নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

Never lose hope...., Never Stop Expedition....

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক

ঘুরে বেড়ানো আমার একটা ভয়ংকর মাত্রার নেশা। আর আমার এই নেশার যোগানদাতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব দুঃসাহসিক অভিযাত্রিকেরা। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ডের বিয়ার গ্রাইলস তাদের লিডার। এই মানুষটার জন্যই আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। ঘোরার নেশা আমাকে গ্রাস করে বসেছে। একা পথচলা আমার খুব পছন্দ। একা চলায় কষ্ট আছে সত্য, কিন্তু তা আনন্দের কাছে চাপা পড়ে যায়।The one who follows the crowd will usually get no further than the crowd. The one who walks alone is likely to find himself in places no one has ever been.

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি বড় আকারের ছোটগল্পঃ দূর নক্ষত্রের মাঝে

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৩



-বাবা, ও বাবা, একটা বড় আয়না এনে দাও না? ওয়াশরুমেরটা অনেক উঁচুতে... দেখতে পারি না।

টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে মুখ তুলে মেয়ের দিকে চাইলেন হাসান সাহেব।

-কেন্ রে মামনি?

-(অভিমানী কণ্ঠে) তুমি জানো না, কেন?

গলা ধরে এলো হাসান সাহেবের। জানেন তিনি কারণটা। বলতে গিয়েও আটকে গেলো কথা। অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখে শুধু বললেন, '"এখন না, মা। পরে..."

-পরে না! এক্ষণ, এক্ষণই...

এতক্ষণে একটু কঠিন হবার সুযোগ পেলো হাসান। “দেখো, মা। বলেছি পরে, পরে।”

মায়াভরা ছোট্ট চাঁদমুখখানির মাঝে একরাশ মলিনতা এসে ভর করলো; ছোট্ট ছোট্ট টানা টানা চোখের কোণ চিকচিক করতে আরম্ভ করলো। বাবা হিসেবে এই দৃশ্য সহ্য করা হাসানের জন্য নিদারুণ কষ্টের। কিন্তু সে উপায়হীন। এই দৃশ্য দেখেই তাকে এই কটা দিন চলতে হয়েছে, সামনের কটা দিনও চলতে হবে। এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ হল। সিস্টার এসেছেন নিশ্চয়ই।

-Time for medicine Mr Hasan.

-Ya, of course. ...মামনি?

-আমি ওষুধ খাবো না, বাবা। তিতা লাগে। সিস্টার, নেহি খাউঙ্গা মেডিসিন। ইট স্টিঙ্কস। এগুলো খেতে বাজে লাগে, বাবা।

-Sister, if you don’t mind, would you please stay sometimes with my daughter?

-(একটু নিচুস্বরে) No need of that, Mr Hasan. She will sleep now. I will give her ‘that one’. So she will fall asleep within a few moments.

-Ok, sister. Thank you.


সিস্টারের সেই that one এর কারণে মিনিট ত্রিশের ভিতর ঘুমিয়ে পড়লো আনিয়া। এটা হল ঘুমের ওষুধ "রিভোট্রিল", পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। মূলত যেসব বাচ্চারা ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধ খেতে চায় না তাদের ঘুম পাড়াতে এই ওষুধটা দেওয়া হয়। এক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন হাসান সাহেব। মনের অজান্তে দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে অবিরাম অশ্রুধারা। বেরিয়ে এলেন রুম থেকে। যাওয়ার সময় নার্স স্টেশনে বলে গেলেন একটু পর পর গিয়ে দেখে আসতে। দেখি, একটা আয়না দেখি পাওয়া যায় কিনা মুম্বাইয়ের কোন দোকানে।



