নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

Never lose hope...., Never Stop Expedition....

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

ঘুরে বেড়ানো আমার একটা ভয়ংকর মাত্রার নেশা। আর আমার এই নেশার যোগানদাতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব দুঃসাহসিক অভিযাত্রিকেরা। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রাইলস তাদের লিডার। এই মানুষটার জন্যই আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘোরার নেশা আমাকে গ্রাস করে বসেছে। একা পথচলা আমার খুব পছন্দ। একা চলায় কষ্ট আছে সত্য, কিন্তু তা আনন্দের কাছে চাপা পড়ে যায়।The one who follows the crowd will usually get no further than the crowd. The one who walks alone is likely to find himself in places no one has ever been.

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ কুমিরার প্রতিরোধ যুদ্ধ (২৬-২৮ মার্চ ’৭১)

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:০২



উত্তাল একাত্তর। শুরু হয়ে গেছে দুর্বার মুক্তিযুদ্ধ। গ্রেফতার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সুসংগঠিত পাকিস্তানী আর্মিরা নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অপ্রস্তুত নিরীহ বাঙালীর উপর। যেখানেই যাচ্ছে তারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে সব, যেখানেই পাচ্ছে যাকে বানিয়ে দিচ্ছে শব। এমনি সময়ে কুমিল্লার দিক থেকে ধেয়ে আসছে ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের একটি বিশাল কনভয়। বাঁধা দেওয়ার জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো ১০২ জন যোদ্ধার ছোট একটি দল। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআরের সমন্বয়ে গঠিত এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রুখে দিতে স্থিরপ্রতিজ্ঞবদ্ধ তারা। যে করেই হোক পাক বাহিনীর চট্টগ্রাম অভিমুখী এই যাত্রাকে হয় থামিয়ে দিতে হবে, নতুবা যতটুকু পারা যায় বিলম্বিত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড ও ভাটিয়ারীর মাঝামাঝি এক স্থানে, শিল্প এলাকা কুমিরায়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে কুমিরার এই প্রাথমিক প্রতিরোধ এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেসব প্রতিরোধ যুদ্ধ পাকিস্তানিদের হকচকিত করে দিয়েছিল, ভাঁজ ফেলেছিল কপালের রেখায়, কুমিরার যুদ্ধ ছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।



২৬ মার্চ, বিকেল পাঁচটা। অস্তাচলের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে সেদিনের লাল সূর্য। আঁধার ঘনিয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তানের বুকে। বিগত রাতের বিভীষিকার শঙ্কায় কাঁপছে জনপদ। কিন্তু মুক্তিকামী জনতার বুকে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন তা তো কাঁপবার নয়। দুরুদুরু বুকে লালন করা মুক্তির চেতনা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করছে। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় এদেশবাসি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী। জায়গায় জায়গায় ফুঁসে উঠছে সেই দ্রোহের অনল। চট্টগ্রাম থেকে উত্তরে ২০ কিলোমিটার দূরের শহরতলী কুমিরা। কুমিরার উত্তরে পাহাড়শ্রেণী, আধ মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর; মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এখানেই প্রতিরোধের জন্য অবস্থান নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা যে সংখ্যাতেই কেবল কম ছিল তাই নয়, অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অপ্রতুল। কি ছিল তাঁদের কাছে? বলার মতো কিছুই না। একটি মাত্র এইচএমজি, গুটিকয়েক এলএমজি আর বাকিসব রাইফেল। এতো অল্পসংখ্যক সৈন্য আর অস্ত্র নিয়ে পুরো একটি সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ঝুঁকি যে কি বিরাট আর তার পরিণাম যে কি মারাত্মক ভয়াবহ হতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তারপরেও আমাদের বীরযোদ্ধারা দাঁড়িয়েছিল অসম শক্তির বিপরীতে, ভয় করেনি মৃত্যুকে, মায়া করেনি নিজের অমূল্য প্রাণটিকে।



৫৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির কাছে আদেশ আসে একটি শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার। ব্রিগেডিয়ার শফি তার ব্রিগেডের অধীন ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের সাথে ইঞ্জিনিয়ার সিগন্যাল, ৮৮ মর্টার রেজিমেন্ট এবং অন্যান্য ইউনিটের সৈনিকদের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরপর নিজেই সড়কপথে রওয়ানা হন চট্টগ্রাম অভিমুখে। ৮০ থেকে ১০০ গাড়ির সে এক বিশাল কনভয়। পথে শুভপুর ব্রিজের কাছে দলটি ছাত্রজনতা ও ইপিআর সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। বাঙালীর এই প্রতিরোধের মুখে শত্রু ২৫ মার্চ রাতে শুভপুর অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট আগেই শুভপুর ব্রিজটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে রেখেছিল। এসব কারণে হানাদার বাহিনী এখানে এসে আটকে যায়। পরদিন ২৬ মার্চ সকাল ১০টায় তারা শুভপুর বাধা অতিক্রম করে পুনরায় চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করে। পিছে শুভপুর ব্রিজ মেরামতের জন্য কিছুসংখ্যক সৈন্য ব্রিজের কাছে রেখে যায়।



