নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রগতির পরিব্রাজক দল (প্রপদ)

চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!

প্রপদ

প্রপদ প্রগতির পরিব্রাজক দল এর সংক্ষিপ্ত নাম। প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৯৪ ইং কেন্দ্রীয় কার্যালয়ঃ ঢাকসু ভাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ প্রকৃত স্বাধীনতা ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

প্রপদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রক্তের অক্ষরে লেখা শহীদের নাম ভেসে গেছে ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১১:৩০

একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভূখণ্ডের জন্য এ জনপদের মানুষ বারবার অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। যুগে যুগে সামরিক-বেসামরিক ছদ্মবেশে স্বৈরাচারীরা ক্ষমতা দখল করেছে। জনগণ প্রতিবাদ করলে জুটেছে বেয়নেট, বুট, গুলি, টিয়ারশেল। এরকমই ১৪ মার্চ ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সামরিক আইন জারি করে সংবিধান ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করা, রাজনৈতিক নেতাদের ধড়পাকড় শুরু করা_এসব বিভিন্ন কারণে তাঁর এ ক্ষমতা দখলকে কোনো রাজনৈতিক দল শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে পারেনি। তবে ছাত্ররা প্রথম থেকেই এরশাদের শাসনক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রদের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রথম শহীদের নাম জয়নাল দিপালী কাঞ্চন। এরপর থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। পশ্চিম থেকে আগত ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে ভেসে গেছে রক্তের অক্ষরে লেখা, এ প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে সেই সব শহীদের নাম। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই রচনাটি লিখেছেন মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান তুহিন ও আজিজ হাসান



এরশাদের ক্ষমতা দখল

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের এভাবে ক্ষমতা দখলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে অনেকটাই নীরবে মিলিটারি স্বৈরশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নেননি এই সামরিক অভ্যুত্থান। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় ছিল আট বছর ২৫৬ দিন। এ সময় দেশের হাজার হাজার মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছে। হত্যা-গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশেষত ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে।



রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট

এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হন। কলাভবনে ২৪ মার্চ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া এই ছাত্রনেতারা হলেন শিবলী কাইয়ুম, হাবিব ও আ. আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাঁদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াইয়ের দিনগুলো।

বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদ বেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী চলে আসে, স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।

সরকারি ফরমান ও তৎপরতার কারণে সে সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের দেয়াল লিখন সমানে মুছতে থাকে সামরিক সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। পুলিশ যত দেয়াল সাদা চুন টেনে মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই দেয়াল লিখন চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলছিল দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রাথমিক প্রস্তুতি।

এ সময় ছাত্রনেতারা একটি সর্বাত্দক গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করা হয়। সেটাই ছিল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত প্রতিবাদ।



মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধে

পাকিস্তান পর্বে পূর্ববাংলার ছাত্রদের প্রধান দাবি ছিল একটি অবৈতনিক একই ধারার বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশের আপামর জনগণের উদ্দেশে ১১ দফা প্রণয়ন করেছিল। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরপরই তাঁর শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। শিক্ষানীতিতেও সে প্রতিফলন ঘটে। একই সঙ্গে শিক্ষার ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। ছাত্ররা এ শিক্ষানীতির ব্যাপক বিরোধিতা করেন। ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা দিবসে এই শিক্ষানীতি বাতিল করার পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলো একমত হয়।

১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গণসাক্ষরতা অভিযান চলে। ছাত্র সংগ্রামের নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। ছাত্রদের এই সংগ্রামকে প্রতিরোধ করতে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুককে গ্রেপ্তার করলে ছাত্ররা আরো ফুঁসে ওঠেন। তাঁর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এবার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি হাতে নেয়। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। কে জানত বসন্তের আগুনরাঙা রঙের সঙ্গে মিশে যাবে মানুষের রক্ত।