হাসান মাসুদ। পেশায় একজন জিনবিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীন প্রকৌশল ও জিবপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স করে যোগ দিয়েছিলেন রিসার্চ অন অ্যাডভান্স সাইন্সেসে। এটি বাংলাদেশের একটি অভিজাত বিজ্ঞান গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে এই প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে সবদিক থেকে উন্নত এবং উঁচুতে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যেমন একটি অভিজাত সংস্থা; এর কিছু কাজের জন্য যেমন যার তার কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, ঠিক তেমনি একটি সংস্থা এই রিসার্চ অন অ্যাডভান্স সাইন্সেস। বিভিন্ন ধরণের সাইন্টিফিক ওয়ার্কস এন্ড এক্সপেরিমেন্ট করা হয় এখানে যার সাথে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ বিজড়িত। এরা একমাত্র প্রাইম মিনিস্টার ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। হাসান এই প্রতিষ্ঠানের একজন সিনিয়র সাইন্টিস্ট। পজিশন ডেপুটি লিডার। তার কর্মজীবনের শুরু অবশ্য এখান থেকে নয়। আইসিডিডিআরবি অর্থাৎ যাকে সবাই ডায়রিয়া হাসপাতাল বলে থাকে। কিছু নীতিগত কারণে সেখানে বেশীদিন কাজ করেনি সে। সেখান থেকে কিছুদিন কাজ করে বিসিএসআইআর এ, যা সাইন্স ল্যাবরেটরি বলে পরিচিত। তারপর এখানে- রিসার্চ অন অ্যাডভান্স সাইন্সেস। নো লবিং, নো নেপটিসম, নো কোটা; জাস্ট ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড প্যাট্রিয়টিসম এই মূলমন্ত্রে নিয়োগ দেওয়া হয় এখানে। পাঁচশ কোটি টাকার একটা বরাদ্দ দেওয়া হয় একনেকে এই কাজের বাস্তবায়নে। যার পরিণতি মিরপুরের দশতলা বিশিষ্ট সুপরিসর সুরম্য প্রতিষ্ঠান। মূলত বায়োসাইন্সের উপর অত্যাধুনিক গবেষণা চালানো হয় এখানে। দেশের সম্মান আর মর্যাদাকে সমুন্নত রাখা এবং স্বদেশের নিজস্ব সম্পদগুলোকে চিরদিনের জন্য নিজেদের করে নেওয়ার সাধনায় রত এই প্রতিষ্ঠানের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীরা। হাসান তাদেরই একজন।



মুম্বাইয়ের প্যারেল এমন একটা জায়গা যেখানে কেউ কারো দিকে ফিরে তাকায় না, কারো অভিব্যক্তিতে বিচলিত হয় না কেউ। সবাই যার যার কাজে, ধান্দায় কিংবা অভিব্যক্তিতে ব্যস্ত। আর তাই হাসানের কান্নাভেজা মুখ আর টকটকে লাল চোখ সবার অগ্রাহ্যে থেকে গেলো। বর্ষাস্নাত ভেজা রাস্তা যেন আজ এক রূপকার্থ বহন করে আছে।

-Brother, do you have any mirror here?

-what? Mirror? Ya.

-Not that size. Bigger than this.

-No. You may find bigger size at Sewree. It will cost you thirty rupia to there by taxi.

-Ok, thank you.



হাসান যে শুধু হিন্দি পারে না তাই নয়, বোঝেও না একেবারে। অনেক সময় আবার উল্টো বুঝে বসে থাকে। এই নিয়ে ফারিয়ার সেই কি হাসাহাসি। ওর মতে একটা মানুষ হিন্দি বুঝতে পারে না কিভাবে! এতো সহজ একটা ভাষা! কিন্তু কি এক অজানা কারণে এই অতি সোজা ভাষাটাই হাসানের কাছে অতি দুর্বোধ্য লাগতো। হিন্দি মুভি দেখতে বসলে সাবটাইটেল ছাড়া কিছুতেই কিছু বুঝতো না সে। অবশ্য ফারিয়া ওর জীবনে আসার পর ওর সাবটাইটেলের ঝামেলা কিছুটা মিটেছিল। হিন্দিতে সুপার পারদর্শী ফারিয়া মুভি দেখার সময় হাসানের দোভাষীর কাজ করতো।

-তোমার এই দোভাষীর কাজটা আর কতদিন করতে হবে বলো তো আমায়?

-কেন? কাজটা তো তুমি ভালোই পারো।

-হুম, ভালো না কচু। দোকানে ৩০ দিনে হিন্দি ভাষা শিক্ষার বই পাওয়া যায় না? ওগুলো কিনে নিয়ে শিখে নিলেই পারো।

-খুঁজেছি তো, কিন্তু পাইনি। আর আমার ঘরে এতো ভালো দোভাষী থাকতে ঐসব ছাইপাঁশ কে কেনে!

-হু, ঢং...