এদিকে মুক্তিবাহিনী শত্রুর (ফেনীর কাছে) শুভপুর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে আসার খবর পায়। প্রস্তুত হয়ে যায় ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে থাকা ছোট্ট মুক্তিসেনার দলটি। ক্যাপ্টেনের আদেশে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী ৫টি সাধারণ পরিবহন ট্রাক এনে হাজির করলো। ক্যাপ্টেন তার দলকে চারটি ট্রাকে তুলে বাকি ট্রাকে গুলির বাক্স উঠিয়ে রওয়ানা হলেন যুতসই একটা জায়গা খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে। তিনি নিজে একটি মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে আগে রেকি করতে লাগলেন। সেই যাত্রাপথের দৃশ্য ছিল অবিস্মরণীয়। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া পরবর্তীতে “মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস” নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর মুখেই শুনুন না হয় কিছু কথা...“রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমিয়েছে। তাদের মধ্যে কল-কারখানার শ্রমিকই বেশী। মুখে তাদের নানান শ্লোগান। হাজার হাজার কণ্ঠের সেই শ্লোগান আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলছিল। গতরাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বর্বর বাহিনী কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণ, নির্মম হত্যা, পাশবিক অত্যাচার, বিশেষতঃ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যে-কোনভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখন দেখতে পেল খাকি পোশাক পরা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই-পি-আর’এর জওয়ানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু তারা শ্লোগান দিতে লাগল- জয় বাংলা, বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিন্দাবাদ, ই-পি-আর জিন্দাবাদ। এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈন্যদেরকে কি দিয়ে এবং কিভাবে সাহায্য করতে পারবে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত।আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলি তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। এমন সময় একজন বুড়ো লোক তার পথের পাশের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিল। বললোঃ “স্যার, আমি গরীব মানুষ, কিছু দেওয়ার মত আমার ক্ষমতা নেই, এই নিন আমার দোকানের সিগারেট (সিগারেট ৩ কার্টুন ছিল); আপনার জওয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন।” বৃদ্ধের এই সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। আর একজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এল। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো।”



সন্ধ্যা ছয়টা। কুমিরায় পৌঁছে গেছে মুক্তিযোদ্ধারা। এখন শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করতে হবে। মহাসড়কের ডানে পাহাড় আর বামদিকে আধা কিলোমিটার দূরে সমুদ্র। অতএব শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা আছে। সুতরাং সামনে এগুতে হলে তাদের পাকা রাস্তা (অর্থাৎ মহাসড়ক) ধরে সরাসরি আসতে হবে। তাই সেখানেই (মহাসড়কের উপর) পজিশন নেওয়ার আদেশ দিলেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। যে জায়গাটা পজিশন নেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হল তার ৫০০ কি ৬০০ গজ পিছনে ছিল একটি খাল। উদ্দেশ্য, পর্যায়ক্রমিকভাবে পশ্চাদপসরণ প্রক্রিয়ায় যেন খালের পাড়ে বিকল্প প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করা যায়। যদিও খালটি পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাধা নয়। তবু এটা পিছনেই রাখা হল। তিনি তাঁর তিন প্লাটুন কম্যান্ডারকে ডেকে সংক্ষেপে যুদ্ধের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিলেন। সেই মোতাবেক সবাই দ্রুত যার যার আদিষ্ট পজিশনে অবস্থান নেওয়া আরম্ভ করলো। একমাত্র এইচএমজি’টা ফিট করা হল উত্তরদিকের পাহাড়ের ঢালুতে। ইপিআরের কোম্পানি কম্যান্ডার সুবেদার মুসার উপর এই এইচএমজির দায়িত্ব অর্পিত হল। ক্যাপ্টেন বামদিকের কয়েকটি এলএমজির পজিশন ঠিক করে দিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দক্ষিণ, উত্তর এবং পূর্বদিকে (চট্টগ্রামের দিকে) অনেকটা ইংরেজি U (ইউ) অক্ষরের মতো সবাই অবস্থান নিল। অর্থাৎ ডানে, বাঁয়ে এবং পিছনে মুক্তিযোদ্ধারা আর যেদিক থেকে (কুমিল্লার দিক থেকে) শত্রু এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা হা করে থাকা সাঁড়াশির মত খোলা। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ৭০ কি ৮০ গজ সামনে একটি বড় গাছ ছিল। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় সেই গাছের মোটা ডাল কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলা হল। রাস্তার আশপাশ থেকে ইট এনে মহাসড়কের উপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হল। অতি অল্প সময়ের ভিতর আশ্চর্যজনকভাবে একটা সুন্দর ব্যারিকেড তৈরি হয়ে গেলো। মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দেওয়া হল যে, শত্রুসৈন্য যখন ব্যারিকেড সাফ করতে গাড়ি থেকে নামবে এবং সাফ করার জন্য একত্রে জমা হবে তখন সবাই একযোগে গুলি ছোড়া আরম্ভ করবে। বিশেষ করে উত্তর পাহাড়ে ফিট করা এইচএমজি থেকে অবিরত গুলিবর্ষণ হতে থাকবে। এহেন কার্যকরী ‘নির্দয়’ অর্ডার দিয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে জন্মভূমির জন্যে রাতের আঁধারে শত্রুহননের অপেক্ষায় রইলেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া।



