ডিজাইন করতে করতে সংসারে চির অমনোযোগী থাকা সেই বাবা নেই, ওখানে ছোটকালের সেই মামা-খালারা নেই, নেই শৈশব-কৈশোরের বন্ধুরা, সেখানে নেই মাসুদ রানা আর তিন গোয়েন্দার সেবা প্রকাশনী। যারা ওখানে আপার সাথে আছে তারা তো আপা যেখানেই যাবে সেখানেই থাকবে। কিন্তু এগুলো, যেগুলো কমা দিয়ে দিয়ে একটু আগে বললাম............



লিখার একদম শুরুতে কয়েকটা বাক্য লিখেছিলাম। যার সারমর্ম ছিল- আম্মা আপাকে তেমন একটা ঘুরতে দিতেন না। আপা এই জন্য অনেক কান্নাকাটি করতেন। একদিন আম্মা আপার কান্নাকাটি দেখে বলেছিলেন, "তোকে আজ যেতে দেইনি বলে তুই কানতেছিস। কিন্তু দেখবি একদিন এমন একটা সময় আসবে যেদিন তুই দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে যাবি, সুন্দর জায়গায় থাকবি; কিন্তু তোর ভালো লাগবে না। তোর এখন মনে হচ্ছে যে এই সময়টা তোর জন্য খারাপ; কিন্তু তুই দেখিস, তুইই (আল্লাহ্‌র রহমতে) সবার চাইতে সবচেয়ে ভালো থাকবি।" আপাকে আম্মা যা বলতেন তা কোন অভিশাপ ছিল না, ছিল এই সমাজে একটা মেয়েকে স্বাধীনভাবে ঘুরতে না দিতে পারার অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতায় বেরিয়ে আশা দীর্ঘশ্বাস ঢাকার জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে করা অনুপম আশীর্বাদ।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৩৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: "তোকে আজ যেতে দেইনি বলে তুই কানতেছিস। কিন্তু দেখবি একদিন এমন একটা সময় আসবে যেদিন তুই দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে যাবি, সুন্দর জায়গায় থাকবি; কিন্তু তোর ভালো লাগবে না। তোর এখন মনে হচ্ছে যে এই সময়টা তোর জন্য খারাপ; কিন্তু তুই দেখিস, তুইই (আল্লাহ্‌র রহমতে) সবার চাইতে সবচেয়ে ভালো থাকবি।"

মায়ের দোয়াতো ফলেই গেল!!!

মায়েরা এমনই হয়। কাঁদে বেঁচে থেকে সারাটা জীবন, কাঁদায় না ফেরার দেশে একেবারে চলে দিয়ে!!!

দিলেনতো মাকে মিস করিয়ে :(( :(( :((

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৫০

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: আমি আর কি বলবো? আমাকে যদি আল্লাহ্‌ তায়ালা বেহেশতের বিনিময়ে কিছু চাইতে বলতেন, আমি আমার মাকেই চাইতাম। কিন্তু তা কি আর সম্ভব?

২| ১০ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:২১

নূরজাহান সালমা বলেছেন: নিজের কথা নিজেও এতো ভালো বলতে পারবো না! অনেক প্রাণোবন্ত হয়েছে! ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.