দূর অতীতের স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে কখন যে ট্যাক্সি সেউড়ি পৌঁছে গেলো বোঝাই গেলো না। ভার্সিটিতে পড়ার সময় ফারিয়ার সাথে পরিচয় হাসানের। ও পড়তো কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে। ডিপার্টমেন্টের এক আউটরিচ প্রোগ্রামে ফারিয়ার সাথে ওর পরিচয়। তখন হাসান পড়তো থার্ড ইয়ারে আর ফারিয়া সেকেন্ড ইয়ারে। মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো এই করতে করতে দিন কেটে যায় ওদের। ফারিয়া যখন ফোর্থ ইয়ারে তখন বাসা থেকে ওর বিয়ে ঠিক হয়, মানে সত্যি সত্যিই ঠিক হয়ে যায়। হাসানের আজও মনে আছে সেই বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যার কথা। টিএসসি, চায়ের আড্ডার সামনে।

-তোমাকে সারাদিন ধরে ফোন করে যাচ্ছি, পাচ্ছি না কেন!

-সরি, ফারিয়া। থিসিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

-ওটা নিয়েই ব্যস্ত থাকো তাহলে। আমি চললাম।

-আহা, রাগ করতেসো ক্যান? ফোনের সাইলেন্ট মুড চেঞ্জ করতে মনে ছিল না। তাই তোমার কল ধরতে পারিনি। কি হয়েছে বলবা তো? আরেক পার্টি আসছে নাকি?

-দাঁত কেলিয়ে হাসবে না বলে দিচ্ছি। সিরিয়াস হতে পারো না একটু!

-ওকে সিরিয়াস। এই যে সাবধান হয়ে দাঁড়ালাম। এইবার কি আদেশ দেবেন স্যার? ওহ, সরি ম্যাডাম হবে তো। ক্ষমা করে দেবেন ম্যাডাম। তা কি কারণে আমাকে জরুরী তলব।

-আজকে আমাকে দেখতে আসবে।

-এ আর নতুন কি। আগেই তো বললাম আরেক পার্টি আসছে নাকি...

-আম্মা বলছিল, আজই নাকি ওরা বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবে।

-ছবি দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে! অবশ্য আমার ফারিয়ার ছবি দেখে কোন ছেলে অপছন্দ করবে এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া ভার...

-হাসান, তুমি যদি সিরিয়াস না হও তাহলে তোমার ফারিয়া আজকের পর আর তোমার থাকবে না।



না, হাসান সিরিয়াস হয়েছিল সেই সন্ধ্যায়। সেই রাতেই ও বিয়ে করে ফারিয়াকে। পরবর্তীতে নানা ঝড়-ঝাঁপটা আসে ওদের জীবনে। বেশী আসে হাসান ও তার পরিবারের উপর দিয়ে। হাসান খুব ভালো ঘরের ছেলে। বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, বড় বোন বিয়ের পর থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেলড, ছোট ভাই সবেমাত্র ডিফেন্সে চান্স পেয়েছে, বিএমএ ট্রেনিং এখনো আরম্ভ হয়নি। কিন্তু এত কিছুর পরও ফারিয়ার উচ্চবিত্ত পরিবার বিশেষ করে ওর বিজনেস ম্যাগনেট শিল্পপতি বাবা হাসানকে তাদের জামাই হিসেবে মেনে নেয়নি। উনি চেয়েছিলেন বড় মেয়ের মতোই ফারিয়ার বিয়েটাও বড় কোন শিল্পপতি পরিবারে দিয়ে নিজের ব্যবসায়িক ভিত্তিটা শক্ত করবেন। কিন্তু মাঝখান দিয়ে সব হিসাবে গোলমাল লেগে গেলো। কিন্তু তাতে ফারিয়া আর হাসানের জীবনে কোন ঝামেলা হয়নি। খুব সুখেই দিন কাটছিল ওদের। বিয়ের চার মাসের মাথায় হাসান আইসিডিডিআরবিতে জয়েন করে। জিগাতলার দিকে তিনরুমের একটা বাসা নেয় ওরা। হাসানের অফিস শেষে ওরা দুজন নিউমার্কেট, গাউসিয়া, সীমান্ত স্কয়ার, চাঁদনী চক ঘুরে ঘুরে ওদের ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কেনাকাটা করে। মাঝে মাঝে টিএসসিতে বসে সেই আগের মতো গল্প করে, হাত ধরে টো টো করে ঘুরে বেড়ায় পুরো ভার্সিটি এলাকা, কখনো বা ফুলার রোডের সামনের রাস্তায় বসে ফুচকা খায় দুজনে, অতঃপর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে দুই প্রেমিক পথিক। এভাবেই চড়ুইভাতির মতো করে চলছিল এক ছোট্ট সংসার। বিয়ের তিন বছর পর ওদের ঘর আলো করে আসে এক ছোট্ট বাবু। মেয়ে হওয়াতে হাসান যারপরনাই খুশি হয়। মেয়েকে কোলে নিয়ে সেদিন সবার সামনেই ঝরঝর করে কেঁদেছিল ও। ওর কান্না দেখে অবাক হয়ে ফারিয়ার চোখও চিকচিক করে ওঠে সহসা। দুদিন পর বনানীর নতুন বাসায় ফেরে ওরা, নতুন বাবুকে কোলে নিয়ে। সারাটা পথ বাবুটাকে কোলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ছিল হাসান। অনেক নামের ভিড়ে আদর করে একটা নাম রাখা হয় সেই ছোট্ট বাবুটার। নুসরাত জাহান আনিয়া। এতদিন ওরা ওরাই ছিল, একজন ছিল কেবল আরেকজনের। এখন ওরা দুজনই নিবেদিতপ্রাণ নতুন অতিথির নিমিত্তে। আনন্দের দিনগুলো যেন পরমানন্দে কাটছিল। এমন সময় হঠাৎই নেমে এলো এক উটকো দুর্যোগ।