এদিকে ২৬ মার্চ সন্ধায় ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি তার সৈন্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে মাত্র বিশ কিলোমিটার দূরের কুমিরার কাছাকাছি এসে পৌঁছান। ছোটোখাটো বাধা অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছে তিনি বেশ খুশিই হন এবং প্রায় নিশ্চিন্ত হন যে, আর তো মোটে ৪৫ মিনিট; তারপরই তিনি তার বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে যাবেন এবং সেখানে অবস্থানরত ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জেসিও মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার সাথে যোগ দিয়ে বাঙালীর সম্মিলিত প্রতিরোধ মাটির সাথে মিশিয়ে দেবেন। ধূলিসাৎ করে দেবেন বাঙালীর স্বাধীনতার তিলোত্তমা আকাঙ্ক্ষাকে। অন্যদিকে কুমিরা পৌঁছেই ক্যাপ্টেন সুবিদ মোটর সাইকেলযোগে একজনকে পাঠিয়ে দিলেন শত্রুর অগ্রগতির খবর নিতে। তিনি জানেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর একটা বিশাল রিইনফোর্সমেন্ট আসছে। কিন্তু তারা আসলে কারা, কোন ব্যাটালিয়ন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু জানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এলো যে, শত্রু তাঁদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) অবস্থানের থেকে বেশী দূরে নেই। মাত্র চার কি পাঁচ মাইল দূরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আসছে। যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল সে পাঞ্জাবীদের নিকটে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে জানালো, পাঞ্জাবীদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কাঁধের উপর কি যে একটা সেটাও কালো। তখন ক্যাপ্টেনের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে।



প্রায় একটা ঘণ্টা কেটে গেলো শত্রুহননের প্রতীক্ষায়। সন্ধ্যা তখন ৭টা। ধীরে ধীরে সগর্জিত হচ্ছে ইঞ্জিনের আওয়াজ, নিরেট পীচ কামড়ে আসছে এক বিশাল বহর। হঠাৎ থেমে গেলো সব আওয়াজ। কারণ সামনে যে ব্যারিকেড। কিছুসংখ্যক সিপাহি নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। তারা ইটগুলো তুলে দূরে ফেলে দিতে লাগলো। কনভয়ের পিছনের গাড়িগুলোও ততক্ষণে চলে এসেছে জায়গামতো। সোয়া সাতটা। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত এমনি সময়ে গর্জে উঠলো ডানদিকের এইচএমজি। সাথে সাথে গর্জে উঠলো অন্য মারণাস্ত্রগুলোও। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লো সামনের সারির সবকটা। মৃত্যুকাতর আর্তনাদ আর দিশেহারা ছুটাছুটিতে হকচকিত পাকিস্তান আর্মি। অবিশ্রাম গুলিবর্ষণে একের পর এক লাশ পড়ছে মহাসড়কের নিষ্প্রাণ পিচের উপরে। এদিকে প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে মেশিনগান, মর্টার আর আর্টিলারি থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বেঁধে গেলো দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। বহু চেষ্টা করেও শত্রুরা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যূহ ভেদ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটা ট্রাকে আগুন ধরে গেলো। হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র মেশিনগানটি নিউট্রালাইজ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করলো। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেলো। প্রায় দু’ঘণ্টার প্রাণপণ লড়াই শেষে পাক আর্মিরা দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলো।



