নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নির্বাসন এ একা

হাত, পা, মাথা থাকলেই মানুষ হওয়া যায় নাহ্রদয় ধ্বক ধ্বক করলেই বেচে থাকা হয় না

নির্বাসন এ একা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইদানীং সন্তান

০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ২:৪৮

ইদানীং সন্তান
- যাযাবর জীবন

সামনে ঈদ
ছেলে প্রতিবারই ফোনে জিজ্ঞাসা করে, বাবা তোমার জন্য কি পাঠাবো?
রফিক সাহেব প্রতিবারই ফোনে উত্তর দেন, কিছু লাগবে না বাবা।

আচ্ছা বাবা তাইলে রাখি, বলেই ছেলে ফোন রেখে দেয়।

রফিক সাহেব নিঃশ্চুপ হয়ে যাওয়া ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।

তারপর নার্গিস, এক কাপ চা বানিয়ে দে বলে ড্রইং রুমে এসে বসেন।

রফিক সাহেবের স্ত্রী লতিফা গত হয়েছেন তাও প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো। এখন বাসায় মানুষ বলতে কেয়ারটেকার মজিদ আর তার স্ত্রী নার্গিস। এদের নিয়েই রফিক সাহেবের ইদানীংকার পরিবার।

ছেলে রুবেলকে সেই যে লন্ডনে পড়তে পাঠিয়েছিলেন সেই থেকে ওখানেই রয়ে গেছে, লন্ডনি বাঙ্গালী মেয়ে বিয়ে করে। শেষবার দেশে এসেছিল তাও প্রায় পাঁচ বছর আগে, লতিফা বেঁচে থাকতে। মায়ের লাশ দেখতে আসার সময়ও পায় নি লায়েক ছেলে। এখন মাসে এক দু বার নিতান্ত দায়সারা ফোনে বাবার খবর নেয়, আর কি পাঠাবে জানতে চায়।

ছেলের ফোন এলে রফিক সাহেব মনে মনে প্রতিবারই বলেন, একবার দেশে আয় বাবা, তোকে দেখি মন ভরে, তোর ছেলে মেয়েদের একবার দেখি প্রাণ ভরে; কত দিন হয়ে গেছে দেখি না তোদের!

*************

মালেক সাহেবের বয়স প্রায় আশির কোঠায়। ওনার এক ছেলে এক মেয়ে, বকুল ও জুঁই। স্ত্রী ফিরোজা প্রায় পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এখন অনেকটা সুস্থ। বুড়ো বুড়ি সারাজীবন কঠিন সংযমের জীবন কাটিয়েছেন। মালেক সাহেব একটু বেশী মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন বলে আত্মীয় স্বজনের সাথে খুব বেশী একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে নি। স্ত্রী, ছেলে মেয়ে নিয়েই তার পুরো জগত সংসার। বিয়ের পর মেয়ে কানাডা প্রবাসী প্রায় বিশ বছর ধরে। মেয়ে স্বামী সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে এটা মালেক সাহেব মেনে নিয়েছিলেন। তবুও খুব কষ্ট হতো প্রথম প্রথম, তবে মেয়ের ঘরের নাতি নাতনিগুলোকে খুব মিস করতেন। ছেলে, ছেলে বৌ ছেলের ঘরের নাতনি নিয়ে মোটামুটি ভালোই কেটে যাচ্ছিল জীবন।

হঠাতই যেন বদলে গেলো তার জীবন। ছেলের মনেও একসময় বিদেশ পাড়ি জমানোর বাসনা উঁকি দিতে দিতে তা দুর্দমনীয় হয়ে উঠলো সময়ের সাথে সাথে। বোনের কাছে পাড়ি জমালো একমাত্র ছেলে একসময় বৌ বাচ্চা সহ। সেও প্রায় ছয় বছর হতে চলল। এখন মালেক সাহেব আর ওনার স্ত্রী ফিরোজা বেগম পুরো বাড়িতে একা, সময় কাটে তাঁদের ছেলে মেয়েদের এ্যালবাম দেখে আর তাদের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলে।

এই ছয় বছরে ছেলে এসে গেছে দু বার, গুনে গুনে এক একবার বিশ দিনের জন্য, আর মেয়ে দুবছর পর পর একবার তাও গুনে পনেরো কিংবা বিশ দিনের জন্য। ছুটির বড্ড অভাব তাদের? অভাব সময়ের। অথচ এদিকে বাবা মায়ের হাতে এখন সময়ই সময়, সারাদিনে একবেলার রান্নায় না হয় মিসেস ফিরোজার এক ঘণ্টাই ব্যয় হয়, আর বাকি সময়? শূন্য খাঁ খাঁ বাড়িময় ঘুরে বেড়ান একাকী, চোখের পানি ফেলে দিনভর, আর ভাবে এত পানি চোখে এলো কিভাবে? কখনো কখনো খুব বেশী মন খারাপ হলে মন'কে জিজ্ঞাস করে - হ্যাঁরে মন আমি ক্যান্সারকে বশ মানিয়ে ফেললাম অথচ তোকে বশ মানাতে পারলাম না কেন রে? সন্তানের মধ্যে এমন কি আছে রে?