যে ফারিয়াকে সে এতো ভালোবাসতো সেই কিনা মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে আরেকজনের সাথে চলে গেলো! এতো সুন্দর অ্যাঞ্জেল টাইপ একটা বাবুর মা হওয়ার পরও কে পারে তাকে ছেড়ে যেতে। শেষদিকে ফারিয়ার ফোনে কথা বলার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। কারণটা প্রথমে হাসান আঁচ করতে পারেনি। সারাদিন ল্যাবে কাজ করার পর বাসায় এসে এগুলো দেখার মুড থাকতো না। আর ও বাসায় এসেই আনিয়াকে নিয়েই পড়ে থাকতো। যখন ও বিষয়টা ধরতে পারে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই একদিন ফারিয়া হাসানকে ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় ওর হাসি মুখে লেগে থাকা “আসি” কথাটা আজও হাসানের বুকে কাঁটা হয়ে ফুটে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই হাসানের কাছে ফারিয়ার নামে একটা লেটার আসে। কিভাবে পারে একজন মানুষ তার এতদিনের প্রিয় মানুষগুলোকে অবলীলায় ছেড়ে চলে যেতে!!! ফারিয়া হাসানকে ছেড়ে চলে যাবার পর কয়েকদিন ও বেশ মুষড়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে ও নিজেকে সামলিয়ে নেয়। শক্ত করে মন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর না। যথেষ্ট হয়েছে। জীবনে আর বিয়ে-শাদীর ধার দিয়েও যাবে না সে। আনিয়াকে বড় করে মানুষের মতো মানুষ করাটাকেই জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে বেছে নিলো হাসান। এখন আনিয়াই ওর জীবনের সবকিছু। অনেকেই আবার বিয়ে করার কথা বলতো। কিন্তু হাসান আর ঐ পথে যেতে নারাজ। যে কষ্ট ও ফারিয়ার কাছ থেকে পেয়েছে তা আবার নতুন করে পেতে চায় না। অবশ্য ফারিয়ার মতো কষ্ট আর কোন মেয়েই ওকে দিতে পারবে না। কারণ সেই ছিল হাসানের প্রথম ভালোলাগা। আছে এবং ......