২৬ মার্চের এই খণ্ডযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর চরম ক্ষতিসাধিত হয়েছিলো। তাদের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার ও একজন লেফটেন্যান্টসহ ১৫২ জন সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারায়। সাথে দু’ট্রাক অ্যামুনিশন মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জায় আসে। আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের চৌদ্দজন বীরযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। কুমিরায় লড়াই চলেছিল সর্বমোট তিনদিন। প্রথমদিনে হেরে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে তারা আবার আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। আর্টিলারি আর মর্টার দিয়ে গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে তাদের। অবশেষে ২৮ তারিখে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় পাক আর্মিরা। পিছন থেকে নৌবাহিনীর গানবোট ফায়ার সাপোর্ট দেয়। রাতের আঁধারে শত্রুরা পাহাড়ের উপর অবস্থিত টি.বি. হাসপাতালের নিকটে মেশিনগান বসায়। শেষতক পিছু হটে যায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগণ। পতন হয় কুমিরার। হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। যাওয়ার পথে রাস্তার দু’পাশের সমস্ত গ্রাম ও হাটবাজার জ্বালিয়ে দেয়। সামনে যাকে দেখে তাকেই গুলি করে হত্যা করে। লোকমুখে শোনা যায়, কুমিরা পতনের পর রাস্তার দু’পাশে নাকি কয়েকদিন ধরে আগুন জ্বলেছিল।



কুমিরার যুদ্ধে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের আপাত পরাজয় হলেও এটাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর পাকিস্তান আর্মির উপর হানা সম্মিলিত আক্রমণের প্রচণ্ড আঘাত। তিনদিনের এই যুদ্ধে গোলাবারুদের যোগান কমে আসাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটে কুমিরা ছেড়ে আসার প্রধান কারণ। তাছাড়া অপ্রস্তুত বাঙালী জাতি যুদ্ধের প্রথমদিকে ছিল অগোছালো ও অসংগঠিত। তথাচ কুমিরার প্রতিরোধ যুদ্ধ পাকিস্তানী জেনারেলদের আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেয়। এই সংঘর্ষের পর ঢাকায় ১৪ পদাতিক ডিভিশনের কর্নেল স্টাফের সাথে চট্টগ্রাম থেকে কোন এক পাকিস্তানী সামরিক অফিসারের ওয়্যারলেসে জরুরী কথা হয় যা ইন্টারসেপ্ট করা হয়েছিল। তাতে শোনা যায় যে, কর্মকর্তাটি বলছিল, “আমাদের অনেক হতাহত হয়েছে, আমাদের সৈন্যরা সীতাকুণ্ডের দক্ষিণে আটকা পড়ে আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য হতাহতদের জরুরিভিত্তিতে বিমানে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।” স্বয়ং মেজর জেনারেল খাদিম রাজা তাদের বিধ্বস্ত ব্রিগেডটিকে খুঁজতে হেলিকপ্টারে বেড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তার হেলিকপ্টারও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে বিদ্ধ হয়। বিফল মনোরথে ফিরে যান তিনি। আর তাই কুমিরার যুদ্ধের পশ্চাদপসরণ আপাত পরাজয়ের তিলক ধারণ করলেও তা ছিল সুদূরপ্রসারী বিজয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তাবাহক।



-----

রণাঙ্গনের দিনগুলিঃ মনতলার যুদ্ধ (১৫- ২১ জুন ’৭১)



-----

১৯৭১: একটি সত্য গল্প 1971: A True Story-একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আপোষহীন পেইজ



-----

সূত্রঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস – সেক্টর এক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – নবম খণ্ড (পৃষ্ঠা ৬৬-৭০)

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৪

একজন ঘূণপোকা বলেছেন:
অনেক ধন্যবাদ


জানানোর জন্য

২| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৪১

মামুন রশিদ বলেছেন: চমৎকার পোস্ট । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুমিরার প্রতোরোধ অন্যতম স্বর্ণালী অধ্যায় ।

০৩ রা জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪২

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: একমত আপনার সাথে... একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা যখন পড়ি তখন বর্তমানের সব অনাচার, নৈরাজ্যের কথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যাই। কিন্তু যখন পড়া শেষ হয় তখন আবার খারাপ লাগাটা জেঁকে বসে।

৩| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:০৫

শরৎ চৌধুরী বলেছেন: অনবদ্য।+++++।

০৩ রা জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৮

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে :) :) :)

৪| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৫৭

টয়ম্যান বলেছেন: +++++্

০৩ রা জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৫| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:২৫

পাঠক১৯৭১ বলেছেন: ভালো, সুন্দর লেখা।

তবে, আরো অনেক ক্যাপটেন ও মেজর রফিক সেই অপারেশনে ছিলেন।

৬| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:৩৫

পাঠক১৯৭১ বলেছেন: ২৬ শে মার্চ সকালে, কুমিল্লা থেকে ৮৫ ট্রেকের কনভয় চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, তাদের কিছুক্ষণের জন্য মানুষ থামায়েছিল শুভপুর ব্রীজে; মানুষ ব্রীজের ছোট অংশ ভেংগে ছিল।

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১০

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: নিক দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আপনি মুক্তিযুদ্ধপ্রিয় একজন মানুষ। ফেনীর কাছে শুভপুর ব্রিজের কাছে যে প্রতিরোধ হয়েছিল তা আরেক মহাকাব্যিক অধ্যায়। এটা নিয়েও লিখবো, ইন শা আল্লাহ্‌। :) :) :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.