প্রতিরোধ-রক্ত আর ভালোবাসার ১৪ ফেব্রুয়ারি

ভালোবাসার রং কী? প্রশ্ন একটি, উত্তর ভিন্ন ভিন্ন। রক্তের স্রোত, বুট, টিয়ারশেল আর গুলির তীব্র ঝাঁজালো বারুদের গন্ধ এমন ভাবে ভালোবেসে সবাইকে ঋণী করে যাবে, তা মিছিলের কেউ বুঝতে পারেনি। সেদিন মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেনের বর্ণনা মতে, '১৪ ফেব্রুয়ারি আরো সুশৃঙ্খল, আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ছাত্ররা কর্মসূচিতে যোগ দেন। মিছিলের প্রথমে শতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। খুবই শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল, উৎসবের মতো অনেকটা। ব্যারিকেডের সামনে যখন মিছিল যায় হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল-সংলগ্ন এলাকায়, তখন মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন। নেতারা তারকাঁটার ওপর উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। মিছিলটি ছিল হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। কিন্তু কোনো উসকানি ছাড়াই তারকাঁটার একদিক কিছুটা সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররা তখন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। পুলিশ তখন ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। সেদিন জয়নালকে গুলিবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। বেয়নেট ফলা আর জয়নালের শরীর থেকে চুইয়েপড়া রক্ত বাংলার পথ-প্রান্তর ভাসিয়ে দেয়। শুধু জয়নাল নয়, ছাত্রদের ওপর পুলিশি তাণ্ডবের সময় শিশু একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তবে দিপালীর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জয়নাল পড়েছিলেন কার্জন হলের মধ্যে। তাঁকে ধরে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যেসব ছাত্র সকালে মিছিলে আসেননি, তাঁরা বিকেলে জয়নালের জানাজায় বটতলায় উপস্থিত হন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষও উপস্থিত হয়। তাৎকালীন অনেক জাতীয় নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।'

পুলিশ সেদিন শুধু হত্যা করেই স্থির থাকেনি, বিকেলে ক্যাম্পাসে একটি যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করে সেনাবাহিনী। তার সঙ্গে যোগ দেয় বিডিআর-পুলিশ। শাহবাগ, টিএসসি চত্বর, কলাভবনের সামনে, নীলক্ষেত, কাঁটাবনের রাস্তা ধরে পুরো অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলে তারা। অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় বহু ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মেরে হাত-পা ভেঙে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। কলাভবনের ভেতরে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক যাঁকে পেয়েছে তাঁকেই নির্যাতন করেছে। ওখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খ ম জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে। ওই বিভীষিকাময় দিনের বর্ণনা করেছেন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেন, 'আমরা জয়নালের লাশ লুকিয়ে ফেলেছিলাম মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে। লাশের খোঁজে পুলিশ চারুকলায় ঢুকে ছাত্রদের নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করে। পুলিশ খুঁজে খুঁজে পোশাকে রঙিন গরম পানির চিহ্ন দেখে দেখে গ্রেপ্তার করে। অবশেষে মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে লাশ পাওয়া গেলে অন্যান্য হলে লাশের তল্লাশি বন্ধ করা হয়।' কিন্তু গ্রেপ্তার করে দুই সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে। সরকারি হিসাব মতে এক হাজার ৩৩১ জন। সবাইকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। এরপর তাঁদের তুলে দেওয়া হয় আর্মির হাতে। বন্দি ছাত্র-জনতার ওপর চলে প্রথমে পুলিশ ও পরে আর্মির নিষ্ঠুর নির্যাতন। মেয়েদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রবল চাপের কারণে তাঁদের ১৫-১৬ তারিখের মধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

আন্দোলনের দুই যুগ পার হতে না-হতেই জনগণের কাছে বিস্মৃতি হতে চলেছে জয়নাল-দিপালীদের নাম। আমি তুমি টাইপের ব্যক্তির ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার-প্রতিরোধ দিবস। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দিনটিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ স্বৈরাচার-প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করে আসছিল। নব্বই-পরবর্তী মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল জোয়ারে দিন পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। রক্তের অক্ষরে যাঁরা আমাদের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন, তাঁদের জন্য অবহেলা ছাড়া আমরা কিছুই দিতে পারিনি।







মোস্তাক হোসেন

১৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলনে কারা নির্যাতিত ছাত্রনেতা




১৫ তারিখে কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ট্রাকভরে ছাত্ররা শহরে এসে মিছিল করে। মিছিলে গুলি হয় এবং এ সময় কাঞ্চন মারা যান। ১৪ তারিখ আমরা শুধু জয়নালের লাশ পাই। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি। আরো অনেকে নিখোঁজ হয়। তাদের জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থায়ই পাওয়া যায়নি। জয়নালের বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার দোলাইপাড়ে।