হাসানের ফারিয়াবিহীন জীবন আনিয়াময় হয়ে আবার গতি ফিরে পায়। মেয়ে যখন হাঁটা শিখল তখন ওকে নিয়ে বিকেল বেলা হাঁটতে বের হতো হাসান। ছোট ছোট আঙুলগুলো দিয়ে বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতো। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ভার্সিটি এলাকায় ঘুরতে যেতো। ধীরে ধীরে আরো বড় হল হাসানের আনিয়া। স্কুলেও ভর্তি হল একসময়। ছোট্ট একটা শরীরে বড়সড় একটা ব্যাগ নিয়ে প্রতিদিন বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতো সে। আনিয়ার স্বভাবের অনেকটাই ওর বাবার থেকে ধার করা। নিজের কাজ নিজে করা তার অন্যতম। তাইতো স্কুল ব্যাগটা সে কিছুতেই বাবার হাতে দেবে না। অবশ্য রাতের বেলা ঘুমানোর আগে গল্পের বইটা বাবাকেই পড়ে শোনাতে হবে। ওর কাজ কেবল বাবার গলা জড়িয়ে বসে বসে গল্প শোনা। গল্প শুনতে শুনতে যখন গলার বাঁধন হালকা হয়ে পড়তো তখনই হাসান বুঝতো আজকের মতো এখানেই গল্প পড়ার ইতি। প্রতিদিনের গল্প পড়ার ইতি যে জীবনেও ইতি ডেকে আনবে তা কে জানতো। নিজের জীবনের চাইতেও যে মেয়েকে সে ভালোবাসতো সেই মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে না ফেরার দুনিয়ায়, যে ছোট্ট হাতটির নরম স্পর্শ না পেলে দিনটাই ভালো কাটতো না হাসানের আজ সেই নরম হাতের জায়গায় জায়গায় ছুঁচের ছিদ্র, ক্যানুলার উপস্থিতি। ছোট্ট এই মায়াময় শরীরে দানা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সারের এক দুর্লভ ভার্সন- লিয়োমায়ো সারকোমা। পৃথিবীর মাত্র ০.০২% লোকের এই ঘাতকব্যাধিটি হয়ে থাকে। এর সবচেয়ে খারাপ দিকটি হচ্ছে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এটি ক্লিনিক্যালি সনাক্ত করা যায়। তড়িঘড়ি করে মেয়েকে নিয়ে মুম্বাই চলে আসে হাসান। মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালের এক সিনিয়র অনকোলজিস্ট আনিয়াকে দেখে হাসানকে দ্রুত মুম্বাই নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

-দোস্ত, মামনির যে ক্যান্সার হয়েছে সেটা খুবই রেয়ার টাইপ। জন্মের সময় থেকেই এই টিউমারটা ওর শরীরে ছিল। তখন সেটা বিনাইন অবস্থায় ছিল। এখন এটা ম্যালিগন্যান্ট হওয়ার পথে।... দাঁড়া, দাঁড়া। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিস না। পুরোটা বলতে দে। তবে আমি টেস্ট করে যা দেখলাম তাতে ওর হার্ট এখনো ঠিক আছে। সো মেটাস্টাসিস জাতীয় কিছু এখনো হয়নি। কিন্তু সমস্যা হল এর প্রপার ট্রিটমেন্ট এখনো বাংলাদেশে ওভাবে আসেনি। আমি বলবো না যে, এদেশে এর ট্রিটমেন্ট নেই। কিন্তু বেটার ট্রিটমেন্ট তুই হয় সিঙ্গাপুর আর না হয় ভারতে পাবি। তবে আমি তোকে মুম্বাইয়ের টাটা হাসপাতালের নাম সাজেস্ট করবো। ওখানে আমার পরিচিত দুইজন অনকোলজিস্ট আছেন। ওনারা তোকে সর্বাত্মক সাহায্য করতে পারবেন। আমি বলি কি, তুই ওকে নিয়ে বাই এয়ারে মুম্বাই চলে যা।



পুরনো দিনের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে সেউড়ির মুসলিম পল্লীতে চলে আসলো হাসান। এখানেই বড় আয়না পাওয়া যায়। বড় দেখে একটা কিনেও ফেললো। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ফিরতে হবে। টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা অনেক কেয়ারিং। কিন্তু মেয়ের জন্য বাবার কেয়ার তার কাছে কিছুই না। ট্যাক্সি ধরতে যেই না রাস্তায় নামলো এমন সময় হাসানের ফোন বেজে উঠলো।

-Mr. Hasan, where the hell are you now? Come to the hospital right now.

-Why?? Sssorry, I’m coming.

কি হল আবার। এখন তো এরকম কিছু হবার কথা না। ডাক্তার তো আরো মাসখানেকের কথা বলেছিলেন। তাহলে এখন কেন?? হন্তদন্ত হয়ে ছুট লাগাল হাসান। পনের মিনিটের মধ্যে চলে আসলো হাসপাতালে। নার্স স্টেশনে এসে জানতে পারলো, আনিয়া নাকি একা একা টয়লেটে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে। আর পড়ে যাওয়ার সময় ওর পেটের যেখানটায় টিউমার ছিল সেখানে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। নিয়মিত চেকিংএ আসা নার্স ওকে রক্তাত্ত অবস্থায় টয়লেটে খুঁজে পায়। এখন ওকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবস্থা ভালো না। প্রচুর ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে। মাথায় যেন পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়লো হাসানের। এক দৌড়ে দশতলা থেকে দোতলার আইসিইউতে নেমে এলো সে। ডাক্তার জানালো তারা ইন্টারনাল ব্লিডিং বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। সারি সারি খালি চেয়ার রাখার পরও অস্থিরভাবে পায়চারী করছে হাসান। প্রায় দুঘণ্টা পরে ডাক্তার এসে জানালেন এখন অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক।