ইদানীং মালেক সাহেব ও ফিরোজা বেগমের সময় কাটে অপেক্ষায়
অপেক্ষা সন্তানদের ফোনের
অপেক্ষা বছর দুবছরে একবার তাঁদের চোখের দেখার
কিংবা হয়তো অপেক্ষা মৃত্যুর।

************

বিধবা আয়েশা আমেনা, এক সময়ের ডাকসাইটে স্কুল শিক্ষক। বনানীতে ওনার ছয় তলা বিশাল বাড়ি, এখন সাড়ে তিন হাজার স্কোয়ারফিটের একটি ফ্লোরে উনি থাকেন, আর বাকি পাঁচ তালা ভাড়াটিয়া। স্বামী পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি ছিলেন, মারা গিয়েছেন প্রায় পনরো বছর হলো। দুই ছেলে তিন মেয়ের সবাই বিদেশের বাসিন্দা। তিনজন ইউরোপে আর দুজন আমেরিকায়। আগে বছরে দু বছরে ওরা কেও না কেও দেশে আসতো, গত তিন বছর ধরে কোন ছেলেমেয়ের মুখ দর্শন হয় নি। ওদের বাবা বেঁচে থাকতে ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল, সেই পাঠানোই কাল হয়েছে; একজন সন্তানের মধ্যেও দেশের জন্য কোন মায়া মমতা ভালোবাসার ছিটে ফোঁটা আয়েশা দেখেন নি, অথচ সারা জীবন ছাত্র ছাত্রীদের দেশ প্রেমের বুলি শিখিয়েছেন। আজ দূর সম্পর্কের এই ভাইয়ের বিধবা বৌ'টাকে নিজের কাছে এনে রেখে কথা বলার সঙ্গী করেছেন। যত না বিধবা ভাই বৌ এর প্রতি দরদে তার চেয়ে নিজের স্বার্থে। আজকাল ছেলে মেয়েরা মাসে দুই মাসে হয়তো ভুলে একবার ফোন করে মায়ের খোঁজ নেয়, আদতে জানতে চায় বুড়িটা এখনো বেঁচে আছে কি না? বুড়ি চোখ বন্ধ করলে'তো বাপের করা বাড়িটা বেঁচে দিয়ে ভাই বোনে মিলে টাকা ভাগাভাগি করে একবারে দেশের মাটির সাথে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেবে, এই আশাতেই হয়তো আছে তারা।

মায়ের বেঁচে থাকা আর না থাকায় তাদের কি আসে যায়?

*************

রফিক সাহেব, মালেক সাহেব ও ফিরোজা বেগম, আয়েশা আমেনা - এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। এদের মত হাজার হাজার পরিবার (কিংবা কে জানে হয়তো লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে এ সংখ্যাটি); প্রতিদিন প্রতিক্ষণ পথ চেয়ে থাকে সন্তান'কে দুচোখ ভরে দেখার, পথ চেয়ে থাকে সন্তানের ফিরে আসার, পথ চেয়ে থাকে তার উত্তরসূরিদের এক নজর দেখার। এ সকল সন্তান'রা হয়তো বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে কেও পেটের টানে, কেও বৈধ পথে আর বেশিরভাগ অবৈধ পথে। যারা অবৈধ উপায়ে বাইরে গিয়েছে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে পারছে না বাবা-মায়ের কাছে। আবার কেও উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসে নি বাবা-মা, কিংবা দেশের টানে।

শেকড় ছিল সবারই; এ দেশেই।
কারো শেকড় হয়তো এখনো অনেক গভীর শুধু পরিস্থিতির কারণে বাধা পড়ে আছে।
কারো শেকড় আলগা হয়ে গেছে, এই টুপ করে বাকিটুকু আলগা হলো বলে;
কারো কারো শেকড় একদমই মরে গেছে।

সন্তানদের শেকড় মরে যায়
বাবা মা পথ চায়;
আজকের সন্তান সেদিন হয়তো বুঝবে, যেদিন তাদের সন্তানও শেকড় ছিঁড়ে বের হয়ে পড়বে চাকচিক্যের হাতছানিতে, অন্যদেশে।

ইদানীংকার সন্তানরা বোঝে না, বাবা-মায়েদের এখন আর জাগতিক কোন উপহারের প্রয়োজন নেই, তাঁদের প্রয়োজন একটু সঙ্গ, সন্তানদের সঙ্গ, উত্তরসূরিদের সঙ্গ, তাঁদের ভালোবাসা তাঁদের কাছে থাকা।

আজকের এইসব বাবা-মায়েদের পথ চাওয়া শেষ হবে কবে?
আজকের এই সব পথচেয়ে থাকা বাবা-মায়ের চোখের জল মোছাবে কে?


**************************************************

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:২১

সুমন কর বলেছেন: বাস্তবতা বড্ড বেশী কঠিন !!! লেখায় তার বহিঃপ্রকাশ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.