ভালোবাসা দিবসে এ রকম একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তা এ প্রজন্মকে স্মরণ করাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ইতিহাসে অনেক ঘটনা আছে, তার পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে গেলেও তার পরবর্তী প্রজন্ম আবার খুঁজে বের করে নিয়ে এসেছে। হয়তো বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ বা মানুষ অনেক সময় চেতনা হারিয়ে ফেলে, তখন তার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে স্মরণ করে না। কিন্তু ইতিহাস হারিয়ে যায় না_তা প্রজ্বলিত অগি্নশিখার মতো মানুষের সামনে উপস্থিত হয়। দেখায় এগিয়ে চলার গতিপথ।

১৪ ফেব্রুয়ারির এ রক্তদানের ইতিহাস আমি প্রতিবছরই হৃদয়ের গভীর থেকে অনুভব করি। এদিন প্রচণ্ডভাবে ব্যথিত হয়ে উঠি। কারণ, এ মহান আন্দোলনের দিনটিকে আমরা পুঁজিবাদের উৎসবে পরিণত করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশে ভ্যালেন্টাইনস ডের এ উৎসব অত্যন্ত দুঃখজনক। যেখানে নিরন্ন মানুষের হাহাকার, সব ঋতু, সব মুহূর্তেই আমাদের দেশের মানুষ নিরন্ন থাকে, দুর্ভাগ্যপীড়িত থাকে, শীতের কাপড় থাকে না মানুষের_সেখানে আমরা ভালোবাসার দিবস উদ্যাপন করি। এ দিনটিতে তাদের স্মরণ না করে সে জায়গায় ভালোবাসা দিবসের একটি বা একাধিক অনুষ্ঠান নিয়ে আসা আমার কাছে খুব দুর্ভাগ্যজনক ও কলঙ্কজনক বলে মনে হয়।



শিবলী কাউয়ুম

সামরিক আদালতে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাবেক ছাত্রনেতা




এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই ১৭টি অধ্যাদেশ প্রবর্তন করেন, যা এমএলএম নামে পরিচিত। তখন আমি বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরশাদের প্রথম দিনেই আমরা তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। এরপর পোস্টারিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হই। আমাদের তিন জনের সাত বছর করে কারাদণ্ড হয়। আমি জেলে থাকা অবস্থায় মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হয়। এতে শিশু বয়স থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আমি জেলে থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘটে ছাত্রদের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ। একাত্তরের পরে এর চেয়ে বড় আন্দোলন আর কোনোটাই নয়। হাজার হাজার ছাত্র এ আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলন দমনে সরকারি বাহিনী যে নির্যাতন করে, তা ভয়াবহ। আমি তখন রংপুর জেলে। বাইরে মিছিলের স্লোগান শুনতে পাই। কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে আনা হয়। আমার সামনে জেলের মধ্যে দুটি ছেলের মাথায় আঘাত করে মগজ বের করে দেয় পুলিশ। এভাবে অসংখ্য মানুষ প্রাণ দেয় এ আন্দোলনে। তবে আন্দোলনটি সফল হয়। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায়। ছাত্রবন্দিদের মুক্তি_আমরা তিনজন মুক্তি পাই। সামরিকতন্ত্রের অবসান না হলেও ঘরোয়া রাজনীতির অধিকার দিতে বাধ্য হয় সামরিক জান্তা।



জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় ছাত্রদলের ছাত্ররা নানা অপকর্মের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন করে, তা থেকে ছাত্রসমাজকে মুক্ত করে ১৪ ফেব্রুয়ারির এই ছাত্র আন্দোলন। একটি মহল অনেক কায়দা-কৌশল করে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় এ ইতিহাসকে ঢেকে দেওয়ার জন্য পশ্চিমা সংস্কৃতির ভ্যালেন্টাইনস ডেকে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিক চেতনাহীন করাই এর মূল অভিপ্রায়।