-হাই ডোজকা পেইনকিলার মরফিন দিয়া গায়া হে। ইস রাতকো উসে এহি রেহ‌্না পারেগা।

-Is the condition static now, doctor?

-Oh, ya. Little bit. You know, she is a paliative care patient...

-(কিছুটা হুংকার দিয়েই) I know that. No need to remind me about that.

-Please, don’t be so upset…. If you please don’t mind, could you please bring the regular medicine of your daughter to here?

এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরল হাসানের। সেউড়ির মুসলিম পল্লী থেকে কেনা বড় আয়নাটা এখনো ধরে আছে সে। লিফটে করে ফিরে আসলো কেবিনে। কেবিনে ঢুকতে গেলে প্রথমেই পড়ে টয়লেট। টয়লেটের লাইট জ্বালানোই ছিল। একদলা রক্ত জমে আছে মেঝেতে। ঝাপসা চোখে সেই দিকে পাথরের মতো চেয়ে আছে হাসান। হঠাৎ লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা তুলে তাকাতেই একটা জিনিসের দিকে নজর পড়লো ওর। হাই-কমোডের ঠিক পাশেই যে বড়সড় আয়নাটা ওখানে কালো রংপেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি কিছু একটা আঁকা; হিজিবিজির একদম বাঁদিকের শেষে একটা লাল ফুলও আঁকা। মুহূর্তে বুঝে নিলো কি হয়েছিল এখানে। হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো ও। ওর আদরের আনিয়া, এতো আদরের সোনামণি টয়লেটের হাই-কমোডের উপর দাঁড়িয়ে আয়নাতে ওর ছবি দেখছিল। টাক মাথার ছবি ওর হয়তো ভালো লাগেনি। তাই আয়নাতে ওর প্রতিচ্ছবির জায়গায় কালো রংপেন্সিল দিয়ে চুল এঁকে একপাশে একটা ফুলও এঁকে দিয়েছিল। কেমোথেরাপির কারণে আনিয়ার মাথার সব চুল ফেলে দিতে হয়। হাসান নিজ হাতে সেই চুল কেটে ফেলে দেয়। ছোট্ট ছোট্ট হাতে আঁকা সেই হিজিবিজির দিকে আবার মুখ তুলে তাকাল হাসান। কান্নার দমকে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। কেন বারবার ওর সাথেই এমন হয়। কেন বারবার ওর প্রিয় মানুষগুলো বিভিন্ন ছলেবলে ওর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চায়, দূরে চলে যায়। যেদিন থেকে ডাক্তার বলে দিয়েছে আনিয়ার বেঁচে থাকা আর অল্প কিছুদিনের সেদিন থেকেই ওর চোখে অঝোর ধারার সূচনা। বর্ষাকালের বৃষ্টিস্নাত মুম্বাই ওর অশ্রুপ্লুত মুখের কাছে কিছুই না। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ও টয়লেটের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই ছিল না ওর।



কি হয়েছিল তারপর?

সেই ঘটনার পরদিনই আনিয়া মারা যায়। প্রচণ্ড আঘাতে আনিয়ার ডান কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গিয়েছিল, হার্টের একটা আর্টারীও ছিঁড়েছিল আর সেখান থেকেই ম্যাসিভ ব্লিডিং হয়। হাসানের কোলে মাথা রেখে আনিয়া চলে যায় ওপারেতে, আর না ফেরার দেশে। আনিয়াকে কবর দেওয়া হয় বাংলাদেশে। ছোট্ট নিথর শরীরটাকে হাসান নিজ হাতে গোসল দিয়ে জানাজা পড়ায়, বুকের মধ্যে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসে কবরের কাছে; তারপর কবরের ভিতরে পরম মমতায় শুইয়ে দিয়ে উঠে আসে উপরে। ঘুরে দাঁড়ায় একটা নির্দিষ্ট দিকে...

-ফারিয়া, তোমার মেয়েকে তোমার পাশেই রেখে গেলাম। ওকে তো আর বেশীদিন দেখে যেতে পারো নি। তুমি যাওয়ার সময় ওকে যেই ছোট্টটি রেখে গিয়েছিলে ও কিন্তু আর সেরকম ছিল না। হাঁটতে শিখেছিল, দৌড়ে আমার কোলে এসে ঝাঁপ দিতে শিখেছিল, তোমার মতোই আদুরে অভিমান করতে শিখেছিল, তোমার মতোই সুন্দর ছবি আঁকতে পারতো। কথা বলা আনিয়াকে তো আর তুমি দেখে যেতে পারোনি, ও কিন্তু অনেক কথা বলতো। মাঝে মাঝে আমার মাথা খারাপ করে দিতো। তুমি থাকলে হয়তো এই মাথা খারাপের আধেকটা তোমাকেও পোহাতে হতো।... কেন তোমরা দুজনই আমাকে একা ফেলে এতো তাড়াতাড়ি না ফেরার দেশে চলে গেলে!!! আমার কি দোষ ছিল!!! কোথায় দোষ ছিল!!! ... দিয়ে গেলাম তোমার মেয়েকে। এতদিন আমি আগলে রেখেছিলাম। ঠিকমতো আদরে রাখতে পারিনি তাই রাগ করে তোমার কাছে চলে এসেছে। তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। স্বার্থপরের মতো আমাকে একা ফেলে মা-মেয়ে পাশাপাশি একসাথে থাকো এখন। দূর নক্ষত্রের তারার মাঝে খুঁজে ফিরবো তোমাদের যতদিন বেঁচে থাকবো।



রিসার্চ অন অ্যাডভান্স সাইন্সেস একটি কল্পনাজাত ধারণামাত্র। তবে এমন একটা প্রতিষ্ঠান হলে খুব একটা মন্দ হতো না বোধহয়।



♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣♣

আধিভৌতিক ঘটনা-দাবাবোর্ড

আধিভৌতিক ঘটনা-জ্যোৎস্নাচূড়া

আধিভৌতিক ঘটনা-হলজীবন

আধিভৌতিক ঘটনা-ধনেশ পাখির ঠোঁট (প্রথমাংশ)

আধিভৌতিক ঘটনা-ধনেশ পাখির ঠোঁট (দ্বিতীয়াংশ)

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৫২

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

অনেক ভাল লাগল গল্পটা কিন্তু শেষের ব্যাখ্যাটুকু না হলেও চলত। পাঠকের ভেতর ভাবনার রেশ থেকে যেত।

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪২

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: ভালো কথা বলেছেন। তাহলে আপনার কথামতো ব্যাখ্যাটুকু বাদই রাখি। :) আসলে এই গল্পটা প্রথমে ফেসবুকে নোট আকারে দিয়েছিলাম তো, তখন এই অংশটা রাখতে হয়েছিল।

২| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৪

দয়ালু বলেছেন: দারুণ লিখেছেন :)

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪০

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: ধন্যবাদ :) :) :)

৩| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: ভাই কি কল্লেন দিহি বলেনতো....

এক্কেবারে ছেড়াবেরা অবস্থা!! মনটা হুহু কইরে উঠল..... :(( :((


দারুন! যেন আমিই হাসান হয়ে সব শেষ করে এলুম!!!!

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪০

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: |-) :-< :-/ :| :|| :( :(( :(( :(( :(( :((

৪| ০১ লা মে, ২০১৪ রাত ১২:১৪

এহসান সাবির বলেছেন: অনেক ভাল লাগল গল্পটা।

০১ লা মে, ২০১৪ দুপুর ২:০৯

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: হাসান মাহবুব বলেছেন: কষ্টের গল্প। এমন গল্পকে "ভালো লাগলো" বলা যায় কী না জানি না।

৫| ০১ লা মে, ২০১৪ রাত ২:২৮

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: সুন্দর গল্প।

০১ লা মে, ২০১৪ দুপুর ২:১২

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: ধন্যবাদ

৬| ০১ লা মে, ২০১৪ দুপুর ১:৫৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: কষ্টের গল্প। এমন গল্পকে "ভালো লাগলো" বলা যায় কী না জানি না।

০১ লা মে, ২০১৪ দুপুর ২:১৬

নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক বলেছেন: ভাবনার বিষয় বটে...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.