অরুণ কুমার দে

শহীদ মধুসূদন দের পুত্র, মধুর ক্যান্টিন




সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৪ তারিখ সকাল ১১টার দিকে কলাভবনের সামনে ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থীর সমাবেশ হয়। এরপর ছাত্ররা মিছিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে যান। হাইকোর্টের গেটে সংঘর্ষ হয়। বিকেল ৫টার দিকে দরজা ভেঙে পুলিশ মধুতে ঢুকে রান্নাঘরে গিয়ে কর্মচারীদের নির্মমভাবে পেটায়। আমি পূজার ঘরে লুকিয়েছিলাম। একপর্যায়ে আমাকে ধরে টানতে টানতে আমগাছের সামনে নিয়ে যায়। ওখানে দাঁড়ানো এক পুলিশ অফিসার আমাকে দেখে বলে, তোকেই তো খুঁজছিলাম। এরপর লাঠির বাড়ি, বুটের আঘাত একের পর এক পড়তে থাকে শরীরে। ওরা আমাকে পুলিশভ্যানে করে নিয়ে যায় শাহবাগের কন্ট্রোল রুমে। কন্ট্রোল রুমের মাঠে নিয়ে সবাইকে আবার মারে। এরপর গরম লবণ-পানি খেতে দেয়, যাতে আমাদের শরীর ফুলে না যায়। কিছুক্ষণ পর আর্মির লোক এসে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়। ওই রাতেই সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমাদের ধরে নিয়ে যায় আর্মি। সকালে রুটির ট্রাক আসে। আমি বন্দি ছাত্রদের রুটি ভাগ করে দিতে যাই। তাতেও ক্ষিপ্ত হয় সেনারা। তারা আবার আমাকে পেটায়। সন্ধ্যায় একটা গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যায় ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে চলে আবারও নির্যাতন। এ সময় ছাত্রদের মাথা ধরে দেয়ালে আঘাত করে সেনা কর্মকর্তারা। এ মার খাওয়ায় আমার ডান হাত অবশ হয়ে যায়। চিরদিনের জন্য আমার ডান হাতের আঙুল হয়ে যায় বাঁকা_যে অভিশাপ আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।



খন্দকার সাখাওয়াত আলী

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকারী

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিদিনের অ্যালবামের সংকলক




'৮৩ সালের একটি আবেগঘন পরিবেশে ঢুকে যাই, ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের কথা মনে করলে একটি বিশেষ সময় আমাদের সামনে চলে আসে। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। রাজনৈতিক সংগঠন করি না। কিন্তু রাজনীতিসচেতন। ঢাকার দিপালী সাহা, জয়নালসহ অনেকে মারা যান। স্বৈরাচারবিরোধী এটিই প্রথম ব্যাপকতর বিদ্রোহ। এর আগে এত বড় বিদ্রোহ আর হয়নি। এর বাঁধভাঙার ঢেউ লাগে চট্টগ্রামে। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাকে করে চলে আসি শহরে। মেডিক্যাল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা এলে মিছিল করি। মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ ও ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ করে।

এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। ১৪ ফেব্রুয়ারির এ আন্দোলন আমাদের জেনারেশনের কাছে একটি আলোকবর্তিকার মতো কাজ করে। একজন সমাজতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে, একজন রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি হিসেবে আমি চেয়েছি এ আন্দোলনের ইতিহাস ধরে রাখতে। কারণ, ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লোকজন ক্ষমতালয়কে কেন্দ্র করে ইতিহাসের বিকৃত রূপায়ণ করে। তাই আমি সত্য বিষয়কে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে সে আন্দোলনের অ্যালবাম তৈরি করি। এ অ্যালবামটি সেই কালকে স্মরণ করিয়ে দেয়।







১৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারের পর সরকারি প্রেসনোট


মোট গ্রেপ্তারকৃত ছাত্র এক হাজার ৩৩১ জন।

১৭ ফেব্রুয়ারি ছেড়ে দেয় এক হাজার ২১ জনকে এবং আটক রাখে ৩১০ জনকে।

১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে সরকার।

ছাত্রদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় পুলিশ ১৩, ১৪, ১৫, ১৭ ধারায় মামলা করে। মামলা নং ৪৭, তারিখ ১৪-০২-১৯৮৩।

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারকৃত জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা_

শেখ হাসিনা, ড. কামাল হোসেন, আব্দুস সামাদ আজাদ, আবদুল মান্নান, বেগম মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, সরদার আমজাদ হোসেন, আমির হোসেন আমু, আব্দুস সামাদ, হাশিমুদ্দিন হায়দার, কামাল হায়দার, কাজী আসাদুজ্জামান, জনাব শফিকুল, সাহারা খাতুন, আজিজুল ইসলাম খান ও আ খ ম জাহাঙ্গীর।



(দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.